মধ্যবিত্ত
আজকাল ‘মধ্যবিত্ত’
শব্দটার ওপর প্রচণ্ড
মেজাজ খারাপ হয়
শ্রাবণীর।শব্দটার
ভারে হাঁটা মুশকিল।
ইতিউতি তাকিয়ে হাঁটতে
হয় ওকে। চোখে মেখে
রাখতে হয় সামাজিক
সেন্টিমেন্ট। সবকিছু
করার পেছনে একটা লেবেল
টেনে দিতে হয়। ওর
লুনাকে দেখে গা জ্বলে
যায়।লুনা শ্রাবণীর
ভাইয়ের ক্লাসমেট। গাড়ি
হাকিয়ে চলে।সিগ্রেট
ওয়িথ একপেগ দুইপেগ গিলে
প্রায়ই.. মফস্বল শহরের
রাস্তায় দাঁড়িয়ে তার
সার্কেলের সাথে দিব্যি
আড্ডা মেরে যায়
রাতদুপুর পর্যন্ত।
ঝুুম বৃষ্টিতে লুনা আজ
গাড়ি থেকে নেমে বর্ষা
মাখছে।ওদিকে
শ্রাবণীদের ইয়ং
বুয়াটাও হু কেয়ার্স ভাব
নিয়ে এখানে সেখানে চলে
যায় ।শ্রাবণী ভাবে এ
সমাজে উচ্চবিত্ত আর
হতদরিদ্ররা জনরোষের
কবলে পড়েনা । ভাবতে
ভাবতে শ্রাবণীর ভেতর
বাহির সেই কখন থেকে
ভিজছে খোলা বাসস্টপেজে
দাঁড়িয়ে।ভেজা কাপড়
শরীর নিয়েই বাসে চড়ে
শ্রাবণী।কত মানুষ
বাসের ভেতর,
রাস্তায়..তবুও কোথাও
কেউ নেই যেনো।কেউ নেই
যেনো বলার, ও শ্রাবণী
অতো ভিজোনা ঠাণ্ডা
লাগবে, জ্বর অাসবে...আজ
অফিস না করলো
হতোনা....!!চলন্ত বাসের
সাথে তার মন দৌঁড়ায়
একটা হাতে হাত রেখে
দূরে কোথাও, দূরে কাশের
বনে অথবা সবুজ
দিগন্তজোড়া মাঠে । বাস
সিগনালে ব্রেক কষতেই
শ্রাবণীর চপচপে ভেজা
শরীর কাঁপে চপচপে
জুবুথুবু ভেজা মহিলা
সিটে বসে ...বাসের
লুকিংগ্লাসে পেছনে
ফেলে আসে অভিজাত বন্ধুর
বিলাসবহুল
অট্টালিকা,বড়চাচার
পাজেরো, বন্ধু তৃণার
মায়ের শখের বুটিকসশপ
........!
ট্রমা
নিশির কদিন ধ'রে ঘুম
হচ্ছেনা।কোথায় যেনো
পড়েছে লাইনগুলো
নিশি।" সারভাইভাল অফ
দি ফিটেষ্ট" এই সাধারণ
সত্যটি দার্শনিকের
মানব জীবনের কণ্ঠে যখন
পৃথিবীতে প্রথম ঘোষিত
হলো,সেদিন থেকে পৃথিবীর
সর্বনাশের
সূত্রপাত।মানব জীবনের
সেই শ্রেষ্ঠ সম্পদ
ধ্যান-কল্পনা,প্রেম-সৌন
্দর্য্যের কদর কমতে
লাগলো।ধ্বংস -সৃষ্টি-
ধ্বংস নিয়ে মেতেছে তাবদ
দুনিয়া...এসব বিক্ষিপ্ত
ভাবনা নিশিকে আজকাল
পেয়ে বসেছে। এরোগ তার
ছিলনা কখনোই! এর মধ্যে
গতকাল রাতে একদমই
দুচোখের পাতায় ঘুম
লাগেনি ওর।নিশির বিয়ে
হয়েছে সাত বছর।পছন্দের
বিয়ে। বর রাসেল এর
মধ্যে বদলি নিয়ে
বগুড়ায়। সরকারি
চাকুরে।সে বদলিটা
খুলনাতে করার জন্য
তদবিরে আছে।ওখানেই
ডরমিটরিতে থাকে রাসেল।
পাঁচ বছরের মেয়ে
টুলটুলকে নিয়ে নিশি
খুলনা নিজেদের
ফ্ল্যাটে থাকে।কাছেই
দু'বিল্ডিং পরে নিশির
মায়ের বাসা। একটা
প্রাইভেট জব করার কারণে
দিনের বেশিরভাগ সময়
টুলটলকে তার দিদার কাছে
থাকতে হয়।
ভালোবাসা আর ভালো - বাসা
নিয়ে নিশির যাপন ভালোই
চলছিলো বলা চলে। বর আসে
সপ্তাহান্তে। ছুটি
হলেই স্ত্রী কন্যার
কাছে উপস্থিত রাসেল।
নতুন করে পাওয়ার মতো
প্রতিটা ক্ষণ তারা
উপভোগ করে।
এর মধ্যে বিশ্বজুড়ে
অণুজীবের আগমন ও
সংক্রমণ নিশিকে
বিপর্যস্ত বিপন্ন করে
তুলেছে।
কোয়ারান্টাইনে আছে
নিশি টুলটুলকে
নিয়ে।বগুড়া লকডাউন। ওর
বা রাসেলের বা ওদের
টুলটুলের কারো যদি
করোনায় পেয়ে বসে তবে কী
হবে!!!ভাবতে ভাবতে
নিশিকে করোনাট্রমায়
পেয়ে বসে। ওর যদি করোনা
হয় তবে রাসেল কী তাকে
একবারও ছোঁবেনা! ওর
ঠোঁটে ঠোঁট ঘষে তুমুল
চুমুতে চুমুতে আর
অস্থির করে তুলবেনা!
মরে গেলে একবার হাতটাও
ছুঁয়ে দেখবেনা!
ফেইসবুকে দেখেছে
ক্রেইন দিয়ে লাশ দাফন
করা হয়। আহা এমন মরা
মরবো ভাবতে ভাবতে
ঘুমিয়ে পড়ে সেদিন
নিশি।গভীর ঘুমে দেখে
ধুতুরাফুলের মতো
করোনাগুলো তার মাস্কের
চারপাশ পলিব্যাগের
হাতলে ছিটকিনি ডোরলক
জানলার কার্নিস
ভ্যানেটি ব্যাগসহ ঘরময়
ঘোরাঘুরি করছে
করোনা।নিশি নিশ্বাস
নিতে পারছেনা।তবে কী
মাস্কের ফাঁক গলে ঢুকে
গেলো করোনা! গলাটা
প্রচণ্ড ব্যথা করছে।
ঢোক গিলতে কষ্ট হচ্ছে।
টুলটুল কোথায় ? ওকে কে
নিয়ে গেল? মা? জানলার
গ্লাসের বাইরে রাসেল
দাঁড়িয়ে কেনো? ও একবার,
একটিবারও ভেতরে আসবে
না! যে কীনা আমার ঠাণ্ডা
লাগলে ব্যাতিব্যস্ত
হয়ে পড়ে! এখন ও ইশারায় কী
বলতে চাচ্ছে জানলার
গ্লাসের বাইরে থেকে !
আমার ফুসফুস আর
চলেছেনা!উফ শ্বাস নিতে
কষ্ট হচ্ছে.. আমাকে
ক্রেণ দিয়ে কোথায়
নামাচ্ছে? আমি বেঁচে
আছি তো! একটু অক্সিজেন
দিলেই আমি বেঁচে উঠবো...
প্লিজ কেউ সুরক্ষিত হয়ে
আমার কাছে একটু আসুন
আমার দুটো কথা শুনুন...
প্লিজজ..!
লাল টিপ
আজ সকালবেলা একটা তাজা
স্বপ্ন দেখে নীতার ঘুম
ভাঙল।পূর্ব স্মৃতি ঠিক
যেন ঘিরে ছিল ভোর হবার
পরও ।স্মৃতি মনে
হলোনা, যেন সত্যি হয়ে
ফিরে এসেছিল
নির্বান।সকালবেলা
ফুরফুরে মন নিয়ে নিতা
তার কর্মক্ষেত্রে
প্রবেশ করতেই সহকর্মী
সায়মা বলে উঠলো ‘কী
ব্যাপার ম্যাডাম নতুন
খবরটা জানালেনও না যে
।কদিন ধরে দেখছি
কালারফুল সাজে থাকছেন
!নীতা ঠিক বুঝতে পারলনা
প্রথমে একটু থতমত খেয়ে
ধাতস্হ হতে কিছুটা সময়
লেগে গেল নিতার।জানবেন
নিশ্চয়ই ম্লান হেসে
নিতা জানালো সায়মাকে
।তাঁতের শাড়ি আর লাল
টিপ পরিহিতা নিতাকে বেশ
ঝলমলে লাগছিল আজ। আর
তার এ সৌন্দর্যই
সহকর্মীর চোখে বাধ সাধল
।এগারমাস হতে চললো
নিতার বর নির্বান না
ফেরার দেশে।এর পর থেকেই
মানসিকভাবে বিপর্যস্ত
নিতার জীবন –যাপন
ক্যামন ফ্যাকাসে হয়ে
উঠেছে ।সবকিছুই বিবর্ণ
যেন ।এ কোন প্রথা মানা
নয় ।সব কিছু ওলট-পালট
হয়ে গ্যাছে নীতার জীবনে
শূন্যতার কারণে ।হবেই
না কেনো !নির্বান তো
শুধু দাম্প্যতের
অংশীদার ছিলনা ।ছিল
পিতা-মাতার আদলে অনন্য
একজন মানুষ,বন্ধু পরম
নির্ভরতা
।ইন্টারমিডিয়েট পড়ার
সময় নিতার বিয়ে হয়।তার
বর তাকে স্নাতকোত্তর
কমপ্লিট করিয়েছে
।স্বনির্ভর আর
স্বাধীনতা যাকে বলে তার
সবটুকুই বন্দোবস্তর
পেছনে বর বন্ধুটির ছিল
অগাধ প্রেরণা ।বই পড়া
নাটক দেখা গানশোনা থেকে
শুরু করে সাহিত্যের সব
শাখায় ছিল ওদের তুমুল
আড্ডা ।নিতা আর নির্বান
দম্পত্তি তাদের এলাকায়
বেশ পরিচিত ।কারও কাছে
প্রগতিশীল হিসেবে কারও
কাছে সমালোচনার পাত্র
হিসেবে ।দুজনে অন্যদের
চেয়ে আলাদা ।আসলে আলাদা
করেছে তাদের
দৃষ্টিভঙ্গী
।কুসংস্কার,মানুষের
তৈরি প্রচলিত
ধ্যান-ধারণার তারা
কখনোই আমল দেয়নি
।সহকর্মী সায়মার এমনতর
অনধিকার চর্চায় নিতার
মেজাজ খারাপ হয়নি
কিছুটা বিরক্ত হয়েছে
মনে মনে ।বরং তাদের
জন্য আমাদের সমাজের
বঞ্চিত মেয়ে
মানুষগুলোর জন্য
করুণা হয়েছে ।শুধু
দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য
একটামাত্র জীবন এরা
যাপন না করে টেনে নিয়ে
যায় মানুষেরই চাপানো
প্রথার ভেতর। বারবাহী
গাধা হয়ে কাটিয়ে দেয়
পুরো জীবন ।
বিধবা নারী লালটিপ কেন
দিবে ! কেনো পরবে ঝলমলে
শাড়ি !আর এজন্যই তার
সমবয়সী সহকর্মী
বিভ্রান্ত করে বসলো !
তার দিকে চোখ পড়বে কেন
অন্য চোখের !বিধবা মানে
স্বামিটির মৃত্যুর
সাথে সাথে তার
স্ত্রীটিও জীবিত মৃত
জীবন-যাপন করবে ।এই
দৃষ্টিভঙ্গীর কারণেই
মৌনশাসন শাসিয়ে গেল তার
সহকর্মীটি ।
নিতার অফিস ছুটির পর আজ
বাসায় না গিয়ে ট্যাক্সী
নিয়ে সোজা নেভাল বিচে
চলে এল একদম একা
।ভেবেছিল বন্ধুদের
ডেকে নিয়ে একটা জম্পেস
আড্ডা দেবে ।পরক্ষণে
তার একাই সময় কাটাতে
ইচ্ছে হলো ।কিছু বাতিক
আছে নিতার ।হুট করে একা
রেস্ট্রুরেন্টে খেতে
চলে যাওয়া একা রিক্সায়
ঘুরে বেড়ানো ছাদে ওঠে
একলা আকাশ দেখা একার
মাঝে অনেক কিছুকে ঘিরে
থাকা ।আবার অনেকের মাঝে
বসে থেকেও একবারে
একেলঅ হয়ে যাওয়া !
কী সুন্দর আকাশ তুলোর
মত শাদা মেঘের ফাঁকে
ফাঁকে ‘আশ্চর্য মেঘদল’
।সুন্দর কিছু দেখলে
নিতার চোখে ভালো লাগায়
জল চলে আসে ।সেটা
প্রিয়কোন গান হতে পারে
প্রিয় কোন কবিতা এমন কী
বাঙলাছবির আবেগপ্রবণ
কোন সংলাপও হতে পারে
।হতে পারে কারো সুবচন
ভালোবাসার
প্রকাশ!নেভাল বীচটা
অনেক পছন্দের নীতার
।সমুদ্র আর নদীর মোহনার
পাশেই বীচ । এখানটায়
আসলেই নিতার মন ভালো
হয়ে যায় ....আজ নিতার মন
ভালো নেই ...মানুষের
সীমাবদ্ধতায় মানুষ
নিজেই নিচে নামে আবার
অপরকেও কতটা
অসহযোগিতামূলক আচরন
করে ।কতটা এলমেলো করে
দেয় চলার পথ । ভাবতে
ভাবতে চোখ ঝপসা হয়ে আসে
নিতার ...