ব্যাপারটা শুরু হয়
এইভাবে। কিংবা ঠিক
এইভাবে হয়তো শুরু হয়ও
না, কারণ ব্যাপার
কীভাবে শুরু হয় তা কেউ
বলতে পারে না, উপরন্তু
যে-বুধবারের সকালে
বাণেশ্বর কানে ইয়ারফোন
গুঁজে নিজের এক-কামরার
ভাড়ার ঘরটিতে
ঘুমোচ্ছিল, এবং তার
মোবাইলের সঙ্গে
সংযুক্ত ইয়ারফোনটিতে
বেজে যাচ্ছিল ‘মেরা
জীবন কোরা কাগজ কোরা হি
র্যাহ গ্যায়া’, রাত্রে
তার ঘুমিয়ে পড়ার সময়
থেকে, সময়হীন লুপ-এ, সেই
বুধবারের সকালে, বিধুর
এবং বিভোর বুধবারের সেই
সকালে, ঠিক সাতটার সময়
বাণেশ্বরের ঘরের কলিং
বেল বেজে উঠলে বাণেশ্বর
ধড়মড় ক’রে বিছানায়
উঠে বসে, যেন
পাগলাঘণ্টি শুনেছে সে,
এবং যা বোঝার বুঝে যায়,
অর্থাৎ কিছুই বোঝে না।
কিংবা হয়তো বোঝেও,
অন্তত অনুমান করতে
পারে, কেননা
অনুমানক্ষমতা তার এখনও
সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে
যায়নি, এবং বিগত দু’ মাস
যাবত, অথবা তিন মাসও
হ’তে পারে—বাণেশ্বর
কখনওই সবকিছু মনে রাখতে
পারে না ঠিকঠাক, প্রতি
বুধবার ঠিক সকাল সাতটার
সময় এইভাবেই
পাগলাঘণ্টির আলোড়নে
সে জেগে উঠেছে, যদিচ
একথাও প্রসঙ্গত বলা
বাহুল্য যে, অনুমান এবং
বোধ এক জিনিস নয়, বোধ,
মানে সেন্স আরকি, কোনও
এক বইয়ে পড়েছিল
বাণেশ্বর, কলেজজীবনে,
শৈশবে দেখা কালীপুজোয়
পাঁঠাবলির দৃশ্যের
স্মৃতির মতো তা সে মনে
করতে পারে, হলো “a faculty by which
the body perceives an external stimulus; one of the
faculties of sight, smell, hearing, taste, and touch.”
যাই হোক, এই বুধবারে
কলিং বেলের আওয়াজে ঘুম
থেকে উঠে বিছানায় ব’সেই
আড়মোড়া ভাঙে
বাণেশ্বর, তারপর কান
থেকে ইয়ারফোন খুলে,
নির্মদ মাতালের মতো
স্খলিত পদক্ষেপে হেঁটে
গিয়ে দরজা খোলে। খুলে
কাউকেই দেখতে পায় না,
পাবে না সে জানত, শুধু
চৌকাঠের সামনে প’ড়ে
থাকতে থাকতে দ্যাখে
সেলোটেপ দিয়ে সিল করা
একটি একহারা
কার্ডবোর্ডের বাক্স।
সে বাক্সটি তুলে নেয়,
এবং পূর্ববৎ নির্মদ
মাতালের মতো হেঁটে এসে
বিছানায় বাবু হয়ে বসে।
বাক্সটি হাতে নিয়ে
কিছুক্ষণ চুপচাপ সে
স্থির হয়ে থাকে, ভাবে,
‘আজ তবে কী?’ কিন্তু
কিছুই সে ভেবে পায় না,
এবং বিছানার পাশের
টেবিলটি থেকে খাপখোলা
ব্লেডটি তুলে নেয়।
বিছানার পাশের টেবিলেই
এভাবে একটি নিরাবরণ
ব্লেড কেন প’ড়ে থাকে
বাণেশ্বরের ঘরে, তা এই
কাহিনির কথক জানে না,
কারণ সবকিছু সে জানতে
পারে না, সে শুধু দেখতে
পায় বাণেশ্বরকে, যে
কিনা ততক্ষণে ব্লেডটি
দিয়ে বাক্সের
সেলোটেপের বাঁধনগুলি
ছিন্ন করতে শুরু করেছে।
সবক’টি সেলোটেপ কাটা
হয়ে গেলে ধীরে ধীরে
বাক্সের ঢাকনাটা সে
খোলে। দেখতে পায়, ভেতরে
মণিবন্ধ থেকে ছিন্ন
একটি রক্তমাখা ডান
হাতের পাঞ্জা রাখা
রয়েছে। বাক্সের ভিতরে
স্থিত কাটা হাতটির দিকে
কিছুক্ষণ সে চুপচাপ
তাকিয়ে থাকে, যেন নদীর
অগম্য অন্যপারে
সূর্যকে অস্ত যেতে
দেখছে, তারপর সদ্যোজাত
শিশুকে কোলে নেওয়ার
মমতায় হাতটি তুলে নিয়ে
নেড়েচেড়ে দ্যাখে।
কর্তিত কব্জির কাছে
এখনও রক্ত লেগে রয়েছে,
তাজা রক্ত। হাতটির
আঙুলগুলো সরু, লম্বা,
অঙ্গুলিসীমায় লম্বা নখ,
তাতে রুপোলি নেলপালিশ।
বুড়ো আঙুলের একটু নিচে
একটি কালো তিল, যে তিল
বাণেশ্বর চেনে, মানে
চিনত, নিজের দু’ হাতের
মধ্যে এককালে
তখনও-অকর্তিত হাতটি
ধ’রে রেখে যে-তিলের
ওপরে আঙুল বোলাতে
বোলাতে, না, শক্তি
চট্টোপাধ্যায়কে
ভাঙিয়ে ‘হাতের পরে তিল
তো তোমার আছে’ সে বলেনি,
বরং বলেছিল, “জানো, তিল
আসলে জমাট বাঁধা
মেলানোসাইট, স্কিনের
এপিডার্মিসে এগুলো
থাকে” এবং শরণ্যা
ততক্ষণাৎ নিজের হাত
ছাড়িয়ে নিয়ে
দুর্দমনীয় কটাক্ষ ক’রে
বলেছিল, “এসব তোমার
স্টুডেন্টদের বুঝিও।”
‘হুম’, এসব কথা মনে
পড়তে ভাবে বাণেশ্বর,
‘হাতটা তবে শরণ্যারই?’
কিংবা সত্যিই কি সে তা
ভাবে, কেন ভাববে, এমন তিল
তো হাজারটা
মেয়েমানুষের হাতে
থাকতে পারে, তবে গড়ন
দেখে বোঝা যায়, মানে
বাণেশ্বর বুঝতে পারে,
হাতটা নিশ্চিতভাবেই
কোনও স্ত্রীলোকের।
অতএব আর কিছু না ভেবে
হাতটির আঙুলগুলো সে
নিজের গালে বোলাতে
থাকে, এবং তার মনে পড়ে,
“লগকে গলে সে ফিরভি মচল
না সকুঁ ম্যায়, ইয়ে দেখো
মেরে বন্ধে হাত”। কিশোর
কুমার, ইনেভিটবলি,
আর.ডি-র সুর, মজরুহ
সুলতানপুরির লেখা,
‘বন্ধে হাত’ সিনেমার
টাইটেল ট্র্যাক।
নাইটিন সেভেনটি থ্রি
কি? হবে হয়তো। ‘আচ্ছা’,
হঠাৎ মনে হয়
বাণেশ্বরের, ‘গানটার
একটা বাংলা ভার্সন আছে
না?’ সে ভাবতে ভাবতে
দেওয়ালে ঝোলানো
প্লাস্টিকের জবার
মালা-সজ্জিত কিশোর
কুমারের ছবির ফ্রেমটার
দিকে তাকিয়ে থাকে।
কিন্তু কিছু তার মনে
পড়ে না। ফলত কাটা
হাতটা সে পুনরায়
বাক্সের মধ্যে ভ’রে
রেখে দেয়। তারপর
বাক্সের ঢাকনা বন্ধ
ক’রে হেঁটে গিয়ে ছোট্ট
ডাইনিং স্পেসটায় রাখা
ফ্রিজটার দরজা খুলে
একটা তাকের এক পাশে
বাক্সটাকে রেখে দেয়,
যে-ফ্রিজের সবক’টা তাক
মিলিয়ে কার্ডবোর্ডের
এরকম আরও বারোটি বাক্স
রাখা রয়েছে। অর্থাৎ
বোঝা যায়, কাহিনির
সূচনায় যে বলা হয়েছিল,
‘ব্যাপারটা এইভাবে
শুরু হয়’ তা আসলে
মিথ্যে, ব্যাপার আরও
অনেক আগেই শুরু হয়েছে,
এবং পর্যায়ক্রমে চলছে।
এই প্রক্রিয়ায়
কাহিনি-কথকের
অনির্ভরযোগ্যতা
পুনঃপ্রমাণিত হ’লেও
বাণেশ্বর সেদিকে
তাকিয়েও দ্যাখে না, সে
বরং স্কুলে যাওয়ার জন্য
রেডি হ’তে থাকে।
রাস্তায় বেরিয়ে
বাণেশ্বর অবাক হয়ে গিয়ে
দ্যাখে, মসমস শব্দে
হাওয়ায় উড়ে চলেছে
মিহিন বৃষ্টি। ‘আরে!’,
ভাবে বাণেশ্বর, ‘বৃষ্টি
কখন নামল? বুঝতে পারিনি
তো!’ আসলে, বিগত দু’ মাস,
কিংবা তিন মাসও হ’তে
পারে, প্রতি বুধবার ওই
দরজার সামনে
কার্ডবোর্ডের বাক্স
আসার সময় থেকেই, ঘরের
সমস্ত দরজা-জানলা
বহির্জগতের মুখের ওপরে
সপাটে বন্ধ ক’রে দিয়েছে
বাণেশ্বর, আর কখনও
খোলেনি, ফলত বাইরের
রোদ-বৃষ্টি ঘরের ভেতর
থেকে কিছুই বুঝতে পারে
না সে। বৃষ্টিতে ভিজতে
ভিজতে অকারণেই নিজের
ফোলিও ব্যাগটা সে একবার
হাতড়ে দ্যাখে, ছাতার
খোঁজে, যদিও সে জানত,
ছাতা থাকবে না। কেননা
সেই যে সেবার এটিএম
থেকে টাকা তুলতে গিয়ে,
অনির্ভরযোগ্য এবং
বানভাসী টাকা তুলতে
গিয়ে, ছাতাটা রেখে সে
চ’লে এলো, তারপর থেকে
কিনব-কিনব ক’রেও ছাতা
আর কেনা হয়নি। অতএব
বৃষ্টিতে সে ভিজতে
থাকে। একটু দূরে
বাসস্টপের শেডের নিচে
আরও অনেক মানুষের
ভিড়ের মাঝখানে নিজের
মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু
ক’রে নেওয়ায়
প্রচেষ্টায় নিজেকে
নিযুক্ত করতে তার কেমন
বাধে। উপরন্তু তার মনে
হয়, কারো, বা কারো-কারো
কাছে তার কিছুটা করুণা
এতদিনে প্রাপ্য হয়েছে,
এবং আদ্যন্ত বৃষ্টিতে
ভিজে গেলে তা হয়তো লভ্য
হ’তে পারে। কেননা,
কাকভেজা মানুষকে কে না
করুণা করে? অতএব
বাণেশ্বর বৃষ্টির
মধ্যে দাঁড়িয়ে ভিজতে
থাকে। সে দ্যাখে,
বৃষ্টির মসলিনে
রাস্তাঘাট কেমন চকচক
করছে, গাছেরা নির্বিকার
রকমের সবুজ, একটা কুকুর
অকারণেই বারবার রাস্তা
এপার-ওপার করছে। বাসের
জন্য অপেক্ষা করে
বাণেশ্বর, কিন্তু বাস
আসে না। দাঁড়িয়ে
দাঁড়িয়ে বাণেশ্বর
ভাবে, কী ভাবা যায়! এমন
আভূমিমেঘ বৃষ্টির ভিতর
দাঁড়িয়ে ‘এসো করো
স্নান নবধারাজলে’ যে
তার মনে পড়বে না, তা
জানা কথা, যদিও শরণ্যা
বাণেশ্বরের সামনে এই
গানটা প্রায়শই গাইত,
তার মন্দ্রগম্ভীর
গলায়। একবার,
বাণেশ্বরের মনে
না-থাকারই কথা, ময়দানের
একটা বেঞ্চিতে
পাশাপাশি দু’জনে,
শরণ্যা ও বাণ, মাঝখান
দিয়ে
মাছিও-গলতে-পারবে-না
এমন পারস্পরিকতায়
বসেছিল, আর শরণ্যা
গাইছিল, ‘দাও আকুলিয়া
ঘন কালো কেশ পরো দেহ
ঘেরি মেঘনীল বেশ’।
সেদিনও বৃষ্টি, সেদিনও
ছাতা ছিল না, শরণ্যা তার
মৃত্যুনীল কোরা সিল্ক
শাড়িটির আঁচল মেলে
ধরেছিল বাণেশ্বরের
মাথার ওপর, যেন তার
ইহলৌকিক অস্তিত্বের
একমাত্র রক্ষয়িত্রী সে,
আর তার নির্বাধ চুলের
ঢেউ পিঠের পেছন থেকে
ঘুরিয়ে ডান বুকের ওপর
ফেলে তার কেশরাজিকে
উড়ে যেতে দিচ্ছিল
বৃষ্টি-আলম্বনী
হাওয়ায়। আর গাইছিল ওই
গান, ওই ‘এস নীপবনে
ছায়াবীথিতলে এসো করো
স্নান নবধারাজলে।’
অতএব, এমন একটা
নীরব-মুখর দৃশ্য এই
গল্পের কাহিনিকালীন
বর্তমানে দাঁড়িয়ে মনে
পড়তেই পারত
বাণেশ্বরের, সেই সূত্রে
মনে আসতে পারত সেদিন
শরণ্যার গাওয়া গানটির
কথা। কিন্তু
বাণেশ্বরের কিছুই মনে
পড়ল না, এমনকি তার
চিরপ্রিয় ‘রিমঝিম গিরে
সাওয়ান’ গানটিও না।
কেনই বা পড়বে, এটা তো
শ্রাবণ মাস নয়। তবে কোন
মাস, ভাবল বাণেশ্বর, সে
জানে না, কাহিনি-কথক তো
জানেই না, তবে মনে হলো,
বাণেশ্বরের, মাস খানেক
আগেও বেশ শীত ছিল, তো
সেটা যদি মাঘ মাস হয়, এখন
তবে ফাল্গুন-টাল্গুন
চলছে বোধহয়। মাঘের পরে
ফাল্গুনই তো আসে, নাকি?
কে জানে, ভাবল বাণেশ্বর,
এবং তারপর কিছুর মধ্যে
কিছু না, হঠাৎ ক’রে তার
মনে প’ড়ে গেল ‘ইয়ে
হাওয়ায় ইয়ে বারিশ ইয়ে
লমহা ইয়ে আঁখে’
ইত্যাদি। কিশোর তো
বটেই, সঙ্গে আশা,
ঊননব্বইয়ের ‘সাচ্চে কা
বোল বালা’ নামের
ধ্যাদ্ধ্যাড়ে একটা
সিনেমার গান। বাপ্পি
লাহিড়ীর মিউজিক ছিল
বোধহয়, চিরতরুণের
ভেকধারী চিরবৃদ্ধ
দেবানন্দ ছিল হিরো।
স্কুল পালিয়ে এলিট-এ
দেখতে গিয়েছিল
বাণেশ্বর, অসহ্য
লেগেছিল, সেই বয়সেও।
কিন্তু আজকে, মানে এই
কাহিনিকালীন বর্তমানে,
বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে
সেই বিধুর স্মৃতিই হঠাৎ
ক’রে মনে প’ড়ে গেল
বাণেশ্বরের। রাস্তার
দিকে তাকিয়ে বাসের জন্য
অপেক্ষা করতে করতে সে
গুনগুন করতে লাগল,
‘মুঝকো ছুনে সে
প্যাহলে তুমকো জারা
জানলুঁ, জানলুঁ,
জানলুঁ’...। বাস যে আসছে
না, তার যে স্কুলে দেরি
হয়ে যাচ্ছে, সে কথা ভেবে
একবার ঘড়িও দেখল না
বাণেশ্বর, কী ক’রেই বা
দেখবে, ঘড়ি পরা সে
ছেড়ে দিয়েছে বহুদিন
হলো। মোবাইলে অবশ্য সময়
দ্যাখা চলত, কিন্তু
বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়ার
ভয়ে ব্যাগ হাতড়ে একটা
মাছের আঁশটে গন্ধওয়ালা
পলিথিন খুঁজে পেয়ে তাতে
মুড়ে ফোনটাকে সে নিজের
ফোলিও ব্যাগটার ভেতরে
রেখে দিয়েছে। এখন শুধু
ক’টা বেজেছে তা জানার
জন্য সেটাকে বার ক’রে
আনার পরিশ্রমের
ক্লান্তি বহন করতে
বাণেশ্বরের ইচ্ছে হলো
না, তার প্রয়োজনও বোধ
করল না। সে কেবল ‘মুঝকো
ছুনে সে প্যাহলে...’
গাইতে গাইতে রাস্তার
দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে
রইল। অবশেষে বাস এলো,
ভিড়ে গাল-ফোলা বাস।
বৃষ্টি নামলেই
বাসগুলোতে ভিড় হয়ে
যায়, এটা বাণেশ্বরের
মতো দৃষ্টিহীন মানুষও
খেয়াল করেছে। বাণেশ্বর
আর কিছু না ভেবে ভারি
পায়ে হেঁটে গিয়ে স্টপে
অপেক্ষারত সমস্ত লোক
বাসে উঠে যাওয়ার পর
কোনওক্রমে বাসের
হ্যাণ্ডেল ধ’রে
পাদানিতে একটা পা রেখে
ঝুলে পড়তেই বাস চলতে
শুরু করল।
স্কুলে যখন পৌঁছলো বাণ
তখন দশটা চল্লিশ বাজে।
ঘড়ি না দেখেও নিজের
ম্রীয়মান
অনুভূতিদেশের ইঙ্গিতে
কেমন যেন অনুভব করতে
পারল সে। সোজা হেঁটে
গিয়ে সে গিয়ে ঢুকল
হেডস্যারের ঘরে,
অ্যাটেন্ডেন্স
রেজিস্টারে সই করবে
ব’লে, ঢুকেই হেডস্যার
ভৌমিকের মাথার ওপর
দেওয়াল ঘড়িটার দিকে
তাকিয়ে সে বুঝল, ভুল,
আসলে এখন এগারোটা বাজতে
পাঁচ। ভৌমিক তার দিকে
তাকিয়ে একটা আক্ষেপের
ভান নিয়ে বলল, “এহে, পুরো
ভিজে গ্যাছো তো, ছাতা
ছিল না?” করুণা প্রাপ্য
ছিল বাণেশ্বরের, কিন্তু
ভৌমিকের করুণা নিশ্চয়ই
নয়। বাণেশ্বর বলল, “না
স্যার”, ব’লে এগিয়ে
গিয়ে ভৌমিকের টেবিলে
রাখা অ্যাটেন্ডেন্স
রেজিস্টারটা খুলল।
ভৌমিক বলল, “আমি তো
এক্ষুণি অ্যাবসেন্ট
বসাতে যাচ্ছিলাম।”
বাণেশ্বর কিছু বলল না।
ভৌমিক তাকে সই করতে
দেখে বলল, “আজকাল
প্রায়শই তোমার লেট
হচ্ছে। আজকে না হয়
বৃষ্টিতে আটকে গেছিলে,
কিন্তু অন্য দিনগুলোতে
একটু সময়মতো এসো। আর
আরেকটা জিনিস,
রেজিস্টারে চোখ বুলোতে
গিয়ে খেয়াল করলাম,
স্পেসিফিকালি
বুধবারগুলোতেই তোমার
লেট হচ্ছে। কেন বলো তো?
কোনও কোর্স-টোর্স জয়েন
করেছ নাকি? নাকি টিউশন
পড়াচ্ছ?” বাণেশ্বরের
অনেক কথা বলার ছিল,
কিন্তু সে শুধু বলল,
“কোনওটাই নয় স্যার।
ইন্সিডেন্টালি
বুধবারটাতেই লেট
হচ্ছে।” ভৌমিক তার
গন্ধগোকুলের লেজের মতো
ভুরু দুটো কুঁচকে বলল,
“সেটাও তো হওয়া কাম্য
নয়। বিশেষত তুমি
এইট-সি-র ক্লাস টিচার,
ফার্স্ট ক্লাসটাই যদি
দেরিতে শুরু হয়, তাহলে
ইট মেকস আ ব্যাড
ইমপ্রেশন আপন দা
স্টুডেন্টস।” যেন
সেকথা সে জানে না,
এমনভাবে বাণেশ্বর বলল,
“রাইট স্যার।” ভৌমিক
বলল, “সরকারি নিয়ম
অনুযায়ী তিনটে
লেটমার্ক-এ একটা সিএল
কাটা যাওয়ার কথা।”
বাণেশ্বরের হয়তো ক্ষমা
চাওয়া উচিৎ ছিল, হয়তো
বলা উচিৎ ছিল, ‘আমার
জীবনে যে কত কষ্ট, সে তো
আপনি জানেন না স্যার’,
হয়তো... হয়তো... ভৌমিকের
পায়ে প’ড়ে, মায়ের
পায়ের জবার মতো, ওই কী
যেন বলে, ‘গিরগিরানো’
উচিৎ ছিল বাণেশ্বরের,
কিন্তু যখন যা করা উচিৎ
তা সে কবেই বা করেছে? তাই
সে বলল, “আপনি যা ভালো
বোঝেন স্যার।” ভৌমিক
তার রিভলভিং চেয়ারের
পিঠে হেলান দিয়ে ব’সে
রোমশ ভুরু দুটো তুলে
বলল, “যা ভালো বোঝেন
বললে তো চলে না, তোমার
সিএল-এর কোটা তো অনেক
আগেই খতম। এরপর সরকারি
নিয়ম মানতে গেলে উইদাউট
পে হয়ে যাবে। সেটা কি
ভালো লাগবে?” বাণেশ্বর
চুপ ক’রে রইল, কিন্তু
নতমুখে নয়। ভৌমিক বলল,
“এনিওয়ে, আমি আমার
কলিগদের কারোরই ক্ষতি
চাই না, কিন্তু বাট আই
এক্সপেক্ট দেম টু
অ্যাবাইড বাই দা রুলস
অ্যান্ড রেগুলেশনস।
কাজেই সময়মতো এসো,
তাহলেই আর কথা ওঠে না।”
বাণেশ্বর কিছু না ব’লে
ব্যাগটা তুলে নিয়ে
বেরিয়ে আসতে যাচ্ছিল,
হঠাৎ ভৌমিক বলল, “ওহ্,
একটা কথা... কাল নাকি
তুমি এইট-সি-র
শুভঙ্করকে খুব মারধর
করেছ? স্কেল দিয়ে
পিটিয়ে নাকি পিঠের
ছালচামড়া তুলে দিয়েছ?”
বাণেশ্বর বলল, “হ্যাঁ,
স্যার।” ভৌমিক বলল,
“আমি তো খবরটা পেয়ে
অবাক হয়ে গেলাম। কারণ,
তোমাকে যতদূর জানি,
তুমি চিরকালই
স্টুডেন্টদের করপোরাল
পানিশমেন্টের বিরোধী।
তাহলে হঠাৎ...” বাণেশ্বর
নিজের কণ্ঠে অনমনীয়
তেজোদীপ্তি খুঁজে, এবং
খুঁজে না পেয়ে, ম্লান
গলায় বলল, “হি মেড ফান অফ
মাই নেম স্যার। গতকাল
আমি ক্লাসে ঢুকতেই,
স্পষ্ট শুনলাম, শুভঙ্কর
চাপা গলায় বলছে, ‘এই যে
আমাদের বানচোৎ স্যার
এসে গ্যাছে’। বেশ কিছু
ছেলে হেসে উঠল। আমার
মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল
স্যার।” ভৌমিক
কিছুক্ষণ চুপ ক’রে থেকে
বলল, “চাপা গলায় বলল,
আবার তুমি স্পষ্ট
শুনলে!” বাণেশ্বর, যেন
কিছু বলার নেই, এমনভাবে
চুপ ক’রে রইল। ভৌমিক
আবারও চেয়ারে এলিয়ে
প’ড়ে বলল, “এনিওয়ে, যা
বলছ, তা যদি সত্যি হয়ে
থাকে, তাহলে শুভঙ্কর
অন্যায় করেছে, খুবই
অন্যায়। কিন্তু এটাও তো
মাথায় রাখতে হবে যে, ও
আমাদের স্কুল
প্রেসিডেন্টের ভাইপো।
ফলে ওর বিরুদ্ধে কোনও
হার্শ স্টেপ নিলে তার
ফল ভোগ করতে হবে।
ব্যাপারটা
প্রেসিডেন্টের কানে
গিয়েছে। কাল
সন্ধেবেলাতেই
প্রেসিডেন্ট আমাকে ফোন
ক’রে বললেন,
‘সরকারিভাবে
ফিজিক্যাল পানিশমেন্ট
যেখানে নিষিদ্ধ সেখানে
আমাদের স্কুলের একজন
টিচার এভাবে একটি
বাচ্চাকে মারতে পারে
কীভাবে! জানেন, আমি এর
বিরুদ্ধে লিগাল
অ্যাকশন নিতে পারি?”
ব’লে কিছুক্ষণ চুপ ক’রে
থেকে ভৌমিক বলল,
“তোমাকে একটা
রিকোয়েস্ট করি
বাণেশ্বর, যদি শুভঙ্কর
কোনও মিসবিহেভ করে, যদি
ওর বিরুদ্ধে কোনও
কমপ্লেইন থাকে, প্লিজ,
সরাসরি আমাকে
অ্যাড্রেস করবে। আমি
পার্সোনালি ব্যাপারটা
ডিল করব। বুঝতেই তো
পারছ, সব দিক সামলে
আমাদের স্কুল চালাতে
হয়।” বাণেশ্বর বুঝতে
পারল না এই কথার উত্তরে
তার কিছু বলার রয়েছে কি
না। অবশ্য বলার তো
রয়েছেই, বলার রয়েছে, ‘ইউ
আর আ কাওয়ার্ড,
সার্ভাইল। তুই
প্রেসিডেন্টের পা-চাটা
কুত্তা।’ কিংবা ‘তোর
টিচারদের সম্মানের
কোনও মূল্যই তুই দিতে
জানিস না।’ কিন্তু যা
বলার, তা বাণেশ্বর কবেই
বা বলতে পেরেছে?
শরণ্যাকেই বলতে
পারেনি। শরণ্যা যখন
বলেছিল, ‘তোমার হৃদয়
ব’লে কিচ্ছু নেই’,
বলেছিল, ‘ভালোবাসতে
জানো না তুমি, একটা
নির্বিকার মনুষ্যরূপী
গর্দভ ছাড়া তুমি
কিচ্ছু নও’, তখন কি
বাণেশ্বর বলেছিল, কিশোর
কুমারের মতো, বাঁধভাঙা
বিষাদকণ্ঠে, “আমায়
ফুলের বাগান দিয়ে নিয়ে
যেও না সইতে পারবো না,
আমি সইতে পারবো না,
গোলাপের সৌরভ আঁচলে
ভরিও না, বইতে পারবো না,
আমি বইতে পারবো না”?
বলেনি, কেনই বা বলবে,
শরণ্যার ওই কথার উত্তরে
এসব বলা যায় নাকি? আর
বললেও শরণ্যার ডাবল
পিয়ার্সড কান পর্যন্ত
সেকথা পৌঁছতই না। অতএব
বাণেশ্বর চুপ ক’রে ছিল,
বরং শরণ্যা যখন মুখ
ঘুরিয়ে তার গর্হিত
নিতম্ব দুলিয়ে
বাণেশ্বরের থেকে ক্রমশ
দূরে চ’লে যাচ্ছে,
মাতাল হাওয়ায় ভাসা কাটা
ঘুড়ির ভঙ্গিতে
হাতছাড়া দূরত্বে, তখন
বরং সে মনে মনে বলেছিল,
কিশোরেরই কথায়, “ঢ’লে
যেতে যেতে ডুবে গ্যালো
শেষে দিন সে রাতের
গভীরে।” মাঝে মাঝে ভাবে
বাণেশ্বর, মানে যতটা
তার ভাবনায় কুলোয় আরকি,
যে, ‘আচ্ছা, আমার নিজের
কথা ব’লে কি কিছু নেই? সব
কথাই কি কিশোর কুমার
আমার হয়ে ব’লে গিয়েছে?’
তা-ই হবে, মানে হ’তেই তো
পারে, এমনটা তো হয়। হয়
না? একজনের কথা অন্য
আরেকজন উপযাচক হয়ে ব’লে
যায়। কিন্তু চুতিয়া
হেডস্যারকে চুপ করিয়ে
দেওয়ার মতো কোনও কথা তো
কিশোর বলেনি। কাজেই
বাণেশ্বর চুপ ক’রে
থাকে, এবং এইট-সি-র
স্টুডেন্টস
অ্যাটেডেন্স
রেজিস্টারটা নিয়ে
ক্লাসে চ’লে যায়।
ক্লাসে পৌঁছে প্রায়
নির্বাক স্বরে রোল কল
শেষ ক’রে সে
ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে
ঘোরে এবং চক ও ডাস্টার
তুলে নেয়। তারপর
সিলেবাসকে সম্পূর্ণ
শিকেয় তুলে বোর্ডে বড়ো
বড়ো অক্ষরে লেখে,
ইংরেজিতে, ‘Anatomy of Human Hand and
Wrist’. তারপর একটা হাতের
পাঞ্জার ছবি আঁকে, ডান
হাতের মেলে ধরা পাঞ্জা,
তার ভেতরে হাড়গুলোকে
চকের আঁচড়ে যথাসম্ভব
স্পষ্ট ক’রে তোলে।
তারপর অঙ্কিত হাতের এক
একটা অংশ থেকে সোজা
ডানদিকে দাগ টেনে টেনে
লিখতে থাকে—পালমাস
লংগাস, ফ্লেক্সর কার্পি
আলনারিস, অ্যাবডাক্টর
পলিসিস ব্রেভিস...এইসব।
তারপর ছাত্রদের দিকে
পিঠ ক’রেই বলতে থাকে,
“দা রিস্ট ইজ আ
কমপ্লেক্স সিস্টেম অফ
মেইনি স্মল বোনস
অ্যান্ড লিগামেন্টস।
দা বোনস আর নোওন অ্যাজ
কারপাল বোনস।” তারপর
বাংলায় ফিরে যায়,
“অনেকগুলো ছোট ছোট হাড়
দিয়ে মানুষের হাত তৈরি।
পাঁচটা অ্যালোংগেটেড
মেটাকারপাল বোন, যেগুলো
কব্জির পাশেই থাকে এবং
হাতের চেটোটাকে গ’ড়ে
তোলে, মানে পাম আরকি।
চোদ্দটা থাকে
ফ্যালাংগাস, যেগুলো
দিয়ে হাতের আঙুল তৈরি
হয়।” ছাত্ররা প্রথমটা
চুপ ক’রে থাকে,
হতভম্বের মতো, তারপর
মৃদু গুঞ্জন শুরু হয়।
ক্রমশ গুঞ্জন শোরগোলে
পরিণত হয়। একজন ছাত্র
প্রশ্ন করে, “স্যার,
এগুলো কি পরীক্ষায়
আসবে?” বাণেশ্বর সেকথার
কোনও উত্তর দেয় না, বরং
ব’লে চলে,
“মেটাকারপোফ্যালাংগাল
বা এমসিপি যে
জয়েন্টগুলো দেখছ,” ব’লে
বোর্ডে আঁকা হাতের একটা
অংশে চক ঠোকে, “এগুলোই
হাতের আঙুলকে হাতের
চেটোর সঙ্গে সংযুক্ত
করে।” কিছুক্ষণ বাদে
ক্লাস শেষের ঘণ্টা বেজে
যায়, কিন্তু বাণেশ্বর
থামে না, ব’লেই চলে। এমন
সময়, নিজের তদ্গত
বক্তৃতার মাঝখানেই,
একটা মন্তব্য কানে আসে
বাণেশ্বরের, যা তাকে
সচকিত ক’রে দেয়, যা
নির্ভুলভাবে
শুভঙ্করের মুখ থেকে
উচ্চারিত ব’লে বুঝতে
পারে সে, ঘাড় না
ঘুরিয়েও, কারণ সে শুনতে
পায়, “বানচোৎ স্যার
পাগলাচোদা হয়ে
গ্যাছে।” সঙ্গে সঙ্গে
ছাত্রদের দিকে ঘুরে
দাঁড়ায় বাণেশ্বর, তার
মেরুদণ্ড গুটিয়ে আসে,
যেন লাফ মারবে এক্ষুণি,
তার মুখচোখ
অগ্নিপ্রভায় শয়তানী
হয়ে ওঠে, তার দুই হাতের
আঙুলের নখগুলো ক্রমশ
লম্বাকৃতি হ’তে থাকে,
আর তারপর
পূর্ণিমারাত্রের
মধ্যপ্রহরকালীন
ওয়্যারউলফের মতো
দিগদিগন্তনিনাদী
হাউলে সে চিৎকার ক’রে
ওঠে,
—“শাট আপ ইউ
বাস্টার্ড।”
কিন্তু আসলে এসব কিছুই
ঘটে না। কারণ,
ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং,
এমনটা ঘটতে পারে না।
কারণ পণ্ডিতেরা স্পষ্ট
ব’লে গিয়েছেন, একটি
স্টোরি হলো, "a series of logically
and chronologically related events that are caused or
experienced by actors." তা এইসব
ওয়্যারউলফ, হাউল, এসবের
মধ্যে আছে নাকি কোনও,
লজিক? রিয়্যালিটি?
হ্যাঁ, একথা সত্যি বটে
যে, “anti-narrative denotes a narrative that depicts
crucial events or relations that are impossible in the real
world”. কিন্তু অ্যান্টি
বলো আর প্যান্টিই বলো, আ
ন্যারেটিভ ইজ আ
ন্যারেটিভ। ইট মাস্ট বি
আ সিরিজ অফ লজিক্যাল
অ্যান্ড
ক্রোনোলজিক্যাল
ইভেন্টস। কাজেই
শুভঙ্করের কথা শুনে
বাণেশ্বরের ওয়্যারউলফ
হওয়া আর হয় না। বরং
নির্বিকার ভঙ্গিতে
পুনর্বার বোর্ডের দিকে
ফিরে নিজের আঁকা হাত
নিজেই ডাস্টার দিয়ে
মুছে দিয়ে স্টুডেন্টস
অ্যাটেন্ডন্স
রেজিস্টারটা হাতে তুলে
নিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে
যায় বাণেশ্বর।
পরপর ক্লাস ছিল
বাণেশ্বরের। থার্ড
পিরিয়ডে ক্লাস
টুয়েলভের
প্র্যাকটিকালে ব্যাঙ
ডিসেকশন করতে গিয়ে
আবারও একটা কাণ্ড ক’রে
বসল সে। ল্যাবরেটরিতে
গিয়ে ছাত্রদের সামনে
অনেকক্ষণ ধ’রে বেছে
একটা মোটাসোটা ব্যাঙ সে
জার থেকে তুলে নিলো, যেন
চিকেন ললিপপের জন্য
উপযুক্ত মুরগি
নির্বাচন করছে। তারপর
নিডল দিয়ে ব্যাঙটার
ঘাড় বিদ্ধ ক’রে
ব্যাটাকে অজ্ঞান করার
বদলে সরাসরি ডিসেকশন
টেবিলে প্রাণীটাকে
রেখে সে হাতে তুলে নিলো
একটা নিরক্ত
স্ক্যালপেল। এমনকি
হাতে গ্লাভসও পরলো না
সে। বরং উপুড় করে বাঁ
হাত দিয়ে ডিসেকশন
টেবিলে ব্যাঙটাকে চেপে
ধ’রে সে স্ক্যালপেলের
একটিমাত্র টানে সেটার
মুণ্ডপাত ক’রে দিলো।
সামান্য রক্ত ছিটকে এসে
লাগল তার ফুলস্লিভ
শার্টের কব্জিতে।
সেদিকে তাকিয়েও দেখল না
সে, বরং নির্মুণ্ড
ব্যাঙটাকে চিৎ ক’রে
দিয়ে ঘ্যাঁচঘ্যাঁচ
ক’রে কাঁচি চালিয়ে তার
চামড়ার আস্তরণ
দ্বিখণ্ডিত ক’রে
টানটান ক’রে পিন দিয়ে
সেঁটে দিলো টেবিলের
সঙ্গে। অভিভূত
ছাত্রদের মধ্যে একজন
বলল, “কিন্তু স্যার,
এইভাবে...?” বাণেশ্বর
ডানা মেলা বাদুড়ের মতো
হাঁ-চামড়া ব্যাঙটার
দিক থেকে চোখ না সরিয়েই
বলল, “হ্যাঁ,
এইভাবেও...”
হিস্ট্রি টিচার
ব্রতীনের সঙ্গে কথা
বলার সুযোগ হলো
বাণেশ্বরের টিফিন
টাইমে। ব্রতীন
বাণেশ্বরের পাশের খালি
চেয়ারটাতে, অবশ্য
ব্রতীন ব্যতীত
বাণেশ্বরের পাশের
চেয়ার টিচার্স রুমে
সবসময় খালিই থাকে, দুই
দিকেই, ব’সে ব্যাগ থেকে
বউয়ের বানানো টিফিন
ক্যারিবদ্ধ
লুচি-তরকারি খুলে নিচু
গলায় বলল, “আজ বুধবার।”
বাণেশ্বরের
ভাত-ডাল-তরকারি-ডিম
কারি টিফিন ক্যারিয়ারে
ক’রে সামনের মা তারা
হিন্দু হোটেল থেকে রোজ
এনে দেয় স্কুলের পিওন
রামদেও। মাসিক
বন্দোবস্ত করা আছে।
প্লাস্টিকের একটা
প্লেটও নিজের লকারে
রেখে দিয়েছে বাণেশ্বর।
ভাত খাওয়া হয়ে গেলে
ধুয়ে মুছে প্লেটটা আবার
লকারে তুলে রাখে। তো
টিফিন ক্যারিয়ার থেকে
ভাত নিজের থালায় ঢালতে
ঢালতে ব্রতীনের
প্রশ্নচিহ্নহীন
প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার
জন্য সে বলল, “হুম।”
তারপর বলল, “আজও
এসেছে।” ব্রতীন যেন কথা
বলার রসদ পেলো। সে বলল,
“ঐ একই সময়ে?” বাণেশ্বর
“হ্যাঁ, ওই সাতটায়”
বলল। ব্রতীন, যেন আহত,
এমন গলায় বলল, “আজ কী?”
“ডান হাতের পাঞ্জা,
আপটু রিস্ট।” “কিছু
বোঝা গেল?” বাণেশ্বর এক
গ্রাস ভাত মুখে দিয়ে
গালফুলো অবস্থায় বলল,
“শরণ্যাই। আজ সিওর
হলাম। বুড়ো আঙুলের ওপর
তিলটা ওর ডিস্টিংক্টিভ
মার্ক ছিল।” ব্রতীন
প্রথমে, কেন কে জানে,
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে
তারপর লুচির একটা টুকরো
ছিঁড়ে নিয়ে বলল, “তুমি
এতটা শিওর হচ্ছো কী
ক’রে? ওরম তিল তো আরও
অনেক মেয়েরই থাকতে
পারে।” বাণেশ্বর মা
তারা হোটেলের কাঠ-কাঠ
আলু ভাজার তিলমাত্র
তুলে নিয়ে মুখে দিয়ে
চিবোতে চিবোতে বলল,
“পারে। তবে এই হাত
শরণ্যারই। আমার চিনতে
ভুল হবে না।” ব্রতীন
নিজের টিফিন ক্যারিয়ার
থেকে আলুর দমের দুটো
আলু তুলে নিয়ে
বাণেশ্বরের প্লেটে
দিয়ে বলল, “শরণ্যাকে
তার মানে ওরা মেরে
ফেলেছে।” বাণেশ্বর,
যেমন অনেক কিছুই বুঝতে
পারে না, তেমনই বুঝল না,
ব্রতীনের কথাটার মধ্যে
কোনও প্রশ্ন নিহিত
রয়েছে কি না। তবু এসব
ক্ষেত্রে সে যা ক’রে
থাকে, তা-ই সে করল, উত্তর
দেওয়ার মতো ক’রে বলল,
“মনে হয় না। কারণ
কব্জিতে তাজা রক্ত
লেগেছিল, তাছাড়া...
তাছাড়া আই কুড ফিল দা
ওয়ার্মথ অফ দা রিস্ট।
মৃত মানুষের হাতে ওরকম
উত্তাপ থাকে না।”
ব্রতীন, অম্নি, যেন
সত্যিই চিন্তিত,
এমনভাবে বলল, “তাহলে কি
ওরা শরণ্যাকে জীবিত
রেখেই এভাবে টর্চার
করছে?” ব্রতীনের দেওয়া
আলুর দমের একটা আলু
নিয়ে টেবিলস্থিত
পেপারওয়েটের মতো থালায়
ঘোরাচ্ছিল বাণেশ্বর, সে
বলল, “সেটাও পসিবল নয়।
এর আগে দুটো
ইনস্টলমেন্টে বুকের
দুটো অংশ এসেছিল। উইথ
হার্ট, লাংগস অ্যান্ড
অল দ্যাট। ওগুলো কেটে
দেওয়ার পর কোনও মানুষের
পক্ষেই জীবিত থাকা
সম্ভব নয়।” ব্রতীন লুচি
চিবোতে ভুলে গ্যালো,
বলল, “তাহলে কেসটা কী?”
বাণেশ্বর বলল, আলুর
দমের আলুটা মুখে পুরে,
এবং বলতে একটুও
লজ্জাবোধ হলো না তার,
কেনই বা হবে, তার
জ্ঞানের পরিধি তো অনন্ত
নয়, হ’তে পারে না, কোনও
মানুষেরই হয় না, এই
কাহিনির কথকের মতোই,
অতএব লজ্জাহীনভাবেই
বলল সে, “আমি... জানি...
না।” ব্রতীন ভাবতে
থাকল, কেননা ব্রতীনের
মতো মানুষেরা ভাবে,
ভাবতে পারে ব’লে ভাবে,
অতএব বেশ কিছুক্ষণ ভেবে
সে বলল, “তোমার বাড়ির
দোরগোড়ায় বাক্সগুলো
প্রতি সপ্তাহে কে পৌঁছে
দিচ্ছে, অন্তত সেটাও
যদি জানা যেত কোনওভাবে...
তোমাকে কতবার বললাম,
দরজার সামনে একটা সিসি
ক্যামেরা লাগাও... কতই বা
দাম নিত, তুমি শুনলে
না।” বাণেশ্বরের খাওয়া
হয়ে গিয়েছিল, এঁটো
থালায় আঙুল দিয়ে
আঁকিবুকি কাটতে কাটতে
“জেনে কি লাভ?” বলল সে।
এবং বলল, যেন আত্মপক্ষ
সমর্থন করছে, “শরণ্যাকে
কে মেরেছে, কে কেটেছে, কে
আমাকে ওর বডি পার্টস
ইনস্টলমেন্টে আমার
ঘরের দোরগোড়ায় পৌঁছে
দিয়ে যাচ্ছে, আমার
জানার কোনও আগ্রহ নেই।
শি ইজ নো বাডি টু মি, নট
এনিমোর। অনেক আগেই
শরণ্যা আমার কাছে ম’রে
গিয়েছে।” ব্রতীন রেগে
যেতে পারত, চিৎকার করতে
পারত, বলতে পারত, “ইউ আর
আ হার্টলেস ডিকহেড”, বা
এরকম কিছু, কিন্তু এই
মুহূ্র্তে রেগে যাওয়া
উচিৎ নয়, সে বুঝল,
ঔচিত্য-অনৌচিত্যের বোধ
তার রয়েছে, কাজেই, যেন
সহানুভূত, এমনভাবে সে
বলল, “তবু ডেলিভারি
ম্যানটাকেও যদি
কোনওভাবে আইডেন্টিফাই
করতে পারতে, দ্যাট উড
হ্যাভ সলভড দা
মিস্ট্রি।” “সে চেষ্টা
তো করেছি দু’বার, জানো
তো তুমি” বলল বাণেশ্বর।
ব্রতীন জানে, সত্যিই
জানে। কাহিনি-কথকের
অবশ্য সেসব জানার কথা
নয়, তবু ওই কী যেন বলে,
অথোরিয়াল ফিগারাল
ন্যারেটিভ সিচ্যুয়েশন
না কি, সেই রকম একটা
পরিস্থিতির সাহায্যে
ব্রতীনের মনের একেবারে
গভীরে জাদুকর
ম্যানড্রেক হয়ে ঢুকে
গিয়ে ন্যারেটরও
ব্রতীনের মতো জানতে
পারে যে, মাসখানেক আগে
পরপর দুটো বুধবার
বাক্সগুলোর ডেলিভারি
ম্যানকে একেবারে
‘রঙ্গে হাত’ পাকড়ানোর
চেষ্টা বাণেশ্বর
সত্যিই করেছিল। সে
করেছিল কী, প্রতি
বুধবার ঠিক সাতটায় তার
কলিং বেল পাগলাঘণ্টি
হয়ে বেজে ওঠে, এবং দরজা
খুলে সে একটা পার্সেল
দেখতে পায়, এটা খেয়াল
ক’রে পরপর দুটো
সপ্তাহের বুধবারে ভোর
ছ’টার সময় মোবাইলে
অ্যালার্ম দিয়ে উঠে
পড়েছিল। তারপর সাড়ে
ছ’টা থেকে বন্ধ দরজার
এপারে আইহোলে নিজের
পিঁচুটিমাখা ডান চোখটা
রেখে ঠায় দাঁড়িয়েছিল।
সাতটা বেজে গিয়েছিল,
সাড়ে সাতটাও। কিন্তু
দরজার ওপারে কাউকেই
দেখতে পায়নি সে। “সে তো
এলো না, এলো না, কেন এলো
না, জানি না” কিশোরের
ভাষাতেই ভেবেছিল
বাণেশ্বর, কেননা কিশোর
ছাড়া তার নিজস্ব ভাষা
নেই আর। কিন্তু সাতটা
চল্লিশ নাগাদ, কী মনে
হ’তে হঠাৎ সে দরজা
খুলেছিল। এবং খুলতেই,
ওহ মাই মাই, দ্যাখে কী,
একটা বাক্স প’ড়ে রয়েছে
তার চৌকাঠের সামনে।
কিছুই বুঝতে পারেনি সে,
কেননা না-বোঝাটাই
স্বভাব তার, যে, কীভাবে
একটা অদৃশ্য মানুষ
আইহোলের পরিধির
সম্পূর্ণ বাইরে থেকে
গিয়ে তার দরজার সামনে
এভাবে বাক্সটা রেখে
যেতে পারে! সেদিন বাক্স
খুলে, একটা জাং-এর,
দক্ষিণ জঙ্ঘা, সফেদ এবং
সফ্ট অ্যাজ সিল্ক,
টুকরো পেয়েছিল সে। পরের
বুধবার সে একেবারে ছ’টা
থেকে আটটা পর্যন্ত
হাঁটু-কোমর সব ব্যথা
ক’রে দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল
আইহোলের সামনে।
সেদিনও কাউকে দেখতে
পায়নি। কিন্তু আটটার পর
দরজা খুলে বাক্স
পেয়েছিল যথারীতি।
সেদিন বাক্সের অন্দরে
ছিল বাম জঙ্ঘা। তখনই
যা-বোঝার বুঝে গিয়েছিল
বাণেশ্বর, অর্থাৎ কিছুই
বোঝেনি। কিন্তু
জেনেছিল, যেমনভাবে সিকি
পরিমাণ মস্তিষ্ক নিয়ে
মাছ জানে জলকে, সেভাবেই,
যে, যে-মানুষ তার দরজার
সামনে এভাবে খণ্ড খণ্ড
নারীশরীর উপহার দিয়ে
যায়, নিয়ম ক’রে, উইদাউট
ফেইল, সে ভূত বা ভগবানের
মতোই মানুষের
দৃশ্যপরিধির বাইরে
থাকা অস্তিত্ব।
সায়েন্সের টিচার
হিসেবে ভূত বা ভগবানে
তার বিশ্বাস না করাই
উচিৎ ছিল, জানে
বাণেশ্বর, কিন্তু যখন
যা করা উচিৎ তা সে কবেই
বা করতে পেরেছে। অতএব
বাণেশ্বর আর সেই
উপহারদাতাকে ধরার কোনও
চেষ্টা করেনি। ব্রতীন
বারবার ইনসিস্ট করলেও
সিসি ক্যামেরা লাগানোর
ব্যাপারেও সে কোনও
আগ্রহ বোধ করেনি এই
কারণেই। কেননা প্রথমত,
কোনও বিষয়েই আসলে সে
আগ্রহী হ’তে পারে না,
সেটা তার স্বভাবে নেই;
এবং দ্বিতীয়ত, সে
জেনেছিল, সিসি
ক্যামেরাতেও ওই দুর্দম
ডেলিভারি ম্যানকে
ক্যাপচার করা যাবে না।
সে অধরা, সে বায়ব। সে এই
কাহিনি-কথকের মতোই
শতরূপে সারদা, অতএব
কোনও রূপেই সে ঘনীভূত
নয়। সে গ্লাসে ধরলে
গ্লাস, ঘটিতে ঘটিতে
ধরলে ঘটি; এবং বাঙালে
ধরলে বাঙাল। কাজেই
বিষ্ণুচক্রে ছিন্ন
একান্ন সতীপীঠে ধৃত
হওয়ার উপযোগী এই দৈবী
নারীদেহকে বাণেশ্বর
কেবল খণ্ডে খণ্ডে গ্রহণ
ক’রে গিয়েছে,
অঞ্জলিবদ্ধ কর-এ,
প্রসাদ গ্রহণের মতো
নির্বিকার চিত্তে, এবং
নির্ভাবনায়। ব্রতীন
এসব জানে, বুঝতে পারে,
তবু বলে, “আচ্ছা,
শরণ্যাকে একটা ফোন ক’রে
দ্যাখো না একবার।”
বাণেশ্বর উঠে গিয়ে
বেসিনে হাত ধুয়ে আসে,
তারপর রুমালে হাত মুছতে
মুছতে বলে, “আমার
নাম্বার ও ব্লক ক’রে
দিয়েছে”, এবং বলে,
“অনেকদিন আগেই।”
ব্রতীন সঙ্গে সঙ্গে
নিজের পকেট থেকে মোবাইল
বার করে, বলে, “আমাকে
নাম্বারটা দাও, আমি ফোন
ক’রে দেখি।” বাণেশ্বর
চেয়ারে ব’সে প’ড়ে বলে,
“আমি ওর নাম্বার ডিলিট
ক’রে দিয়েছি।” “তা হোক,
তবু নাম্বারটা তো মনে
আছে নিশ্চয়ই?” বেপরোয়া
হয়ে ওঠে ব্রতীন। “না”
বাণেশ্বর বলে, “আমি অতো
মনে রাখতে পারি না।”
আবারও কিছুক্ষণ ভাবে
ব্রতীন, তারপর বলে, “সে
হোক, তবু হোয়াটস অ্যাপ,
ফেসবুক,
ইনস্টাগ্রাম—কোনও না
কোনওভাবে তো ওর সঙ্গে
যোগাযোগ করা যাবে।”
বাণেশ্বর টেবিলে রাখা
খবরের কাগজটা তুলে নেয়,
সামনের পাতাটা চোখের
সামনে মেলে ধরে, যদিও সে
জানে, কিছুই তার পড়ার
নেই, এবং বলে, “আমি
হোয়াটসঅ্যাপ ফেসবুক
করি না।” ব্রতীন বলে,
“দাঁড়াও, আমি দেখছি।”
তারপর নিজের মোবাইলে
ফেসবুক খোলে সে, বলে,
“শরণ্যা সেনগুপ্তা,
না?” বাণেশ্বর খবরের
কাগজের দিকেই দৃষ্টি
নিবদ্ধ রেখে বলে,
“হ্যাঁ।” ব্রতীন সার্চ
করে। তিনটি প্রোফাইল
আসে ওই নামে। ব্রতীন
বাণেশ্বরকে ছবিগুলো
দেখায়, জানতে চায়,
“কোনটা?” দৃষ্টিহীন
দৃষ্টি নিয়ে সেদিকে
একবার তাকিয়ে বাণেশ্বর
একটা প্রোফাইলের দিকে
আঙুল দেখায়। ব্রতীন
একটু পরেই বলে, “এ হে,
প্রোফাইল লক ক’রে
রেখেছে। নইলে গত
তিনমাসে কোনও আপডেট
দিয়েছে কি না, সেটা জানা
যেত।” বাণেশ্বর বলে,
“ছেড়ে দাও।” ব্রতীন
বলে, “এক কাজ করি। একটা
ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট
পাঠিয়ে রাখি।
অ্যাকসেপ্টেড হ’লে
বোঝা যাবে শরণ্যা
জীবিত।” বাণেশ্বর বলে,
“ও ম’রে গেলেও, আই মিন,
বেঁচে থাকলেও তোমার
ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট
অ্যাকসেপ্ট করবে না।
আমার মুখে তোমার কথা ও
অনেকবার শুনেছে। তোমার
নামটা ওর চেনা। আমার
সঙ্গে কোনওভাবে
অ্যাসোসিয়েটেড কারো
সঙ্গেই ও টাচে আসার
মেয়ে নয়।” ব্রতীন আরও
ভাবে। তারপর বলে, “ওর
এখনকার বয়ফ্রেন্ডটার
কী যেন নাম?” বাণেশ্বর
“সিদ্ধার্থ মুখার্জী,
প্রবাবলি” বলে। ব্রতীন
বলে, “কী করে? মানে পেশা
কী?” “যতদূর জানি
সার্জন, এনআরএস-এ।”
“ওহ” ব’লে ব্রতীন আবারও
মোবাইলে কি খুঁজতে
থাকে। তারপর বলে,
“পেয়েছি, ডক্টর
সিদ্ধার্থ
মুখোপাধ্যায় দিয়ে
সার্চ করতেই এসে
গ্যালো। এই দ্যাখো।” সে
ফেসবুকে একটি
দাড়িওয়ালা যুবকের ছবি
সমন্বিত প্রোফাইল
দেখায়। বাণেশ্বর একবার
তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়।
ব্রতীন আবারও মোবাইলে
ব্যস্ত হয়। তারপর বলে,
“এই তো, শরণ্যার সঙ্গে
ছবি।” বাণেশ্বর আবারও
তাকায়, দ্যাখে, একটি
ফ্রেমে জ্যাকেট সজ্জিত
ডক্টর মুখার্জী এবং তার
পাশে জিন্স ও ফুলস্লিভ
ডিজাইনার সোয়েটার পরা
তার ফিয়ান্সে শরণ্যা
সেনগুপ্তা। দু’জনের
চোখেই সানগ্লাস।
হংস-হংসীর লক্ষণীয়
সংলগ্নতা ছাড়িয়ে
পিছনে দ্যাখা যাচ্ছে
ধোঁয়াশামণ্ডিত
পাহাড়চূড়া।
বরফাবৃত। বাণেশ্বর
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে
ছবিটার দিকে, তার মনের
মধ্যে শব্দ হ’তে থাকে,
“তুমি কি কুয়াশা? ধোঁয়া
ধোঁয়া ধোঁয়া? পারি না
সইতে, না পারি কইতে, তুমি
কি কুয়াশা?” সে চোখ
ফিরিয়ে নেয়। ব্রতীন
মোবাইল নিজের দিকে
ঘুরিয়ে নিয়ে আবার কী
দেখে বলে, “ও হো, নভেম্বর
মাসের পোস্ট গো। তাহলে
তো তিন মাস হয়ে
গ্যাছে।” বাণেশ্বর
বিরক্ত হ’তে পারত,
কিন্তু বিরক্তিহীন
গলাতেই সে বলে, “ছাড়ো
না।” ব্রতীন ভাবতে
ভালোবাসে, তাই সে আবারও
ভাবতে থাকে, এবং বলে,
“আমার কি মনে হয় জানো, এই
সিদ্ধার্থ ছোকরাই
কোনওভাবে তোমাদের
রিলেশনটার কথা জানতে
পেরেছে, এবং মেনে নিতে
পারেনি, দেন আউট অফ
শিয়ার গ্রাজ, অর জেলাসি,
হোয়াটএভার, ও শরণ্যাকে
খুন ক’রে কোনওভাবে
বডিটাকে প্রিজার্ভ
করেছে। দ্যাখো, ও
ডাক্তার, ওরা এটা করতে
পারে, তার ওপর সার্জন,
মানে বডি ডিসেকশানেও
সিদ্ধহস্ত। তারপর
তোমার ওপর রিভেঞ্জ
নেওয়ার জন্য শরণ্যাকে
টুকরো টুকরো ক’রে
কেটে...” বাণেশ্বর যেন
এবার সত্যিই বিরক্ত হয়,
বলে, “আহ্, তুমি থামবে?”
ব্রতীন চুপ ক’রে যায়।
তারপর বলে, “তুমি কি
পার্সেলগুলো নিজের
কাছেই রাখছ?” “হ্যাঁ”
বলে বাণেশ্বর। “কোথায়?”
“ফ্রিজে। এমনিতে তো
ফ্রিজটা কোনও কাজে লাগে
না। বাজার-টাজার তো করি
না। এখন বরং যন্ত্রটা
একটা পারপাস সার্ভ
করছে।” “ফ্রিজে!
হিউম্যান বডি পার্টস!!”
ব্রতীন এবার সত্যিই
বিস্মিত হয়। বলে, “এ তো
হরার স্টোরির মতো
শোনাচ্ছে।” তারপর বলে,
“তুমি কিন্তু বড়ো
ফাঁসা ফাঁসবে দাদা, আমি
ব’লে দিলাম। এখনও সময়
আছে। পুলিশের কাছে যাও।
পুরো ব্যাপারটা খুলে
বলো। তুমি একজন টিচার।
তোমার একটা সোশ্যাল
রেপুটেশন আছে। পুলিশ
ব্যাপারটা লাইটলি নেবে
না। এর তদন্ত হওয়া
দরকার।” বাণেশ্বর
এতক্ষণে খবরের কাগজটা
থেকে নিজেকে মুক্ত করে,
এবং বলে, “পুলিশ লাইটলি
নেবে না। জানি। পুলিশ
আমাকেই সন্দেহ করবে।
বলবে, আমিই, ওই কী যেন
বললে, আউট অফ শিয়ার
গ্রাজ অর জেলাসি,
শরণ্যাকে খুন ক’রে কেটে
ফ্রিজে ভ’রে রেখেছি।”
ব্রতীন বলে, “আরে সে তো
পরের কথা। তুমি একবার
গিয়েই দ্যাখো না।
তাছাড়া আমার
মেসোশ্বশুর এন্টালি
থানার ওসি। ওঁকে বললে,
কিছুটা ইনফ্লুয়েন্সও
খাটাতে পারবেন।”
“না”—এমনভাবে বলল
বাণেশ্বর যেন নেতি
ছাড়া তার কোনও গতি
নেই। ব্রতীন ম্লান গলায়
বলল, “তবু...”, আর অম্নি,
কী আশ্চর্য, লাইক আ
বোল্ট ফ্রম দা ব্লু,
বাণেশ্বরের মনে প’ড়ে
গেল, “তবু ব’লে কেন
সহসাই থেমে গেলে? বলো, কী
বলিতে এলে...” –‘বন্ধে
হাত’-এর বাংলা ভার্সন।
সে খুশি হয়ে উঠল,
ব্রতীনকে বলল, “তুমি
‘রাজকুমারী’ দেখেছ?”
ব্রতীন গর্তে প’ড়ে
যাওয়া মানুষের মতো ক’রে
বলল, “কে রাজকুমারী?”
“উত্তম-তনুজা”, বলল
বাণেশ্বর, “নাইনটিন
সেভেনটি, আর.ডি.।
সিনেমাটার একটা গান
হঠাৎ মনে প’ড়ে গেল।”
“নিশ্চয়ই কিশোরের?”
ব্রতীন বলল। “হুম।”
ব্রতীন টিফিন শেষের
ঘণ্টা শুনে উঠে যেতে
যেতে “তোমার জীবনে
কিশোর ছাড়া আর কিছু
নেই বাণেশ্বরদা” ব’লে
চ’লে গেল। বাণেশ্বরের
মনে পড়ল, শরণ্যাও বলত,
“তোমার মতো
স্টিরিওটিপিকাল একটা
মানুষ যে কী ক’রে কিশোর
কুমারের গান, ইনফ্যাক্ট
কোনও ধরনের গানই, এতো
ভালোবাসতে পারে, ভাবলে
অবাক হই।” বাণেশ্বর
বলত, “কিশোরের চেয়েও
তোমাকে বেশি ভালোবাসি
শরণ্যা।” শরণ্যা হেসে
উঠত, ম্যাজিক মিরারে
দ্যাখা প্রতিচ্ছবির
মতো লার্জার দ্যান লাইফ
হাসি, হেসে বলত,
“মিথ্যুক।” এরকম একটা
আনন্দস্পন্দিত মেয়ে যে
কেন চ’লে গেল
বাণেশ্বরের জীবন থেকে,
ভেবে পায় না বাণেশ্বর,
তার শুধু মনে জাগে,
কিশোরের
হাহাকারনন্দিত কণ্ঠে
“ফিরে এলো না আর সে চ’লে
গেল যে, ফিরে যাবে
কোনওদিন ভাবিনি আমি”।
অবশ্য সত্যিই কি ফিরে
আসেনি শরণ্যা? এসেছে তো,
টুকরো টুকরো হয়ে,
রক্তমাখা
মেদমাংসঅস্থি সহ, তার
আল্টিমেট
ডেস্টিনেশনে।
সেইজন্যই তো প্রতিটা
বাক্স যত্ন ক’রে
প্রিজার্ভ ক’রে রেখেছে
বাণেশ্বর, কারণ সে জানে,
যা খণ্ডিত, তা পূর্ণতা
একদিন পাবেই, পূর্ণতা
ছাড়া তার গতি নেই। সে
নিজের হাতে তাকে
সম্পূর্ণতা দেবে। সেই
আসন্ন শুভকালের জন্য
অধীর আগ্রহে ব’সে আছে
বাণেশ্বর।
চারটেয় স্কুল ছুটি হয়ে
যাওয়ার পর বাণেশ্বর
ঘণ্টাখানেক
লাইব্রেরিতে কাটায়।
প্রতিদিন। যে-কোনও একটা
বই খুলে রাখে সামনে।
কারণ লাইব্রেরিতে বসতে
গেলে সেটা করতেই হয়,
কিন্তু পড়ে না কিছু।
যাবতীয়
পরীক্ষা-টরিক্ষা পাশ
করা হয়ে যাওয়ার পর
থেকেই সে কোনও কিছু
পড়ে না আর। ভালো লাগে
না পড়তে। বিএসসি,
এমএসসি-তে, বিএড ক্লাসে,
কিংবা এসএসসি দেওয়ার
সময়, অনেক নোট মুখস্থ
করেছিল সে। সে মুখস্থ
করতে পারত ভালো। তার
কিছু কিছু এখনও মনে রয়ে
গিয়েছে। সেগুলো থেকেই
প্রয়োজনমতো ক্লাসে যা
উগরোনোর সে উগরে দেয়।
কিন্তু নতুন কিছু পড়ার
কথা ভাবলে তার ক্লান্তি
আসে, অপ্রয়োজনের বোধ
জেগে ওঠে। কিন্তু তাহলে
রোজ স্কুল লাইব্রেরিতে
ব’সে থাকে কেন সে? ব’সে
থাকে, কারণ তাদের
পাড়ার বিশুদার দোকানে
ছ’টার আগে রুটি তৈরি
করা শুরু করে না। স্কুল
ছুটির পর এক ঘণ্টা
লাইব্রেরি খোলা থাকে।
ফাঁকা লাইব্রেরিতে
ব’সে সময়কে খুন করে
বাণেশ্বর। তারপর
পাঁচটা বেজে গেলে
লাইব্রেরিয়ান
অসিতবাবু যখন বলেন,
“স্যার, সময় হয়ে
গিয়েছে”, তখন বাণেশ্বর
এক-লাইনও-না-পড়া বইটা
বন্ধ ক’রে উঠে পড়ে।
এরপর স্কুল থেকে বেরিয়ে
বাস ধ’রে নিজের স্টপে
নেমে হেঁটে বিশুদার
দোকান পর্যন্ত যেতে
যেতে ছ’টা ঠিক বেজেই
যায়। আজও গেল। বিশুদার
দোকানে গিয়ে বাণেশ্বর
বলল, “তিনটে রুটি, আর
একটা এগ তরকা।” রোজই
বলে। বিশুর ছেলে পল্টু
হট-পট থেকে গরম তিনটে
রুটি একটা ঠোঙায় ভ’রে
ফয়েল ব্যাগে তরকা ঢেলে
পলিথিনে ক’রে
বাণেশ্বরকে দিলো।
বাণেশ্বর যখন দাম
মেটাচ্ছে, পল্টু বলল,
“স্যার, রাত্রে যখন খান,
রুটি-তরকা ঠাণ্ডা হয়ে
যায় না?” বাণেশ্বর বলল,
“তা একটু হয়।” পল্টু
বলল, “তাহলে স্যার
খাওয়ার আগে নিয়ে গেলেই
তো পারেন। আপনার বাড়ি
থেকে তো দু’মিনিটের
হাঁটা পথ। আর আমাদের
দোকান তো রাত এগারোটা
পর্যন্ত খোলা থাকে।
খাওয়ার আগে নিয়ে গেলে
গরম-গরম খেতে পারতেন।”
‘হুঁঃ’ মনে মনে বলে
বাণেশ্বর, ‘আমি যেন
জানি না সেটা। কিন্তু
একবার বাড়ি ঢুকে
যাওয়ার পর খাওয়ার আগে
আবার জামা-প্যান্ট পরো
রে, সিঁড়ি দিয়ে নামো রে,
দু’মিনিট হোক আর যা-ই
হোক, রাস্তা হেঁটে এসো
রে—এতসব করবে কে?’
বাণেশ্বর তো কখনওই করবে
না। কাজেই স্কুল থেকে
ফেরার পথেই সে যা কাজ
সারার, মানে ওই রাতের
খাবারের বন্দোবস্ত
আরকি, ক’রে একেবারে
ফেরে। তারপর দরজায় খিল
তুলে সেই যে ঘরের ভিতরে
নিজের খাটটাতে গিয়ে
শুয়ে পড়ে সে, খাওয়ার
আগে আর ওঠে না। খেয়ে
আবার শোয়। যে শুয়ে থাকে,
তার ভাগ্যও শুয়ে
থাকে—জানে বাণেশ্বর।
কিন্তু তা-ই যদি হতো,
তাহলে সমস্ত ট্র্যাফিক
পুলিশের ভাগ্য, মানে
তাদের ‘ওই’টা আরকি,
পুরুষের প্রকৃত ভাগ্য
বলতে ওছাড়া তো আর কিছু
নয়, সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে
থাকত। অতএব বাণেশ্বর
শুয়ে থাকে। ঘরের সমস্ত
আলো নিবিয়ে দেয়, আলো
অপ্রয়োজনীয় মনে হয়, মনে
হয়, তার কিছুই দেখার নেই,
এবং কানে ইয়ারফোন গুঁজে
কিশোর শোনে। অন্যদিন
অকারণেই শুয়ে থাকে,
অথবা নিষ্কর্মতাকে যদি
একটা কারণ ব’লে ধরা যায়,
তাহলে হয়তো সকারণেই শোয়
সে, কিন্তু আজ বাড়ি
ফিরে বাণেশ্বরের মনে
হলো, শুয়ে পড়া ছাড়া
গতি নেই। কেননা বাড়িতে
ঢুকে সে টের পেলো, তার
প্রচণ্ড মাথা ধরেছে,
এবং শরীরটা কেমন শিরশির
করছে। ‘সকালে বৃষ্টিতে
ভেজার ফল’ ভাবল সে।
জামাকাপড় বদলে সে
শয্যা নিলো। উঠল দশটার
সময়। খেলো। ঠাণ্ডা
রুটি-তরকা। রুটি শেষ
হয়ে যাওয়ার পরেও কিছুটা
তরকা রয়ে গ্যালো।
বাণেশ্বর ভাবল ফ্রিজে
রেখে দেবে। কিন্তু
ফ্রিজ খুলে দ্যাখে,
একটুও জায়গা নেই, সবকটা
তাক আলো ক’রে
বাণেশ্বরের সাপ্তাহিক
উপহারের বাক্সগুলো
ব’সে রয়েছে। ‘আমার
শরণ্যা’ মনে মনে বলল
বাণেশ্বর, ‘তোমার
দখলদারি কে আটকাবে?’
তারপর বাথরুমে গিয়ে
বেঁচে যাওয়া তরকাটুকু
কমোডে ঢেলে ফ্লাশ টেনে
দিলো। গা-শিরশিরানিটা
আরও বাড়ছে দেখে
একেবারে দু’খানা
প্যারাসিটামল সিক্স
ফিফটি, আর কী মনে হ’তে
দুটো অ্যালজোলাম
পয়েন্ট ফাইভ জল দিয়ে
গিলে সে শুয়ে পড়ল।
কানে গুঁজল ইয়ারফোন,
মোবাইলে চালিয়ে দিলো
“বহুদূর থেকে একথা দিতে
এলাম উপহার”, অন্তহীন
লুপে। ‘হীরক জয়ন্তী’,
অঞ্জন চৌধুরীর ডিরেকশন,
মিউজিক গৌতম বোস,
নায়িকা অঞ্জনের সেই
ভ্যাদা মেয়েটা, কী যেন
নাম, চুমকি, আর হিরো
ভ্যাদেশ্বর জয়
ব্যানার্জী। নাইনটিন
নাইনটি কি? কিন্তু
এইটটি সেভেনেই তো কিশোর
চ’লে গেলেন। তাহলে কি
এটা পোস্থামাস রিলিজ?
তা-ই হবে। মৃত্যুর পরেও
এভাবেই মানুষ বেঁচে
থাকে। শুধু কিশোরের মতো
লেজেন্ডরা নয়, কখনও
কখনও শরণ্যারাও থাকে।
তবে অন্যভাবে। ফ্রিজের
ভেতরে হিম হয়ে, কুয়াশা
মেখে, খণ্ডে খণ্ডে,
অখণ্ডতায় পূর্ণতা
পাওয়ার প্রতীক্ষায়।
বাণেশ্বর জেগে উঠল পরের
বুধবার। মানে কার্যত
জেগে উঠল আরকি, গত
তিনমাস ধ’রে একমাত্র
বুধবারগুলোতেই নিজের
সাম্বৎসরিক ঘুম ত্যাগ
ক’রে জেগে ওঠে
বাণেশ্বর, এক
পাগলাঘণ্টির আহ্বানে।
সপ্তাহের বাকি ছ’টা দিন
সে ঘুমোয়, মানে কার্যত
ঘুমোয়। কারণ তার মতো
মানুষেরা, যাদের জীবনে
কোনও কিছুই ঘটে না, মানে
পণ্ডিতেরা যাকে
‘ইভেন্ট’ বলেন আরকি,
বলেন, “The event, therefore, has to be defined as
a change of state that fulfils certain conditions.”
এবং সেই সমস্ত
‘কন্ডিশনস’-কে চিহ্নিত
করতে গিয়ে বলেন, উক্ত
‘change of states’ আখ্যানজগতের
অভ্যন্তরস্থ প্রভাবিত
ব্যক্তির কাজ এবং
চিন্তাতেও পরিবর্তন
আনবে, সেরকম ইভেন্ট
যাদের জীবনে নেই, যেমন
বাণেশ্বর, তারা একমাত্র
পাগলাঘণ্টির আওয়াজ না
শুনলে জেগে উঠতে পারে
না। তবে দুটো বুধবারের
মধ্যবর্তী ছ’-ছ’টা দিনে
বাণেশ্বর যে কিছুই করে
না, তা নয়। সে স্কুলে
যায়, রুটি-তরকা খায়, হয়তো
স্নান করার সময় নিজের
অমেরুদণ্ডী
পুরুষাঙ্গটির দিকে
তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে,
‘হিসি করার যন্ত্র’,
হয়তো দাড়ি কামানোর সময়
নিজের গালে ব্লেড চেপে
ধ’রে দেখতে চায় রক্ত
বেরোয় কি না, কিংবা তার
রক্তের রং লাল কি না,
হয়তো-বা শুভঙ্করের মতো
এক মাইনর বাস্টার্ডের
বিরুদ্ধে ছাড়া কখনও
মুষ্টিবদ্ধ না হওয়া
হাতদুটোর দিকে তাকিয়ে
মনে মনে বলে, ‘ইয়ে হাত তু
লেই লে গব্বর’। আর হয়তো
বারবার ঘুরঘুর করে
হিমেল আবহাওয়ার গভীরে
পূর্ণতা পাওয়ার জন্য
অপেক্ষারত শতচ্ছিন্ন
একটি নারীশরীর সমন্বিত
ফ্রিজের সামনে, হয়তো
নিতান্ত অকারণেই তার
মনে প’ড়ে যায়,
শরণ্যাকে সে একবার
বলেছিল, “জানো, এফএম-এ
সেদিন শুনছিলাম, কিশোর
তাঁর শেষজীবনের একটা
ইন্টারভিউতে বলেছিলেন,
তিনি তাঁর বাগানের
গাছেদের সঙ্গে গল্প
করেন, কারণ ওরাই তাঁর
একমাত্র বন্ধু।”
শরণ্যা সেকথা শুনে
ত্রিলোকমোহিনী কটাক্ষ
ক’রে বলেছিল, “চারটে
বিয়ে করলে ওই হয়।
বিশুদ্ধ পলিগ্যামাস,”
এবং বাণেশ্বর বলেছিল,
“বিশুদ্ধ নিঃসঙ্গ।
সম্রাটেরা যেমন হয়।”
অবশ্য এত কথা সত্যিই
বলতে পেরেছিল কি না,
মানে তার পক্ষে বলা
সম্ভব হয়েছিল কি না, তা
ঠিক মনে করতে পারে না
বাণেশ্বর। মুখস্ত
মেটেরিয়াল বাদে নিজের
স্মৃতি নিয়ে সন্দেহ
বাণেশ্বরের কখনও দূর
হওয়ার নয়। তাছাড়া
শরণ্যার সঙ্গে যতটুকু
সময় কাটাতো সে, ক’টাই বা
কথা হতো দু’জনের।
বাণেশ্বরের বলার কিছুই
থাকত না, শরণ্যা একা কথা
ব’লে যেত, বাণেশ্বর
শুনত, গাছ হয়ে, একাকীর
একমাত্র সঙ্গী রূপে।
সারা সপ্তাহ জুড়ে এইসব
হয়তো নিদ্রিত
অবস্থাতেই ভাবে বা ক’রে
যায় বাণেশ্বর, কিন্তু
বুধবার সকাল সাতটায়
কলিং বেলের একটিমাত্র
ডাকে সে জেগে ওঠে। উঠে
গিয়ে দরজা খোলে।
চৌকাঠের সামনে রাখা
বাক্সটা সযত্নে তুলে
নেয়। ফিরে এসে নিজের
বিছানায় বসে। বিছানা
সংলগ্ন টেবিলটিতে
কাহিনি-কথকের জ্ঞানের
অতীত কোনও কারণে
নিরাবরণ হয়ে প’ড়ে থাকা
ব্লেডটি দিয়ে
সেলোটেপের মোড়ক কাটে।
আস্তে আস্তে বাক্সের
ঢাকনা খুলে দ্যাখে,
নিখুঁত ভি-শেপে কর্তিত
একটি ভ্যাজাইনা রাখা
রয়েছে ভেতরে।
মাতৃমমতায় কর্তিত
যোনিদেশটিকে দু’হাতে
তুলে নেয় বাণেশ্বর।
কর্কশ চুলের
বেলাভূমিতে হাত বুলোয়।
‘আচ্ছা’, হঠাৎ মনে হয়
বাণেশ্বরের, ‘শরণ্যা
রেগুলার ওয়্যাক্স না
হেয়ার রিমুভাল—কী একটা
করাতো না?’ বাণেশ্বর
ঠিক মনে করতে পারে না।
আর মনে করতে পারলেই বা
কী, শরণ্যার সঙ্গে
ছাড়াছাড়ি তো কম দিনের
নয়, শরণ্যা হয়তো বদলে
গিয়েছিল পরে, তার
নির্বাক বৃক্ষসঙ্গী
হ’তে অসংলগ্ন হওয়ার
পরে। ত্রিভুজাকৃতি এবং
রক্তরঞ্জিত
নারীরত্নটিকে
নেড়েচেড়ে দ্যাখে
বাণেশ্বর। ক্লিটোরিস
থেকে শুরু ক’রে লেবিয়া
মেজোরা, লেবিয়া
মাইনোরার ওপর দিয়ে আঙুল
বুলিয়ে ইউরেথরাল
ওপেনিং পেরিয়ে
ভ্যাজাইনাল ওপেনিং-এর
ওপর দুটো আঙুল রাখে সে।
কিছুক্ষণ থেমে থেকে
আঙুল দুটো প্রবেশ করিয়ে
দেয় কৃষ্ণগহ্বরে।
মুখবিবরের অন্তঃস্থ
তালু ও মূর্ধ্বার মতো
স্পর্শ পায় সে আঙুলে।
স্বল্পসিক্ত,
ছিন্ন-হাইমেন, সারিবদ্ধ
স্কোয়ামাস সেলের
অমসৃণতা পেরিয়ে
গহ্বরটির আরও গভীরে
প্রবিষ্ট হয় সে,
সারভিক্স ছুঁয়ে ফ্যালে,
অতলান্তের তল খুঁজে পায়
যেন। কিন্তু সীমার
ওপারে কী? বুঝতে পারে না
বাণেশ্বর। সে আঙুলটি
প্রবিষ্ট করিয়ে রাখে।
তার মনে পড়ে, প্রথম
সঙ্গমে বালিকার মতো
কেঁদে উঠেছিল শরণ্যা,
বালিকার মতো
আনন্দবেদনায়, নিজেকে
উৎসর্গের আনন্দে,
নিজেকে সমপর্ণের
বেদনায়, আর বাণেশ্বর,
সেই অশ্রুবিনিন্দিত
বন্ধ আঁখিপল্লবে প্রবর
প্রেমিক হয়ে সস্নেহ
চুম্বন করার বদলে, জিভ
বার ক’রে চেটে নিয়েছিল
শরণ্যার চোখের জল। জিভে
নোনা স্বাদ নিয়ে তারপর
বলেছিল, যেন শায়েরি,
কিন্তু আসলে কিশোরের
গান, “কভি পলকোমে আঁসু
হ্যায়, কভি লব পে শিকায়ত
হ্যায়, মগর অ্যায়
জিন্দেগি ফিরভি মুঝে
তুঝসে মুহব্বত হ্যায়।”
অশ্রুধারা বন্ধ হয়নি
সেসব শুনে শরণ্যার, মনে
পড়তে প্রবিষ্ট আঙুল
দু’টি বার ক’রে আনে
বাণেশ্বর। একবার কী মনে
হ’তে নিজের প্যান্টটা
তুলে ভেতরে তাকায়,
দ্যাখে, এতসবের পরেও
তার আনন্দযন্ত্রটি
সামান্যও মাথা তোলেনি,
ঢ্যামনা সাপ যেন।
বাণেশ্বর কর্তিত
অঙ্গটি বাক্সের ভিতরে
রেখে দিয়ে সেলোটেপ আটকে
ফ্রিজ খোলে। চারটি
তাকের আর কোথাও জায়গা
নেই। সে তাই ডিফ্রিজের
ঢাকনা খুলে তার ভেতর
ভ’রে দেয় বাক্সটা।
তারপর পুনরায় নিজের
বিছানায় কিছুক্ষণ চুপ
ক’রে ব’সে থাকে। তারপর
হঠাৎ মোবাইল তুলে ফোন
করে ভৌমিককে। বলে, আজ
তার জ্বর এসেছে, সে
স্কুলে যাবে না। ভৌমিক
বলে, “ইএল কাটা যাবে
কিন্তু। কারণ তোমার
সিএল আর নেই।” “আচ্ছা”
ব’লে ফোন কেটে দিয়ে
জামাকাপড় পাল্টে ঘর
থেকে বেরিয়ে আসে
বাণেশ্বর।
বিল্ডিং-এর নিচে নেমে,
বাণেশ্বরের যা হয়,
নিজের গন্তব্য বা
কর্তব্য স্থির করতে
পারে না সে। হঠাৎ তার
চোখ পড়ে তাদের
বিল্ডিং-এর গেট-এর
সামনে ব’সে থাকা
প্যাকাঁটে বুড়ো
সিকিউরিটি গার্ড
নিধিরামের দিকে। ‘আরে!’
ভাবে বাণেশ্বর, ‘এতদিন
নিধিরামকে এই
পার্সেলগুলো কে দিয়ে
যাচ্ছে, সে ব্যাপারে
প্রশ্ন করার কথা মাথায়
আসেনি কেন?’ সে
নিধিরামের দিকে এগিয়ে
যায়। প্রথমে “কেমন আছো
নিধিরাম?” ব’লে আলাপ
জমায়। কষ্ট হয় এসব করতে
বাণেশ্বরের, “বাড়ির সব
ভালো তো?” কিংবা “এবার
দেখো, হেভি গরম পড়বে”
ইত্যাদি বলতে, কিন্তু
তবুও তা করে সে।
নিধিরাম একটু ঘাবড়ে
যায় প্রথমটা, কারণ
ফ্ল্যাট নম্বর টু/এ-র এই
মাস্টারকে আজ পর্যন্ত
তার সঙ্গে একটাও কথা
বলতে দ্যাখেনি সে। সে
‘হুঁ’, ‘হাঁ’, ‘জরুর’
ব’লে উত্তর দিয়ে যায়।
অবশেষে মতলব কি বাৎ-এ
পৌঁছয় বাণেশ্বর। চাপা
গলায়, অত্যন্ত
সতর্কভাবে, যেন
সমুদ্রতীরে দেশলাই
জ্বালিয়ে সিগারেট
ধরাচ্ছে, এমন ভঙ্গিতে
জিজ্ঞাসা করে, “আচ্ছা
নিধিরাম, এই সাতটা
নাগাদ, মানে সকাল সাতটা
আরকি, কাউকে আমাদের
বিল্ডিং-এ ঢুকতে
দেখেছিলে? হাতে একটা
বাক্স ছিল।” নিধিরাম
সরাসরি উত্তর না দিয়ে
ভুরু কুঁচকে বলে, “কেন
বলুন তো?” বাণেশ্বর
ঘাবড়ে যায়, তার ভয় হয়,
নিধিরাম বুঝি আঁচ করতে
পেরেছে কিছু। সে
কিছুক্ষণ ভাবার চেষ্টা
ক’রে, তারপর কিছুই ভেবে
না পেয়ে বলে, “না মানে...
একটু দরকার ছিল।”
নিধিরাম ঘাড় নাড়ে
প্রথমে, তারপর বলে,
“নেহি সাব, আমার ডিউটি
তো সকাল আটটা থেকে শুরু
হয়। নাইট ডিউটিতে থাকে
নেপাল। সাতটায় কেউ
এসেছিল কি না, বললে ও-ই
বলতে পারবে।” নেপালের
নাম সত্যিই নেপাল, নাকি
সে নেপালি ব’লেই তাকে
নেপাল নামে ডাকা হয়, তা
বাণেশ্বর জানে না।
কিন্তু নিধিরাম যে কিছু
বলতে পারে না, তার জন্য
বাণেশ্বরের বুক থেকে
একটা চাপা ভার নেমে
যায়। অজানার মধ্যে যে
একটা যা-ইচ্ছে ভেবে
নেওয়ার অনির্দেশ্য
নিশ্চিন্তি রয়েছে, তা
সে অনুভব করে।
নিধিরামকে হালকা গলায়
“আচ্ছা, নেপাল এলে ওকে
একটু জিগেস ক’রো তো মনে
ক’রে” ব’লে সে বিল্ডিং
প্রেমিসেসের বাইরে
বেরিয়ে আসে। রাস্তায়
দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ
এদিক-ওদিক তাকানোর পর
সে হঠাৎ হাঁটা দেয়
তাদের লোকাল পি.এস.
তিলজলা থানার দিকে।
থানায় পৌঁছে অনেকক্ষণ
ধ’রে বাইরের সিঁড়িতে
পা ঘষে সে, তারপর ভেতরে
ঢুকে খোঁজ নিয়ে
কনসার্নিং এএসআই-এর
টেবিলের সামনের
দাঁড়িয়ে বলে, “আমি
একটা মিসিং পারসনস
ডায়রি করতে চাই।”
অফিসার বলে, “বসুন।”
তারপর বলে, “জিডি করবেন,
না এফআইআর?” বাণেশ্বর,
যথারীতি, বুঝতে পারে
না। তখন এএসআই বলে,
“মানে অ্যাবডাকশন,
ইলোপ, বা সাসপেক্টেড
মার্ডার—এই ধরনের কেস,
নাকি জেনারেল মিসিং?”
বাণেশ্বরের গলায় ব্যাঙ
লাফায়, সে বলে, “হ্যাঁ।
মানে ওই জেনারেল।”
এএসআই বলে, “কমপ্লেইন্ট
লেটার এনেছেন?”
বাণেশ্বর ‘এই যাঃ!’
বলার মতো ক’রে বলে, “না,
ওটা আনা হয়নি।” অফিসার
ফাইল ঘেঁটে একটা কাগজ
বার ক’রে বাণেশ্বরের
সামনে রেখে বলে, “নিন,
একটা স্যাম্পেল দিলাম।
এটা দেখে লিখে দিন।”
তারপর বলে, “না দিলেও
চলে, তবে রিটন
কমপ্লেইন্ট থাকলে
সুবিধাই হয়।” বাণেশ্বর
চিঠিটা প’ড়ে মাম্পি
ঘোষ, এইজ সেভেনটিন
ইত্যাদির বদলে শরণ্যা
সেনগুপ্তা, এইজ
টুয়েন্টি সিক্স এইসব
লিখে চিঠিটা অফিসারের
হাতে ধরিয়ে দেয়। অফিসার
চিঠিটা পড়ে, এবং এক
জায়গায় থেমে গিয়ে বলে,
“রিজাইডিং অ্যাট ইডেন
টলি গার্ডেনিয়া,
টলিগঞ্জ!” তারপর
বাণেশ্বরের দিকে
তাকিয়ে বলে, “আপনি
কোথায় থাকেন?” বাণেশ্বর
বলে, না-বললেও-চলত
এমনভাবে, “এই কাছেই,
গ্রিন হেভেন নামে একটা
বিল্ডিং উঠেছে না, ওর
ফার্স্ট ফ্লোরে।
রেন্টে।” অফিসার
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে
বাণেশ্বরের দিকে, তারপর
বলে, “উনি কি এখান থেকেই
মিসিং হয়েছেন?” “না তো”
বলে বাণেশ্বর। অফিসার
তখন বলে, “তাহলে তো
আমাদের কিছু করার নেই,
টলিগঞ্জ পি.এস.-এ যান।”
বাণেশ্বর, কী বলব, কথাটা
শুনে সত্যিকারের
রিলিভড ফিল করে। বলে,
“ওওও, আমি জানতাম না।”
ব’লে উঠে পড়ার উদ্যোগ
নেয়। কিন্তু এএসআই
কমপ্লেইন্ট লেটারটা
ফিরিয়ে দিতে গিয়েও দেয়
না। চিঠিটার দিকে
তাকিয়ে থেকে বলে,
“মিসিং সিন্স ফার্স্ট
ডিসেম্বর?” খাদের
কিনারে দাঁড়ানো
মানুষের মতো ক’রে
বাণেশ্বর বলে, “হ্যাঁ।”
অফিসার ভুরু কুঁচকোয়,
এবং বলে, “তা এই তিনমাসে
কোনও জিডি হয়নি?”
বাণেশ্বর বলে, “না”,
তারপর বলে, “মানে আমি
ঠিক জানি না। হ’তেও
পারে।” অফিসার সূচালো
চোখে বাণেশ্বরকে লক্ষ
করে, এবং বলে, “আপনার
সঙ্গে এনার রিলেশনটা
কী?” বাণেশ্বরের বলা
উচিৎ ছিল “কিছু না”,
কিন্তু তা তো আর বলা যায়
না, সেটা, এমনকি,
বাণেশ্বরও জানে। তাই সে
বলে, “ফ্রেন্ড। মানে
বন্ধু আরকি।” অফিসার
বলে, “তা এনার
ফ্যামিলির কেউ এর মধ্যে
ডায়রি করেনি?” বাণেশ্বর
একটানা এত কথা বলতে,
বিশেষত প্রশ্নের উত্তর
দিতে অভ্যস্ত নয়। তার
ক্লান্তি বোধ হয়। সে
বলে, “বললাম তো, জানি না।
হ’তেও পারে।” অফিসার
বলে, “স্ট্রেঞ্জ!” ব’লে
পুনরায় চিঠিটার দিকে
তাকায়, এবং বলে,
“ফার্স্ট ডিসেম্বর
কোথা থেকে মিসিং হলেন
উনি?” বাণেশ্বর মনে হয়
ঘুমিয়ে পড়বে, তার হাই
ওঠে, সে বলে, “জানি না
ঠিক। তবে ওই ফার্স্ট
ডিসেম্বরের পর থেকে
আমার সঙ্গে আর কোনও
যোগাযোগ হয়নি
শরণ্যার।” অফিসার বলে,
“আশ্চর্য! আপনার সঙ্গে
যোগাযোগ হয়নি ব’লে আপনি
মিসিং পারসনস ডায়রি
করতে চ’লে এলেন?” তারপর
বলে, “তার আগের দিন
পর্যন্ত আপনার সঙ্গে
কথাবার্তা, মেসেজ বা
দেখাসাক্ষাৎ হয়েছিল?”
বাণেশ্বর বলে, “না।
আমার সঙ্গে অনেকদিন
থেকেই যোগাযোগ নেই
কোনও”, বলতে বলতে তার
ঘাড় নত হয়ে আসে।
অফিসার বলে, “গোটা
ব্যাপারটাই আমার
অদ্ভুত লাগছে। আপনার
বান্ধবী, যার সঙ্গে
দীর্ঘদিন আপনার
যোগাযোগ নেই, সে
ফার্স্ট ডিসেম্বর থেকে
মিসিং, এ ব্যাপারে এত
সিওরই বা আপনি হচ্ছেন
কী ক’রে আর হঠাৎ মিসিং
পারসনস ডায়রিই বা করাতে
আসছেন কেন?” এ কথায়
বাণেশ্বর হঠাৎ যেন
শিকলছেঁড়া উন্মাদের
মতো চেয়ার ছেড়ে উঠে
দাঁড়ায়, তার দাঁড়ানোর
অভিঘাতে চেয়ার উল্টে
পেছনে প’ড়ে যায়, আর
বাণেশ্বর লাফিয়ে সোজা
টেবিলের ওপর উঠে পড়ে,
তারপর জংলি কুত্তার মতো
হাঁটু গেড়ে ব’সে
অফিসারের কলার চেপে
ধরে, এবং গ্রাউলিং
ভয়েসে ব’লে চলে, “বিকজ
শি ওয়াজ ওয়ান্স মাই
ফিয়ান্সে ইউ সান অফ আ
বিচ। বাট দেন শি হ্যাড
গট হার আ নিউ বয়ফ্রেন্ড,
হু ইজ আ সার্জন বাই
প্রফেশন, অ্যান্ড হু
আউট অফ শিয়ার জেলাসি
অ্যান্ড গ্রাজ
অ্যাবাউট আওয়ার পাস্ট
রিলেশন, হ্যাজ কিলড কার,
কাট হার ইনটু পিসেস,
অ্যান্ড নাউ সেনডিং আর
বডি পার্টস টু মি ইন
রেগুলার
ইনস্টলমেন্টস।”
কিন্তু আদপে, বলা
বাহুল্য, এসব কিছুই ঘটে
না। কারণ একটা স্টোরির
‘লজিক্যাল’ হওয়ার দায়
রয়েছে। এসব ইললজিক্যাল
জিনিসপত্রের বোঝা
আমাদের ‘স্টোরি’ ঘাড়ে
নেবে কেন? কাজেই
বাণেশ্বর অফিসারের
কথার কোনও উত্তর
না-দিয়ে কেবল হাত
বাড়িয়ে বলে, “আপনি বরং
চিঠিটা আমায় দিন। আমি
টলিগঞ্জ পি.এস.-এই যাই
একবার।” এএসআই চিঠিটা
ফেরত দিয়ে দেয়। থানার
বাইরে এসে বাণেশ্বর আর
কিছু ভাবে না, কারণ আর
কিছুই ভাবার থাকে না
তার, সে সোজা একটা
ছুটন্ত ট্যাক্সিকে
হাঁক দিয়ে থামায়, তারপর
দরজা খুলে সটান ভেতরে
উঠে প’ড়ে বলে, “যোধপুর
পার্ক বয়েজ স্কুল,
জলদি।” ট্যাক্সি ছুট
দেয়।
স্কুল থেকে বাড়িতে
ফিরে বাণেশ্বর অনুভব
করে, আবারও তার মাথা
ধরেছে, এবং জ্বর-জ্বর
লাগছে। ‘আজ তো বৃষ্টিতে
ভিজিনি’ ভাবে সে, ‘তবে
সারাদিন ধকল গিয়েছে
খুব’—এ-ও ভাবে।
বাণেশ্বরের পক্ষে ওই
নিধিরামের সঙ্গে কথা
বলা, থানায় যাওয়া, তারপর
স্কুল—এসব কি কম ধকল
নাকি! স্কুলে সে আজ
পৌঁছেছিল এগারোটা
চল্লিশ নাগাদ। তাকে
দেখে ভৌমিক বলেছিল,
“আরে! এই সকালে বললে
জ্বর হয়েছে, আসবে না।
আবার এসেও গেলে!”
বাণেশ্বর বলেছিল,
“হ্যাঁ স্যার, একটা
প্যারাসিটামল খেলাম,
অনেকটা ঠিক লাগল
শরীরটা, ভাবলাম চ’লে
যাই।” “ভালোই করেছ”
ব’লে ভৌমিক
অ্যাটেন্ডেন্স
রেজিস্টারটা এগিয়ে
দিয়ে বলেছিল, “নাও, সই
ক’রে দাও। এখনও বারোটা
বাজেনি, অ্যাবসেন্ট
করিনি এখনও। শুধু শুধু
একটা ইএল নষ্ট করবে
কেন। সাড়ে দশটা লিখেই
সই করো। আর এইট-সি-র
স্টুডেন্টস
অ্যাটেন্ডেন্সে আজকের
ডেট-এ একটা সই ক’রে
সেকেন্ড পিরিয়ডের রোল
কল ফলো ক’রে যাদের
প্রেজেন্ট ক’রার ক’রে
দিও নাহয়।” বাণেশ্বর
তা-ই করেছিল, কিন্তু
ভৌমিকের এই বদান্যতায়
কৃতজ্ঞতা বোধ করতে
পারেনি। কারণ সে নিজে
না জানলেও এই কাহিনির
ন্যারেটর জানে, কারণ
এটুকু তাকে জানতেই হয়,
যে, কিশোর কুমারের
প্রতি ছাড়া আর কারো
প্রতি কৃতজ্ঞ হ’তে
বাণেশ্বর শেখেনি।
টিফিন টাইমে যথারীতি
ব্রতীন বাণেশ্বরের
পাশের চেয়ারে এসে
বসেছিল। বাণেশ্বরের
সঙ্গে তার কোনও কথা
হওয়ার আগেই ইংলিশের
জনার্দন সমাদ্দার, যে
কিনা তার এক একটি টিউশন
ব্যাচে একসঙ্গে
বাহান্ন জন
স্টুডেন্টকে সালটে
দেওয়ার ক্ষমতা রাখে,
সেই সমাদ্দার, হেঁড়ে
গলায়, সবাই যাতে শুনতে
পায় এমনভাবে, ব্রতীনকে
বলেছিল, “কী হে ব্রতীন,
ফিনান্সিয়াল ইয়ার তো
শেষ হয়ে এলো। ট্যাক্স
সেভিংগস-এর কী হাল?”
ব্রতীন বলেছিল, “কত আর,
ওই আশি-নব্বই হবে।”
সমাদ্দার বলেছিল, “আমি
আজই পিপিএফ-এ পুরো দেড়
লাখ ঢুকিয়ে দিলাম। তার
ওপর তোমার ধরো জিপিএফ,
এলআইসি, মেডিক্লেম—এসব
তো আছেই। তবু রিস্ক
নিলাম না, পিপিএফ-এই
সোজা দেড় লাখ। একেবারে
নিশ্চিন্ত।” ব’লে
হেসেছিল সমাদ্দার, সফল
মানুষের হাসি, যা দেখে,
কেন কে জানে, বাণেশ্বর
মনে মনে বলেছিল,
‘বহিনচোৎ’। ব্রতীনও
সমাদ্দারের কথায় হেসে
অতঃপর বাণেশ্বরের দিকে
ঘুরে জানতে চেয়েছিল,
“আজ কী?” বাণেশ্বর
যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত
বিস্তারে যা বলার
বলেছিল। থানার
ব্যাপারটাও। শুনে
ব্রতীন বলেছিল, “তা
টালিগঞ্জ থানাতেই না হয়
যেতে একবার।” অত ঝক্কি
পোষাত না বাণেশ্বরের,
ব্রতীন না জানলেও
বাণেশ্বর সেটা জানে।
কিন্তু সেকথা তো
ব্রতীনকে বলা যায় না,
তাই সে বলে, “আমি আর
পুলিশের চক্করে পড়ছি
না। বাবাঃ, যা সব
ত্যাড়াব্যাঁকা
প্রশ্ন, আমার বিচি
এমনিতেই নকুলদানা হয়ে
থাকে, এবার একেবারে
মিহিদানা হয়ে
গিয়েছিল।”
অকালবৈরাগ্যের হাসি
হেসে ওঠে ব্রতীন, বলে,
“তুমি পারোও
বাণেশ্বরদা।” বাড়িতে
ফিরে অন্ধকার ঘরে শুয়ে
বাণেশ্বর ভাবার চেষ্টা
করছিল, মানে যতটুকু তার
ভাবনায় কুলোয় আরকি, যে,
ব্রতীনকে, শুধুমাত্র
ব্রতীনকেই সে এই সমস্ত
ঘটনা প্রমথাবধি ব’লে
চ’লেছে কেন? যাদবপুরে
এমএসসি পড়ার সময়
ব্রতীন ছিল বাণেশ্বরের
এক বছরের জুনিয়র, সেই
সুবাদে মুখ চেনা,
সামান্য দু’-একটা কথা
হয়তো, ওই বাণেশ্বর
যতটুকু বলতে পারে।
ইউনিভার্সিটি ছাড়ার
পর আর কোনও যোগাযোগ ছিল
না ব্রতীনের সঙ্গে।
কিন্তু বিএড, এসএসসি
সেরে এই স্কুলে যখন সে
জয়েন করল তখন দেখল,
ব্রতীন সেখানে আগেই
ঢুকে ব’সে আছে। আসলে
বি.এড. করেনি, উপরন্তু
এস.সি. কোটা, ফলত স্কুলের
নিরিখে ব্রতীনই সিনিয়র,
জুনিয়র বরং বাণেশ্বরই।
সম্পূর্ণ অচেনা মহলে
একটি মাত্র চেনা মুখ
পেয়ে তাকেই সম্বল
করেছিল বাণেশ্বর। তার
সঙ্গেই, সখ্য ঠিক নয়,
কথালাপটুকু অন্তত
অব্যাহত রেখেছিল, এবং
এখনও রেখে চলেছে। সেই
সঙ্গে, নিজের মনের
গভীরে, বাণেশ্বর জানে
না, কিন্তু ন্যারেটরকে
এই সব টুকরো-টুকরা খবর
কিঞ্চিৎ জানতেই যেহেতু
হয়, সেহেতু ন্যারেটর
বলতে পারে, ব্রতীনকে
ঈর্ষা করে বাণেশ্বর।
শুধু তার বিএড-হীন
কোটার চাকরির জন্য নয়,
সেই সঙ্গে তার
স্ত্রীপুত্র সমন্বিত
একটি সম্পূর্ণাঙ্গ
পরিবারের অধিকারী
হওয়ার কারণেও।
সম্পূর্ণতা সর্বদাই
একটি প্রার্থিত বিষয়
বাণেশ্বরের কাছে। সেটা
যেখানে বা যার মধ্যে
দ্যাখে সে, সেখানে তার
মনে ঝাঁপবদ্ধ সাপের মতো
বেঁচে থাকে ঈর্ষা। অথচ
এই অসূয়াই, কী আশ্চর্য,
ব্রতীনকে যেন আরও আপন
ক’রে তোলে তার।
বাণেশ্বরের মনে হয়, তার
সান্নিধ্যের মধ্যে
দিয়ে ব্রতীনের পূর্ণতর
জীবনের কিছুটা অংশভাগী
হ’তে পারছে সে-ও। কথাটা
একবার শরণ্যাকেও
বলেছিল সে, বলেছিল,
“আমাদের বিয়ের পর, দেখো,
আমরা ব্রতীনদের মতো
ক’রে থাকব। ওদের মতো
ক’রে ঘর সাজাব, তুমি ওর
বউয়ের মতো আমার টিফিন
ভ’রে দেবে ব্যাগে।
সন্ধেবেলা ডিভিডি-তে
সিনেমা দেখব।” শরণ্যা
অম্নি, যেন মাছি
তাড়াচ্ছে, এমনভাবে
বলেছিল, “হেল টু ইয়োর
ব্রতীন। আমরা থাকব
আমাদের মতোন। আমাদের
ইউনিক স্টাইলে। আর
তোমার জন্য রোজ টিফিন
বানাতে গেলে, আমার
চাকরিটার কী হবে,
অ্যাঁ?” ভ্রুযুগে
বিদ্যুতরেখা হেনে
বলেছিল শরণ্যা। কথাটা
মনে আসতেই, হঠাৎ কী থেকে
কী, বাণেশ্বরের মনে
প’ড়ে গেল, সত্যিই তো,
চাকরি তো একটা করত
শরণ্যা। কুক-টুক কিচেন
চিমনির কাস্টোমার
কেয়ার সেকশানে, মানে ওই
কাস্টোমারদের
এনক্যোয়ারি, অভিযোগ,
“আমার চিমনি দিয়ে ধোঁয়া
উল্টোদিকে রান্নাঘরেই
নেমে আসছে,” “অটোক্লিনে
কই ফুল ক্লিন তো হচ্ছে
না”, ব্লা ব্লা, এইসব
শোনা আর নোট ডাউন করা।
বাণেশ্বরের মনে হলো,
শরণ্যার খোঁজে সেখানে
একবার ফোন ক’রে দেখলেই
তো হয়। আর কিছু না ভেবে
মোবাইল বার ক’রে গুগল
সার্চে গিয়ে কুক-টুক
কাস্টোমার কেয়ারের
নাম্বার খুঁজে বার করে
বাণেশ্বর। নিজের মধ্যে
এই অভূতপূর্ব তৎপরতা
লক্ষ ক’রে তার তেমন
বিস্ময় বোধ হয় না, বরং
খুঁজে পাওয়া নম্বরটা
ডায়াল করার সময় তার
বুকের মধ্যে আলাদা
রকমের কোনও ধুকপুকুনি
হচ্ছে না দেখেই আশ্চর্য
হয় সে। কুক-টুকের
টুয়েন্টি-ফোর সেভেন
সার্ভিস, জানে
বাণেশ্বর, শরণ্যারও
মাঝে মাঝে নাইট শিফট
পড়ত। কাজেই কেউ না কেউ
ফোন তুলবেই। তুললও।
একটি মেয়েলি কণ্ঠ,
শরণ্যার নয়, বলাই
বাহুল্য, মাখনঢালা গলায়
বলল, “ওয়েলকাম টু
কুক-টুক কিচেন চিমনি
কাস্টোমার কেয়ার
সার্ভিস। হাউ মে আই
হেল্প ইউ?” বাণেশ্বর
একবার গলাটা পরিষ্কার
ক’রে নিলো, নিয়ে বলল,
“অ্যাকচুয়ালি আই অ্যাম
লুকিং ফর শরণ্যা
সেনগুপ্তা। ক্যান ইউ
পুট হার অন লাইন প্লিজ?”
মাখকনণ্ঠী বলল, “হোয়াটস
ইয়োর প্রবলেম স্যার, ইউ
মে টেল মি, আই অ্যাম
প্রেজেন্টলি ইয়োর
কাস্টোমার
এগজিকিউটিভ।” “না
মানে”, ইংরেজি গুলিয়ে
যায় বাণেশ্বরের, সে বলে,
“আসলে শরণ্যার সঙ্গে
আমার একটু পার্সোনাল
কথা আছে, হুইচ হ্যাজ
নাথিং টু ডু উইথ ইয়োর
বিজনেস। সো আই
রিকোয়েস্ট ইউ টু পুট
শরণ্যা অন লাইন
প্লিইজ।” মেয়েটির
মাখনকণ্ঠ যেন গ’লে যায়
একেবারে, সে বলে, “স্যার,
এটা পার্সোনাল
কনভার্সেশনের জায়গা নয়
কিন্তু। আমাদের সমস্ত
কল রেকর্ডেড হয়, হায়ার
অথোরিটি জানতে পারলে,
উই উড বি ইন বিগ
ট্রাবল।” বাণেশ্বর চুপ
ক’রে রইল, মাখনকণ্ঠীও।
তারপর মেয়েটি বলল, “তবে
আপনাকে এইটুকু জানিয়ে
রাখিয়ে স্যার, শরণ্যা
হ্যাজ লেফ্ট দা জব,
অ্যাবাউট থ্রি মান্থস
অ্যাগো।” বাণেশ্বর, যেন
মর্মে আহত, এমনভাবে বলল,
“ওহ! দেন ক্যান ইউ টেল মি
হোয়্যার ইজ সি ওয়ার্কিং
নাউ?” “নো স্যার, সরি
স্যার” ব’লে মেয়েটি
“ওকে স্যার, হ্যাভ আ
নাইস ইভনিং।” ব’লে লাইন
কেটে দিলো। রাত্রে
খাওয়া শেষ ক’রে দুটো
প্যারাসিটামল এবং দুটো
অ্যালজোলাম একসঙ্গে
গিলে শুতে যাওয়ার আগে
ব্রতীনের একটা কথা মনে
পড়ল বাণেশ্বরের। আজ
টিফিন টাইমে ব্রতীন
বলছিল, “অনেক ভেবে
দেখলাম বাণেশ্বরদা,
শরণ্যার খোঁজ পাওয়ার
দুটোই রাস্তা। এক, সোজা
ওর বাড়িতে গিয়ে হাজির
হওয়া। আর দুই, কোনওভাবে
সিদ্ধার্থ মুখার্জীর
কাছে পৌঁছনো।” এই বিষয়
দুটো বাণেশ্বরেরও যে
মাথায় আগে আসেনি, তা নয়।
কিন্তু যে নিদ্রার্তি,
যে অবসাদ, যে ক্লান্তি
তাকে সর্ব দিবসরাত্রি
পঙ্গু ক’রে রাখে তারই
প্রগলভতায় সে কিছু ক’রে
উঠতে পারেনি এতদিন।
তাছাড়া, সত্যি বলতে কী,
শরণ্যার এগজ্যাক্ট
অ্যাডড্রেস সে জানেও
না। শরণ্যার বাড়ি
কোনওদিন যায়নি সে।
অনেকবার নিজে থেকেই আগ
বাড়িয়ে যেতে চেয়েছে,
আবদার যেন-বা, কিন্তু
সেকথা শুনেই শরণ্যা
লেজে-পা-পড়া সর্পিনীর
মতো হিলহিলিয়ে উঠে
বলেছে, “ওরে বাবা, ওই
চেষ্টাও ক’রো না। আমার
বাবা-মা প্রচণ্ড
কনজার্ভেটিভ, তোমাকে
নিয়ে গিয়ে হাজির করলে
আমাদের রিলেশনটাই
কেঁচে যাবে। একেবারে
বিয়ের কথা বলতে যেও,
কেমন” ব’লে
আঁধারবিদারী হাসি
হেসেছে শরণ্যা। ফলত তার
বাসস্থান সম্পর্কে
বিস্তারিত কিছুই জানা
হয়নি বাণেশ্বরের। শুধু
টলি গার্ডেনিয়া নামের
কমপ্লেক্সের একটি
ফ্ল্যাটে শরণ্যারা
থাকে, এটুকু সে
জেনেছিল। আজ সকালে
থানায় মিসিং পারসনস
কমপ্লেইন্ট লেখার সময়ও
সেইটুকুই লিখেছিল।
এমনকি সেই চিঠিতে
শরণ্যা সম্পর্কে ডটার
অফ জয়দ্রথ সেনগুপ্তা
লিখলেও আদপে বাণেশ্বর
শিওর নয় যে, শরণ্যার
বাবার নাম জয়দ্রথই।
জয়ব্রত হ’তে পারে, অথবা
জয়দেবও। বাণেশ্বর মনে
করতে পারে না। তবে
ভদ্রলোক ইসিএল-এ কাজ
করতেন, এখন রিটায়ার
করেছেন—এটুকু সে
শুনেছিল শরণ্যার মুখে,
অনেকবার, তাই মনে আছে।
সেই কেঁচো পরিমাণ সূত্র
ধ’রে আসল কেউটের খোঁজে
কি যাওয়া যায়? ভাবতে
ভাবতে বাণেশ্বরের মনে
হলো, অ্যাটলিস্ট চেষ্টা
ক’রে দেখতে অসুবিধা কী?
ক্ষতি তো নেই কিছু। সে
স্থির করল, আগামী
রবিবার টলি
গার্ডেনিয়ায় গিয়ে সে
হাজির হবে। তারপর যা
হওয়ার হয়ে যাবে—এসপার
কিংবা ওসপার। ভেবে কানে
ইয়ারফোন গুঁজে “আ চলকে
তুঝে ম্যায় লেকে চলুঁ”
গানটা অনন্ত লুপে দিয়ে
সে ঘুমিয়ে পড়ল।
রবিবার তার ঘুম ভাঙল
অন্যদিনের থেকে একটু
আগেই। উঠে দাড়ি
কামিয়ে, স্নান সেরে
বিল্ডিং থেকে বেরোচ্ছে,
দ্যাখে, গেটের সামনে
টুলে নেপাল ব’সে।
মোবাইল বের ক’রে
বাণেশ্বর জানল, সাড়ে
সাতটা বেজেছে। অর্থাৎ
নিধিরামের ডিউটি আওয়ার
এখনও শুরু হয়নি। ‘ভালোই
হলো’, মনে মনে বলল
বাণেশ্বর। সে নেপালের
সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই
নেপাল উঠে দাঁড়িয়ে
মিলিটারি কায়দায় সেলাম
ঠুকে বলল, “গুড মর্নিং,
সাব।” “মর্নিং” বলল
বাণেশ্বর। নেপালের
সঙ্গে এই প্রথম কোনও
বাক্যালাপ করছে সে,
কাজেই নেপাল নিজেই কথা
শুরু করায় তার বরং
সুবিধাই হলো। সে
নেপালের কুতকুতে চোখ
দুটোর দিকে কিছুক্ষণ
তাকিয়ে থেকে বলল,
“আচ্ছা নেপাল, তোমার
নাম কি সত্যিই নেপাল,
নাকি তোমার দেশ নেপালে
ব’লে তোমাকে সবাই নেপাল
ব’লে ডাকে?” নেপাল বলল,
“সত্যিই নেপাল, সাব।”
“হুম” ব’লে কিছুক্ষণ
চুপ ক’রে রইল বাণেশ্বর।
তারপর বলল, “আচ্ছা
নেপাল, একটা কথা বলতে
পারো, তুমি তো সকালে
ডিউটিতে থাকো, প্রতি
বুধবার ঠিক সাতটার সময়
কোনও ছেলেকে হাতে একটা
কার্ডবোর্ডের বাক্স
নিয়ে বিল্ডিং-এর ভেতরে
যেতে দেখেছ কখনও?”
নেপাল বলল, “হাঁ, সাব।”
বাণেশ্বর দেখল, এই
উত্তরে সে খুশি হ’তে
পারছে না, বরং তার
হৃৎপিণ্ড একটা
ময়ালগ্রাসে গ্রস্ত
হ’তে শুরু করেছে আচমকা।
সে বলল, “কে নেপাল? কে
যায় প্রতি বুধবার?
কার্ডবোর্ডের বাক্স
নিয়ে? তাকে চেনো তুমি?”
“জি, সাব।” ব’লে চুপ
ক’রে গেল নেপাল। কিন্তু
বাণেশ্বরের মুখ দিয়ে আর
কোনও প্রশ্ন বেরলো না
কিছুতেই, তার মনে হলো,
অনেক প্রশ্ন সে ক’রে
ফেলেছে, সে কেবল গয়টার
রুগীর চোখ নিয়ে তাকিয়ে
রইল নেপালের দিকে।
নেপাল তার ‘সাব’-এর
অবস্থাটা অনুমান করেই
বলল, “পঞ্চু যায় সাব, ঠিক
সাতটায়, হাতে
কার্ডবোর্ডের বাক্স
থাকে।” বাণেশ্বরের চোখ
দুটো মনে হলো কোটর থেকে
ফেটে বেরিয়ে আসবে। সে
কোনওক্রমে বলল, “পঞ্চু?
কে পঞ্চু?” “ওই যে সাব,
ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে দুধ
দেয়,” বলল নেপাল, “শুধু
বুধবার নয়, রোজই আসে, ঠিক
সাতটায়। হাতে বাক্স
থাকে, তাতে দুধের
প্যাকেট রাখা থাকে।
ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে
দিয়ে আসে।” বাণেশ্বরের
চক্ষুদ্বয় আবার
স্বস্থানে ফিরে আসে।
“পঞ্চু ছাড়া আর কেউ
আসে না তো?” যেন না-এলেই
ভালো, এমনভাবে বলল
বাণেশ্বর। নেপাল খানিক
মাথা চুলকে বলল, “আর তো
কাউকে দেখিনি সাব।”
“বেশ” ব’লে রাস্তায়
নেমে এলো বাণেশ্বর।
একটা ট্যাক্সি ডেকে উঠে
বসল। ট্যাক্সিতে
টালিগঞ্জের দিকে এগোতে
এগোতে ভাবল, আচ্ছা, এমনও
তো হ’তে পারে যে,
পঞ্চুকেই কেউ তার
ডেলিভারি ম্যান হিসেবে
নিযুক্ত করেছে? পঞ্চুর
হাতে পয়সা গুঁজে দিয়ে
হিসহিসে গলায় বলেছে,
দুধ তো সব ফ্ল্যাটেই
দিস, শুধু টু/এ-র সামনে
এই পার্সেলটা নামিয়ে
কলিং বেল বাজিয়ে পালিয়ে
আসবি। হ’তেই পারে
এমনটা, কিন্তু এমনটা না
হ’লেই যেন ভালো হয় ব’লে
মনে হলো বাণেশ্বরের।
মানুষের জীবনে কিছু
রহস্য অমীমাংসিতই থাকে,
অমীমাংসিত থাকাই ভালো
হয়। কারণ মীমাংসার অভাব
মানুষকে অপেক্ষায় রাখে,
আর অপেক্ষার থেকে বড়ো
কাজ মানুষের পক্ষে আর
কিছু হয় না। অকর্মণ্য
বাণেশ্বর সেরকম একটা
কাজেই নিজেকে নিযুক্ত
করতে চায়। কাজেই কে
পঞ্চু, কে ডেলিভারি
ম্যান, কে শরণ্যার খুনী,
কে তাকে কেটে টুকরো
টুকরো করছে—এসব জেনে কী
লাভ! তার চেয়ে চলুক না,
যেমন চলছে। ভেবে হঠাৎ
মনে হলো বাণেশ্বরের,
ট্যাক্সি থামিয়ে সে
নেমে পড়ে। যেটুকু পথ
এগিয়েছে, সেটুকু হেঁটে
ফেরে। কিন্তু ট্যাক্সি
থামাতে গেলে
ড্রাইভারকে বলতে হবে,
‘থামো ভাই’, বলতে হবে,
‘আমি এখানেই নেমে যাব’,
ড্রাইভার হয়তো ঘাড়
ঘুরিয়ে বলবে, ‘এই তো
বললেন, টালিগঞ্জ
যাবেন’, তখন আবার তাকে
ব্যাখ্যা দিতে হবে, কেন
সে টালিগঞ্জ যাবে না,
হয়তো বলতে হবে, ‘শরীরটা
হঠাৎ খারাপ লাগছে’,
কিংবা, ‘কী জানো ভাই, খুব
জরুরি একটা কাজ মনে মনে
পড়ে গ্যাছে হঠাৎ’—এত
সবের ধকল বাণেশ্বরের
সইবে না। তার চেয়ে যা
হচ্ছে, হোক। দ্যাখাই
যাক না, ব্যাপার শেষ
পর্যন্ত কী দাঁড়ায়।
রবিবারের ভোরের
রাস্তায় হু হু ক’রে
ট্যাক্সি দৌড়ে
কিছুক্ষণের মধ্যেই
বাণেশ্বরকে পৌঁছে দিলো
টলি গার্ডেনিয়ার
সামনে। গেটের সামনে
দাঁড়িয়ে ঘাড় উঁচু করল
বাণেশ্বর, কারণ টলি
গার্ডেনিয়া এমন একটা
কমপ্লেক্স যার
অন্তর্গত টাওয়ারগুলোর
শীর্ষদেশ দ্যাখার জন্য
ঘাড় উঁচু করতে হয়।
‘জাঁকালো ব্যাপার’ মনে
মনে ব’লে গেটের দিকে
এগোলো সে। মূল গেটটা
বড়ো, গাড়ি আসা-যাওয়ার
জন্য, সেটা বন্ধ রয়েছে,
পাশে ছোট একটা গেট খোলা,
মানুষ হেঁটে ভেতরে যেতে
পারবে, গরু বা
কুকুর-বেড়াল পারবে না,
কারণ তলায় ফাঁক-ফাঁক
পাইপ দেওয়া রয়েছে। সেই
ছোট গেটের পাশেই
গার্ডের গুমটি।
বাণেশ্বর সোজা ভেতরে
ঢুকে যাচ্ছিল, হঠাৎ
গুমটির ভেতর থেকে
উর্দিধারী এক শের
পালোয়ান ভীমসিং বেরিয়ে
এসে হাঁড়ি গলায় বলল,
“কোথায় যাবেন, দাদা?” এই
তো মুশকিল! কোথায় যাবে
এখন বলে কী করে
বাণেশ্বর! সে বলল,
“শরণ্যা সেনগুপ্তার
ফ্ল্যাটে।” “শরণ্যা
সেনগুপ্তা!”—নামটা যেন
প্রথম শুনছে এমনভাবে
তাকিয়ে থাকে ভীমসিং।
তারপর বলে, “কত নম্বর
বলুন তো?” বাণেশ্বর বলল,
“নম্বরটা তো জানি না।”
“নম্বর না জানলে যাবেন
কী ক’রে? এখানে এন্ট্রি
বুকে আপনাকে ফ্ল্যাট
নাম্বার, পারপাস সব
লিখে ইন-টাইম দিয়ে সই
ক’রে যেতে হবে তো”,
ভীমসিং বলে। বাণেশ্বর
পঙ্গু ভিখারি হয়ে চুপ
ক’রে দাঁড়িয়ে থাকে।
এমন সময়, যেন অবিকল
পাহাড়ী সান্যাল, এমন
এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক
কমপ্লেক্সের ভেতর থেকে
হেঁটে এসে বাণেশ্বরের
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে
অবিকল ছবি বিশ্বাসের
গলায় বলে, “কী ব্যাপার,
কাকে খুঁজছেন?”
বাণেশ্বরের হয়ে
ভীমসিং-ই উত্তর দেয়, বলে,
“এই যে স্যার, উনি
শরণ্যা সেনগুপ্তার
ফ্ল্যাট খুঁজছেন।”
“শরণ্যা?” পাহাড়ী
সান্যালের ভুরু কুঁচকে
যায়, বলে, “ওই নামের
কাউকে তো...” তারপর বলে,
“শরণ্যা সেনগুপ্তার
নামেই ফ্ল্যাট কি?
তিনিই ওনার?” বাণেশ্বর
বলে, “না বোধহয়, ওর বাবার
নামে ফ্ল্যাট।” “কী নাম
বাবার?” পাহাড়ী
সান্যাল জানতে চায়।
“ঠিক মনে নেই” বলে
বাণেশ্বর, “জয়দ্রথ বা
জয়ব্রত—টাইপের কিছু
একটা। তবে টাইটেলটা
ডেফিনেটলি
সেনগুপ্তা।” পাহাড়ী
সান্যাল হাসে, বলে,
“দেখুন, এখানে তেরোটা
টাওয়ারের প্রতিটায়
বারোটা ফ্লোর। প্রতি
ফ্লোরে চারটে ক’রে
ফ্ল্যাট। প্রতিটা
ফ্ল্যাটই অকুপাইড। সেই
হিসেবে ছ’শ’ চব্বিশটা
ফ্যামিলি থাকে এখানে।
তাদের মধ্যে তেরো জন
রয়েছে সেনগুপ্তা।
এগজ্যাক্ট ফিগারটা
জানি, কারণ মাইসেল্ফ
অ্যাম আ সেনগুপ্তা।
কিন্তু জয়দ্রথ বা
জয়ব্রত নামের কোনও
সেনগুপ্ত এখানে নেই।
থাকলে আমি জানতাম।”
বাণেশ্বর ভাবে বলবে,
তাহলে কমপ্লেক্সটার
নাম সেনগুপ্তা কলোনি
রাখলেই তো হতো, কিন্তু
আদপে পরের কথা আর সে
খুঁজে পায় না। কিছুক্ষণ
চুপ ক’রে থেকে সে বলে,
“সত্যি বলতে কী,
ভদ্রলোকের নামটা আমার
ঠিক মনে নেই। তবে উনি
ইসিএল-এ কাজ করতেন।”
“ওওওও” ব’লে এতক্ষণে
হেসে ওঠে ছবি
বিশ্বাস-কণ্ঠী পাহাড়ী
সান্যাল, থুড়ি, মি.
সেনগুপ্তা। বলে, “আপনি
জয়রামের কথা বলছেন। ওরা
তো চ’লে গ্যাছে।”
“মানেএএএ!” বাণেশ্বরের
চোয়াল জ্যৈষ্ঠের
কুকুরের মতো ঝুলে পড়ে।
“কোথায়?” জানতে চায় সে।
“লেকটাউনে” বলে
সেনগুপ্তা, “ওদের পৈতৃক
বাড়িতে।” “কেন?”
উদভ্রান্ত হয়ে জিগেস
ক’রে ফ্যালে বাণেশ্বর।
“কেন বলতে” সেনগুপ্তা
ব’লে যায়, “জয়রামরা দুই
ভাই। বড়ো ভাই এতদিন
লেকটাউনের বাড়িটায়
ছিলেন। তো গত অগাস্টে
ভদ্রলোক মারা গেলেন।
একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে
গিয়েছে। বউদি গ্রামের
মেয়ে, মেদনীপুর সাইডের।
তিনি অতবড়ো তিনতলা
বাড়িতে একা থাকতে
চাইলেন না। তিনি চ’লে
গেলেন গ্রামে। জয়রাম
দেখল, ওরকম একটা বাড়ি
ফাঁকা ফেলে রেখে কী হবে,
তাই ফ্ল্যাট বেচে দিয়ে
চ’লে গেল লেকটাউনে।
তাছাড়া ওদের মেয়েটা,
ওই শরণ্যা না কি...”
বাণেশ্বরের হৃদিধ্বনি
শ্রুতিযোগ্য হয়ে ওঠে
শরণ্যার নামে,
সেনগুপ্তা ব’লে চলে,
“ওর অফিস ওই বাগুইহাটির
ওদিকে। কী একটা কল
সেন্টারে যেন কাজ করত
মেয়েটা। এখান থেকে রোজ
যাতায়াত করতে বেশ
অসুবিধাই হতো।
লেকটাউনে গেলে সেই
অসুবিধা নেই। তাই আর
কী...” সেনগুপ্তা কথা
অসম্পূর্ণ রেখেই থেমে
যায়। বাণেশ্বর
বেপরোয়ার মতো বলে,
“জয়রামবাবুর
নাম্বারটা একটু পাওয়া
যায়?” সেনগুপ্তার ভুরু
কুঁচকে যায়, সে বলে,
“আপনার দরকারটা ঠিক কী
বলুন তো?” বাণেশ্বর বলে,
বলতে তার কষ্টই হয়, যে,
“আসলে শরণ্যা আমার
পুরনো বন্ধু, কলেজ
ফ্রেন্ড আরকি। তো ওর
কাছে আমার কতকগুলো বই
রয়ে গিয়েছে। আমি
কর্মসূত্রে
ব্যাঙ্গালোরে থাকি।
তাই রেগুলার যোগাযোগ
নেই। ওর ফোন নাম্বারটাও
হারিয়ে ফেলেছি, আসলে এর
মধ্যে মোবাইল চেঞ্জ
করেছি তো, পুরনো
কনট্যাক্টসগুলো আর
রিট্রিভ করতে পারিনি।
এখন ক’দিনের জন্য
কলকাতায় এসেছিলাম।
ভাবলাম, এই সুযোগে যদি
বইগুলো ফেরত নেওয়া যায়।
তাই একবার খোঁজ ক’রে
গেলাম। টলি
গার্ডেনিয়ায় ও থাকে
জানতাম, কিন্তু ইন দা
মিনটাইম ওরা যে
লেকটাউনে শিফট করেছে,
সেটা জানা ছিল না।”
এতগুলো ক্রিস্টাল
ক্লিয়ার মিথ্যে যে এত
দ্রুত ব’লে যেতে পারবে
বাণেশ্বর, তা সে নিজেই
ভাবেনি। এরকমটা করতে
পারছে দেখে তার নিজের
জন্য গর্ববোধ হয়।
সেনগুপ্তা ছবি
বিশ্বাসের গলায় বলে,
“হুম। কিন্তু কী জানেন,
জয়রাম এমনিতে খুব একটা
মিশুকে ছিল না। ওদের
পাশের ফ্ল্যাটে থাকে
অরুণ চৌধুরী, ও-ও আগে
ইসিএল-এ কাজ করত। সেই
সূত্রে জয়রামের সঙ্গে
পুরনো আলাপ। ওদের সঙ্গে
জয়রামদের বেশ মেলামেশা
ছিল। অরুণের কাছে
জয়রামের নাম্বার পেলেও
পেতে পারেন। ইনফ্যাক্ট
জয়রামের এতসব খবরও
চৌধুরীর মুখেই আমার
শোনা।” বাণেশ্বর বলে,
“মিস্টার চৌধুরীর
ফ্ল্যাট নাম্বারটা যদি
বলতেন...” সেনগুপ্তা
বোধহয় কর্মহীন, পাহাড়ী
সান্যাল-রূপী ছবি
বিশ্বাস-কণ্ঠী বুড়োরা
যেমন হয়ে থাকে, সর্বদা
কাজরূপী অকাজ খুঁজে
বেড়ায়, সে বলে, “চলুন,
আমি নিয়ে যাচ্ছি।”
বাণেশ্বর তার সঙ্গে
সঙ্গে এগোতে থাকে,
ওদিকে পেছন থেকে ভীমসিং
বলে, “সইটা ক’রে গেলেন
না দাদা?” “বেরনোর সময়
ক’রে দেবে” বাণেশ্বরের
হয়ে সেনগুপ্তাই উত্তর
দেয়। চার নম্বর
টাওয়ারের নাইনথ ফ্লোরে
লিফটে ক’রে পৌঁছে তিন
নম্বর ফ্ল্যাটটা
দেখিয়ে সেনগুপ্তা বলে,
“এই যে, এটায় থাকত
জয়রামরা।” বাণেশ্বর
দ্যাখে, দরজায় নেমপ্লেট
ঝোলানো—ভীরেন্দ্র
জয়সওয়াল, নতুন মালিকের
নাম। দেখে, হঠাৎ কী-রকম
কান্না পেয়ে যায়
বাণেশ্বরের। তার খুব
ইচ্ছে হয়, বন্ধ দরজাটা,
শরণ্যার অযুত
স্পর্শলব্ধ দরজাটা,
একবার ছুঁয়ে দ্যাখে,
কিন্তু সঙ্গে
সেনগুপ্তা, তার সামনে
তো সেসব করা যায় না।
কিন্তু বাণেশ্বর চোখ
ফেরাতে পারে না দরজাটা
থেকে। তার নিষ্পলকতার
মধ্যেই সেনগুপ্তার ছবি
বিশ্বাসী গলা ভেসে আসে,
“এহে, ভুলেই গেছিলাম,
চৌধুরীরা তো নেই। ওদের
ছেলে থাকে গুরগাঁও-এ।
সেখানেই গিয়েছে
হপ্তাখানেক হলো।” বন্ধ
একটা ফ্ল্যাটের দরজার
সামনের কোলাপসিবল গেটে
ঝোলানো তালা দেখিয়ে
সেনগুপ্তা বলে।
বাণেশ্বর চুপ ক’রে
দাঁড়িয়ে থাকে।
সেনগুপ্তা, যেন সত্যিই
বাণেশ্বরের সমস্যাটা
নিয়ে চিন্তিত, এমনভাবে
বলে, “তাহলে...?” তারপর
হঠাৎ বলে, “আসুন তো
একবার” ব’লে লিফটের
দরজা খোলে। সেনগুপ্তার
সঙ্গে সঙ্গে বাণেশ্বরও
ঢুকে পড়ে, কিন্তু
বুঝতে পারে না
সেনগুপ্তা তাকে কোথায়
নিয়ে চলেছে। লিফটে
নামতে নামতে সেনগুপ্তা
বলে, “কো-অপারেটিভ
অফিসে একবার খোঁজ নিয়ে
দেখি। ওদের কাছে সমস্ত
ফ্ল্যাট ওনারেরই
নাম্বার থাকে।
জয়রামেরটা পেয়ে যাব
ঠিক।” বাণেশ্বরের
ইচ্ছে হয় বলে, ‘আর কেন?
অনেক তো হলো।’ কিন্তু
বলতে পারে না।
সেনগুপ্তা তাকে টেনে
নিয়ে যায় কো-অপারেটিভ
অফিসে। কিন্তু সেখানে
গিয়ে সুবিধে হয় না
কোনও। অফিস ম্যানেজার
বলে, তাদের সমস্ত ডেটা
কম্পিউটারে সেভ থাকে।
আর ফ্ল্যাটের মালিকানা
বদল হ’লে পুরনো মালিকের
নাম ও নম্বর ডিলিট ক’রে
ফ্ল্যাট নাম্বারের
এগেইনস্টে নতুন
মালিকের নাম, নাম্বার
বসানো হয়। কাজেই আগে
যেখানে জয়রাম
সেনগুপ্তার মোবাইল
নাম্বার শোভা পেত,
সেখানে এখন ভীরেন্দ্র
জয়সওয়ালের তিন-তিনটে
নম্বর সেভ হয়ে রয়েছে।
“ইস” সেনগুপ্তা বলে,
“তাহলে আর কোনও উপায়
নেই ভাই।” বাণেশ্বর
সম্ভবত হাসে, বলে, “ও ঠিক
আছে।” সেনগুপ্তাকে
থ্যাংকস জানিয়ে গেটে
ভীমসিং-এর খাতায় সই
ক’রে বেরিয়ে আসে
বাণেশ্বর। আবার একটা
ছুটন্ত ট্যাক্সি দাঁড়
করায়। উঠে প’ড়ে বলে,
“এনআরএস।” এতটা
দ্বিধাহীনভাবে নিজের
গন্তব্য স্থির করতে
সচরাচর দ্যাখা যায় না
বাণেশ্বরকে। কিন্তু আজ
সে স্থির ক’রে ফেলেছে,
ঘটনার শেষ দেখেই
ছাড়বে।
কিন্তু বাণেশ্বরের
হিসেবে ভুল ছিল। সে
জানত না, ঘটনার শুরু কখন
বা কীভাবে হয়, তা যেমন
কেউ বলতে পারে না, তেমনই
তার শেষও দেখা সম্ভব হয়
না, অন্তত বাণেশ্বরের
মতো মানুষের পক্ষে।
রবিবারের এনআরএস-এ বহু
কষ্টে নিউরো সার্জন
ডক্টর সিদ্ধার্থ
মুখার্জীর খোঁজ মেলে
ঠিকই, কিন্তু বাণেশ্বর
জানতে পারে, সে এনআরএস-এ
এখন আর নেই। সে রয়েছে
ব্যাঙ্গালোরে, নিমহানস
হসপিটালে যোগ দিয়েছে।
সরকারি চাকরি আর মাইনে
তার পোষায়নি হয়তো, তাই
বেসরকারিকরণ ঘটিয়েছে
নিজের। “কতদিন হলো?
মানে ওনার এনআরএস
ছাড়ার?”
অফিস-ক্লার্কটিকে
জিগেস করে সে। ক্লার্ক
বলে, “কত আর, মাস চারেক
হবে।” “ওঁর নাম্বারটা
পাওয়া যায়?” ক্লার্কটি
খাতা খুলে একটি নম্বর
দেয়। বাণেশ্বর নিজেকে
চমকে দিয়ে সেখানে
দাঁড়িয়ে, তৎক্ষণাৎ,
নাম্বারটি ডায়াল করে।
কিন্তু শোনে, ‘দিস
টেলিফোন নাম্বার ডাজ নট
এগজিস্ট’। সেকথা বলতে,
ক্লার্কটি বলে, “ওখানে
গিয়ে নতুন নম্বর
নিয়েছেন হয়তো।” “হুম,
তা-ই হবে” নিজেই নিজেকে
শুনিয়ে বলে বাণেশ্বর।
এনআরএস থেকে বেরিয়ে
নিজের মানিব্যাগটা
খুলে একবার মালকড়ির
হাল দ্যাখে সে, দেখে
আবারও একটা ট্যাক্সি
নেয়। বাসে অন্য মানুষের
সঙ্গ তার সহনীয় ব’লে
মনে হয় না। নিজের
পাড়ায় ঢুকে বিশুদার
হোটেলে পৌঁছে শোনে, ভাত
শেষ হয়ে গ্যাছে। তবে
পরোটা আছে। আলুর দম
দিয়ে দুটো পরোটা খেয়ে
নিজের ফ্ল্যাটে ঢোকে
বাণেশ্বর। তারপর সময়
কীভাবে কেটে যায় বুঝতে
পারে না সে। ভাবার
চেষ্টা করে,
ব্যাঙ্গালোরে স্থিত
একটি মানুষের পক্ষে
লেকটাউনের বাসিন্দা
কোনও মেয়েকে কেটে
হপ্তায় হপ্তায় পাঠানো
সম্ভব কি না। এবং কিছুই
ভেবে পায় না। সন্ধেয়
একবার বেরিয়ে বিশুর
দোকান থেকে রুটি-তরকা
নিয়ে এসে খেয়ে দুটো
অ্যালজোলাম পয়েন্ট
ফাইভ গিলে বাণেশ্বর
শুয়ে পড়ে। তার কানের
ইয়ারফোনে বাজতে থাকে
‘ইয়ে লাল রং কব মুঝে
ছোড়েগা’। সোমবারের
রাত্রে অ্যালজোলাম
খাওয়ার পর সে মোবাইলে
চালিয়ে দেয়, “এই সেই
কৃষ্ণচূড়া, যার তলে
দাঁড়িয়ে চোখে চোখ, হাতে
হাত, কথা যেত হারিয়ে, আজ
এখানে আমার আশার সমাধি,
ব্যথা জানাবার ভাষা
নেই...”। মঙ্গলবার
রাত্রে, ঘুম আসবে না
জেনে, এবং এসব ক্ষেত্রে
সাধারণত তার প্রফেসি
মিথ্যে হয় না বুঝে,
একসঙ্গে চারখানা
অ্যালজোলাম গিলে
ফ্যালে বাণেশ্বর।
বিছানায় শুয়ে মোবাইলে
চালায়, “সে যেন আমার
পাশে আজও ব’সে আছে”,
কিন্তু ঘুম তার আসে না।
মধ্যরাত্রে উঠে গিয়ে সে
বন্ধ ফ্রিজটার সামনে
দাঁড়ায়। দরজাটা খোলে।
প্রতিটা বাক্সেরও
ঢাকনা একবার ক’রে খুলে
দ্যাখে। একবার
ডিপফ্রিজটা খুলে
হিমায়িত যোনিদেশটা
দেখে নেয়। বাণেশ্বর
জীবননান্দ দাশ পড়েনি,
নইলে হয়তো তার মনে আসত,
“সে কত শতাব্দী আগে
তাহাদের করুণ শঙ্খের
মতো স্তন/ তাদের হলদে
শাড়ি — ক্ষীর দেহ —
তাহাদের অপরূপ মন/ চলে
গেছে পৃথিবীর সব চেয়ে
শান্ত হিম সান্ত্বনার
ঘরে:/ আমার বিষন্ন
স্বপ্নে থেকে থেকে
তাহাদের ঘুম ভেঙে
পড়ে।” বরফলাগা
যোনিদেশটা হাতে ধ’রে
তার ইচ্ছে হয়
মাস্টারবেট করতে।
কিন্তু প্রার্থিত
উত্থান থেকে সে বঞ্চিত
থেকে যায়। ‘অনভ্যাসের
পরিণতি’ ভাবে সে।
বাক্সটা পুনরায়
ডিপফ্রিজে রেখে
ফ্রিজের দরজা বন্ধ ক’রে
দেয় বাণেশ্বর। সে বোঝে,
হিসেবে তার ভুল হয়নি,
কর্তিত নারীদেহটির
প্রতিটি অঙ্গই তার কাছে
পৌঁছে গিয়েছে, বাকি
রয়েছে শুধু একখানা
মুদিতনেত্র নিষ্পন্দ
মাথা, ধড়হীন মুণ্ড, আ
হেড উইথাউট আ বডি, বাট,
অফকোর্স, উইথ আ ব্রেইন।
সেটা কাল আসবে, জানে
বাণেশ্বর। তাই আজ
রাত্রে আর তার ঘুম আসতে
চায় না। কারণ কাল সে
জানতে পারবে, এই
বিখণ্ডিত নারীদেহটি
কার, মানে শরণ্যার কি না,
সেটুকু অন্তত জানা
যাবে। বন্ধ ফ্রিজের
সামনেই চুপচাপ
দাঁড়িয়ে থাকে
বাণেশ্বর। উত্তেজনা সে
বোধ করে না, সেটা তার
স্বভাব নয়, কিন্তু
অপেক্ষার অধীরতা টের
পায়। টের পেতে তার ভালো
লাগে। এবং তা টের পেতে
পেতে, কী আশ্চর্য, তাকে
ঘিরে, শুধুমাত্র তাকে
ঘিরে, ঘরের ভিতরে
বৃষ্টি নামে। বাণেশ্বর
দ্যাখে, একটা পুরনো
গ্রামীণ ভগ্ন মন্দিরের
মধ্যে সে দাঁড়িয়ে
রয়েছে। চারিদিকে
বনবনান্ত। মন্দিরটি
বিগ্রহহীন। কিন্তু সে
নিজে পুরোহিতের
পোশাকধারী। সামনে
প্রজ্জ্বলন্ত
প্রদীপটি দেখে সেটি সে
হাতে তুলে নেয়। মুদিত
নেত্রে বিগ্রহহীন
মন্দিরের ভিতরে, কোনও
এক অরূপা কিংবা অপরূপা
দেবীর উদ্দেশে উচ্চণ্ড
আরতি শুরু করে সে। তার
কণ্ঠে মন্দ্রিত হ’তে
থাকে এক দুর্বোধ্য এবং
নির্ভাষ মন্ত্র।
মন্ত্রের তালে তালে সে
নাচতে থাকে। নাচের
অভিঘাতে প্রদীপের শিখা
ছিটকে এসে তার পরণের
কাপড়ে আগুন ধ’রে যায়,
তাকে ঘিরে অগ্নিবৃত্তও
নাচতে থাকে। কিন্তু
আরতি সে থামাতে পারে
না। কমপ্লিটলি
ইললজিক্যাল অ্যান্ড
আনরিয়ালিস্টিক এই
অগ্নিনৃত্যের গভীরে
দূরাগত ঢাকের আওয়াজ
শুনতে পায় সে। সে ঢাক
আবাহন, নাকি
বিসর্জনের—তা সে বোঝে
না। সে শুধু নেচে চলে।
এবং ভোরের আলো যখন
ভূমিকে স্পর্শ করবে
ব’লে প্রস্তুত হচ্ছে
তখন এক লেলিহান নীলবর্ণ
অগ্নিচিতার ভিতরে
নিরাবেগ শুয়ে পড়ে
বাণেশ্বর, মানে এই
ন্যারেটিভের এক এবং
অদ্বিতীয়
প্রোটাগনিস্ট।
নির্দহন এক চিতাশয্যায়
শুয়ে নির্ঘুম ঘুমে
ঘুমিয়ে পড়ে সে।
সাতটার সময় ডোরবেল বেজে
ওঠে। নিঃশব্দ পায়ে
এগিয়ে গিয়ে দরজা খোলে
বাণেশ্বর। দ্যাখে,
প্রত্যাশিত বাক্সটি
তার চৌকাঠের সামনে
প’ড়ে। এবং অন্যদিনের
চেয়ে আকারে বড়ো বাক্স
এসেছে আজ। একটি
মানবমুণ্ডকে ধারণ করার
উপযোগী বড়ো বাক্স।
বাক্সটি বাণেশ্বর তুলে
নেয়। অনুভব করে, আজ
বাক্সটি ওজনেও অনেকটা
ভারি। হেড ইজ দা
হেভিয়েস্ট পার্ট অফ দা
হিউম্যান বডি—মনে
প’ড়ে যায় তার। সে
বাক্সটি নিয়ে নিজের ঘরে
এসে বিছানার ওপর বসে।
দু’হাতে ধ’রে থাকে
বাক্সটি। কিন্তু
অন্যদিনের মতো বিছানা
সংলগ্ন টেবিল থেকে
অনাবৃত ব্লেডটি সে তুলে
নেয় না। বরং সে অপেক্ষা
করে। কীসের অপেক্ষা সে
জানে না। খানিক বাদে এক
হাতে বাক্সটা ধ’রে অন্য
হাতে মোবাইলটা তুলে
নিয়ে ভৌমিককে ফোন ক’রে
বলে, আজ তার জ্বর, সে
স্কুল যেতে পারবে না।
ভৌমিক বলে, “তোমার তো
ভালুক-জ্বর। আবার কখন
দেখব, এসে হাজির হয়েছ।”
বাণেশ্বর বলে, “না
স্যার, আজ সত্যিই জ্বর।
আজ একটা ইএল নেবো।” ফোন
কেটে দিয়ে বাক্সটা হাতে
ধ’রে সে ব’সে থাকে,
নিষ্পন্দ,
নিষ্প্রাণ—ভেতরের
কর্তিত মানবমুণ্ডটির
মতোই। এবং দুপুরের দিকে
তার সত্যিই জ্বর আসে।
হাই টেম্পারেচর,
থার্মোমিটার না দিয়েও
বুঝতে পারে বাণেশ্বর।
কিন্তু প্যারাসিটামল
সে খায় না, এবং বাক্সটাও
খোলে না। দুপুর গড়িয়ে
যায়। বিশুর হোটেলে
খেতেও যায় না সে। ইচ্ছে
করে না যেতে। জল খেতেও
দ্বিধা হয়। শুধু
প্রাণহীন এক
অস্তিত্বের মতো
বাক্সটা হাতে ধ’রে ঠায়
সে ব’সে থাকে। বিকেলের
দিকে তার ঘর অন্ধকার
হয়ে আসতে থাকে,
অন্যদিনের থেকে অনেক
আগেই। দরজা-জানলা বন্ধ
থাকলেও বাণেশ্বর বুঝতে
পারে, আকাশ ছেয়ে মেঘ
আসছে। একটু পর থেকে
মেঘের গর্জন শুনতে পায়
সে। সন্ধ্যা নামে, এবং
বিশ্বসংসারকে উত্তাল
ক’রে তোলার মতো
ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়।
ঘরের ভেতর থেকেও
বাণেশ্বর টের পায়।
সন্ধে সাতটার সময়,
অর্থাৎ বাক্সটি তার
হাতে আসার ঠিক অর্ধদিবস
পরে ব্লেডটি হাতে তুলে
নেয় বাণেশ্বর। বাক্স
এবং ব্লেড নিয়ে সে চ’লে
আসে তার ছোট্ট ডাইনিং
স্পেসটিতে। তারপর
ফ্রিজ খোলে। একটা একটা
ক’রে ফ্রিজের ভেতরে
রক্ষিত সবক’টি বাক্স
বার করে। তাদের ঢাকনা
খুলে বার ক’রে আনে
হিমেল ধোঁয়া ওঠা
প্রতিটি নারী অঙ্গ।
ডিপফ্রিজ খুলে বার করে
ভ্যাজাইনাটা। তারপর,
জিগস পাজল সলভ করার মতো
ক’রে, একটির পাশে
আরেকটি দেহখণ্ড রেখে,
ওপরে কিংবা নীচে
নামিয়ে, ডান-বাঁ পাশে
সরিয়ে, দেহটিকে পূর্ণ
ক’রে তোলার খেলায় রত হয়
সে। মোটামুটি আধ
ঘন্টাখানেকের চেষ্টায়
বাণেশ্বরের ডাইনিং
স্পেসের মেঝেয়
মুণ্ডহীন দেহটি গ’ড়ে
ওঠে। নিজের
নির্মাণকার্য দেখে
খুশি হয় বাণেশ্বর।
বাইরে পৃথিবী
উথাল-পাতাল হ’তে থাকে।
কিন্তু বাণেশ্বরের
জানলা-দরজা বন্ধ। তারা
বৃষ্টির অভিঘাতে চঞ্চল
হয়, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ
হারায় না। বাণেশ্বর
চুপচাপ কিছুক্ষণ
প্রাণোত্তাপরহিত
নারীদেহটির দিকে
তাকিয়ে থাকে। তার মনে
হয়, এতক্ষণে, এতদিনে, তার
তিনমাস ধ’রে সঞ্চিত
ভালোবাসার ধনকে পূর্ণ
করার সময় এসেছে। বন্ধ
বাক্সটা আর ব্লেডটা
তুলে নেয় সে। হাত তার
কাঁপে না, শুধু ভাবার
চেষ্টা করে যে, আচ্ছা,
শরণ্যার ঠোঁটে যে নিত্য
লিপগ্লস থাকত, যা সে
অনেকবার শুষে নিয়েছে
চুম্বনের ছলে, তার
পিচ্ছিলতা কি তার
কর্তিত মুণ্ডের
ওষ্ঠাধরেও থাকবে? যে
সমস্ত গান গাইত শরণ্যা,
তার মস্তিষ্কে যারা
বাসা বেঁধে ছিল, তাদের
দু’এক কলির চিহ্ন কি
তার ধড়হীন মাথাতেও
অবশিষ্ট থাকবে না?
কিন্তু ব্লেডটা দু’
আঙুলে ধ’রে সে অনুভব
করে, বাক্সটা খুলতে তার
ইচ্ছে করছে না। তার মনে
হয়, এ বাক্স না খুললেই বা
কী? তার চেয়ে বিগত
তিনমাস ধ’রে
যে-অপেক্ষার অধীরতায় সে
নিজেকে ব্যাপৃত
রেখেছিল, তা-ই অব্যাহত
থাকুক না। কিন্তু
শরণ্যা, শুধুমাত্র
শরণ্যার অমেয় রূপরাজি
তার প্রাণহীন
অবস্থাতেও কতখানি
অক্ষুণ্ণ রয়েছে, তা
অন্তত একবার, প্রথমবার,
এবং সম্ভবত শেষবার,
দেখার কৌতূহলে ব্লেডটা
সেলোটেপের বাঁধনের
ওপরে বাণেশ্বর স্থাপন
করে। তারপর, যেন নিজের
কব্জির শিরা কাটছে, এমন
নিপুণতায় এবং
নিশ্চিন্ততায় সেলোটেপ
কাটতে থাকে। বাক্সটা
সম্পূর্ণ বন্ধনমুক্ত
হওয়ার পর ঢাকনাটা খোলার
আগে একবার বুক ভ’রে
শ্বাস নেয় সে। তারপর
ধীরে ধীরে ঢাকনাটা
খোলে। এবং সেটি খোলার
পর তার মস্তিষ্কের শিরা
ছিঁড়ে যায়, হৃৎপিণ্ড
অস্বীকার করে স্পন্দিত
হ’তে, শ্বাসযন্ত্র
বিস্ফোরিত হ’তে চায়।
কেননা বাণেশ্বর দ্যাখে,
তিনমাস ধ’রে যে
বাক্সটির প্রতীক্ষায়
সে ব’সে ছিল, যার
মাধ্যমে সে এই
তিনমাসব্যাপী
খণ্ডতাকে এক অখণ্ডে
রূপদান করবে ব’লে সে
ভেবেছিল, সেই বাক্সটি
সম্পূর্ণ খালি, তার
ভেতরে কিচ্ছু নেই।
বাণেশ্বরের প্রথমে মনে
হয়, ব্যাপারটা হোক্স,
কারণ তার মনে হয়, খালি
বাক্স এতটা ভারি হ’তে
পারে কীভাবে? বাক্সটায়
নির্ঘাৎ কোনও ট্রিক
রয়েছে। সে নেড়েচেড়ে
দ্যাখে বাক্সটা, কিন্তু
কোথাও কিছু খুঁজে পায়
না। উন্মত্ততার
প্রাবল্যে সে বাক্সটা
ছিঁড়তে থাকে,
কার্ডবোর্ডের
টুকরোগুলোকে
ছিন্নভিন্ন ক’রে
চারদিকে ছড়িয়ে দেয়,
কিন্তু শূন্যতার
অতিরিক্ত বাক্স থেকে
কিছুই সে উদ্ধার করতে
পারে না। সে অসম্পূর্ণ
নারীদেহটার দিকে
নিষ্পলক তাকিয়ে সঘন
নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে,
তার নিঃশ্বাসের
প্রগলভতায় তার
প্রত্যাশার মিনার
মড়মড় শব্দে ভেঙে
পড়ে। এমন সময় হঠাৎ
বজ্রগর্জনের
দিগন্তব্যাপী নিনাদে
কেঁপে ওঠে দশদিশি, এবং
বাণেশ্বরের ঘরের সমস্ত
আলো নিবে যায়। বাণেশ্বর
চমকে উঠে পিছিয়ে আসে
বিখণ্ডিত এবং
অসম্পূর্ণ নারীদেহটির
কাছ থেকে। এবং তারপর
তার সজল অথচ বিস্ফারিত
চক্ষুদ্বয় দেখতে পায়,
সামনে শায়িত দেহটির
প্রতিটি খণ্ডিত অঙ্গ
থেকে গ’লে গ’লে খ’সে
পড়ছে ফ্রিজের বরফ।
তারপর মেলে ধরা
অঙ্গসমূহের
প্রত্যেকটি থেকে ধীরে
ধীরে ক্ষরিত হ’তে থাকে
এক অদ্ভুত,
অদৃষ্টপূর্ব, নিরং, এবং
গাঢ় তরল। সেই তরলের
আকর্ষণে একটি দেহখণ্ড
অন্যটির সংলগ্ন হ’তে
থাকে, এবং একসময় তারা
পরস্পর জুড়ে যায়।
প্রতিটি কর্তিত অঙ্গের
খণ্ডতা এইভাবে লুপ্ত
হয়, এবং বাণেশ্বরের
সামনে শুয়ে থাকে এক
নগ্ন, অখণ্ড, অথচ
মুণ্ডহীন হওয়ার কারণে
অসম্পূর্ণ নারীদেহ।
তৎক্ষণাৎ আবার
সৃষ্টিবিলোপকারী একটি
বজ্রপাত হয়।
বাণেশ্বরের ঘরের সমস্ত
দরজা-জানলা এক ধাক্কায়
খুলে যায়। হু হু শব্দে
ঘরে প্রবেশ করতে থাকে
বৃষ্টি এবং ঝড়। এবং
বাণেশ্বর দ্যাখে, সেই
মুণ্ডহীন নারীদেহ
আস্তে আস্তে উঠে
দাঁড়াচ্ছে। সে ভয়
পেতেও ভুলে যায়।
রাস্তার হ্যালোজেনের
ম্লান আলোয় সে বুঝতে
পারে, নির্মুণ্ড দেহটি
এক পা এক পা ক’রে তার
দিকে এগিয়ে আসছে। এ
দেহের মুণ্ড নেই, অতএব
চোখ নেই, তবু যেন মনে হয়
বাণেশ্বরের, সে তার
দিকেই একদৃষ্টে চেয়ে
রয়েছে, এক ক্রূর
জিঘাংসু দৃষ্টিতে। সেই
মুহূর্তে আবার এক
আকাশচেরা বজ্রালোকে
চমকিত হয়ে ওঠে
দিগবিদিক। আর অম্নি,
বাণেশ্বর দ্যাখে, সেই
নির্মুণ্ড নারীর ডান
হাতের মুষ্ঠিতে কোথা
থেকে যেন এসে হাজির
হয়েছে গণ্ডারের
চর্মনির্মিত এবং
সজারুর কাঁটায় কণ্টকিত
এক বিশাল চাবুক।
বাণেশ্বর যেন নিজের
নিয়তিকে চোখের সামনে
দেখছে—এমন বোধে সেই
নারীর সামনে নতজানু হয়ে
ব’সে পড়ে। আর সেই নারী
ষাঁড়াষাঁড়ির বানের
মতো অভিঘাতে তার চাবুক
ঘোরায়। গোটা ঘরময় তার
চাবুকের পরিধি আছড়ে
পড়ে কান ফাটানো ‘সপাং’
শব্দে। বাণেশ্বরের
ফ্রিজ উল্টে যায়, তার
বিছানার তোষক
ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, আর
প্লাস্টিকের জবার মালা
সজ্জিত কিশোর কুমারের
ছবিখানি ফ্রেমসুদ্ধু
জানলা দিয়ে বেরিয়ে উড়ে
কোথায় চ’লে যায় কে
জানে। পুনর্বার চাবুক
ঘোরায় সেই নারীধড়,
বাণেশ্বরের এতদিনের
সঞ্চিত কিশোরের সমস্ত
সিডি, ক্যাসেট, সিডি
প্লেয়ার সব টুকরো টুকরো
হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে
পড়ে। নতজানু বাণেশ্বর
নিজের অজান্তেই করযুগ
ক্ষমাপ্রার্থনার
ভঙ্গিতে একত্রিত করে।
তখন সেই নারীদেহ, সেই
মুণ্ডহীন, ওষ্ঠহীন,
কণ্ঠহীন নারীদেহ এক
বায়ব ভাষায় অমানব কণ্ঠে
কথা ব’লে ওঠে। সে বলে,
“উঠে দাঁড়া”, ব’লে সে
মাটিতে চাবুক আছড়ায়।
তার চাবুকের আঘাতে
মেঝের মোজাইকে ফাটল
ধ’রে যায়। বাণেশ্বর উঠে
দাঁড়ায়। নারীদেহ বলে,
“খোল।” বাণেশ্বর বুঝতে
পারে, কী খোলার কথা সে
বলছে। সে আস্তে আস্তে
নিজের টি-শার্টটা খোলে,
তারপর পায়জামার দড়ি
ধ’রে টান মেরে পায়জামা
নামিয়ে দিয়ে
অন্তর্বাসহীন শরীরে
দাঁড়িয়ে থাকে। এমনকি
নিজের লজ্জাঙ্গটিকে
হাত দিয়ে আড়াল করতে
পর্যন্ত সে ভুলে যায়।
চাবুকধারিনী বলে, সেই
বায়ব অমানব ভাষাকণ্ঠে,
“ঘরে চল।” বাণেশ্বর সেই
নারীশরীরের দিক থেকে
চোখ ফেরাতে পারে না।
তার মনে হয়, এমন অতুল্য
স্তন, অটুট জঙ্ঘা,
অনমনীয় নিতম্বের
অধিকারী কোনও পার্থিব
নারী হ’তে পারে না। সে
তার শোবার ঘরে গিয়ে
তোষকহীন বিছানাতেই
শুয়ে পড়ে—নগ্ন, অলজ্জ।
নির্মুণ্ড নারীটি ঘরে
আসে। তার হাত থেকে
চাবুক সে ফেলে দেয়।
তারপর দু’পা ফাঁক ক’রে
চ’ড়ে বসে নির্বস্ত্র
বাণেশ্বরের নাভির
একহাত নিচে। বাণেশ্বর
চোখে অন্ধকার দ্যাখে,
কেননা সে বুঝতে পারে,
এমন অযোনিসম্ভূত
যোনিস্পর্শ সে জীবনে
কখনও পায়নি। কিন্ত
অন্ধকার আসলে সে দ্যাখে
না, বরং মুহূর্মুহু
বজ্রালোকের আভাসে
বুঝতে পারে, বাণেশ্বরের
উপরিস্থিত সেই নারী
ধীরে ধীরে নিজের শরীরকে
আন্দোলিত করতে শুরু
করেছে। নিজের শরীর
বাণেশ্বরের
নিয়ন্ত্রণহারা হয়, তার
অস্তিত্ব, তার
ভূতভবিষ্যৎ, তার
পুরুষার্থ, তার
জীবনার্থ সেই নারীর
আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে
আলোড়িত এবং উত্থিত
হ’তে থাকে। বাণেশ্বর
সেই অসম্পূর্ণ
নারীদেহের ভিতরে
প্রবিষ্ট হয়। বল্গাহীন
বৃষ্টিতে ধুয়ে যেতে
থাকে চরাচর, আর
বাণেশ্বর যেন কিছু
দেওয়ার বদলে ওই
নারীশরীর থেকে নিজের
অনুপ্রবিষ্ট অঙ্গটির
মাধ্যমে প্রাণমধু আহরণ
করতে থাকে। বাণেশ্বর
বুঝতে পারে না, এই
ক্রীড়ার পরিণতি কী,
বোঝে না যে, তার
গুপ্তভাণ্ডারের বন্ধ
দরোজা কখনও খুলবে কি না,
বোঝে না, এই মিলনই
পূর্ণতার প্রতিভাস কি
না, শুধু সে তার আঁখি
দু’টি নত ক’রে আনে
আরূঢ় নারীটির তার
দেহের দু’পাশে ছড়িয়ে
থাকা পদযুগে। বহমান
অশ্রুধারায় তার গাল
ভিজে যায়। বাণেশ্বর
দ্যাখে, তার উপর
আন্দোলিত হ’তে থাকা
নারীটির যে-স্তনযুগ তার
নিবিড় নির্মম
হস্তলাঞ্ছনেও এতটুকু
ধ্বস্ত হয়নি, সেই যুগল
অহংকারের দুই উৎসমুখ
থেকে দুই বিচিত্র রং-এর
রসধারা ক্ষরিত হচ্ছে।
বাণেশ্বরের করপল্লব
ভিজে যায়, এবং সে বোঝে,
জীবনে প্রথমবারের মতো
সম্পূর্ণ নির্ভুলভাবে
বোঝে, ওই দুই রসস্রোত
যথাক্রমে অবিংসবাদী
জীবন ও মৃত্যুর
বীজবাহী। এক নির্ভাষ
প্রার্থনায় সে
মুখব্যাদান করে। আরূঢ়
নারীটির শরীরে যেন
মমতার তরঙ্গ জেগে ওঠে।
সে ক্রমশ ঝুঁকে আসে
বাণেশ্বরের উপরে, তারপর
দুই হাতে তার দুই স্তন
একত্রিত ক’রে দুই বৃন্ত
একযোগে বাণেশ্বরের
হাঁ-মুখে প্রবিষ্ট
করিয়ে দেয়। বাণেশ্বর
আজন্ম পিপাসার্তের মতো
সেই অমৃতগরল পান করতে
থাকে। সে মুহূর্তে
মুহূর্তে জন্মায় এবং
ম’রে যায়, মরে এবং
পুনর্জন্মলব্ধ হয়।
বাইরে চরাচরপ্লাবী
বৃষ্টিতে পৃথিবী
স্নিগ্ধ হ’তে থাকে। আর
মিলনের উত্তুঙ্গ
শীর্ষে নিজেকে ওই
নারীদেহের গভীরে
নিঃস্ব ক’রে দিতে দিতে
অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার
পূর্বমুহূর্তে
করজোড়ে বাণেশ্বর শুধু
ব’লে উঠতে পারে,
সুরসংযুক্ত অবিকল
কিশোর-কণ্ঠে, শরণ্যার
মুখে বহুশ্রুত তার
প্রিয়তম
সংগীতপংক্তি—“ক্লান্ত
ি আমার ক্ষমা করো...
প্রভু”। ‘প্রভু’
শব্দটির নিঃসীম আর্তি
তথা আততি খোলা জানলা
দিয়ে প্রবিষ্ট
বৃষ্টিহাওয়ার মত্ততায়
ঘরের মধ্যে পাক খেয়ে
উঠে দেওয়ালে দেওয়ালে
ধাক্কা খেতে খেতে বহুল
প্রতিধ্বনিতে ভেঙে
পড়ে। নির্মুণ্ড
নারীটি তখন তার নিরষ্ঠ
ওষ্ঠাধর নামিয়ে আনে
বাণেশ্বরের ঠোঁটের
ওপরে। তৎক্ষণাৎ এক
বিধ্বংসী বজ্রপাতে
বাণেশ্বরের ঘরের ছাদ
শতখণ্ডে খণ্ডিত হয়ে
হুড়মুড় ক’রে নিচে
নেমে আসে। আর সেই
ছিদ্রপথে
বহ্মাণ্ডপাতালব্যাপী
এক সম্পূর্ণ
যুক্তিবুদ্ধিরহিত
বৃষ্টি ঝ’রে পড়তে থাকে
এক অচৈতন্য পুরুষ, ও তার
উপর বিপরীত রতিতে আরূঢ়
চৈতন্যস্বরূপিনী অথচ
অপূর্ণ এক নারীদেহের
ওপরে। একযোগে তারা
ভিজতে থাকে, ভিজে যায়।