তারপর তুমি আমার কাছে
ফিরে এলে, কিন্তু এই
তুমি সেই আগের তুমি নও।
প্রায়ই তোমার অফিসে
তোমাকে সঙ্গ দিতে যাই,
একসাথে ভিডিওগুলো
দেখতে থাকি; তুমি গভীর
মনোযোগের সাথে দেখো
মেয়েটিকে বাঁচানোর
জন্য আর কী কী করা যেত আর
সেগুলো খুঁজতে থাকো,
সময়োযোগী কোন কোন
সিদ্ধান্ত তোমার নেয়া
হয়নি সেগুলোই
অনুসন্ধান করতে থাকো।
কিংবা হয়ত তুমি তোমার
নিজের প্রতিফলনই দেখো,
আয়নার সামনে, নগ্ন।
তোমার ক্যামেরা
আলমারিতে পড়ে থাকে
দিনের পর দিন, তুমি
লেখালেখি বা গান কিছুই
করো না আর, কেবল জানালার
পাশে ঘন্টার পর ঘন্টা
বসে থাকো। আর আমি? তোমার
পাশে থেকে অপেক্ষা করি
কখন তুমি তোমার নিজের
ভেতরের দীর্ঘ ভ্রমণ
শেষে ফিরে আসবে, কখন
পুরনো ক্ষতগুলো সেরে
উঠবে।
সেদিন ডুরিয়াহাটের হাট
তখনো সেভাবে জমে
ওঠেনি,সমরবাবার
আশ্রমের পাশে শ্মশানের
ভেতর পাওয়া গেল
মেয়েটিকে। সারাশরীর
ক্ষতবিক্ষত, চোখ খোলা,
আর্তনাদ করে সাহায্যের
জন্য ডাকছিল। মেয়েটির
নাম জানা গেল,সীতা।
কান্না ও আর্তনাদের
স্বরে বাতাস ভারী হয়ে
আছে,টিভি ক্যামেরাগুলো
প্রায়ই অসহনীয় দৃশ্যটি
প্রচার করে যাচ্ছিল।
সাথে সাথেই সবার মুখে
ছড়িয়ে গেল ওর নাম।
যতবার ক্যামেরা
মেয়েটির দিকে ধরা
হচ্ছিল ততবার কেন
জানিনা তোমাকে দেখতে
পাচ্ছিলাম আমি।
ইদানীং প্রায়ই আমার
সম্পর্কে চারদিকে
নানান গুজব ছড়িয়ে পড়ার
কথা শুনতে পাই। এসব
মিথ্যে রটনা কে যে ছড়ায়
তার কিছুই আমি ঠিকমতো
বুঝতে পারি না, আর কেন যে
ছড়ায় তারও কোনো হদিস
পাই না আমি। অন্যের
হেঁশেলের খবর টেনে বের
করতে যারা ভালবাসে
তারাই আমাকে নিয়ে এসব
গুজবের কথা বাড়িতে এসে
আমায় শুনিয়ে যায়। কেবল
শুনেই নিস্তার নেই
আমার, গাদা-গাদা
প্রশ্নবাণ ছুটে আসে
আমাকে লক্ষ করে, যেমন :
‘কী ব্যাপার বলুন তো,
দাদা?’, ‘নারীদের জন্য
পরিবেশটা এমন খারাপ হয়ে
ওঠার কারণ কী মশাই?’,
‘তোমার বউয়ের কি
হয়েছে?’,‘নারীরা কোথায়
কার কাছে নিরাপদ?’ ‘এই
জটিলতা কাটিয়ে ওঠার
উপায় কী হবে এখন?’, ‘এই
মুশকিল থেকে কীভাবে
বেরিয়ে আসতে চাও তুমি?’
ইত্যাদি ইত্যাদি।
এমনসব প্রশ্ন শুনে
প্রাথমিকভাবে আমি বেশ
ঘাবড়ে যাই; সারাশহর যে
আমার সম্পর্কে এমন একটা
আগাম ধারণা করে বসে
রয়েছে, সে-সম্পর্কে
আমার কোনো ধারণাই ছিল
না। তার ওপর আবার এসব
প্রশ্নের ঝড়! এই
বিচিত্রসব গুজবের
সঙ্গে আমার কোনোভাবেই
বিন্দুমাত্র যোগাযোগ
ছিল না যখন, তাহলে
কীভাবে আমি
প্রশ্নগুলোর উত্তর
দেবো?
তিনদিন পরে সকালবেলার
খবরের কাগজ চেঁচিয়ে
বলল,‘গণধর্ষণে সীতার
মৃত্যু অপরাধীদের
খোঁজে পুলিশ।’
খবর-কাগজের হকারটি
স্থির দাঁড়িয়ে রাস্তায়
হাওয়ার মধ্যে, কিছু
একটা যেন কেঁপে-কেঁপে
উঠল, যেন তা আগে থেকেই
নির্দিষ্ট হয়ে ছিল।
তুমি তোমার চিরুনিটি
ড্রেসিং টেবিলের ওপর
ছুঁড়ে ফেললে আর যেন
স্বপ্নের ঘোরে গাইতে
লাগলে– ‘আমার প্রাণের
পরে চলে গেলো কে, বসন্তর
বাতাসটুকুর মতো’;
কিন্তু হঠাৎ কেমন যেন
উত্ত্যক্ত হয়ে উঠে দুম্
করে গানটা বন্ধ করে
দিলে একটা ফ্যানের
মতো।
কানাঘুষাটা তেমন ঘন হয়
না সীতার মৃত্যূ শোকে।
সীতার মৃত্যূতে এলাকার
লোক শোকাহত হয়,মানুষের
মুখে মুখে সীতার
মৃত্যুর খবর
হাট-বাজার,হারাধনের
দোকান, প্রাইমারী
স্কুলের মাঠ কিংবা
ষ্টেশন রোডের শেষ মাথায়
নতুন গজিয়ে ওঠা মোবাইল
ফোনের দোকানে ছড়িয়ে
যায়। এইসব শোকগুজার
স্থানের কোথাও আমরা
সীতার বাবাকে দেখি না।
সে কী করছে, কী খাচ্ছে,
মেয়ের শোকে কেমন ভেঙে
পড়েছে সে খবরও কেউ নেয়
না। লোকজন সীতার জন্য
মন খারাপ করে, কারণ সীতা
গরীব বাবার মেয়ে, সীতার
এখনো মরার বয়স হয়নি,
কিংবা একটা মানুষ আচমকা
মারা গেলো - এই সব ভেবে
ভেবে লোকজন মন খারাপ
করে । তবে এই মন খারাপে
সীতার বর্ননা কিংবা
সীতার সাথে কোনো
স্মৃতিময় ঘটনা উঠে আসে
না। কারণ, সীতাকে তারা
কেউ দেখেনি। তাদের
অনেকেই সীতার নাম
জেনেছে তার মৃত্যু
সংবাদের পরে, কিংবা
টিভিতে দেখে।
তবু ঘর থেকে পাড়া,পাড়া
থেকে শহর হয়ে দেশে
ছড়িয়ে পড়েছে বিক্ষোভ।
রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে
ধর্ষণের প্রতিবাদ।
ব্যানারে ব্যানারে
ছড়িয়ে পড়ছে সত্য এবং
প্রচারের বাণীতে নারী
অধিকার ও সে যে মানুষ
ভোগপন্য নয় সেই সব
খইয়ের মতন অজস্র বাণী।
আহা কেমন যে মেঘলা
দিনের মতো ঘরখানা
এখানেই তুমি বসে আছো,
নিজেকে খুঁজে যাচ্ছে
অবিকল। জানলার গ্রীলে
আটকা পড়ে গেছে সূর্য আর
দেয়ালের গায়ে আলো
কেঁপে-কেঁপে যাচ্ছে যেন
গিটারের কোনো তার।
সন্দেহ সচেতনতা বাড়ায়।
বিশেষ করে এমন একটি
ঘটনার পরে,কেউ কেউ
রাজনীতির দিকে আঙুল্
তুলছে।পুলিশের কাজে তো
বটেই। দিনের বেলা,
কিংবা ভোর হয়ত হয়নি
তখনো, তবে পাঁচটা বেজে
গেছে। আরামকেদারায়
শোওয়া থেকে জেগে উঠলাম,
মোমবাতিটা শেষ হয়ে নিভে
গেছে, ঘরের দরজা বন্ধ –
সবাই ঘুমে, অস্বস্তিকর
নীরবতা টের পাচ্ছি
বাড়িতে। আমি তড়াক করে
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াই, এর
আগে আমার এমনটা কখনোই
হয়নি, তখনই আমার জ্ঞান
কাজ করতে শুরু
করে,বোতলের দিকে চোখ
যায়, বিষ ভর্তি ওটা আমার
সামনেই পড়ে আছে। আমি
হাত দিয়ে ঠেলে সেটা
সরিয়ে দিই। না, জীবন দাও,
জীবন চাই আমার! দুহাত
বাড়িয়ে আলিঙ্গন করি
নতুন জীবন,খুশির তরঙ্গ
বয়ে যায় শরীর জুড়ে
চোখের কোণে জমে ভোরের
শিশির।
সীতার কথা বলছিলাম,
তোমাকে ফিরে পেলাম তার
আদলে।
এখন আমি তোমার মুক্তির
পথে হেঁটে যেতে থাকব।
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই হাঁটতে
থাকব।