অলিম্পিকের গোল্ড
মেডালিস্টের মতো করে
দৌঁড়ে এলেও, ঐ নীল নয়না
স্বর্ণকেশী যে শেষ
রক্ষা করতে পারবে না, তা
প্রায় নিশ্চিত ছিলাম!
স্পষ্ট মনে আছে, আমাদের
কামরা'র মানে
কমপার্টমেন্টের
সবগুলো চোখ তখন বন্ধ
হয়ে যাওয়া গ্লাস-ডোরের
ওপারে মেয়েটির অসহায়
চোখদুটোতে আটকে গিয়েছে|
জুলাই মাসের বরফ শীতল
বৃষ্টি মাথায় করে,
দরোজার হাতল ভীষণ জোরে
টেনে সামান্য, খুবই
সামান্য খুলতে পারলো
বটে কিন্তু সাথে সাথেই
আবার তা বন্ধও হয়ে গেল!
হঠাৎ কি যে হলো! আমি আর
আমার সামনে দাঁড়িয়ে
থাকা ছেলেটা গায়ের সর্ব
শক্তি দিয়ে দরোজার দুই
হাতল দুই দিকে টেনে
ধরলাম| ট্রেনে দরোজার
ভেতর দিকে যে হলুদ হাতল
আছে ঐ দুটো|| ওমা কি অবাক
কান্ড, আমাদের সবাইকে
হতবাক করে দিয়ে দরজাটা
খুলে গেলো! সাধারণত
এরকম সময়ে হাজার চেষ্টা
করেও খোলা যায় না|
মেয়েটিও কালক্ষেপে না
করে, স্প্রিঙের মতো
লাফিয়ে ভেতরে ঢুকে
পড়লো| ঢুকেই আমার পাশ
ঘেঁষে দাঁড়ালো! খুব
হাঁপাচ্ছিলো| তার তীব্র
গতির হাঁপানো দেখতে
দেখতেই খেয়াল করলাম
ট্রেন হোপার্স ক্রসিং
ছেড়ে পরের স্টেশন
'উইলিয়ামস ল্যান্ডিং' -এ
পৌঁছে যাচ্ছে! সে এবারে
একটু ধাতস্ত হয়ে, বড় করে
শ্বাস নিয়ে আমাকে আর
আমার সামনের ছেলেটাকে
অমায়িক ধন্যবাদ জানায়|
আদ্রিয়ানা'র সাথে
পরিচয়ের সূত্রপাত
হয়েছিল ঠিক এই ঘটনায়!
সেদিনের ঐ ধন্যবাদ আদান
প্রদানের মাধ্যমে|
একদিনের এমন এক ঘটনায়
অবশ্য এদেশে কেউ কাউকে
মনে রাখে না| আমার ধারণা
সকাল ৭টা ৪২ এর 'ওয়েরিবি
লাইনের ট্রেন' এ চড়া
তাবৎ যাত্রী তাকে চিনে
গিয়েছিল| হেঁটে গিয়ে
ট্রেনে উঠতে তাকে
সম্ভবত কখনোই দেখা
যায়নি! পরে বুঝেছি, দুই
বাচ্চা'র মা যখন একজন
'সিঙ্গেল মম' এবং
'৯টা-৫টা'র ওয়ার্কিং
লেডি', তখন এই দৌঁড়ঝাঁপই
স্বাভাবিক! যাই হোক,
আমাদের পরিচয়টা হয়েছিল
এভাবেই|
আমার কাজ সিটিতে| তাই
প্রায় নিয়মিতই তার অমন
ছোটাছুটি দেখি! সিটির
উদ্দেশ্যে ট্রেন ধরবার
পথে| ভীড় কম থাকা কোনো
কোনো দিনে আবার সে আমার
জন্য কিংবা আমি তার
জন্য জায়গাও রাখতে শুরু
করি| টুকটুক করে কিছু
আলাপ হতে না হতেই অবশ্য
ওর গন্তব্য এসে যায়|
আদ্রিয়ানার কাজ
ফুটস্ক্রে তে| তাই ও
নেমে যায় সিটি থেকে দুই
স্টপেজ আগে| সুতরাং ঐ
বারো/তেরো মিনিট
মেলবোর্নের জঘন্য
আবহাওয়া, পাবলিক
ট্রান্সপোর্টের
অপ্রতুলতা নিয়ে আলাপ
সারতেই, শেষ হয়ে যায়! তবু
এর মাঝেই কিভাবে কিভাবে
যেন ওর সম্পর্কে অনেক
কিছু জেনে যাই|
আদ্রিয়ানা থাকে
হোপার্স ক্রসিং স্টেশন
এর কাছেই| তিন আর পাঁচ
বছর বয়সী দুই মেয়েকে
নিয়ে নিজের মতো করে
একাই থাকে|
অস্ট্রেলিয়ার
সিটিজেনশিপ হয়েছে
অনেকদিন হলো কিন্তু
অরিজিনালি সে ইতালিয়ান|
তার ইংলিশ উচ্চারণেও
ইতালিয়ান একসেন্ট
রয়েছেও কিছুটা! তেরো
বছর বয়সে মা-বাবা'র হাত
ধরে প্রথম এসেছিল এ
দেশে| মা-বাবা এবং ছোট
দুই ভাইও রয়েছে
মেলবোর্নেই| ওরা সবাই
নাকি বেশ ফ্যামিলি
ওরিয়েন্টেড| ওর মা বাবা
খুব করে চেয়েও ছিলেন
ডিভোর্সের পর
আদ্রিয়ানা ওদের কাছেই
থাকুক! কিন্তু সে
থাকেনি! ওর মুখেই শোনা এ
সবকিছু| এভাবেই চলছিল
আমাদের দুই
ট্রেনযাত্রীর
আলাপচারিতা এবং হালকা
বন্ধুতা| ও নিজের কথা
নিজে থেকে বললেও আমার
কেন যেন তেমন কিছু বলা
হয়নি| ও যেটুকু জিজ্ঞেস
করতো শুধু সেটুকুই
বলেছি| এই যেমন, দুই
ছেলে-মেয়ে আর
হাসব্যান্ড সহ থাকি
টার্নেইটে| শিক্ষকতা
করি| জব সিটিতে| ওর জানতে
চাওয়া অনুসারে
জানিয়েছি| …এটুকুই!
পরিচয়ের মাস ছয়েক পর
হঠাৎ এক উইকেন্ডে ফোন
পাই| স্ক্রিনে ওর নম্বর
দেখে অবাক হই কিছুটা| এই
ধরণের সম্পর্কে ফোন
নম্বর বিনিময়ই হয়
কদাচিৎ, ফোন কল তো দূর কি
বাত! যাইহোক ফোনে কথা
বলে জানতে পারি, জরুরি
ভিত্তিতে কেয়ারার
প্রয়োজন! ওর বাচ্চাদের
রেগুলার কেয়ারারের কি
একটা প্রব্লেম হওয়ায় সে
ভয়ঙ্কর বিপদে পড়েছে|
বিশেষ করে ছোট
বাচ্চাটাকে নিয়ে! বড়টা
যেহেতু স্কুলে পড়ে, ওকে
স্কুলেরই 'বিফোর এন্ড
আফটার কেয়ার' -এ দিতে
পারবে| কিন্তু ছোট
মেয়ের জন্য হুট্ করে
কোনো চাইল্ড কেয়ার
সেন্টার কিংবা
ফ্যামিলি কেয়ার (যাঁরা
সরকারী ভাবেই নিজের
বাসায় রেখে বাচ্চার
দেখাশোনা করেন) কিছুই
পাচ্ছে না! আমাকে প্রায়
কাঁদো কাঁদো হয়ে
রিকোয়েস্ট করলো যেন
কারোর খোঁজ দেই! অবাক
হয়ে ভাবতে থাকি, এতো লোক
থাকতে আমাকে কেন বলছে?
আমাকে কি ঠিক ততখানি সে
'চেনে' নাকি 'জানে'?
বাচ্চার কেয়ারার
খুঁজতে হয় খুব রিলায়েবল
সোর্স থেকে| ভাবতে
ভাবতেই শুনি আদ্রিয়ানা
বলছে
- "দ্যাখো রাকা, আমি
আমার এক বন্ধুস্থানীয়
কলিগ ম্যালিসা আর
তোমাকে ছাড়া কাউকেই
বলিনি এই বিপদের কথা!
ট্রেনে দেখেছি তুমি সব
বাচ্চাদের ব্যাপারেই
কেয়ারিং| নিশ্চয়ই
তোমার ছেলেমেয়েদেরকেও
ভালো একজন কেয়ারারের
কাছে দিয়েছিলে? প্লিজ
তাকে কি রিকোয়েস্ট করে
দেখবে? আমার মেয়েটাকে
রাখতে পারবে কিনা?
বোঝোই তো একার ইনকাম;
চাইল্ড কেয়ার
সেন্টারের খরচ পোষাতে
পারবো না| যদিও হুট্ করে
তাও পাচ্ছি না| আমার মা'র
কাছেও নিয়মিত রাখতে চাই
না| আমার জন্য ভালো
ফ্যামিলি কেয়ারারই
একমাত্র ভরসা!"
- 'হুমম …বুঝতে পারছি
আদ্রিয়ানা! কিন্তু আমার
ছেলে মেয়ে দুজনই তো
স্কুলে পড়ে| ছোটজনও তো
ফ্যামিলি কেয়ার ছেড়েছে
তাও প্রায় বছর তিনেক
হলো! …আচ্ছা দেখি খোঁজ
নিয়ে..
- "হ্যাঁ প্লিজ
…প্লিইজ চেষ্টা করো
আমার জন্য! সারা জীবন
কৃতজ্ঞ থাকবো তোমার
প্রতি! প্লিজ!
দুশ্চিন্তা না করার
পরামর্শ আর কিছুটা
আশ্বাসও দিয়ে ফোনটা
ছাড়লাম| তারপর জোর
চেষ্টা চালিয়ে এবং অনেক
অনুনয়-বিনয় করে, পরিচিত
একজন (ফ্যামিলি
কেয়ারার হিসেবে কাজ
করতেন আগে, এখন জব ছেড়ে
দিয়েছেন) ভাবীকে রাজী
করিয়েও ফেললাম
বাচ্চাটাকে রাখার জন্য|
দুইপক্ষের তুমুল
তোড়জোড়ে তিনদিনেই সব
ফরম্যালিটিজ সেরে ফেলা
গেলো| আদ্রিয়ানাকেও আর
বেশি দিন অফিস কামাই
দিতে হলো না!
এই ঘটনার পর থেকেই মনে
হয় আদ্রিয়ানা আমাকে
অন্যরকম রিলাই করতে
শুরু করলো| প্রায় প্রতি
উইকেন্ডেই ফোন করতে
থাকলো!| আমি ফোনের ফ্যান
নই, বুঝতে পেরে হঠাৎ
হঠাৎ ওর বাসায় কফি'র
দাওয়াত দিতে শুরু করলো|
সময় সুযোগ মিললে
গিয়েছিও চার/পাঁচ বার|
কিন্তু আমি আসতে বললে
আমার বাসায় তেমন আসতে
চায় না! শুধু একবার
এসেছিলো; তাও রাকিন
মানে আমার হাসব্যান্ড
ফেরার সাথে সাথেই কি
একটা কারণ দেখিয়ে ও
হুড়মুড় করে বাসা থেকে
চলে গিয়েছিল| ওর
বাসাতেও যে গেলে আমাদের
অনেক গল্প-আড্ডা হয় তাও
তেমন নয়! মেয়েটার মাঝে
কি যেন একটা আছে! অনেক
এলেমেলো কথা বলেও, কি
যেন শেষে আর বলতে পারে
না! প্রথম যেদিন
গিয়েছিলাম, মনে আছে
একটু এদিকে সেদিকে
ইতস্তত ঘুরিয়ে ওর
ব্যাকিয়ার্ডে (বাসার
ভেতরের দিকের উঠোন)
নিয়ে গিয়ে বসায়| সেদিন
ফিরে আসার সময় বলেছিলাম
ওর ব্যাকিয়ার্ডটা আমার
ভালো লেগেছে| খুব খুশি
হলো শুনে| ব্যস, তারপর
যতবারই গিয়েছি, সরাসরি
ওখানে নিয়ে বসিয়েছে …!
ব্যাকিয়ার্ডটা কোথাও
বেশ একটু ছিমছাম, আবার
কোথাও কিছুটা এলোমেলোও!
সবমিলিয়ে কোথায় যেন এক
মফস্বলী ভাব রয়েছে!
হঠাৎ একদিন মনে হলো আরে,
এ ভাবটা তো খানিক
আদ্রিয়ানার মতোই! … ঘন
সবুজ ঘাস পুরো টা উঠোন
জুড়ে| গ্রীন
আর্টিফিশিয়াল টার্ফ নয়;
একবারে সবুজ প্রাকৃতিক
ঘাস| পাঁচিল ঘেঁষে (তবে
সার বেঁধে নয়) কমলালেবু,
এপ্রিকট, পাতিলেবু আর
বুনো টক আপেলের গাছ|
আপেল গাছে আবার সবসময়
দেখেছি ~ এক ঝাঁক টিয়ে
'আসছে আর যাচ্ছে'| উঠোনের
মাঝ বরাবর বেশ বড়সড় এক
ফুল-লতাপাতার নকশা কাটা
লোহার দোলনা| বসার
জায়গায় বাদামি
প্ল্যাস্টিকের কভারে
মোড়া নরম একটা গদিও আছে
আঁটা| এই দোলনায় চড়েই
আমরা ওর বানানো কফি পান
করি আর আস্তে ধীরে
দুলতে থাকি| এই কফি
পানের সময়টায় ওকে
প্রায়ই কেমন একটু
বিহ্বল দেখায়| মনে হয় ওর
একার এই লড়াইয়ের কিছু
কথা কাউকে শেয়ার করতে
চায় কিন্তু পারছে না!
হয়তো ওর সেই শেয়ারিং এর
মানুষটা 'আমি' কিনা ও
নিশ্চিত নয়! নিজে থেকে
অবশ্য কিছু জিজ্ঞেস
করিনি| উপযাজক হয়ে
জিজ্ঞেস করাটা এখানকার
দস্তুর নয়; আর তাছাড়া তা
আমার ইচ্ছেও নয়| তাই
চুপচাপ দুলে দুলেই পার
করে দিতাম ঘন্টা খানিক
সময়! এইরকম 'কথা বলা' 'না
বলা'র মাঝেও কি একটা
সমঝোতা যেন আমাদের হয়ে
গিয়েছিল| সময়টা আমাদের
কারোরই খারাপ কাটতো না!
বাসায় ফিরে আসবার কথা
বললেই সে আশ্চর্যজনক সব
কথাবার্তা বলতো| কখনো
বলতো ''প্লিজ আর একটু
বোসো?" অথবা "..যা আছে
তাই দিয়েই আমার
বাচ্চাদের সাথে ডিনার
করে যাও?" কোনো বাঙালি
বাসায় গিয়ে এ কথা শুনলে
নিশ্চয়ই অবাক হতাম না!
কিন্তু একজন
ইতালিয়ান-অস্ট্রেলিয়া
ের বাসায় এ কথা শোনা
মানে দুচোখ কপালেই উঠে
যাওয়া! আমার অবাক
দৃষ্টি পড়ে নিয়ে, নিজেই
আবার বলতো "না না ঠিক
আছে, তুমি যাও! আরশি আর
আর্নণও নিশ্চয়ই
অপেক্ষা করছে মায়ের
জন্য!
মেয়েটা কখনো খুব
দৌঁড়োচ্ছে, হাঁপাতে
হাঁপাতে ফোনে একনাগাড়ে
কথা বলছে| আবার কখনো বা
উইকএন্ডের অলস কোনো
দুপুরে ওপ্রান্ত থেকে
কথাহীন বসে আছে ফোনটা
কানে চেপে| তখন ওদিক
থেকে কিছু তেমন শুনতে
না পেলেও আমি ওর এবং
বাচ্চাদের খোঁজ খবর
করি, মা কেমন আছেন জানতে
চাই| সে হু হা করে শেষে
ফোন রেখে দেয়! বুঝতে
চেষ্টা করি ওর এই
'গতিহীনতা', আবার একই
সাথে 'তীব্র গতিশীলতা'র
যোগসূত্র ঠিক কোথায়?|
মেয়েটা আর দশজন
অস্ট্রেলিয়ান বা
ইতালিয়ান মেয়ের মতো নয়|
এখানকার জীবনে ডিভোর্স
প্রায় ডাল-ভাত| ছেলে,
মেয়ে দুপক্ষই মেনে নেয়
সহজে| শুধু 'সিঙ্গেল
মম'দের জীবন একটু কঠিন
হয়ে যায় এই আর কি! তারপরও
জীবনের বাকি সব কিছুতে
তারা স্বাভাবিক সব
কার্যক্রমেই থাকে| নতুন
করে পার্টিতে যায়|
বয়ফ্রেন্ড খুঁজে নেয়|
বন্ধুবান্ধবের সাথে
উইকেন্ডে বারবিকিউ করে|
কিন্তু আদ্রিয়ানার
ব্যাপার স্যাপারই আলাদ!
অনেকটা এশিয়ান মায়েদের
মতো! উইকেন্ডে ফ্রি
থাকলে মা-বাবার কাছে
বেড়িয়ে আসে| মা, বাবা,
দুই ভাই এর বার্থডেতে
নিয়মিত গিফট সহ,
প্ল্যান প্রোগ্রাম করে
আনন্দময় উদযাপন করে|
উদযাপন হয়
রেস্টুরেন্টে কিংবা
বাসায়| ঐ ওটুকুই| এর
বাইরে ওর জগৎ বলতে
শুধুই দুই মেয়ে
এলিস-এঞ্জেলিনা এবং
তার কর্মক্ষেত্র| খুব
মন দিয়ে কাজ করে| ওর জব
রিয়েল এস্টেটে| এই
ইন্ডাস্ট্রিতে
দক্ষতাও আছে বেশ| বাড়ি
কেনার সময়ে ওর কৌশলী
পরামর্শ আমাদের দারুণ
কাজে এসেছিলো|
এর কিছুদিন পরই
আদ্রিয়ানার সাথে
ট্রেনে দেখা হওয়া টা
বন্ধ হয়ে যায়| ওর একটা
প্রমোশন হয়েছে| তাই
কাজের সময়সূচি কিছুটা
বদলে গিয়েছে| তবে
আমাদের যোগাযোগটা তখনো
আছে| কেন এবং কিভাবে যে
আছে বুঝতে পারি না
বরাবরের মতোই! তবে আছে|
সে ফোন করে| মেসেজ দেয়|
আমিও একটু আধটু তাল
মিলিয়ে যোগাযোগ রক্ষা
করি| এর মাঝেই একদিন
হুট্ করে ফোন দিয়ে
জানতে চায় আমি কোথায়|
একটু জ্বর থাকায় সেদিন
সিক লিভ নিয়েছিলাম, তাই
জানালাম বাসাতেই আছি|
শুনেই বললো "আমি আসি
তোমার বাসায়? তোমার
হাজব্যান্ড নিশ্চয়ই
অফিসে?" কি বলি বুঝতে
পারছিলাম না কিছুক্ষণ!
বাসায় তেমন
রান্নাবান্না নেই! আর
থাকলেও ওকে অফার করার
মতো কিছু তো একেবারেই
নেই! তার উপরে শরীরটা
এতো ম্যাজম্যাজ করছে যে
ইচ্ছে ছিল বাচ্চারা
স্কুল থেকে ফেরার আগ
পর্যন্ত বিছানায়
গড়িয়েই কাটিয়ে দেবো!
ইতস্তত করেও শেষে বললাম
'ঠিক আছে, চলে এসো!' ফোন
রাখার আগে অবশ্য ও
বারবার করে বললো
"প্লিজ তুমি আমাকে
নিয়ে ব্যস্ত হবে না! আমি
দুজনের জন্য কফি নিয়েই
আসবো" … ঘন্টা দেড়েকের
মাঝে যখন সে এলো, তাকে
দেখে তো আমি অবাক! এত
অল্প সময়ে সে কেমন করে
এত কিছু বেঁধেছেঁদে
আনতে পারলো? নেভিব্লু'র
মাঝে সাদা ডটের ঢোলা
একটা কর্ডের শার্ট
(হাতা ফোল্ড করা)
ক্যাজুয়াল জিন্স আর
চামড়ার ফিতের
স্যান্ডেলে বেশ লাগছে
দেখতে| সবসময় অফিসের
ফরম্যাল সাজে নয়তো ওর
বাসায় গেলে ঘরের
পোশাকেই দেখেছি| কাঁধে
ঝুলছে ওর অফিসের ঢাউস
কালো ব্যাগটা, তার উপরে
আবার কাপড়ের ঝোলা মতোন
এক ব্যাগ আর সাথে দুই
হাত ভর্তি খাবারের
বাক্স| আমার অবাক
দৃষ্টির সামনে যেন খুব
লজ্জ্বায় পড়ে গেল,
কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে
বললো
-- "তোমার বাচ্চাদের
জন্য ক্রীমি পাস্তা
রেঁধেছিলাম| আর নিজ
হাতে বানানো
সান-ড্রায়েড টমেটো-
শশা'র আচার দিয়েছিলেন
মা, তোমার জন্য আলাদা
করে| দেবো দেবো করে আর
দেওয়া হচ্ছিলো না!
আজকাল তো আর ট্রেনেও
দেখা হয় না| জানো, তুমি
আজ বাসায় না থাকলেও ডোর
স্টেপে রেখে যেতাম|
কিন্তু ফোনে তোমার বসা
গলা টের পেয়ে দ্রুত
একটা লেমন ফ্লেভার্ড
ভেজিটেবল স্যুপ বানিয়ে
এনেছি| প্লিজ কিছু মনে
কোরো না!"
- 'এই এতো কিছু …?! তারপরও
আবার দোকানের খাবার?!
-- "যদি আমার হাতে তৈরি
স্যুপ তোমার এই
অসুস্থতায় মজা না লাগে!
আমি তো তেমন স্পাইসি
করে রাঁধতে পারি না| তাই
স্টেশনের কাছেই যে
ইন্ডিয়ান
রেস্টুরেন্টটা আছে,
ওখানকার চার সার্ভ রোটি
আর বাটার চিকেনও নিয়ে
নিলাম|"
- 'ওহঃ খোদা… এতো কিছুর
পরেও আবার গ্লোরিয়া
জিন্সের কফি?'
--"কফি তো লাগবেই, নাহলে
মুখোমুখি বসবো কি নিয়ে?
আর, বাইরের কফি নিতে হলে
তো তুমি সবসময়
'গ্লোরিয়া জিন্স'ই নাও
বলেছিলে একদিন …
তাই…"
এরপর আর কিইবা বলা যায়!
ওর আনা কফি নিয়েই গিয়ে
বসলাম ভেতরের ফ্যামিলি
লাউঞ্জে| পর্দা টেনে
সরিয়ে দিতেই দেখি বাইরে
ঝলমলে রোদ উঠে গিয়েছে| ও
একদম ঝপাং করে রোদের
মাঝে গিয়ে বসেই আবার
সরে এলো|| আমাকেই জোর
করলো ঐ রোদ লাগা
সোফাটায় বসতে| ওখানে
রোদমাখা হয়ে আধাঘন্টা
বসলেই নাকি আমার শরীরটা
ঝরঝরে লাগতে শুরু করবে|
হেসে ফেললাম!
ভাষা-সংস্কৃতি-কাঁটাতা
ের বিশাল ব্যবধানেও
আপন মানুষগুলো এখনও
ভেতরে ভেতরে একই! ওর
ইচ্ছেয় ওখানেই বসলাম|
সেদিনের ঐ সকালে, বলা
ভালো দুপুরে, তাকে কি
যেন পেয়েছিল! কি যে
ছটফটানি সারা চোখেমুখে
আর খলখল করে হাসছিলো
সবকিছুতে| মিনিট পনেরো,
টুকটাক গল্প হলো| তারপর
হঠাৎই জিজ্ঞেস করলো
-- "আচ্ছা রাকা, তোমার
কি মনে হয় আমি খুব বোকা
একটা মেয়ে?"
- 'আরে না …! কেন, কেউ কিছু
বলেছে?'
-- "নাহ মানে, আমার মা গত
এগারো বছর ধরে ক্রমাগত
তেমনটাই বলেন কিনা!"
- 'বোকা মেয়ে! মায়েরা তো
অমনটা বলেই থাকেন!
আমারই তো মনে হয়
ছেলে-মেয়ে দুইটাই আমার
চরম বোকা হয়েছে!'
-- "না না …. ঠিক ওরকম না
বিষয়টা!"
থেমে যাই| আদ্রিয়ানাও
চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ|
তারপর আদ্রিয়ানাই আবার
বলতে শুরু করে|
-- "জানো, আজকের এই দিন
আমার জীবনের অতি বিশেষ
একটি দিন! এগারো বছর
আগের এই দিনটাও জানো,
হুবহু একই রকম ছিল!
সকালটা ছিল হীম শীতল
ঠান্ডা| প্রচণ্ড
কুয়াশাও ছিল আজকের মতো|
তারপর এই সকাল এগারোটার
দিকে হঠাৎই একেবারে রোদ
ঝলমলে যেমনটা এই এখন
দেখছো! পার্থক্য শুধু
তখনকার আর এখনকার
আমাতে| তখন আমি চঞ্চল,
উচ্ছল, তারুণ্যে ভরপুর
এক তরুণী| বয়সও অল্প|
কতইবা ছিলাম তখন? এখন
যদি একত্রিশ হয়, তখন
কুড়িতে পড়েছি মাত্র|
উচ্চতর পড়াশুনায় আগ্রহ
ছিল না কখনো| ইয়ার
টুয়েলভের পর, কিছুদিন
টুকটাক কাজ করে, স্থায়ী
কোনো পেশার চিন্তা শুরু
করলাম| ভাবতে ভাবতেই
একদিন রিয়েল স্টেট্ এর
কোর্স-এ ভর্তি হলাম|
কোর্স শেষ করার আগেই
কয়েকটা জায়গায় এপ্লাই
করে রেখেছিলাম| তাই
কোর্সের সার্টিফিকেট
হাতে আসার আগেই একটা
ইন্টারভিউ এর ডাক আসলো|
ইন্টারভিউ দিতে গেলাম
স্প্রিংভেল এর একটা
মোটামুটি মানের রিয়েল
স্টেটের মেইন
ব্র্যাঞ্চে| গিয়েছিলাম
এই ওয়েরিবি থেকে| দুবার
ট্রেন বদলিয়ে| কিন্তু
কিছুটা টেনশন, আবার
খানিক এক্সাইটমেন্টও
থাকায় একটা ভুল ট্রেন
ধরে ফেলি| বোঝোই তো সিটি
থেকে চেঞ্জিং এর সময়ে
ভুল লাইনের ট্রেন নিলে
কি মারাত্মক বিপদে পড়তে
হয়! যাইহোক মাথা ঠান্ডা
রাখতে চেষ্টা করি| এক
স্টেশন পেরিয়ে আবার
দৌঁড়াদৌঁড়ি করে ভুল
শুধরেও নেই| কিন্তু
নিলেও হাতের সময়ে কম
পড়ে যায়| স্প্রিংভেল
স্টেশনে নেমে আবার বাস
নেওয়ার প্ল্যান থাকলেও,
সময় স্বল্পতায় একটা
ট্যাক্সি খুঁজতে থাকি|
- 'একটু চা করে আনি? 'চায়ের
তৃষ্ণা পাচ্ছে যেন…|'
--"তোমার হাতের চা?
চমৎকার … কিন্তু আজ বাদ
দাও! সুস্থ থাকবে যেদিন,
সেদিন এসে নাহয় .."
- 'আরে একটু চা'ই তো …
ব্যাপার না!'
চা বানিয়ে লাউঞ্জে
নেবো, এমন সময় চোখে পড়লো
ব্যাকিয়ার্ডের ডেকে
এসে বসে রয়েছে আমার
সেমি পোষা দুই শালিখ|
'সেমি পোষা' বললাম
রাকিনের ভাষায়| ও আমাকে
এই শালিখ জোড়া নিয়ে
সবসময় খ্যাপায়| বলে এই
শালিখ পাখিরা নাকি কোনো
খাবার মুখেই তোলে না,
আমার দেওয়া ভাত-রুটি বা
অন্য কিছু ছাড়া| চায়ের
মগ দুটো বেঞ্চটপে
নামিয়ে ওদের জন্য ফ্রিজ
থেকে এক পিস্ ব্রেড
নিলাম| স্লাইডিং ডোর
পেরিয়ে ব্রেড টুকরো করে
ছড়িয়ে দিলাম| কিন্তু
অবাক কাণ্ড ~ ওরা মুখেও
তুললো না, একটু নড়েচড়ে
আমার প্রতি ভালোবাসাও
দেখালো না| এক দৃষ্টিতে
বাসার অনিয়মিত এই
অতিথিকে দেখছে! দেখছে
তো দেখছেই! কি এতো দেখছে
কে জানে! রাকিন সহ
আরশি-আর্নণ আজ বাসায়
ফিরলে বলতে হবে~ আমার
হাতেও খাননি উনারা!
শুনলে বোধহয় বলবে - ঘরের
ভেতরে বসা এই অতিথিকে
তাদের হিংসে হয়েছে!
শালিখজোড়াকে বাইরে
বসতে হয় যে!
চায়ে চুমুক দিয়েই বিনা
ভূমিকায় আদ্রিয়ানা
আবার বলতে শুরু করলো
-- "স্প্রিংভেল
স্টেশনে নেমেই শয়ে শয়ে
ট্যাক্সি দেখা যায়
সবসময়| শুধু ঐ দিনই নেই!
নেই তো নেই! ট্যাক্সি
সার্ভিসে কল করলাম|
একটা ট্যাক্সি আসলোও;
এসেই আবার চালক 'স্যরি'
বলে চলে গেল| যেন ভূতে
আচ্ছন্ন হয়ে সে এসেছিলো
আবার ভুতের ডাকে চলেও
গেল! এমন সময় স্টেশনের
বাইরে বেশ দূরের রাস্তা
দিয়ে একটা হলুদ ক্যাব
যেতে দেখলাম| যদিও
নিশ্চিত ছিলাম ভুলেও সে
ঐ অতদূর থেকে আমার এই
হাত নাড়ানাড়ি দেখতে
পাবে না| তারপরও পাগলের
মতো হাত নাড়লাম| মজার
বিষয় হলো ট্যাক্সি টা
এলো! আরো চমৎকার বিষয়
ছিল ট্যাক্সির চালক
আমাকে কোথায় যাবো তা না
জিজ্ঞেস করে, সরাসরি
গাড়িতেই উঠে বসতে বললো|
অর্থাৎ আমাকে বাতিল করে
দেবার কোনো অবকাশ তার
রইলো না| উত্তেজনায়
গাড়িতে চড়ে বসে তাকে
ধন্যবাদ না জানিয়ে
শুধুই 'থ্যাঙ্কস গড'
'থ্যাঙ্কস গড' বলছিলাম|
চালক পিছে ফিরে তাকিয়ে
স্মিতহাস্যে বললো 'কোনো
ইন্টারভিউ -এ যাচ্ছ
বুঝি? কোনো ভয় নেই,
প্লেনের গতিতে গিয়ে
হলেও পৌঁছে দেবো|
কিন্তু ঠিকানা তো বলো!'
শুনে সম্বিৎ ফিরে
পেলাম| ধাতস্থ হয়ে তাকে
আমার গন্তব্য জানালাম|
জীবনের প্রথম
ইন্টারভিউ ছিল বলেই
কিনা জানি না,
সিরিয়াসলি নিয়ে
ফেলেছিলাম| দেরি করে
ফেলায় শেষের দিকে
নার্ভাসও ফিল করতে শুরু
করলাম| বাদামি মুখের
মিষ্টি হাসি'র ছেলেটা
টুকটুক করে কি যে
বলছিলো তা আর আজ
ডিটেইল্ড মনে নেই| শুধু
মনে আছে আমিও খানিক সময়
পরে হাসতে আরম্ভ করলাম|
এবং এক পর্যায়ে আমার
নার্ভাসনেস কেটে গেলো|
আমাকে সে ঠিকঠাক পৌঁছে
দিয়েছিলো| তাকে কার্ডে
পে করে নামতেই, সেও
নামলো| আর বিড়বিড় করে কি
একটা প্রে করে আমার
গায়ে দূর থেকে ফুঁ দিলো|
কিছুই বুঝলাম না| বোঝার
সময়ও নেই| কোনোমতে
ইন্টারভিউ বোর্ডে
ঢুকলাম| ঢুকতেই সুন্দর
করে ওয়েলকাম করলো আর
বললো আমার সাথে প্রথম
ইন্টারভিউ অর্থাৎ
ফোনের ইন্টারভিউ এ সে-ই
ছিল| সাহস পেয়ে গেলাম|
কারণ ফোনের সেই
ইন্টারভিউয়ারকে আমার
চমৎকার লেগেছিলো| তো
ঘন্টাখানিকের
প্রশ্নোত্তর শেষে ওরা
আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে
বললো মনে রেখো কাজে
দেরি করে আসা চলবে না!
আমিও খুশিতে তৎক্ষণাৎ
ঘাড় কাৎ করে জানিয়ে
দিলাম আমি কাছেপিঠের
কোনো একোমোডেশন নিয়ে
নেবো|"
-- 'বাহ্, চমৎকার তো! প্রথম
চেষ্টাতেই চাকরি হয়ে
গেলো!
-- "হুম.. হয়ে গেলো! প্রথম
এপ্লিকেশনেই চাকরি
পেয়ে যাবার আনন্দে আমি
রীতিমতো উড়ছিলাম| উড়তে
উড়তেই কনট্র্যাক্ট
পেপারে সাইন করে অফিস
থেকে বের হতেই দেখি সেই
ট্যাক্সিচালক গাড়ি
নিয়ে অফিসের সামনের
পার্কিংএ দাঁড়িয়ে আছে|
আমাকে দেখেই এগিয়ে এসে
জিজ্ঞেস করলো চাকরিটা
হয়েছে কিনা| জানালাম
হয়েছে| শুনে প্রায় আমার
মতোই খুশি হয়ে গেল| হাত
তালি দিয়ে বলে উঠলো 'আমি
জানতাম হবে'! চাকরি
প্রাপ্তির উত্তেজনায়
প্রথমে খুব একটা অবাক
হইনি তার এমন খুশি
হওয়ায়|"
-- 'কি হলো? থামলে কেন?'
- "নাহ কিছু না!! … এরপর
তাকে ভালো করে ধন্যবাদ
জানিয়ে স্টেশনের
উদ্দেশ্যে বাস নেবার
জন্য পা বাড়াতেই সে
আমাকে থামালো| বলল 'বাসে
যাওয়ার কি দরকার? তোমার
বাসার ঠিকানা বলো,
একটানে পৌঁছে দেবো|'
আমার একটু মায়াই লাগলো
বেচারি'র জন্য|
প্যাসেঞ্জার পাওয়ার
আশায় এতক্ষণ বসে ছিল|
তাকে আবারো ধন্যবাদ
জানিয়ে বললাম আমার বাসা
অনেক দূরে| সেই
ওয়েরবিতে| আমি এখান
থেকে একটা বাস ধরে
স্প্রিংভেল থেকে ট্রেন
নিয়ে নেবো| … তবে তুমি
যেহেতু এতক্ষণ ওয়েট
করেছো, তাই চলো আমাকে
স্প্রিংভেল স্টেশনেই
নামিয়ে দিয়ে এসো? সে আর
কথা না বাড়িয়ে, গাড়ির
দরোজা খুলে দিলো|
স্টেশনে যাবার পথে
ইন্টারভিউ নিয়ে
অনেকগুলো মজার মজার জোক
বললো| হাসতে হাসতে আমার
অবস্থা শেষ হয়ে
যাচ্ছিলো| স্টেশনের
কাছে আসতেই সে আমাকে
জানালো কষ্ট করে ট্রেনে
না গিয়ে তার সাথেই
ওয়েরিবিতে যেতে পারি|
আমি বিনয়ের সাথেই
প্রত্যাখ্যান করি তার
সে প্রস্তাব|| স্টেশনে
পৌঁছে ভাড়া মিটিয়ে এবং
শেষ বারের মতো ধন্যবাদ
জানিয়ে ট্রেন নিয়ে
নিলাম|
-- "আচ্ছা রাকা, তোমাকে
বিরক্ত করছি না তো?"
- 'আরে না, বিরক্ত কেন হবো?
আমি তো আজ ফ্রিই ছিলাম! …
বলো তারপর কি হলো?
আচ্ছা, এরপরে কি ঐ চালক
ছেলেটির সাথে তোমার
আবার দেখা হয়েছিল?'
-- 'আশ্চর্য! …তাহলে, কি
হয়েছিল তুমি তা বুঝতে
পারছো?"
- 'না না, আমি সেভাবে
কিছুই বুঝতে পারছি না …
প্লিজ তুমি কন্টিনিউ
করো! আর বিরক্ত করবো
না!'
-- "বিরক্ত? হি হি হি
....আচ্ছা বলছি| ট্রেনে
উঠেই মা-বাবা সবার সাথে
কথা বললাম| বাবা মা
দুজনেই খুব চমকিত হলেন,
অনেক খুশিও হলেন| তুমি
তো জানোই আমাদের কঠিন
ক্যাথলিক পরিবার| বাসায়
রোজ সন্ধ্যায় সবাইকে
নিয়ে মা প্রে করতে বসান|
আমাদের ওয়েরিবি'র বাসায়
ফ্যামিলি লাউঞ্জের বাম
দিকের এক কোণে যেই প্রে
কর্ণার, সেখানে| যেকোনো
খুশির খবরে মা অনেকগুলো
মোমবাতি উৎসর্গ করেন
গীর্জায়| ফি রবিবারে
যেখানে প্রে করতে যাই,
ওখানে| মা জানালেন এই
রবিবারেই মোমবাতি
দেবেন! বন্ধুদের সাথেও
কথা হলো| এতোদূরের পথ
তবু কি দ্রুতই না সেদিন
ওয়েরিবিতে পৌঁছলাম!
স্টেশনের বাইরে আসতেই
দেখি.."
- 'দাঁড়াও, আমি বলি কি
দেখলে? তোমার সামনে
দাঁড়িয়ে আছে সেই
ট্যাক্সি চালক!'
-- "ওহঃ গড! তুমি কিভাবে
বুঝলে?! তাহলে কি এইটা
তেমন আশ্চর্যজনক কোনো
ঘটনা ছিল না? আমি আসলেই
খুব বোকা, তাই ভীষণ অবাক
হয়েছিলাম?"
- 'না না… তুমি একটুও
বোকা নও| এই ধরণের ঘটনা
আসলে বেশ কমন আমাদের
সাবকন্টিনেন্টের
দেশগুলোতে| ছেলেরা
কারোর প্রেমে পড়লে সব
রকম সারপ্রাইজ দিতে
পারে তার পছন্দের
মেয়েটিকে নিজের প্রেমে
ফেলতে! তাই হয়তো অনুমান
করে ফেললাম কিছুটা!
আসলে ওর আগের আচরণে মনে
হলো ও তোমার সঙ্গ পেতে
চাইছে…'
-- "তাহলে তোমাকে আর কি
বলবো! নিশ্চয়ই অনুমান
করতে পারো, তার ঘটানো
অত্যাশ্চর্য সব ঘটনা
কেমন ছিল! … শর্টকাটেই
বলি - হ্যাঁ বের হয়ে
দেখি, সেই ট্যাক্সি
চালক আমার দিকে তাকিয়ে
হাত নাড়ছে আর হাসছে!
…তোমরা ইন্ডিয়ানরা
প্রেমে পড়লে যে কতখানি
রোম্যান্টিক হতে পারো,
তা নিজের জীবনে না ঘটলে
কোনোদিনই বিশ্বাস করতে
পারতাম না! প্রথম প্রথম
বিব্রত বোধ করেছি|
এড়িয়েও যেতে চেয়েছি|
কিন্তু নাহ, পারিনি! এক
মাসের মাঝে আমিও হুড়মুড়
করে তার প্রেমে পড়লাম|
তার মুগ্ধ চোখে নিজেকে
দেখাটা নেশার মতো হয়ে
গিয়েছিল| কিছুদিন বাদে,
আমার চোখও রঙিন হতে
শুরু করলো| আগে যে
একেবারেই কোনো প্রেম
হয়নি, তা নয়! তবে এ প্রেম
ছিল অন্যরকম| উথাল
পাথাল! প্রশান্ত
মহাসাগরের ঢেউয়ে মতো
উত্তাল! এদিকে সব
দেখে-বুঝে আমার
মা-বাবা'র 'মাথা খারাপ
অবস্থ'!! জানোই তো, আমরা
অস্ট্রেলিয়ানদের মতো
'হিজ হিজ হুজ হুজ' টাইপ
নই| অন্তত বিয়ে বিষয়ক
সিদ্ধান্তে পরিবারের
মতামত আমাদের জন্য
অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ|
কিন্তু মাস তিনেক
যেতেই, রাফি বিয়ের জন্য
নাছোড়বান্দা হয়ে উঠলো|
অন্যদিকে মাও ক্রমাগত
বোঝাতে লাগলেন ধর্ম
ভিন্ন, দেশ ভিন্ন,
দুজনের ভাষাও ভিন্ন~ এ
সম্পর্ক থেকে অবশ্যই
সরে আসা উচিত| বিশেষ করে
ধর্মের ভিন্নতা মা
মানতেই পারছিলেন না!"
- 'কঠিন পরিস্থিতি! কি
করলে তুমি?'
-- "রাকা, তোমার তো
বুঝতে পারার কথা কি
করেছিলাম! হ্যাঁ
সম্পর্কের চার মাসের
ভেতর, দুইজন মিলে রাফি'র
কয়েকজন বন্ধুকে সাথে
নিয়ে বিয়ে করে ফেললাম|
বাসার কেউ বিয়ের প্রথম
তিন বছর আমার সাথে কোনো
যোগাযোগ রাখলো না! আমি
অবশ্য মাঝেমাঝেই
চেষ্টা করতাম|
তাঁদেরকে না পেলেও,
আমাদের দুজনের সংসারে
সুখের কোনো ঘাটতি ছিল
না| রাকা, তুমি আমার
ব্যাকিয়ার্ডে গিয়ে যে
দোলনায় দোল খাও, সেই
দোলনাটা আমরা বিয়ের
পরপর কিনেছিলাম|
সামারে ও যত রাতেই
ট্যাক্সি চালিয়ে ফিরুক
না কেন, ডিনার সেরে
একবার অন্তত দুজন গিয়ে
দুলতাম| ওর কাঁধে মাথা
রেখে কোনো কোনো
অতিরিক্ত ভালোলাগার
রাতে আমার মনে হতো - আমি
মেলবোর্নে নেই, আমার
ফেলে আসা ভেনিসে রয়েছি|
শহরের অথৈ পানিজুড়ে
একটি মাত্র নৌকা; দুজন
মিলে সেই নৌকায় দুলে
দুলে চলছি! অমন দুলতে
দুলতেই দুই বছর কেটে
গেলো চোখের পলকে! ধীরে
ধীরে আমরা সংসার টা
গুছাতে শুরু করলাম|
স্টুডেন্ট লাইফে
সেমেস্টার ফি দিতে গিয়ে
ওর প্রচুর ক্রেডিট
কার্ড নিতে হয়েছিল|
প্রথমে সেগুলো শোধ
করলাম| তুমি তো জানোই,
রিয়েল স্টেটে থাকলে
নিজেদের উপযোগী ভালো
বাড়ি কিনে ফেলাটা বেশ
সহজ| এপিং এর দিকে ছোট্ট
সুন্দর একটা একতলা বাড়ি
কিনে ফেললাম| জানো, ঐ
বাড়িটার সাথে আমার
এখনকার যেই বাড়ি তার
অনেক মিল রয়েছে| আচ্ছা,
সে গল্প আজ থাক| … আমরা
নিজেদের বাড়িটা কিনেই
মনের মতো করে সাজাতে
শুরু করি … প্রায়ই
বিভিন্ন পার্টি দিতাম|
আমাদের বেশিরভাগ
মেলামেশাই ছিল ওর দেশি
বন্ধুদের সাথে… "
- 'তোমার কষ্ট হতো না
ভাষা-ধর্ম-সংস্কৃতির
ভিন্নতায়?'
-- "নাহ, একদমই না! আসলে
কি জানো, অনেকবেশি
ভালোবাসা থাকলে অনেক
কিছুই পারা যায়! ওর
বন্ধুরাও বলতো-
আদ্রিয়ানা নিজেকে
সম্পূর্ণ বদলে নিয়েছে|
জানো, যেই আমার পর্ক
ভীষণ প্রিয় ছিল সেই আমি
পর্ক রীতিমতো অপছন্দ
করতে শুরু করে দিলাম|
বাসায় কিংবা বাইরে
সবখানেই, একা থাকি বা
দোকা, হালাল খাবারের
মেন্যুই খুঁজে
নিতাম!"
- 'নাহ, আসলেই আমূল বদলে
গিয়েছো ওকে বিয়ে করে!
আমি হলে, পারতাম না! হয়তো
এতোটা চেষ্টাও করতাম
না! কিন্তু সে যাইহোক,
তুমি বোধহয় ওভাবে উজাড়
করে দিয়েই সুখী ছিলে?'
-- "হ্যাঁ তা ছিলাম …
কিন্তু হঠাৎ একটু একটু
করে খেয়াল করলাম ওর
একধরণের হীনমন্যতা
হচ্ছে| আমার সাথে কিংবা
আমার জবের সাথে প্রায়ই
নিজের অবস্থা তুলনা করে
ফেলে কষ্ট পাচ্ছে| ওর
দেশে নাকি জবের ধরণ
ধারণের পার্থক্যের
উপরে ব্যক্তিগত
স্ট্যাটাসেরও
পার্থক্য নির্ধারিত হয়|
কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায়
তো এসব নেই, তাই না? কোনো
কাজই ছোট বা বড় নয় এখানে|
যাইহোক, ওকে তা বোঝাতে
ব্যর্থ হয়ে, নিজের মতো
করে নিজেই বুঝে নিলাম
আমাকে কি করতে হবে|
কিন্তু নতুন করে কোনো
পড়াশুনা বা কোনো
উদ্যোগও যে সে নিতে চায়
না! শেষে অনেক চেষ্টায়,
ওকে বুঝিয়ে রিয়েল
স্টেটের একটা শর্ট
কোর্স করিয়ে ফেললাম|
প্রথম জব আমিই পাইয়ে
দিলাম| প্রথম প্রথম ওর
সেলস টেকনিকে প্রচুর
ভুল থেকে যাচ্ছিলো, তাই
সেভাবে কোনো সেলও
পাচ্ছিলো না| ডিরেক্টলি
শেখালে মন খারাপ করবে,
তাই অনেক ঘুরিয়ে শেখাতে
শুরু করলাম| দুজনের বছর
খানিকের চেষ্টায়
অবশেষে সেও এই লাইনে
দাঁড়িয়ে গেল| আগে শুধু
সুখ ছিল, এরপর
প্রাচুর্য্যও জড়িয়ে
নিলো আমাদের|"
- 'সবই তো ভালোই চলছিল|
সমস্যা কিভাবে হলো?'
-- "সেটাই!… সমস্যা
কিভাবে হলো? আজও যে ভালো
জানা নেই উত্তরটা| …
হ্যাঁ যা বলছিলাম,
ততদিনে আমরা দুজনই বেশ
ভালো নাম করে ফেলেছি
ইন্ডাস্ট্রিতে|
কলিগদের অনেকেই বুদ্ধি
দিলো দুইজন মিলে
নিজেদের একটা ফার্ম
দিতে| ওকে বললাম আমারও
তেমন ইচ্ছের কথা| ও লুফে
নিলো বিজনেসের আইডিয়া|
আমাদের প্রথম বেবি মানে
এলিস তখন এক বছরের| আমি
চাকরি ছেড়ে দিয়ে
নিজেদের বিজনেস-এ
আঁটসাঁট বেঁধে নামলাম|
ল'ইয়ার, একাউন্ট্যান্ট
আর ব্যাংকের সব
ছোটাছুটি কোলের ছোট্ট
বাচ্চা নিয়েই করে
ফেললাম| ওঃ বলা হয়নি-
এলিস হবার পরে আমাদের
পরিবারের সবাই একটু
আধটু মিলতে শুরু করলো
আমার সাথে| মাও তখন অনেক
হেল্প করেছেন, এলিসকে
সারাদিন মায়ের জিম্মায়
রেখে অফিস গুছিয়ে
নেওয়ার কাজ করেছি| সব
গুছিয়ে কেবল ধাতস্থ হয়ে
যখন নিজেদের ক্লায়েন্ট
বেইজ বাড়াচ্ছি, ঠিক তখন
এঞ্জেলিনার অস্তিত্ব
টের পাই আমার মাঝে| রাফি
আমাকে কিছুদিন রেস্ট
নিতে বললো| একাই নাকি এ
ক'দিন ম্যানেজ করে নিতে
পারবে| আমিও মেনে নিলাম|
সারাদিন এলিসের
দেখাশুনা করি আর
এঞ্জেলিনার আগমনের
অপেক্ষা করি| এলিসের
বেলায় মনে হয়নি কিন্তু
এঞ্জেলিনার বেলায় খুব
মনে হতো কেউ একটু আমার
যত্ন নিক! রাফি'র কাছে
কিছুটা সাংসারিক কাজ,
শারীরিক যত্নের আশা না
করে থাকতে পারতাম না|
কিন্তু মুখে কিছু
বলিনি| মেনে নিয়েছি ওর
ব্যস্ততার কারণকে
সামনে রেখে| কিন্তু সব
মানলেও একটা ব্যাপার
কিছুতেই মানতে
পারছিলাম না~ তা হলো দিন
কে দিন বাড়তে থাকা ওর
দম্ভ, উন্নাসিকতা আর
অহংকার| এত দ্রুত এতো বড়
ব্যবসায়ের মালিক হয়েছে!
হুহু করে টাকা আসছে|
এঞ্জেলিনা পৃথিবীর মুখ
দেখতে দেখতে আমাদের
নিজেদের ৫টা বাড়ি হয়ে
গেল| ব্যাংকেও প্রচুর
নোট জমছিলো! রাফি আজন্ম
এক মধ্যবিত্ত পরিবারের
ছেলে| বছরে কেন সারা
জীবনে নাকি এতো টাকা
আয়ের স্বপ্নও কখনো
দ্যাখেনি সে!"
- 'তাহলে কি টাকাই …?'
- "জানি না রাকা! … হবে
হয়তো টাকা! হতে পারে
হঠাৎ আসা সম্মান,
প্রতিপত্তি, নিজে ছাড়
না দিয়েও অপরপক্ষের সব
গ্রহণ, ওভার কনফিডেন্স ..
কিংবা হবে হয়তো আরো
কিছু একটা! … কিন্তু
আমিও তো বরাবরই
মধ্যবিত্ত পরিবারের
সন্তান| ইতালিতে থাকতে,
বাবা ছিলেন স্কুল
টিচার| এখানে এসে একটা
সুপার মার্কেটের
ম্যানেজার হয়েছেন|
জানো, বাবা-মা আমাদেরকে
সবসময় শিখিয়ে ছিলেন যত
বড়ই হই না কেন, কখনোই যেন
উদ্ধত/অহংকারী না হই আর
কখনোই কোনো
পরিস্থিতিতেই যেন
অকৃতজ্ঞ না হয়ে যাই
কারোর প্রতি| আমার তাই
খুব ভয় হতে লাগলো ওর এই
পরিবর্তনে| সবচেয়ে
কষ্টের বিষয় হলো - যেই
রাফি একদিন সব কিছু
থেকে আমাকে উপড়ে তার
জীবনে এনেছিল, সে-ই আমার
অস্তিত্ব হঠাৎ ভুলতে
বসলো| বছরখানিক আগেও যে
কৃতজ্ঞচিত্তে জানাতো
তার জীবন শুধু আমি বলেই
নাকি পেরেছি এমন করে
গুছিয়ে দিতে! সেই 'সে'
ওভাবে …! জানো, বহুদিনের
পুরোনো আমাদের বন্ধুসম
একাউন্ট্যান্ট, ল'ইয়ার
সবাই ফোন করে দুঃখ করতো
ওর অহংকার কিংবা অন্য
কোনো উদ্ধত আচরণের
জন্য| অন্যরা যদি নাও
বলতো, নিজের চোখেই তো
দেখেছি রাতে কোথা থেকে
কি পান করে বাসায় ফিরতো
বেসামাল মাতাল হয়ে!
বিশ্বাস করবে না রাকা,
ও-ই এক সময়ে আমাকে
ড্রিংক করতে 'না' করেছিল|
যদিও আমি সেভাবে কখনোই
ড্রিংকস এর ফ্যান ছিলাম
না; দৈবাৎ পার্টিতে
একটু আধটু…"
- 'কেন বুঝবো না,
আদ্রিয়ানা? ড্রিঙ্কস তো
তোমার
খাদ্য-সংস্কৃতিরই একটা
অংশ| সেখানে তোমার জন্য
তা ভুল কোথায়? … যতক্ষণ
না তুমি মাতাল হয়ে
অন্যের ক্ষতি করছো,
ততক্ষণ তো তা তোমার
জীবনধারায় কোনোমতেই
অন্যায় নয়!'
-- "ধন্যবাদ রাকা … তুমি
আমাকে বুঝতে পেরেছো…
যাইহোক, মাতাল অবস্থায়
বাসায় ফিরে প্রচুর
ভাঙচুর করেছে| থামাতে
না পেরে, তাও মেনে
নিয়েছিলাম| কিন্তু এরই
কিছুদিন পরে আসলো
ভয়ঙ্করতম কষ্টের সেই
ফোন| ওরই এক বন্ধুর বৌ
ফোনে জানালো 'রাফি নাকি
…!' নাহ থাক, মুখে বলতে
পারবো না রাকা! আমি আজও
কারোর সামনে ওর
সম্পর্কে এই তেতো
সত্যটি উচ্চারণ করতে
পারি না! নিজেরই
লজ্জ্বা, অপমান যে কি
পরিমানের, ভুল মানুষকে
জীবন দিয়ে ভালোবাসার!
নাহ তুমি তা বুঝবে না|
প্রার্থনা করি পৃথিবীর
কাউকেই যেন তা আর বুঝতে
না হয়! … 'পৃথিবী ধ্বসে
পড়ার মতো কষ্ট' হয় বলে
শুনেছিলাম, কিন্তু তখন
সেই 'ধ্বসে পড়া' নিজের
জীবনে দেখলাম|"
-- 'এই যে টিস্যু… চোখ
মোছো আদ্রিয়ানা .. ..!'
-- "ধন্যবাদ … চিন্তা
কোরো না; আমি ঠিক আছি|
এখন বেশ ভালো ফিল করছি|
অনেক দিনের অসমাপ্ত
কাজটা এখনই শেষ করতে
যাচ্ছি তো! জানো, তোমার
সাথে আলাপের এ ক'বছরে
অনেকবার চেষ্টা করেছি
তোমাকে, শুধুমাত্র
তোমাকেই জীবনের এ
অংশটুকু আদ্যোপান্ত
বলতে| কাউকেই বলতে
পারিনি| সবাই জানে
বনিবনা হয়নি| আজকাল তো
এসব অনেকেরই হয়না|
যাদের জানার তাদের
অনেকেই অবশ্য জানে| তবে
আমি তাদের সাথে কোনো
যোগাযোগ রাখি না,
লজ্জ্বায় অপমানে| যেই
মানুষ ঐ মুখে একদিন
আমার জন্য আকাশের
চাঁদটাই শুধু পেড়ে আনতে
পারবে না বলেছিল, সেই
মানুষই নিজের মুখে
স্বীকার করলো সে নিয়মিত
অন্য মেয়েদের সাথে
…!"
- 'তুমি খুব বেশি বিশ্বাস
করেছিলে, মন প্রাণ দিয়ে
ভালোবেসেছিলে, তাই
কষ্টটা এত্ত বেশি
পেয়েছিলে| ওর
'ডিজঅনেস্টি'টা তাই
মানতেই পারোনি! … অনেক
অনেক রাফি কিন্তু এসব
আকসারই করে; তবে তোমার
রাফির পক্ষে এমন ঘৃণ্য,
জঘন্য কাজ একেবারেই
মানায়নি!'
-- "জানো, আমার মন আজ
ভীষণ ভালো, তুলোর মতো
হালকা লাগছে এখন
নিজেকে! নিজের একান্ত
দুঃখ কষ্টগুলো যখন অতি
সন্তর্পনে নিজের মাঝেই
লুকিয়ে রাখতে হয়, তখন সে
কষ্টগুলো বাড়তে বাড়তে
পাহাড়ের মতো ভারী হয়ে
যায়| সেই পাহাড় একা বয়ে
চলেছি| প্রায় ছ'বছর হতে
চললো; প্রত্যেকটা দিনই
বইছি! বাবা মা অনেক
সাহায্য করেছেন, আরো
পাশে থাকতে চান| কিন্তু
আমার অপরাধবোধ হয়| আর
তাছাড়া আমার তো একটা
কঠিন শপথ আছে নিজের
কাছে, মেয়েদের কাছে ~
ওদেরকে অনেক শক্তপোক্ত
আর প্র্যাকটিক্যাল করে
গড়ে তুলতে হবে| 'মানুষ
চেনা' শেখাতে হবে| … এ
লড়াই আমার একার| তবু
জানো, ইদানিং মাঝে মাঝে
কি হয়? চারপাশ যখন বড্ড
বেশি অন্ধকার হয়ে যায়,
চব্বিশ ঘন্টাই একঘেয়ে
ধূসর ক্লান্তিকর হয়ে
যায়; তখন চোখ বুজে আমি
তোমাকে পাশে পাই…"
- 'কি বলছো তুমি! 'সত্যি?!
কিন্তু তোমার জন্য
কখনোই তো আমি সেভাবে
কিছু করিনি… নিজেকে
ভাগ্যবতী ভাববো যদি
সত্যিই তোমার প্রয়োজনে
পাশে থাকতে পারি! প্লিজ
বোলো… নিজের'একান্ত
বন্ধু মনে করেই বোলো!'
-- "তোমাকে হয়তো সেভাবে
বলিনি কখনো… কিন্তু মা
জানেন, আমার মেয়েরা
জানে তুমি আমার
কতখানি!"
- 'আর লজ্জ্বা দিও না
প্লিজ! আচ্ছা বাচ্চাদের
সাথে দেখা করতে আসে
ওদের বাবা? যাক,
বাচ্চারা প্রায় তোমার
চেহারাই পেয়েছে!'
-- "না বাচ্চাদের সাথে
দেখা করতে পারে না|
তাদের আঠারো বছর বয়স না
হওয়া পর্যন্ত পারবেও
না!"
- 'কি বলছো! এটা কিভাবে
সম্ভব হলো?'
-- "আমাদের বাসায়
সিকিউরিটি ক্যামেরা
সেট করা ছিল| জানো যখন
এটা লাগানো হচ্ছিলো,
আমি খুব বিরোধিতা
করেছিলাম| শুধু শুধু
গুচ্ছের খরচা| কিন্তু ও
তখন প্রায় জোর করেই সেট
করিয়েছিলো| কি আশ্চর্য,
দ্যাখো শেষে ঐটাই কিনা
আমার বিশেষ প্রয়োজনে
এসেছিলো! শেষ ছয় মাসের
এক তান্ডবময় রাতে আমাকে
থ্রেট করতে
এঞ্জেলিনাকে বেবিকট
থেকে তুলে ছুঁড়ে মারতে
উদ্যত হয়েছিল| বিচারকরা
সবই দেখেছেন| তাই এক
কথায় ওর সব চাওয়াকেই
তাঁরা নাকচ করে
দিয়েছেন| দেখা তো দূরের
কথা; কোর্ট থেকে
ইন্টারভেনশন অর্ডারও
দেওয়া আছে| আমার
কন্যাদের চৌহদ্দির
মধ্যেও সে এখন আসতে
পারবে না!"
- 'বাচ্চারা? ওরা কিছু
জানতে চায় না?'
-- "ওরা সব জানে|
যতোটুকু জানা
বাচ্চাদের পক্ষে শোভন!
বড় মেয়েকে তো অনেকদিন
চাইল্ড সাইকোলজিস্ট
দেখাতে হয়েছে| ঐ
সাইকোলজিস্ট অনেক
হেল্প করেছেন| কিভাবে
কতখানি বলতে হবে সব ওঁ-ই
বুঝিয়ে দিয়েছেন| … তুমি
একটু আগেই বললে না, ওরা
আমার মতোই দেখতে হয়েছে?
মজার ব্যাপার কি জানো,
এই নিয়েও আমার দুঃখ ছিল!
ইশ, একটাও কেন বাবার মতো
হলো না! আর এখন দ্যাখো,
সেটাই আমার জন্য কতটা
স্বস্তি'র! … আমরা আসলে
খুব অল্পই জানি কি
আমাদের সত্যিকারের
চাওয়া! সবচেয়ে ভালো কি
জানো? ভালো বুদ্ধি
হচ্ছে অপেক্ষা করা|
সময়ই সেরা উত্তরটা জানে
এবং জানায়!"
- 'একদম ঠিক … আচ্ছা সব
আলাপ একদিনে করে ফেললে
হবে? চলো আমরা মন ভালো
করি! তোমার আনা খাবার
দিয়েই লাঞ্চ সেরে
ফেলি!'
-- "কি বলছো! তোমার জন্য
এনে আমিও খেয়ে যাবো? … ওঃ
আচ্ছা তার আগে তোমার
জন্য একটা ছোট্ট উপহার
এনেছিলাম যে, সেটা দেই!
দাঁড়াও ঝোলা থেকে বের
করি| এই নাও এলিস আর
এঞ্জেলিনা দুজন মিলে
মনের মাধুরী মিশিয়ে
তোমার জন্য এটা এঁকেছে|
আমি শুধু বাঁধিয়ে নিয়ে
এসেছি| খুব খারাপ বোধহয়
আঁকেনি, বলো?"
খারাপ কি বলবো, এতো
সুন্দর একটা ছবি আট আর
ছয় বছরের দুই শিশু
কিভাবে আঁকলো!? সূর্য
উঠছে ওদের
ব্যাকিয়ার্ডে …
চারপাশে অন্ধকার,
কিন্তু স্পষ্ট বোঝা
যাচ্ছে একটু পরই আলো
আলো হয়ে যাবে চারপাশ!
মায়ের প্রিয় দোলনাটাও
এঁকেছে সাধ্যমতো|
আদ্রিয়ানা জানালো আমার
দেওয়া রংপেন্সিল এর সেট
দিয়েই নাকি এঁকেছে|
বাচ্চাদের স্কুল ছুটির
সময় হয়ে যাচ্ছে তাই
তড়িঘড়ি করে ওর আনা
পাস্তা দুজনই অল্প করে
প্লেটে নিয়ে গরম করে
খেলাম| চলে যাবে, তাই
বিদায়ী কথাবার্তা সেরে,
গেটের কাছে এসে হাগ্
দিলো| হাগ্ দিতে দিতেই
বললো "মনে করে বাটার
চিকেন টা খাবে কিন্তু …
এ তো তোমাদের অথেন্টিক
ট্র্যাডিশনাল ফুড|"
আমি হেসে বললাম …
- 'আরে খাবো … কিন্তু
বাটার চিকেন আমাদের
ট্র্যাডিশনাল ফুড
কেমনে হবে? তুমি কি জানো
না যে আমি বাংলাদেশী?'
-- "কী? কী বললে তুমি?
তুমি বাংলাদেশী? ঠাট্টা
করছো নিশ্চয়ই?"
- 'ঠাট্টা করবো কেন?
তোমাকেও তো বলেছি, ভুলে
গিয়েছো?'
-- "তাহলে আমারই ভুল|
খেয়াল করে শুনিনি
নিশ্চয়ই …"
- 'কিন্তু তুমি এতো চমকে
গেলো কেন? মনে হচ্ছে
আমার দেশের নাম শুনে
আপসেট হয়ে পড়েছো?'
-- "আমাকে ভুল বুঝো না
রাকা, বাংলাদেশ খুব
সুন্দর একটা দেশ|
চমৎকার আতিথ্য ঐ দেশের
মানুষের| আমি গিয়েছিলাম
একবার, বিয়ের মাস ছয়েক
পর| ওর বাবা মা যখন
আমাদের বিয়েটা মেনে
নিয়েছেন জানালেন| আমার
অনেক মিষ্টি স্মৃতিও
আছে ঐ দেশকে ঘিরে|
কিন্তু কিছু মনে কোরো
না; তোমার-আমার এই
বন্ধুত্বটা বোধহয় আর
সেভাবে থাকবে না| ওর ঐ
নোংরা চেহারাটা দেখে
ফেলার পর আমি আর কোনো
বাংলাদেশির সাথে
সম্পর্ক রাখি না|"
- 'আমিও জানতাম না
এলিস-এঞ্জেলিনা'র বাবা
বাংলাদেশী| ওকে নিয়ে তো
আগে কখনো আলাপ হয়নি! আজ
বাদামী মুখের কথা বললে
যখন তখন ধরে নিয়েছিলাম
ইন্ডিয়ান
সাবকন্টিনেন্টের কোনো
দেশের হবে নিশ্চয়ই| …
তবে একটা কথা বলি
আদ্রিয়ানা, কোনো একটা
দেশের সব মানুষ একই রকম
হয় না! তুমি কি আমার সাথে
এতদিন মিশেও বোঝোনি যে
আমি ওর মানসিকতার নই?'
-- "স্যরি তোমাকে হার্ট
করতে চাইনি… তুমি
নিশ্চয়ই ওর মতো না,
তোমার দেশও ভালো… আচ্ছা
বাদ দাও, ভালো থেকো! এখন
যাই?"
ঐ দিনের পর আমার জীবন
থেকে 'আদ্রিয়ানা
চ্যাপ্টার' সত্যিই শেষ
হয়ে গিয়েছিলো| কেননা,
তিন বছর কেটে গিয়েছে;
আদ্রিয়ানা'র সাথে আর
দেখা হয়নি! আমি ফোন বা
মেসেজ করলে সে দায়সারা
উত্তর দিয়েছে কিন্তু
নিজে থেকে একটা দিনও আর
কোনো যোগাযোগ করেনি!
কষ্ট পেয়েছি| খুব! তবু
দেশি এক নষ্টজন এর
অপরাধকে একজন
বাংলাদেশী হিসেবেই
দেখেছি| তাই অপরাধবোধ
থেকেই ওর এই অদ্ভুত
আচরণে রাগ বা বিরক্ত
হতে পারিনি! প্রার্থনা
করেছি - যেখানেই থাকুক,
যেভাবেই থাকুক মেয়েটা
ভালো থাকুক| দুই
কন্যাকে নিজের মনের মতো
করে মানুষ করুক! ভালো
থাকার জন্য নতুন সুন্দর
স্বপ্ন খুঁজুক! তবে বেশ
একটু খারাপ লাগলো যখন
আগের বাসাটা বিক্রি করে
সিটির কাছে বাসা নিলাম|
এলিস আর আঞ্জেলিনার
ছবিটা যখন দেয়াল থেকে
উঠিয়ে বেঁধে নিলাম নতুন
বাসার জন্য, তখন কেন
জানি না হুহু করে কেঁদে
ফেললাম! আমাকে বুঝতে
পেরে সে এ বাসায় হুট্
করে একদিন চলে আসবে~ সেই
আশাটুকুও আর থাকলো না
ভেবে|
অভিমানে নতুন বাসার
ঠিকানা ওকে দেইনি|
দিয়েই বা কি হবে? বাসা
বদলানোর কথাও মেসেজ
লিখে জানাইনি| তারপর
নতুন বাসায় ওঠার
ব্যস্ততায় ওকে অনেকদিন
মনেও পড়েনি| বাচ্চাদের
অপেক্ষাকৃত ভালো
স্কুলের জন্যই বাসা
বদলানো হয়েছে| ওরা বড়
হচ্ছে, পড়াশুনায় দেখভাল
করতে হয়| এর মধ্যেই হঠাৎ
সেদিন ছুটি নিয়েছি|
ব্যাংকের কাজ সহ প্রচুর
ব্যক্তিগত কাজ জমে
গিয়েছে, ওগুলো সারতে
হবে| রেডি হচ্ছি, এর
মধ্যে বারবার কে যেন
ফোন দিচ্ছে| বিরক্ত
লাগছে, আরে বাবা এখন
পারছি না, একটু পরই তো কল
ব্যাক করবো! টানা এতবার
ফোন দেওয়ার কি আছে!
ফোনটা নিয়ে দেখতে যাবো,
এমন সময় ডোরবেল বেজে
উঠলো| উফফ! কে আসবে এই
অসময়ে, নিশ্চয়ই সেলস এর
লোক| দৌঁড়োলাম দরোজা
খুলতে| দরোজা খুলে দেখি
আদ্রিয়ানা| আর যেই আসুক,
ওর আসবার কথা কল্পনাতেও
ছিল না আমার! অবাক হয়ে ওর
দিকে তাকিয়ে আছি|
আদ্রিয়ানা এসেছে!!
এতদিন বাদে ? এই এখন?
....কোত্থেকে কিভাবে এ
বাসার ঠিকানা পেল? পাঁচ
বছরে দেখছি, একটুও
বদলায়নি| একরাশ সোনালী
চুল এলোমেলো পিঠময়
ছড়ানো| এখনো সেই আগের
মতো একহাতে চুল বাঁধার
কালো রাবার ব্যান্ড
একটা, আরেক হাতে কালো
সিকো ব্র্যান্ডের
রিস্ট ওয়াচ| প্রসাধনহীন
গোলাপি পাতলা ঠোঁটে
মিষ্টি হাসি| একদম আগের
মতোই! নাহ একটা চেঞ্জ
অবশ্য হয়েছে| নীল
স্বচ্ছ চোখ দুটো আগে
সরাসরি দেখা যেত| এখন
কালো ফ্রেমের একটা
চশমার ফাঁক দিয়ে দেখতে
হচ্ছে| আর আজ সে চোখে
বিষন্নতার খেলাটাও যেন
নেই!
-- "কি আশ্চর্য! এভাবে
কি দেখছো? অবাক হওয়ার
কথা, তাই বলে এতটা! …
নাকি এতই রাগ করে রয়েছে
যে, বাসাতেই ঢুকতে বলবে
না!"
- 'না তা কেন! এসো… কেমন
আছো সেটা আগে বলো!
এলিস-এঞ্জেলিনা কেমন
আছে? আচ্ছা, আমাদের
বাসার ঠিকানা কোথায়
পেলে?'
-- "একসাথে এতো প্রশ্ন!
আচ্ছা বলছি| আমরা সবাই
ভালো আছি| তোমার সঙ্গে
নিজে থেকে কোনো যোগাযোগ
না করলেও, তোমার নতুন
বাড়ি কেনার সবকিছুই
জানি| ইন ফ্যাক্ট, আমার
বন্ধু'র মাধ্যমেই তুমি
এ বাড়িটা কিনেছো! অনেক
ভালো ডিলে পেয়েছিলে এ
বাড়িটা, ঠিক না?
- 'ওহ তাহলে তুমিই … এই
রিয়েল স্টেটের স্যাম কে
তুমি চেনো?'
-- "শুধু চিনি? … ও আমার
একজন ভালো বন্ধু… ও
তোমাকেও চেনে| তোমার
অনেক গল্পই ওর সাথে
করেছি| ওকে বলে
রেখেছিলাম, যেন
সাধ্যমতো তোমাকে হেল্প
করে!"
- 'তুমি কি কোনো সুসংবাদ
দিতেই তবে এসেছো? বিয়ে
টিয়ে, মানে কাউকে ভালো
লেগেছে মনে হচ্ছে..'
-- "সংবাদ একটা দিতে
এসেছি ঠিকই তবে তা
সুসংবাদ বা বিয়ে'র খবরও
নয়! রাকা, আমি আর কোনো
ভুল করবো না| কাউকে যতই
ভালো, ইনোসেন্ট,
রোম্যান্টিক মনে হোক না
কেন, তাকে অনেক অনেক দিন
যাবৎ দেখবো| সময়ের
উত্তর যতখানি পারি,
ততখানিই নিতে চেষ্টা
করবো| আর তাছাড়া আমার
বাচ্চারা আরো একটু বড়
হোক! …. কথা তো বলেই
যাচ্ছি, তোমার হাতের
ইয়াম্মি চা টা খাওয়াবে
না …? ওহ আচ্ছা তুমি বোধ
হয় কোথাও বের হচ্ছিলে!
আমি কিন্তু একটা চান্স
নিয়েছিলাম… লাকিলি যদি
বাসায় থাকো …"
- 'হ্যাঁ বের হবো, তবে
একটু দেরি করে বের হলেও
চলবে| আর এতদিন বাদে
তুমি আবার এলে… চলো চা
বানাতে বানাতেই কথা
বলি…'
-- "হুম তাই চলো …
আরশি-আর্নন কেমন আছে?
ওদের জন্য চকোলেট
এনেছিলাম| অবশ্য চকোলেট
খাবার বয়স বোধ হয় আর
নেই!"
- 'কিছুটা বড় তো হয়েছেই…
সময় চলে যাচ্ছে বুনো
ষাঁড়ের মতো, দৌঁড়ে
দৌঁড়ে! … তা তুমি এত যে
দেখবে, যাকে দেখছো, সে
অপেক্ষা করবে তো?'
-- "স্যাম… স্যাম জানে
তার প্রতি আমার বিন্দু
মাত্র ভালোবাসাও তৈরি
হয়নি, তাই নিজের
স্বার্থেই চায় আমি যেন
সময় নেই| … আর তাছাড়া আমি
এখনো অন্য কাউকে আমার
জীবনে চিন্তা করতে পারি
না!'
- 'বাহ্ … ঐ স্যাম…?
ভদ্রলোককে কিন্তু
ভালোই মনে হয়! অবশ্য সময়
নেওয়াটা মন্দ নয়|
বাচ্চারাও ততদিনে
কিছুটা বড় হলো! … আচ্ছা
এবার তোমার সুসংবাদটা
দাও'
-- "রাকা এটা ঠিক
সুসংবাদ নয়| কিন্তু
ছোটবেলা থেকে মনে হতো
'নেচারাল জাস্টিস' বলে
একটা কথা আছে| থাকা উচিত!
… জানো কি হয়েছে? ক'দিন
আগে অফিসের একটা
সপ্তাহব্যাপি ট্রেনিং
ছিল সিডনিতে| শেষ দিনে
আবার ছোটখাটো একটা
পার্টিও ছিল সিডনীর
সিটি সেন্টারে| ওদের
দেওয়া গাড়িতেই
গিয়েছিলাম দুপুরে
কিন্তু মাথাটা হঠাৎ খুব
ধরে গেল, তাই আগেভাগেই
হোটেলে ফেরার
সিদ্ধান্ত নিলাম|
সবাইকে বিদায় জানিয়ে
একাই বের হয়ে একটা
ট্যাক্সি ডাকলাম|
রাস্তার ঐ পাড় দিয়ে
যাচ্ছিলো, ডাক পেয়ে
ঘুরে এসে আমার সামনে
থামলো| স্বয়ং জেসাস কে
গাড়িতে বসে থাকতে
দেখলেও এত অবাক হতাম না,
যতটা অবাক হয়েছি রাফিকে
ড্রাইভিং সিটে দেখে!"
- 'তাইতো ..! কি বলছো এসব?!
রাফি'র এত এত সম্পদ,
ব্যবসা ..'
-- "হ্যাঁ … আমাকে দেখে
মাথা নিচু করে কয়েক
সেকেন্ড প্রথমে বসে
ছিল| তারপর আমি গাড়িতে
উঠছি না দেখে, গাড়ি
সাইডে পার্ক করে আমার
পাশে মাথা নিচু করে
দাঁড়ালো| আমাকে নিশ্চুপ
দেখে বললো 'পাপের
শাস্তি আমি পেয়েছি
আদ্রি! যে আমার জীবন গড়ে
দিয়েছিলো, তাকে দুপায়ে
দলেছি; শাস্তি তো পেতেই
হবে বলো? প্রথমে দুই
আত্মজা সহ তোমাকে
হারিয়েছি| তারপর একের
পর এক হারালাম ব্যবসায়,
সব কটা বাড়ি| সবশেষে
প্রিয় মার্সিডিজ গাড়ি!
মাথায় জমে উঠলো পাহাড়
সম ঋণ| আইনত তুমি যা পাও,
তাও দিতে চাইনি দেখে
তুমিও নাওনি| চাইলে তো
আইনত সব কিছুর অর্ধেক
পেতেই| আর সেসব তো আসলে
তোমারই, অধিকাংশই ছিল
তোমার অর্জন, উপার্জন|
নিজের সন্তানদেরকেও কি
ভীষণ ঠকিয়েছি! তাই এখন
পথের ফকির হয়েছি!
শরীরের শক্তিও আগের মতো
নেই, ভেঙে গিয়েছে| তেমন
বেশি কাজ করতে পারি না|
তাও যা আয় করি, ক্রেডিট
কার্ড শুধতে শুধতেই সব
চলে যায়| দেশে ফোন করলেই
আমার মা কাঁদে আর বলে
'অতো ভালো মেয়েটাকে
দম্ভ করে বলেছিলি- এত
টাকা'র মালিক হয়েছিস যে
চাইলেই নাকি হাজারটা
আদ্রিয়ানা পাবি! দ্যাখ
কি পেয়েছিস?"
- 'তারপর? তুমি কি বললে..?'
-- "আর কি বলবো? বলার কি
আছে বলো! সব কিছু হারিয়ে
যে এখন একটা মানবেতর
জীবন যাপন করছে, তাও
আবার চোরের মতো নিজের
শহর ছেড়ে অন্য শহরে
পালিয়ে… তাকে আর আমার
কি বলার থাকতে পারে?
শুধু মুখ ঘুরিয়ে অন্য
পথে যাওয়া বাদে…?"
- 'খুব ভালো শিক্ষা
পেয়েছে… খুব ভালো
লাগছে…'
-- "না রাকা, ওর
দুঅবস্থা আমি কামনা
করিনি| কিন্তু ওর
রিয়েলাইজেশন দেখে
অনেকখানি হালকা হয়েছি…
ছোটবেলার বিশ্বাসটা
প্রায় ভেঙে গিয়েছিল| তা
আবার এমন ভাবে জোড়া
লাগবে বিশ্বাস করতে
পারিনি| … এখন আবার
কনফিডেন্স পাচ্ছি! …
আমার নানী বলতেন-
ন্যায়-অন্যায় বুঝে চলতে
হয়| ভালো বা মন্দ সব
কাজেরই কিন্তু ফলাফল
আছে| বেশিরভাগের ফলাফল
এই দুনিয়াতেই এসে যায়|
নানীর কথাগুলো ইদানিং
খুব মনে হচ্ছে! আমি তো
বেশি মানুষকে বলতে
পারছি না! রাকা, প্লিজ
তুমি বোলো? তুমি তো অনেক
মানুষকে চেনো…এই
অদ্ভুত পরিণতির গল্প
তোমার পরিচিত কারোর বা
তোমার ছাত্রছাত্রীদের
কাজে লাগলেও লাগতে
পারে!"
- 'এ তো একেবারে ঈশপের
গল্পকেও হারা মানালো
আদ্রিয়ানা! এমন
ন্যাচারাল পানিশমেন্ট?!
ভাবাই যায় না! যাক, আমি
অত দয়ালু নই| ওর এই পতনে
আমার খুব আনন্দ হচ্ছে|
আনন্দ হচ্ছে আসলে দুইটা
কারণে এক, ওর উচিত
শিক্ষা হয়েছে; দুই, এই
ঘটনা ঘটেছে বলেই না
তুমি আবার আসলে আমার
কাছে!'
-- "না রাকা, এই ঘটনা না
ঘটলেও আমি আসতাম| আমার
ছেলেমানুষি ভুল
অনেকদিন আগেই বুঝতে
পেরেছিলাম| লজ্জ্বায়
আসতে পারছিলাম না, এই যা!
স্যাম অনেকদিন ধরেই
ইনসিস্ট করছিলো তোমার
কাছে এসে যেন 'স্যরি'
বলি…|"
- 'আরে বন্ধুকে বুঝি
স্যরি বলতে হবে? … ভালো
কথা, স্যাম কোন দেশের?
বাড়ি কেনার আলাপের সময়ে
রাকিন একবার ওর দেশ
জিজ্ঞেস করলে, কেন যেন
এড়িয়ে গিয়েছিল| ভালো
করে খোঁজ নিও … আমাদের
সাবকন্টিনেন্টের বলেই
মনে হয়েছে কিন্তু…
হুহ!'
- "রাকা, ও ইচ্ছে করেই
তোমাদেরকে জানায়নি|
স্যাম বাংলাদেশী! ওর
আসল নাম শামস আরেফিন|
এখন পর্যন্ত সময়ের
ফিল্টারে যা দেখেছি সে
বন্ধু হিসেবে চমৎকার|
তোমারই মতোন কিছুটা!
আমার ভবিষ্যৎ
পরিকল্পনা এখনও কিছু
ঠিক করিনি, তাই জানি না|
তবে এই পর্যন্ত শুধু
এটুকু জানি, বন্ধু
হিসেবে তোমরা সেরা!"