(১)
সময়টা বড্ড খারাপ।
করোনা পরিস্থিতিতে
জীবন স্থবির হয়ে আছে।
চারদিকে শুধু আতংক!
কিন্তু এ গল্পটা যে
গ্রামের মানুষদের নিয়ে,
তাদের জীবনে খারাপ
-ভালোর ব্যবধান বোঝার
সুযোগ নেই। তারা তাদের
মর্জি মত চলে,
প্রত্যেকেই এখানে
রাজা। কোন সচেতনতার ধার
ধারেনা এখানকার লোকজন।
নিয়ম মেনে চলা, ভদ্রতা,
সামাজিকতা সবকিছু
নিজেদের রুচি অনুযায়ী
হয় এখানে। এরা খবর
দেখেনা। ভারতীয় একটা
চ্যানেলের জয়জয়কার এই
গ্রামে। দেশ কেমন আছে,
কোথায় কতজন মারা গেল, কী
প্রাকৃতিক দূর্যোগ
আসতে চলেছে তা জানার বা
বোঝার প্রয়োজন এরা মনে
করেনা। পুরুষেরা ঘুম
থেকে উঠে পেঁয়াজ, শুকনো
লঙ্কা দিয়ে পান্তা ভাত
খেয়ে কোদাল, কাঁচি,
ঝাঁকা নিয়ে জমির দিকে
রওনা দেয়। মহিলারা হাস,
মুরগি, গরুর যত্ন করে,
রান্না করে। জমিতে ভাত
পাঠায় গামছায় বেঁধে।
এরপর পান চিবোতে চিবোতে
এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে
বেড়ায়। সবাই সবার খোঁজ
খবর নেয়। প্রতিদিন দেখা
হয় তবু কত গল্প যে জমা
থাকে! কাঁথা সেলাই করে
কেউ কেউ। বিকেল হলে
গল্পের তোড়ে বাতাসে
শোভা জর্দার ঘ্রাণ
ছড়ায়।
একটু বয়স্ক মহিলারা
এখানে জর্দার পরিবর্তে
তামাক পাতা খায়, খর খায়।
কেউকেউ বিড়িও টানে। যখন
তখন এরা ঝগড়া করে,
মারামারি করে। আবার
কোথাও কোন নতুন ফকিরের
আবির্ভাব হলে সকলে মিলে
গলাগলি ধরে পানি পড়া
তাবিজ আনতে যায়।
এ গ্রামে সবচেয়ে মজার
ব্যাপার হচ্ছে এখানে
সবাই কোন না কোন পীরের
ভক্ত। পীর এবং ফকিরের
প্রভাব ভয়ংকরভাবে চেপে
বসেছে।
বাচ্চার ডায়রিয়া হয়েছে
ফকিরের কাছে এরা পানি
পড়া আনতে ছোটে। ফকির
বাচ্চার মাকে বাগানের
কোন এক বড় গাছের নিচে
খোলা চুলে দাঁড় করিয়ে
আইশালের ডাল দিয়ে ঝেড়ে
দিলেই বাচ্চার ডায়রিয়া
সারবে বলে বিশ্বাস করে
প্রায় সবাই। হাত-পা
ভেঙ্গে গেলে, জ্বর হলে,
এমনকি নিজেদের ভবিষ্যৎ
জানতেও এরা ফকিরের কাছে
সিজদা দিয়ে পড়ে থাকে।
একটু বয়স্ক এবং যুবকরা
বিকেল হলেই তাসের
আড্ডায় বসে। মাছ
বাজারের পাকা ভিটির উপর
বসে জুয়া খেলে গ্রামের
গণ্য মান্য ব্যক্তিরা।
আর সম্মানে যারা একটু
খাটো তারা গ্রামের ঘন
ঝোপ ঝাড়গুলো বেছে নিয়ে
বসে পড়ে। সকলের সামনে
বসে তাস বা জুয়া খোলার
অধিকার শুধু নেতা গোছের
লোকেদের।
যেমন ফকিরের সমারোহ
গ্রামে তার
দ্বিগুনহারে মেলা বসে
এখানে। প্রত্যেক
ফকিরের বাড়িতে এখানে
বিভিন্ন উপলক্ষে মেলা
বসে। পীরের ভক্ত বা
খাদেমরাও মেলা এবং
মাহফিল এর আয়োজন করে।
সারারাত মাইকে গান
বাজিয়ে পীরের
গুনকীর্তন করা হয়।
গ্রামে ঘুরে ঘুরে চাল,
টাকা, তেল, আলু, পেঁয়াজ
তোলা হয়। অনেকে আবার
রোগমুক্তির জন্য মোরগ,
ছাগল মানত করে। মেলার
সময় সেসব মানতগুলো তুলে
বড় বড় পাতিলে খিঁচুড়ি
রান্না হয়। গ্রামে
এগুলো ড্যাগ নামে
পরিচিত। পড়াশোনাও করে
এখানকার লোকজন। স্কুলে
পাঠাতে হয় তাই
পাঠায়।হাতে গোনা দু এক
পরিবার আছে এর
ব্যতিক্রম। কাঁচা
রাস্তার জায়গায় পাকা
রাস্তা হয়েছে, বিদ্যুৎ
এসেছে, ডিশ এসেছে তবুও
এদের অন্ধ বিশ্বাস থেকে
মুক্তি নেই।
মাহিনের বাড়িও এই
গ্রামে। মাহিনেরর ঘরের
ঠিক দেড় বা পৌণে দুইহাত
দূরে থাকে বারেক শেখের
পরিবার।
মাহিনের শোবার ঘরটির
লাগোয়া একটি ঘরে থাকে
বারেক শেখ,তার
ষাটোর্ধ্ব স্ত্রী
শ্রীমতি, ছোট ছেলে শুকর
আলী শেখ। বারেক শেখের
আরো তিনটি ছেলে আছে
যারা বিয়ে করে একটু
ঢালে গিয়ে বাড়ি করেছে।
দুই মেয়েরও বিয়ে হয়ে
গেছে। দীর্ঘদিন শহরে
থাকার পর সেখানকার পাট
চুকিয়ে গ্রামে এসে
স্থায়ী বসবাস শুরু
করেছে মাহিনের পরিবার।
দুটো মুখোমুখি বড় ঘরের
মাঝে বেশ বড় আঙিনা।
তারই এককোনে মেঝে পাকা
করে রান্নাঘর তোলা
হয়েছে,রয়েছে কলতলা এবং
ছোট্ট একটুকরো ফুলের
বাগান। মাহিনের ফুলের
বাগানের বড্ড শখ। ঘুম
ভাঙার পর প্রথম কাজ
বাগানে গিয়ে ফুল
দেখা...গাছে পানি দেয়া।
মাহিন একদিন দুটো তুলসি
গাছের চারা এনে ফুলের
বাগানের এক কোনায় পুতে
দিল। অনেকদিন থেকেই
মাহিন খুঁজছিল
তুলসিগাছ। অফিসের
পাশেই হিন্দু এক
পরিবারের কাছ থেকে দুটো
চারা সংগ্রহ করতে পেরে
ভীষণ খুশি ও। পরেরদিন
কাজ থেকে ফিরে এসে
মাহিন বাগানে গিয়ে
তুলসিগাছ কোথাও দেখতে
পেল না। একটু অবাক হয়ে
গেলে চারা দুটো কোথাও
নেই কেন! প্রচন্ড মন
খারাপ করে একে ওকে
জিজ্ঞেস করতে লাগলো
গাছের চারা দুটো এখানে
নেই কেন? কেউ দেখেছে
কিনা! বারেক শেখ তখন
গরুর জন্য খড় কাটছিল
বসে। মাহিন তুলসিচারার
কথা জানতে চাইলে বারেক
শেখের মেজ ছেলে বাজারে
যার মিষ্টির দোকান আছে,
সে বেরিয়ে আসলো ঘর
থেকে। মাহিনের চোখে
চোখ রেখে হাসিমুখে বলল
:আমি উডাইয়া হালাইছি।
কেন কী অইছে?
: আপনি? মানে? কেন এটা
করেছেন?
: ক্যা করছি মাইনে কী?
তুলসীগাছ হিন্দুগো
গাছ...হিন্দুরা পুজা করে
এই গাছের। এই গাছের
বাতাস লাগাও খারাপ। তুই
এই গাছ এই জায়গায়
লাগইতে পারবিনা। মাহিন
প্রতিবেশির এমন
ব্যাখ্যা শুনে এতটাই
আঘাত পেল যে তার মুখ
দিয়ে অনেকক্ষণ কথ বের
হলোনা। নিজেকে একটু
স্বাভাবিক করে শুধু
বলতে পারলো
: আমি কি ভুল করে
তুলসিগাছটা আপনাদের
জায়গায় লাগিয়ে
ফেলেছিলাম?
: নাতো। তোগো জায়গায়ই
লাগায়ছোস,
কিন্তুচাইলেইতো নিজের
জায়গায় যা খুশি করা
চলবোনা। এই গাছের
বাতাসতো আমাগো গায়ে
লাগতো।
মাহিন এবার প্রচন্ড
রেগে গেলে কিন্তু
নিজেকে নিয়ন্ত্রণে এনে
বলল "আপনি জানেন তুলসি
গাছ কতোটা উপকারি?
তাছাড়া আপনি আমাকে বলতে
পারতেন, আমাকে না বলে
আমার বাগানের গাছটা
তোলা কি ঠিক হয়েছে? এবার
ক্ষেপে উঠল বারেক শেখ।
:হিন্দুগো কালি আইন্যা
ঘরে রাখ। তুলসিগাছ ঘরে
রাইখা পুজা কর কেউ না
করবোনা। উঠানে লাগানো
যাবেনা।
:এমন উত্তরের পরে আর কোন
কথা না বলে ঘরে গিয়ে
দরজা লাগিয়ে বসে রইল
মাহিন। চোখ দিয়ে পানি
পড়তে লাগলো...
সেইদিন থেকে মাহিন মনে
মনে প্রচণ্ড ঘৃণা করতে
শুরু করল প্রতিবেশি এই
পরিবারকে। গ্রামের
মানুষের প্রতি
বিতৃষ্ণা তৈরি হলো শহরে
বেড়ে ওঠা মাহিনের। বইয়ে
যেমন পড়েছে সে মোটেও
তেমন সহজ সরল নয়
গ্রামের মানুষ। বেয়াড়া
টাইপের লোক,
কুসংস্কারাচ্ছন্ন।
কখনোই এদের সঙ্গে মিশবে
না বলে ঠিক করল মাহিন।
অফিসের কাজের শেষে
নিজেকে বইয়ের মধ্য
ডুবিয়ে রাখতে থাকল।
এর বেশ কিছুদিন পরের
শুক্রবারের এক ছুটির
দিনের কথা। মাহিন
বাগানের দিকের
জানালাটা খুলে এক কাপ
চা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে
আছে। হোম থিয়েটার থেকে
বন্যার মিষ্টি গলার "
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাইনা"
ভেসে আসছে। ঠিক তখনি
বাগানের পাশে এক অদ্ভুত
পোশাকের লোক চোখে পড়লো।
লাল রংয়ের থান পরে আছে
লুঙ্গির মত করে। সেই
একই থান দিয়ে বানানো
ফতুয়া। চুলগুলো
বাবরিছাট।হাতে গলায়
কাঠের পুতির মালা। হাতে
একটি বড় বস্তা।
বস্তাটিকে পায়ের কাছে
রেখে কোমর থেকে গুল বের
করলেন। মাহিন লোকটির
দিকে তাকিয়ে চায়ে চুমুক
দেয়ার কথা ভুলে গেল
একেবারে। খুটিয়ে
খুঁটিয়ে দেখতে থাকলো
তাকে। লোকটি তার ডান
হাতের তর্জনীর
সাহায্যে অনেকটা গুল
তুলে ঠোঁটের এককোনা
ফাঁকা করে ঢেলে দিল
সেখানে। তারপর গুল আবার
কোমরে বেঁধে এদিক ওদিক
তাকিয়ে চেঁচিয়ে ডাকতে
শুরু করলো।
‘মা জননী বাড়ি আছোনি
তোমরা? সিন্নির চাল
দাও।"
মাহিন এবার জানালা
ছেড়ে ঘরের সামনের
সিঁড়িতে এসে বসল।
:কিসের সিন্নি?
:রশিবাবার
সিন্নি।সন্ধ্যার পর
মেলা বসবে। খিচুড়ি
রান্না হবে, চাল দিতে
বলো মা জননীরে। কোন
মানত থাকলে করতে পারো।
আর একবার সময় করে আসোনা
আমাদের বাবারে দর্শন
দিতে, হাজত ও বেশিনা
মাত্র ২২০ টাকা।
: আপনার এই রশি বাবার কাজ
কী? আর এমন অদ্ভুত নাম
কেন তার?
: কাজ কী মানে? তুমি
শোননি তার নাম? আমাদের
রশি বাবা আঙুলে রশি
বেঁধে শরীরের সমস্ত
ব্যথা টেনে টেনে নামিয়ে
নিয়ে আসতে পারে। তাইতো
আমরা যারা তার ভক্ত আছি
তার নাম দিয়েছি
রশিবাবা। মাদ্রাজ থেকে
ডাক্তাররা ফেরত দিয়ে
দিয়েছে। সেই রুগী সব
ভালো করে দেয় আমাদের
রশিবাবা। বাবার তেল পড়া
১০০ ভাগ গেরান্টি।
: রশি দিয়ে টেনে শরীরের
সব রকম ব্যথা সারিয়ে
দেয়। এগুলোও আপনারা
বিশ্বাস করেন?
কথা শেষ হতে না হতেই
বারেক শেখ এসে হাজির
সেখানে। মাহিনের
উদ্দেশ্যে বলতে শুরু
করে
পড়ালেখা বেশি শিখলেই
বাপ চাচাগো চেয়ে বেশি
বুঝবার চেষ্টা করিস না।
হাজার হাজার মানুষ আইসা
সুস্থ হয়ে ফিরা যায়,
উপকার না পাইলে কি তার
কাছে কেউ আসে? হাজার
হাজার মানুষ মিথ্যা তুই
একলা সত্য?
বারেক শেখকে দেখে
সকালের মিষ্টি আবেশ
হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
বিরক্তিতে উঠে গেল
মাহিন। হোম থিয়েটারে
তখন বাজছে এরা সুখের
লাগি চাহে,. শুধু সুখ চলে
যায়...
(দুই)
সেদিন চাঁদ ছিল
বাড়াবাড়ি রকমের
সুন্দর। জোসনায় গা
ভিজিয়ে বাড়ির পাশের
রাস্তার বড় সাঁকোটায়
বসে পা পানিতে ডুবিয়ে
বসেছিল মাহিন। গ্রামের
মানুষগুলো যত খারাপ
প্রকৃতি তত সুন্দর।
প্রকৃতির টানে গ্রামে
আছে এখনো না হলে
কেরানির চাকরিটা ছেড়ে
দিয়ে শহরে কিছু একটা
জুটিয়ে নিতে পারতো। রাত
১২ টা হবে হয়তো।তবে
গ্রামে তখন গভীর
নির্জনতা। সেই
নির্জনতা ভেদ করে মাঝে
মাঝে পানির ছলাৎ ছলাৎ
শব্দ শোনা যাচ্ছে।
একটা ঘোরের মাঝে ডুবে
গেছিলো মাহিন। হঠাৎ
একটা কান্নার আওয়াজ
মগ্নতার সুতো ছিঁড়ে
দিয়ে বুকের ধুকপুকানি
বাড়িয়ে দিয়ে গেল। এ
গ্রামে আসা অব্দি যত
ভুত,জিনের গল্প শুনেছে
তার সবগুলো মনে পড়তে
লাগলো। সাঁকো থেকে নেমে
কান্নার আওয়াজ যেদিক
থেকে আসছে সেদিকে
এগুতেই বুঝতে পারলো এ
ভুত বা জিন নয়,বারেক
শেখের ষাটোর্ধ স্ত্রী।
নিশ্চয়ই ওই খারাপ লোকটা
এতরাতে বউ পিটিয়েছে।
বারেক শেখের উপর মেজাজ
আরো খারাপ হয়ে গেল।
কাছে গিয়ে জানতে চাইলো
কাকি কি হয়েছে?কাঁদছেন
কেন?
শ্রীমতি বেগম কান্না
থামিয়ে দিল হঠাৎ করেই।
এতরাতে এখানে কাউকে
দেখবে বলে ভাবেনি সে।
চুপ করে দাড়িয়ে রইলো।
শ্রীমতি বেগমের হাতটা
ধরে মাহিন বাড়ি যেতে
অনুরোধ করল।
কিন্তু সে শক্ত হয়ে
দাঁড়িয়ে রইলো। মাহিন
তখন নারকেল গাছের গোড়ায়
কিছুটা ঘাস দেখে
শ্রীমতি বেগমের পাশে
বসে চাঁদ দেখতে দেখতে
অপেক্ষা করতে লাগলো।
আমার বিয়া অয় গণ্ডগোলের
তিন চার বছর আগে।
বাড়িতে তহন ভাতের খুব
অভাব। বাপ মা বিয়া দিয়া
তিনবেলা ভাতের
ব্যবস্থা করবার চাইছিল
আমার। তোমার বারেক
কাকার বড় ভাই আমারে
বিয়া কইরা নিয়া আসে এই
বাড়িতে। হারেজ আছিলো
তার নাম। তারা দুই ভাই
মহাজনের নাওয়ে যাইতো
ধান কাটবার। গোলা ভরা
ধান থাকতো। ভাতের অভাব
হবেনা কোনদিন এই চিন্তা
হইরা বাপ মা এইহানের
প্রস্তাবে খুশি অইয়া
রাজি অইছিলো। আমি ছোট
কাল থেইকা ভাত না খাইয়া
থাকবার পারিনা। ক্ষিধা
সহ্য হরবার পারতাম না।
বছর দুয়েক কোন সমস্যা
অয়নাই। এরপরের থেইকা
শুরু হইলো ঝামেলা। দাম
বাইড়া গেল সবকিছুর।
মাইনষের মুখে হুনতাম
হরতাল দিছে শেখ সাবরা।
জিনিসপত্রের দাম বাইড়া
গেল। মহাজনের কাছ থাইকা
প্রথম প্রথম টাকা ধার
আনতে শুরু করলো। খামু
কী! উত্তরে ধান কাটবার
যাবার আগে মহাজনের
থেইকা টাহা আইনা আমাগো
দিয়া যাইতো দুই ভাই।
আমরা শাক পাতা টুকাইয়া
খাইতাম। ধান কাইটা
আসলেই কষ্ট থাকবোনা
ভাইবা কষ্ট করতাম মুখ
বুইজা। ধান কাইটা আইসা
মহাজনের সাথে হিসাব
করতে বসতো। ধান যা
পাইতো তা দেনা শোধ
করতেই চইলা যাইতো।
মহাজনের কাছ থেইকা
আবার ধার কইরা ১০ সের
ধান নিয়া বাড়ি আসতো দুই
ভাই। তহন আমরা ভাত
খাইতাম এক বেলা। ভাতের
ফ্যানের ভিতরে এক ওড়োন
ভাত নিয়া নুন গুলাইয়া
খাইতাম আমি আর আমার
শাশুড়ী। তোমার হারেজ
আর বারেক কাকারে দিতাম
ভাত। নুন মরিচ আলু
সিদ্ধ দিয়া মুখ বুইজা
খাইয়া উঠতো দুই ভাই।
গণ্ডগোল শুরু অইয়া
গেছে খবর পাই মাইনষের
মুহে মুহে। গ্রামে
মহাজন গো বাড়ি রেডিওতে
খবর শুনবার যাইতো
গ্রামের হগ্গল
পুরুষরা। শেখ সাবের
ভাষণ শুইনা সবাই যুদ্ধে
যাওয়ার চিন্তা করে।
কিন্তু কোথায় যাবে, কার
কাছে যাবে বুঝবার
পারেনা। তোমার হারেজ
কাকা তহন আমার শাশুড়ীরে
বুঝাইয়া আমার কাছে না
কইয়া শিকদার কান্দার
মহিউদ্দিন শিকদারের
সাথে যশোর বর্ডারের
কাছে চইলা যায়। কোলে
তখন আমার বড় মাইয়া
কুলসুম। ওর বয়স তখন ২
বছর। আমার তহন খালি
ক্ষিদা লাগে। মাইয়াডা
বুকের দুধ খায় তহনো।
ভাতের অভাবে মাইয়াডাও
দুধ পায়না। সারাদিন
খালি কান্দে। বাড়তি কোন
খাবারও দিবার পারিনাই।
একবেলা ভাতও তহন অয়না
বাড়িতে। গমের জাউ
রাইনদা খাই আমরা। নুন
নাই। নুনের দাম বাইড়া
গেছে। গমের জাউ কি নুন
ছাড়া গলা দিয়া নামে? তাও
খাই। ক্ষিদার জ্বালা
কি, আমার মাইয়াডাও
বুইঝা গেছে। মাইয়াডারে
সাথে নিয়া কচুর গাডি
টুকাইয়া আনতাম। কচুর
গাঠির জাউ, গমের জাউ
খাইতাম। আমার শাশুড়ী
শিকদার বাড়ি বারা বানতে
যাইতো তারা ক্ষুদ দিতো
মাঝে মধ্যে। এদিকে
কুলসুমের বাপের আর কোন
খোঁজখবর পাইনাই।
কুলসুমের বাপ মাইয়ার
পাগল আছিলো, খুব
ভালোবাসতো। মাইয়াও
বাপরে পাইলে ক্ষিধা
ভুইলা যাইতো। বাপরে
দেখবার না পাইরা
মাইয়াডা আমার সবসময়
জ্বালাইতো।
দেখতে দেখতে মেলেটারি
আমাগো গেরামেও আইসা
পড়লো। কোন কাম
নাই,খাবার নাই। সবাই
যার যার জান নিয়া পলায়ে
বাঁচে। পুরুষরা কেউ
বাড়ি থাকতো না রাইত
অইলে। ক্ষিদায় কুলসুম
আমার সারাডাদিন কানতো।
হেইদিন আছিলো
শুক্কুরবার। মেলেটারি
আমাগো এলাকায়ও ঢুইকা
পড়ছে । গড়েরমাঠের
স্কুলে তাবু গাড়ছে।
সবাই যে যার মত দৌড়াইয়া
পলানো শুরু করছে।আমরা
তহন মহাজনের
পুকুরপাড়ের পাশের
ঝোপের ভিতর যাইয়া
পলাইছি। বাড়িঘরে আগুন
দিছে ওই হারামির
বাচ্চারা। শ্রীমতি
কাকির মুখ ঘৃণায় বেঁকে
ওঠে। চাঁদের আলোয় কাকির
মুখের দিকে অপলক
দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে
মাহিন। একটা মুখের
রেখার টান, ঘৃণার ছাপ,
হাহাকার মাহিনকে নিয়ে
যাচ্ছিলো অভিশপ্ত কোন
রাতের ইতিহাসের
স্বাক্ষী হতে।
ঝোপের ভিতরে থেইকা
আগুন দেইখা চোখ দিয়া
পানি পড়ে সবার,মুখে কোন
কতা নাই। গ্রামে তখন
ঝোর জঙ্গল বেশি আছিলো,
রাস্তা ছিলনা এমন।
মেলেটারিরা বাজারের
রাস্তায় জিপ রাইখা
হাইটা ঢুকছিল গ্রামে।
গুলির শব্দ, আগুন, বুটের
জুতার দৌড়াদৌড়ির শব্দে
আমরা পাথরের মত বইসা
রইলাম।পা দুইডা এত ভার
অইয়া গেল আমি আর নড়তে
পারলাম না। সবাই ঝোপের
থেইকা বাইর অইয়া
খালপাড়ের দিকে দৌড়
দিল..আমি ঝোপের মধ্যই
বইসা আছি। গুলির শব্দ
শুনলাম,সাথে সাথে
ঝুপঝাপ মানুষ পড়ার
শব্দ। আমি তহন ঘুমন্ত
কুলসুমরে বুকে জড়াইয়া
শাশুড়ীর লাশ ধইরা বইসা
আছি। কান্দার কোন শক্তি
নাই..আঁচল দিয়া মুখ
চাইপা আছি। তোমার বারেক
কাকা আমারে আন্ধারে হাত
টাইনা ধইরা নিয়া পাগলের
মত দৌড়ানো শুরু করলো।
আমাগো পিছনে তহন ওই
হারামির বাচ্চারা আইসা
পড়ছে। বাঁশের ঝাড়ের
ভেতর দেইহা আমাগো ধরবার
পারেনাই। না ধরবার
পাইরা পাগলের মত গুলি
করলো আামাগো দিকে।
রাশেদ কাকা, আমার দুই
চাচি শাশুড়ি, আমার
পাশেই পইড়া গেল। কুলসুম
এরমধ্যেই গুলির শব্দে
জাইগা গেছে। জোরে জোরে
কান্দা শুরু করছে।
জানোয়ারগুলা কান্দার
শব্দ শুইনা আন্ধারে দিক
ঠিক কইরা আবার গুলি
ছুড়লো। আমার কুলসুম
কোলের ভিতরেই ঠান্ডা
অইয়া গেল।
কাঁদছে শ্রীমতি কাকি।
কাঁদুক মাহিন তাকে
সান্ত্বনা দিবেনা। সব
কান্নার স্বান্তনা
হয়না। গভীর রাত ফুড়ে
শুধু সন্তান হারা মায়ের
আর্তনাদ বুকটা কাঁপিয়ে
দিল মাহিনের।
একটা গুলি আমার চোখের
কোনা ছিড়া দিয়া গেল।আমি
অজ্ঞান অইয়া পইড়া
রইলাম...চোখটা আর ভালো
অইলোনা। আমার কুলসুম আর
ক্ষিদার জ্বালায়
কানলোনা।
কত ভাত..কত ভাত আমার ঘরে
এহন...আমার কুলসুম খিদার
কষ্ট নিয়া চইলা গেল।
আমি ডাইনি, মা না...আমি
পেট ভইরা ভাত খাই
বাজান। আমি মা না...
ডাইনি রে বাজান। আমি
রাক্ষস...সবাইরে খাইয়া
একলা বাঁইচা রইছি। দেশ
স্বাধীন হইলো, শেখ
সাবরে মেলেটারিরা
ছাইড়া দেল, তোমার হারেজ
কাকা আর ফিরা আইলোনা।
মাহিন ধীরে ধীরে
শ্রীমতি কাকির মাথায়
হাত রাখে। কিছুই বলতে
পারেনা। ভোর হয়ে
এসেছে। ভোরের স্নিগ্ধ
আলোয় চোখ, মনে আরাম
লাগছে। আজ যেন অন্যরকম
সকাল। একটা রাত কেড়ে
নিয়েছিল শ্রীমতি কাকির
ক্ষুধার্ত সন্তানকে,
আত্মীয়, শাশুড়ী, নিজের
চোখের দৃষ্টিকে। আবার
অনেক বছর পর আর একটা রাত
বদলে দিয়েছে আস্ত একটা
মানুষের ভেতরের
সত্তাটাকে। মাহিনের
মনে হলো সে যেন নতুন করে
নিজের মাঝেই নিজেকে
আবিষ্কার করলো। এই পোড়
খাওয়া সংগ্রামী
মানুষগুলো তার বড্ড
আপনার।
ভালোবাসার...ভীষণ
কাছের।
(৩)
সেদিন সন্ধ্যার
কিছুক্ষণ পরেই
উত্তরপাড়ার জামে
মসজিদ,পরে গ্রামের
সবগুলো মসজিদ থেকে
মাইকিং করা হলো ডাকাত
পড়েছে গ্রামে। কেউ যেন
না ঘুমায়।জেগে থেকে
পাহারা বসাতে আহবান করা
হলো গ্রামবাসীর প্রতি।
মাহিন থ্রিলার উপন্যাস,
গোয়ন্দা কহিনী,মাসুদ
রানা পড়ে নিজেকে সাহসী
হিসেবে কল্পনা করলেও
ডাকাত খুব ভয় পায় ও।
মাইকিং শুনে কি করবে
বুঝে উঠতে পারছেনা। এমন
সময় দরজায় জোরে জোরে
আঘাত পড়লো। প্রথমে
ডাকাত ভেবে ভয় পেলেও
পরে কন্ঠ শুনে বুঝতে
পারলো দরজায় তার
প্রতিবেশি বারেক শেখ
আর তার ছেলেরা। দরজা
খুলে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন
মাহিনের মা। বারেক শেখ
বলছে," কোন ভয় নাই
তুমাগো মাহিনের মা,
আমরা আছি বাইরে। পাহারা
দিতেছি সবাই। কোন ভয়
নাই। নিশ্চিন্তে
ঘুমাও।"
না,মাহিন আজ ভয় পাবেনা।
ভরসা করতে পারছে এই
মানুষগুলোকে।
ভালোবাসার চোখ দিয়ে
দেখলে সত্যি জীবন
সুন্দর হয়। তার
প্রতিবেশীরা বা
গ্রামের অনেক লোক ই
অন্ধ বিশ্বাস নিয়ে
বেঁচে আছে।তাদের
বিশ্বাস কেউ নড়াতে গেলে
তারা মানবেনা ঠিকই, তবে
মানুষগুলোর ভেতরে এক
একটা সাচ্চা মানুষ বাস
করে। সে সত্যিকারের
মানুষ দেখতে চোখ লাগে,
ভালোবাসার দৃষ্টি
লাগে। শূণ্য চোখে তা
দেখা যায়না। বাবা ঠিক
বলতেন," মানুষ পড়তে
পারা টা খুব জরুরী।"