জলজ্যান্ত একজন
মানুষকে পক্ষীতে
রূপান্তরিত হতে দেখে
উপস্হিত সকলে তাজ্জব
বনে গেল। শুধু তাজ্জব
বললে পুরোটা বলা হয় না
অবশ্য। মানুষগুলোর
মুখে-চোখে এক ধরনের
চাপা আতঙ্ক মড়ক লেগে
পুকুরে ভেসে ওঠা
ফ্যাকাশে মরা মাছের মতো
ভেসে বেড়াতে লাগলো।
ঘটনার আকস্মিকতায় সবার
ঠোঁটে ঠোঁট সেঁটে গেছে,
যেন সেলাই পড়েছে। টু
শব্দটি নেই।
মুহূর্তকাল আগে কাকটার
রেখে যাওয়া ডানা
ঝাপটানোর রেশটুকু শুধু
থেকে গেছে ঘর জুড়ে।
পেরেক বাবা নিজেও
কিছুটা বিব্রত। এমনটা
হওয়ার কথা ছিল না।
বিশেষ একজনের জন্য
ব্রক্ষ্মাস্ত্র
প্রয়োগের নিমিত্তে
নিবিড় ধ্যানে বসে ছিল
সে। কথা ছিল ধ্যান শেষে
মন্ত্র পড়া পানি সে
তুলে দেবে ওদের হাতে।
কিন্তু ঠিক কানের কাছে
বসে ওদের একজন বহুক্ষণ
ধরে তার এলেম নিয়ে
সন্দেহ করে যা-তা বলে
যাচ্ছিল। ধৈর্য্যের
একটা সীমা থাকে তো, নাকি!
বুজরুকি নাকি অন্য কিছু
মজা বুঝুক এখন।
পরিস্হিতির রাশ টানতে
ঘর কাঁপিয়ে মন্ত্র
উচ্চারণ করে ওঠে পেরেক
বাবা- কাব্বাম,
তুরিস্ত্রিধ্ধাম
ত্রিথ্রিথ্রি
চাকাচাকা বুমবুম বাহ্
বাহ...
কোনো রকমে জান নিয়ে
জানলা গলে উড়ে এসে
কামরাঙা গাছটায় আশ্রয়
নিয়েছি। ঘটনাটা হজম
করতে নিজেকে সময় দেয়া
দরকার। এটা কী হলো?
হারামজাদা পেরেক বাবার
সাথে কী কথা হয়েছিল আর
সে করলোটা কী! রাগে
দুঃখে মাথার চুল ছিঁড়তে
ইচ্ছা করছে। কিন্তু সেই
উপায়ও তো রাখেনি
হারামজাদা পেরেক বাবা।
সগীরের বাচ্চা সগীর!
বাগে পাই একবার। তোর
জীবন যদি ভাজা ভাজা না
বানিয়েছি তো আমার নাম
ফ-রি-দ…. বাক্যটা শেষ করা
হয় না।
সব কিছু দিব্যি চলছিল।
খাচ্ছিলাম,
ঘুমাচ্ছিলাম। সময় মতো
কাজে যাচ্ছিলাম, কাজ
থেকে মর্জি মাফিক বাড়ি
ফিরছিলাম। হঠাৎ সব কেমন
ওলট পালট হয়ে গেলো।
হাড়ে হারামি কাদের
খানকে জব্বর শিক্ষা
দেওয়ার মতলবে সগীরের
পরামর্শ মতো এক জবরদস্ত
কামেল ফকির বাবার
দ্বারস্হ হই। সেটাই কাল
হলো। তাকে নিয়ে সন্দেহ
করাটা ঠিক হয়নি। ব্যাটা
আমার কথাগুলো শুনে
ফেলেছিল। কিসব ফুঁ-ফা
দিয়ে পানির ঘটিটা আমার
দিকে ছুঁড়ে দিলো আর
ভোজবাজির মতো সব পালটে
গেল। আমি এখন আর মানুষ
নেই। অমানুষ হয়ে গেছি।
না, না, ঠাট্টা নয়।
সত্যি, সত্যি আমি মানুষ
থেকে একটা কাক হয়ে
গেছি। কোথায় গেলো আমার
পরিপাটি সাজানো
ঘর-বিছানা, কোথায়ই বা
আমার স্ত্রী রিঙ্কু, আর
একমাত্র মেয়ে রোদেলা।
বউ-বাচ্চার কথা মনে
পড়তে মনটা আনচান করে
ওঠে। নিজের এই করুণ
পরিণতি ওদের জানানো
দরকার ভেবে বাড়ির
উদ্দেশ্যে উড়াল দিলাম।
বাড়ির মানুষজন সবাই
বহাল তবিয়তেই আছে।
বাগানের দেবদারু গাছে
বসে দিব্যি ওদের দেখতে
পাচ্ছি। রোদেলা নতুন
কেনা বাইকটায় চড়ে
বাড়িময় চক্কর দিচ্ছে।
বাগানে পেতে রাখা সৌখিন
চেয়ারে বসে রঙ্কু মায়া
মায়া চোখে মেয়ের দিকে
তাকিয়ে আছে। ওর সামনে
টেবিলে চায়ের সরঞ্জাম
সাজানো। কোলের উপর
কুকুর ছানা ক্যায়ও।
আমি যে উপস্হিত নেই
সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ
নেই কারো। যে যার জীবন
নিয়ে ব্যস্ত। ওদের আর
কী! যার যায় তারই
জ্বালা। অবশ্য এই সময়
আমি আর কবেই বাড়িতে
থাকতাম! বউ-বাচ্চাকে
দেওয়ার মতো সময় কি আমার
হাতে ছিল?
কাদের খান তিন তিনটে
চালানের হিসাব একাই
বেমালুম হজম করে না
নিলে আজ এই দিন আমাকে
হয়ত দেখতে হতো না।
সগীরও তার হিস্যা না
পাওয়ায় কাদের খানের উপর
ভয়ানক ক্ষেপে ছিল।
দুজনে মিলে কাদের খানকে
একটা মোক্ষম শিক্ষা
দেওয়ার শলাপরামর্শ
করি। সগীর কোত্থেকে
জানি এই পেরেক বাবার
হদিশ নিয়ে আসে। ঠিক হয়
মোটা অংকের টাকার
বিনিময়ে আজগুবি নামের
বাবাটা জব্বর এক
জাদুকরী পানি পড়া দেবে।
সেটা কোনোভাবে কাদের
খানের উপর ছিটিয়ে দিলেই
কেল্লাফতে।
হারামজাদার তড়পানি
খতম। কিন্তু হলো তো
উল্টো!
রিঙ্কু সযত্নে কাপে চা
ঢেলে তাতে ছোটো ছোটো
চুমুক দিচ্ছে। পড়ন্ত
বিকেলের আলোতে কী যে
অপরূপা লাগছে ওকে!
কতদিন বউটাকে ভালো মতো
খেয়ালও করিনি! টাকার
নেশায় ঘর-সংসার,
সংসারের মানুষগুলোকে
বড্ড অবহেলা করেছি।
কিন্তু তার জন্য এমন
শাস্তি কপালে বরাদ্দ
ছিল কে জানতো! রিঙ্কুর
নজর কাড়তে গলা ফাটিয়ে
বার কয়েক ডেকে উঠি।
বিরক্ত হয়ে প্রচণ্ড
রাগী দৃষ্টিতে মাথা
তুলে তাকায় আমার
মায়াবতী বউটা। আমাকে
চিনতে ব্যর্থ হয়
রিঙ্কু। বুক জুড়ে সব
হারানোর বেদনা গড়াতে
শুরু করে আমার। হায়
মনুষ্য জীবন...তোমার
সাথে আর কি হবে না দেখা!
অভিমান কানে কানে বলে
‘হেথায় তোমায় মানাইছে
না গো’ ...বাতাসে ডানা
ভাসিয়ে বাড়ি ছেড়ে
বহুদূরে চলে আসি।
কেমন দিব্যি ঝাঁ চকচকে
একটা জীবন ছিলো আমার,
একথা এখন কেউ বিশ্বাস
করবে! শহরের সবচেয়ে
আরাধ্য জায়গায় দোতলা
বাড়ি, ব্যাংকে মোটা
টাকা, সুন্দরী স্ত্রীর
লকারভরা গয়না। দেশের
একটা প্রথম সারির
স্কুলে পড়ুয়া সন্তান।
এতসব করতে গড়পড়তা লোকের
গোটা জীবন ভাজা ভাজা
হয়ে যায়। তাও সব কিছুর
নাগাল পাওয়া সম্ভব হয়
না হয়ত। অথচ আমি অল্প
কয়েক বছরেই সব কেমন
গুছিয়ে নিয়েছিলাম।
ক্যারিয়ারকে ধাই ধাই
করে উপরে টেনে নেয়ার
যাবতীয় কলাকৌশল আমার
নখদর্পণে থাকার কারণে
এতসব সম্ভব হয়েছিল।
যদিও আমার এমন উন্নতিতে
রিঙ্কু একদম খুশি ছিলো
না। শিক্ষক মা বাবার
সন্তান বলেই হয়ত খামোখা
নীতি আঁকড়ে থাকার
বোকামিতে ভরপুর
মেয়েটা।
মজার কথা হলো, আমার
বাবাও শিক্ষক। তবে
রিঙ্কুর মা বাবার মতো
বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষক ছিলেন না।
তাঁদের মতো
হিল্লি-দিল্লির
সৌভাগ্যও কোনো দিন তাঁর
হয়নি। বাবা ছিলেন
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের
সামান্য অংকের শিক্ষক।
জীবন অংকে যিনি কোনোমতে
টেনেটুনে পাশ ছাড়া আর
কোনো উন্নতিতে সক্ষম
হননি। গ্রামে
দাদাজানের জায়গা জমি না
থাকলে ঢাকা শহরে বাস
করা আমাদের পরিবারটার
জন্য সীমাহীন কষ্টের
হতো সন্দেহ নেই। অবশ্য
গ্রামের সাপোর্ট
পাওয়ায় জীবন যে একেবারে
দুধেভাতে কেটেছে তাও
না। পড়াশোনায় ভালো
হওয়ার সুবাদে নামকরা
কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে
পড়ার সুযোগটা আটকে
থাকেনি। বাবার অবস্হা
দেখেশুনেও কেন জানিনা
নিজের ভেতর ক্যারিয়ার
নিয়ে খুব একটা
উচ্চাকাঙ্ক্ষা তৈরি
হয়নি কখনও। পাশ করে
চলনসই একটা চাকরি পেলেই
বর্তে যেতাম।
জীবন নিয়ে আমার এই
বাউন্ডুলেপনার প্রেমে
পড়ে যায় প্রাণরসায়ন
বিভাগের চৌকস ছাত্রী
রিঙ্কু।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের
দ্বিতীয় বর্ষে শুরু
হওয়া প্রেমটা জমে ওঠতে
সময় লাগেনি। আমাকে ছাড়া
রিঙ্কুর জীবন অর্থহীন
এমন অবস্হায় পৌঁছাতে
পৌঁছাতে, ততদিনে আমি
জীবন সম্পর্কে নতুন
হিসাবনিকাশ শুরু করে
দিয়েছি। মাঝারি মানের
চাকরির জায়গায় খুব অল্প
সময়ে কীভাবে বাড়ি গাড়ি
করা যায় তার ছক কষছি মনে
মনে। রিঙ্কু তখন আমাতে
মশগুল থাকা সত্ত্বেও
আমার ভেতরের
পরিবর্তনটা ধরতে
পারেনি। যখন বুঝতে পারে
সেই বাউন্ডুলে
রোমান্টিকতায় আমি আর
ডুবে নেই, ততদিনে
আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে।
আসলে জীবনের মোড় ঘুরিয়ে
দেবার স্বপ্নটা আমার
মধ্যে গুঁজে দিয়েছিল
প্রিয় বন্ধু, সহপাঠী
আবু বকর। আবুই আমার চোখ
খুলে দিয়েছিল। জীবনে
উন্নতির শর্টকাট পথটা
খুঁজে নেবার অর্জিত
যাবতীয় জ্ঞান যা এখন
আমার নখদর্পণে, তার
সবটাই আবু’র কাছ থেকে
শেখা। ব্যাটার ভবিষ্যত
পরিকল্পনা ছিলো একদম
মেদহীন শরীরের মতো টান
টান। হিসাবে পাকা ছিলো
বলেই আজ আবু বকর কোথায়
পৌঁছে গেছে। রাজনীতিতে
সক্রিয় না হলেও বুদ্ধি
আর টাকার জোরে সেখানেও
ভালো প্রভাব রাখে।
আমার অবশ্য রাজনীতিতে
মাথা ঘামানোর খায়েশ
কোনো কালেই ছিলো না।
ক্যারিয়ারটা চাহিদা
মাফিক উচ্চতায় নিয়ে
আরামে দিন কাটানোর
স্বপ্নে নিজেকে সঁপে
দিয়েছি। রিঙ্কুর তাতে
একদমই সায় ছিলো না।
নেহায়েত অন্ধের মতো
আমাকে ভালোবেসেছিল বলে
ছেড়ে চলে যায়নি। তাছাড়া
মা বাবার সেপারেশনের
প্রভাব মেয়েটার উপর
পড়ুক সেটাও চায়নি
রিঙ্কু। বউ বাচ্চার
চেয়ে আমার কাছে
ক্যারিয়ার, টাকার গন্ধ
প্রিয় হয়ে ওঠেছিল।
টাকার নেশায় আমি এক
পর্যায়ে এতটাই পাগল হয়ে
ওঠেছিলাম যে আমাকে
নীতিজ্ঞান দিতে আসা
রিঙ্কুকেও সহ্য হতো না।
মনে মনে চাইতাম আমাকে
ছেড়ে ও চলে যাক। আমি
তাহলে বাঁচি। সেই তো
দূরেই চলে গেলো, কিন্তু
আমার আর সেভাবে বাঁচা
হলো কোথায়!
মানুষের আয়েশি জীবন
হারিয়ে কাক হয়ে ভাগাড়ে
বসে এখন কা কা করছি।
পৃথিবীতে আমিই তো আর
একমাত্র পাপী বান্দা
নই। যে কারণে হাতেনাতে
ফল পেতে হবে। হ্যাঁ,
স্বীকার করছি পাপ আমিও
কম করিনি। কিন্তু
অগুণতি পাপের ভেতর ঠিক
কোনটির জন্য এই শাস্তি
বরাদ্দ, সেটাও ঠিকঠাক
ঠাওর হচ্ছে না। একে কি
আদৌও পাপের ফল বলা উচিত
হবে, নাকি পেরেক বাবার
ভুলের মাশুল বলবো? কে
জানে, হয়ত দুটোই।
সারা জীবনে ‘এতো কালো
মেখেছি দু-হাতে’ তার
জন্য মাশুল আমার পাওনা,
সেটা জানি। কিন্তু
মানুষের সমাজে
কৃতকর্মের ফল কবে থেকে
হাতে হাতে পাওয়া শুরু
হলো! তারমানে কি ধরে
নেবো, আমার মতো যারা
পাপী তাদের ভাগ্যেও এমন
বিদঘুটে শাস্তি বরাদ্দ
হবে কিংবা হওয়ার
সম্ভাবনা আছে?
ব্যাপারটা মনকে
খানিকটা হলেও স্বস্তি
দিলো।
সকাল থেকে কিছুই জোটেনি
খাওয়ার মতো। এই ক’দিনে
যতটা বুঝেছি, কাক
সমাজেও মানুষদের মতো
জোর যার মুল্লুক তার
রীতি চালু আছে। ভাগাড়ের
দিকটায় সকালে একবার ঢুঁ
দেবার চেষ্টা করতেই
চোয়াড়ে চেহারার এক
কাকের ঠোক্কর খেতে
হয়েছে। চোয়াড়টার প্রতি
অন্যদের হাবেভাবে বোঝা
গেছে সে এ পাড়ার
মাস্তান কাক। ধুর্বাল!
বলে ওখান থেকে সরে
এসেছি। মানুষের সমাজে
হরদম ক্ষমতাশালীদের
‘জ্বী হুজুর’ করা
লেগেছে, এখন কাক হয়েও
নিস্তার নেই দেখছি!
মানুষেরা সকালের এই
সময়টাতে যার যার কাজে
যাবার তাড়ায় থাকে। আমি
যে চাকরীটা করতাম,
মানুষের কাঠামোতে
থাকলে এতক্ষণে সেখানে
উপস্হিত থাকা লাগতো।
কর্মহীন জীবন কতটা
আনন্দের ঠিক বুঝে ওঠা
হয়নি এখনও। কাকেদের
অবস্হা বাংলা-হিন্দি
বেহুদা সিরিয়ালের
চরিত্রগুলোর মতো। কাজ
কম্মো কিস্যু নেই,
খামোখাই কা কা করা।
কিংবা কার কাছ থেকে কী
ছিনিয়ে নেয়া যায় তার
জন্য তক্কে তক্কে থাকা।
খোঁজ নিলে দেখা যাবে এ
সমাজে কুটনামি,
নষ্টামিরও ভালো কদর
আছে।
হঠাৎ মাথায় দারুণ
বুদ্ধি ভর করে।
সিদ্ধান্ত নেই, আগে
কাদের খানকে জব্দ করে
তারপর সগীরের বাচ্চাকে
একহাত দেখে নেবো। ওর
উইগ ঠুকরে টেকো মাথা
যদি ভরা মজলিশে প্রকাশ
করে না দেই তো আমার
নাম….. যাগগে যা। আগে
হাড়ে বজ্জাত কাদের
খানের পালা।
পরিকল্পনা মতো উড়াল
দিয়ে সটান কাদের খানের
বাড়ির ইউক্যালিপটাস
গাছটার সবচেয়ে উঁচু
ডালে গিয়ে বসি। চকচকে
হাভালের এসইউভিতে চড়ে
ব্যাটার এখন হাসপাতালে
রওনা দেবার কথা। পেরেক
বাবার পানি পড়া ট্যাকে
করে আনা সম্ভব হলে আজই
ব্যাটাকে কাকে পরিণত
করতাম। সে যখন সম্ভব না
অন্য পথ ধরা লাগবে।
কাদের খান চরম হারামি
একজন মানুষ। হাসতে
হাসতে মানুষ খুন করতে
পারে লোকটা। এমন লোকের
ডাক্তার না হয়ে কসাই
হওয়া উচিত ছিলো।
উপরে উপরে রোগী
দেখাশোনা চললেও আড়ালে
কাদের খানের হাসপাতালে
কিডনি লেনদেনের রমরমা
ব্যবসা চলে। কাদের
খানের চাহিদা মতো আমি,
সগীর, আরো কয়েকজন
সেকাজে জড়িত। বিশ্বস্ত
লোক লাগিয়ে রেলওয়ে
স্টেশন, বাসস্টপ,
ইত্যাদি স্হান থেকে কত
দিকভ্রান্ত মানুষকে
ঠিকানা খুঁজে দেবার
ছুতোয় তুলে আনিয়েছি।
তাদের পরিণতি শেষমেশ কি
হয়েছিল জানা নেই।
পরিণতি যাই হোক, তার
জন্য আমি নিজেও দায়ী
বৈকি।
কানাঘুষায় জেনে ছিলাম
কাদের খান শুধুমাত্র
অবৈধ কিডনি বানিজ্যের
সাথেই জড়িত না। মানুষের
অন্যান্য
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়েও
তার ধান্ধা চালু আছে।
সত্যি মিথ্যা জানি না।
কাদের খানের মতো মহা
হারামির পক্ষে সবই
সম্ভব। হারামিটার পাপ
কাজের সাথে যুক্ত থাকায়
আমিও পাপী। যার শাস্তি
কাক হয়ে দিতে হচ্ছে।
আরে ওই তো! কাদের খানকে
গাড়ির দিকে এগিয়ে আসতে
দেখা যাচ্ছে। পাপীটাকে
মানুষের বেশে হেঁটে
আসতে দেখে আমার কাক
শরীর জ্বলেপুড়ে খাক হতে
চায়। ব্যাটা গেট খুলে
গাড়িতে ওঠে বসবার আগেই
যা করার করে ফেলা
দরকার। শা করে নীচে
নেমে এসে চোখের পলকে
কাদের খানের কপাল
লক্ষ্য করে মোক্ষম একটা
ঠোক্কর বসিয়ে দেই।
কপালে ঠোক্কর দেবার
সাথে সাথে কাদের খানের
হাত থেকে চাবির গোছাটা
পড়ে যায়। সেই চাবির
গোছার সাথে ছোট্ট একটা
রূপালি বাক্স থাকে। আমি
জানি ওই বাক্সে কী আছে।
হঠাৎ আবার নীচু হয়ে উড়ে
গিয়ে চাবির গোছাটা
ঠোঁটে নিয়ে মগডালে এসে
বসি। কাদের খান হা হা
করে ওঠে আঘাত সামলে।
আমি উড়াল দিয়ে পুলিশ
দপ্তরের ভেতরে গিয়ে
চাবির গোছাটা ফেলে
দিলাম এক বড়কর্তার
সামনে।
করিৎকর্মা পুলিশি
অভিযানে সেদিন বিকেলের
মধ্যেই গ্রেফতার হলো
কাদের খান। হারামিটা
এখন হাজতে। টিভির খবরে
ফাঁস হলো তার বিপুল
অপরাধের তথ্য। মনুষ্য
জন্মে আমার পক্ষে যা
সম্ভব হয়নি, কাক হয়ে
কাদের খানকে ফাঁসিয়ে
কিছু পাপ ক্ষয় করে আমি
সুখী। আমার কাক জন্ম
সফল হলো।
কিন্তু ফেলে আসা মানব
জীবন বার বার পিছু
ডাকে। ফিরতে চাইলেও
আমার আর সেই জীবনটায়
ফেরা হয় না। দু’বেলা
আমার বাড়িটার আশেপাশে
চক্কর কাটি। বউ-বাচ্চার
শুকনো শোকগ্রস্হ মুখ
দেখে বুকটা ফেটে যায়।
ওরা ধরেই নিয়েছে আমি
গুম হয়েছি। জীবিত ফেরার
আশাও হয়ত ছেড়ে দিয়েছে।
প্রথম প্রথম কয়েকদিন
বাড়িতে পুলিশের
আসা-যাওয়া চোখে পড়েছে।
এখন সেসব থিতিয়ে এসেছে।
খুব কাছের গুটিকয়েক
আত্মীয়-পরিজন মাঝে সাজে
আসছে এখনও। ক্রমশ সেটাও
থেমে যাবে। রিঙ্কু আর
রোদেলা একা হয়ে যাবে
বিশাল এই বাড়িতে।
চাইলেও ওদের কাছাকাছি
আমার পৌঁছানো হবে না
কোনোদিন। ওদের কাছে আমি
নেহায়েত তুচ্ছ একটা
কাক। এই সত্যিটা যখন
আমাকে অতিরিক্ত
ক্ষুব্ধ করে তোলে,
গলা ফাটানো চিৎকারে তখন
এই শহরের শান্তি
ছুঁড়েখুঁড়ে ফেলার জন্য
আমি মরিয়া হয়ে উঠি।