উৎসব ফিরে আসে। উৎসবকে
ফিরে আসতে হয়। আগের বছর
যেভাবে দেবীকে ডুবিয়ে
দেওয়া হয়েছিল, তারপর
সংকট গভীর হয়েছে আরও।
সংকট বাড়লেই উৎসবের
আয়োজন হয়, দেবীকে
সাজিয়ে আনা হয়।
স্বার্থের সুতোয় বাঁধা
মানতের ঢিল বটগাছের
ঝুরিতে ঝুলে থাকে।
সপ্তমীর ভোরে নববধূর
পোশাকে স্নান করিয়ে
আনা। সন্ধিপুজোয় জ্বলে
ওঠা একশ আট প্রদীপের
শিখা। সংকট গাঢ় হোক যতই,
এই সমস্ত আচারের ভেতরে
বেড়ে ওঠা বিশ্বাস আর
বছর বছর ধরে পুনরাবৃত্ত
পদ্ধতি সংকটকে
দ্রবীভূত করে। পদ্ধতি
আর আচারের বিস্তৃতি
বাড়ে সংকটের
সমানুপাতে। উৎসব জেগে
ওঠে সংকটের বিপ্রতীপে।
দিনক্ষণ সাজানো হয়।
উৎসবকে সাজিয়ে নেওয়া
যায় বিভিন্ন উপকরণে।
পরিচ্ছদে আলোয়
ভালবাসায় তার পূর্ণতা।
কিছুতেই না-ফুরোক সেই
দিনরাত, হা-হা শূন্যতা
না আসুক- এইটুকু আশার
ঝোঁকে পথে পথে লোক, মনে
মনে সেতু বাঁধা যায়।
ভাসানও হয়ে ওঠে উৎসব,
যতক্ষণ ছুঁয়ে থাকা যায়
দেবীর অস্ত্রভার, দেবীর
সিঁদুর। মূর্তি গড়া আর
ভাসানোর খেলা চলতে
থাকে। ছাই রঙের মেঘ
নেমে আসে, সরে যায়।
দেবীর প্রসারিত হাত,
বরাভয়মুদ্রা ভেসে
থাকে। শরীর ডুবে যায়।
হেমন্তের পাতারা ঢেকে
দেয় দেবীর সাজ। মুখটুকু
গর্জন তেলে চকচক করে।
পঞ্চমী অষ্টমী একাদশী
দ্বাদশী... কোজাগরী
লক্ষ্মীপুজোর পরে আর
দিনের আদরনাম রাখা হয়
না।
#
পঞ্চমী থেকে দশমী
প্যান্ডেলে বডি ফেলে
দেয় বুড়ো, তুতা, অমর,
বাবু, শ্যামল, কার্তিক,
বাজি। তুতা আর বুড়ো অটো
চালাত। এখন সবজি নিয়ে
বসছে ঘোষ বাড়ির সামনের
রোয়াকে। মার্চে সেই যে
লকডাউন হয়েছিল,
এপ্রিলের শুরুতে
সবজি-শাক কিনে আনত ভোরে
বেরিয়ে। বুড়ো মেছুয়ার
ফলপট্টি থেকে সস্তায় ফল
কিনে আনত,
আপেল-মুসাম্বি-কলা-বেদা
না। জুনের পরেও অটো
ফেরত পায়নি ওরা, মালিক
দেয়নি। তুতার মালিক অটো
বেচে দিয়েছে আর বুড়োর
মালিকের কাপড়ের
ব্যবসায় লস্ হচ্ছিল
বলে নিজেই অটো চালাচ্ছে
এখন। শ্যামলের দু’টো
কুকুর, নেড়ি। নবমীর
সন্ধ্যেয় বারোয়ারি
পুজোর সামনে ত্রিপল
খাটিয়ে চেয়ার-টেবিল
পেতে মাংস-ভাত হয়;
শ্যামল মাংসের হাড় আর
দু-থালা ভাত নিয়ে যেত
কুকুর দু’টোর জন্যে।
লালি আর জ্যাক। ওদের
কুকুর বললে রেগে যেত
শ্যামল। বাবু’দা সকালে
আর বিকেলে দু’টো ক’রে
বিস্কুট দিত। বাবু’দার
দোকানে চা খেতে আসা
অন্যরাও দিত একটা-দু’টো
করে; লালি ছুঁড়ে দেওয়া
বিস্কুট খেত না, মুখের
সামনে ধরতে হত! শ্যামল
সেলস্ম্যান। সাউথের
দিকে যেত- ফিটফাট, সেন্ট,
চকচকে জুতো। মার্চ থেকে
আর বেরোয়নি। ওর মায়ের
ডায়ালিসিস হত
হাসপাতালে, বন্ধ হয়েছিল
ভাইরাসের আতঙ্কে। গাড়ি
জোগাড় ক’রে সল্টলেকের
একটা হাসপাতালে নিয়ে
গেছিল, দু’বার; আর
পারেনি খরচ জোগাতে।
লালির খাওয়াদাওয়া
কমিয়ে দিতে হয়েছিল,
লালিও ভালবাসত ওকে;
নিজেই বোধহয় খাওয়া
কমিয়ে দিয়েছিল।
আশেপাশের বাড়ি থেকে
খাবার কুড়োতেও যায়নি,
অবশ্য পাড়ার প্রায় সব
বাড়ির দোরই আঁটা থাকত।
জুলাইয়ের একুশ তারিখ
লালিকে
মিউনিসিপ্যালিটির
গাড়িতে তুলে দিয়েছিল।
জ্যাক আর শ্যামল দু’দিন
কিছু খায়নি। জ্যাক
টিঁকে গেছে, শ্যামলের
মাস্ক-স্যানিটাইজারও
টিঁকে গেছে কোনওরকমে।
পুরনো কোম্পানিতে আর
সেলস্ম্যান লাগবে না,
ফোনে বলে দিয়েছে ওকে।
অসীমের বাবার কারখানা
লক-আউট হব হব করছিল,
পঁয়ষট্টি বছর বয়সে উনিও
আর পারছিলেন না তবু
যেতেন হপ্তায় পাঁচদিন,
দিনে তিনশো চল্লিশ টাকা
কম নয়। ট্রেন বন্ধ হয়ে
যাতায়াতের সুতোটাও
কেটে গেল পুরো। অসীম
আমেদাবাদে থাকছিল বছর
তিনেক হল। বছরে একবার
বাড়ি আসত। পাড়ার
বন্ধুরা জানত
কনস্ট্রাকশন
ম্যানেজার আর উন্নাসিক
ভদ্দরলোকেরা মুচকি
হেসে বলত ঠিকে শ্রমিক।
এক মাসের মাইনে আর
জমানো টাকার প্রায়
সবটুকু খুইয়ে অসীম
ট্রাকে চেপেছিল, সঙ্গে
আরও দশজন।
উত্তরপ্রদেশের বর্ডার
পেরোনোর সময় ওদের গায়ে
ব্লিচিং ছুড়েছিল পুলিশ,
ফোনে বলেছিল বৌকে।
অসীমকে মরার-গাড়ি থেকে
নামানোর সময় বাবু’দা,
শ্যামল, তুতা সবাই ছিল।
ওই ট্রাকে ধাক্কা
মেরেছিল একটা
পাঞ্জাব-লরি, ট্রাকের
ড্রাইভারের চোখ লেগে
এসেছিল ভোরের দিকে।
অসীমের বাবা এদিক-ওদিক
দৌড়ে, ইয়াসিনের
বিধায়ককে ধ’রে
ব্যবস্থা করেছিল; ওর বৌ
এক-বছরের মেয়ে নিয়ে
ছুটোছুটি করতে পারেনি।
অসীমের বৌ নার্সিংহোমে
আয়ার কাজ করে;
প্রত্যেকবছর বিজয়ার
বিকেলে ও-ই সিঁদুর
খেলতে ডেকে আনত পাড়ার
বৌ-মেয়েদের। বাজির
অবশ্য মাংসের দোকান
চলছে। মুরগির দাম আর
শেয়ার-বাজারের
ওঠা-নামার মিল দেখে
আশ্চর্য হয়েছে এই
ক’মাসে! করোনা হয়েছিল
বলে এক সপ্তাহ ওর
অ্যাসিস্ট্যান্ট মানে
ভজাকে দোকান দেখতে
বলেছিল। লেগ-পিস্,
চিলি-চিকেনের পিস্,
কিমা- ভজা দারুণ মাংস
কাটতে শিখে গেছে; ভজা
ইস্কুলে সবচেয়ে ভাল
পারে অঙ্ক আর ড্রইং।
স্মার্টফোন নেই বলে ওর
জন্যে ইস্কুল বন্ধ; সে
অবশ্য ওর বন্ধুদের
অনেকেরই পড়াশোনা এখন
বন্ধ। ভজার
বেস্ট-ফ্রেন্ড
কসাইবস্তিতে থাকে,
গেঞ্জির কলে কাজ
নিয়েছে, মাস্কের
প্রোডাক্শন বেড়েছে তো!
ভজার বেস্ট-ফ্রেন্ড
দারুণ ধুনুচি নাচে আর
ভজা ঠাকুর বসানোর
বেদিতে আলপনা আঁকে।
বুড়োর বউ আগেরবার মানত
করেছিল, বুড়োর নতুন অটো
হলে অষ্টমীর ফুলের সব
খরচ দেবে। অসীমের ইচ্ছে
ছিল লেবার ম্যানেজার
হয়ে গেলে ঢাকির পুরো
টাকা ও-ই দেবে, তুতাকে
আগের বার একাদশীতে মাল
খেতে খেতে বলেছিল। ওরা
এবারও পুজোর মিটিং
করেছে। চাঁদাও তুলেছে
পাড়ায়। লক্ষ্মীপুজোর
আগের দিন দুঃস্থদের
জামা-বিতরণ করা হয়;
ইয়াসিন’দা এবারেরটা
ব্যবস্থা করে দেবে
বলেছে। লোকাল
কাউন্সিলরের সঙ্গে
ঝামেলা করেও দিব্যি
বিধায়কের
অ্যাসিস্টান্টের
সঙ্গে সাঁট ক’রে নিয়েছে
এখন! ইয়াসিনেরও চাপ
চলছে দোকান বাঁচানো
নিয়ে... ভজা আর ওর বেস্ট
ফ্রেন্ড একদিন অন্ততঃ
ঘুরতে বেরোক একসাথে;
সপ্তমী বা নবমী যেকোনও
একদিন কি গেঞ্জিকলের
মালিক ছুটি দেবেনা?
একটা ছুটির দিন ছাড়া
ঠাকুরের কাছে কীই বা
চাইবে ও? আর, হ্যাঁ,
ইস্কুল খুলুক এবার,
প্লিজ! ঠাকুরের অস্ত্র
জমায় শ্যামল,
প্রত্যেকবার, দরজার ওপর
টাঙ্গিয়ে রাখে; এবছর
অঞ্জলি দিতে পারবেনা,
কিন্তু, দেবীর বজ্রটা
নেবে বলে রেখেছে আগে
থেকেই। এবছর টাকাও কম
উঠেছে, কিন্তু কাটছাঁট
করতে মন চাইছে না ওদের।
মিটিং চলছে ওদের। দেবী
আসছেন। ছাতিমের গন্ধ
পাড়ার মোড় থেকে পাওয়া
যায়। পুজোর ছ’দিন আগের
ভোরে লাউডস্পিকারে
আবার মহালয়া চালাবে বলে
প্ল্যান করছে। রাতের
দিকে হালকা শিরশির,
স্ট্রিটলাইটগুলোকে
জড়িয়ে ধরছে মিহি
চিনিদানার মতো কুয়াশা।
বেঁচে থাকছে উৎসব। আর,
ঈশ্বরকে যুদ্ধের দিকে
এগিয়ে দেওয়া যাক আবার।
ওতে নিশ্চিন্তি গাঢ় হয়
বাবু, তুতা, ভজা, অসীমের
বৌয়ের, আমাদের সকলের।
ইয়াসিন’দার মেয়ে
রিম্পি অষ্টমীতে
প্যান্ডেলে আসবে ঠিক,
গিটার-বাপ্পার সঙ্গে
আড়াল খুঁজে ঘুরতে
বেরোবেই।
গিটার-বাপ্পার বাবার
অফিস খুলেছে আবার,
কিন্তু দেনা বেড়ে গেছে
অনেকটা এই ক’মাসে।
মাঝেমাঝে রাতে বাড়ি
ফেরেনা পাওনাদারের
ভয়ে। শরিকি বাড়ির
ঝামেলাও মেটেনা, নইলে
কবেই ফ্ল্যাট হয়ে যেত
আর দেনাও মিটত ওই
টাকায়। গিটার-বাপ্পার
ওপরে ভরসা রাখে
রিম্পিই,
ইউনিভার্সিটিতে
মাস্টার্স শেষ করছে
বাপ্পা। তিনবছর আগে
এর’মই এক হেমন্তে
রিম্পি-বাপ্পার আলাপ
হয়েছিল। কার্তিক ওদের
দেখেছিল একদিন নিউ
মার্কেটে। গেলবার
পুজোয়। তুতা দোলের আগের
সন্ধ্যেয় অটো নিয়ে
ফেরার সময় দেখেছিল
কানাগলিতে মল্লিকদের
ভাঙা বাড়ি থেকে বিষণ্ণ
মুখে বেরোচ্ছে ওরা।
বারোয়ারি পুজোর মাইকে
অঞ্জন দত্তের গান শুনে
গিটার শেখার শখ হয়েছিল
বাপ্পার... এসব আখ্যান
ফুরোয় নাকি? পাড়ায়
বেপাড়ায় নামগুলো বদলে
যায়
#
দেবীকে ডুবিয়ে দেওয়ার
পরেও উৎসব থেকে যায়।
সেই কবেকার নদী থেকে
ভাসানের গন্ধ বুড়ো
বাতিঘরের প্রাজ্ঞতা
কুড়িয়ে নেয়, জলের সংলাপ
জানে। নীলকণ্ঠরা ডানা
মেলে ঠোঁটে ঠোঁটে
অপরিমেয় বিষাদগন্ধ
রেখে যায়। ভাসানকুলিরা
পরমাদরে কাঠামোটুকু
তুলে আনবে মরচে পড়া
দুপুরের গভীর থেকে- এমন
বিশ্বাস নিয়ে দেবী সব
হাত মেলে দিয়ে ডুবে
যান। আবারও সংকট গাঢ়
হবে জেনে ভাঙা
মিথ্গুলো জুড়ে জুড়ে
নেন। তখন বিষুবরেখা
পেরিয়ে যাওয়া দিন নিভে
আসে। আহত আলোর ভিড়ে
পাতাঝরা শুরু হলে
অলক্ষ্যে
একটা-চারটে-তিনটে
পরিযায়ী আসে; শেষবার এই
জনপদে কী নিভৃত অসুখ
জমিয়ে রেখেছিল, কোন
কুটো ফেলে গেছিল কোন
ঝিলে- সেইসব খুঁজে
নিতে। এসবই হেমন্ত নাম
দিয়ে আকাশপ্রদীপে
বেঁধে রাখা হয়। বাঁশের
মাথায় জ্বেলে রাখা আলো
নির্জন স্বাক্ষর হয়ে
জেগে থাকে আতপচালের
গন্ধমাখা সন্ধ্যেয়। কে
নেমে আসে পথ চিনে? কারা
আসে? উৎসব ফুরোলে কী
পাবে তারা আমাদের
জনপদে? অন্নজল, আলোসুখ-
সবই তো বিপন্ন এ জনপদে।
চালবাটা দিয়ে আঁকা
পায়ের ছাপ লক্ষ্মী পা
ফেলার আগেই উধাও। সাদা
পেঁচার অপেক্ষায় জেগে
জেগে বহু রাত কোজাগর- কত
বিষণ্ণ জানলায়। জনপদে
সাদা পেঁচা আসে না।
উঠন্ত দোকান আর পড়ন্ত
শরিকি বাড়ির শোকে পরী
আসে, হারানো ডানা খুঁজে
পেলে উড়ে যাবে পোড়ো
বাড়ির একাকী ভূতের
সঙ্গে। ভোররাতে তাদের
দেখা হয়ে যায়; যখন
উৎসবের আলো খুলে ফেলা
হয়ে গেছে, প্যান্ডেলের
বাঁশ সাইকেল ভ্যানে
চেপে চলে গেছে, বিসর্জন
আর বলির ঢাক থেমে গেছে।
সমস্ত মানত তাদের
খোয়াবের পথে কবোষ্ণ
ভোরে জেগে উঠেছে আড়মোড়া
ভেঙে, হয়তো। আকাশপ্রদীপ
আর কথাঠোঁট পরিযায়ী
বিপর্যস্ত জনপদে
ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে
সরিয়ে লিখছে-
হাওয়া জুড়ে চাঁদ নেমে
দেখে ঝুটোপাথরেও
স্বপ্ন মাখানো ঢের
কার্সিনোমিক দিন খোঁজে
কবেকার খসে পড়া প্রিয়
তারাদের!
পরীটি উড়তে চেয়ে
কোজাগরে ভোরের মানত
ছুঁয়ে চুপ
কানাগলি চেয়েছিল
সারারাত হিম চুঁয়ে
পথবাতিরা জ্বলুক
জানা থাকে বিপর্যয় হলুদ
পাতার ঝোঁকে অভিমানী
শ্লোক
পোড়োবাড়ি চেয়েছিল
আখ্যানে ভূত ও পরীর
দেখা হোক
অসুখ মুছুক তবে! অন্ন
খুঁটে উৎসব পাক বিষণ্ণ
ত্রিলোক
ক্রাইসিস গাঢ় হবে,
ততক্ষণ জলে দেবী সুখেতে
জিরোক।।