শব্দ হল। সে কান পাতল।
যেমন যন্ত্রণার শব্দ।
স্রোতের মতো গড়িয়ে
যাওয়া বেদনার শব্দ।
শরীর থেকে শরীর পড়ে
গেলে, শরীর থেকে শরীরের
বদল হলে যেমন শব্দ।
শরীর পতনের শব্দ।
শরীরের রূপান্তরের
শব্দ।
নিজের দুটি হাতকে আলতো
করে, শরীরের ওপরে
ভুমিদাগ দিল যেন। আহা
শরীর। একটা কিছু ভিতরের
শব্দ হচ্ছে না? থেকে
থেকে একটা শব্দ কিছু।
একটি শরীরের ভিতরে সৈকত
থাকে, সূর্যাস্তের পরে
যেমন একটি বালুকাবেলা,
সারি সারি গাছ, পিচের
রাস্তা, আর রেললাইনের
ওপরে দাঁড়িয়ে বহুক্ষণ
ধরে একটি রেলগাড়ি।
সিগন্যাল লাল। কিছু
বড়সড় দীর্ঘকায় মালগাড়ি
হয় তো ক্রসিং নিচ্ছে।
বা সামনে কোনো
দুর্ঘটনা। ট্রেন
কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে।
হিসেব করে বলা যাচ্ছে
না। অনেকক্ষণ।
বহুক্ষণ।
কিন্তু সে একজন এমন
যাত্রী যার সঙ্গে এখনও
কেউ একটিও কথা বলে নি।
বলছে না। কিন্তু পরস্পর
যাত্রীরা সবাই নিজেদের
মধ্যে কথা বলছে।
বিভিন্ন বিষয় নিয়ে।
ম্যাগাজিন, রাজনীতি,
খেলা, হলুদ সাংবাদিকতা,
শেয়ার বাজের ক্রমশ
তলিয়ে যাওয়া অর্থনীতি
কখনও কখনও। আসলে
সংরক্ষিত বগির ভিতরে
এমন একজন যাত্রী থাকে,
যে ব্রাত্য থেকে যায়।
অথচ সবাই তাকে তলচোখে
দেখে যায়, নিরীক্ষণ করে
শিকারি পাখির মতো।
সে একটু দূরে বসে আছে।
কারণ সবাই তাকে দেখে
দেখে উপভোগ করছে,
কিন্তু কথা বলছে না। সে
নিজের মধ্যে নিজেই ডুবে
আছে। কখনও কখনও ঢুলুনি,
আবার একটা কাগজ খুলে
কিছু পড়ছে, জানালার
বাইরে চোখ রেখে দখছে
বহুদূরের আকাশ কেমন
ঝুঁকে পড়ে গেছে।
একেবারে কাঁত হয়ে গেছে,
যেন ওই দূরে, জায়গা জমি
শেষ হয়ে গেছে, হয় তো বা
ওখান থেকেই একটি সাগরের
সূচনা বা পৃথিবীর সব
জমি যেন ফুরিয়ে গেছে।
সে বুঝতে চেষ্টা করছিল,
যেমন সে কল্পনা করত,
একটা কিছু শেষ সীমানা,
স্থির তাকিয়ে ছিল।
নিস্পলক।
তার উল্টো দিকে একজন
প্রবীণ ভদ্রলোক। গায়ে
তার সাদা ফতুয়া।
ডোরাকাটা পায়জামা।
সাদা কালো স্ট্রাইপ।
তার স্ত্রী, ঠিক তার
পাশের সিটে, মাঝে
যাতায়াতের করিডোর।
বৃদ্ধ মাঝে মাঝে চেষ্টা
করছে কিছু বলার জন্য।
কিছু বলতে গিয়েও বৃদ্ধ
কথাগুলি ফিরিয়ে নিচ্ছে
বারে বারে। অনেকক্ষণ
ধরেই, একটি কথা বৃদ্ধ
ঝড়ে ভাঙ্গা পাখির বাসার
মতো ঝুলিয়ে রেখেছে
ঠোঁটের ডগায়। কিন্তু
কোনো কথা বলতে চাইলেও
না বলার মধ্যে একপ্রকার
অস্বস্তি থাকেই।
সে এবার লক্ষ করল,
করিডরের পাশের সিটে বসে
আছে সুঠাম দেহের দুইজন
যুবক। তাকে বারে বারে
দেখছে। ওদের পাশে পড়ে
আছে, একটি ফুলের তোড়া,
ভারি চমৎকার দেখতে,
দেশি ও বিদেশি ফুলের
সমাহারে গুচ্ছ। আর
তেমনি নানান সবুজের
পাতার বাহার। ফুলের
তোড়াটি চমৎকার
অ্যান্টিক, উচ্ছসিত
বিমর্ষ একপাশে যুবক
দুটির পাশেই। ফুলের
তোড়া এমনই, আসর বা
অনুষ্ঠানের শেষে যেমন
প্রাপকের হাতে উঠে
অবশেষে বিষণ্ণ ও বিমর্ষ
হয়ে যায়। ফুল তখন ফুলের
ধর্মে নেই, তোড়ার
পরিণতি, একাকী পড়ে পড়ে
শুকিয়ে ওঠাই তার নিয়তি।
সে বুঝতে পারল, তারা
এসেছিল সেই শহরে যেখান
থেকে ট্রেনের যাত্রা
শুরু, সব যাত্রীই সেই
স্টেশন থেকেই সংরক্ষিত
জায়গায় বা সিটে বসে
আছে। সে নিজের মধ্যে
ডুবে থেকে একাকী নিজের
কথার সঙ্গে ভ্রমণ করতে
করতে, একটি গোটা রাত
অতিক্রম করে, ট্রেনটি
সিগন্যাল না পেয়ে থেমে
গেছে একটি অন্তহীন হলুদ
মাঠের পাশে। সকাল
গড়িয়ে, বুনো লতাপাতার
পাশে, সোনালি রোদের
ঝকঝকে বেলা।
সে ভাবছিল, আর ঘড়ি
দেখছিল। ঠিক কতক্ষণ
দাঁড়িয়ে আছে ট্রেন,
একটু দূরেই পাহাড়,
পাহাড়ের সারি, সামনে
জলাশয়, পাহাড়ের নিচে
সবুজ ফসলের মাঠ, একটি
নিমেষে পলক ফেলার মতো
সেতু, তারপরে প্রান্তিক
নদীর অশ্রু দাগ। সে যা
দেখছে বিবরণগুলিকে আরও
খুঁটে খুঁটে উপভোগ করতে
থাকল।
হঠাৎ বৃদ্ধ তার দিকে
তাকিয়ে বলল,- বয়স হলে
শরীর আর শরীরে থাকে না।
সে চমকে উঠল বৃদ্ধের
কথা শুনে। কিছু বলতে
গিয়েও নিজেকে ফিরিয়ে
নিল। বৃদ্ধের কথাটি সে
পুনরায় শুনতে চাইল, সে
তাই কিছু না বলে
বৃদ্ধের দিকে এমন
তাকাল, আপনি কিছু বললেন,
আমি শুনিনি। আবার বলতে
পারেন।
বৃদ্ধ একই ভাবে, একই
সুরে আবার বলল,- বয়স হলে
শরীর আর শরীরে থাকে না।
সে একটুও সঙ্কোচ না করে
বলল,- আমাকে বললেন?
আপনাকে? আমি এমনিই
বললাম।
তা হলে যা বললেন, আমার
দিকেই বা তাকিয়ে কেন?
আপনি আমার সামনে বসে
আছেন বলে, তাই বললাম।
“তাই বলে শরীর শরীরে
থাকে না”, এমন কথাই বা
কেন?
কেন? শরীর কি কোনো
অশ্লীল শব্দ?
তা কেন? শরীর এক বড় শব্দ।
হ্যাঁ। যে কোনো শরীর
তার সম্মান আছে। বললাম,
বয়স হলে শরীর আর শরীরে
থাকে না। আপনার বয়স কম,
তাই, আপনি বুঝবেন না,
আমার মতো বৃদ্ধের
শরীরের অবস্থান।
হ্যাঁ। আমি আমার
অবস্থানে বুঝতে পারব
না, আপনার অবস্থান।
করিডোরের পাশের সিটে
বসে থাকা দুই যুবক যেন
কান পেতে শুনছিল ওদের
কথাবার্তা। নিজেরাই
পরস্পর মুখের দিকে
তাকাচ্ছিল। প্রসঙ্গ তা
হলে সরাসরি এসে পড়ল, বা
না। কিন্তু কথাটা যে
শরীর নিয়ে শুরু হল।
আসলে দুই যুবক নিশ্চিত
হতে পারছিল না, কিন্তু
নিজেরাই নিজের মুখের
কথা বলতে গিয়েও ঢোঁক
গিলে ফিরিয়ে নিল।
আচ্ছা নাম তো শরীরের
আইডেন্টিটি বহন করে।
নাম তো জিজ্ঞাসা করা
যেতে পারে। নাম
জিজ্ঞাসা করলে অনেকটাই
সমাধান হতে পারে। নাম
দিয়েও বুঝে নাওয়া যায়,
যেমন ডাকঘরের নাম দিয়ে
তার স্থান বা জেলা
মহকুমা এসব চিহ্নিত করা
যায়। অনেক সময় অনেক
ব্যক্তির শরীর বিভ্রম
সৃষ্টি করে। একজন
ব্যক্তির শরীর তার
পরিচয়ের অনেকটাই
সমাধান করে দেয় না।
কিন্তু নাম অস্তিত্বের
সমাধান করে দেয়। যেমন
এই নামে তিনি, সেই নামে
শ্রদ্ধেয় ও শ্রদ্ধেয়া
মহাশয়া বা মহাশয়।
দুইজনের এক যুবক কিছু
বলতে যাচ্ছিল, পাশের
যুবক তার হাত চেপে দিয়ে
তাকে সাবধান করে দিল।
চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে
চাইল, কি বলতে চাও অথবা
কি প্রশ্ন করতে চাও
তুমি? বোকার মতো কিছু
বোলো না। দেখলে না,
বৃদ্ধ কেমন নিজেই তার
দিকে তাকিয়ে নিজের কথা
বলল, আর প্রশ্নের
সম্মুখীন হতে হল। আসলে
তুমি যদি নিজের শরীর
নিয়ে কিছু বলে ফেল,
উপস্থিত সবাই ভাববে,
কারও না কারও শরীর নিয়ে
তুমি প্রহসন করছ। এ
ভীষণ সুক্ষ্ম প্রশ্ন।
যুবক দুইটির মনের
অবস্থানের কথা ভেবে
বৃদ্ধ বলল,,- অথচ শরীর এক
অনন্ত। অন্তহীন তার
আকার। সময়ের ঘাত
প্রতিঘাতে ক্ষত।
একজন যুবক তার বন্ধুর
দিকে তাকিয়ে তার কানে
ফিস ফিস করে বলল,- আমি
নিশ্চিত হতে চাইছি।
আমার কৌতূহল চেপে
বসেছে।
খবরদার না। এই বোকামি
করলে, তোমাকে অপমানিত
হতে হবে। তখন আমাদের
পরের স্টেশনে নেমে যেতে
হবে। তা হবে এক বড়
বিড়ম্বনা।
আমি বরং বিবরণ দেখি।
দেখ। কিন্তু দেখে
তোমার প্রতিক্রিয়া
ব্যক্ত করা চলবে না।
নিজের মধ্যেই নিজে রেখে
দাও। প্রকাশ করা চলবে
না। সাবধান করে দিলাম,
আমাকে বিব্রত কোরো না।
সে তাকাল, কিন্তু দুই
যুবকের দিকে নয়। ওরা
খেয়াল করে নি, ফুলের
তোড়াটি, ওদের পায়ের
নিচে কখন পড়ে গেছে। সে
নিস্পলক তাকিয়ে ছিল
ফুলের তোড়াটির দিকে।
ফুলের তোড়ায় অনেকক্ষণ
পরে মোড়ানো সেলোফেন
পেপারে একপ্রকার ঘাম
হয়। মানুষ ফুল ছিঁড়ে
সংগ্রহ করে, তোড়া
বানিয়ে, বিশেষ
ব্যক্তিকে সম্মান
জানানোর মধ্য দিয়ে
ইচ্ছাকে চরিতার্থ করে।
তারপরে সম্বর্ধনার
নামে প্রাতিষ্ঠানিক
উত্তরীয় পড়িয়ে দেয়। আর
করতালি।
সে এমন ভাবে তাকিয়ে আছে,
ফুলের তোড়াটির দিকে,
যেন না তুলে রেখে দুই
যুবক ভীষণ অন্যায় করে
ফেলেছে। হ্যাঁ, অন্যায়
তো বটেই। একেই ফুলের
তোড়া, যার একটি শরীর,
একটি নয়নাভিরাম গঠন,
খেয়ালই করে নি তোড়াটি
পড়ে আছে ওদের পায়ের
কাছে। অথচ ওরা তাকে
দেখছে, যেন গিলে ফেলছে।
সে তাই কঠিন দৃষ্টিতে
তাকিয়ে ছিল ফুলের
তোড়াটির দিকে। দুই যুবক
তার কঠিন দৃষ্টির অর্থ
বুঝতে পারল না। বুঝতে
পারল না, সব শরীরেরও
সম্মান আছে। আসলে
মানুষ, শরীরকে সম্মান
না দিয়ে, তার প্রতি
কৌতূহল পূরণের জন্য
ব্যস্ত হয়ে ওঠে।
ট্রেন থেমে আছে কতক্ষণ
হল? আর কতক্ষণই বা
দাঁড়িয়ে থাকবে। সেই
সকাল থেকে ট্রেন
দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু
সঠিক কোনো সংবাদই পাওয়া
যাচ্ছে না কেন ট্রেন
দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণ
দাঁড়িয়ে আছে দেখে
যাত্রীরা ভাবল, নিশ্চয়ই
কোনো দুর্ঘটনা ঘটে
গেছে। না হলে, এতক্ষণ
ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকার
কথা নয়। অনেকেই বুঝতে
পারছে না সামনে কোন
স্টেশন, কতই বা দূরে?
চলার গতি ও থেমে থাকার
মধ্যেও অনিশ্চিত
ভবিষ্যতের ইঙ্গিত
থাকে। আসলে নিশ্চিত
ভবিষ্যৎ ও চিন্তাহীন
জীবন পারদের মতো চমকায়
না, একবার যেন ট্রেনের
ইঞ্জিন ভোঁ ভোঁ করে
উঠল। পাহাড়গুলি যেন
কেঁপে উঠল। আর হলুদ
মাঠের ওপর দিয়ে, বাতাস
চলে গেল। বেশ কিছুটা
দূরে গ্রামীণ পিচের
রাস্তা, মোটরসাইকেল
দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি,
কয়েকটি ফসলের মাঠের যান
যেমন হয়, আর
ট্র্যাক্টর। একজন
যাত্রী বলল,- ট্রেন আর
কয়েক ঘণ্টা এগিয়ে গেলেই
আঁখের ক্ষেত দেখতে
পাবেন, চিনিকলের গাঁদের
গন্ধ উড়ে আসবে বাসি
তাড়ির মতো।
যত সময় যাচ্ছে, সে বুঝতে
পারছে, তাকে দেখার
অভ্যাস সব যাত্রীরাই
ক্ষয়ে ফেলেছে, মানে
তাকে দেখার মধ্য দিয়ে
যে ভাবে সবাই আয়জনহীন
উৎসব যাপন করছিল, এখন
তার আমেজ অনেকাটাই পড়ে
গেছে। সে নিজের মনেই
হাসতে হাসতে বলল,-
মানুষের থেকেও শরীর হল
অনেক বড়, আসলে শরীর হল
প্রতিটি মানবিক
অস্তিত্বের ঠিকানা।
ট্রেন যখন ছাড়ল, তখন
দুপুর গড়িয়ে গেল। দুপুর
হলে বুনো কাঠকুটোর
ধোঁয়া ও গন্ধের টের
পাওয়া যায়। আসলে
গ্রামীণ উনুন জ্বলে,
রন্ধনের আয়োজন চলে।
রেললাইনের পাশে জনপদ,
সব হারানো উবু জনপদ, বা
নিঝুম শহর, বা মাটির
বাড়ি ও উনুনের ধোঁয়া
এসবের মধ্যে অদ্ভুত এক
ভিন্নতা আছে। সামনের
স্টেশন আর কিছুক্ষণ
পরে। সে তার লাগেজ
গুছিয়ে নিয়েছে। জলের
বোতল, ক্যামেরা কলম,
ব্যাগের ভিতরে রাখা
পারফিউম বার করে, নিজের
পোশাকে স্প্রে করে,
আবার তা হাত ব্যাগে
রেখে দিয়ে, অন্যান্য
টুকিটাকি গুছিয়ে নিয়ে
প্রস্তুত হয়ে আছে,
সামনেই তার নেমে পড়ার
স্টেশন। কি যেন নাম? কি
যেন নাম স্টেশনের?
নিজের মনেই হাঃ হাঃ হাঃ
হাঃ করে চারদিকে তাকিয়ে
নিজেই বলে উঠল,-
শরীর... শরীর... শরীর।
আসলে শরীর হল একটি
স্টেশন।
যার ভূমিকা আছে কিন্তু
প্রস্তাবনা নেই।
স্টেশনের কি নাম? জানার
দরকার নেই। স্টেশনের
নাম আগে থেকেই ঠিক হয়ে
আছে। শরীর... শরীর... সে
নেমে পড়ল, একজন এসে তার
লাগেজ নামিয়ে নিতে
সাহায্য করল, স্টেশনে
আর কোনো যাত্রী নেই,
নিজেরাই তারা কিছু কথার
টোকা দিল, দুজনেই খুশির
হাসি হাসল, পরস্পরকে
আলিঙ্গন করে চুমু দিতেই
ট্রেনের হুইসেল বেজে
উঠল, ট্রেন ছেড়ে দিল...