নদীর মাঝামাঝি যেতেই
সন্ধ্যা নামল, আলো
নিভছে পশ্চিমে, গতর
ঢলকিয়ে, তখন মাঝি কেবল
মুখে আগুন দিয়েছে
অর্থাৎ সিগারেট
ধরিয়েছে এমন সময় নদীতে
ঢেউ উঠল, নৌকা ইঞ্জিনের,
ভটভট শব্দ বাতাসের
যৌনতায় আঘাত হানল,
কোথায় যাবে মাঝি? মাঝি
নিজেকেই প্রশ্ন করে -
উত্তর অদৃশ্য মায়ার
মতো, তুমি যেথা যেতে চাও,
আমার তো কোথাও যাওয়ার
জায়গা নেই, পুঁজের মতো
মেঘ আকাশ চিরে বেরিয়েছে
মাত্র, মাঝি সিগারেটের
ধোঁয়া নাকের ভেতর দিয়ে
ছাড়ে, টানের পর টান
দিচ্ছে উহ তবু শালা
সুখটান আসছে না, কলিজা
ঠার হয়ে আসে, মাথায়
গনগনে আগুনের বর্শি যেন
হাবিয়া দোজখে পাপীদের
শাস্তির অন্যতম নমুনা
মাঝি তার মাথায় বয়ে
চলেছে, তবুও মাঝি
থামেনা আবার মুখে আগুন
দেয় - ভাবে, জিজ্ঞাসা তার
পিছু ছাড়েনা, রাতে চাঁদ
নেমে আসলে নদীর পানির
চেহারায় জেল্লা ফিরে
আসে, সে জেল্লা মাছের
আইঁশের মতো রুপালি
ঝকঝকে, সাধুরঘাট ছেড়ে
এগুলে মহৎ দালালের মতো
দাঁড়িয়ে থাকে বটগাছ,
সেই গাছ মাঝি দেখত আর
পরিকল্পনা করত যদি
বটগাছটার মতো তাকে কেউ
ছায়া দিত, ভালবাসত,
গোপনে কাছে ডেকে
ফুসলিয়ে জেনে নিত
পারাপারের টাকাকড়ির
নগদ হিসাব নিকাশ, কেউ
মাঝির মন বোঝার আগেই
তিরষ্কারের ছলে ঘাটের
ঘাট পানি ভেঙে যেতে বলত
নতুন কোন ঘাটে, এসব
পুরাতন বাতচিত -
ভটভট শব্দ পশ্চিম থেকে
উত্তরে ঘুরে গেলে
জেলেদের কয়েকটা ডিঙি
নৌকা মাঝির ভাবনা ছুঁয়ে
খালঘাটের দিকে শিশ দিয়ে
মিলিয়ে গেল, বাতাস চেপে
এসেছে, মাঝি তার ফরসা
মুখ স্রোতের ভাঙা ঢেউয়ে
এগিয়ে দিতেই কানে নিজ
গ্রাম কাইয়া ( কাক) পাড়ার
ব্যক্তিগত ঝংকারে ঝগড়া
পরবের মালসা বেজে উঠল -
ঝম - ঝম - ঝম, ক্যাঁক -
ক্যাঁক - ক্যাঁক, রে - রে -
রে -
'এই চাইল চুন্নি মাগি
এই খানগি
এই লটি
এই বুড়ি বেশ্যা
ধরাপড়ানি
ভাতারখাক্কি'
মালসার তালে তালে এই
গালির মুদ্রা মুসি তার
বৃদ্ধা ফুফু শ্বাশুড়ির
থোবড়ানো গালে কষে মারল
-
ঝগড়া পরবের মাঝে
প্রাকৃতিক নিয়মে আবার
মালসা বেজে উঠল, ঝম - ঝম -
ঝম, ক্যাঁক - ক্যাঁক -
ক্যাঁক, রে - রে - রে -
মুসি থামেনি বটে, মাঁজা
শক্ত করে, গরম বালিতে
ভুট্টার খৈয়ের মতো তার
শব্দবাণ ফুটে , চোয়ালের
মাংস ফুলে কেঁপে লাল
হয়ে উঠল, সাপের ফণার মতো
নাক ফরকিয়ে, চোখ উলটিয়ে,
কৃষাণের জমি কোপানোর
ন্যায় কোপাতে থাকল
মুখের ভাষা, আর
লম্ফঝম্ফ অবিকল তেলি
বাড়ির ছুটে যাওয়া ঘানির
চোখেপট্টি দেয়া কানা
এঁড়ে গরুটির মতো -
কে থামায় তাকে!
তার কানে মালসার ঝংকার
বেজে উঠেছে, ভয়ে পাড়ায়
কেউ তাকে লাড়েনা,
ছোঁয়না, প্যাশালে
অর্থাৎ আড়ালে ছি - ছায়ে
ঘিন্না করল বহুত, কে
থামায় তাকে!
মুসির ফুফু শ্বাশুড়ি
এইবার মুখ খুলল, তার
স্বর মৃতপ্রায় নদীতে
খেলে যাওয়া বাতাসের মতো
ছিল, মাগি - হামি ভাতার
খাক্কি লই, তুই ভাতারকে
ভেড়ার লোম খাইয়ে বস
করেছিস লজ্জা কর
বেহায়া, হামি হামার
ভিটা- মাটি লেখ্যা দিনু
শ্যাষে হামার প্যাটে
লাত দিলি মাগি, ভাতারকে
বশ করলি!
কথায় আছেনা ' লাভাঙার
অাভাঙা কথা, গোয়ালটুলির
লড়ে মাথা - আর আল্লা কইরা
না হয় দেখা
লক্ষ্মীপুরের সাথে ' -
সেই লক্ষ্মীপুরের
লাগিনী আইজ হামার ঘরে -
মুসি বঙ্গোপসাগরের
নোনা ঢেউ জমিয়ে
জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি করে
আঘাত হানল সাংসারিক
উপকূলে , এবং নিম্নচাপ
চলল দিনমান -
কে থামায় তাকে!
গ্রামের হাটের এক হকার
ওষুধ বিক্রির আগে
চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গলা
ফাটিয়ে খুব বলত '
চুলকানি দ্যাওর ভাসুর
মানেনা, এ মহালম লিয়া
যান, উপশম ম্যাজিকের
মতোন ' - তেমনি এই বউটি
চুলকানির মতো দ্যাওর
ভাসুর মানেনা, সময় -
অসময়ে ঝগড়ায় লেগে পড়ে,
তার স্বামী ভেজা
বেড়ালের মতো চুপটি করে
নিজ স্ত্রী আর বৃদ্ধা
ফুফুর কাজিয়া উপভোগ করে
- মাঝি কী এসব দেখেনি! সব
দেখেছে পাড়ার মানুষ
কাকের মতো জুটে চিমটি
কেটে কথার বারুদ
কাজিয়ায় ছিটিয়ে উসকে
দিয়েছে - মাঝি এটাও জানে,
কিন্তু এসবের উপশম
ম্যাজিকের মতো তার নজরে
পড়েনি -
মাঝি গুনগুন করে বলে
উঠল -
কে থামায় তাকে!
বাঁক নিল নদী। এইখানে
শশ্মান। অন্ধকারে
কাছাকাছি কোথাও গা
ডুবিয়ে আছে প্রাচীন এক
মসজিদ, তার চুঁড়ায়
মাইকজোড়া হাতির কানের
মতো উত্তর - দক্ষিণমুখি
প্রত্যহ পবিত্র
উচ্চারণ বিলি করে,
পরিচিত যাওয়া আসার
মানুষ ছাড়া হাতড়ে
মসজিদটি ঠাওর করা বা
খুঁজে পাওয়া কঠিন, তারই
ধারে মেলার মাঠ এইখানে
পরিরা নামে, জ্যোতির্ময়
ধবধবে পাখা নিয়ে, আমার
এসব শোনা কথা তবে মাঝি
সকল বৃত্তান্ত জানে
গোপন রাখে, তার যে
পৃথিবীর বহু রহস্য গোপন
রাখতে হয়, এই রাত তার
মোহিনীশক্তি,
যোগিনীতন্ত্র দিয়ে
মুড়িয়ে রাখে পৃথিবীর
নিহত দেহটিকে -
মানুষ বড় উদাসীন রাতের
রহস্যের মতো নিজের আত্ম
- আত্মার রহস্য নিজের
কাছে রুক্ষ এবং
রসকষহীন, জানতে হলে আগে
মরে যাও এ মৃত্যু
অমৃতকুম্ভের মতো,
ঘোলাটে স্বচ্ছ কিন্তু
আবার মাতাল, পরিরা
নিশিপহার রাতে নেমে আসে
গগন গহিন ভেঙে, আসমানের
সুপ্ত দরজার চাবি তাদের
ইশারা, মানুষ সেই
ইশারার বাইরে,
আধ্যাত্মিক ফকিরের
বুকে পাঁজরে পুষ্প গন্ধ
ফেনিয়ে উঠলে তারা দূর
আকাশের তারাটির মতো
কিংবা গঞ্জের
বদ্ধপাগলের মতো চেয়ে
থাকে তাদের কেউ কটাক্ষ
বা তাচ্ছিল্য করেনা,
দ্যুতিময় ঘাগরার ভাঁজ
থেকে জোনাকীপোকার আলো
নিয়ে পরিদের নৃত্যকলা
ছিটকে পড়ে -
আশ্চর্য সেই
দৃশ্যসঙ্গীত, আশ্চর্য
তার কল্পনা মহিমা, তার
ধারে কাছে যারা গেছে
অর্থাৎ সেই মোহময়
উপাখ্যান নিজের চোখকে
বিশ্বাস করিয়েছে তারা
অনেকেই মরেছে অথবা
নিয়ন্ত্রণে আত্মশাসন
করে পাগল হয়ে বেঁচে, পথে
প্রান্তরে বাহ্যিক
নগ্নতা প্রকাশ করছে -
সেই পরিরা খিলখিল করে
হাসে, তারা কি জানে!
নগ্নতা একটি ভাষা,
ধর্মের - অধর্মাচরণের
আর বর্ণের, তারা
যৌবনপ্রাপ্ত, লক্ষ্ণৌর
বিখ্যাত সব তাবায়েফের
মতো সুরমাচখি, কৌশলী,
মধুময়ী আর দক্ষ বেশ্যার
মতো কারুকার্যখচিত
আবেদনময়ী!
পাকা ডুমুর রঙা
নাভিচক্র থেকে বেরিয়ে
এল এক ঢিলেঢালা সোনালি
গাউন পড়া বুড়ি, তার চোখ
জ্বলছিল, মেলার মাঠের
এক কোণে আছড়ে পড়ল তার
ক্লান্তি আর ক্রোধ,
বছরের এই দিনটিতে সে
একরাতের জন্য অভিশাপ
মুক্ত হয়, বিশ্রী চাহনি
নিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে
সুন্দরী সব পরিদের বলে '
পান করো বায়ু, তারপর
নেমে পড় পানিতে, এই
মোক্ষম সময়, লোকালয়
নেতিয়ে পড়েছে, ঘুমের
বিষ পান করে সবাই মৃত,
এসো বালিকারা - পান করো,
পান করো বায়ু -
অভিশপ্ত বুড়ির আদেশে
পরির দলের সবাই মুক্তোর
মতো দাঁত দেখিয়ে হাঁ
করে পান করল নিশিপহার
রাতের বাতাস, তারপর
ঝপাঝপ নদীর পানিতে নেমে
লম্ফঝম্ফ শুরু করল,
মাঝি এসব দেখে অজ্ঞান
হবার জো, অভিশপ্ত বুড়ি
পরিদের পানিতে নামিয়ে
উড়াল দিল পূবে সেখানে
তার জন্য অপেক্ষা করছে
অদৃশ্য প্রণয়, জলকেলি
মেতে উঠেছে, মাঝি এত
সুন্দর সুন্দর পরিদের
দেখে নিজেকে সামলাতে না
পেরে নৌকাটি তাদের
কাছাকাছি নিয়ে গেল,
পরিরা আশ্চর্য হয়ে
মাঝির দিকে তাকিয়ে
লম্ফঝম্প বন্ধ করে বলল '
কে তুমি? '
- আমি এই নদীর মাঝি
- নৌকা চালাও বুঝি?
- হ্যাঁ, বাপদাদার কাজ
রুপালি পরি বলল আমার
খুব শখ নৌকায় চড়ার, তুমি
আমাদের তোমার নৌকায়
নিলে পয়সা দেব, তারপর
খলখলানি হাসি -
পাশেই লাল পরি ছিল সে
বলল বুড়ি যদি জানতে
পারে তাহলে সব বলে দেবে
পরিরাজাকে, জানোতো সে
কেমন ; না হলে অভিশপ্ত
হবে কেন!
লাল পরির কথা শুনে বাকি
পরিরা বলল ঠিক, আমরা
যেমন বিপদে পড়তে চাইনা
কিন্তু ঠিক তেমনি নৌকায়
চড়তে চাই, বহু দিনের শখ
আমাদের - পরিরাজ্যের
সোনার নৌকায় চড়ে চড়ে মন
গুলিয়ে এসেছে শুনেছি
মানুষেরা কাঠের নৌকা
চালায়, ' এটা কি কাঠের
নৌকা মাঝি? '
হ্যাঁ পরিকন্যা এটা
কাঠের তৈরি, ' তোমাদের
সোনার নৌকা কে চালায় গো
পরিকন্যা? ' মাঝি
জিজ্ঞেস করল -
' আমাদের ও মাঝি আছে তবে
সে মাঝি অলস আমাদের
রাজ্যে এখন সবাই অলস,
সময় দূর্নীতি করে,
আইনকানুন ও নড়বড়ে কারণ
রাজ্যের সবার কাছে অঢেল
সোনার পয়সা '
মাঝি পরিদের কথা শুনে
ক্ষনিকেই নিজের
অস্ত্বিত ভুলে গেল,
পরির দলটিকে নৌকায় তুলে
ইঞ্জিন চালু করল,
ইঞ্জিনের ভটভট শব্দে
তারা সকলে কোমর দুলিয়ে
নাচতে লাগল - মাঝি অবাক,
এত সুন্দর নাচ জীবনে সে
দেখেনি -
নাচের সাথে কী সুন্দর
সেই গান! কী সুন্দর সেই
কথা!
ঝাঁক মিলে ধরল সেই
গানের সুর -
"এসো স্বচ্ছ
বালিকারা
তোমাদের সৌরভে
রাত্রি মোহিত ও আমোদিত
হোক
আনন্দ পল্লবে -
সুর এখানে এসেছে,
থেমেছে
গান তন্দ্রা আমাদের
ভেঙেছে
স্বর্গের বাতাস দেখ,
এনেছি বয়ে
পুলকিত শরাবের
পেয়ালায়
হে মাঝি তুমি
যৌবন যতটুকু গলিয়েছ
জলে
গোপনে গোপনে ভুলে
আমাদের নৃত্য, হৃদয়ের
ছানি
কেটে নিয়ে যাক গন্ধবতীর
উজানে "
একে একে যেন আচ্ছাদিত
উজ্জ্বল দেহবস্ত্র
খুলে পড়ল, পরিরা
সানন্দে গেয়ে যাচ্ছিল
গান, মাঝির নৌকা
হারিয়েছে পরিচিত নদীর
অববাহিকা, যেখানে অজস্র
কুমিরের ন্যায় অন্ধকার
ওৎ পেতে আছে, শুনেছি সেই
কলরব, শুনেছি সেই
আত্মচেতনার হুংকার,
ঐন্দ্রজালিক এক মায়া
নগ্নতার ভেতর থেকে নতুন
প্রেম আবিষ্কার করল, এস
মাঝি এস ধর আমার দুবাহু
এ ঐশ্বরিক প্রণয়,
অভিশাপের সংগ্রামে
অবসান ঘটুক লুকায়িত
আদেশ, সেই বুড়ি যার
পুনরুত্থানের দ্বার
আমাদের নাভিমূল, তুচ্ছ
করি সেই ধমক তোমার শক্ত
বাহু পেশি তীব্র মানসিক
দ্বিধাদ্বন্দ্বের
গন্ধ ছড়িয়ে দাও কুমারী
বুকে -
মাঝি নিস্পলক, আকাশে
উজ্জ্বল তারকারাজি মুখ
মেলেছে, এ বড় সুন্দর
ক্ষণ, এ সময় এই যৌবন
বীণাবাদন কি সত্যি তার
কানে বাজছে! এত উপমাভরা
মেদে আঙুর রসের মতো টক
নিঃশ্বাস বড়ই বেমানান,
গ্রামের চৌধুরীদের
মেয়ের চেয়েও সুন্দর
তাদের চোখের ভাষা, ডাক,
কামনার ঘুঙুর,
চৌধুরীদের শহুরে জামাই
পল্লীর কোন দারিদ্র
চার্চের ম্লান যিশুর
মতো বিদ্ধ ক্রুশকাঠে
যেন নত মুখ, মৃত, পয়সার
বেদীতে উৎসর্গকৃত যৌবন,
যৌনসুখ বিনিময়ের আগেই
শুকিয়ে গেছে বীজ, সেই
করুণতার থেকে সিল্কের
অথবা মখমলের কাপড়ের
আড়ালে তড়পানো দেহটির কী
হবে? মাঝি সংযত চোখে
লালসার গীদ পরিবেশন
করে, জেনেও যে রাত
পোহালে তার ভবিষ্যৎ
কী!
তুমি সামান্য একজন - লোভ
সম্বরণ কর মাঝি, গুনে
গুনে দেখল অবশেষ হ্যাঁ
ওরা আটজন যুবতী পরি,
তারা সবাই নগ্ন এবং একই
ভঙিতে নেচে চলেছে তাদের
কাউকে চেনার জো নেই
কারণ তাদের রঙিন পোষাক
গুলি নদীর খাদ্য, মাঝি
লোভী হয়ে উঠছে বাইশ
বছরের লোভে তার চেতনা
লোপ পেয়ে উঠল -
কেউ একজন কানে
ফিসফিসিয়ে বলল, এই নদীর
নাম কী? আমি তাকে নদীর
নামটি বলিনি, আসলে
রহস্যের মায়াজালে
ফাঁসিয়ে দিতে চেয়েছি
মাত্র, এই নদী ও মাঝি
আমার শৈশবের, তার যে
সাহস তাকে টেনে নিয়ে
যাচ্ছে পরিদের সাথে
আমার সেই সাহস নেই, এই
অঞ্চলে এককালে ঘন জঙ্গল
ছিল, চড়েছে বাঘ, গন্ডার
আর বুনো শুয়ার, কুমির আর
শুশুকে ভরা নদীর গর্ভ
বিভিন্ন জাতের মাছ ও
কাছিম লালন পালন করেছে,
সে গল্প বিস্তরে বলব
অন্য এক কাহিনিতে,
নদীটি বিখ্যাত হলেও
এখানে কোন বিখ্যাত ঘন
জঙ্গল আর পাহাড়ের চিহ্ন
নেই, আছে রসবতী ঘন
আম্রকানন, তার খ্যাতিতে
মৌমাছির মতো মানুষ
জুটেছে, সেই রসের মিঠা
বাতাস পথিক সহ জাগতিক
অশরীরী মায়ার মন উচাটন
করে তুলেছে -
পরিরা মাঝিকে মধ্যে
রেখে বৃত্তাকারে ঘুরে
ঘুরে নাচছে, পানিভরা
বেলুনের মত দুলছে
স্তনদ্বয়, নিতম্বে
উঠেছে তরঙ্গ, মধুময়
শুশ্রী বাতাসে মাঝির
ঘাম দরদর করে বিসর্জিত
হচ্ছে নদীবক্ষে, তার
নাচের মুদ্রায় সহসা তাল
ভঙ্গকারী কূট স্মৃতির
প্রণয়ডোর বিঘ্ন আনে -
মাঝি! এই ছেলে এদিকে শোন,
মাঝি সেই আদেশ ইশারা
পালন করতে পিছে পিছে
হেঁটে যায়, খুলে যায়
সিমসিম জাতীয় গোপন
কুঠুরির দরজা, ঝকঝকে
বিছানায় শুয়ে পড়ে
নাগিনী ছন্দ, মেলে ধরে
রত্নের ভান্ডার, আদেশ
আমার মাঝি নে - নে যতটুকু
নিতে পারার ক্ষমতা
পারলে তার ও অধিক, তারপর
প্রবল চিহ্নিত ক্ষুধায়
এঁটো হয়ে যায় চৌধুরীদের
সুরক্ষিত পেয়ালা -
এরমধ্যেই ঘাই মেরে উঠল
সোনালি গাউন পড়া বুড়ির
অভিশপ্ত দিনকাল, ফিরি
সেই সব বিস্তীর্ণ
মোহমন্ত্র টানে -
মেলার মাঠের পশ্চিমের
পাড়ায় এক তেলির তিল,
তিষি, সরিষা আর খৈল
বহনের জন্য তাগড়া এক
মদ্দা ঘোড়া ছিল , তাকে
পোষানিতে নেয়া হয়েছিল ছ
কি সাত মাসের বাচ্চা
বয়স থেকে, সে এখন গুড়ের
লালি আর ঘাস খেয়ে চকচকে
শুশ্রী লোমশঅলা ঘোড়ায়
পরিনত হয়েছে, তেলি সেই
ঘোড়াটিকে নিয়ে হাটবারে
খুব আয়েশ করে যেত, সবাই
সেই দৃশ্য দেখে বাহবা
ছুড়ে মারত আর সেই বাহবা
যেন তেলির তেলুক টাকে
এসে টোকা মারত -
দেখেছ অমন পুষ্ট গতর
অ্যাঁ - তেলি গোপন করেছে
বুঝলে, এ তল্লাটে কী আর
কেউ ঘোড়া পুষেনি!
মীরেরা, মালোরা,
কাঁসারিরাও তো ঘোড়া
পুষেছে কই কথা তো উঠেনি,
তবে এখন উঠছে কেন? হাটে
কথা বাজে কারো কাছে কোন
উত্তর নেই, সবার চোখের
নজরে যে বিস্ময় তার
আড়ালে রয়েছে হিংসা,
তাদের সেসব হিংসার উপর
দিয়ে তেলি দিব্যি তার
ঘোড়া নিয়ে ক্ষুরে বাজনা
তুলে হাট ঘুরে ঘুরে
সয়দা করে, হিংসুকদের গা
পিত্তি জ্বলে আসমানে
মেঘ আনে - বৃষ্টি নামে
তেলি তখন ঘোড়াটিকে ছেড়ে
দেয়, তারপর - পরই হ্রেষা
ধ্বনি তুলে তেলির ঘোড়া
অদৃশ্য হয়ে যায় - হাটভরা
মানুষের পদভারে বৃষ্টি
যেন আরো চেপে আসে -
জানা গেল সে রাতে
ফিরেনি ঘোড়া, তেলি ভেবে
ভেবে অস্থির, তার যে কথা
পূর্বেই মনে আনা উচিৎ
ছিল তা আসল হাত থেকে
ঘুড্ডুর ডোর ফসকে বের
হয়ে যাওয়ার পর -
পূর্বপুরুষের কথা
ঘোড়ার অর্ধেক প্রাণি
অর্ধেক জ্বিন, তাহলে কী
সেই জ্বিন অংশ তাকে
ভুলিয়ে ফেরারী করেছে!
মূহুর্তেই সব কিছু
নিস্তব্ধ আর চিৎ হয়ে এল,
অভিশপ্ত বুড়ির
পরিকালিন ঝরঝরে যৌবন
ঝরনাটির মতো উজ্জ্বল
পানির স্রোত নিয়ে নামছে
যেন, নাচতে নাচতে এল এই
নদীর ধারের মেলার মাঠে -
এখানেই চড়ছিল ভেজা গতর
নিয়ে কেশর দুলিয়ে তেলির
সেই পুষ্ট ঘোড়া - কেবল
তার মধ্যে নেমেছে ঘোড়া
যৌবনের সমস্ত
চাকচিক্যময় প্রভা -
তাতেই পরির মন উথলে উঠল,
মনে ধরে গেল তার - মনের
বিষক্রিয়ায় নিজেকে আর
কতক্ষণ করবে খুন! ঘাগড়া
ঘুরিয়ে নাচতে নাচতে
ঘোড়ার পেছনে যেই গিয়ে
দাঁড়িয়েছে, অমনি পেছনের
দুই পায়ের চ্যাটে পরি
সামান্য দূরে ছিটকে পড়ল
- ঐ যে বলেছিলাম জ্বিন
অংশ পরিটির ছলনা বুঝে
এই কান্ড ঘটিয়েছে,
ক্রোধের বশে পরি আত্ম -
উচ্ছ্বাসের বিস্ফারণ
ঘটাতে কু মতলব আঁটতে
লাগল - অদৃশ্য হল - আর
অন্ধকার থেকে ঝুন ঝুন
শব্দ হাঁকিয়ে বের হয়ে
এল এক ধবধবে মাদি ঘোড়া
হয়ে , যুবক তেলির ঘোড়া
মাদিটার ঘ্রাণ পেয়ে
হৃদয়কে ঠেলে নিয়ে গেল -
ব্যস শুরু হল লেজ
নাড়িয়ে খুনসুটি, প্রেম -
রাত্রির শেষ, সুবে
সাদিকের প্রথম প্রহরে
যৌন আবেদন, তারা যখন
নক্ষত্রের
জ্যোতিধারায় ডুবে
মিলিত হচ্ছিল তখন পরি
জগতে ফেরার ঘন্টা বেজে
উঠেছে - আহা! ধাক্কা লাগল
সেই আনন্দে - ধিক্কারের
বাজনা বাজতে লাগল, কোথা
থেকে যেন উদয় হল একটি রথ,
তাতে অজস্র সুন্দরের
প্রচুর সংখ্যক উপমা
জ্বলজ্বল করছে - পরিটি
ভৎসনা কুড়ানোর আগেই তার
আগের রুপে ফিরে যাওয়ার
পোশাক খুঁজতে লাগল,
তেলির ঘোড়াটি কোথায় যেন
ছুটে পালাল -
কান্নায় ভেঙে পড়ল সে
আমায় ক্ষমা করুন আর
আঘাত করুন শাস্তি দিয়ে,
রথ হতে রাজপুরুষ বলল
তোমার ক্ষমা নেই তুমি
পরিজগতের লজ্জা,
অভিশপ্ত - নিক্ষিপ্ত হও
যৌবনের শেষ সিড়ির
নিকটে, আর তোমার জন্য
ক্ষমা আর শাস্তি মাত্র
একটিদিন তুমি মুক্তি
পাবে মানবজগতে ফেরার -
সাথে থাকবে যুবতী
পরিরা, যেন তোমাকে দেখে
তারা সেই ভুল না করে,
তুমি হবে অভিশাপের
প্রায়শ্চিত্ত চিহ্ন -
অভিশপ্ত হওয়ার শর্ত
শুনে সে বলল হে
রাজপুরুষ এহেন ভুল
পূর্বেও আমার এক জ্ঞাতি
পুরুষ করেছিল তার
পেছনে এমন তো কোন শর্ত
জুড়ে দেওয়া হয় নি, এইসব
শর্ত কী আমি নারী বলে?
রাজপুরুষ ক্ষুব্ধ হয়ে
তার দন্ড বাহির করল এবং
সে দন্ডের আঘাতে
মূহুর্তেই সে তার সকল
রুপ যৌবন হারিয়ে এক
বুড়িতে পরিণত হল, যে
কিনা অভিশপ্ত বুড়ি -
রাত্রি মীমাংসার পর -
লোক লাগিয়ে যথেষ্ট
অনুসন্ধান শেষে খোঁজ
মিলল তেলির ঘোড়াটির,
চৈতন্যপুরের পানের
বরজে তেজী পুষ্ট
দেহটিকে রক্তশোষণ করে
কারা যেন দুমড়ে মুচড়ে
ফেলে গেছে -
অভিশাপ, বেদনা,
আত্মগ্লানির বিপরীতে
পরির দলটি তখনো নেচে
চলেছে, গাইছে - নদীর
উজানে বয়ে চলেছে নৌকা,
মাঝি বিলুপ্ত হয়েছে
পরিদের ঐশ্বর্যে,
নিদ্রালু চোখের পাতায়
আটকে গেছে আত্মঘাতী
সুখ, মাঝি তার ইঞ্জিনের
নৌকা নিয়েই পরিজগতে
প্রবেশ করতে চলেছে
শঙ্খপুরুষ ঢঙে - এ কী
লোভ, মোহ নাকি
প্রত্যাশা? যেখানে
খাদ্যসম্ভার হিসেবে
রয়েছে বিশেষ জাতীয় গাছ -
গাছড়া ( প্রতীকী খাদ্য
কবিরাজ ভাষায়) , ক্ষীণ
হয়ে আসছে নৃত্যের তাল,
সুর, লয়, গন্ধবতীর উজান
শুষে নিচ্ছে রাত,
সাড়াশব্দহীন রাতে
ক্রমশ দাঁত বসাতে থাকল
নির্জনতা, এ বড়ই
চতুরস্র রহস্য -
এসব কী বিশ্বাস করলেন
যেটা আমি শুনেছিলাম
অথবা আপনাদের শুনালাম,
সেই মাঝি যে কিনা বহু
বছর আগে হারিয়ে গেছে
গাড়োয়ালদের যুবক
ছেলেদের মতো - দরকার নেই
তবে কল্পনার ফ্রেমের
মধ্য দিয়ে মাঝিকে
দেখেছি সে ফিরেছে তার
অতীত মুছে, অকথ্য
বর্তমান নিয়ে - সেই
বায়বীয় কল্পনা জাগাতে
চেষ্টা করবেননা নয়তো
আমৃত্যু রয়ে যাবেন
মাঝির মতো পাগলাটে -
যেমনটা আমি নিজেই তার
স্বপ্ন স্তূপাকারে
পরিণত হয়েছি, আমার
বারোটা বেজে গেছে।