কথাগুলো সেই সময়ের যখন
শঙ্কর প্রসাদের সানাই
ছাড়া বিয়ের আসর জমত না।
মুসলমান বাড়ি হোক কিংবা
হিন্দু বাড়ি, সানাই
বাজাতে দূর দূর থেকে
ডাক পড়ত শঙ্কর
প্রসাদের। আভিজাত্যের
প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল
শঙ্কর প্রসাদের সানাই,
কারণ শঙ্কর কোন আসরে
সানাই বাজাবে আর কোথায়
বাজাবেনা সম্পূর্ণটাই
নির্ভর করত তার মর্জির
ওপর, আগে থেকে কেউ বলতে
পারতোনা। বিয়ের আসরে
তার শুদ্ধ সাড়ং, গানের
আসরে লক্ষ্মী কল্যাণ আর
চাঁদনী কেদার যে
শোনেনি, তার জীবন বৃথা,
এমনটাই বলে আশেপাশের
দশগ্রামের ছেলে
বুড়োরা। বয়স যখন তাকে
বার্ধ্যকের কাছে নিয়ে
এলো তখন বিশেষ কিছু
জায়গায় চিন্তাশীলদের
কানাকানি শুরু হয়ে গেল।
তাদের মধ্যে অন্যতম
উস্তাদ ফয়েজ খাঁ সাহেব।
শোনা যায়, ফয়েজ আর
শঙ্করের বয়সের ফারাক
বেশি না হলেও তাদের
সঙ্গীতে বিস্তর ফারাক
রয়েছে। এত বছরে অনেক
চেষ্টা করেও ফয়েজ
শঙ্করের সাথে পেরে
ওঠেনি। শঙ্করের সাধনায়
এমন কিছু ছিল, যা তার
সুরকে অন্য সব থেকে
আলাদা করেছে সবসময়।
ফয়েজের ইচ্ছা সেই সুরের
সন্ধান জানা, সেই
সাধনার উৎস খোঁজা।
শঙ্করের সাথে তার বয়সেও
ভাটা পড়েছে। কিন্তু আশা
হয়ে জেগে আছে ছেলে ফয়সল
খাঁ। টগবগে যুবক ফয়সল
সানাই হাতে নিয়েছে
শৈশবেই। এই বয়সেই
নিশ্বাসের ওপর তার
নিয়ন্ত্রণ দেখলে অবাক
হতে হয়। গ্রামের কাবাডি
খেলার
প্রতিযোগিতাগুলোতে
ফয়সলকে দলে নেয়ার জন্য
কাড়াকাড়ি পড়ে যায়
ছেলেদের মধ্যে, তার
দমের জোরের কারনে। ফয়েজ
খাঁ যতদূর পেরেছেন
তালিম দিয়েছেন। তার বড়
ইচ্ছা, শঙ্করের গোপন
সাধনার বীজ যদি কোনভাবে
ছেলের মধ্যে রোপন করতে
পারতেন! একদিন ছেলেকে
ডেকে তিনি তার ইচ্ছার
কথা বললেন। শঙ্করের
ছেলে নেই। আছে কেবল এক
মেয়ে। স্ত্রী গত হয়েছে
বহু আগে, মেয়েটা তাই
শঙ্করের চোখের মনি।
কিন্তু তাতে কি!
উত্তরাধিকার তো আর মেয়ে
দিয়ে রক্ষা হয়না। ফয়সল
যদি কোনভাবে শঙ্করের মন
জয় করে তার শিষ্য হতে
পারে, তবে ভবিষ্যতে
ফয়সলের সানাই শঙ্করের
নামকে ছাপিয়ে যাবে।
ফয়সলের নিজের প্রতিভা
তো রয়েছেই, সাথে
শঙ্করের শিক্ষা মিলে এক
অদ্ভুত ধারার সৃষ্টি
হবে যা বহন করবে
খাঁয়েরা। ধীরে ধীরে
সবাই শঙ্করকে ভুলে যাবে
আর সানাই সাধনার ধারক
হিসেবে খাঁয়েদের
সম্ভ্রম জেগে উঠবে।
ফয়সল বাবার সব কথাই
শুনল। শঙ্করের প্রতি
তারও দুর্বলতা রয়েছে।
তার বাবার আর শঙ্করের,
দুজনেরই সানাই শুনেছে
সে। নিঃসন্দেহে শঙ্কর
সাধনায় এগিয়ে আছে।
কিন্তু শঙ্কর কাউকে
সুরের শিক্ষা দেয়না
বলেই জানা ছিল তার। সে
কথা বাবাকে বললে ফয়েজ
খাঁ জানায় যে, কঠিন কাজে
বাধা থাকেই। যেভাবেই
হোক তাকে শঙ্করের মন জয়
করতে হবে। সেক্ষেত্রে
শঙ্করের মেয়েটাকে যদি
হাত করা যায়, তাহলে কাজ
অনেক সহজ হয়ে যাবে।
মেয়ে ছাড়া শঙ্করের আর
কেউ নেই। ফয়সল সবটা
শুনে রাজি হয়, যতটা না
বাবার জন্য তার চেয়েও
বেশি নিজের তাগিদে।
ছোটবেলা থেকে সানাই যে
ছেলের হাতে তার শঙ্করের
মত গুরুর দরকার বৈকি।
পরের সপ্তাহে ভালো একটা
দিন দেখে বেলা করে ফয়সল
বেড়িয়ে পড়ে। আরও তিনটি
গ্রাম পেরিয়ে তবেই
শঙ্কর প্রসাদের গ্রামে
যাওয়া যায়। মেঠো পথ ধরে
যেতে যেতে ফয়সল ভেবে
নেয় প্রথমে শঙ্কর
প্রসাদের সাথেই কথা
বলবে, তারপর যদি কাজ না
হয় তবে নাহয় তার মেয়ের
শরণাপন্ন হওয়া যাবে।
মেয়ে তো আর পালিয়ে
যাচ্ছেনা, কিন্তু
প্রথমেই মেয়ের আঁচল ধরা
ঠিক পছন্দ হচ্ছিলনা
তার। শঙ্করের বাড়িতে
যখন সে গিয়ে পৌঁছয় তখন
সন্ধ্যে হয়ে এসেছে।
বাড়ির উঠোনে পা দিয়েই
ফয়সল দাঁড়িয়ে পড়ল।
শ্যামরঙা একটি মেয়েকে
দেখা গেল তুলসীতলায়
প্রদীপ দিয়ে দুহাত জোড়
করে কপালে ঠেকিয়ে
প্রণাম করছে। বাড়ির
ভেতর থেকে ভেসে আসছে এক
অপার্থিব সুর। হালকা
বাতাসে কোথা থেকে যেন
ভেসে আসছে কামিনী ফুলের
সুবাস। হঠাৎ তাকিয়ে
ফয়সলকে দেখে মেয়েটি
কিছুক্ষণ তাকিয়েই
থাকে। তারপর কিছুটা
এগিয়ে এসে শান্ত গলায়,
"বাবামশাই রেয়াজ
করছেন। পরে আসুন, "
বলেই ঘুরে দাঁড়ায়।
মেয়েটির গলার স্বর শুনে
ফয়সল মুগ্ধ হয়ে যায়।
তানপুরার তারে বোনা কোন
নিখুঁত রাগিনী যেন।
মেয়েটিকে যেতে দেখে বলে
ওঠে,
- বড্ড দূর থেকে এসেছি।
যাবার জায়গা নেই।
ফিরে তাকিয়ে মেয়েটি পা
থেকে মাথা অব্দি দেখে
নিয়ে বলে,
- তবে আসুন। বসবার ঘরে
এসে বসুন। কিসের বায়না?
বিয়ে?
- নাহ।
- তবে? আসর?
- নাহ।
- তবে কেন এসেছেন?
বসবার ঘরে বসতে বসতে
ফয়সল ঘরের মধ্যটা দেখে
নেয়। বেশ পরিপাটি করে
সাজানো। বেতের কয়েকটি
আরামকেদারা, একটি
তামাকদান। ভেতরের কোন
এক ঘর থেকে তখনো ভেসে
আসছে সুর। ফয়সলের সামনে
তখনো দাঁড়িয়ে মেয়েটি।
আশ্চর্য শান্ত মুখ, বড়
বড় চোখ। এমন মুখ এই
শান্তি শান্তি
পরিবেশের সাথে বেশ
মানিয়ে যায়। ফয়সলের
বাড়িতে অনেক লোকজন,
আত্মীয়-স্বজন, আশ্রিত।
এই বাড়িতে তেমন লোক নেই
বোঝাই যাচ্ছে। ফয়সল
জিজ্ঞেস করে,
- বাড়িতে কে কে থাকেন?
- আমি আর বাবামশাই।
কিন্তু আপনি তো বললেন
না কেন এসেছেন?
- আমি... আমি শঙ্করজির
কাছে তালিম নিতে এসেছি।
- বাবা আপনাকে ডেকেছেন?
- নাহ।
- বাবা কাউকে তালিম
দেননা, আপনি আসুন।
- আমার যাবার জায়গা
নেই।
- কেন? জায়গা থাকবেনা
কেন?
- আমি আপনার বাবাকে গুরু
মেনেই ছোটবেলা থেকে
সানাই হাতে নিয়েছি।
আমার বাবা ওস্তাদ ফয়েজ
খাঁ সেটা মেনে নেননি।
বাবা বলেছেন, শঙ্কর
প্রসাদকে গুরু মানলে
যেন তার বাড়ি আমি ত্যাগ
করি। তাই, আপনার বাবাকে
গুরু মেনে আমি বাড়ি
থেকে বেরিয়ে এসেছি।
- আপনি ওস্তাদ ফয়েজ খাঁ
সাহেবের ছেলে?
- জ্বি।
- আপনার বাবা আর আমার
বাবামশাইয়ের সানাইয়ের
রেশারেশি তো বহুকাল
ধরে। বাবামশাই বলেন,
আপনার বাবার সুরে
সাধনার চেয়ে অহং বেশি
থাকে।
- সে আমি জানি।
- আপনি সানাই বাজান?
- হ্যা।
- তবে প্রমাণ দিন আপনি
খাঁ সাহেবের ছেলে। বলুন
তো, বাবামশাই কোন রাগ
বাজাচ্ছেন?
- শ্যাম কল্যাণ।
মেয়েটির ঠোঁটের কোণে
একটা হাসি ফুটে উঠতে
গিয়েও থেমে গেল। শান্ত
গলাতেই সে বলল,
- বাবামশাই আপনাকে
গ্রহন করবেন না।
- তা জানি। তবে আমার
ধারণা, আপনি বললেই উনি
আমাকে গ্রহণ করবেন।
- আর আমি কেন বলব?
- আমি আমার জীবনের
অনেকটা অংশ ওস্তাদ ফয়েজ
খাঁ সাহেবের ছেলে হয়ে
কাটিয়েছি। বাকি জীবনটা
ওস্তাদ শঙ্কর প্রসাদের
শিষ্যের পরিচয়ে বাঁচতে
চাই। আপনি আমাকে এতটুকু
সাহায্য করবেন না?
ভেতরের ঘরের সুর বন্ধ
হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে।
মেয়েটি উঠে দাঁড়ায়।
তারপর ঘুরে দরজা অব্দি
গিয়ে বলে,
- বসুন। বাবামশাইকে
বলছি।
- কিছু মনে করবেন না...
আপনার নামটা?
- দেবযানী!
পরদিন থেকেই ফয়সলের
সুরশিক্ষা শুরু হয়ে
গেল। দেবযানী তার
বাবাকে কি বুঝিয়েছে
জানা যায়নি, তবে শঙ্কর
প্রসাদ ফয়সলকে নিজের
ছেলের মতই আপন করে
নিলেন। ভোর থেকে রেয়াজ
শুরু হতে লাগল,
পাশাপাশি চলতে লাগল
শঙ্করের বিভিন্ন
জায়গায় সানাই বাজাতে
গিয়ে দেখা শোনা বিভিন্ন
ঘটনা। ফয়সল মন দিয়ে
শুনত, শঙ্করও শ্রোতা
পেয়ে মন খুলে বলত।
শঙ্কর শাকাহারী হলেও
ফয়সলের পাতে দুধ ডিম
পড়তে লাগল নিয়মিত।
সানাইয়ের সুরের
পাশাপাশি আরও কিছু সুর
খেলা করতে লাগল আঙিনায়।
সকাল সকাল দেখা যেত
দেবযানীকে পূজোর ফুল
তুলে দিচ্ছে ফয়সল।
কখনোবা পুকুরঘাটে বাসন
মাজতে দেখা যেত
দেবযানীকে, আর ফয়সলকে
দেখা যেত ঘাটের উপরে
বসে নানারকম অদ্ভুত কথা
বলে তাকে হাসাতে। কখনো
চা, কখনো শরবত নিয়ে সময়ে
অসময়ে দেবযানী চলে যেত
ফয়সলের কক্ষে। রেয়াজের
সময় দুই পুরুষের সুরের
খেলা উপভোগ করত, কখনো
তবলায় তাল দিত। সময়
গড়িয়ে যেতে লাগল, ফয়সল
যেন ধীরে ধীরে ঘরের লোক
হয়ে উঠতে লাগল। তার
প্রতিভা আর শিখন
ক্ষমতায় শঙ্কর প্রসাদ
মুগ্ধ। সে যেন দমের
কারুকার্যে শঙ্কর
প্রসাদকেই টেক্কা দিতে
লাগল। আজকাল বিকেলের
সময়টা শঙ্কর প্রসাদ
একটু ঘুমিয়ে নেন। বয়স
বাড়ছে, বাড়ছে
ক্লান্তিও। বিকেলের এই
সময়টা দুটো প্রণয়ী
প্রাণের স্পন্দন
কাছাকাছি আসতে থাকে
প্রতিদিন। একদিন
মধুবন্তীর শেষে দুটি
ঠোঁটও স্পর্শ পেয়ে যায়
একে অন্যের।
ফয়সলের সুরের শিক্ষা
শেষ হলো। শঙ্করের কাছে
ডাক এলে তার স্থানে
কয়েক জায়গায় সে সানাই
বাজিয়েও এলো। দিকে দিকে
খবর ছড়িয়ে গেলো শঙ্কর
প্রসাদের যোগ্য
উত্তরসূরী পাওয়া গেছে।
ফয়সল মাঝে একদিন গিয়ে
ফয়েজ খাঁর দোয়া নিয়ে
এলো। ফয়েজ খাঁর বুকটা
ভরে গিয়েছিল ফয়সলকে
দেখে। উস্তাদ ফয়েজ খাঁ
সাহেবের ছেলে উস্তাদ
ফয়সল খাঁ সাহেব। কয়েক
বছর গেলে শুধু এই
নামগুলোই থাকবে,
শঙ্করের নাম হারিয়ে
যাবে চিরতরে। শুনেছে
শঙ্করের শরীরও পড়ে
এসেছে। যদিও তার শরীরও
ভালো নেই খুব একটা।
কিন্তু তাতে কি! সে
উত্তরসূরী রেখে যাচ্ছে,
শঙ্করের সুরের অভাব
ভুলে যাবে সবাই। ভেবেই
ভালো লাগছিল তার। সে
ফয়সলকে বলে এবার বাড়ি
ফিরে আসতে। ফয়সলও মেনে
নেয় সবটা। ও বাড়ি গিয়ে
শঙ্করের কাছ থেকে বিদায়
নিয়ে দেবযানীর কাছে যায়
সে। দেবযানী ভরাট গলায়
জিজ্ঞেস করে,
- কবে আসবেন আবার?
- মাঝেমাঝে আসব।
গুরুজিকে দেখে যাব।
- আর আমি?
ফয়সল মাটির দিকে তাকিয়ে
থাকে। তারপর আস্তে
আস্তে বলে,
- আমাদের এক হওয়া সম্ভব
নয়। সব ভুলে যাওয়াই
ভালো। তুমি আমার গুরুর
কন্যা, সম্পর্কে আমার
বোনের মত। তাও আমি
ক্ষমা চাইছি।
দেবযানীর চোখেমুখে
বিস্ময় ফুটে ওঠে
প্রথমে, তারপর আগুন
জ্বলে ওঠে...
- কি?!!!
ফয়সল আর তার মুখের দিকে
তাকায়না। একনাগাড়ে বলে
যায়,
- আমাদের ধর্ম আলাদা,
তাছাড়া আমার বাবা তোমার
বাবাকে পছন্দ করেনা। আর
এখন আমার যে অবস্থান
তৈরি হবে, সেখানে আমি
শঙ্কর প্রসাদের কোন
চিহ্ন নিয়ে চলতে
চাইনা।
পুরো জগত সংসার নিয়ে
যেন দেবযানীর মাথা ঘুরে
ওঠে। অচেতন হয়ে সে পড়ে
যায় শিশিরে আধভেজা
মাটির ওপর। ফয়সল একনজর
দেবযানীর পরে থাকা
শরীরের দিকে তাকিয়ে সেই
দৃশ্য পেছনে ফেলে দ্রুত
হাটতে থাকে। একপর্যায়ে
দৌড়াতে থাকে, দৌড়ে
পেছনে ফেলতে চায় শঙ্কর
প্রসাদের বিশ্বাস,
স্নেহ আর দেবযানীর
ভালোবাসা। এখন আর এই
জিনিসগুলোর প্রয়োজন
নেই তার, প্রয়োজনের পথ
এখন শুধু সামনের দিকে
যাবে।
( মহাভারতোক্ত কচ এবং
দেবযানীর আখ্যানের
ছায়া অবলম্বনে।)