আজ পূর্ণিমা। মাথার ওপর
ঝুলে থাকা গোলগাল
চাঁদটার উপচে পড়া
জোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে
চরাচর। সেই আলোয়
‘স্বপ্নকথা’ নামের এই
অলৌকিক সৌন্দর্যের
রিসোর্টটার চৌকো উঠানে
একা বসে আমি পাহাড়ি
মোহময়তায় আচ্ছন্ন হয়ে
যেতে থাকি। প্রকৃতি
সত্যিই এক অদ্ভুত
জিনিস, কত ক্ষত সারিয়ে
তোলে আপনা থেকেই!
এই পূর্ণিমার রাতটা
আমরা দুজনে এখানে কাটাব
ঠিক করেছিলাম। সেটা
করতে গিয়ে দুজনের
অফিসের হাজারটা ঝক্কি
সামলে, আমার দুটো কাজের
ডেডলাইন পিছিয়ে দিয়ে
অবশেষে গতকাল থেকে ছুটি
নেয়া সম্ভব হয়েছে। পরশু
অফিস শেষে রাতের বাস
ধরে কাল সকাল দশটার
দিকে আমরা স্বপ্নকথায়
পৌঁছেছি।
রিসোর্টটা আসলেই খুব
চমৎকার। আমাদের মতো
দম্পতিদের ছুটি
কাটানোর জন্য একেবারে
আদর্শ জায়গা। এমন
সুন্দর পাহাড়ি পরিবেশে
চমৎকার আতিথেয়তা পাবার
জন্য বেতনের কটা টাকা
বিসর্জন দেয়াটা তেমন
গায়ে লাগে না। আর
তাছাড়া, এই ছুটিটার পর
আমাদের আর একসাথে কোথাও
বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ
নাও হতে পারে। আর হয়ত
কোনোদিন আমাদের কোথাও
বেড়াতে যাবার জন্য বেতন
থেকে আলাদা করে
টাকাপয়সা জমাতে হবে না।
রিসোর্টের দারুণ মনোরম
প্রাঙ্গনে একলা
পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে
দেখতে আমি তাই
খরচাপাতির হিসাব নিয়ে
মাথা ঘামাতে চাই না।
বরং আমি ভাবতে চাই সেই
শুরু থেকে, যখন থেকে
রুমঝুম নামের একটি মেয়ে
ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছিল
আমার অস্থি, মজ্জ্বায়,
অস্তিত্বে।
ঘণ্টাখানেক আগে খাওয়া
সুস্বাদু রাতের
খাবারটা একটা ছোট্ট
ঢেঁকুর হয়ে ফিরে আসে।
সেই ঢেঁকুর চুপচাপ গিলে
ফেলে আমি আবার ফিরে যাই
আমার ভাবনার জগতে।
রুমঝুম এখন আমাদের তিন
রাতের জন্য ভাড়া নেয়া
ঘরটায় কী করছে কে জানে।
হয়তো মাকে ফোন করে
তোর্ষার খোঁজখবর
নিচ্ছে। তোর্ষা
নির্ঝরিনী আমাদের তিন
বছরের মেয়ে। ওকে রেখে
এসেছি মা বাবার কাছে।
রুমঝুম অবশ্য প্রথমটায়
ওকে রেখে আসতে রাজি
হচ্ছিল না কিছুতেই।
কিন্তু আমাদের
সম্পর্কটা যেখানে এসে
পৌঁছেছে, সেখান থেকে
একটা ‘ফ্যামিলি ট্রিপ’
দেয়ার চাইতে শুধু
আমাদের দুজনের কিছু সময়
একান্ত কাটানো খুব
জরুরি ছিল। আমি তাই
অনেক কষ্টে রুমঝুমকে
রাজি করিয়েছি তোর্ষাকে
রেখে আসতে।
ঢাকায় থাকতে এ নিযে মন
খারাপ করলেও এখানে আসার
পর সত্যিই রুমঝুম খুব
খুশি হয়েছে। হয়তো
তোর্ষা কাছে নেই বলেই
অনেক দিন পর ও সংসার আর
সন্তানের চিন্তা মাথা
থেকে ঝেড়ে ফেলতে
পেরেছে। অনেক দিন পর
আবার কিছুটা হলেও সেই
আগের মতো আচরণ করছে।
শেষ ফেব্রুয়ারির
পূর্ণিমা রাতে পাহাড়ি
খোলা হাওয়া গায়ে মাখাতে
মাখাতে আমি আমাদের
ঘরটার দিকে তাকাই। তিন
তলার ঘরটার ভেতরের আলো
ভারি পর্দার ঠেলে বেশ
হালকা হয়ে বাইরে ছড়িয়ে
পড়েছে। ওই ঘরে আছে আমার
রুমঝুম- ‘আমার রুমঝুম’
কথাটাই কতদিন পরে মনে
এলো! ইশ! রুমঝুম কত দিন
আমার নেই আর! অথচ এইসব
দুঃস্বপ্নের মতো দিন
রাত শুরু হবার আগে ও
শুধু আমারই ছিল।
রুমঝুম আর কদিন পর
থেকেই আর আমার থাকবে না
হয়ত- সে কথা মনে করে
রিসোর্টের খোলা উঠানের
ঝিরিঝিরি হাওয়া আর
পূর্ণিমার গোল চাঁদের
মায়াবি আলোতে আমার খুব
বিষন্ন লাগে। আমাদের
ভালোবাসার বিয়ে। বিয়ের
আগে রুমঝুমকে কিছুতেই
বউ হিসাবে মেনে নিতে
চায়নি আমার পরিবার।
বাবা, মা আর বড়দাকে
বোঝাতে অনেক কষ্ট করেছি
আমি। অবশেষে বছর পাঁচেক
আগে আমরা বিয়েও করেছি।
বিয়ের পর অবশ্য বাড়ির
সবাই ওকে আপন করে
নিয়েছিল, রুমঝুম আপন
হয়ে যাবার মতোই মানুষ।
সত্যি কথা বলতে কী, এত
ভালো মেয়ে আমি আমার
জীবনে আর একটাও দেখিনি।
কিন্তু তারপরও রূপকথার
গল্পের মতো আমাদের
অতঃপর সুখে শান্তিতে
বসবাস করতে থাকা হলো না
কিছুতেই।
রুমঝুম যদি সেই আগের
মতোই থাকত তাহলে হয়তো
আমাদের এই নির্জনবাস
দরকার হতো না এমন করে।
আমরা দুজনে আলাদা হয়ে
যাওয়ার কথা ভাবতেও
পারতাম না আগে কোনোদিন।
অথচ আজ, কেবল একসাথে
থাকবার শেষ চেষ্টা
হিসাবে আমরা বেড়াতে
এসেছি এই পাহাড়ের কাছে!
কে জানে, আমাদের প্রায়
ভেঙ্গে যাওয়া সংসারটা
যদি আবার জোড়া লাগে!
অথবা যদি আমরা সত্যিই
আলাদা হয়ে যাই, তাহলেও
যেন অন্তত দু তিনটা দিন
থাকে আমাদের নিজেদের
মতো- সে কারণেই আসা।
রুমঝুম ছিল হাসিখুশি
উচ্ছ্বল আর ভীষণ
প্রাণবন্ত মানুষ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনে
ওর ওই প্রাঞ্জলতাই
আমাকে টেনেছিল অমোঘ
টানে। অথচ আমার অনেক
দিনের পরিচিত, হাসিখুশি
সেই মেয়েটা কেমন বদলে
যেতে থাকল বিয়ের
কিছুদিন পর থেকে-
স্পষ্ট করে বলতে গেলে
তোর্ষা পেটে আসার পর
থেকে। আজ পেট ব্যথা, কাল
হাঁটতে পারি না, খেতে
পারি না ইত্যাদির সাথে
প্রায়ই মন খারাপটাও
সঙ্গী হয়ে উঠতে লাগল
ওর। যে রুমঝুম আগে
সারাদিন ঝলমলিয়ে হাসত,
সেই রুমঝুমের মুখের
হাসি দেখতে পাওয়া
অমাবশ্যায় চাঁদ
খুঁজবার মতো ব্যাপার
হয়ে দাঁড়াল। আমি কত
চেষ্টা করতাম ওকে খুশি
রাখতে! অথচ রুমঝুম যেন
ওই সময় আমাকেও সহ্য
করতে পারত না!
তোর্ষা হবার পর দিনে
দিনে ও আরও কেমন অবোধ্য
হয়ে যেতে থাকল আমার
কাছে। আমার ধারণা ছিল
বাচ্চা হলে মায়েরা
সারাদিন বাচ্চা নিয়ে
পড়ে থাকে আর তার
সবকিছুতে দারুণ খুশি
হয়। কিন্তু কী আজব!
তোর্ষা জন্মাবার
তিনদিন পর ভীষণ মুখ
কালো করে রুমঝুম আমাকে
প্রশ্ন করে বসল- কৌশিক,
সবাই শুধু বাচ্চার খবর
নিচ্ছে। তুমিও। কই
তুমিও তো একবার জিজ্ঞেস
করলে না আমি কেমন আছি?
আমিও তো একটা মানুষ
কৌশিক! আমার ভালো থাকা
না থাকায় কারও কিছু আসে
যায় না আজকাল?
মন খারাপের বদলে সেই
আমার চমকে ওঠার শুরু। এ
কোন রুমঝুম? এই রুমঝুমই
কি প্রেগন্যান্ট হবার
খবরে বাচ্চা মানুষের
মতো খুশি হয়ে উঠেছিল? এই
একই মানুষ কি অনেক অনেক
নাম বাতিল করে দিয়ে
আমাদের অনাগত সন্তানের
নাম তোর্ষা নির্ঝরিনী
রেখেছিল? ধাক্কাটা একটু
সামলে নিয়ে আমি ওকে
জিজ্ঞেস করেছিলাম-
তোমার শরীর খারাপ লাগছে
রুমঝুম? সে কথার উত্তরে
হাসপাতালের ছোট বেডটায়
রুমঝুম উল্টোদিকে ফিরে
শুয়েছিল আর আমি বুঝে
গিয়েছিলাম ও কোথাও একটা
খুব বদলে গেছে, খুব
অচেনা হয়ে গেছে।
তোর্ষা যত বড় হতে থাকল,
আমাদের মাঝখানের
দেয়ালটা ততই পুরু হতে
হতে হতে হতে পুরো
দুর্ভেদ্য হয়ে গেল। সে
দেয়ালের এপাশ থেকে
ওপাশে রুমঝুমকে আমি
দেখতে পাই না, শুনতে পাই
না, বুঝতে পারি না আর।
আমাদের বাচ্চাটা যখন
মাত্র কয়েক মাসের,
রুমঝুম যখন
ম্যাটার্নিটি লিভে ছিল-
প্রায়ই আমার বুকে নাক
ঘষতে ঘষতে বলত, কৌশিক,
আজকাল আমায় আদর করতে
চাও না কেন তুমি? কেন?
কেন? কেন?
ওর সেই কেন প্রশ্নের
উত্তরে আমি সভয়ে আরও
সরে যেতাম ওর থেকে। ও
ছুটিতে থাকলেও আমি ন’টা
পাঁচটা অফিসের ধকল শেষে
সদ্য মা হওয়া রুমঝুমের
শরীরের মা মা গন্ধ নিতে
পারতাম না। তার ওপর ছিল
ওর ঘ্যানঘেনে
কথাবার্তা, নিজের জন্য
একটু সময় না পাওয়ার
আক্ষেপ! ও কেমন অসুস্থ
হয়ে যাচ্ছিল
মানসিকভাবে। আমি মানতে
পারতাম না সেই
রুমঝুমকে। ওর তলপেটের
সেলাইয়ের ক্ষত আরও ভালো
করে সারা উচিত ইত্যাদি
হাবিজাবি কারণ দেখিয়ে
আমি ছুটে পালাতাম।
নিতান্তই যেদিন নিজের
ভেতর থেকে আসা
চাহিদাটাকে আর সরিয়ে
রাখতে পারতাম না, সেদিন
রুমঝুমের মা মা গন্ধের
শরীরটায় শরীর ডোবাতে
যেতাম। প্রায় সময়ই বুনো
সঙ্গম শেষে ও আমাকে বলত-
তুমি আর আমাকে ভালবাসো
না, কৌশিক!
অথচ আমি সত্যি
ভালোবাসতাম ওকে।
ভালোবাসতাম বলেই
চাইতাম ও সেরে উঠুক, ওর
মনটা সেরে উঠুক
পুরোপুরি। সেই রুমঝুম
কী করে যেন একটু একটু
করে সরে গেল আমার কাছ
থেকে। আজকাল আমি আদর
করতে চাইলেও ও আসতে চায়
না কিছুতেই। প্রায়
সময়েই কী সব অজুহাতে
আমার কাছ থেকে ছুটে
পালায়। আজকাল সত্যিই
শরীরের সম্পর্ক বলতে
তেমন কিছু নেই আমাদের
মধ্যে। মাঝেমাঝে আমার
পাগল হয়ে যেতে ইচ্ছে
করে। মাঝেমাঝে সত্যি
ভীষণ খারাপ হয়ে যেতে
ইচ্ছে করে। এসব আর কত
সহ্য করা যায়? আর শুধু কি
শরীর? ওর সাথে আমার মনের
সম্পর্কই বা কতটুকু আছে
আর? কতকাল হয়ে গেছে আমরা
একসাথে একটা সিনেমা কী
নাটক নিদেনপক্ষে একটা
শর্টফিল্মও দেখতে পারি
না! ওকে ডাকলে বিরক্ত
হয়ে উত্তর দেয় যে
শরীরের অনেক ধকল গেছে।
কোনো কোনো দিন খুব
আগ্রহ নিয়ে ল্যাপটপে
সিনেমা চালু করলেও একটু
পর ঘুমিয়ে কাদা হয়ে পড়ে!
আমাদের দুজনের জগত বলে
আজকাল কি কিছু অবশিষ্ট
আছে? এ প্রশ্নের উত্তর
জানা নেই আমার।
রুমঝুমের এই
পরিবর্তনের কোনো
যৌক্তিক কারণ আমি আজও
খুঁজে পাই না। ছয় মাসের
ছুটি শেষে ও আবার যখন
অফিসে ফিরে গেল, তখন
দিনে দিনে আরও
দুর্বোধ্য, আরও অচেনা
হয়ে যেতে থাকল ও।
বাচ্চা, সংসার, চাকুরি-
সব নাকি একসাথে সামলিয়ে
ও ক্লান্ত! অথচ ততদিনে
তোর্ষা মাকে চিনতে শিখে
গেছে, সারাদিন পর মাকে
পেলে কাছছাড়া করতে চায়
না। রুমঝুম তা নিয়েও
অসন্তুষ্ট ছিল
মারাত্মক! আশ্চর্য! ওকে
তো আমার মা নিজের মেয়ের
মতো যত্নে রাখে, বাড়ির
কত কাজ করে তবু এত
অভিযোগ অনুযোগ কেন পুষে
রাখে মেয়েটা?
আগের রুমঝুমের সাথে
নতুন রুমঝুমের এত
পার্থক্য আমি আর মানতে
পারছিলাম না। আমাদের
সংসারে টুকিটাকি
বিষয়ের সাথে সাথে ঝগড়ার
একটা বড় কারণ হয়ে উঠল
তোর্ষা। হুম, মাঝেমাঝেই
সে ঝগড়া আমার বুড়ো
বাবা-মার সামনেও।
তোর্ষাকে একটা চকলেট
খেতে দিলেও ও চিৎকার
করে ওঠে- কী করলে কৌশিক?
অত ছোট বাচ্চাকে তুমি
চকলেট দিলে?
আশ্চর্য! নিজের
বাচ্চাকে একটা চকলেট
খাওয়ানোর অধিকার
পর্যন্ত আমার নেই?
মেয়ের প্রতি তাহলে শুধু
ওরই অধিকার? তবু
রুমঝুমের অনেক কথা মেনে
নিচ্ছিলাম আমি। কিন্তু
যেদিন মার সামনে ও বলে
ফেলল- এমন করতে থাকলে
আমার সাথে সংসার করা
নাকি ওর পক্ষে আর সম্ভব
হবে না, সেদিন আমার
মাথায় রক্ত উঠে গেল
সত্যিই। কী স্পর্ধা
মেয়ের! পাঁচ বছর প্রেম
করে বিয়ে করা সংসারেরও
পাঁচ বছর হয়ে গেছে,
আমাকে এভাবে অপমান করে
কী করে? মার সামনে
বলেছিল বলেই বোধহয়
অপমানটা আরও বেশি করে
বিঁধেছিল আমাকে। মাও
আমাকে পরে বলেছিল-
রুমঝুম তোর সাথে এত
খারাপ ব্যবহার করে কেন,
বাবু?
মার প্রশ্নের কোনো
উত্তর দিতে পারিনি
সেদিন। তবে সেদিন থেকেই
মনে মনে ঠিক করে
ফেলেছিলাম ওর সাথে আর
সম্পর্ক নয়। ওই মেয়ে
আমার সমস্ত সুখ নষ্ট
করে দিচ্ছে একটু একটু
করে। সারাক্ষণ একজন
ক্লান্ত শ্রান্ত
বিরক্ত রাগি মানুষের
সাথে সংসার করা যায় না।
ও মনে হয় মানসিক রোগী
হয়ে যাচ্ছিল দিন দিন।
আমি ভেবেছিলাম আমাদের
আলাদা হয়ে যাওয়াই
শ্রেয়। রুমঝুমকে না
জানালেও ডিভোর্সের
ব্যাপারে আমি মনস্থির
করেই ফেলেছি তারপর।
কিন্তু সেই আলাদা হয়ে
যাওয়ার আগে ওর সাথে খুব
একান্তে কয়েকটা দিন
কাটাতে মন চাইল ভীষণ।
যে রুমঝুমের সাথে আমার
দশ বছরের সম্পর্ক, কেবল
তার সাথে তিন চারটা দিন
পার করতে মন চাইল। ওর
প্রতি একরাশ অভিমান আর
অপমান নিয়েও তাই
রুমঝুমকে বেড়াতে আসার
প্রস্তাবটা দিলাম আমি।
নিমরাজি থেকে এক সময়
রাজিও হয়ে গেল ও।
একটা সিগারেট খেতে
ইচ্ছে করছে। আমি পকেট
থেকে সিগারেটের
প্যাকেট বের করে লাইটার
দিয়ে আগুন জ্বাললাম।
নিজের কাছেই সে আলো
জোনাকির আলোর মতো মনে
হয়। আমার মোবাইলটা বের
করে সময় দেখি। দশটা
বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি
আছে এখনও। সপ্তাহের মাঝ
বরাবর বলে রিসোর্টে
তেমন অতিথি নেই। বাইরে
আমি একাই বসে আছি। এই
বড়সড় উঠানের এখানে
সেখানে বিভিন্ন শেডের
আলো আর পূর্ণিমার চাঁদ
আমাকে সঙ্গ দিচ্ছে তখন
থেকে। কাছেই কোথাও
একটানা সুরে ঝিঁঝিঁ
ডেকে যাচ্ছে। পাহাড়ি
প্রকৃতির একটা আলাদা
শব্দ আছে মনে হয়। সেই
শব্দ আমাকে বুঁদ করে
রাখে।
প্রায় এক ঘণ্টা ধরে আমি
রুমে নেই, এই পুরো সময়ে
রুমঝুম একবারও কল করেনি
আমাকে, একটা মেসেজও
দেয়নি। আগে হলে এটা
কল্পনাও করা যেত না।
সিগারেটটা শেষ করে আমি
এবার উঠে পড়ি। রুমে
যাব।
হ্যাঁ মা, না না ওকে
কান্নাকাটি করতে দিবেন
না প্লিজ। আমরা তো
পরশুই ফিরে আসছি। ওর
ঠান্ডার ওষুধটা মনে করে
খাইয়ে দিবেন মা। মাছ না
হয় থাকুক এই দুদিন।
আপনার তো কাঁটা বাছতে
অসুবিধা হয়, দুদিন মাছ
না খেলে কিচ্ছু হবে না
ওর- আমাকে দরজা খুলে
দিয়েও রুমঝুম ফোনে কথা
বলতেই থাকে- না না,
চিন্তা করবেন না। আমরা
ভালোই আছি এখানে। আপনার
জন্য একটা সারপ্রাইজ
আছে, উঁহু, বলা যাবে না
এখন। ঠিক আছে, রাখছি।
ফোনটা শেষ করে রুমঝুম
আমার দিকে তাকায়। ওর
ছোট করে কাটা এলোমেলো
চুলগুলো কপাল জুড়ে পড়ে
আছে, আমি ভালো করে
তাকিয়ে দেখি ওর চোখের
নিচে ছোপ ছোপ কালির
চিহ্ন। আমার মনে হয় কত
দিন এমন করে দেখিনি আমি
ওকে! কত যুগ এমন করে
দেখিনি!
আচ্ছা, আজ পূর্ণিমা
নাকি? জানালা দিয়ে চাঁদ
দেখছিলাম। জানো,
তোর্ষাটা নাকি খুব
কান্নাকাটি করছে
আমাদের না দেখে?
রুমঝুম আমার চোখের দিকে
তাকিয়ে বিষন্ন হেসে
বলে। হয়তো শুধু তোর্ষার
জন্য হলেও আমাদের
একসাথে থাকা উচিত। আমরা
আলাদা হয়ে গেলে
বাচ্চাটার কী হবে! অথচ
এই মুহূর্তে তোর্ষাকে
নিয়ে রুমঝুম কী বলছে সে
কথা আমার কানে যায় না।
আমি ওর মুখটা দেখতে
থাকি। কত শুকিয়ে গেছে ও
এই কয় বছরে! পাশাপাশি
কাছাকাছি থেকেও সেটা
আমি খেয়াল করিনি কত
দিন!
শোনো না, কৌশিক, তোমার
কাছে কি ঘুমের ওষুধ হবে?
আমি অনেকদিন ভালো করে
ঘুমাই না। একটা খেয়ে
ঘুমাতাম।
হঠাৎ রুমঝুমের এই কথায়
আমি চমকে উঠি। এই
মেয়েটার ওপর কী ভয়ঙ্কর
রকমের বিরক্ত আমি! অথচ
এই মুহূর্তে ওর চোখের
নিচে রাতের পর রাত না
ঘুমানো কালি দেখে, ওর
এলোমেলো অবিন্যস্ত চুল
আর পরিশ্রান্ত মুখ দেখে
আমার বুকের ভেতর কষ্ট
হয়। আমাদের একসাথে
কাটানো পুরোটা সময়ের
কথা মনে পড়ে। আমাদের
আনন্দ আর বিষাদে ভরা
একেকটা দিনের একেকটা
রংয়ের কথা মনে পড়ে। মনে
পড়ে আমাদের শোবার ঘরের
দুটো জানালা। তার একটা
খোলা হয় না বহুকাল,
দরকার পড়ে না বলে, ইচ্ছে
হয় না বলে, অন্য
জানালাটাই রোদ আর
বাতাসের প্রয়োজন
ঠিকঠাক মিটিয়ে দিতে
পারে। আমার হঠাৎ
রুমঝুমকে সেই বন্ধ
জানালাটার মতো মনে হয়
এখন। কতদিন ওকে দেখিনি
আমি ঠিক করে! অনেক
অনেকদিন বাদে আমার সেই
জানালাটা খুলে দিতে
ইচ্ছে করে, আর এক ঝলক
খোলা হাওয়ার জন্য।
রুমঝুম, আমার রুমঝুমের
জন্য হঠাৎ খুব মায়া
লাগে বুকের কোথাও। কী
আশ্চর্য! আমি জানি মায়া
বড় খারাপ জিনিস, মায়ায়
পড়লে নিজের কাজ ঠিকমতো
করা হয় না। রুমঝুমের
প্রতি অনেক দিন পর হঠাৎ
আসা সেই মায়া ঠেলে
সরাতে সরাতে আমি আমার
ট্রাভেল ব্যাগের চেইন
খুলতে থাকি। আজকাল
আমারও ভালো ঘুম হয় না,
কয়েকটা ঘুমের ওষুধ তাই
সঙ্গেই থাকে সব সময়।