পরাজিত সময়ঃ ওরা
কারা
বিড়িটা দুই ভাগ করে এক
ভাগ কানে গুঁজে রাখে
কুরান।
ফজলু বিশ্বাসের বাড়ি
ডেইলি মজুরিতে কাজে
নিয়েছিল ওরা। কিন্তু
পুরানের গায়ে জ্বর,
মাথায় ব্যাথা, মুখে
অরুচি।
সাত সকালে পুরানের বউ
এসে জানিয়ে গেছে, ওদ্দা
সে তো যাতি পারবি নানে।
ফজলু কাগারে এড্ডু
বুঝায়ে কইও দিনি।
কাজ শেষে ঘরে ফিরছিল
কুরান। মিলু মিয়ার
হোটেলের ম্যানেজার
সন্তোষ ঘোষ টাকা গুণতে
গুণতে ডাক দেয়, ওরে ও
কুরান ইদিকে আয় ভাডি।
ওই দেখ জানালার
পাল্লাডা ভাঙি পড়িছে।
শীত আসি গেল। কাল পরশু
আসি ঠিক করি দিস দিনি
সব।
এহুনি দিই কাগা ?
কাজ শেষে মজুরির টাকা
থেকে কুরান চল্লিশ টাকা
দেয় সন্তোষকে, কয়ডা
পরোডা ডাল লাবড়া দেও
দিনি কাগা।
ক্যাশ ছেড়ে ভেতরে যায়
সন্তোষ ঘোষ। কিছুক্ষণ
পর একটি গরম প্যাকেট
কুরানকে দিয়ে হাসে,
সকালের তা গরম করি
দিলাম। আর নে টাকা
লাগবিনা । আরো মেলা কাজ
আছে বুঝিছিস । তোর
দোস্তোরে নিয়ি কালকে
চলি আসিস।
কুরান কথা দেয় এখন ও একা
করবে। দোস্তো সেরে
উঠলেই ওর সাথে কাজে
আসবে।
জ্বর হলেই পরোটা খেতে
ভালবাসে পুরান।
কুরানের আনা পরোটা পেয়ে
কতক্ষণ থালাখানা নাকের
কাছে ধরে রাখে। ডালডার
গন্ধ শোঁকে। তারপর খুশি
খুশি হয়ে খুব সাবধানে
আস্তে করে একটুখানি
পরোটা ছিঁড়ে নেয়, খা
কুরান। ইট্টু খা। কি
সুন্দর ঘিরান রে মনা !
মনে কয় একশডা পরোডা
খায়ি ফেলাই।
কুরান খেয়ে হাত ধুয়ে
আসে। পুরান হাত ধোয় না।
শিশুর মত বলে, হাত ধুলি
ঘিরান চলি যাবিনি যে।
দু কানের পাশ থেকে দু
টুকরো সিগারেট বের করে
কুরান, হাত ধুয়ে নে
ভাডি। কালকে বেশি করি
আনি দিবানি। তহন আবার
খাস।
পুরানের চোখ হাসে,
সত্যি ? ক তোর আল্লার কসম
?
জ্বলন্ত সিগারেটের
টুকরোটা পুরানের হাতে
দিয়ে হাসে কুরান, কলাম ত
! তোর ভগমানের কিরে---
তোমার দুধের ধারা
গোর খোদক রব্বানী শেখ
স্ত্রী পরিজাদির কবরের
মাটি ঠিক করে দিচ্ছিল ।
হঠাত ধবলী ছাগী আর তার
শিশুদের সমস্বর
আর্তনাদ শুনে চমকে ওঠে।
নাহ্ দুশ্চিন্তার
তেমন কোন কারণ নেই।
জয়লক্ষ্মী
জুয়েলার্সের কারিগর
নরেন পোদ্দারের বউ
বুকের দুধ নামাতে এসেছে
ওদের বাড়ি। পনের দিনের
ছেলে মায়ের দুধ খেতে
গিয়ে ভিজে নেয়ে হাঁপসে
যাচ্ছে। অদম্য
ঝর্ণাধারার মত ছেলের
নাকে মুখে দুধ ঝরে
পড়ছে। নরেনের বউএর
একেবারে যা তা অবস্থা।
ধবলী বাঁধা আছে উঠোনের
পাশে চালতাগাছের সাথে।
দুধের ভারে ভাল করে
হাঁটতেও পারে না ।
মাত্র সাতদিন আগে চার
চারটা ছানা বিইয়েছে ।
এরই মধ্যে ছানাগুলো
মায়ের ভরভরন্ত দুধে মুখ
দিয়ে ভরপেট দুধ খেয়ে
লাফাচ্ছে, ঝাপাচ্ছে,
ছুটছে। কোন ছানা আবার
পা ভেঙ্গে ঢং দেখাচ্ছে
। সাথে সাথে অন্য
ছানাগুলো তার গায়ের উপর
লাফিয়ে ঝাপিয়ে খেলার
চূড়ান্ত করে ছাড়ছে।
চার মাস আগে তিনদিনের
জ্বরে পরিজাদী মরে
গেছে। পনেরো দিন বয়স
ছিল গ্যাদাটার।
রব্বানী এখন মেয়ের দিকে
ফিরেও তাকায় না। কেবলই
মনে হয় ঘরে ফিরলে ও
দেখতে পাবে উথলে ওঠা
বুকের দুই দুধ চিপে
হালকা রঙা নীলসাদা দুধ
বের করে বাটিতে জমা
করছে পরিজাদী। মুখে
স্মিত হাসি। উদলা বুক।
নিটোল পুষ্ট। স্ফীত
পবিত্র। অসীম
সুন্দরতার মায়া লেপে
আছে দু বুক জুড়ে।
লজ্জাহীন এক ধরণের
তীব্র ভালবাসার কাজল
কালো রঙ ধরেছে দুটি
বৃন্তসহ গোলাকার
পৃথিবীতে।
পরিজাদী দুধ ভর্তি সেই
বাটি রব্বানীর হাতে
দিয়ে সতর্ক গলায় বলত,
শুনিচ্চো গো মিয়া,
নিরিখ করি বড় কলাগাছটার
গুড়ায় দুধটুকুন ঢালি
দিবা । খুব ভাল ভাবি
ঢালবা ! নালি কিন্তুক
আমাগের মাইয়েডার আলাই
বালাই কোনো অকল্যেণ হতি
পারে গো !
রব্বানী কখনো পরিজাদীর
বলা নিয়মের ব্যতিক্রম
করে নাই। মেয়ে ত তারও।
তাই কাঁদি ভর্তি
কলাগুলো পোক্ত হতে
শুরু করেছে এমন একটি মা
কলাগাছ খুঁজে নিয়েছিল।
সে কলাগাছের লাল লাল
ফোলা শরীর। গর্ভ
অবস্থার শেষ দিকে
পরিজাদীর শরীর যেমন
ছেড়ে দিয়েছিল তেমনই
আলুথালু চেহারা
গাছটার। তার গোড়ায় খুব
সাবধানে দুধ ঢেলে খুশি
মনেই সে ফিরে আসত।
তবু অকল্যাণ যা হওয়ার
তাতো হয়েই গেলো।
পনেরো দিনের মেয়ে,
অনুগত স্বামী, স্নেহময়ী
শাশুড়ি, বাবামা এক বোন,
গর্ভবতী ধবলী আর আত্মীয়
স্বজন ঘরবাড়ি রেখে
পরিজাদী হঠাত মরে গেল।
পরিজাদীর কবরে দুর্বা
ঘাস লাগাতে লাগাতে
রব্বানী দেখে তাজজাদী
দুটি ছানা কোলে করে
ঘরের দিকে চলে যাচ্ছে।
ধবলী মুখ তুলে দেখে
এবার নিশ্চিন্তে
রোদ্দুর পোহাচ্ছে
কিন্তু অন্য ছানাগুলো
গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে।
তাজজাদী ছানাগুলোকে
ধমকেধামকে ঘরে ঢুকে
গেল। রব্বানী বোঝে নরেন
পোদ্দারের বউ এবার
ছানাদুটোকে দুধ
খাওয়াবে।
একটা ছানাকে কোলের ভেতর
রেখে হাসি হাসি মুখ করে
তাজজাদী অন্য ছানাটির
দুধ খাওয়া দেখে। মানুষ
মায়ের বুকের দুধ
কিছুতেই খেতে রাজি নয়
ছানাটি। বার বার মুখ
থেকে ঠেলে ফেলে দিচ্ছে
দুধের বৃন্ত। অস্থির
রাগে মাথা দিয়ে আঘাত
করছে নরেনের বৌয়ের ভরা
বুকে। ব্যাথায় কুঁকড়ে
যাচ্ছে বউটি। চোখ ভিজে
গেছে। তবু ঠোঁট কামড়ে
সহ্য করছে। বুকে দুধ
জমে গেলে সেও এক মহা
জ্বালা। এত দুধ তার
ছেলেশিশুটি খেয়ে শেষ
করতে পারছে না। ভয় হয়
দুধের ভারে না ছেলেটার
দম আটকে যায় ! রাত বিরেতে
ঘুমের ঘোরে কোনো অঘটন
না ঘটে যায় ছেলের।
আচমকা এরকম কত
দুর্ঘটনাই ত ঘটে।
দক্ষিণ পূর্ব বাংলার
গ্রামগঞ্জে তাই
সদ্যজাত ছাগল ছানাকে
দিয়ে মানুষ মায়ের বাড়তি
দুধ খাইয়ে দেওয়ার চলন
রয়েছে।
ছাগল ছানাটির মুখ জোর
করে দুধের বৃন্তে গুঁজে
দেওয়ার মুহুর্তেই
কেঁদে ওঠে পরিজাদীর
মেয়ে। নরেনের বউয়ের
বুক কেঁপে ওঠে আর হাত
ফস্কে ছুটে যায় ধবলীর
ছানাটি। শত সহস্র ধারায়
নেমে আসছে দুধের স্রোত
। ধরিত্রীর জোড়ামুখ
থেকে মেঘরঙ নীল মায়া
ঝরে পড়ছে নরেনের বউয়ের
কোলে। সেখানে ফুটে উঠছে
মায়াফুলের আল্পনা। মা
মা সুগন্ধ।
নরেনের বউ দুই হাত
বাড়িয়ে দেয়।