“আমি যখন কথা বলি, লোকে
শুধু শোনে। মুখে রা
থাকে না, বুঝলেন
স্যার।"
বিপজ্জনকভাবে
স্টিয়ারিং-এ এক হাত
রেখে রাস্তা থেকে চোখ
ঘুরিয়ে পিছন ফিরে বলে
যাচ্ছিল ছেলেটা।
কয়েকবার তো ওর কাটানো
দেখে চোখ বুজে ফেলেছিল
সমরেশ। আজ প্রাণ নিয়ে
গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে
তো ওরা?
কলোনি মোড়ে বিকাশের
ড়িয়ে ওলা বুক করার সময়ই
যেন সে বুঝতে পেরেছিল,
আজকের জার্নিটা
সুবিধের হতে যাচ্ছে না।
বিকাশকে সে কথা বলেওছিল
সমরেশ। এই ড্রাইভারের
রেটিং চারের নীচে। এই
রেটিং-এর ড্রাইভারেরা
খুব একটা সুবিধের হয় না,
এ তার আগের অভিজ্ঞতা
থেকে জানা।
ব্যাপারটা গাড়িতে উঠেই
মালুম হল সমরেশের।
"যাবেন কোথায়,
স্যার"
"ওকাকুরা ভবন,
সল্টলেক"
"বেশ। ওলা কতটাকা
দেখাচ্ছে?"
"সাড়ে চারশ।"
" বেশ, বেশ, তাহলে
ট্রিপটা ক্যানসেল করে
দিই।"
"মানে?"
"আরে স্যার, বোঝেন না।
শুধুমুধু ওলাকে
কমিশনের টাকা দিয়ে কী
হবে? তার চে বরং ওই
টাকাটা আমাকেই দেবেন।
আমি ওলার বাইরে আপনাদের
পৌঁছে দেব। পাক্কা। ভয়
নেই স্যার। আর তাছাড়া
হয়ত সামনের মাসেই ওলা
ছেড়ে দেব। শালাদের
বড়োলোক করে লাভ কী!”
পড়েছে যবনের হাতে,
অগত্যা মেনে নিতেই হল।
সময়ের মধ্যে পৌঁছতেও
হবে। আজকের অনুষ্ঠানটা
খুব জরুরী। গাড়িতে
হাল্কা একটা
অ্যালকোহলের গন্ধ
পাওয়া যাচ্ছে নাকি! অথচ
ছেলেটা তো স্টেডিই
চালাচ্ছে। বন্যার
তোড়ের মতো কথার মধ্যেও
মাঝেমাঝে প্রায় পিছন
ফিরেই দিব্যি চালাচ্ছে
সে। "আমার চার-চারটে
গাড়ি কলকাতা শহরে চলে
স্যার। একদিন গাড়ি
বসিয়ে রাখলেও কিছু যায়
আসে না। আমার সিগ্রেট
আর মালের খরচই দিনে
হাজার-দেড় হাজার,
স্যার। তবে ভালো লিকার
ছাড়া কিছুই খাই না। এ
নেশা ছেড়ে দিতে পারি
কিন্তু। যে কোনো দিন
লাথি মেরে এই অভ্যেস
ভাগিয়ে দিতে পারি আমি।
তেমন মনের জোর আছে,
স্যার।"
আবার কিছুক্ষণ নীরবতা।
রিস্ক নিয়ে ওভারটেক
চলছে। পাশের বাইকওলা
খিস্তি দিল একটা।
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে
ছেলেটা। বলে, "ব্যাটা,
কী করে বুঝবে রোজ
ভিখিরিদের কত টাকা খেতে
দিই আমি। খিস্তিটুকুই
আছে, পকেটের সে ক্ষমতা
আছে ওর। জানেন স্যার,
প্রথম যেদিন মাল খেয়ে
বাড়ি ঢুকি বাবা একটা
বেতের লাঠি ভেঙেছিল
পিঠে। বড়ো পুলিশ অফিসার
তো। আঁতে ঘা লেগেছিল।
ছেলে মাল খেয়ে ঘরে আসবে!
মা কিন্তু কাটা জায়গায়
মলম লাগিয়ে দিয়েছিল,
নিজে হাতে খাইয়ে
দিয়েছিল। তারপর যখন
থার্ড ইয়ারে পড়াশুনো
ছেড়ে দিই, বাবা লাথি
মেরে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে
দিল। ভাই পড়াশুনোয় ভালো
কিনা। ওকেই বেশি
ভালোবাসে। আমি পড়া
ছাড়ায় তার প্রেস্টিজে
লেগেছিল খুব। কিন্তু
স্যার, এখনকার দশাটা কী!
নিজে তো পেনশনের টাকায়
টিপে টিপে গুনে গুনে
দিন চালায়। আর আমি! এই যে
ঘড়িখানা দেখছেন এটার
দামই চল্লিশ হাজার। আর
ভাই হয়ত মাসে মাসে এই
পায়। হা হা হা।"
সমরেশরা তো সিঁটিয়ে
বসে আছে। হ্যাঁ বলবে না,
না বলবে বুঝতে পারছে
না। ছেলেটা বলে চলেছে,
"তবে মা এখনও খোঁজ নেয়,
ফোন করে, জানেন? এ তো আর
পয়সা-ঝাড়া প্রেমিকা নয়।
যতক্ষণ পয়সা ততক্ষণ
সম্পর্ক। এ হল মা। ঠিক
বলেছি কিনা বলুন!"
সমরেশরা বাধ্য হয়ে
সমস্বরে কঁকিয়ে ওঠে,"
বটেই তো, বটেই তো।"
"বুঝলেন স্যার, তারপর
তো বাড়ি থেকে লাথি খেয়ে
রাস্তায় রাস্তায়
ঘুরছি। সস্তার মাল
টানছি। জুয়ার ঠেকে
বসছি। ভাড়ার গাড়ি
চালাচ্ছি। কত কী করেছি
জানেন স্যার। পাতার
বিজনেসও করেছি। তবে মা
কসম পাতা কখনও খাইনি।
তারপর এক রবিবার এল সেই
দিন। শ্যামবাজারের এক
ঠেকে জুয়ার বোর্ড
একেবারে ফাটিয়ে দিলাম।
সেদিন মনেহয় আমার ওপর
শয়তান ভর কিরেছিল। এক
টানে তিরিশ লাখ। সবাই
তো শিউরে উঠেছে।
বোর্ডের মালিক
ভালোবাসত খুব। দুজন
এসকর্ট দিয়ে বাড়ি
পাঠাল। অত ক্যাশ টাকা
বলে কথা! তবে ঠেক ছাড়ার
আগে তাস ছিঁড়ে পুড়িয়ে
দিয়ে এলাম। এর মানে কী
জানেন তো স্যার।"
করুণভাবে সমরেশ বলে, "
কী করে জানব বল"।
ছেলেটা তাচ্ছিল্যের
হাসি হেসে বলে, " এর
মানে হল, ওই শেষ, আর আমি
কোনোদিন কোনো ঠেকে
ঢুকতে পারব না। সব ঠেকে
আমার খবর চলে যাবে। তো
সেই রাতে ওই দুটো ছেলে
মেশিন নিয়ে সারা রাত
আমাকে পাহারা দিয়েছিল।
ওদের ক্যাশ এক লাখ টাকা
দিয়ে দিলাম।"
বিকাশ এবার একটু
উৎসাহিত হয়ে বলে
"তারপর কী হল"।
"তারপর? পরদিন সোজা
হাফ প্যান্ট, টি শার্ট
পরে ব্যাগে টাকা নিয়ে
সাউথ কলকাতার এক মারুতি
শো রুমে চলে গেলাম।
গিয়ে বললাম একসঙ্গে
তিনখানা মারুতি সুইফট
কিনব। তাজা ক্যাশ ডাউন
করে। তারপর কী হল জানেন?
ওরা সিকিউরিটি ডেকে
ধাক্কা মেরে আমাকে
দোকান থেকে ভাগিয়ে দিল।
বিশ্বাসই করল না ব্যাগে
২৯লাখ টাকা আছে।"
"তারপর, তারপর কী হল"
সমস্বরে বলে ওঠে
সমরেশরা। "তারপর আর
কী! টাকা নিয়ে সোজা
আপনাদের বারাসাতের
মোহনের শো রুমে। ওরা
বিশ্বাস করল আমাকে।
একেবারে ক্যাশ ডাউন করে
তিন তিন খানা সুইফট এক
সঙ্গে কিনে ফেললাম।
কিনে ক্যাশমেমো নিয়ে
সোজা কলকাতার শো রুমে
এসে ওদের নাকের ডগায়
ছুঁড়ে মারলাম খিস্তি
মেরে। ম্যানেজারের মুখ
এত বড় হাঁ হল যে বিশ্বাস
করবেন না। সেই থেকে আমি
আর ড্রাইভার না। তিন
তিন খানা গাড়ির মালিক।
আমার আন্ডারে তিনটে
ছেলে কাজ করে। আর বাকি
টাকা ফিক্সড। পরে আরো
একটা গাড়ি কিনেছি।
হুণ্ডাই অ্যাকসেন্ট।
এখন সবাই খাতির করে।
ড্রিংক্স অফার করে।
মেয়েরা পেছন পেছন ঘোরে।
দক্ষিণ কলকাতার এম এল এ
মাখনদার সঙ্গে ওঠাবসা,
প্রোমোটিং, সোনাগাছিতে
গিয়ে গান শোনা, কী না
চলছে, স্যার।"
" সে কী মাখনবাবু
সোনাগাছিও যান!" সমরেশ
আঁতকে উঠে বলে।
"যান মানে! আলবত যান।
তবে কী না ছদ্মবেশে!"
"ছদ্মবেশে! সে কী!"
" হুঁ হুঁ বাবা।
ছদ্মবেশ বলে ছদ্মবেশ।
চাপদাড়ি, কালো
সানগ্লাস, গালে একটা
ফলস আঁচিল, গোঁফের ওপর
আর একটা তাগড়াই গোঁফ।
যেন পুরোনো নবাব।তখন
গুরুকে মানে আমাদের
মাখনদাকে চিনতেই
পারবেন না, স্যার।"
"তোমার তো দারুন
অভিজ্ঞতা হে" এতক্ষণে
সমরেশের দেহে বল ফিরে
এসেছে যেন।
"তবে স্যার ওই যে
বলেছি আমি বেশি
নখরাবাজি পছন্দ করি না।
কোনো প্যাসেঞ্জার বেশি
কিচাইন করলে স্রেফ গাড়ি
দাঁড় করে ধাক্কা মেরে
নামিয়ে দিই। ওসব ওলা
ফোলা গুলি মারো" বলে
গাড়িটা সত্যিই দাঁড়
করিয়ে দিল ছেলেটা।
সমরেশরা ভয়ে জড়োসড়ো। কী
ভুল হল আবার।ওদেরও
নামিয়ে দেবে নাকি!
ছেলেটা বলল, "একটু জল
কিনে আনি, স্যার"।
গাড়ি থামিয়ে নেমে গেল
সামনের পানের দোকানে।
জল কিনল না। কী যে সব করল
বোঝা গেল না। কী একটা
চিবোতে চিবোতে আবার
ফিরে এল গাড়িতে।
গাড়ি আবার চলছে। কথাও
চালু হয়েছে। "তবে
মেয়েদের একদম বিশ্বাস
করবেন না স্যার। পয়সা
আছে জানলে পেছনে ঘুরঘুর
করবে। যতক্ষণ আছে খালি
পয়সা খসানোর তাল। ফতুর
করার তাল। ওর থেকে
সোনাগাছির মেয়েরা
ভালো। পফেসনাল। পয়সা
নেবে, ঠকাবে না। সেদিন
দিয়েছি নমিতাকে
ভাগিয়ে। লাভার না হাতি।
শুধু আমার পয়সার দিকে
নজর। সত্যি বলতে কী
পয়সা ছাড়া কেউ পাত্তা
দেয় না স্যার। দুর্দিনে
দেখেছি কেউ এক কাপ চা,
একটা বিড়িও দেয় না।
বন্ধুরা চেনে না, বাবাও
পাত্তা দেয় না। তবে
মায়েরা দেয় স্যার। শুধু
জবাব দেবার জন্যেই আমার
আরো অনেক টাকা বানাতে
হবে। এই এক কামরার
ফ্ল্যাটটা ঝেড়ে দেব। আর
একটা থ্রি বিএইচকে
ফ্ল্যাট করতে হবে।
বাবাকে দেখাতে হবে বি
এস সি ফেল ছেলে কত কামাই
করতে পারে। আর আমাকে
তাড়িয়ে বাবা কতটা ভুল
করেছিল।"
ছেলেটাকে যেন অন্য
গ্রহের প্রাণী মনে
হচ্ছে। ঠিক চেনা
মানুষজনের মতো না। কী
যে একটা আগুন আছে ওর
মধ্যে। এত টইটুম্বুর
জীবনের মধ্যে ভালো
মন্দের আলোছায়ায় মাখা
এক না-শয়তান, না-দেবতা,
না-মানুষ, যে প্রকাণ্ড
একটা নির্বান্ধব
মরুভূমিতে তার মোকাম
খুঁজে বেড়াচ্ছে শুধু।
হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে
গাড়ি থেমে গেল। ওকাকুরা
ভবন এসে গেছে। সমরেশরা
হাঁফ ছেড়ে বাঁচে যেন।
গুনে গুনে ছেলেটার দিকে
সাড়ে চারশ টাকা বাড়িয়ে
দেয় সমরেশ। ছেলেটা বলে
ওটা রেখে দিন স্যার। এই
ট্রিপ্টা আমার তরফ থেকে
ফ্রি। আপনাদের দেখেই
বুঝেছিলাম আপনারা খুব
ভালোমানুষ। কেউ শোনে
না, আপনারা এতক্ষণ কত
ধৈর্য ধরে আমার কথা
শুনলেন। এটা তার ফিজই
ধরুন। এই নিন আমার
কার্ড। চাইলে কোনোদিন
ফোন করবেন। আরো অনেক
গল্প আছে আমার কাছে।