১
ভিড়ের ভিতরে মিশে গেলেই
জয়ন্তর মনে হয় সে একটা
নির্জন সৈকতে চলে
এসেছে।
সাধারণত উল্টোটাই হয়
সকলের।
কিন্তু জয়ন্ত অন্য
ধাতুতে গড়া। সাজানো
গোছানো ছিমছাম
পরিষ্কার পাড়া বা
এলাকার থেকে জয়ন্তর ভাল
লাগে নোংরা বিধ্বস্ত
ভাঙাচোরা
ধ্বংসস্তূপের মতো
এলাকা।
শহরের একপ্রান্তে
যেখানে ভাঙা গাড়িগুলো
সব ডাম্প করা হয়, সেখানে
ঘুরতে জয়ন্তর ভাল লাগে।
ভাল লাগে প্রবল ব্যস্ত
বাজারের ভিতর
উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে
বেড়াতে।
এসময় জয়ন্ত আসলে কাউকে
দেখতে পায় না। সমস্ত
মুখগুলিই ভীষণ সেলাই
করা একটা কাপড়ে মোড়া
বলে মনে হয়।
মনে হয় কেউ কথা বলছে না
আদৌ। সকলের মুখ নড়ছে।
কিন্তু বাজার ছেড়ে,
মোড়ের মাথা থেকে অনেকটা
হাঁটতে হাঁটতে যখন
জয়ন্ত এসে পড়ে তাদের
বাড়ি যাওয়ার পথে দুপাশে
সাজানো গাছের মধ্যে
দিয়ে লম্বা হয়ে যাওয়া
রাস্তাটায়, মনে হয় কোথা
থেকে যেন প্রবল আওয়াজ
ভেসে আসছে।
আর সে আওয়াজ ভয়ংকর।
পাতা পড়ার আওয়াজ, পাতার
উপর শিশির পড়ার আওয়াজ,
ফুলের জন্ম নেওয়ার
আওয়াজ, ফুল খসে পড়ার
আওয়াজ, মাটির উপর দিয়ে
কেঁচোর বুকে হেঁটে
যাওয়ার আওয়াজ।
এমন অনেক আওয়াজ
বিস্ফোরণের মতো তার
মাথার মধ্যে যেন হাতুড়ি
মারতে থাকে।
একা বাড়িতে বসে থাকলেও
সমস্যা। জয়তী ছেলেকে
নিয়ে হয়তো বিষণ্নতার
মতো উঁচু ওই ইস্টওয়েস্ট
মলে মার্কেটিং করতে
গেছে। বাড়িতে কেউ নেই।
কিন্তু কোথা থেকে যেন
বাড়ির ভিতরে পিঁপড়ের
হেঁটে যাওয়ার শব্দ। যেন
কেউ নূপুর পরে হেঁটে
যাচ্ছে। যেন তার পায়ের
শব্দের ছমছম বুকের
ভিতরে এক একটা
প্রতিধ্বনি তৈরি করছে।
আবার টিকটিকি যখন
লাফিয়ে পড়ছে প্রজাপতির
উপর, তখন তার চোয়ালের
চাপে মড়মড় করে ভেঙে
যাওয়া প্রজাপতির দেহের
শব্দ জয়ন্তকে আধমড়া করে
দেয়।
জয়ন্ত এসময় ভিড়ের মধ্যে
পালিয়ে যায়।
কথায় বলে শব্দে শব্দ
ঢাকে। আসলে জয়ন্ত ভিড়ের
মধ্যে কিছুই শুনতে পায়
না।
জয়ন্ত নির্জনে থাকতে
পারে না। রাতের বেলা
যখন ঘুম ভেঙে যায়, তখন
তার বুকের ভিতর থেকে
হৃৎপিণ্ড যেন
ডাইনোসরের পায়ের মতো
বুকের উপর এক একটা পা
ফেলে।
শুধু নিজের নয়, জয়ন্ত
শুনতে পায় পাশে শুয়ে
থাকা জয়তীর বুকের শব্দ।
ও ঘরে শুয়ে থাকা মা আর
ছেলে বাবাইয়ের বুকের
শব্দ।
নিঃশ্বাসের শব্দ।
প্রশ্বাসের শব্দ।
যেন ঝড় বয়ে চলেছে কোনও।
যেন এইমাত্র সব দরজা
জানলা ভেঙে পড়বে।
জয়ন্ত ঘামতে থাকে।
ইয়ারফোন কানে গুঁজে
মোবাইলে গান শোনে। ফুল
ভল্যুমে।
আর আশ্চর্য ঘুম আসে
তার।
২
মড়া কাটার ডাক্তার বলে
সে এলাকায় পরিচিত। তার
কারণ আর কিছুই না,
মর্গের পোস্টমর্টেম
রিপোর্ট জয়ন্তর হাত
দিয়েই বেরোয়।
ব্যাপারটা যতই
অস্বস্তির হোক, আর
মানুষের শরীর সম্পর্কে,
বেঁচে থাকা আর মরে
যাওয়ার সূক্ষ্ম
সুতোগুলোর বিজ্ঞান
সম্পর্কে তার
পর্যবেক্ষণশক্তির যতই
প্রশংসা আসুক কাজের
উপরমহল থেকে, ডাক্তার
হিসেবে সে ব্রাত্য।
মানুষ হয়তো ভাবে, মড়া
কেটেই যে হাত পাকাল, সে
আর জীবিত মানুষের
চিকিৎসা কী করে করবে।
কিন্তু জয়ন্তর এ বিষয়ে
কোনও দুঃখবোধ তো নেই-ই,
বরং, যেখানে লোকজন
ঢুকতে ভয় পায়, সেখানে সে
অদ্ভুত স্বস্তি বোধ
করে।
অনেক সময় ডোম না থাকলেও
নিজেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা
সে নগ্ন ঠান্ডা
মৃতদেহগুলির সঙ্গে সময়
কাটায়।
তাদের আগাপাশতলা
ওলোটপালোট করে দেখে।
কারোর রক্তচলাচলের
কোনও শব্দ নেই।
লাবডুবের কোনও শব্দ
নেই। নিঃশ্বাস
প্রশ্বাসের কোনও শব্দ
নেই।
শরীর কাটার পরে
অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো
দেখতে দেখতে সে তন্ময়
হয়ে যায়।
নীরব সব
অঙ্গপ্রত্যঙ্গ।
কর্মহীন। যেন একটা থমকে
যাওয়া যন্ত্র। তার মনে
পড়ে বহুদিন আগে টিটাগড়ে
থাকার সময় বাবার বন্ধ
হয়ে যাওয়া কারখানার
কথা। ভাঙা পাঁচিলের
মধ্যে দিয়ে ঢুকে,
ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে
লাফিয়ে টুবলু, রিনি আর
শান্তনুর সঙ্গে
কারখানার মধ্যে ঢুকে
পড়ার কথা। বিরাট বিরাট
যন্ত্র। অন্ধকার আর
আলোর মধ্যে সেই সব
যন্ত্রের এক একটা
নাটবল্টু যেন থমকে আছে।
হাত দিয়ে স্পর্শ করে
ওরা বোঝার চেষ্টা করছিল
যন্ত্রগুলিকে। কী
ঠান্ডা সেই সব যন্ত্র।
সিলিং থেকে ঝুলে পড়া
বাবার মৃতদেহের গায়ে
একমাত্র সেই ঠান্ডা টের
পেয়েছিল জয়ন্ত।
তেমন ভাবেই আদর করে
স্পর্শ করে দেখতে ইচ্ছে
হয় জয়ন্তর, মৃত মানুষের
অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলি।
মাঝেমাঝে ঘুমন্ত মায়ের
দেহ স্পর্শ করে জয়ন্ত
বোঝার চেষ্টা করে দেহ
উষ্ণ আছে কিনা।
মাঝেমাঝে জয়তী বা
বাবাইয়ের দেহ স্পর্শ
করেও টের পাওয়ার চেষ্টা
করে জয়ন্ত।
মাঝেমাঝে নিজের গায়েও
হাত দিয়ে জয়ন্ত দেখে
নেয়।
নগ্ন শরীরের দিকে
তাকিয়ে সে আর কোনও
উত্তেজনা টের পায় না।
জয়ন্ত জানে, মৃতদেহের
কোনও লিঙ্গ নেই।
জয়ন্ত এখন একটু একটু এও
জানে, জীবিত শরীরেরও
কোনও লিঙ্গ নেই।
শারীরিক একটা পার্থক্য
আছে শুধু।
বহুবছর পরে টিটাগড়ে
আবার সেই কারখানার কাছে
গিয়েছিল জয়ন্ত।
উঁচু উঁচু বাড়ি সেখানে।
আবাসন।
এত মানুষ কোথায় ছিল?
কারখানাটি আর নেই।
যন্ত্রগুলিই কি তবে
মানুষ হয়ে গেছে?
৩
-তুমি আস্তে আস্তে
পালটে গেছ জয়ন্ত। আগের
মতো আর নেই।
জয়তীর মুখের উপর হাল্কা
একটা আলো এসে পড়েছে।
রাস্তার দিকের ঘর হলে
যেমন হয়। অসংখ্য শব্দের
ভিড়। অবশ্য তা জয়ন্তর
কাছে একপ্রকার
স্বস্তির। কারণ সেই সব
আওয়াজ আদৌ জয়ন্তর মনের
মধ্যে ঢোকে না। কিন্তু
জয়তীকে সেই সব শব্দ
কাহিল করে ফেলে।
- আমি পালটে গেছি কেন বলছ
বল তো।
- তোমাকে দেখলে মনে হয়
তুমি সবসময় পালিয়ে
বেড়াচ্ছ। এমনকী আমার
থেকেও। তুমি আজকাল
তোমার মায়ের সঙ্গেও
কোনও কথা বল না।
- বাবাইকে যে পড়াই?
- আর আমি? আমিও তো
সারাদিন স্কুলে পড়িয়ে
বাড়িতে আসি। আগে তোমার
অফিস নিয়ে, সিনেমা নিয়ে
কত কথা বলতে! এখন…
- এখন কথা বলি না। জানি
আমি। আমার আসলে কথা
নেই। একজন মানুষের কত
আর কথা থাকতে পারে
বলো।
- তুমি কতটা দূরে সরে গেছ
বুঝতে পারছ?
জয়তীর মুখের দিকে
তাকিয়ে রইল জয়ন্ত। জয়তী
যা বলছে, মিথ্যে নয়।
আবার সত্যিও নয়। কিন্তু
এ ব্যাপারটা জয়তীকে
বুঝিয়ে বলাও সম্ভব নয়।
জয়ন্তর যে মৃতদেহের
পাশে চুপচাপ বসে থাকতে
বেশি ভাল লাগে, এ কথা সে
কাকেই বা বলবে। একমাত্র
মায়ের কাছে জয়ন্ত একদিন
জিজ্ঞেস করেছিল, ‘ আমার
মনে হয় মৃত্যুকে যে আমি
ভয় পাই না, তা আমার
ক্ষতিই করেছে’।
- মৃত্যুকে ভয় পাস না তুই
বাবু? সত্যিই?
- ডেডবডি এলে, আমার যে
তাদের মুখের দিকে
তাকিয়ে থাকতে ভাল লাগে
মা।
- কেন ভাল লাগে? তুই কি
পাগল হয়ে যাচ্ছিস
বাবু?
- না, মা, তোমার মনে আছে,
আমার যখন ওই অপারেশনটা
হয়েছিল। ডাক্তার
হিসেবে আমি তো জানি
অ্যানাস্থেশিয়া দিলে
কী হয়। কিন্তু যখন
দেওয়া হল, তার ঠিক আগের
মুহূর্তে আমি ভাবছিলাম
কী জানো? আম্মি যদি অমন
ঠান্ডা একটা শরীর হয়ে
যাই, তাহলে কি কেউ আমার
দিকে তাকিয়ে থাকবে?
- তার মানে তুই মৃত্যুকে
হয়তো আরও বেশি ভয়
পাচ্ছিস বাবু। তুই এত
দুর্বল হয়ে যাস না। তোর
বউ আছে, ছেলে আছে। আমার
কথা বাদ দে।
মাকে সেদিন ভয় পেয়ে
যেতে দেখে এটুকু বুঝে
গেছিল জয়ন্ত, যে, তাকে
অভিনয় করেই চলতে হবে
সকলের সঙ্গে।
জয়তীর দিকে তাকিয়ে
মুচকি হেসে জয়ন্ত বলল, ‘
জয়তী, ব্যাপারটা তেমন
না, কাজের প্রেসার
বেড়েছে, ক্লান্ত লাগে
এখন।
- সে তো আমারও লাগে। আমরা
সকলেই খুব ক্লান্ত হয়ে
যাচ্ছি জয়ন্ত।
অপারেশনটা খুব জটিলই
ছিল। মস্তিষ্কে একটা
ছোট্ট সিস্ট, যা হয়তো
দেহের অন্য কোনও অংশে
হলে কিছুই মনে হত না।
কিন্তু যখনই ব্যাপারটা
মস্তিষ্কের, তখনই
অপারেশনে সারভাইভ করার
চান্স ১০ ভাগ হয়ে যায়।
অ্যানাস্থেশিয়া
দেওয়ার সময় আপ্রাণ
চেষ্টা করেছিল জয়ন্ত
শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত
তাকিয়ে থাকার।
কী ভাবছিল সে?
কোনও শব্দ আসছিল কী?
কোনও রাগ? বিষাদ?
কিছুই না। শুধু তাকিয়ে
থাকার কথা মনে হচ্ছিল
জয়ন্তর। আর তার পর কখন
যেন সমস্ত কিছুই নিভে
গেল।
এমনই কি অবস্থা হয়
মৃত্যুর ঠিক আগে? তার পর
একটা দীর্ঘ ঘুম। যে
ঘুমের ভিতরে কেউ কড়া
নাড়তে পারে না?
হয়তো তখন এক দীর্ঘ জীবন
শুরু হয়ে যায় অন্য
কোথাও। হয়তো সেই ঘুমের
অর্থ অন্য কোথাও জেগে
ওঠা। অন্য কেউ, যে
জীবনটা বেঁচে নিচ্ছে
তখন। একটি মূর্তির মতো
অথবা একটি দেহের মতো বা
একটি শিল্পের মতো তখন
সে শান্ত, নীরব, উদাসীন,
রাগ-দুঃখ-হিংসা-
মায়াহীন।
জ্ঞান ফিরে আসার সময়
প্রথমেই তাই কিছু মনে
পড়ে না।
জয়ন্ত’র-ও কিছু মনে
পড়েনি।
সে শুধু ভেবেছিল, আমার
মস্তিষ্ক কি বেঁচে আছে?
আর ঠিক এই সময়ে, জগতের
সমস্ত কিছুর প্রতি এক
তীব্র ভালবাসা তৈরি হয়।
সে যে কী মায়ার ভালবাসা!
সে যে মায়ার করুণা!
সমস্ত দুঃখের প্রতি এই
যে দুঃখ, এর কোনও নাম
নেই। অথচ এর পুরোটাই
খুব শব্দহীন। খুব
যন্ত্রণাহীন। যেন
যন্ত্রণার একটা জীবন সে
পেরিয়ে এসেছে। যেন কেউ
তার ঘুমের ভিতরে শুষে
নিয়েছে সে সব
যন্ত্রণাগুলিকে।
‘জয়তী, আমাদের জীবনের
সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে
ভালবাসার সময়টা কখন ছিল
জানো?
‘কখন’?
‘ যখন আমরা দুজনেই
দুজনকে জানতে দিইনি একে
অপরকে কতটা ভালবাসি।
অথচ দুজনেই দুজনকে উঠতে
বসতে ভালবাসতাম, লক্ষ
করতাম আড়াল থেকে, কেউ
জানত না। আমরাও না।
একটাও শব্দ খরচ করিনি
আমরা।‘
‘ হ্যাঁ, সময়টা খুব
থ্রিলিং ছিল।
‘শুধু থ্রিলিং নয়। ওটাই
প্রেম। যে আলোর উৎস
দেখা যায় না, অথচ তার
আলোয় আলো হয়ে থাক, সে
আলোই তো আলো।
কিন্তু জ্ঞান ফিরে আসার
পরেও জয়ন্তর প্রথম মনে
পড়ছিল তার মায়ের কথা।
আর কারো কথা না।
মায়ের মুখের দিকে
তাকালে যেমন সর্বদাই
জয়ন্তর মন দুঃখে ভরে
যায়। এই দুঃখটিকে ঠিক
কোনওভাবেই ব্যাখ্যা
করা যাবে না।
মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে
এসে যে কেউ এভাবে
মৃত্যুকে ভালবাসতে
পারে, তা জয়ন্তর নিজেরও
জানা ছিল না।
আবার, মৃত্যুকে ভালবাসা
মানে যে জীবনকে আরও
কাছের করে ভালবাসা, সে
কথাও জানা ছিল না তার।
৪
জয়ন্ত সেদিন ঘুম থেকে
জেগে উঠেই টের পেল কিছু
একটা বদলে গেছে আবার।
আশ্চর্য নীরবতা
চারিদিকে।
নিজের হৃদয়ের শব্দ
শুনতে পাচ্ছে না। নিজের
হার্ট বিটের শব্দ কোথাও
যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে।
দেওয়ালের ঘড়িটার থেকে
একটা হালকা টিকটিক শব্দ
শোনা যেত, যা জয়ন্তর
কাছে হাতুড়ির মতো এসে
পড়ত।
তাও শোনা যাচ্ছে না।
রান্নাঘর থেকে কোনও
শব্দ আসছে না। কেউ কথাও
বলছে না।
বিছানা থেকে উঠে জয়ন্ত
বারান্দায় গেল। গাছ,
পাখি, কুকুর, রাস্তা
দিয়ে চলে যাওয়া মানুষ,
গাড়ি—সমস্ত কিছুই যেন
সাইলেন্ট মুভির মতো।
মুখ নড়ছে। শব্দ নেই।
জয়ন্ত নিজের না কাটা
দাড়িতে একটু হাত
বোলাল।
এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল
না।
জয়তী বারান্দায় এসে চা
দিয়ে দ্রুত কিছু একটা
বলে চলে গেল।
চায়ের কাপ হাতে জয়ন্ত
ঘরের ভিতরে ঢুকে মায়ের
ঘরের কাছে গেল। মা কাগজ
পড়ছেন। বাতাসে কাগজ
উড়ছে। কিন্তু শব্দ নেই।
মা জয়ন্তকে দেখে কিছু
একটা বললেন। কিন্তু
জয়ন্ত শুনতে পেল না
কিছুই।
জয়ন্ত মাথা নেড়ে আবার
ঘরের কাছে চলে এল। আবার
বিছানার ধারে বসে ভাবতে
লাগল।
এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল
না। এমনটা তো গতকাল রাত
অব্দিও ছিল না।
ফোনটা নীরব ভাবে বেজে
যাচ্ছে। ফোন করছে
হাসপাতাল থেকে। ফোনটা
ধরল জয়ন্ত। কিন্তু
কিছুই শুনতে পারল না।
অর্থাৎ জয়ন্ত আর কানে
শুনতে পাচ্ছে না। মেসেজ
করে বলে দিল, যাতে ওকে
মেসেজ করা হয়। ফোনে
গণ্ডগোল।
মেসেজ এল, দ্রুত যেতে
হবে। কেস আছে একটা।
বাড়ির লোকে কেউই জানতে
পারল না এসব বিষয়ে।
৫
দেহটা ছিল এক তরুণীর।
মাথায় চোট। হেমারেজ।
ব্রেন ডেথ। অন দ্য
স্পট।
পোস্টমর্টেম লাগবে।
কাগজপত্র নিয়ে ঢুকেই
টেবিলের উপরে দেখল একটা
সাদা কাপড়ে মোড়া দেহ।
এটাই হবে। ভিতরে আর
কেউই নেই।
আস্তে আস্তে কাছে গিয়ে
একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল
জয়ন্তর।
রাস্তায় বেরিয়ে গাড়িটা
চালাতে চালাতেও এই
অনুভূতি হচ্ছিল।
কিন্তু তা ছিল খুব
মৃদু।
একটা অদ্ভুত গুঞ্জন
ধ্বনি শুধু সে শুনতে
পাচ্ছিল। যেন দূরের
একটা শব্দ।
এই শূন্যতার মধ্যেও সে
এই গুঞ্জনধ্বনি টের
পাচ্ছে।
দূর থেকে ভেসে আসছে এই
ঠান্ডা ঘরেও।
কাপড়টা সরাতেই চোখে পড়ল
মেয়েটির মুখ। ঘুমিয়ে
রয়েছে। এখুনি হয়ত জেগে
উঠতে পারে। আস্তে আস্তে
জয়ন্ত সম্পূর্ণ কাপড়টা
সরিয়ে নিল। এই প্রথম
তার মনে হতে লাগল
মৃতদেহ শুধু দেহ নয়।
আশ্চর্য শরীর। যেন পরম
মমতা ভরে এক শিল্পী
দেহটাকে গড়ে দিয়েছেন।
স্তনদুটি যেন খাজুরাহর
কোনও নাম না জানা
শিল্পীর গড়ে তোলা।
ঠোঁটদুটি যেন সদ্য
কাউকে আদর করে চলে
এসেছে। তলপেট যেন ইশারা
করছে কোনও। একটা
আশ্চর্য আকুতি আছে
কোথাও সারা শরীরে।
কিন্তু আকুতি বলার মতো
কোনও ভাষা নেই। এই
শরীরটাকে কাটতে হবে
ভেবেই জয়ন্তর শীত করতে
লাগল।
আজকেই কেউ নেই। কেউ
থাকলে কাজটা সহজ হত
হয়তো।
হাত কাঁপছে কুড়ি বছরের
অভিজ্ঞ জয়ন্ত
সান্যালের।
নীরবতাকে বিশ্বাস করতে
পারা এখন কঠিন। কারণ
জয়ন্ত কিছুই শুনতে
পাচ্ছে না।
একটা চেয়ার টেনে নগ্ন
মৃতদেহটার পাশে বসে পড়ল
জয়ন্ত।
এই দেহ কত বছরের? বাইশ?
চব্বিশ? না, কাগজপত্র
অনুযায়ী ছাব্বিশ।
হালকা করে মেয়েটার সারা
দেহে হাত বোলাতে শুরু
করল জয়ন্ত। এমনই কি
হয়েছিল যখন
অ্যানাস্থেশিয়ার সময়
তাঁর কোনও অনুভূতিই ছিল
না? এমন সুন্দর হয়ে
গিয়েছিল সে? এমনই কি কেউ
তার সারা দেহে হাত
বোলাচ্ছিল? এখন কি এই
মেয়েটাও অন্য কোথাও
বেঁচে উঠেছে?
অন্য কোথাও চুমু
খাচ্ছে? সারা শরীর ঘেমে
যাচ্ছে তার?
মেয়েটার সারা শরীর ঠিক
তেমনই ঠান্ডা, যেমনটা
হয়ে থাকে। কিন্তু
ঠোঁটদুটি কি কিছু বলতে
চাইছে?
জয়ন্ত ঘামছে। আবার সেই
শব্দটা শুনতে পাচ্ছে
সে। কিন্তু আর কিছুই
শুনতে পাচ্ছে না।
খুব দ্রুত কিছু চলছে।
হার্ট। রক্তসঞ্চালন।
ঠান্ডা শরীরে
রক্তসঞ্চালন?
তবে কি মেয়েটা সরীসৃপ
হয়ে গেছে?
এই হার্টের শব্দ আসছে
কোথা থেকে?
ক্রমশ হার্টের ল্যাব
ডুব শব্দটা বাড়তে শুরু
করল। শব্দটা এত জোরে
আসছে কোথা থেকে? যেন
হার্টের উপরে কেউ
অ্যামপ্লিফায়ার
লাগিয়ে দিয়েছে।
মেয়েটা কি তবে বেঁচে
আছে?
তাহলে পোস্টমর্টেম হবে
কী করে?
জয়ন্ত মেয়েটার বুকের
উপর কান পাতল। কান
পেতেই ছিটকে উঠল।
মেয়েটা বেঁচে। মেয়েটার
হার্টের শব্দ ক্ষীণ
থেকে ক্রমশ জোর হতে
শুরু করেছে। মেয়েটার
মুখের কাছেও মুখ নিয়ে
গেল জয়ন্ত। নিঃশ্বাস
পড়ছে কি তার? নিঃশ্বাস
তো পড়তেই হবে। মেয়েটার
কপালে কি বিন্দু বিন্দু
ঘাম? আবার মেয়েটার সারা
শরীরে হাত বোলাল জয়ন্ত।
টেম্পারেচার একটুও
বাড়েনি। তা কি এই
মর্গের এসির কারণে?
শরীর এখন বরফের মতো
ঠান্ডা। শক্ত। রিগার
মর্টিস শুরু হয়ে যাওয়ার
কথা। কিন্তু হার্ট
চলছে। তবে কি এখন
অক্সিজেন দেওয়া উচিত?
জয়ন্ত চিৎকার করে উঠল।
এই প্রথম জয়ন্ত কাঁদতে
কাঁদতে চিৎকার করে উঠল।
ভয় নয়, লোভ নয়, ঘৃণা নয়, এক
আশ্চর্য করুণা তার মনের
মধ্যে জন্ম নিচ্ছিল।
একটা শক্ত ঠান্ডা বরফের
মতো শরীরে হার্ট চলছে।
যেন কেউ দরজায় বারবার
আঘাত করছে। কিন্তু
মেয়েটার ঘুম ভাঙছে না।
জয়ন্ত বারবার চিৎকার
করতে লাগল। কিন্তু সে
শুনতে পেল না তার নিজের
চিৎকার।
একটা শান্ত ঠান্ডা মৃত
মর্গের চেম্বারের
মধ্যে একটা জীবিত লোক
কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার
করে উঠছে। কিন্তু এই
ডাক শোনার মতো আর কেউ
কোথাও নেই।
জয়ন্ত আর কোথাও যেতেও
পারছে না। তার পা দুটো
এই ঠান্ডায় আটকে গেছে
মেঝের সঙ্গে।
তবু সে চেষ্টা করল বুকে
হেঁটেও যাতে দরজার কাছে
চলে যাওয়া যায়। মেঝের
উপরে উপুর হয়ে শুয়ে সে
বুকে হাঁটতে লাগল
মুখটাকে সাপের মতো উঁচু
করে।
আর ঠিক সেই সময়, সমস্ত
নীরবতা ভেঙে, ঠিক সেই
সময়ে, সে শুনতে পেল একটি
বিষাক্ত হিস হিস শব্দ।
ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে
তাকাতেই তার চোখে পড়ল
মেয়েটিকে।
ময়াল সাপের মতো ভঙিমায়
স্ট্রেচার থেকে তার
নগ্ন শরীরটা নেমে আসছে
মেঝের উপর। মুখ দিয়ে
লকলক করে বেরিয়ে আসছে
চেরা জিভ। চোখদুটিতে
লালসা নয়, যেন কয়েকশো
জন্মের খিদে।
মেয়েটি বুকে হেঁটেই
এগিয়ে এল জয়ন্তর দিকে।
তার পর আস্তে আস্তে
শঙ্খ লাগার মতো করে
জড়িয়ে ধরতে লাগল
জয়ন্তকে।
জয়ন্তর মুখের উপর নেমে
এল তার মুখ।
অ্যানাস্থেশিয়ার ঠিক
আগে যেমন আস্তে আস্তে
স্থির হয়ে গেছিল সারা
দেহ, তেমন এক অনুভূতি হল
জয়ন্তর। সব যেন স্থির
হয়ে গেছে। আর সেকেন্ডের
ভগ্নাংশের মধ্যেই সে
তলিয়ে যাবে ঘুমের
মধ্যে।
সে শুধু শুনতে পাচ্ছিল
হার্টের লাব-ডুব শব্দ।
আর এক হিস হিস ধ্বনি।
মেয়েটার নগ্ন শীতল
সরীসৃপ গন্ধ ঢুকে পড়ল
তার সারা শরীরে।