একবার নিউইয়র্ক
যাচ্ছি। একাই। প্লেনের
যে দুটি আসন পাশাপাশি,
তার একটায় আমি আর একটায়
এক তরুন। তরুনটি
ভিনদেশি দেখেই বুঝেছি
এবং তারও এককযাত্রা!
সেজন্যেই হয়ত পাশাপাশি
সিট ।
চারদিকটা দেখছি। যা আমি
করে থাকি প্রথমে। আমি
আর তরুনটির যেমন
পাশাপাশি সিট আমাদের
মাঝখানের পুরা আট সিটের
ওপাশে আবার তেমনি দুটো
সিট। এইভাবেই সিটের
বিন্যাস। দূরে বাচ্চার
কান্না শোনা যায় হঠাত।
খুব তেড়ে ফুঁড়ে কাঁদছে।
প্লেনের এই আটকা
আবহাওয়া মেনে নিতে
পারছেনা । কান্নার ঢং
বিদ্রোহি ধরণের।
তাকিয়ে দেখছি। চেষ্টা
চলছে নানা রকমের। একটু
থামে তো কিছুক্ষণ পরে
তার চেয়ে বেশি
চিল্লিয়ে ওঠে।
ছয় ঘন্টার ট্রাঞ্জিট
ছিল কাতার এয়ার
লাইন্সের । ফলে ঢাকা
থেকে যারা আমার
সহযাত্রি ছিল তারা নেই।
মনে পড়ছে, আমার পাশেই
বসেছিল সদ্য দেশ ছাড়া
একজন। প্রথম প্লেনে
উঠেছে। অভিজ্ঞতা কম।
আমার মতোই।
আমি ফার্ষ্ট প্লেনে উঠি
খুব অল্প বয়েসে। করাচি
যাচ্ছিলাম। এটা
স্বীকার করে সবাই যে ভয়
আমার বরাবরই কম। কিন্তু
জড়তা ছিল অসীম তাই এয়ার
হোস্টেসদের দেখে হা করে
তাকিয়ে থাকতাম পরম
বিস্ময় নিয়ে। এখনও দেখি
তবে বিস্ময় নয়, কেমন যেন
কষ্ট হয়। এত সুন্দরী
মেয়েরা ট্রে নিয়ে নিয়ে
ছুটছে আমার মত সাধারণ
মানুষকে চকোলেট কেক
অন্যান্য খাবার দিতে।
তাদের হাত থেকে চকোলেট
নিতেও লজ্জা হচ্ছিল।
নিলে কয়টা নেব! একটা
নাকি দুটো! বেশি নিলে
কিছু মনে করবে না তো!
পরে এই সংকোচ ছিলনা।
হাতের ইশারায় ফিরিয়েও
দিয়ে বলেছি, নেবনা।
অথবা আমাকে আরও দুটো
বাটার দিন।
ঢাকা থেকে যে অনভিজ্ঞ
লোকটি আমার পাশের সিটে
বসেছিল, দেখছি সে
প্রথমে বুঝতেই পারলোনা,
সুন্দরী সুবেশী বিমান
বালা কি বলছে, হাত
বাড়াচ্ছেনা বা নিচ্ছে
না। আমি একটু সহযোগিতা
করলাম, বুঝতে পেরে।
বললাম, চকোলেট নেন,
দূরের যাত্রা,
ভালোলাগবে খেতে।
সংকোচে একটা নিল কিন্তু
খাচ্ছেনা।
পরে একের পর এক খাবার
আসছে আর সে আমার দিকে
তাকিয়ে বলছে, কি করব।
আমি ইশারা করলাম।
মজার যন্ত্রণা হল, সে
বাটারের ছোট প্যাকেট
জীবনে দেখেনি। সেগুলো
সে ছুঁয়েও দেখছেনা।
আবার আমি বাটারের কাগজ
খুলে দেখালাম। দেখালে
কি হবে সে খাবেনা। আমি
বাটার প্রিয় তাই
নিজেকেও তারগুলোও
দিলাম নিয়ে। পরে কাতার
এয়ারপোর্টে নেমে সে চলে
গেল।
আমারতো আবার উঠতে হবে ।
যাচ্ছি নিউ ইয়র্ক।
যাত্রি যারা প্রায়
বিদেশি সব।
পাশাপাশি সিটের
যাত্রিও ভিন্ন।
একসময় এক লোক দেখি উঠে
এসে আমাকে বলল, আপনি ওই
ওখানে , অনেক মহিলা আছে
ওখানে গিয়ে বসেন। ( তার
মায়া হয়েছে দেখে যে আমি
এক বিদেশি তরুনের পাশে
বসেছি । বাঙালি তো ! হা
হা )
কি মনে করে সটান উঠে
দাঁড়িয়ে লোকটার
নির্দেশ ফলো করে পৌঁছে
গেলাম সেখানে। সত্যিই
অনেক মহিলা। আমি
যাত্রাপথে গল্প করিনা
কেন যেন। সে বাসে হোক বা
প্লেনে। একাকি ভাবতে
ভালো লাগে। খুব নিজেকে
পাই।
ওবাবা, একী! সেই মাথা
খারাপ কান্না। দেখি
আমার পাশে যে মহিলা তার
পাশেই সেই বেবি তার মা
সহ। অবিরাম অবিশ্রান্ত
কান্না। বাঙালির সেধে
উপকার করার কারণ
বুঝলাম। চেষ্টা করলাম
সহ্য করার, উহু ভবী
ভোলেনা যতই যা করা হোক।
আমার নিজেকে গুছিয়ে
নেয়া মাথায় উঠলো।
এক লাফে এগিয়ে আগের
সিটের সামনে দাঁড়িয়ে
সেই উপকারি লোকটিকে
বললাম, প্লিজ ওঠেন ভাই।
লোকটা কিছুক্ষণ তাকিয়ে
দেখে উঠে গেল।
আরেকবার স্বেচ্ছায়
প্রতারিত
হয়েছিলাম।ঠিক
প্রতারণাও না। খুব
জমাটি হয়ে বসেছি
প্লেনে। চারিদিকে
বাঙালি্র ভিড়। কখনও মৌন
থেকেছি কখনও দুচারটি
কথা বলেছি ও শুনেছিই
বেশি। বাঙ্গালি চুপ
থাকতে শেখেনি। আল্লায়
মুখ দিছে কথা না বললে
মুখের অপমান হয়না!
তো এক সময় দেখি ওয়াইন
পরিবেশিত হল। আমিতো লাফ
দিয়ে উঠলাম। ওরে বাবা,
প্রথম বারের কথা মনে
হল। গা গুলিয়ে প্রায়
পড়েই গেছিলাম সেবার।
বাড়িতেই। আর যা দু
একবার টেস্ট করেছি
মাত্র। মানে আমার সয়না।
ছোটো ছোটো বোতল ট্রের
অন্যান্য খাবারের
সঙ্গে পরিবেশিত হচ্ছে।
সবাইকেই দিয়েছে। এয়ার
হোস্টেস্ কে নেবনা
বলেছি কি বলিনি, হাত
থেকে প্রায় কেড়ে নিল
সহযাত্রি এক জন। সিটের
পিছনে এবং সামনে যারা
বাঙালি ছিল হৈ হৈ রব
সকলের!
বুঝলাম, বলছে, আপনি না
খান না খাবেন, কিন্তু এ
জিনিস ছাড়বেন না। আমরা
আছি।
এত লুব্ধতা এই জিনিস
নিয়ে আরও কয়েকবার
দেখেছি।
আমেরিকা খুবই দূর
যাত্রা। সারাপথ ওই
বাচ্চা কেঁদে গেল। এয়ার
হোস্টেস অনেক কিছু দিয়ে
এবং করেও থামাতে
পারলোনা। এই থামে তো
আবার শুরু করে।
ফিরে এলাম নিজের সিটে।
পাশের সুদর্শন
তরুনটিকে দেখি, ফিরেও
তাকালনা। প্রহর যায়।
প্রহর আসে। একসময় সারা
প্লেন নিস্তব্ধ হয়। শেষ
হয় রাতের খাওয়া। দুজন
করে নারী এবং পুরুষ
বিশাল এক পলি ব্যাগ করে
প্রত্যেক সিটের
পরিত্যক্ত খাদ্যাদি
কুড়িয়ে নিতে থাকে।
চট পট সাজিয়ে গুছিয়ে
নিয়ে একটু অন্তরালে
গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
ফিস ফাস কথাও আর শোনা
যায়না। একটু উঁকি মেরে
দেখি, কি করছে এই লোভনীয়
চাকুরির সুন্দরীরা।
মাঝে মাঝেই দেখেছি তারা
মুখের মেকাপের উপরে আরও
গাঢ় করে পুনরায় মেকাপ
লাগাচ্ছে।
প্লেনের ভিতরে কেমন এক
নিঃশব্দতা নেমে আসে।
কারুর নড়া চড়া নেই।
বাইরে নিঃসীম অন্ধকার।
একটা গো গো আওয়াজ আসছে
কেবল। ভয় লাগেনা।
অভিজ্ঞতায় বুঝি,
গন্তব্যের শেষ হচ্ছে।
এই রাত এই নিস্তব্ধতার
শেষ হচ্ছে।
শীত করে ওঠে। কম্বল
টেনে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।
যথেষ্ট চেষ্টা করি
হাতলে হাত রাখলে যাতে
জড়াজড়ি না হয় !
সবাই জানেন, কি দীর্ঘতম
যাত্রা এই আমেরিকা।
ঘুমিয়ে পড়েছি। কম্বল
জড়িয়ে । ভীষন শীত ।
সারারাত তো আর ঘুমানো
যায়না সে আমি যতই ঘুম
কাতুরে হই, মাঝে একবার
জেগে উঠি। উঠতেই হয়।
সারা প্লেনে এয়ার
হোস্টেসদের দেখা নেই।
কেবল রাতের শব্দ।
নিস্তব্ধতার শব্ধ। হায়
আমার কপাল দেখি, কার
মাথা আমার কাঁধে আর
আমার মাথা?
বেশ সরে টরে গিয়ে যার
যার মাথা টেনে নিলাম।
আরেকবার ঘুমিয়ে গেলাম !
ভোর হলে জেগে উঠি। এই
এতক্ষণ ঘুমিয়ে নিয়েছি
কে যেন কাকে জড়িয়ে
ধরে।
অপূর্ব সে উষ্ণতা!
ভাবলাম, শীত বড়ো
অবিশ্বাসী,অসচেত্ন,
বেহায়া...