সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে
কাজে আসার কথা
জলেবিয়ার। কিন্তু
প্রথম দু-পাঁচদিন ছাড়া
আজ প্রায় এক মাস হতে চলল,
কোনোদিন সে সকাল সাড়ে
আটটার মধ্যে কাজে
আসেনি। এদিকে আমার অফিস
যাওয়ার তাড়া থাকে। সাড়ে
নটার গাড়িটা যদি ধরতে
না পারি, হাজিরা খাতায়
লাল ঢ্যারা পড়বে। আর
এদিকে আমার বর আটটায়
বেরিয়ে যায়। মেয়েকে
স্কুলবাসে উঠিয়ে দিয়ে
তারপর অফিস যায়। মেয়ের
স্কুল ছুটি হলে আমার মা
ওকে নিজের কাছে নিয়ে
যায়। আমি অফিস থেকে
ফেরার সময় মেয়েকে মায়ের
কাছ থেকে নিয়ে আসি। এই
চাপটা এক মাস আগেও ছিল
না। মনুমাসি যদ্দিন ছিল
আমি অনেক ঝাড়া হাত-পা
ছিলাম। এখন এই নতুন
নিয়মে অভ্যস্ত হতে
চাইলেও জলেবিয়া আমার
চিন্তা বাড়িয়ে দেয়।
কোনো মোবাইল ফোনও নেই
ওর, যে খবর নেব। বললেই
বলে, ‘কী দরকার ভৌজাই?
হামার কে আছে!’ কেউ
থাকা-বা-না-থাকার সঙ্গে
মোবাইল ফোনের কী
সম্পর্ক, আমার মাথায়
ঢোকে না। কিনে দিতে
চেয়েছি, তাতেও রাজি নয়।
উলটে বলে, ‘ক্যা জরুরত
ভৌজাই? ফালতু পোয়সা
নোস্টো কোরবে। হামি
ঠিক এসে যাব।’ আমি
উষ্মা প্রকাশ করি,
‘রোজ-রোজ তাহলে দেরি
কেন করিস? বুঝিস না কেন,
অফিসে দেরি করে গেলে
আমার মাইনে কাটা যাবে?’
উত্তর না দিলেও আমি
জানি ও কী বলতে
পারে—নিন্দ না ছুটল। এত
কীসের ঘুম বুঝি না বাপু!
রেগে গিয়ে বলি, ‘এই ঘুমই
তোর কাল হবে। এত ঘুম
কীসের?’ বড়ো বড়ো
দাঁতগুলো বের করে হেসে
বলে, ‘সপ্না দেখি যে!
সপ্না দেখতে হামার খুব
ভালো লাগে।’ এই এক কথা।
সপ্না! ‘নিকুচি করেছে।
বকবক না করে হাত চালা
দেখি!’ বলে ঘরে ঢুকে যাই
শাড়ি পরতে। যাবার আগে
নজর করি জলেবিয়ার দিকে।
যথারীতি কড়াইয়ে ওর জন্য
রাখা মাছের ঝোলের
মধ্যেই ভাত বেড়ে নিয়ে
দ্রুত গতিতে খেতে শুরু
করে দিয়েছে। শুরুতেই
ওকে বলেছিলাম, ‘তোকে
কিন্তু ভাত খেতে হবে।
সক্কাল-সক্কাল আমি রুটি
করতে পারব না। ছুটির
দিনে রুটি-পরোটা করি।
সেদিন খাবি।’ হেসে
বলেছিল, ‘কুনো ওসুবিধা
নাই ভৌজাই। ভাত খেলে
পেট ভি ভরে, মন ভি ভরে।
কিন্তু ভাইয়া কুছু
বোলবে না তো?’ বলার
মধ্যে এটুকুই বলেছিলাম,
‘ওসব তোকে ভাবতে হবে
না।’ মনের মধ্যে খালি
উঁকি মারে—মনুমাসি
থাকলে... আট বছরের
অভ্যাস। চট করে ভোলার
নয়।
বর-মেয়েকে তৈরি করে
রওয়ানা করিয়ে দেবার পর
কোনোমতে দু-মগ জল মাথায়
ঢেলে রান্নাঘরের কাজ
সারতে-সারতে অপেক্ষা
করি জলেবিয়ার। আগে তো
মনুমাসি ছিল। আমার
কাছেই থাকত। অনেক দিন
কাজ করেছে। বিয়ের পর
বছর দুয়েক শ্বশুরঘর
করার পর ঝামেলার কারণে
এই রেললাইন সম্বল
এলাকায় দু-কামরার বাসায়
ভাড়া এলাম। কাছেই আমার
বাপের বাড়ি। সেটা একটা
মস্ত সুবিধে। ততদিনে
মেয়ের বয়স পাঁচ মাস।
মনুমাসিকে মা-ই জোগাড়
করে দিয়েছিল। কী
ভাগ্যিস পেয়েছিলাম!
নইলে সংসার সামলে অফিস
করা সম্ভব ছিল না।
চাকরিটা ছেড়েই দিতে হত।
মনুমাসি সব করত। মেয়ের
দেখাশোনা, ঘর গুছিয়ে
রাখা, রান্নায় আমাকে
সাহায্য করা... সব। এমন
লোক পাওয়া আজকালকার
দিনে ভারি ঝঞ্ঝাট। গত
মাসে মেয়ের আট বছরের
জন্মদিনের রাতে সব মিটে
গেলে মনুমাসি এসে আমার
কাছে দাঁড়াল। আমি তখন
রান্নাঘর গোছাচ্ছি।
এসে পাশে চুপ করে
দাঁড়িয়ে আছে দেখে
জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিছু
বলবে?’ বলল—
--ছোটোমা, এবার আমায় ছুটি
দাও।
--ছুটি দাও মানে? কোথাও
যাবে?
--মুন্নি তো বড়ো হয়ে
গেছে। এবার আমায় ছুটি
দাও। বাকি জীবনটা দেশের
বাড়িতে কাটাব।
মনুমাসির যে দেশের
বাড়ি বলে কিছু আছে, এটা
ভুলেই গেছিলাম।
রাণাঘাটের ওদিকে কোথায়
যেন। এই আট বছরে
একদিনের জন্যও ছুটি
নেয়নি। আমরা কোথাও
বেড়াতে গেলে আমাদের
সঙ্গেই গেছে। আমি আমার
বিস্ময় চেপে রেখে
বললাম, ‘ঠিক আছে। কাল
কথা বলব। সারাদিন অনেক
ঝামেলা গেছে। এসব
আলোচনা মাথা ঠান্ডা করে
করা উচিত। তাই না? এখন
যাও, শুয়ে পড়ো।’ মনে মনে
নিজের ঠান্ডা মাথার
তারিফই করলাম। কিন্তু
মনুমাসি চলে যাবে—এই
চিন্তাটা শিরদাঁড়ায়
শীতল স্রোত বইয়ে দিলো;
অস্বীকার করব না।
মনুমাসি চুপ করে
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার
কাজ দেখল। নাকি আমাকে?
পেছন না ফিরেও সেটা
বুঝতে পারছিলাম।
সে-রাতে স্বরূপকে
এ-ঘটনা নিয়ে কিছু আর
বলিনি। শুধু বলেছিলাম,
‘কাল সকালে আমার সঙ্গে
একটু বেরোতে হবে। একটা
জরুরি আলোচনা আছে। আজ
আর কিছু জিজ্ঞেস কোরো
না।’ স্বরূপের চটজলদি
মন্তব্য, ‘ডিভোর্স করবে
নাকি?’ বিরক্ত হয়ে
উত্তর দিলাম, ‘বাজে কথা
কম বলো। সরে শোও।’
পরদিন সকালে রান্নার পর
আমি আর স্বরূপ বেরোলাম।
সকাল থেকে মনুমাসি একটা
কথাও বলেনি বা কিছু
জিজ্ঞেসও করেনি। নিজের
নির্ধারিত কাজগুলো ঠিক
করে গেছে। রিক্সায় উঠে
রিক্সাওয়ালাকে বললাম,
‘স্টেশন।’ স্বরূপ বলল,
‘রোব্বারও ট্রেন? কোথায়
যাচ্ছি আমরা?’ আমি কোনো
উত্তর দিলাম না।
স্টেশনে পৌঁছে
প্ল্যাটফর্ম ধরে আরো
উত্তর দিকে সোজা হাঁটা
লাগালাম। শেষ মাথায়
একটা বাবলা গাছ আছে।
একটা বসার বেঞ্চও।
সেটার ওপর বসে স্বরূপকে
বললাম, ‘বসো।’ স্বরূপ
বাধ্য ছেলের মতো একটা
কথাও না বলে বসল। আমার
দৃষ্টি আরো উত্তরে, আর
স্বরূপের দৃষ্টি আমার
দিকে। আজ স্টেশনটা খুব
ফাঁকা। দক্ষিণ দিক থেকে
একটা ট্রেন এসে চলে
গেলে স্বরূপের দিকে
ফিরে বললাম, ‘মনুমাসি
চলে যাবে।’ স্বরূপ
প্রথমে ব্যঞ্জনাটা
ধরতে না পেরে বলল,
‘মনুমাসি? কোথায় যাবে?’
আমি বললাম, ‘বোঝনি?
একেবারে চলে যাবে।
দেশের বাড়ি। কাল
রাত্তিরে বলেছে।’
স্বরূপ এবার বুঝল। চোখ
কপালে তুলে বলল, ‘এ বাবা!
এবার তাহলে কী হবে? এত সব
কাজ কে সামলাবে? আমার তো
অফিস!’ আমি স্বরূপের
দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে
থাকার পর বললাম, ‘আর
আমার অফিস? সেটার কী হবে?
মুন্নিকে সামলাবে কে?
ঘরের দেখাশোনা কে করবে?
আজ অব্দি তুমি কোন
কাজটা করেছ মুন্নিকে
স্কুলবাসে তুলে দেওয়া
ছাড়া? সামলানোর চিন্তা
করছে!’ স্বরূপ এমন ভাবে
বলতে শুরু করল যেন একটা
উপযুক্ত সমাধান পেয়েছে,
‘বেশ তো, মনুমাসির
মাইনে বাড়িয়ে দাও। আর
মাসে দুদিন করে ছুটি। ও
ঠিক থেকে যাবে। এটা
কোনো ব্যাপার হল? এ-কথা
তো বাড়িতেই বলা যেত।
এখন চলো।’ আমি স্বরূপকে
পুরো কথা শেষ করতে
দিলাম। স্বরূপ এবার উঠে
দাঁড়িয়ে আবার বলল, ‘না-ও
চলো চলো। ওঠো।’ এবার
আমি বললাম, ‘বসো। কথা
শেষ হয়নি। মুন্নির
সামনে এ-আলোচনা করা যায়
না স্বরূপ। ওর মনের
অবস্থাটা কী হবে, সেটাও
ভাবার।’ স্বরূপ বসে
পড়ল। চেহারার বিরক্তি
কেটে গিয়ে মুন্নির নামে
দুশ্চিন্তা ফুটে
উঠেছে। বললাম, ‘তুমি
মনুমাসিকে কতটুকু চেনো?
একটুও না। কোনোদিন
মনুমাসিকে মন খুলে
হাসতে দেখেছ? কোনোরকম
আবেগ দেখেছ ওর মধ্যে? ওর
বাড়ি কোথায়, বাড়িতে
কে-কে আছে, জানো সেসব?
মনুমাসি কী-কী ওষুধ খায়,
খোঁজ নিয়েছ? কোনোদিন
ছুটি নিয়েছে? দেখেছ?’
স্বরূপ এবার দক্ষিণ
দিকে কয়েক সেকেন্ড
তাকিয়ে থেকে বলল, ‘ঠিক
আছে ঠিক আছে। যায় যাবে।
অন্য লোক পেয়ে যাবে।
এখন ওঠো। আচ্ছা ঠিক আছে,
বাজার আমি করব। হল তো?’
আমি হেসে বললাম, ‘বাজার!
সেই এক কেজি কাঁচালঙ্কা
কিনেছিলে, মনে আছে?’
স্বরূপ হেসে বলল, ‘তখন
আর এখন! মাঝখানে দশটা
বছর কেটে গেছে ম্যাডাম।
আগামী বছর আমার চল্লিশ
হবে। এখন চলো। কাজ
আছে।’ রিক্সায় ফেরার
পথে স্বরূপ বলল, ‘এর
জন্য আমাকে নিয়ে
বেরোনোর কোনো দরকারই
ছিল না। এতকাল তুমি
করেছ, এখনো তুমিই করবে।
কোনোদিন কোনো প্রশ্ন
করেছি? আমি সংসারের
কিছু বুঝি-ফুঝি না। আমি
সেই ‘যেমন চালাও তেমনি
চলি মা’ গোত্রের মানুষ।
খেতে দিলে খাই, না দিলে
চাই। ভেবো না। সব ঠিক
হয়ে যাবে।’ বাড়ির দরজায়
নামতে নামতে স্বরূপকে
বললাম, ‘তুমি আমার বিয়ে
করা বর। পাশের পাড়ার
বোসবাবু নও। সংসারের
গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা
তোমার সঙ্গেই করব। সে
তুমি চাও বা না চাও।’
মনে মনে এ-ও বুঝলাম ওকে
দিয়ে কিচ্ছুটি হবার নয়।
নিশ্চিন্তে আছে।
খাচ্ছে-দাচ্ছে, অফিস
করছে। মেয়েটাকে নিয়ে
পড়াতেও বসায় না। এবার
বুঝবে ঠ্যালা।
দুপুরের খাওয়ার পর
স্বরূপ মুন্নিকে নিয়ে
শুয়ে পড়ার পর আমি
মনুমাসিকে ডাকলাম।
সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম,
‘সত্যিই চলে যাবে? একদম
ঠিক করে ফেলেছ?’
মনুমাসি আমার দিকে
তাকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ
ছোটোমা। এবার নিজের
বাড়ি যাই। অনেকদিন তো
হল।’ মনে হল জিজ্ঞেস
করি—মুন্নির কী হবে, এই
সংসারটার কী হবে, আমি
সারাদিন বাড়ি থাকি না,
সেটার কী হবে? ইচ্ছে করল
না। মনুমাসির
সিদ্ধান্তকে সম্মান
দিতে ইচ্ছা করল। আর
সংসারটা মনুমাসির নয়,
আমার। যা করার মাথা
ঠান্ডা রেখে আমাকেই
করতে হবে।
আমি তো ভুলেই গেছিলাম
মনুমাসির একটা বাড়ি
আছে, যেটা মনুমাসি
বিধবা হবার পর নিজের
নামে করে নিয়েছে।
ছেলে-বউয়ের সঙ্গে
বিস্তর ঝামেলাটা না হলে
মনুমাসি বাড়ি ছেড়ে
বেরিয়ে আসত কি? কিছু
জিজ্ঞেস করব না বললেও
একটা চিন্তা তো থেকেই
যায়। সেই চিন্তা থেকেই
জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার
ছেলে, ছেলের বউ থাকতে
দেবে তোমাকে? বাড়ি যদিও
তোমার নামে তবু, বাড়ি
থেকে যদি আবার বের করে
দেয়?’ মনুমাসি বলল,
‘কাগজপত্র আছে না!’
‘সেগুলো কোথায় রেখে
এসেছ?’—জানতে চাইলাম।
মনুমাসি হালকা হেসে
বলল, ‘আমি কি অত বোকা
ছোটোমা? সেগুলো সব আমার
সঙ্গেই আছে। আসার সময়
নিয়ে এসেছিলাম। অপমান
সইতে না-পেরে সব ছেড়ে
চলে এসেছিলাম। আমার
নাতিটার বয়স এখন
আট-সাড়ে আট হবে।
মুন্নির বয়সী।’
মনুমাসির হাতের ওপর
আমার নিজের হাতটা রেখে
জিজ্ঞেস করলাম, ‘তার
কথা খুব মনে পড়ে তোমার,
না?’ মনুমাসি চুপ করে
রইল। জানি এর কোনো
উত্তর হয় না, তাই জানার
জন্য জোর না করে বললাম,
‘ব্যাংকে তোমার প্রায়
তিন লাখ টাকা জমেছে।
একটা টাকাও তো এতগুলো
বছরে তোলনি। কীভাবে
নিয়ে যাবে টাকাগুলো?’
‘খুব সামান্য কিছু টাকা
সঙ্গে নিয়ে যাব।
বাকিটা...’ মনুমাসিকে
চিন্তিত দেখাল। আমি
আশ্বস্ত করে বললাম,
‘ঠিক আছে, পরশু চলো
ব্যাংকে যাই।’ ‘আর
তোমার অফিস?’ মনুমাসি
প্রশ্ন করল। ‘ছুটি নেব।
আর একটা কথা, একজন লোক
পাওয়া পর্যন্ত কি তুমি
থাকতে পারবে? জোর করছি
না। যদি পারো।’ মনুমাসি
বলল, ‘অবশ্যই থাকব
ছোটোমা। আমি একজনকে
দেখেছি। পাশের বাড়ির
তিনতলায় কাজ করে। তুমি
অফিস বেরিয়ে যাবার পর
কাজে আসে। পরশু তো তুমি
বাড়ি থাকবে, কাল বলে
দেবো যেন বিকেলবেলা
আসে। দেখো যদি তোমার
পছন্দ হয়।’
সেই জলেবিয়ার আমার
সংসারে ঢোকা। মাথায়
সিঁদুর নেই দেখে
জিজ্ঞেস করেছিলাম,
‘বিয়ে করোনি?’ এতক্ষণ
ঠোঁট দিয়ে চেপে রাখা
দাঁতের পাটি বের করে
হেসে বলল, ‘সাদি? হামার?
কে কোরবে? হামি মোটি আছি,
কালি আছি। হামার মা বলে
রাকশসের মতো দাঁত।’ আমি
হেসে ফেলে বললাম,
‘যাহ্! এ আবার কী কথা?
তোমার মুখটা তো খুব
মিষ্টি। আর কী সুন্দর
ডাগর দুটো চোখ!’
জলেবিয়া দু-হাতের পাতা
দিয়ে যতটা পারা যায়
পুরো মুখটা ঢেকে খুব
হাসল। হাসি থামলে বলল,
‘চোখ ধুয়ে কি পানি পিব?’
মনুমাসিও পাশে বসে হেসে
ফেলেছে। স্বরূপ বা
মুন্নি কেউ না-থাকায়
তিন মহিলা মন খুলে
যেন-বা গপ্প করছি আমরা,
এমন একটা পরিবেশ। আমার
কিন্তু জলেবিয়াকে বেশ
পছন্দ হল। বললাম, ‘একটা
কথা, সকাল সাড়ে আটটার
মধ্য কাজে আসতে হবে।
আমি নটা দশ-পনেরোয়
বেরিয়ে যাই। পারবে
আসতে? তোমার জন্য অফিস
কামাই করতে পারব না।
কদিন দেখব, যদি দেখি
সময়মতো আসছ না, ছাড়িয়ে
দেবো। কী?’ জলেবিয়া
আঁচল দিয়ে মুখ মুছে
উত্তর দিলো, ‘হাঁ পারবে
ভৌজাই। খুব পারবে।’
আস্তে আস্তে জলেবিয়ার
সঙ্গে কেমন যেন একটা
আত্মীয়তা গড়ে উঠল। খুব
কোমল স্বভাবের মেয়ে।
অজান্তেই কখন তুমি থেকে
তুইতে চলে এসেছি মনে
পড়ে না। মাঝেমধ্যে
একটু-আধটু দেরি করলে
বলি, ‘জলেবিয়া, শনি-রবি
দেরি কর, স্বপ্ন দেখ
কিছু বলব না। অন্যদিন
দেরি করলে খুব বকব।’
জলেবিয়া ঘর মুছতে মুছতে
বলে, ‘জি ভৌজাই, আর দেরি
নাই কোরবে।’ কিন্তু
সেই-ই আবার দেরি।
মাঝেমধ্যে ওর ঘুম ভাঙে
না। ও ওর মাসির সঙ্গে
থাকে। সে কেন ডেকে দেয়
না জিজ্ঞেস করলে বলে,
‘বুড়ির টাইমের কুনো ঠিক
নাই ভৌজাই। কানে ভালো
সোনে না, আঁখ ভি খারাব
হোই গেলো।’
শনি-রবি জলেবিয়া তার
গল্পের প্যাঁটরা খুলে
বসে আমার কাছে। ওদের
দেশ জলৌন-এ। সেটা কোথায়
জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘সে
হামি বলতে পারব না।
হামরা মাল্লাহ্ জাত।’
আমি বলি, ‘মাঝি? নৌকা
চালায়?’ ‘হাঁ-হাঁ, ওহি
কাম। হামাদের গাঁও কা
নাম গোরহা কা পুরওয়া।
ফুলন দেবীর নাম সুনেছ?
হামাদের গাঁও কি থি।’
‘তুই দেখেছিস ওকে?’
‘হামি কুথা থেকে দেখব?
সুনো না, হামার বাবা
লেকিন ওই কাম কোরে না।
মাল্লাহ্ কা কাম।
জোগোদ্দলে জুটমিলে কাম
কোরে। আভি ভি কোরে।
হামি পাঁচ বোছর তক দেসে
ছিলাম। বাবা ইখানে কাম
কোরত। তারপর হামাকে,
হামার দুই দিদিকে আর
মাঈ কো লেকর চলিয়ে
আসলো। ইখানে আসার পর
হামার আরো দুই বহিন
হোলো। তারা সবাই দেখতে
ভালো। হামার ভাই নাই। ই
জন্য বাবা মাঈ কো বহুত
মারতা থা। সে ওনেক
গোল্পো ভৌজাই। আজ আর
হোবে না। পাসের বাড়িতে
দের হোইয়ে যাবে।’ বুঝবে
কিনা না ভেবেই বললাম,
‘এই সময় জ্ঞানটা আমার
বেলায় কোথায় থাকে? এ
জলেবিয়া!’ একচোট হেসে
বলে, ‘মাঈ কে মাফিক
বুলাচ্ছ! এ জলেবিয়া!’
যে-প্রশ্নটা প্রথম
দিনেই করা যেত, সেটা
করলাম, ‘তোর নাম
জলেবিয়া কেন রে? তুই তো
জিলিপির মতো দেখতে
নোস!’ ‘হামাদের এমুন
নামই হোয়। হামার এক
বুনের নাম বুন্দিয়া
আছে।’ বুঝলাম, এটা এমন
কী ব্যাপার!
দু-চারদিন তো মনের জোরে
পার করে দিলাম। অফিস
থেকে ফিরে কোনোরকমে
জামাকাপড় বদলে
মুন্নিকে নিয়ে পড়াতে
বসি। স্বরূপ এলে চা
বানাই। একটু আরাম করে
চা খাবার যো নেই। রাতের
রান্না, পরের দিনের
রান্নার
তোড়জোড়—হাঁপিয়ে
উঠছিলাম। স্বরূপ
এ-ব্যাপারে কোনো
সাহায্য করতে পারবে না
জেনেই ওকে কিছু বলিনি।
মাথার মধ্যে থেকে
বিষয়টাকে বের করে দিতে
পারছিলাম না। এসবের
মধ্যে হঠাৎই একদিন
মায়ের ফোন। অফিস থেকে
বেরোবার মুখে। কী, না
মুন্নির খুব জ্বর।
স্কুল থেকে ফিরেছে,
খেয়ে উঠে শুয়েছে, তখনো
কিছু না, বিকেলে খেলতে
খেলতে খেলা ছেড়ে
বিছানায় এসে একেবারে
নেতিয়ে পড়েছে। মা গায়ে
হাত দিয়ে দেখে, গা বেশ
গরম। কী থেকে কী হয়ে গেল
বুঝে উঠতে পারলাম না।
স্বরূপকে ফোন করে বললাম
তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে।
মায়ের কাছ থেকে যখন
মুন্নিকে নিচ্ছি, তখনো
মুন্নির গা বেশ গরম।
সোজা ডাক্তারের কাছে
নিয়ে গেলাম। উনি রক্তের
বেশ কিছু পরীক্ষা করাতে
বললেন আর ওষুধ দিলেন।
ফিরছি যখন, তখন
স্বরূপের ফোন। বললাম
বাড়ি ফিরছি। মুন্নিকে
নিয়ে খুব সাবধানে
রিক্সা করে বাড়ি ফিরে
দেখি স্বরূপ ততক্ষণে
এসে গেছে। ও-ই দরজা খুলে
দিয়ে মুন্নিকে কোলে
তুলে নিয়ে বিছানায়
শুইয়ে দিলো। আমি
চিন্তায় পড়ে গেলাম।
শোয়া অবস্থাতেই
মুন্নির জুতো-জামা খুলে
দিতে দিতে স্বরূপকে
বললাম, ‘একটু চা বানাতে
পারবে? আমি এদিকটা
সামলাই।’ মুন্নি
মিনমিনে কণ্ঠে বলে উঠল,
‘মা, বাবা চা বানাবে?
আমিও একটু খাব। দেবে?’
বললাম, ‘হ্যাঁ মা,
দেবো।’ স্বরূপের কাছে
গিয়ে বললাম, ‘পারবে তো
বানাতে? একটু বেশিই
বানিয়ো, মুন্নি খেতে
চাইল। বাবার বানানো
চা!’ বলে একটু হাসলাম।
শুনতে পেলাম স্বরূপ
মুন্নির কাছে গিয়ে
বলছে, ‘বাবা মা-র চেয়ে
ভালো চা বানায় বুঝলি
মুন্নি! আর সেই চা খেয়েই
দেখবি তোর জ্বর ভালো
হয়ে যাবে। কোনো ওষুধই
খেতে হবে না। কী!’
পরদিন সকালবেলা দেখলাম
মুন্নির জ্বর বেশ একটু
কমেছে। অফিস যাব না।
ভাবলাম রান্নার দিকটা
একটু সামলাই। স্বরূপই
মুন্নিকে নিয়ে গেল রক্ত
পরীক্ষা করাতে। মুন্নি
ফিরতে ফিরতে অনেকটা কাজ
সেরে ফেলতে পারব,
মুন্নিকেও সময় দিতে
পারব। ভাবলাম, স্বরূপ
নিশ্চয় পারবে।
দুশ্চিন্তা করে লাভ
নেই। সাড়ে আটটায়
জলেবিয়া কাজে এলে ওকে
জিজ্ঞেস করলাম, ‘কাল
সন্ধেবেলা তোকে দেখলাম
রাস্তার মোড়ে। কাজ থেকে
ফিরছিলি?’ জলেবিয়া
উত্তর দিলো,
‘সন্ঝাবেলায় কুথায়
কাম করি? তেলেভাজা
কিনতে গেছিলাম। রোজই তো
যাই।’ আমি অবাক হয়ে
জিজ্ঞেস করলাম, ‘রোজ
তেলেভাজা খাস?’ ‘হাঁ!
রোজ খাই। মাসি আর হামি
রাতের বেলায় মুড়ি আর
তেলেভাজা খাই।’ ‘সে কী
রে! রোজ তেলেভাজা খেলে
তো শরীর খারাপ করবে।
রান্না করিস না কেন?’
‘ইচ্ছা কোরে না।
সারাদিন কামের পর আরো
ঝামেলা কোরতে ভালো লাগে
না ভৌজাই।’ ‘দুপুরে কী
খাস তোরা?’ ‘কামের বাড়ি
থেকে ভাত দেয়, সবজি, দাল
ভি দেয়। ওই লিয়ে বাড়ি
যাই। বুড়ি খায়, হামি
খাই। ওতো পোয়সা কুথায়
পাবো ভৌজাই?’ ‘কেন,
রোজগার তো করিস। সেই
টাকা দিয়ে খাবি। একজনের
খাবার দুজনে ভাগ করে
খাস, পেট ভরে?’ ‘ওল্প
ওল্প ভোরে।’ ‘তাহলে?’
‘হামি তো টাকা জোমাচ্ছি
ভৌজাই। দেসে যাব। যখন
আর কাম কোরতে পারবো না।
জানো ভৌজাই, হামাদের
গাঁওমে আমুয়া কা পেড়
আছে। সিখানে ঝুলা ভি
আছে। বহুত আচ্ছা লগতা
হ্যায় ঝুলনে মে। অউর ভি
ওনেক পেড় আছে। সপ্না
ভি দেখলাম।’ বলে হাসল।
আমি দেখছি জলেবিয়ার
মুখে ওর গ্রামের ছবি
ফুটে উঠছে। আম গাছে
টাঙানো দোলনায় দোল
খাচ্ছে সখীদের সঙ্গে।
গাছের পাতা চুইয়ে
ঝিরিঝিরি রোদ ওদের
হাসিমুখে লুকোচুরি
খেলছে। ‘হামার কোথা
ছাড়ো। তুমি আজ হামার
সঙ্গ্ বাত কোরছো, অফিস
যাবে না?’ জলেবিয়া বলে
উঠল। ‘না রে, দেখ না কাল
থেকে মুন্নির খুব জ্বর।
ওর বাবা ওকে নিয়ে
ডাক্তারের কাছে গেছে।’
‘হায় রাম! বিটিয়ার জোর
হইয়েছে! দাওয়াই দিয়েছ?’
‘হ্যাঁ রে, দিয়েছি।
আচ্ছা শোন না, আজ
সন্ধেবেলা একটু আসতে
পারবি?’ ‘হাঁ, আসবো।
ছোটার সোময় আসব?’
‘আসিস।’ ভাত খেয়ে, কাজ
সেরে জলেবিয়া চলে গেল।
ওকে আর কিছু বললাম না।
সেই থেকে সন্ধেবেলা
জলেবিয়া আসা শুরু করল।
মাইনে কিছুটা বাড়িয়ে
দিয়েছি। ও এসে চা করে,
রুটি বানায়, সবজি কেটে
দেয়। ওকে বললাম, ‘চারটে
রুটি আর তরকারি নিয়ে
যাস। রাতে আর
মুড়ি-তেলেভাজা খেতে হবে
না, বুঝলি?’ হেসে বলল,
‘বহুত আচ্ছা ভৌজাই।’
মুন্নি এখন অনেক ভালো
হয়ে গেলেও কিছুটা
দুর্বল। এখনো স্কুলে
পাঠাচ্ছি না। মায়ের
কাছে রেখে আমি অফিস
যাচ্ছি। বাড়ি ফেরার পর
জলেবিয়াই মুন্নিকে
পরিষ্কার করে বিছানায়
শুইয়ে দেয়। স্বরূপ এলে
চা করে। ভালোই বানায়।
নিজে খায়, হাসিমুখে
আমাদের দেয়। একদিন
রাতের রান্না শেষ হয়ে
গেছে, বাড়ি যাবার আগে
জলেবিয়া আমাকে ডেকে
মাথা নীচু করে আঙুলে
আঙুল জড়াতে জড়াতে বলল,
‘ভৌজাই, একটা কোথা বলব?
কুছু মনে কোরবে না তো?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, বল
না। লজ্জা পাচ্ছিস
কেন?’ কণ্ঠস্বরে একটু
যেন দ্বিধা, জলেবিয়া
বলল, ‘আর দুটো রুটি বেসি
দিবে? মাসি ভি দুটো রুটি
খেয়ে রাতে খুব ভালো
নিন্দ দিলো। তুমি
মাহিনা একটু না হয় কোম
দিয়ো। কী কোরবো,
হামাদের বহুত ভুখ। মিটে
না ভৌজাই...’