দরজা
দরজাটা ভেজানো ছিল মনে
হল তনুর। কিন্তু খোলা
এখন। কে খুলল? তনু
ছিটকিনি লাগিয়ে দেয়।
নিশ্চিন্ত বোধ করে।
ওপরের ঘরে যায়, বাবার
আশি, অসুস্থ। বাবার
কাছে এসে বসে তনু।
সে নিশ্চিন্ত যে নিচের
দরজা বন্ধই আছে। ক'দিন
ধরে পাড়ায় ছিঁচকে চোর
ও চুরি বেড়েছে, মনে মনে
এরকম কথা তার পায়চারি
করে। মনে একটা অনাস্থা
বা ভয় আলতো গরম
বাতাসের মতো ঘুরপাক
খায়।
বাবা পাশ ফিরতে চায়,
তনু বাবাকে যে দিকের
দেয়ালে মা-র ছবি
সেদিকে পাশ ফিরিয়ে
দেয়।
তনু আবার একা হয়ে যায়,
মনের দরজা তার খোলে
বন্ধ হয়, আবার খোলে।
দেবজিৎ-এর কথা মনে হয়।
দেবজিৎ-এর কথা মনে এলেই
মনে হয় তার সব বন্ধ ও
ভেজানো দরজা খুলে যাবে
এবার। তনু দীর্ঘশ্বাস
ছাড়ে , তনু দীর্ঘশ্বাস
ফেলে।
কেন যেন মনে হয়, তার
দীর্ঘশ্বাসের দমকায়
নিচের দরজা খুলে গেছে।
দীর্ঘশ্বাস তো আসলে
হাওয়া! দীর্ঘশ্বাস
মানে অল্প ঝড়। তনুর
দীর্ঘশ্বাসে দু-একটা
খড়কুটো দু-একটা সবুজ
পাতা খসে পড়ে তার ভিতর
থেকে।
তবু তনু জানে
দীর্ঘশ্বাস মলয় বাতাস
নহে। দীর্ঘশ্বাস মলয়
বাতাস হলে বা দখিনা
বাতাস হলে ভালো লাগত
তার।
তনু নিচে আসে। বাবা
দেয়ালে মার ছবির দিকে
মুখ করে ঘুমোচ্ছে বা
চোখ বুজে আছে। তনু চোখ
বুজতে পারে না, তনুর চোখ
বুজতে ইচ্ছে করে, অনেক
দিন ধরে চোখ - মন - চোখের
জল - এইসব বুজে রাখতে
ইচ্ছে করে তার।
তনু নিচের দরজা দেখতে
অনেক ফাঁকা জায়গা
অতিক্রম করে। পুরো
বাড়িটা তাদের ফাঁকা বা
শূন্যতা দিয়ে ভরাট।
তনু দীর্ঘ পথ অতিক্রম
করে, দীর্ঘ সিঁড়ি ভেঙে,
এঘর ওঘর পেরিয়ে দরজার
কাছে এসে দেখে, না সে
ছিটকিনি তো লাগিয়েই
ছিল! খোলা নেই তো! বন্ধই
তো!
বন্ধ দরজার সামনে সে
দাঁড়িয়ে থাকে
অনেকক্ষণ। দীর্ঘক্ষণ।
সময় না-পেরনো কাল ধরে
সে বন্ধ দরজার সামনে,
গানহীন দাঁড়িয়ে আছে।
দরজার ওপাশে রাস্তা।
দরজার ওপারে জীবন।
দরজার ওইপাশে উল্লাস
হাসি ঠাট্টা মজা। দরজার
ওপাশে আকাশ।
তনুর মনে হল দরজার
ওপাশে সমুদ্রও থাকতে
পারে তার অযুত নিযুত
ঢেউ নিয়ে।
তনু বন্ধ ও ছিটকিনি
লাগানো দরজার মুখোমুখি
দাঁড়িয়ে আছে, ঢেউহীন,
স্রোতহীন।
পলাদি আমাকে
গড়ে
পলাদি খুব সুন্দর।
পলাদি সুন্দরী। পলাদি
ভালো মানুষ। পলাদির খুব
মায়া। পলাদি আমাকে
পাত্তা দেয়। পলাদি
আমাকে গড়ে।
পলাদি মাঝেমাঝে মুখ
গোমড়া করে আমাকে
গড়ে।
পলাদি চিন্তায় ডুবে
থাকে, পলাদি আর্ট করে।
আমার গায়ের রং প্রচন্ড
কালো বলে, আমার নাম
কালু। কালুর সঙ্গে আমার
ঠাকুমা আবার 'চরণ' যোগ
করে দিয়েছিল। আমার
পুরো নাম এখন কালুচরণ
দলুই।
পলাদি আমায় 'এই কালু এই
কালু' বলে ডাকে। আমার
খুব অভিমান হয়। কিশোর
বয়সে মনে মনে ভাবতাম,
'পলাদি কি আমার একটা
সুন্দর নতুন নাম দিতে
পারে না! "কালু" তো
কুকুরেরও নাম হয়!
পলাদির কি কোনো মায়া
ভালোবাসা আমার জন্য
নেই!'
পলাদির মায়া ভালোবাসা
একটা গ্রামের মতো। দীঘি
পুকুর কলাবাগান
তালসারি মেঠোপথ হাট
হাটচালা সরকারি
ডাক্তারখানা শ্মশান
হ্যারিকেন কুপির আলো
জোৎস্নাভরা বিস্তৃত
ধানখেত - এইসবের মধ্যেই
পুরো পলাদিকে পাওয়া
যাবে।
পলাদির পুরো নাম, পলা
ব্যানার্জি। পলাদি
মাটি সিমেন্ট পাথর কেটে
নানা রকমের মূর্তি
বানায়। ছোট বড়।
মাঝেমাঝে বীরভূমের
শান্তিনিকেতন যায়।
পলাদির কাজ আমি ছোট
থেকে দেখছি। আমার মা
পলাদির রান্না ও
অন্যান্য কাজ করে। তাই
আমি ছোট বয়স থেকেই
পলাদির এসিস্টেন্ট।
পলাদি ভাস্কর। ছোট
বয়সে ভাবতাম পলাদি
কুমোর।
ঐ ধেয়ে আসা বৃষ্টি
দিয়ে - বৃষ্টির
অন্ধকার দিয়ে পলাদি
মূর্তি গড়ছে।
পলাদি আটিস্ট। বিভিন্ন
মূর্তি যেমন বানায়
তেমন ছবিও আঁকে। আমার
ছবি এঁকেছে, আমি কাস্তে
দিয়ে মেঘ কাটছি,
অন্ধকার কাটছি।
মেঘ, অন্ধকার এসব কি
কাস্তে দিয়ে কাটার
জিনিস!
মা আড়ালে বলত, 'কালু,
তোর ঐ দিদি একটা
পাগলী।
মা পলাদিকে পাগল বলাতে
আমার ভিতরেও একটা পাগল
অন্ধকার, পাগল মেঘ
নড়েচড়ে ওঠে, আমার
মনখারাপের দম আটকে
যায়।
পলাদি পাগল কেন হবে?
পলাদি খুব ভালো, আমার
দিদি।
আমাকেও পাথর সিমেন্ট
এসব দিয়ে 'হুবহু কালু'-র
মতো বানিয়েছে, আমি
পাথর হয়ে সবসময়
পলাদির ইস্টুডিওতে
থাকি এখন। বাড়ি যাই
না। বাড়ি যে যায় সে
অন্য কালুচরণ!
পলাদির গরম নিঃশ্বাস
হাসি চোখের জল আমার
গায়ে পড়ে, আমার
গায়ের পাথরে পড়লে
শিহরণ হয়।
পলাদি ইস্টুডিওতে ঢুকে
'এই কালু এই কালু' বলে
স্নেহে আদরে
ভালোবাসায় ডাকে
আমায়।
আমার ভিতরের পাথর নড়ে
ওঠে।
পলাদি গুনগুন করে গান
গায়। একবার এ-মূর্তি
একবার ও-মূর্তির কাছে
যায়। কথা বলে তাদের
সঙ্গে। তাদের অনুমতি
নিয়ে, তাদের দুঃখ
কমায়, সুখ বাড়ায়,
কাউকে
দুশ্চিন্তাগ্রস্ত
গম্ভীর করে। সিমেন্ট
মাটি ছেনি হাতে পলাদি।
যেন বীণা হাতে দেবী
সরস্বতী মূর্তিতে
মূর্তিতে সুর তুলছে
ঘুরেঘুরে।
আমিও মূর্তি হয়ে দেখি
এইসব।
সিমেন্ট- পাথরের
কালুচরণ পলাদির গায়ের
গন্ধ, গুনগুন করে তার
গাওয়া গানের গন্ধও
পায়। পলাদির হাতেগড়া
সিমেন্ট-পাথরের 'এই
কালু এই কালু' আস্তে
আস্তে বড় হচ্ছে। বড়
হতে হতে আমি হঠাৎ, আসল
কালু হয়ে ঢুকে পড়ি
পলাদির মূর্তির ঘরে।
আমি আগের চেয়ে অনেকটা
বড় হয়েছি। আমাকে দেখে
পলাদি ওড়নাকে
যথাস্থানে আনে।
তারপর আবার মূর্তিদের
চলাচল দুঃখ-সুখ পাওয়া
না-পাওয়ার ভিতর পলাদি
ডুবে যায়।
অনেক মূর্তির ভিতর আমি
পলাদিকে খুঁজি। দেখি সে
নেই। সে নাই কোথাও।
কিন্তু পলাদি আছেও
কোথাও।
আমি খুঁজে পাচ্ছি না
তাকে। খুঁজে না-পাওয়া
পলাদিকে দেখতে পাই,
পুকুরের মূর্তি হয়ে
গায়ে শ্যাওলা জড়িয়ে
টলটল করে হাসছে সে।
শুধু দূর থেকে, কাছ থেকে,
পুকুরের জল থেকে - 'কালু,
এই কালু' এই ডাক ভেসে
আসছে।
আমার অভিমান হয়। রাগ
হয়। পলাদি কেন আমার
একটা সুন্দর নাম দেয়
না! যে নাম শুধু পলাদির,
শুধু পলাদিই ওই নামে
আমায় ডাকবে! অন্য আর
কেউ আমার সে নাম জানবে
না।
একদিন পলাদি, আবার আমার
সিমেন্ট-পাথরের
মূর্তির কাছে এলো। তার
মনের মতো গড়ে ওঠেনি 'এই
কালু, এই কালু'! তাই সে
আগের কালুকে নতুন করে
ভেঙে গড়ে ভেঙে, তৈরি
করবে আবার।
আমি স্থির অপলক
দাঁড়িয়ে আছি।
শিল্পীর নিঃশ্বাস
পড়ছে আমার চোখেমুখে।
পলাদি আমাকে নতুন করে
গড়ছে। আগের কালুতে তার
মন ভরেনি, কোথাও ছন্দ
কাটছিল, মন খুঁতখুঁত
করছিল তার। সে সিমেন্ট
পাথরের সঙ্গে একটু
শ্রাবণ একটু ভাদ্র একটু
হেমন্ত একটু ক্রোধ এবং
একটু অভিমান মিশিয়ে
নতুন কালুকে তৈরি করছে।
করছে তো করছেই। বৃষ্টি
ধারার মতো তার শিল্পীর
হাত দ্রুত চলছে। আমি
নড়ছি তার শিল্পের তালে
তালে।
পলাদি এখন আর আমাকে, 'এই
কালু, এই কালু' বলে ডাকে
না। এখন সে আমায় শুধু
'এই' বলে ডাকে।
পলাদির দেওয়া আমার
নতুন নাম এখন 'এই'!
কাগজের নৌকো
তিনি একটা কাগজের নৌকো
বানিয়েছেন। কাগজের
নৌকো শিশুরা বানায়।
জলে ছাড়ে।
কিন্তু তার এই বাহাত্তর
বছর বয়সে এসে জলে
কাগজের নৌকো ভাসাতে
ইচ্ছে করছে।
ভেসে ভেসেই তো এলেন
এতকাল। ভেসে থাকা। ভেসে
থাকার মধ্যে আনন্দ আছে,
চ্যালেঞ্জ আছে।
কিছুদিন আগে স্ত্রী
প্রয়াত হয়েছেন।
একমাত্র মেয়ে বিদেশে,
জামাই সমেত।
ফলে তিনি একা। এবং দিন
দিন মনটা শিশুর মতো
হচ্ছে। তিনি কাগজের ফুল
তৈরি করেন, কাগজের নৌকো,
কাগজ দিয়ে পুরো একটা
কাল-কে বানানোর ইচ্ছে
তাঁর। কাগজের
বসন্তকাল। কাগজ দিয়ে
তৈরি বর্ষাকাল।
ঘর ভর্তি তাঁর কাগজের
নৌকো। কিন্তু সে নৌকো
ভাসানোর মতো জল পাচ্ছেন
না তিনি।
অনেক জল দরকার তাঁর।
কাগজের নৌকো ভেসে ভেসে
যাবে, সেই ছোট্টবেলা
অব্দি, মায়ের কোল
অব্দি, বাবার বকাঝকা
পর্যন্ত।
বাথরুমে গিয়ে বালতিতে
ভাসাতেই পারেন। কিন্তু
সে তো একটুখানি জায়গা।
কাগজের নৌকো ছোটবেলা
অব্দি ভেসে যেতে পারবে
না। যে জল ছোটবেলা থেকে
এই বাহাত্তর পর্যন্ত
গড়িয়ে এসেছে, এমন
দীর্ঘ জলের ধারা তিনি
খুঁজছেন। পাচ্ছেন না।
শরৎ গেল, হেমন্ত গেল।
কাগজের নৌকো তিনি
বানিয়েই চলেছেন। তিনি
অপেক্ষা করছেন
দীর্ঘকাল ধরে বয়ে চলা
একটা স্রোতের।
কাগজের নৌকো বানাতে
বানাতে তিনি নিজেই তাতে
চড়েন, ভাসেন, বয়ে যান।
স্বপ্নে এ-বন্দর
ওই-বন্দর। এই ঘাট ওই
ঘাট। এই পার ওই পার। এই
ঢেউ ওই ঢেউ করতে করতে
তিনি নিজেই কাগজের নৌকো
হয়ে ভাসতে থাকেন,
ভাসেন।
পুলিশ এসে দরজা ভেঙে
দেখে, মাঝি গলে পচে
হাজার হাজার কাগজের
নৌকোয় চাপা পড়ে আছেন।
জলের স্রোতের অপেক্ষা
এখন - মর্গের অল্প আলোয়
- তবু নিজের মতো ভাসছে।