‘অবশেষে জেনেছি মানুষ
একা!
জেনেছি মানুষ তার
চিবুকের কাছেও ভীষণ
অচেনা ও একা!' (আবুল
হাসান)
যে বয়সে রঙিন কাগজে
ত্রিভুজ বানিয়ে স্কুল
সাজানো হতো বার্ষিক
পুরস্কারের জন্য, যে
বয়সে বইয়ের ভাঁজে
ময়ূরের পেখম রেখে
অপেক্ষায় থাকতে হতো
দ্বিগুণ হবার, যে বয়সে
তিন গোয়েন্দা ভাগাভাগি
করে পড়তে গিয়ে আড়ি
হতো-----ঠিক তেমন বয়সেই
আমি আর রাতুল একে
অন্যকে আবিষ্কার করে
ফেলেছিলাম।
বইয়ের আলমারি খুললেই শত
পুরানো বইগুলোর লালচে
পাতায় আমাদের নামের
আদ্যাক্ষর দেখে এখন
হাসি পায়। অথচ একসময় এই
বইয়ের পাতাগুলোয় কত না
কথা, প্রিয় ময়ূর পেখম বা
ডাঁই করা ফুলের পাপড়ি।
এখন আটপৌরে ভাষায়
ন্যাকামিও বলা যায়
তাকে।
রাতুলদের বাড়ি ছিলো
আমাদের বাড়ির পরেই।
বাড়ির নাম 'টগরকুঞ্জ'।
দেরাজ লাগোয়া কাঠটগর
গাছ নাকী কারো নামে সে
বাড়ির নাম, তা জানা নেই
আমার।
সত্যি বলতে বাড়ির নাম
নয়, এমনকি রাতুলও নয়--
বাড়িটিকে ঘিরে আমার
আগ্রহের কারণ ছিল যুথী
দিদি। আর যুথী দিদির
কপালে লাল কুমকুমে আঁকা
নকশা টিপ। প্রতিদিনের
নিভাঁজ বিকেল যখন জড়তি
সন্ধ্যার অপেক্ষায়
থাকতো তখন যুথী দিদি
টগরকু্ঞ্জের দেরাজে
এসে দাঁড়াতো। নরম যুঁই
ফুলের মৃদূ সুবাস ছড়িয়ে
উদাস তাকিয়ে থাকতো গলি
ছাড়িয়ে বাজারের ওই
রাস্তার দিকে। বাওড়ের
বাতাসে এলোমেলো বিকেল
অন্তর্লীন সন্ধ্যার
দিকে এগোতেই অদ্ভুত
বিষণ্ণতা ভর করতো যুথী
দিদির চেহারায়। তবে সে
বিষণ্ণতার ঢেউ কখনই
পৌঁছাতো না লাল কুমকুমে
আঁকা সেই ফুল তারায়।
আমি যখন সন্ধ্যার বুকে
দাঁড়িয়ে যুথী দিদির
বিষণ্ণতা উপেক্ষা করে
মন ডুবাতাম সেই ফুল
তারায়, ঠিক তখনি বেজে
উঠতো সাইকেলের টুং টাং
ঘন্টা।
আমি অবাক হয়ে দেখতাম,
যুথী দিদির চোখে তখন
সামুদ্রিক ঝড়। এক
মুহূর্ত আগের বিষণ্ণতা
অদ্ভুতভাবে নিমেষেই
অপাংক্তেয় হয়ে যেতো।
তবে অনাবিল সে সময়ের
সুর ভেস্তে দিয়ে কোথা
থেকে হাজির হতো রাতুল।
আমার হাত থেকে জলসিঙারা
ছিনিয়ে নিয়েই হাক দিতো
যুথী দিদিকে,
' দিদি, ভেতরে চল।
সন্ধ্যা পার হয়ে
যাচ্ছে।'
আড়ি দেওয়া ছেলেটার
প্রতি খুব রাগ হতো
আমার। জলসিঙ্গারার
জন্য নয়, যুথী দিদির
কপালের নকশাগুলোর
ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ তখনো
বোঝা হয়ে ওঠেনি বলে।
'নক্ষত্র ফোটার আগে
আমি একা মৃত্তিকার
পরিত্যক্ত,বাকি
আঙুর, ফলের ঘ্রাণ, গম, যব,
তরল মধু-র
রৌদ্রসমুজ্জল স্নান
শেষ করি। এখন আকাশতলে
সিন্ধুসমাজের
ভাঙা উতরোল স্বর শোনা
যায় গুঞ্জনের মতো'(
উৎপল বসু)
আমি তখন হারমোনিয়মে
কেবল, ' অরুণকান্তি কে গো
যোগী ভিখারি'
স্থায়ীটুকু তুলেছি। মা
হঠাত একদিন বললেন,
নন্দী দাদা ছেলেকে ওপাড়
পাঠাচ্ছেন, জেঠার কাছে
থাকবে এখন থেকে রাতুল।
এপাড় ওপাড়ে তালগোল
পাকিয়ে ফেলা আমি কিছু
সময় শূন্য হয়ে বসে
রইলাম।
এরপর রাতুল ওপাড়ে যাবার
দিনও যখন আড়ি ভাঙাতে
এলো না তখন কেঁদেকেটে
চোখ ফুলিয়ে যুথী দিদির
কাছে গিয়ে বিচার
দিলাম।
' তোমার ভাই আমার তিন
গোয়েন্দা বইগুলো না
ফিরিয়ে দিয়েই চলে
গেছে।'
খুব হেসে উঠলো যুথী
দিদি।
ঘরের কড়ি বর্গা ছুয়ে
গেলো সে হাসি। তবে সাথে
সাথে একটা উপায়ও বাতলে
দিলো,
' তুই চিঠি লিখবি। তোর বই
চাইবি। আমাদের চিঠির
সাথে তোর চিঠিও পাঠিয়ে
দেবো রাতুলকে।'
আমি তাই করলাম। চিঠি
লিখতে বসলাম।
' খোকনদের বাড়ির পেয়ারা
গাছে পাখি বাসা
বেঁধেছিলো। কিন্তু ওরা
খেলতে খেলতে পাখির বাসা
ভেঙে দিয়েছে। জানো,
পাখির ডিমগুলো নীল
ছিল।'
অথবা,
' বড় ভাই আমাকে তার
পুরাতন রঙিন
মার্বেলগুলো একেবারে
দিয়ে দিয়েছে। আমি
সাবানের বাক্সে সব
লুকিয়ে রেখেছি, তোমার
জন্য।'
এই চিঠিগুলো আমি নিয়ম
করে দিয়ে আসতাম যুথী
দিদির কাছে। কিন্তু সে
চিঠি রাতুল পর্যন্ত
পৌঁছাতো কীনা জানা নেই
আমার।
দশ-বারো বয়সী কারো
বিরহবোধ থাকে কীনা তাও
জানতাম না আমি। তবে এই
চিঠিগুলো রাতুলের কাছে
পৌঁছালে সে জানতো এক
একটি শব্দে কতটা কান্না
গুঁজে দেওয়া যায়।
এরমধ্যে অবশ্য
অনেকগুলো দিন কেটে
গেছে।
ততদিনে রাতুলদের
দেরাজছোঁয়া টগরগাছ
বয়সের ভারে কিছুটা নুয়ে
পড়েছে। টগরকুঞ্জের
সামনে সেই সাইকেলের টুং
টাং থেমে গিয়েছে। আমাকে
কুমকুমে আঁকা টিপের
নকশার কারিগরি না
শিখিয়েই যুথী দিদি চলে
গিয়েছে।
সে এক আশ্চর্য ঘটনা!
বৈশাখের এক দুপুরে
বাড়ির ছাদে রোদে দেওয়া
রাজ্যের আচারে পাহাড়া
দিচ্ছিলাম আমি।
প্রাচীরের উপর
মাধবীলতার ঝাড় এড়িয়ে
চোখ পড়েছিলো
টগরকুঞ্জের দেরাজে।
সাইকেলের ' টুং টাং'
শব্দে সেদিনও ছুটে আসতে
দেখেছিলাম যুথী
দিদিকে। যুথী দিদি
আসতেই হাওয়ায় ভেসে
হারিয়ে গিয়েছিলো
সাইকেলটা। সাথে যুথী
দিদিও।
কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই
নন্দী কাকু ফিরেছিলো
যুথী দিদিকে নিয়ে। সে
যুথী দিদি অবশ্য ছিলো
আখের ফুলের মতো
নির্ভার। টগরকুঞ্জ
এরপর কিছুদিন খুব
নিষ্প্রাণ ছিল। বন্ধ
দেরাজের ওপাড়ে সে বাড়ির
মানুষগুলোর শব্দহীনতা
আমাকে খুব অবাক করতো।
কতবার গিয়ে দেরাজ ঠেলে
ডেকেছি,
' যুথী দিদি....'
ভেতর থেকে উত্তর
আসেনি।
এরপর একটানা পনেরদিন
টগরকুঞ্জের দরজায় বড়
লোহার তালা ঝুলতে
দেখেছিলাম।
তারপর এক সকালে আবার ও
বাড়ির কাকীমার পুজোর
ঘন্টা, ধুপের গন্ধ
বাতাসে ভেসেছিলো।
টগরকুঞ্জের দেরাজ আবার
হাট হয়ে খুলেছিলো আমার
ডাকে।
কিন্তু ডাকে সাড়া দিতে
যুথী দিদি এগিয়ে
আসেনি।
'স্পর্শ করে অন্য নানা
ফুল
অন্য দেশ, অন্য কোনো
রাজার,
তোমার গ্রামে,
রেলব্রিজের তলে,
ভোরবেলার রৌদ্রে বসে
বাজার |' (উৎপল বসু)
রাতুল ফিরলো বছর চারেক
পর, শীতে। ততদিনে হাতে
পায়ে বেশ বেড়েছে রাতুল।
গলার স্বর ভেঙে গেছে।
চেহারায় সদ্য কিশোর
পেরোনো তরুণের ভাবসাব
উঁকি দিচ্ছে।
আমি আপ্লুত হয়ে জমিয়ে
রাখা রঙিন মার্বেলগুলো
মেলে ধরলাম রাতুলের
সামনে। রাতুল ঠোঁটের
কোণে হাসি ঝুলিয়ে এড়িয়ে
গেলো তা।
আমি বুঝলাম যে রাতুল
আড়ি না ভেঙেই চলে
গিয়েছিলো, ফেরার পথে সে
বদলে গিয়েছে অনেক।
আমি আবার রাতুলের কাছে
পৌঁছাতে সাহায্য নিতে
চাই সেই অন্তর্লীন যুথী
দিদির।
'কেমন আছে যুথী দিদি? কত
বড় বাড়ি তার? আমাদের কথা
মনে আছে তার?'
রাতুল ততদিনে গুছিয়ে
কথা বলতে শিখে গেছে।
' নিজের দেশের কথা কী কেউ
ভুলে যায়?'
আহা! আমি তো দেশের কথা
জানতে চাইনি। আমার কথা
কিছু বলে?
রাতুল অনিবার্যভাবে তা
ভুলে কথা পাতলো যুথী
দিদির নতুন শহরের।
'সে শহর অনেক বড়। সে শহরে
যুথী দিদি একবার
ভিক্টোরিয়া
মেমোরিয়ালের সামনে
হারিয়ে গিয়েছিলো। সে
শহরে সাজতে যুথী দিদি
পার্লারে যায়।'
আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন
করলাম,
' কুমকুমে নকশা টিপ আঁকে
না, যুথী দিদি?'
' আরেহ্! ওসব ওই শহরে চলে
নাকী? কত মানুষের সাথে
মিশতে হয় সেখানে।'
আমি অবাক হয়ে দেখলাম
যুথী দিদির কোনো কথাতেই
আমি নেই। আছে শুধু নতুন
শহর আর নতুন মানুষ।
আমার ভাল লাগছিলো না তা
শুনতে।
আমি মোক্ষম অস্ত্রটি
ছাড়লাম,
' তুমি এখনো তিন
গোয়েন্দা পড়ো?'
খাপছাড়া রাতুলকে সেই
প্রথম মনে হয় আমি
ঠিকঠাক ধরতে পারলাম।
আমার কাছ থেকে জমানো সব
বই নিয়ে গেলো সে
সন্ধ্যাতেই।
আমি ইচ্ছে করেই প্রতিটা
বইয়ের শেষ পাতায় লিখে
দিয়েছিলাম আমাদের
দু'জনের নামের
আদ্যাক্ষর।
সেবার খুব অল্পদিনের
জন্যই এসেছিল রাতুল।
শ্রাবণের শেষদিন
কাকীমার হাতে সবগুলো বই
পাঠিয়ে রাতুল ফিরেছিলো
ওপাড়ে।
কাকীমা বলেছিলো খুব
সামনেই রাতুলের স্কুল
ফাইনাল। তাই যুথী দিদি
ওকে জরুরী তলব করে
ফিরিয়ে নিলো।
আমি বইগুলো হাতে নিয়ে
অনিবার্যভাবেই চলে
গিয়েছিলাম শেষের পাতায়,
আমাদের দু'জনের নামের
আদ্যাক্ষরের কাছে। না,
সেখানে নতুন কোনো শব্দ
বা বাক্য যুক্ত করেনি
রাতুল।
শুধু আদ্যাক্ষরের
চারপাশ ঘিরে দিয়েছে
কয়েকটি ডট দিয়ে।
সেবার রাতুল যাবার
অনেকদিন পর আবার চিঠি
লিখতে বসেছিলাম। স্কুল
ফাইনালে খুব ভাল ফল
করেছে রাতুল, কাকিমা
কাঁসার জামবাটি ভর্তি
করে নারু দিয়ে গিয়েছিলো
সেদিন।
'কেমন আছো?
তোমাদের টগর গাছটি
ধুকছে, এবার খুব কম ফুল
এসেছে। আমাদের
প্রাচীরের মাধবীলতার
ঝাড় বড়ভাই কেটে
ফেলেছেন। বলেন, এসব
ফুলগাছ থাকলেই ঘোষ
বাড়ির মানুষেরা
সকাল-বিকাল ছুতোনাতায়
ফুল চাইতে আসে। কী
পাগলামি বলো!
যাক সেসব কথা, আমি এখন
'আনা ফ্র্যাংকের ডায়েরী
পড়ছি। তুমি কী পড়ছো,
জানিও।'
উত্তরহীন সে চিঠি
রাতুলের ঠিকানায়
পৌঁছেছিলো কীনা, তা
নিয়ে আজ অবধি আমি
অনিশ্চিত।
'মন মানে না বৃষ্টি হলো
এত
সমস্ত রাত ডুবো-নদীর
পারে
আমি তোমার
স্বপ্নে-পাওয়া আঙুল
স্পর্শ করি জলের
অধিকারে |' ( উৎপল বসু)
এরপর অনেকগুলো দিন
বিষণ্ণতা হ্রেষা তুলে
তেপান্তরে ছুটলো।
দীর্ঘ এক একটা দিন আমার
কাটতো বইয়ের পাতায় মুখ
গুঁজে। ততদিনে অবশ্য
আমারও স্কুল ফাইনাল
শেষ। নতুন কলেজ। আর
চিঠির বাক্সে ভিনদেশী
টিকিট লাগানো একটা হলুদ
খামের প্রত্যাশা।
সে প্রত্যশা ক্রমেই যখন
ছটফটে সাদা ঘোড়ার মতো
সময় ছিঁড়েখুঁড়ে বল্গা
হারাতে লাগলো, তখন
রাতুলের সাথে সংযোগের
একমাত্র উপায় হয়ে
দাঁড়ালো কাকিমা।
' রাতুলের কবে ছুটি হবে
কাকিমা? এবার কী
রাতুলের সাথে যুথী
দিদিও আসবে?'
প্রশ্নগুলোর সাথে
রাতুলকে একবার দেখার
আকাঙ্খা লেপ্টে থাকতো
খুব নিভৃতে।
রাতুল ছুটিতে আসবে,
আমরা সারাদিন গল্প
করবো, রাতুল শোনাবে বড়
শহরে আমিহীন ওর
বিরহদিনের কথা, আমি
বলবো হলুদ খামের
প্রত্যাশার কথা, রঙিন
রোমাঞ্চে আমরা নতুন করে
জানবো একে অন্যকে,গল্পে
গল্পে বেলা যাবে,
পাশাপাশি হাঁটতে থাকবো
আমরা ঝকঝকে দিনের অলিতে
গলিতে।
না,এমন কিছুই হয় না।
রাতুলের ছুটি হলেও দেশে
আসার ফুরসত হয় না।
এরমধ্যে নন্দী কাকার
হার্টের গণ্ডগোল ধরা
পড়লো। যুথী দিদি আর
রাতুলের পীড়াপীড়িতে
মাসখানেক ওদের কাছে
থেকেই চিকিৎসা করালেন
তিনি।
নন্দী কাকুকে নিয়ে
রাতুল ফিরবে----জলের উপরে
মাকড়সার জালের মতো
স্বপ্ন বুনতে থাকি আমি।
কিন্তু সে স্বপ্ন এক
ঝাপটাই ফুরিয়ে গেলেও
আমার দিনগুলোতে রাতুল
আরও পরিব্যাপ্ত হয়ে
পড়লো বেশ আড়ম্বর করেই।
কাকিমার হাতে কয়েকটি বই
পাঠিয়ে লুদ্ধ হাতে
আমাকে আরোও কাছে টেনে
নিলো রাতুল। সে বই
পেয়েই আমি চলে যাই
নির্জনে। নিজেকে এই
পৃথিবীর সবচেয়ে
সৌভাগ্যবতী মনে হয়
সেদিন আমার।
অভ্যাসবশতই বইগুলোর
প্রতি পাতায় খুঁজতে
থাকি প্রতিশ্রুত সময়ের
সীলমোহর।
পাতার পর পাতা শুধুই
ছাপার অক্ষরে ঠাসা।
আমার কপালে বিন্দু
বিন্দু ঘাম জমতে থাকে,
গলার কাছে আটকে থাকা
বাস্পটুকু বাঁধ ভেঙে
আছড়ে পড়তে চায় সে সময়ের
নীরব দেয়ালে। আর ঠিক
তখনি চোখে পড়ে একটি
বইয়ের একদম শেষ পাতায়
আমাদের দু'জনের নামের
আদ্যাক্ষর। আর সে
পাতাতেই স্কচটেপ দিয়ে
আটকানো কয়েকটি ময়ূর
পেখম।
রাতুল আমাকে নতুন করে
তপস্বিনী হবার মন্ত্র
দিয়ে দিলো।
'ব্যবহৃত খাম। আমি তার
পিঠের ওদিকে সামান্য
কয়েক ছত্র লেখার মতো
স্থান পেয়ে যাই-
আঁকিবুকি কিছুটা
টেনেছি,
তবু ফাঁক থাকে, যত লিখি
ততই শূন্যতা জন্মে' (
উৎপল বসু)
প্রায় মাস ছয়েক পর
সেবার দেশে ফিরলো
রাতুল। সাথে যুথী দিদি।
তবে যুথী দিদি অবশ্য
গুণে গুণে পাক্কা
পাঁচবছর পর ফিরলো।
রাতুলকে দেখতে পেয়ে
যতটা উচ্ছ্বাসিত হবার
কথা ছিল তা কিছুটা
ম্রিয়মাণ হলো যুথী
দিদির কারণে। এ ক'বছরে
যুথী দিদি আরোও পরিপাটি
হয়েছে। রঙ বেরঙের শাড়ির
সাথে ম্যাগি হাতার
ব্লাউজ, খোলা চুল, চোখের
কোণে কাজল আর কুমকুমে
আঁকা টিপের জায়গায়
সূর্যের মতো লাল টিপ।
যুথী দিদিকে সেসময়
অপ্সরী মনে হতো।
সারাক্ষণ ছল ছল করে
হাসে, বড় শহরের গল্প করে,
একে তাকে উপহার দেয়
মার্গো নিম সাবান,
বোরোলিন ক্রীম, ভিকো
টারমারিক স্কীন ক্রীম
আর শ্রীমতী টিপের
পাতা।
সবকিছু খুব পরিপাটি
যুথী দিদির। শুধু
সাইকেলের 'টিং টং' পেলেই
কেমন অগোছালো হয়ে ওঠতো।
যুথী দিদি তখনো জানতো
না, তপন ভাই এখন সাইকেল
নয়, মোটরসাইকেল ব্যবহার
করেন।
আমি যুথী দিদির কাছে
গিয়ে ফিসফিস করে বলি,
' এখানে কিছুই আর আগের
মতো নেই। অনেককিছুই
বদলে গেছে।'
শুধু এ কথাটুকুই। যুথী
দিদির মনের সব ভার
হেমন্তের বাতাস এসে
উড়িয়ে নিয়ে যেতো টুক
করে।
ভোকাট্টা হয়ে উড়ে
বেরাতো এরপর যুথী
দিদি।
তবে শুধু যুথী দিদি নয়,
সেবার ভোকাট্টা হয়ে উড়ে
বেরিয়েছিলো রাতুলও
খুব। তার নাগাল পেতে
আমাকে অপেক্ষা করতে
হয়েছিলো প্রায় দিন
পাঁচেক।
সেদিন দুপুরে আমি ছাদের
ঘরে রাতুলের পাঠানো
বইয়েই মগ্ন ছিলাম।
'খুব মনোযোগী পাঠক
হয়েছিস? এতটা মন দিয়ে
কলেজের বই পড়িস তো?'
আমি তখন সময়কে করোতলে
বন্দি করতে চাইছি।
অদৃশ্য রঙতুলি দিয়ে
সময়ের বুকে আঁকতে চাইছি
পৃথিবীর সবচেয়ে
অন্তরঙ্গ ছবি।
' আজ তোমার সময় হলো, এ
বাড়িতে আসার?'
আমি খুব চাইছি তখন বড়
শহর থেকে আসা ঝকঝকে
তরুণটি আমাকে বলুক, এ
বাড়ি নয় আমি তোর কাছে
এসেছি।
না, আমার অব্যক্ত সেই
চাওয়াতে রঙ চড়ায় না
রাতুল। বরং অদৃশ্য রঙিন
কাগজের শিকলিতে সে
বেঁধে দেয় আরোও একটু
নৈকট্যের সুর,
' কলেজে রেজাল্ট ভাল কর।
চাচাকে আমি বলবো, তোকে
স্টুডেন্ট ভিসায় ওপাড়ে
পড়তে পাঠাতে।'
প্রেমের রঙিন অন্তরঙ্গ
সে সময়ে দাঁড়িয়ে আমি
খুব নির্লজ্জের মতো
বলেছিলাম,
' আমি যাব তোমার ওই বড়
শহরে।'
আর এর উত্তরে লুকোছাপার
সব ব্যারিকেড ভেঙে
রাতুলও খুব স্পষ্ট করে
বলেছিলো,
' তুই যাবি।'
সময়ের ঘূর্ণনে সেই
অন্তরঙ্গ ছবির উৎসব খুব
তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে
গিয়েছিলো সেদিন।
'এইসব তামসপ্রবাহে
স্নিগ্ধ স্নান সেরে
নাকি এক
বিলুপ্ত জাতির ফের
জাগরণ হবে,
এক কান্তিমান নাকি ফিরে
আসবে আবার উষ্ণীষে,
কিন্তু কই? আমি যতবার
আসি
ততবার ওরা তো আমাকে আজও
হত্যা করে!
হত্যা করে ফেলে!' (আবুল
হাসান)
সেবার দিন খুব দ্রুতই
ফুরিয়ে আসছিলো। যুথী
দিদি সুযোগ পেলেই
গুছিয়ে নিচ্ছিলো নিজের
সুটকেস। তাতে আচার,
ডালের বড়ি, চালকুমড়ার
মোরব্বা, বাড়ির গন্ধরাজ
লেবু। সব পাওয়ার বড়
শহরে যুথী দিদি নিয়ে
যেতে চাইছে বাওড় পাড়ের
এই জনপদের বাওড়ি
হাওয়াটুকু।
খুব নির্বিবাদি
চাওয়া।
কিন্তু নির্বিবাদি
সময়ের মুষ্টিতে তখন যে
এক উত্তাল মুহূর্ত
জমায়েত হচ্ছিলো, তা
অজানা ছিল আমার।
' আজ সকাল দশটায় ভারত ও
বাংলাদেশ 'এ দল' এর মধ্যে
অনুষ্ঠিতব্য ওয়ান ডে
ক্রিকেট ম্যাচ
বিক্ষোভের মুখে বাতিল
হয়ে গেছে'
রেডিও থেকে ভেসে আসা
দুপুরের খবর। নিরালা
দুপুর। কিন্তু আচমকাই
সেদিন নিরালা দুপুরকে
ছিঁড়েখুঁড়ে বেরিয়ে আসে
এক বিস্ফোরক বিকেল।
আমি তখনও ছাদঘরে শুয়ে
লিস্ট করছি; ইমপেরিয়াল
চন্দন সাবান, ল্যাকমে
উইন্টার লোশন। যুথী
দিদি বলেছে, লিস্ট করে
দিতে। সুযোগ পেলেই
কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে
দেবে।
নীচে কয়েকজনের মৃদূ
গুঞ্জরন আমার লিস্টের
ভাবনায় কোনো প্রতিফলন
ফেলছিলো না। আমি মনে
মনে ভেবে চলেছি, এরপর
কোনটা রাখবো লিস্টে,
শঙ্খের গুড়া নাকী আমলা
তেল।
অমুক্ত বাণিজ্যের সে
সময় আমার কাছে এই লিস্ট
ছিল রোমাঞ্চের এক
বর্ণিল ছায়াছবি।
তবে সে ছবিতে রঙের
আরেকটু সমাহার ঘটানোর
আগেই নীচের গুঞ্জরন
কোলাহলে পরিণত।
অনেকগুলো আওয়াজ থেকে
আমি অবলীলায় আলাদা করতে
পারলাম বড় ভাইয়ের
শব্দগুলো,
' ওর হাত পা সব ভেঙে
দেওয়া উচিত ছিল। ওপাড়ে
তো ধরে ধরে কচুকাটা
করছে।'
আমি ত্রস্ত হলাম।
সচরাচর বড় ভাই এত
নগ্নভাবে আক্রমণের কথা
বলেন না। তাহলে নিশ্চয়
ভয়ংকর কিছু হয়েছে।
আমি দৌড়ে নেমে এলাম
ছাদঘর থেকে নীচে।
সেখানে আমাদের বসার
ঘরের সামনে জড়ো হয়েছেন
এপাড়া ওপাড়ার কিছু
আত্মীয়। সাথে আব্বা ও
বড় ভাই। আব্বা বলে
উঠলেন,
' এলাকার পরিস্থিতি ভাল
না। ঘোষ বাড়ির
মানুষগুলোকে দেখলে
মায়া হয়। আতংকে আছে
ওরা।'
আব্বার সেই সমবেদনার
সুরকে ফুৎকারে উড়িয়ে বড়
ভাই বলে উঠলো,
' শুধু ঘোষ বাড়ি নয়, ওদের
সব বাড়ির অবস্থাই খারাপ
হবে। ওপাড়ে যা হচ্ছে
তাতে এলাকার ছেলেদের
কোনকিছুতেই বাঁধা
দেওয়ার দরকার নেই।
নন্দীবাড়ির ছেলেকে যখন
বাজারে ওরা মেরেছে আমি
বাঁধা দেইনি।'
এবার আমার চারপাশে
বাতাসের ঘূর্ণন তীব্র
হলো। আমি ধুলো ঝড়ের
প্রগাঢ় ধুম্রতায়
নিজেকে আবিষ্কার করলাম
ভয়াবহ এক সময়ে।
বড়ভাই রাতুলের কথা
বলছে, বড়ভাই 'টগরকুঞ্জ'র
কথা বলছে।
টগরকুঞ্জ আর এবাড়ির
সীমানা প্রাচীরে জড়িয়ে
থাকা তেলাকুচ লতার
জায়গায় আমি প্রথমবার
কাঁটাতার দেখতে পেলাম।
সে কাঁটাতারে রক্তাক্ত
সময় উপেক্ষা করে আমি
দৌড়ালাম টগরকুঞ্জ'র
দিকে।
' কাকিমা......যুথী দিদি.....'
আমার উত্তাল ডাকগুলো
বারবার মুখ থুবড়ে পড়তে
থাকে টগরকুঞ্জের বন্ধ
দরজায়।
আমি থামি না।
শরীরের সব শক্তি কন্ঠে
জড়ো করে চেঁচিয়ে ডাকি,
' কাকিমা দরজা খোলো।
যুথী দিদি দরজা খোলো।'
আমার চিৎকার থেকে
আকুলতাটুকু আলাদা করতে
পেরেছিলেন নন্দী কাকু।
তিনি এসে উন্মুক্ত করে
দিলেন টগরকুঞ্জ'র পথ
আমার জন্য।
ঝুলে থাকা মুখে স্নেহের
শেষ শব্দটি যুগিয়ে
বললেন,
' সবাই উপরের ঘরে, যা
ওখানে।'
টগরকুঞ্জ'র উপরের ঘরটি
মূলত একটা স্টোর রুম।
শীতের লেপকাঁথা থেকে
শুরু করে বড় বড় কাঠের
বাক্সে ভরা জরুরী বা
মূল্যবান জিনিষ রাখা হয়
সেখানে।
ন্যাপথলিনের গন্ধভরা
সে ঘরে আমি পৌঁছাই
প্রায় হুড়মুড়িয়ে।
কাকিমা আর যুথী দিদি
লেপ তোশক, গরম কাপড়,
কাঁসা পেতলের
বাসনকোসনে তখন
হাবুডুবু খাচ্ছিলো।
আমাকে নিরাশ করে সেখানে
অনুপস্থিত রাতুল। যার
জন্য আমি ছুটে এসেছি সব
কাঁটাতার উপেক্ষা
করে।
' তোমরা দু'জন এখানে কেনো
? বাড়ির আর সবাই কই?'
রাতুলকে একনজর দেখতে
আমি ধৈর্যহারা তখন।
আমার প্রশ্নগুলো
উপেক্ষা কাকিমা মুখ
নীচু করে কাঁসার বাসন
বের করতে থাকেন কাঠের
বাক্স থেকে
।
আমার অসহায়ত্ব দেখে
অবশ্য নিশ্চুপ থাকতে
পারেনি যুথী দিদি।
' দেশের অবস্থা খুব
খারাপ। তুই বাড়ি যা।'
আমি ঢিল ছোড়া জলাশয়ের
মতো দূলে উঠি কান্না
গিলে,
' রাতুল কই.....'
উত্তর আসে নন্দী কাকুর
কাছ থেকে। আমাকে সেই
ছোটবেলায় নাবিস্কো
বিস্কুট দেবার সময়
যেভাবে ডাকতেন অবিকল
সেই একইভাবে বললেন,
' এদিক আয়। তুই এখন বাড়ি
যা। আমাদের এখন অনেক
কাজ।'
নন্দী কাকুর কথাগুলোয়
কিছু একটা ছিল। আমি
সম্মোহিতের মতো সে ঘর
ছেড়ে সিঁড়ির মাথায় চলে
এলাম।
দু'ধাপ নামতেই পেছন
থেকে কেউ ডাক দিলো,
' শোন'
আমার সময় থমকে গেলো।
আমি শক্তি হারালাম
সামনে এগোনোর। যাকে
দেখার জন্য আমি ছুটে
এসেছি তাকে দেখার সাহস
হারালাম আচমকা।
আমার অপারগতা বুঝেই
রাতুলও দু'ধাপ নেমে
আমার পাশে এসে দাঁড়ালো।
এরপর একটা ইনভেলোপ আমার
দিকে বাড়িয়ে বললো,
' সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই
ভিসা নিয়ে পড়তে আসিস
ওখানে।'
যে মানুষের পাঠানো একটা
হলুদ খামের প্রত্যশায়
কেটেছে আমার অজস্র দিন,
তার বাড়ানো সাদা খাম
উদযাপন করার সুযোগ
পাইনা আমি।
ওদের আক্রমণে কালশিটে
পড়া রাতুলের মুখ আমার
বুকের মধ্যে হুহুপাখির
মতো ডেকে ওঠে।
আমি হাত বাড়িয়ে ছুঁতে
চাই সেই ঘৃণার
আক্রমণকে, পারি না। আমি
রাতুলকে নিরীহ
ভালবাসায় লুকিয়ে ফেলতে
চাই, পারি না।
কান্না পরিব্যাপ্ত সে
সময়ের বুক মাড়িয়ে আমাকে
ফিরতে হয় বাড়িতে।
কিন্তু সেদিনের
বিস্ফোরক বিকেলের
গর্ভে জন্ম নেওয়া রাত
ছিল আরোও হিংস্র।
সন্ধ্যার আবছায়া
ডুবতেই মশাল উন্মত্ত
হয়ে উঠলো শিরে আগুন
লাগিয়ে। আর একইসাথে
পরিচিত আওয়াজের অসহায়
আর্ত চিৎকার।
বড়ভাই এক কথার মানুষ।
সে যায়নি কাউকে বাঁধা
দিতে। তবে আব্বা
পারেননি। গিয়ে
দাঁড়িয়েছিলেন হিংস্র
সময় আর টগরকুঞ্জ'র
মাঝে।সবাইকে বুঝিয়ে
শুনিয়ে নিবৃত্ত
করেছিলেন টগরকুঞ্জকে
আহত করতে।
অবাক হবার মতো ঘটনা।
পাশের ঘোষবাড়িগুলো যখন
জ্বলেছে তখন টগরকুঞ্জ
তার সম্ভ্রম বাঁচিয়ে
ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেছে।
জ্বলন্ত সে রাত ফুরিয়ে
গেলে দেখেছি টগরকুঞ্জে
স্থানচ্যুত হয়নি কোনো
জিনিষ। কাকিমার পুজোর
ধূপদানী থেকে উপরের
ঘরের লেপ তোষক বা
কাঁসার বাসন----কোন
কিছুরই জায়গা পরিবর্তন
হয়নি।
কিন্তু টলে যাওয়া
আত্মবিশ্বাসী সময়ের
রূঢ়তায় শুধুমাত্র সে
বাড়ির মানুষগুলো নিবাস
ছেড়েছে নিভৃতে।
সেদিনের পর থেকে আব্বা
দায়িত্ব নিয়েছিলো
টগরকুঞ্জ দেখাশোনার।
আর মৃত্যূসময়ে আমার
প্যারালাইজড বাবা
কাঁদতে কাঁদতে
টগরকুঞ্জ'র দায়িত্ব
দিয়ে গেছেন আমাকে,
' ওদেরকে ফিরিয়ে এনে
বাড়িটা বুঝিয়ে দিস।'
দূরে বসে প্রবাহের
অন্তর্গত আমি, তাই
নিজেরই অচেনা নিজে
কেবল দিব্যতাদুষ্ট
শোনিতের ভারা ভারা
স্বপ্ন বোঝাই মাঠে
দেখি,
সেখানেও বসে আছে
বৃক্ষের মতন একা একজন
লোক,
যাকে ঘিরে বিশজন দেবদূত
গাইছে কেবলি
শতজীবনের শত কুহেলি ও
কুয়াশার গান!( আবুল
হাসান)
টগরকুঞ্জে ওরা কেউ
ফিরবে কীনা আমার জানা
নেই।
এখনো প্রতিমাসে আমি
একটা করে চিঠি লিখি
হলুদ খামে।
উত্তর আসে না
চিঠিগুলোর। আমি কিন্তু
রাতুলের দেওয়া ঠিকানা
মিলিয়েই চিঠিগুলো
পাঠাই।
সেই সাদা ইনভেলপের
ছোট্ট চিঠিতেই ছিল
ঠিকানা।
'আয়েশা,
আমরা চলে যাচ্ছি
দু'দিনের মধ্যে। সবকিছু
এভাবে হুট করে বদলে
যাবে আগে বুঝিনি। তাই
তোকে বলা হলো না অনেক
কথা। একবারে তো সব নিয়ে
যাওয়া সম্ভব না, তাই
জরুরী কিছু জিনিষ, কিছু
কাঁসার বাসন নিয়ে যাবো।
বাকী জিনিষ তোদের
জিম্মায় রেখে যাওয়া
হবে। সব ঠিক হলে আসবো,
তখন বাড়ি বা জিনিষের
ব্যবস্থা করা হবে।
আমি ঠিকানা দিয়ে
যাচ্ছি। তুই যোগাযোগ
করিস।
হ্যাঁ, তোর সাথে বলার
অনেক কথা জমেছে, চিঠিতে
বলবো।
ইতি
রাতুল
৭ই ডিসেম্বর ১৯৯২
ঠিকানা:
রাতুল নন্দী
১৬০, শ্রী অরবিন্দ
সরণী
কলকাতা- ৭০০০০৬'
চিঠির উত্তর না পেয়ে
প্রথম প্রথম খুব অভিমান
হতো। এরপর আসতো অভিমান
মিইয়ে রাগ।
কিন্তু গত তিন বছর রাগ
বা অভিমান কিচ্ছু আসে
না আমার।
আমি আব্বার দেওয়া
দায়িত্ব থেকেই এখন হলুদ
খামে প্রতিমাসে নিয়ম
করে চিঠি পাঠিয়ে যাই
সেই ঠিকানায়।
জানি না মৃত্যূ সময়ে
আব্বার কী হয়েছিলো,
কেনইবা আমাকেই তিনি
বেছে নিয়েছিলেন তাঁর
জীবনের সবচেয়ে গোপন
কথাটি জানাতে।
' নন্দীদের তুই ফিরিয়ে
আনিস। সেই রাতে
টগরকুঞ্জ রক্ষা করার
বিনিময়ে আমি পাঁচশ
টাকার স্ট্যাম্পে
লিখিয়ে নিয়েছিলাম,
সজ্ঞানে নন্দী এই বাড়ি
আমাকে দিয়ে গেলো।
টগরকুঞ্জ'র সকল অধিকার
ওরা ত্যাগ করলো।
ওদের সাথে আমি খুব
অন্যায় করেছি।'
আব্বার সেই
স্বীকারোক্তি থেকেই
আমি জানতে পেরেছিলাম
দু'দিন পর যাবার কথা
থাকলেও সব ফেলে কেন সে
রাতেই ওরা চলে
গিয়েছিলো।
সেদিনের পর থেকে
রাতুলকে লেখা চিঠিতে আর
আমার বিরহদিনের কথা
থাকে না। শব্দগুলোতে
এখন গুঁজে দেই একসমুদ্র
অনুশোচনার
আদ্যপ্রান্ত।
ও হ্যাঁ, বলা হয়নি,
জ্বলন্ত সে রাতে
টগরকুঞ্জ না জ্বললেও,
পুড়ে গেছে টগরগাছটা,
কারো ছুড়ে দেওয়া
উন্মত্ত আগুনে।