সতত ভেঙ্গে যায় আলোর
বৈভব
এখানে ছকে বাঁধা খুনের
উৎসব
গাছেরা থিতু কিছু
ভূমিকা নেবে বলে
স্রোতের কথকতা পাথর
ভেঙ্গে চলে
আহা! কী উল্লাসে কথক একা
হাঁটে
আহা, কী বিষাদেও কথক
ভিড়ে মেশে
যে আলোটা মরছে বিকেলের
ঠোঁট ঘেঁষে, ওর কেউ নেই।
এর’ম বিকেল মরলে কেউ
থাকেনা। জানেইনা। কশ
বেয়ে রক্ত। পাখিরা মুছে
নিচ্ছে ডানায়। তাদেরও
থামতে নেই। অনেকগুলো
হাঁ-ঠোট অপেক্ষায়।
প্রচণ্ড চাপ, বুকের
মাঝখানে, অসহ্য। অথচ
বিকেল, পেরোচ্ছিল। আগের
রাত থেকে। ভোর আর সকাল
পেরিয়ে। দুপুর জ্বলতে
জ্বলতে। আলোটা বিকেলের
বুকের কাছে এসছিল। আলোর
ট্যাঁকে গোঁজা ক’টাকার
মুড়ি আর হাতে খালি জলের
বোতল। সারারাত
পেরিয়েছে আলো। ধানের
শীষে দুধ আসা দেখেছে।
বুনো হাতি সেই ধানের
গন্ধে আসে। ভোরে
শিশিরের জলছাপ মেখে
পেরিয়েছে বাদাড়। সে ছাপ
এখনও রয়েছে। জলছাপের
পাশে কবিতা লিখছে কেউ।
ট্রেন যাচ্ছে। রেলপথ
ধরে চলকাচ্ছে আলো।
রেলট্র্যাক চমকে উঠছে।
কিছু রুটি আর আচার
সেখানে ফেলে আলো
যাচ্ছিল আরও পুবে।
পশ্চিমে তখন অন্ধকার।
উত্তরে অনির্বাণ চিতা।
দক্ষিণে মহাসমাধি। আরও
পুবে যেতে হবে। ওখানেই
ঝোপঝাড় ঠেলে কবেকার
বসতি। শ্যাওলা ছেৎরে,
ভাঙা টালি, সার জল
না-পাওয়া চারাগুলো
শুকিয়ে লোহা। লোহার কথা
ভেবে আলো দুপুরের দিকে
এগোচ্ছে। তখনই কি মরচের
মতো কশ বেয়ে খানিক বমি?
হাইওয়ে জুড়ে বাদাড় জুড়ে
পথ ছুটে যাচ্ছে। নম্বর।
হাইওয়ের নম্বর আছে।
আলোর তাও নেই। শুধু
পুবে ছুটে চলা। আলো
বিকেলের বুকে এসে মাথা
রাখছে। দেখো, ওর
মৃত্যুমুহূর্ত দেখো।
বুকের মাঝে ওই অসহ্য
ব্যথা। আলো ঘামছে।
হাতের বোতল খালি।
বৃষ্টি নেই, সেই
সিনেমায় বৃষ্টি ছিল,
নায়ক হাসছিল গালে টোল
ফেলে। এখানে বৃষ্টি
নেই। বিকেলের ঠিক আগে
রোদের তেজ বাড়ে। আলো
নিজেকে আড়াল করে
নিচ্ছিল দুপুর থেকে,
বিকেলের আগের ওই
ছন্দ-মেলানো
স্মৃতিকামুকতা থেকে।
হাঁ-মুখ গুলো জেগে।
তাদেরই জন্যে ভিটে ছেড়ে
যাওয়া, আসা সেই ভিটের
টানেই। নীড়ের মতো চোখ,
না; শ্রাবস্তীর
কারুকাজ, না। বিকেলের
আলো মরে আসছিল দ্রুত
পদক্ষেপে, ক্লান্ত আরও
ক্লান্ত শরীরে। বুকের
মাঝখানে ওই অসহ্য
ব্যথায় শরীর এলোয়।
পায়খানা হয়ে যায় মরার
আগেই। বিকেলের ঠোঁট
ঘেঁষে আলো মরে যায়।
তারপর ঠোঁটের কষ বেয়ে
রক্ত নেমে আসে। আলো
ফিরতে চেয়েছিল
সন্ধ্যেয়। পাখিরা মুছে
নিচ্ছে ডানায়। সবাই
ফিরছে। আলো ফেরে নি।
বিকেল শেষ হচ্ছে। রোজ
বিকেল মরে। একা।
“...আরো কিছুক্ষণ পরে
তাহাদের সে ভিটায়
সন্ধ্যার অন্ধকার হইয়া
যাইবে, কিন্তু সে
সন্ধায় সেখানে কেহ সাঁজ
জ্বালিবে না, প্রদীপ
দেখাইবে না, রূপকথা
বলিবে না।
...চোখ মুছিতে হাত উঠাইয়া
আকুল সুরে মনে মনে বলিল-
আমাদের যেন
নিশ্চিন্দিপুর ফেরা হয়-
ভগবান তুমি এই কোরো, ঠিক
যেন নিশ্চিন্দিপুর
যাওয়া হয়- নৈলে বাঁচবো
না, পায়ে পড়ি তোমার-
পথের দেবতা প্রসন্ন
হাসিয়া বলেন-
দিন রাত্রি পার হয়ে,
জন্ম মরণ পার হয়ে, মাস,
বর্ষ, মন্বন্তর, মহাযুগ
পার হয়ে চ’লে যায়...
তোমাদের মর্মর
জীবন-স্বপ্ন
শেওলা-ছাতার দলে ভ’রে
আসে, পথ আমার তখনও ফুরোয়
না... চলে... চলে... চলে...
এগিয়েই চলে...
অনির্বাণ তার বীণ শোনে
শুধু অনন্ত কাল আর
অনন্ত আকাশ...”
এখন জেগে নেই, কেউই জেগে
নেই
খোয়াবে পথ খোঁজে
ভাঙাডানা
কিছুটা ঘুমঘোরে সময়
পুড়ে গেছে
কথন তবু জেগে, কথকেরা?
যে লিখছে, একা, লিখুক। ওর
পাপ কমে যাচ্ছে। দুঃখ
ক্ষইছে। বিষাদ ক্রমে
বদলে যাচ্ছে সুখের
নিশ্বাসে। একাই,
ক্রমাগত একা হয়ে যেতে
হবে। শোক থেকে আলো
জ্বলে না আর, ক্রোধ
জাগে। তুমি যাকে
বিষাদের আলো বলে জেনেছ,
সে আমার না হতে পারা
ক্রোধ। কোমলতা কোথাও
জাগেনি। ক্রমশঃ মুছে
যাচ্ছে। বহু মাস পরে
বিষাদ বলে কোনও শব্দ
থাকবে না। একলা মানুষ
সান্ধ্য গলিপথে ফিরবে
ঘরের দিকে, তার মানে
তৈরি হবে। বিপন্ন
স্বদেশ দেখে কেঁদে ফেলা
তরুণের কাটা মাথা নতুন
শব্দ দেবে। ক্রোধের আগে
অসহায় চেপে বসে যাবে।
শোক নদী হয়ে বইতে
থাকবে। অক্ষরের জন্যে
নয়, শোলোকের জন্যে নয়।
প্রত্যেক মানুষের
শরীরে কাঁটাতার। যে
ভাষা আগে ঠোঁটের পাশে
তিলের ভেতর মিশে যেত,
তারা শোক আর ক্রোধের
ভেতর কোথাও। পার্ব্বণ
সমস্বর কেড়ে নিয়ে গেছে,
যেমন কাটা হয়ে গেছে
পুরুষ্টু নিমগাছ।
গর্ভবতী বিদ্রোহিনী
একা, সলিটারি
কনফাইনমেন্ট। মিছিল
থেকে ফিরেছে যারা,
ভার্চ্যুয়ালে বন্দি।
অনন্ত পরিযানে গেছিল
যারা, তারা খুন হয়ে গেছে;
অদৃশ্য ছোরা গঙ্গাজলে
ধুচ্ছে রাষ্ট্র। একা
মৃতদেহ উদ্ভাসিত মাছির
ঝাঁকে ঢেকে ফিরছে। এইসব
অন্ধকার কে লিখছে? যে
লিখছে সংক্রান্তিতে,
একা; যে লিখছে মাটিতে
মুখ থেঁতলে যাওয়া চোখের
ভাষা, একা- ওরা ক্রোধ
লেখে। সেই সব লেখা কোনও
পাপবোধে জেগে। সময় কেমন
একাই পুড়ে যায়।
ডানাভাঙ্গা কথন সমস্ত
একার উড়ান জড়ো করছে।
কথককে খুঁজছে। কোনও
মিথুনাবদ্ধ পরিযায়ী
ক্রৌঞ্চক্রৌঞ্চী কথক
পেয়েছিল। একলা কথক।
শোলোকেরা থাকবে না। কথক
ডুবে যাবে। তবু ভেসে
থাকবে যে লেখা, জেগে
থাকবে যে কথামুখ; কথক
জানবে- ৭টা রিয়াক্ট আছে-
লাইক, লাভ, কেয়ার,
স্মাইল, ওয়াও, স্যাড,
অ্যাংরি
আয়নার সামনে দাঁড়াতেই
হয়। একা। সমস্ত রিয়াক্ট
আর শ্লাঘা পেরিয়ে
দাঁড়াতে হয়। নামিয়ে
রাখতে হয় ইগোধোয়া
শস্ত্র। ক্ষতমুখ খুলে
রক্তমাংসে আলোহাওয়ার
স্পর্শ দিতে হয়। হিসেব
নিতে হয় কতটা তীক্ষ্ণ
ফলা বিঁধেছে মৃত্যুভয়ে,
কতটা দিতে পেরেছি ছুঁড়ে
অন্যের আঘাত বিষিয়ে
দিতে। নির্লিপ্ত ভান
ক’রে থাকা যুদ্ধগুলোয়
রক্তপাত সবচেয়ে বেশি।
শোক না ক্রোধ ঠিক করা
যায়না যখন, সে মুহূর্তে
সবথেকে একা।
শ্রেণিসুখী অবস্থান-
নিজেদের বন্দি ক’রে
নেওয়া স্বরচিত বৃত্তে।
একা আরও। মেনে নেওয়া
যাবতীয় অনুশাসন। একার
মতো বাঁচতে শিখে যাওয়া-
সামাজিক দূরত্ব শব্দের
বিষ। খোয়াব দেখতে দেখতে
দড়ির ফাঁস খুঁজে নিয়েছে
কাজ-হারানো ভারত।
খোয়াবে ক্লান্ত হয়ে ২০০
কিলোমিটার হাঁটার পরে
মরে গেছে ভারত। লকডাউন
এক মৃত ভারতবর্ষের
মুখের ওপর থেকে সাদা
চাদর সরিয়ে দিয়েছে। সেই
ভারতবর্ষের কপালে
সেলাই, পাঁজর ফাটানো,
পোস্টমর্টেম হচ্ছে।
লাশকাটা ঘরে, ভারতবর্ষ
একা। এসময় ঘরে আয়না
রাখা চলে না। আয়নার
সামনে ঢং চলে না।