প্রথম দিকে বেশ আলস্যে
কাটছিলো দিনগুলো। এক
একটা দিন যেন শীতের
দুপুরে বারান্দায় বসা
দোলনাটার ঝুলন গতি
সমান। সকলের মতন আমিও
নিজেকে খানিকটা যাচাই
করার মরশুমে প্যালেটে
সবুজ রঙ চড়ালাম, তিনটে
ছন্দ বিহীন কবিতা লিখে
ভোররাতে শুতে গেলাম।
সমরেশ থেকে শক্তি এবং
ভিনচি থেকে বেগম আখতার
সবাইকেই বেশ সকাতরে
আওহ্বান জানাতে হয়েছে
সময় কাটানোর জন্য।
আজ মনে হচ্ছে, সময়
কাটানোর জন্য কি শুধু
মাত্র ছিলো অত আড়ম্বর?
নাকি একাকিত্ব বস্তুটি
যাতে সেই রাতগুলোয়
বেসামাল হয়ে একেবারে না
ঘাড়ে চেপে বসে, তার
অজ্ঞাত প্রচেষ্টা
চালিয়ে গেছি বারবার?
ভাগলপুরের সোঁদা
গাছমাটির কোলে বসে
বিভূতিবাবু সৃষ্টি
করেছিলেন আরণ্যক। অথবা
রাস্কিন বন্ড, যিনি
মুসৌরির কোনো এক চুপ
মাখানো আইভী কটেজে বসে
লিখে গেছেন তার পাহাড়ি
ছোটগল্পগুলি। আজ মনে
হয়, তাঁরাও হয়তো কোনো এক
শুক্রবারে পূর্ণিমার
হলদে চাঁদের মতন একা
বোধ করেছেন। গ্রাস করতে
দেননি সম্ভবত, তবে কোনো
কোনো রাত তাদের হয়তো
এসেছিল, যাতে অবাঞ্ছনীয়
অনাদর মেশানো স্তব্ধতা
বিড়ম্বিত করেছে
বারবার। হানা দিয়েছে
তখন, অশনি সংকেত
হয়ে...ঘরে ফেরার চাতক
ডাক, সেই অনাহুত
বিড়ম্বনা থেকে রক্ষা
পেতে।
আজ মনে হয়, বাইরে থাকতেও
কম একা কিছু ছিলাম না।
তবে বন্ধুদের বা
পরিবারের বাড়িয়ে দেওয়া
নরম পশমে সেই অসহনীয়
ব্যথা ভুলিয়ে দেওয়ার
দায়িত্ব ছিলো প্রাথমিক
ভাবে তাদেরই, এখন যা
কেবলমাত্র
শীর্ষেন্দুতে মুখ
গোঁজা আমার-ই দুটি
দুর্বল কাঁধের উপর।
মাঝে মাঝে মনে হয়, এই
বেশ, ছেলেবেলার গরমের
ছুটি আরো বাড়ালে যেমনটা
মনে হয়। গোটাটা থেকে
যেন ছুটি, রামধনু
রাঙানোর এই বুঝি সময়।
আবার মাঝে মাঝে পাতার
পর পাতার ফর্সা ধবধপে
থেকে যায়, নেরুদা
বিড়বিড় করে আওড়ানোর বা
তুলিটা উঠে গিয়ে ধোয়ার
ইচ্ছেটাও আর থাকেনা।
ইজিপ্টের লুকোনো
টুম্বের মতন অনেকেই একা
এই বিধ্বংসী ভাইরাসের
কবলে পড়ে। কিছু মানুষের
বাড়ির কোনে নিঃসঙ্গতার
সান্ধ্য আলো ছাড়া কোনো
কিছু চোখে পড়েনা। তাদের
কাছ থেকে এই বিরতিতে
আরণ্যক আশা করাটা এক
স্পর্ধাই বটে। কারণ
তাদের জন্য মানসিক
দ্বন্দ্বগুলিকে অবদমন
করাটাই আজকে দাঁড়িয়ে এক
বিরাট সংঘর্ষ। তাই
একাকিত্বটা ভেবে দেখতে
গেলে ভিন্ন মানুষের
কাছে ভিন্ন স্বাদের
পরমান্ন। কিছু দিনে
অনামী লেখকের মতন
সৃষ্টিশীল, আবার অন্য
দিনগুলোয় সঙ্গহীন, যেন
বহুদূর বিস্তৃত
সাহারার প্রান্তর
সমান।
এতদিন ধরে শৈলী প্রচার
করতে করতে আজ ক্লান্ত
আমি। কালো এগিয়ে আসা
দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে
বড় বিষন্ন মনে হয়।
কালকের দিনও যে আজকের
থেকে কিছু বহুরূপীভাবে
আলাদা হবে, এই ভাবনা আর
খেলে না। প্রত্যেক
মানুষ একা এসেছে, এবং
একা তাকে যেতে হবে। তবে
এই রূঢ় সত্য আগলে ধরে
রুটিন মাফিক বাস করাটা
যেন অসহনীয় হয়ে
দাঁড়িয়েছে। এখনো রাত
গুনে চলেছি এই আশায়, কবে
টুম্ব খুঁড়ে শোনাবে কেউ
ভেজা বাতাসের গান। কবে
আবার ট্রাম বাসের
ক্যাকোফোনিতে ভুলতে
বসবে এই অবোধ মন, যে
দুর্বিষহ ভাবে
গৃহবন্দি না হলেও আসলে
কতটা একা আমরা সকলেই।