রাজকুমার
মায়ের আঙুলের মধ্যে
নিবিড় হয়ে বসে আছি।
আমার লাল রঙের
পাপড়িগুলো এখনো চোখ
খোলেনি। কিছুই দেখতে
পাচ্ছি না। মা বলেছিল,
পাপড়ি খুলে গেলেই নাকি
আমাকে এসে নিয়ে যাবে
পচ্ছন্দের 'সে'।
তুমি যেদিন এলে, সেদিন
আমার ভাই বোনেরা অনেক
উঁচু ডালে। নাগালের
মধ্যেই ছিলাম, তাই টুক
করে পেড়েও নিলে। তোমার
হাতের মুঠোয় আমি আমার
ডানা মেলে শুয়েছিলাম।
খুব আদর করছিলে। আবেশে
ভেসে যেতে যেতে হঠাৎ
তোমার হাত থেকে আমি
ফসকে গেলাম মাটিতে। আর
মুহূর্তে ঘন মেঘের ফাঁক
দিয়ে তোমার ঘেন্না-ভরা
চোখটা যেন দেখতে
পেলাম।
মাথায় জরির টুপি, কোমরে
তরোয়াল। পাতলা ঠোঁটের
ওপর মোম দিয়ে পাকানো
গোঁফে রোদ্দুর মাখতে
মাখতে, এত জোরে মাড়িয়ে
দিয়ে চলে গেলে কুমার!
আমি তো তোমায় কিছু বলতে
পারিনি কারণ খরগোশ বা
জিরাফের মতোই আমাদের
যন্ত্রণা প্রকাশের
কোনো ভাষা নেই। প্রকৃতি
'মা' হয়েও নিজের হাতেই তা
কেড়ে নিয়েছে এক
বৃষ্টিভরা মধ্যরাতে।
যদি নিজের যন্ত্রণা
নিজেই আঁকতে পারতাম
তাহলে বলতাম, একটু
আস্তে তোমার নাগরার চাপ
দাও কুমার! আমার বড্ড
কষ্ট হচ্ছে! তুমি কেন
বুঝতে চাইছ না, আমার
লালরঙা পাপড়িগুলো আরও
লাল হয়ে উঠছে--- যেন
সূর্যাস্ত।
শিক্ষার্থী
মরুভূমি আর সাদা মেঘের
মধ্যে পাতলা সুতোর ভেদ
রয়েছে। সেই সুতো সীমানা
এঁকে হাসে, খিলখিল করে
এগিয়ে যায়। তার ঢেউ
নাচতে নাচতে এগিয়ে আসে,
পিছিয়ে যায়। মাঝে মাঝে
আঁচড় কেটে দেয় গভীর
বালিখাতে। মরুভূমি আর
মেঘেরা একে অপরের মুখের
দিকে চায়।
সূর্যের তাপে জ্বলে
পুড়ে খাক সেই আবছা জমির
উপর দিয়ে হাঁটে
তীর্থযাত্রীরা।
হিংলাজের আগে এক কাদার
পাহাড় সেখানে বুক অবধি
ডুবে তারা আহবান করে
পুণ্যের। এদিকে মরু
তাকায় মেঘের দিকে।
সামান্য জলের আশায়।
সাদা ধবধবে মেঘ, কী বা কম
আছে তার। পেঁজা তুলোর
সর যেন দুধেল গাভীর
প্রেম। অথচ জল নেই,
বৃষ্টি নেই। যেমন
সোনালী ঢেউ খেলানো চিতা
তেমন সাদা ফাঁকা বলয়।
মাঝখানে বয়ে যাওয়া
অতলান্ত জল যার ডানায়
লেগে নোনতা স্বাদ।
খিলখিল করে হাসে সে।
মেঘের বা মরুর পাওয়ার
কিচ্ছু নেই। তাদের কোনো
ক্ষমতা নেই। না আছে জল
দেবার শক্তি, না আছে
সবুজ অরণ্য পাবার
আনন্দ। তারা জ্বর গায়ে
একে অপরকে শূন্যতা দেয়।
সমুদ্রের ঢেউ হেসে
এগিয়ে আসে। এক নম্বর, দু
নম্বর, তিন নম্বর করে
শূন্য সংখ্যা ধরে ফেলে
সে। অকৃত্রিম অকৃপণ
অগুনতি জলরাশি এসে
বালির বুক ঠান্ডা করে।
চুপ করিয়ে দেয় যা কিছু
সরব, যাদের কাছে শূন্য
নেই। অঙ্ক জুড়ে পৃথিবী
কুঁচকে ওঠে। টেথিসের
নাড়িভুড়ি ছুঁতে চায়
উচ্চতা। হাজার লক্ষ
কোটি অযুত বর্ষ ধরে
তৈরি হয় পামির,
কারাকোরাম।
মরু শুয়ে থাকে মেঘের
সময় ধরে। তাদের কিছু
পাওয়া হয় না। অগুনতি
ঢেউ তাদের শূন্য আর
পূর্ণ সংখ্যা থেকে দূরে
পাঠায়। উচ্চতা আর
নৈঃশব্দ্য তাদের নাম।
যাদের কিচ্ছু নেই তারা
একদিন পাহাড় শিখে নেয়।
ইডিপাস
পরি দেখতে পাচ্ছিলো
ছেলেটা। খাটের তলায়,
জানালার পর্দার ভাঁজে,
রান্নাঘরের এঁটো
বাসনে। সে জ্বর গায়ে
মাথা ধুয়ে পোশাক বদলে
এসে গুটিশুটি মেরে বসে
পিড়ে পেতে। মা থালাতে
ভাত দেন। জল দিয়ে
নাড়াচাড়া করে দানা।
থালার মাঝখানে আঁকে
জিনের লম্বা চুল। বিকেল
পড়ে, ভাতের থালা
শুকোয়।
মায়ের কোমর ছড়ানো চুল।
নাকে মুখে লাগায় সে।
হাঁ করা মুখের ওপর
মাছিটা উড়ছে। নাকের
নাকছাবির পাশে সাদা
পুঁজ। ভন ভন করে মাথার
মধ্যে মেয়েগুলো। কারোর
সাদা ধব ধবে গাল, কেউ বা
একটা ডানা ছেঁড়া, কেউ
বা অন্ধ। মায়ের আঙুলে
সাদা শাখার আংটা। মা
সারাদিন চুপচাপ শুয়ে
থাকবে এভাবে চুল খুলে।
আর তার ইচ্ছে করছে
ওভাবে তার বুক পেট
শান্ত জলে ভেসে ওঠানামা
করবে। কিন্তু চুলগুলো
বজ্জাত। সারা শরীর
টলছে। ছেলেটা ধীরে ধীরে
বঁটিটা নামিয়ে রাখে।
নরদমা দিয়ে সরসর শব্দ।
এগুলো পুড়িয়ে ফেললে মা
বকবে। ঘরের পাশে মাথাটা
রেখে এসে সে আবার বসে
পিড়িতে। ভাত ঢেলে দেয়,
মায়ের মুখেভাত হোক। মা
তাকে মা ডাকবে। বাবা কে
এভাবে আর কাছে আসতে
দেবে না। আড়াআড়ি মাছ,
শোয়ানো। জ্বরের ধোঁয়া
পাকিয়ে উঠে যাচ্ছে
পরিরা। সবাই চলে
যাবে,বাবা ঘরে ফিরবেন।
নাগিনী
মণির মাঝখান দিয়ে যে
সাপ ধীরে ধীরে এগিয়ে
আসে তার পক্ষে বন্দরে
নামা কঠিন। একটা জাহাজ
রাত ভেঙে উপুড় করে
দিচ্ছে নিজেকে ডকে। অথচ
সব মানুষ ঘুমাচ্ছে।
তাদের চোখ খোলা। অথচ
গভীর ঘুম নেমে এসেছে
শরীরে। এমন ভাবে নদীর
উপর ঘাম জমতে থাকে।
জাহাজের সাইরেন কাজ করে
না৷ জল আর জেটির মধ্যে
সামান্য ফাঁক। সাপটা
হিলহিল করে এগিয়ে যেতে
থাকে। দূরে জটিল
অন্ধকার যার একপাশে
সরাইখানা। সেখানে সবাই
চিরকাল জেগে থাকে। সাদা
শিশুরা বই খুলে দুলে
দুলে পড়ে অ, আ ই। তাদের
মৃদু হাসি দেখে সাপটা
চুপচাপ এগোয়। চাঁদপুর
নামের এ গ্রামে আজ মোড়ল
রানিমা নেই। কারা যেন
বলেছে দিনের পর দিন
নাসার অতিথিদের সাথে
বসতে বসতে তিনি
পালিয়েছেন। বাঁকা
বৃষ্টিপাতের লালচে
দানা ছড়িয়ে পড়ছে ঘরে।
তবু বহাল তবিয়তে মন্দির
ভেঙে পেঁচিয়ে নিচ্ছে
শাড়ি সাপটা। চারদিকে
জমছে বাড়ন্ত চাল। কেরি
ভর্তি সেই চালের পাশে
রাখা নদী। জাহাজ সরে
যেতে থাকে। সাপটা
চুপচাপ দরজায় দাঁড়ায়।
ব্যাগ নিয়ে লোকটা
গাছতলায় এসে জল খায়।
জাহাজ আর নদীর পথে পিছল
আলো ছড়িয়ে গাছতলা
শুদ্ধু সংসারে ফিরে
যাচ্ছে লোকটা, তার
পিছনে পাঁচ কেজি চাল।