আমি একটা সমস্যায়
পড়েছি। লিখতে চাইছি
মানুষের গল্প অথচ একটাও
মানুষ দেখতে পাচ্ছি না।
এটা আমার চোখের দোষ
অথবা মানুষদের নিজেদের,
সেটাও ঠিক বুঝতে পারছি
না। দিনরাত চোখের সামনে
কিছু দু'পেয়ে জীব
ছোটাছুটি করতে করতে
কাটা পড়ছে, কিছু তাদের
নিয়ে খবর করছে গলা
ফাটিয়ে আবার আরো কিছু
দু'পেয়ে জীব খবর নিয়েও
ফেঁদে ফেলছে জবর জবর
মিথ। মিথগুলো বড় হয়ে
উঠছে খুব দ্রুত আর
একবার সাবালক হলেই
ছড়িয়ে পড়ছে তারচেয়েও
দ্রুত। ওদের বংশবৃদ্ধি
ইঁদুরকেও হার মানায়।
যাক সেসব, আমার
মুশকিলটা হল আমার
গল্পের নায়ক বা নায়িকা
যাই বলুন, তার জন্য একটা
মানানসই নাম কিছুতেই
খুঁজে পাচ্ছি না। আপনি
বলতেই পারেন, গল্পটা
যখন আপনার তখন পছন্দমতো
একটা নাম দিয়ে দিন না,
আটকাচ্ছে কে? আপনি তো
মশাই বলেই খালাস। এদিকে
ভেবে ভেবে আমার হাড়ে যে
দুব্বো গজিয়ে গেল। শেষে
হাল ছেড়ে আপনাদের
শরণাপন্ন হয়েছি। এবার
আপনারাই ঠিক করবেন আমি
যে নামটা ওর দিয়েছি তা
ঠিকঠাক হয়েছে কিনা।
ব্যাপারটা খুলে বললে
হয়ত বুঝতে পারবেন।
আমি যার কথা বলছি তাকে
এমনই অদ্ভুতুড়ে দেখতে
যে কিছুতেই ওর দিকে
তাকাতে ইচ্ছে করে না।
অথচ একবার দেখে ফেললেই
বারবার দেখতে ইচ্ছে
করে। করবেই, এ কথা হলফ
করে বলতে পারি যে যদি
একবার ভুল করেও তাকিয়ে
ফেলেন কিছুতেই আর ওকে
অস্বীকার করে নিজের
চোখদুটোকে বশে আনতে
পারবেন না। মন আপনার
চোখদুটোকে ক্রমাগত ওর
দিকে ঠেলবেই তা মগজ যতই
বাধা দিক না কেন। জানি
জানি এখনি আপনি হা হা
করে বলে উঠবেন, মন আর মগজ
তো একই জিনিস বাপু।
কিন্তু এটাও তো মানবেন
ওসব সাহেবিয়ানা আমরা
ততটা মানি না। ফলে মন আর
মগজের অভিন্নতা আমরা
স্বীকার করি না। আর
জানেনই তো পৃথিবীতে
সবচেয়ে অচেনা বস্তুটি
হল আমাদের নিজেদের মন।
কখন যে কোন্ দিকে
পাল্টি খাবে তা আমরা
নিজেরাই জানি না। অগাধ
পড়াশোনাও তখন বে-জান
জড়ের মতো মগজের এককোণে
পড়ে থাকে যেন কোনোদিন
ওগুলো কোনো কাজে লাগার
জন্য তৈরিই হয়নি। তার
ওপর ওর রূপের যা বাহার!
বারবার না তাকিয়ে উপায়ই
বা কী? ওকে দেখলেই আপনি
বুঝতে পারবেন কিছুটা
অংশ মানুষের মতো,
কিছুটা মাছের মতো,
কিছুটা পাখির মতো আর
কিছুটা গৃহপালিত
ছাগলের মতো একটা
প্রাণীকে নিয়ে আমি কী
বিড়ম্বনাতেই না পড়েছি।
চাঁদনি রাতে ও চাঁদটাকে
সুস্বাদু বিস্কুটের
মতো ভেঙে ভেঙে খায়। ওর
মতে চাঁদ আধখানা হলে
চাঁদের আলোও আধখানা হয়ে
পড়ে এবং ঐ আধখানা আলোয়
জগতের দিকে তাকালে
জগতটাকে দেখায় ঠিক যেন
আধখাওয়া একটা আপেল বা
কমলালেবু বা এরকমই কিছু
একটা। মোটের ওপর যা
দেখলে আমাদের মনে হতে
পারে আধখাওয়া এঁটো
জগতটাকে সাজিয়ে রাখার
বদলে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে
ফেলাই ভালো।
এরকম অদ্ভুত ভঙ্গিমার
ভাবনাচিন্তা নিয়ে
জন্মানো কোনো জীব
আমাদের আশেপাশে থাকাটা
কোনোভাবেই সমর্থন
যোগ্য নয় এই বোধে একদিন
ওকে যে আদপেই পছন্দ করি
না এ কথা স্পষ্ট ভাবেই
জানিয়ে দিয়েছিলাম।
শোনার পর পুরো একটা দিন
কিছুটা সময় ও
ঘ্যানঘ্যান করেছিল
নাকে সিকনি নিয়ে
খিদেকাতর নোংরা শিশুর
মতো, কিছুটা সময় ঘাড়
বেঁকিয়ে এমন ভাবে
বসেছিল যেন গ্রীষ্মের
প্রবল দুপুরে জ্বলে
গেছে মস্ত একটা শিশু
গাছ। তারপর ধরুন কিছুটা
সময় এমন একটা ভাব নিয়ে
বসে ছিল যেন মনে হচ্ছিল
সাগরের হাজার হাজার
মাইল নিচে দুটো ঘোলাটে
চোখ ফুটে উঠেছে কোনো
ভুলে যাওয়া পাথুরে
ফসিলের মুখে। আর অবশ্যই
বাকিটা সময় ও কাটিয়েছিল
চোখ বুজে কাঁঠাল পাতা
চিবুতে চিবুতে।
ভগবানের কৃপায় বলতে নেই
আমার বাগানে গাছগাছালি
কিছু কম নেই আর
কাঁঠালপাতা তো
পর্যাপ্তই আছে শরীরের
কিছুটা অংশ ছাগল সদৃশ
এমন একটা জীবের জন্য।
কিম্ভুতকিমাকার এইরকম
একটা ইয়ের কোনো নাম হয়
কি? আমি তো মশাই ভেবে
ভেবে হেরে গেছি। শেষে
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ওর
নাম রেখেছি
প্রোটাগনিস্ট। ভালো না
নামটা? যদিও এই
অতিমানুষী নাম ওর
একেবারেই পছন্দ নয়। তবু
আমি লাচার ওর মতো
অমানুষীর জন্য কোনো
কাল্পনিক নাম ভেবে
ফেলতে।
##
ধরুন কোনোদিন বিকেলে
নিজেকে তরতাজা করতে
বেরিয়ে হাওয়া খেতে খেতে
আপনি আমার বাড়ি এসে
পড়লেন। আহা, বন্ধু
মানুষ যখন, তখন তো
বন্ধুর বাড়ি আসতেই
পারেন। ধরে নিন চলেই
এলেন। আর এসেই যখন
পড়েছেন তখন ওকে দেখে
কৌতূহলবশে জিজ্ঞেসও
করে বসেছেন,
'এই যে একই অঙ্গে এত রূপ
নিয়ে তুমি ঘুরে বেড়াচ্ছ
তোমার অসুবিধে হয় না?'
সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা
প্রশ্ন আপনার দিকে ছুটে
আসবেই,
'এই যে একই অঙ্গে একটাই
রূপ নিয়ে তুমি
নেচেকুঁদে বেড়াচ্ছ
নিজেকে অসম্পূর্ণ মনে
হয় না?'
বুঝুন ঠ্যালা। আপনি তখন
কোন্ দিকে যাবেন? আর
আমিও বাড়ি বয়ে আসা
অতিথির সামনে
অপ্রস্তুতের একশেষ।
কোত্থেকে যে এসব আপদ
এসে জোটে আর চেষ্টা করে
ভারসাম্য নষ্ট করার।
বলে কিনা মানুষের মতো
হাস্যকর প্রাণী সে নাকি
আর দুটো দেখেনি ! আমাদের
সমস্ত জালিয়াতি আর
নষ্টামি নাকি ধরা পড়ে
গেছে, শিগগিরই এর বিচার
হবে !
এমন বদস্বভাবী জীবের
প্রতি আর কোনো
সহানুভূতি এরপর দেখানো
চলে কি?আপনিই বলুন,
দেখানো চলে আর? আর যাই
হোক প্রশ্নের বদলে
প্রশ্ন করাটা আমাদের
দস্তুর নয়। যারা এটা
করে তাদের আমরা বে-আদব,
অসভ্য এবং নীচ বলে মনে
করি কিনা? আমাদের
বাপ-দাদাদের তাদের
বাপ-দাদারা শিখিয়ে
গেছেন তাদের বাপ-দাদারা
যা বলে গেছেন তাইই
আমাদের ঐতিহ্য। না
মানলে আমাদের সুন্দর
পৃথিবী দেবতাদের
অভিশাপে কালো হয়ে যাবে।
অভিশাপের ভয়ে আমি
প্রোটাগনিস্টকে
পৃথিবী থেকে তাড়িয়ে
দিতে চাই। কিন্তু
হতচ্ছাড়া পাজিটা
হম্বিতম্বি করে কিনা
আমাকেই কোণঠাসা করার
মতলব ভাঁজতে থাকল!
আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম
আমারই নাকের ডগায়
দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করছে,
' কী অদ্ভুত না! যারা
জন্ম থেকে শুধু ধ্বংসই
করে চলেছে তারাই
ঐতিহ্যের কথা বলছে?
নিজেদের ক্রমাগত
ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে
যাওয়ার উল্লাস
তোমাদেরই মানায় বটে।
অন্ধের কিবা দিন কিবা
রাত।'
আর যাই হোক না কেন
গালাগালি হজম করতে আমি
নারাজ। সপাটে মুখের ওপর
বলে দিলাম,
' যতই যাই বলো না কেন
পৃথিবীর ওপর রাজত্ব
আমরাই কায়েম করেছি।
সবার উপর বসে ছড়ি
ঘোরানোর সাহসকে তুমি
এভাবে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে
দিতে পারো না। জেনে
রেখো, তোমাদের সবাইকে
কলা দেখিয়ে পৃথিবীতে
একদিন আমরা, এই
মানুষরাই থেকে যাব। '
যদিও হাসির কথা কী
বললাম বুঝতে পারিনি,
রাগে তখন অন্ধ হয়ে গেছি,
তবুও অট্টহাসি শুনে মনে
হল বেকায়দা কিছু বলে
ফেলেছি আর শত্রুকে
সুযোগ করে দিয়েছি মুখ
খোলার। ফল যা হওয়ার তাই
হলো, গরম সীসে এসে পড়ল
কানে,
' বলে দিও তোমার
বাপ-দাদাদের যেন তারা
তাদের বাপ-দাদাদেরও
বাপ-দাদাদের জানিয়ে দেয়
পৃথিবীটা কোনোদিনই
কারো একার ছিল না। এই যে
বিশাল পৃথিবীটা দেখছ,
এটারই একটা অন্ধকার
কোণায় জন্মেছিলে তোমরা
আর জন্মকালীন সেই
অন্ধকারই চিরকাল বয়ে
বেড়াচ্ছ ঘাড়ে অথচ
বুঝতেই পারছ না।
নির্বোধের মতো
অন্ধকারের বড়াই করছ বুক
বাজিয়ে।'
এত তাচ্ছিল্যের পরেও কি
আমার উচিত না তলোয়ারের
এক কোপে ওর অতিচালাক
মুণ্ডুটা ধড় থেকে আলাদা
করে দেওয়া? ওটা যত
তাড়াতাড়ি মাটিতে মরা
পাতার মতো গড়াগড়ি যায়
ততই ভালো। কিন্তু গোল
বাঁধালো ওর মাথা। কোন
মাথাটা কাটলে যে ভয়ে
শুকিয়ে ওঠা আমার বুক
জুড়োবে সেটা ভাবতে গিয়ে
রেগেমেগে বলেই ফেললাম,
'এমনিতে তো রা ফোটে না।
দিনরাত হয় পাতা নয় চাঁদ
চিবুচ্ছ। এত চোখা চোখা
ভাষা শিখলে কোথায়?
তোমার কথায় আমার সম্মান
হানি ঘটছে। চুপ করো।
এখুনি বন্ধ করো মুখ। '
ভাবলাম রাগ দেখে হয়ত
চুপ করে বসবে। ওমা,
কোথায় কী? দ্বিগুণ
তেরিমেরি করে বলে ওঠে,
'আমি না তো কি তুমি
শিখবে? সেই কোন্
আদ্যিকাল থেকে একটাই
ভাষায় ক্যাঁচরম্যাঁচর
করে যাচ্ছ। আমি জল, স্থল,
আকাশ সবার ভাষা জানি।
আমি পৃথিবীর নিজের
ভাষায় কথা বলি। কোনো
অন্ধ স্বার্থপর জীবের
একটাই বোবা ভাষায়
অনর্গল বাজে বকে মুখের
ফেনা তুলি না। এই যে
মূর্খের মতো দল বেঁধে
বেঁধে ঘুরে বেড়াও, একই
কথা বারবার নকল করে
বলতে থাকো তাতে তো কই
তোমার মানহানি হয় না?
মিথ্যেকে সমস্বরে
চিৎকার করে সত্যি বলে
চালানোর সময় মানহানি হয়
না তো? '
' কিন্তু আমাকে সমাজে
বাস করতে হয়। আমরা
চিরকালই মিলেমিশে
বেঁচে থাকার জয়গান
করেছি। '
' তোমার বয়স কত? '
'কেন? '
' আহা বলোই না, ভয় কী? তুমি
তো দুটো জিনিসই পারো, ভয়
পেতে আর বাজে বকতে।
এখানে এই লেখার টেবিলের
উপর তো আর তোমার সমাজ
উঁকি দিয়ে বসে নেই যে
নিজের কথা বললে তোমাকে
তুলে নিয়ে যাবে আর ঠেলে
ফেলে দেবে গ্রহের
বাইরে। '
' তা ধরো পঁয়ষট্টি সত্তর
তো হবেই। '
' জানতাম, সোজা কথার সোজা
উত্তর তুমি দেবে না।
কিন্তু এটা জানতাম না
তোমার নিজের বয়স তুমি
জানো না। যে নিজের বয়স
নিজেই জানে না সে বেঁচে
থাকা আর টিকে থাকার
ফারাক বুঝবে, এটা আশা
করা বাড়াবাড়ি ব্যাপার।
'
' কী বলতে চাও?'
' কিছুই না। তিরিশ হাজার
বছর বয়সী একটা ধেরে
বুড়োকে যদি এখন বোঝাতে
বসতে হয় যে তার আসার
অনেক আগেই আমরা
পৃথিবীতে এসেছি,
পরস্পরের ভাষায় কথা
বলেছি, একে অপরের সঙ্গে
মিলেমিশে বেঁচে থেকেছি,
তাহলে তো সময়ের এর চেয়ে
যোগ্য অপচয় আর কিছুই
হতে পারে না। হাজার
হাজার বছর ধরে কালি
ঘেঁটে গেলে, শেখোনি
কিছুই। তাই একটা ছোট্ট
ভাইরাসও তোমার মুখোশ
ছিঁড়ে তোমাকে উদোম করে
ছেড়ে দিতে পারে। আর
তুমি খাতা পেন্সিল নিয়ে
টেবিলের সামনে ন্যাংটো
বসে বসে গপ্প লেখার
তামাশা করতে পারো। একা
হওয়াও যে কতটা জরুরী
সেটাও তখনই বুঝলে যখন
ঘাড়ে ধরে বুঝিয়ে দেওয়া
হল। '
বিবেকের সামান্য অংশও
যদি কারোর অচ্যুত থাকে
তাহলে তাকে পাগল করার
জন্য এটুকু প্রলাপই
যথেষ্ট। কথা না বাড়িয়ে
সেখান থেকে মানে মানে
তখন কেটে পড়াই
বুদ্ধিমানের কাজ
বিশেষত যখন মুহূর্ত
মধ্যে মুহূর্ত বদলে
যেতে পারে আগের চেয়েও
বেশি অনিশ্চিত ভাবে।
## ##
আজকের ভোরটা ভারি
সুন্দর। সাধারণত জুন
মাসে এমন ভোর দেখাই যায়
না। কোকিলের ডাকও নৈব
নৈব চ। সূর্যের দেখা
এখনও নেই কিন্তু তার
রক্তিমাভা ইতিমধ্যেই
গায়ে এসে লাগছে, আড়ালে
হাল্কা একটা মেঘও যেন
সুড়সুড়ি দিচ্ছে। যে
মানুষ সত্যিকারের একা,
আজকের মতো ভোর তার কাছে
প্রকৃত প্রিয়। ঘুম
ভাঙার পর ভোরের এই
কুসুম ফোটা রূপ প্রায়ই
আমায় ধরেবেঁধে মোহিত
করে ফেলে।
প্রোটাগনিস্ট কখনো
ঘুমোয় না। অন্তত আমার
বাড়িতে একদিনও ওকে
ঘুমোতে দেখিনি। জেগেই
থাকে বলে নতুন করে জেগে
ওঠার বালাই নেই।
বেশিরভাগ সময় ও চুপ করে
ভাবে। নিজের শরীরের
বিভিন্ন অংশে আদরের চোখ
বুলায়। অথচ অদ্ভুতভাবে
লক্ষ্য করেছি ওর কোনো
লোভ নেই। এমনকি বেঁচে
থাকার লোভও ওকে তাড়িত
করে না। খেতে দিলে খায়,
না দিলেও ক্ষতি নেই।
আমার উপস্থিতির পরোয়া
করে না যে তা নয়, তবে তা
নিয়ে বিশেষ ভাবিত বলে
মনে হয় না। নিজের কথা
বলতেই সর্বদা উৎসাহী
এবং লক্ষ করে দেখেছি
কথাগুলো নেহাত ফেলে
দেবার মতো নয়। বরং
যুক্তির ধারে যথেষ্ট
ধারালো।
বৈরাগী কোকিলের আদর
নিতে নিতে বারান্দা
থেকে ওর ঘরে উঁকি দিয়ে
দেখলাম দেওয়ালের গায়ে
গায়ে ও কবিতা আওড়াচ্ছে।
যার এক বর্ণও বোঝা যায়
না। কানে গেলে মনে হয়
কোনো দুর্বোধ্য মন্ত্র
উচ্চারিত হচ্ছে
প্রাচীন এক পুরোহিতের
কণ্ঠে। প্রতিটা
উচ্চারণে দেওয়ালে ঝলসে
উঠছে অতীত, বর্তমান,
ভবিষ্যতের রঙ। সে বর্ণ
আগুনে দৃশ্যমান নয়। হতে
পারে সে জলের
অন্তর্নিবিষ্ট কোনো
রঙ। আবার এমনও হতে পারে
সে রঙ আমাদের অন্ধত্বের
গভীর বার্তাবহ। মোটের
উপর প্রোটাগনিস্ট
তাতেই বিভোর আর আমি,
গ্রহের সবচেয়ে
বুদ্ধিমান প্রাণী,
ফ্যালফ্যালিয়ে দেখে
চলেছি ভোরের নরম আলোয়
নীরব কক্ষে অনাদি থেকে
অনন্তে বয়ে চলা
দৃশ্যাবলী। ওর মাছের
লেজের ঝাপটায় সময়ের
ঢেউয়ে দুলে আমার চোখের
সামনে কোটি কোটি বছরের
পৃথিবী তার সমগ্র সত্তা
নিয়ে বদলে বদলে যাচ্ছে।
এরমধ্যেই ভবিষ্যতের
ভূমিকম্পে ছারখার হয়ে
যাচ্ছে আমার প্রজাতি।
আমি মুছে যাচ্ছি।
নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছি।
বিলীন হয়ে যাচ্ছি
প্রখর ধোঁয়ায়।
দু'ডানায় আকাশ খেলাতে
খেলাতে ওর পাখি-অংশ
বলছে,
'কবির থেকে কবিতাকে
বিচ্ছিন্ন করেছ তুমি
পুরস্কারের লোভী
প্রাচীর তুলে।
পৃথিবীকে অপবিত্র
করেছ। অশ্লীল আগুনে
পুড়িয়ে ছাই করে ফেলেছ
তাকে। আগুনের কী চমৎকার
প্রতিদানই না দিয়েছ
ফিরিয়ে। এ শুধু তোমরাই
পারো। এখন আমাদের
সেটুকুই পবিত্র যেটুকু
তোমাদের অনাবিষ্কৃত... '
এতদূর যারা পড়ে ফেলেছেন
তারা বুঝতেই পারছেন এটা
কোনো গল্পই হয়নি।
এতক্ষণ ধরে নেহাতই
একটা ছক কষা হল মাত্র।
প্রশ্ন হল কিসের ছক আর
কেনই বা? হাজারো
সম্ভাবনার মধ্যে একটা
সর্বজনবোধ্য যুক্তি
হতে পারে বলবার কথা
অল্প না হলে গল্পে তাকে
সাজানো মুশকিল। শেষ
পর্যন্ত শুধু এটুকুই
বলার যে প্রোটাগনিস্ট
থামেনি। আমাকে
সম্পূর্ণ ধ্বংস না করে
ও থামবে না। ওর
অভূতপূর্ব অমানুষী
ভাষায় এখনও বলেই চলেছে
আকাশ, বাতাস, জল, আগুন আর
পৃথিবীর সেই সব গোপন
কথা যে কথা আমাদের কানে
শোনাও পাপ।