মাথার ভেতর কেবল একটা
কুবো পাখির ডাক। কুব্
কুব্ কুব্।
সে শ্রাগ করে বললো
কুবোপাখির ডাক শোনেনি
কখনো। আমি চোখ ছোট করে
তাকালাম কথাটা শুনে। সে
হাসছে। গজদন্ত ঝকঝক
করছে। আমিও হাসলাম। সে
জানেই না একটা
কুবোপাখির সাথে দু'বছর
ধরে ঘর করছে। ব্যাপারটা
হাস্যকরই।
কুবোপাখির কথা জানতে
চেয়ে সারাদিন আমার পিছু
পিছু ঘুরলো তিমির।
উত্তর দিইনি আমি।
ফেসবুকে লিখি
কুবোপাখির কথা। যখন
অবসন্নতা
থার্মোমিটারের একশো
পাঁচ তখন এমন হয়। যেন
কেউ স্কুইজ করে করে
প্রত্যেকটা পাল্প থেকে
শুষে নেয় অজস্র আমিকে।
সেই আমি একটু একটু করে
ডুব দিই মুদিত অনন্ত
সন্ধ্যায়, আঁধার নদীর
তরলে।
আমাকে দু’হাত ধরে
ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে তিমির
বলে-শুধু তোমার মন
খারাপ? আমার কি খুব
ভাল্লাগছে ঘরে বসে
থাকতে?
রাতে সে আমার
ডিফারেন্সিয়াল
ডায়াগনোসিস করতে শুরু
করে। তীব্র আশ্লেষে
আমার মাঝে অন্তর্লীন
হতে হতে জানতে চায় কেন
এমন করি। তারপর ও
ঘুমিয়ে পড়লে আমি
হাঁটুতে মুখ ডুবিয়ে বসে
থাকি বাকিটা রাত।
তবু সকালবেলাটা
স্বাভাবিকভাবেই শুরু
হয়। স্প্যানিশ অমলেট
মুখে নিয়ে গরম চায়ে
চুমুক দিতে দিতে তিমির
মিটিমিটি হাসে।
‘পাখির ডাক থেমেছে?’
ভ্রু নাচিয়ে হাসে
তিমির। আমি হাসিটা
ফিরিয়ে দিতে দিতে ঢুকে
যাই নিজস্ব ছায়াচক্রের
ভেতর, একটা মিহিপাতার
বন আছে যেখানে।
হাঁটতে হাঁটতে সেখানে
গিয়ে থামি যেখানে কেউ
একজন প্রথম সেই পাখিটার
ডাক শুনিয়েছিল। ইশারায়
বলেছিল- শুনতে পেলি? এই
সেই কুবোপাখি।
পাখির মতোই পলকা ছিল
রোগা মানুষটা। আমি
মাঝেমাঝে তাকে কোলে
নেবার চেষ্টা করতাম। সে
হেসে কুটিকুটি হতো। আর
লম্বা বেনি দু'টো এদিক
ওদিক দুলতো। আমার মনে
হতো বুঝি দু'দিকে দুটো
নদী দুলছে। মা ওর
চুলগুলো কেটে দিয়েছিল,
বেনিসুদ্ধ। সামলাতে
পারতো না অত লম্বা চুল।
মনে আছে হাতের তেলো
দিয়ে চোখ মুছতো মেয়েটা।
আর ভেজা ভেজা গলায় বলতো -
আমি কি বিচ্ছিরি
দেখতে!
সত্যি, কী অদ্ভুত
লাগছিল ওকে তখন! রোগে
ভোগা আধখানা শরীরে
একঢাল চুলই যেন সমস্ত
মাধুরী নিয়ে ঘিরে রাখতো
ওকে। আমি রাগ করে মায়ের
সাথে কথা বলিনি দু'দিন।
মনে হতো এই পৃথিবীর কেউ
বুঝি আমার দিদিকে দেখতে
পারে না।
এমনকি তিমিরও দিদিকে
কখনো পছন্দ করেনি। ওর
প্রসঙ্গ এলে তিমিরের
পিউপিল দুটো ডাইলেটেড
হয়ে যায়। লকডাউন
চলাকালে আমি কতবার
দিদির গল্প শোনাতে
চেয়েছি ওকে। আসলে
তিমিরকে ভাগ করতে
চেয়েছি আমাদের দু’জনের
মাঝে। দিদির মতো অমন
অর্ধেক মানুষকে
সবকিছুতে ভাগ দেবার
চেষ্টা আমার বরাবরই
ছিল। নিজে বেশি পাচ্ছি
ভেবে আমার সবসময় মন
খারাপ হতো।
দিদির কথা বলি আমি।
তিমির অন্যমনস্ক
ভঙ্গিতে আমার গালে হাত
বোলাতে বোলাতে চুলের
ভেতর নাক ডুবিয়ে দেয়।
আমি ভেতরে ভেতরে অস্থির
হয়ে উঠি।
আমি ওকে জিজ্ঞেস করি-ডু
ইয়্যু লভ মাই
হেয়ার,তিমু? আমার হাঁটু
অব্দি লম্বা চুল ছিল
জানো? ঠিক দিদির মতো।
সেদিন মায়ের সাথে জেদ
করে আমিও কাঁচি দিয়ে…
তিমু আমার কথা শেষ হতে
দেয় না। আমার ঠোঁটে
ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। ওর
চোখ দু'টো গাঢ় হয়ে ওঠে।
‘তুমি ন্যাড়া হলেও আমি
তোমাকে একই রকম
ভালোবাসবো। চলো, আমরা
একসাথে ন্যাড়া হয়ে যাই।
এখন তো ফেসবুকে এটাই
ট্রেন্ড…’
তিমির সারাদিন আমাকে
এমন করে কথার জালে
ভুলিয়ে রাখে। তারপর
আমাকে ঘুমাতে পাঠিয়ে
দিয়ে মাকে ফোন করে।
চাপাস্বরে দীর্ঘক্ষণ
কথা বলে তার সাথে। ওদের
কথোপকথন আমি শুনতে না
পেলেও অনুমান করতে
পারি। আমার চোখের পাতা
ক্রমশ ভারি হয়। দিদি
তখন চুপিচুপি এসে আমার
পাশে গুটিসুটি দিয়ে
শোয়। দিদির গায়ে সাদা
জামা। আর চুলে নীল রঙের
ফুল। দিদি হেঁটে আসে
সুস্থ মানুষের মতো। আমি
অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি।
এসেই অভিযোগের ঝাঁপি
খুলে দেয় মেয়েটা।
‘তুই আর বেনি করিস না?’
আমার কাঁধ ছুঁই ছুঁই
চুলে বিলি কেটে দেয়
দিদি। আরামে চোখ বুজে
আসে আমার।
‘এত রোগা হয়ে গেছিস!’
‘আমাকে ভুলে যাচ্ছিস
কেন রে, রুপু?’
‘ওরা যে আমাকে ঘুম
পাড়িয়ে রাখে..’
দিদির অভিমানী ফোলা
ফোলা গালে হাত বুলাতে
বুলাতে আমি ঘুমে ডুব
দিই টুপ করে। আমার
কথাগুলো জড়িয়ে যায়। যখন
ঘুম ভাঙ্গে তখন পাশে
দিদি থাকে না। দিদির
ছবিটাও দেখতে পাইনা
অনেকদিন। সেবার মায়ের
হাতে তৈরি একই রকম জামা
পরেছিলাম দিদি আর আমি।
ততদিনে ওকে উচ্চতাতেও
ছাড়িয়ে গিয়েছি। ওর
কাঁধে হাত রেখে একান
ওকান হাসছি আমি। আর
দিদি যেন আমার ছোটবোন,
কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে
আছে কেমন! তিমির কোথাও
রেখে দিয়েছে ছবিটা। ওকে
ঘুম থেকে ডেকে তুলে
জানতে ইচ্ছে করে আমাদের
ছবিটার কথা।
কোথায় কী আছে আমি
ঠিকঠাক মনে রাখতে
পারিনা আজকাল। তিমির
সবকিছু গুছিয়ে রাখে।
বাসা বদলের সময়
অনেককিছুই তো এলোমেলো
হয়ে গেছে। সেদিন হঠাৎ
আমাকে একটা ডায়েরি এনে
দিল তিমির। নতুন ডায়েরি
পেয়ে আমি তো অবাক।
বললাম- এটা এখন কোথায়
পেলে তিমু?
তিমির বললো ড্রয়ারে পড়ে
ছিল।
‘কী লিখবো আমি?’
‘লকডাউনের
স্মৃতিগুলোই লিখে
রাখো।’
রাতঘুম আজকাল খুব
তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়।
ছায়াচ্ছন্ন
প্যারাবোলিক পথে ভোর
নেমে আসে আমাদের ঘরে।
তখন ডায়েরিটা খুলে বসি।
আর দিদি পাশে এসে বসে
তক্ষুণিই। ওর কাঁধ ছুঁই
ছুঁই চুলগুলো ভারি
অদ্ভুত দেখায়।
‘এই ফুলটার নাম জানিস
রুপু?’
দিদির চুলে বিন্দু
বিন্দু নীল রঙের ফুল।
আমি মাথা দোলাই।
আমার কাঁধে মাথা রেখে
দিদি যেন ঘুমিয়ে পড়তে
পড়তে বলে- আমাকে কি
বিচ্ছিরি দেখতে রে...
সকালে তিমির চা খেতে
খেতে গল্প করে।
‘তোমার কী হয়েছে রুপু?
মায়ের কথা মনে পড়ছে?’
মাথা নেড়ে অস্ফুটে বলি
'দিদি'!
‘রুপু, তুমি ডায়েরিতে
এটা কেন লিখেছো?’
‘কী লিখেছি?’
তিমির ডায়েরিটা এগিয়ে
দেয়। আমি চোখ রাখি বড় বড়
হরফের দিকে।
'ফরগেট মি নট'।
‘এতো আমি লিখি নি। দিদি
লিখে গেছে গতকাল
রাতে।’
তিমিরের চোখে
অবিশ্বাসের রেখা। থেমে
থেমে আবার প্রশ্ন করে
সে।
‘কেন লিখেছো এটা?’
‘আমি লিখিনি’
‘উফ, রুপু! এটা তোমার
হাতের লেখা।’
‘দিদির চুলে ঐ ফুলগুলি
ছিল। ফরগেট মি নট!’
সেদিন দুপুরে আমাকে
ঘুমাতে বলে পুরনো
ফাইলপত্র ঘেঁটে
কাগজপত্র বের করলো
তিমির। রাইটিং প্যাডে
দ্রুত হাতে কীসব টুকে
নিল। তারপর বোধ হয়
ফার্মেসিতে গেল।
কতদিন আগের ঘটনা এটা
আমি জানিনা। এরপর আর কী
কী হয়েছে শুরুতে মনে
পড়েনি আমার। আমি যেন
রিপ ভ্যান উইঙ্কলের মতো
দীর্ঘকাল পর ঘুম থেকে
জেগে উঠলাম এই একটু
আগে। আরো খানিকটা সময়
গড়িয়ে গেলে দেখি আবছায়া
দিনগুলি অল্প অল্প করে
সামনে এসে দাঁড়াতে শুরু
করেছে।
দিদির সাথে হাঁটার সময়
আমি ঠিক ওর মতো খুঁড়িয়ে
খুঁড়িয়ে হাঁটতাম। মা
দেখতে পেলে বেধড়ক মারতো
আমাকে। আর আমাকে মারলে
দিদির খুব রাগ হতো।
অতটুকু মুখ কেমন লাল
টুকটুক হয়ে উঠতো সাথে
সাথে। ইচ্ছে করে সমস্ত
ভাত ছিটিয়ে ফেলতো থালার
বাইরে। নয়তো জলের গ্লাস
উপুড় করে দিতো থালায়।
তখন সেও মার খেতো মায়ের
হাতে।
আমি এবার দেখতে পাই
একটা বাতি নেভানো
সন্ধ্যা।আকাশে সাইরাস
মেঘ। দিদির প্রাণহীন
নীল রঙের শরীর। বাবার
উশকোখুশকো চোখমুখ।
মায়ের মুহুর্মুহু
সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়া।
‘তারপর কী হলো? মনে পড়ে
রুপু?’
তিমির আমার হাত ধরে
রাখে। আমি যেন একটু
একটু করে ঘুম থেকে জেগে
উঠি।
‘দিদির গায়ে হারপিকের
গন্ধ। জামায় ছোপছোপ নীল
রঙ৷ ওকে স্ট্রেচারে
তুলে একটা সাদা গাড়িতে
করে নিয়ে গেলো ওরা।’
তিমির আমার কম্পমান
শরীরটাকে শক্ত করে
জড়িয়ে ধরে। আর কিছু
শুনতে চায় না সে। তবু
আমি ওকে বলতে চাই খুব
গোপন একটা কথা। আমি ওর
কানে কানে বলি দিদির
ঠোঁটজোড়া কেমন কেঁপে
উঠেছিল সেদিন। আমি
স্পষ্ট দেখতে
পেয়েছিলাম। দিদি বলছিল-
আমার খুব একা
লাগছে,রুপু।
তিমির আমাকে বিছানায়
নিয়ে যায়। বাতি নিভিয়ে
আবার ঘুম পাড়িয়ে দেয়
আমাকে। তিমুর হাতে যেন
জাদুর কাঠি আছে। ওর
জাদুমন্ত্রে আমি
ঘুমিয়ে পড়ি রোজ।
ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই আমি
আবার ডায়েরিটা খুলে
বসি। পাশে তিমির অঘোরে
ঘুমাচ্ছে। মিডিয়া
প্লেয়ারে লো ভলিউমে গান
বাজছে একের পর এক।
ভোরটা কেমন স্থির হয়ে
আছে। আমি জানালা দিয়ে
মুখটা বাড়িয়ে দিই
বাইরে। ভীষণ মেঘ করেছে।
বোধ হয় আর একটু ভারী
হলেই ওরা বৃষ্টি হয়ে
ঝরে পড়বে।
আমি দিদির জন্য অপেক্ষা
করছি। অনেকদিন পর সেই
কুবোপাখিটা ডাকছে।
কুব্ কুব্ কুব্। ‘পিয়া
তোরা ক্যায়সা অভিমান।’
লুপে বেজে চলেছে
অবিরাম। আমার ভীষণ একা
লাগছে।