আমার একাকিত্ব আর আমার
নিঃসঙ্গতার মাঝখান
দিয়ে একটা শীর্ণ রেলপথ,
একটা ক্লান্ত রেলপথ
বহুযুগ ধরে হেঁটে চলেছে
গন্তব্যহীনতার দিকে।
আমার চেতন আর আমার
অবচেতনের মাঝখান দিয়ে
একটা কুয়াশাচ্ছন্ন
রেলপথ হাঁটতে হাঁটতে
ক্রমশ আকাশের দিকে চলে
যাচ্ছে। একপাশে আমি আর
আমার নিঃসঙ্গতা,
অন্যপাশে আমি আর আমার
একাকিত্ব। আমার
একাকিত্বের বিছানায়
কোনো জৈব চাঞ্চল্য নেই।
অথচ আমার নিঃসঙ্গতার
পালঙ্কে অজস্র ফুল
ফুটেছে বিছানা জুড়ে।
চাদরের উপর দোল খাচ্ছে
অবসাদবিলাসী
বিস্তীর্ণ তৃণভূম।
ঘাসের মাথায় মাথায় জমে
থাকা নির্লিপ্ত ভোরের
শিডিউলে এককাপ গরম চা।
আমার পাশ থেকে আড়মোড়া
ভাঙা নদী এইমাত্র বয়ে
চলে গেছে নিজের
দৈনন্দিনতায়, নিজের
বহমানতায়। তার বাসি
গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে একটা
প্রজাপতি এসে বসেছে
কুঁচকানো বালিসের উপর।
ওর ডানার উপর আজ
সূর্যোদয়ের লাল। আমি আর
আমার নিঃসঙ্গতা
একসঙ্গে ঝুঁকে পড়ি
এককাপ চায়ের উপর।
নিঃসঙ্গতা আর
একাকিত্বের কোনো
বৈয়াকরণিক দ্বৈধ টানা
যায় কিনা জানা নেই!
জানিনা কোনো
বিজ্ঞানসম্মত
পদ্ধতিতে একজন একাকী
মানুষের নিঃসঙ্গতাকে
আরএকজন নিঃসঙ্গ
মানুষের একাকিত্বের
সঙ্গে তুলনা করা যায়
কিনা! তবে এটুকু বোঝা
যায় একজন নিঃসঙ্গ মানুষ
আদতে অন্তর্মুখী হয়।
নিজেই নিজেকে সমষ্টি
থেকে ক্রমশ পৃথক করে
নেয়। নিজের চারিপাশে
একটা অদৃশ্য প্রাচীর
গড়ে তুলে সে সৃষ্টির
নেশায় বুঁদ হতে চায়। সে
সৃষ্টি নিজেকেই নতুন
করে সৃষ্টি করা। নিজের
মধ্যেই নিজেকে খোঁজা।
নিজের অপরের মুখোমুখি
হওয়া গোপন সাধনায়। সেই
পথই আমাদের ঐতিহ্যের
পথ। এই পথে হেঁটে গেছেন
যুগযুগ ধরে এই
প্রাচ্যভূমির
সিদ্ধাচার্যেরা। এই
পথেই হেঁটে গেছেন
রামপ্রসাদ, হেঁটে গেছেন
লালন, হেঁটে গেছেন
রবীন্দ্রনাথ। এ পথ হলো
আত্মদর্শনের পথ। এ সৃজন
নিজের নিজেকে সৃষ্টি
করা। সেখানে নিজেই
স্রষ্টা, নিজেই সৃষ্টি।
সেই অর্থে এই নিঃসঙ্গতা
ঠিক একা থাকা নয়, বরং
মননের অন্তর্মুখী
প্রবাহে নিজেকে গুটিয়ে
নেওয়া, নিঃসঙ্গতা তৈরি
করা। তারপর সেই কৃত্রিম
নির্জনতায় অবসাদের
গৌরব রচনা করা।
অন্যদিকে একজন একাকী
মানুষ মূলত বহির্মুখী।
সে তার একাকিত্বের
চিরায়ত একঘেয়েমি
কাটাতে বারবার
বহুত্বের অনুসন্ধান
করে। অথচ যতই বহুকে
পেতে চায়, ততই
একাকিত্বের গহীন
অন্ধকারে ডুবে যায় তার
অস্তিত্ব। বৃহত্তর
সমাজের শরীক হতে চায়,
অথচ পারেনা। এই অতীমারী
এই দীর্ঘ লকডাউনে
জনবিচ্ছিন্ন হয়ে
সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে
থাকতে থাকতে ভ্যান গগের
প্রসঙ্গ মনে পড়ে যায়।
শিল্পীর সারাজীবনের
একাকিত্ব বারবার তার
শিল্পকর্মের মধ্যে ধরা
দিয়েছে। একটি বহু
আলোচিত ছবির কথা বলা
যায় এখানে। বেডরুম
অ্যাট আর্ল। একটি
শয়নকক্ষ, আকাশের মত নীল
দেওয়াল জুড়ে তার প্রিয়
ছবিগুলি প্রেতের মত
চেয়ে আছে বিছানার দিকে।
নির্জন একটি ঘরের
মাঝখানে হলুদ বিছানা।
চারিপাশে পরিপাটি করে
গোছানো শিল্পীর
ব্যক্তিগত সামগ্রী,
আসবাব। খালি বিছানার
দিকে মুখ করে হলুদ রঙের
চেয়ারগুলি সাজানো। যেন
অদৃশ্য মানুষেরা
নিস্তব্ধ আলাপনে কথা
বলছে পরস্পরের সঙ্গে।
অথচ সারা ঘর জুড়ে
নিস্তব্ধতা, হলুদ
নিস্তব্ধতা। ভ্যান গগ
তার ছবিতে হলুদ রঙ কেন
এত ব্যপকভাবে ব্যবহার
করেছেন তার স্পষ্ট কোন
ধারণা নেই। তবে
মনোবৈজ্ঞানিক
মতানুসারে শিল্পী হয়তো
মনের মধ্যে জমানো ঘাত
অভিঘাতের যন্ত্রণাকে
হলুদের ব্যবহারে
প্রকাশ করতে ভালোসতেন।
ছবিটিতে দেখতে পাই ঘরের
মধ্যে কেউ নেই, কোথাও
নেই। অথচ দুটি খালি
চেয়ার তার বিছানার দিকে
মুখ করে রাখা। কিন্তু
চেয়ারগুলি খালি কেন
রেখেছেন শিল্পী! তবে কী
কারও অপেক্ষা! আমরা
শিল্পীর জীবনের
অন্তহীন ব্যর্থতার কথা
জানি। একজন প্রেমিক
হিসাবে ব্যর্থ, একজন
শিক্ষক হিসাবে ব্যর্থ,
একজন বন্ধু হিসাবে
ব্যর্থ, একজন মানুষ
হিসাবে ব্যর্থ।
ব্যর্থতা শুধুই
ব্যর্থতা। ভিনসেণ্ট
ভ্যান গগের জীবনের দুটি
পর্যায় আমারা দেখেছি।
একটি তিরিশ বছর বয়সের
আগের জীবন। যখন তিনি
ক্রমশ একা হচ্ছেন। তার
অজান্তেই তার
ব্যর্থতার হাত ধরে একে
একে সবাই চলে যাচ্ছে
তার জীবন থেকে। আর একটি
পর্যায় যখন তিনি একা
হয়ে গেছেন। সম্পূর্ণ
একা। তার এই দীর্ঘ
ব্যর্থতার মধ্যেও যাকে
তিনি সবসময় পাশে পেতেন
সে হলো ভাই থিও। আর থিওর
হাত ধরেই একদিন
পেয়েছিলেন বন্ধু পল
গগ্যাঁকেও। কিন্তু
তাদেরকেও ধরে রাখতে
পারেননি তিনি। তাঁর
শৃঙ্খলাহীন যাপন, তার
সেই একগুঁয়ে স্বভাব
তাকে তাঁর প্রিয় দুই
মানুষের থেকেও সরিয়ে
নেয়। এরপর শিল্পীর
জীবনে পড়ে থাকে শুধু
সীমাহীন শূণ্যতা।
আর্লের সেই বিখ্যাত
শয়নকক্ষের দুটি খালি
চেয়ার যেন আজও অপেক্ষায়
থাকে। থিওর অপেক্ষায়,
পল গগ্যাঁর অপেক্ষায়।
অথচ দিনের পর দিন খালিই
থেকে যায় চেয়ারগুলি।
তবে কী সবকিছুর মধ্যেই
স্ফুট অস্ফুটভাবে
তিনিই রয়েছেন! রয়েছেন
ফাঁকা চেয়ারগুলিতে,
রয়েছেন খালি বিছানায়!
তিনি নিজের একাকিত্বকে
নস্যাৎ করে বহুত্বের
আস্বাদন করছেন কী
এভাবেই? এটাই কী তার
মনখারাপের শুশ্রূষা,
বহির্মুখী শুশ্রূষা?
হয়তো তাই।
এভাবেই আসে
দ্বান্দ্বিক ভাববাদ।
আমি প্রতিনিয়ত দেখতে
পাই আমার স্ববিরোধী
অন্য আমিকে। আর নিজের
এই পরস্পর বিরোধীতার এ
সংঘাত থেকেই কখনো ছুটে
যেতে চাই বৃহত্তর
সমাজের কাছে, এই
অতীমারীধ্বস্ত
জরাগ্রস্ত পৃথিবীর
মাঝখানে, আবার কখনো
ফিরে আসি স্বরচিত
নিঃসঙ্গতায়। অথচ এই
মহামারী, লকডাউন,
সামাজিক দুরত্ব,
জীবিকাহীনতা এসবের
মধ্যে কোনো রাস্তা দেখা
যায়না। একটা ভয়ঙ্কর নীল
কুয়াশায় আবছা হয়ে যায়
চারিদিক। জীবনানন্দের
ভাষায় যা " গভীরতম
অসুখ"। অথবা জাঁ পল
সাঁত্রের কথায় যা
"নাথিংনেস"।
আমার দেওয়ালের উপর একটা
একগুঁয়ে সরীসৃপ বারবার
ঘুরতে থাকে ঘুরতে থাকে
একটা বৃত্তাকার পথে।
প্রতিটি পরিক্রমণের
শেষে একটি করে শূন্য।
বুদবুদের মত আকাশের
দিকে উড়ে চলে যায় একটি
করে শূন্য। তবুও অদৃশ্য
কক্ষপথে অনবরত সে ঘুরেই
চলে ঘুরেই চলে। তারপর
যেদিন বিকট বিশ্রী সে
সরীসৃপের সঙ্গে
সহাবস্থান অসম্ভব জেনে
নিয়ে তাকে মেরে ফেলবার
জন্য মনস্থির করি,
সেদিন দেখি সে নিজেই
মরে পড়ে আছে অর্থহীন
সাংকেতিক চিহ্নের মত।
অর্থহীন কোনো একটি
সংখ্যার মত।
একপাশে আমি আর আমার
গদ্য, অন্যপাশে আমি আর
আমার কবিতা। মাঝখান
দিয়ে একটা ধূসর রেলপথ
হেঁটে চলে গেছে আকাশের
দিকে। অজস্র কাটা
হাত,অজস্র কাটা পা, কাটা
মুণ্ড, কাটা স্তন কাটা
যোনি পড়ে আছে রেলপথ
জুড়ে। তাদের মাঝখানে
পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে
আছে আমাদের মা। আর আমার
মতই একজন আবাল শিশু
চাদর টেনে জাগাতে চাইছে
তাকে, তার ইতিহাসকে।
অথচ সে ওঠেনা কিছুতেই
ওঠেনা। তাকে পাশ কাটিয়ে
যান্ত্রিক আচ্ছনতায়
হেঁটে চলে যায় সীমাহীন
পিঁপড়ের সারি। হেঁটে
চলে যায় ভ্যান গগ, হেঁটে
চলে যায় পল গগ্যাঁ
হেঁটে চলে যায়
রবীন্দ্রনাথ, হেঁটে চলে
যায় জীবনানন্দ।
সারাদিন সারারাত
সারাদিন সারারাত...