ছেলেছোকরার দল ওই
গঙ্গায় গাঙ্গেয় সুখে
মজে থাকে রোজ। ডুব ডুব
গঙ্গা ভাজে। অথবা
পুরোহিত তাঁর নৈবেদ্য
দেন গঙ্গাজলে।
শেষস্নানে শুদ্ধ হন
তিনি। সবকিছুই আমাদের
জানা ছবি। গঙ্গার দোষ
নেই কোনও। আহা কী শীতল!
হয়তো এই পাড়ের এক
বাসিন্দা বলে উঠল—
গঙ্গা গঙ্গা না জানি কত
রঙ্গা-চঙ্গা। কেন বলল
সে? কী তার কারণ? গঙ্গার
পরিচয়ে পুণ্যি ফলে। ওই
বাসিন্দারও বিশ্বাস—
গায়ের কালি ধুলে যায়,
মনের কালি ম’লে যায়। ওই
বাসিন্দা অতি সাধারণ।
ওর বিশ্বাস ওকে পড়িয়ে
দেওয়া হয়েছে। এটা করলে
ওটা হবে। ওটা করলে
সেটা। সে জানে,
গঙ্গাস্নানে পুণ্যি।
সে জানে ডুব বেশি দিলে
কালি মুছবে। পাপ মুছবে।
সে এটাও জানে, মনের কালি
মোছে না সহজে; এমনকী
মরলে পরও সহজে মোছার নয়
এ কালি। ওই বাসিন্দা
রোজ দেখে। পায়ে হেঁটে
মায়ের ঘাট যায়। বসে
থাকে। ট্রেন যায়। ট্রেন
আসে। তবু বাসিন্দাটির
জীবন পালটে যায় না।
জীবন যেন তার কাছে
অনুপ্রেরণায়
রূপান্তরিত। সে যখন
পড়াশোনা করত,
মাস্টারমশাই তাকে
দার্শনিক ভালেরির কথা
বলেছিলেন। পাঠককে
অনুপ্রাণিতে
রূপান্তরিত করবার কাজ
নাকি কবির। সে কবিতা
বোঝে না। জীবনের অত
ভারী ভারী সার কথাও
বোঝে না সে। তার গণ্ডি
বাগবাজার।
গঙ্গাধ্ধার।
বটবৃক্ষমূল। শুকোতে
দেওয়া ওই গামছাটি তার।
অথবা তার মতো কারওর।
অথচ এইসব পরিচিত দেখা
যখন পরস্পর বাক্য হয়,
তখন বুঝতে পারে ওই
বাসিন্দা। এ যেন তার
কাছে পরিচিত বহুদিনের।
তা জটিল নয়। অহেতুক
তাত্ত্বিক দর্শনে ভারী
নয়। এ যেন তার চেনা
প্রাত্যহিককে গুছিয়ে
দেওয়া শুধু।
খুব বৃষ্টি হচ্ছে
সেদিন। ওই বাসিন্দাকে
সেদিন জিজ্ঞেস
করেছিলাম— ‘আপনি কী
ভাবেন সারাদিন?’
ফটাফ্ফট উত্তর
মিলেছিল— ‘ছাইপাশ’।
— দেখুন, এই অঞ্চল এমনই,
আপনি না বললে আমি
আপনাকে অবিশ্বাস করব।
— বিশ্বাস করা আবার
কেমন ব্যাপার?
— আপনার ছাইপাশ শব্দে
আমার বড় আপত্তি। আপনি
জানেন অনেক কিছু !
বলুন...
— ভুল জানেন বলছি না, তবে
আপনি ঠিক নন।
— ঠিক কোনটা?
— ওই ছাইপাশ
ভাবনাগুলি।
— বেশ, তবে ছাইপাশ
ভাবনাটা কি, জানতে
পারি?
— চলুন, হাঁটা যাক,
হাঁটবেন?
— চলুন।
আচরো বিনয়ো বিদ্যা
প্রতিষ্ঠা
তীর্থদর্শনম্; নিষ্ঠা
বৃত্তিস্তপো দানং নবধা
কুললক্ষণম্। বোঝা গেল
যে আজ কিছু মিলবে। যাই
হোক, চলা যাক। চলতে চলতে
পথ বর্তে দিল অনেক
কিছু। ঐতিহ্য আর
ইতিহাসের দোহাই ছাড়া
উপায় কি কিছু আছে বলতে
পারেন? যে ভাষায় কথা বলি,
সে তো হাজার বছরের বেশি
পুরনো। এ যেন, আচারে
বাড়া, বিচারে এড়া। বুঝি
না কিছু। আবার
কখনও-সখনও সবটাই বুঝে
যাই— সবটা ! সেই ইংরেজ
পেরিন সাহেব, পেরিন
সাহেব থেকে পেরিন্স
গার্ডেন, গার্ডেন
পরবর্তী পেরিন-বাগ থেকে
বাগবাজার, বাগবাজারি
গঙ্গার কল্পিত সেতুপথ
ডিঙিয়ে ধীবরের
জেলেপাড়া, বর্গি
আক্রমণের সেই সম্ভাবনা,
ঘুমন্ত ইংরেজ শাসনের
জেগে ওঠা, তাদের
নিরাপত্তার সেতু, সেতুর
নীচে খালকাটা, চারপাশ
বসতি অতিপরিচিত
মারহাট্টা ডিচ লেন !
আবার বাগবাজার বলেই
ভাষার ব্রজবুলিও আছে—
কলকাতা আছে... বৃষ্টি
আছে... প্রথম বর্ষা আছে...
আর আছে ছেলেবেলা। আছে
বেড়ে ওঠাও।
বাসিন্দাটির নাম
সন্দীপ মণ্ডল। তাঁর
স্ত্রী যখন প্রেমিকা
ছিলেন, অনেক বিকেলে এই
জায়গাটায় ঘুরে
বেড়াতেন দু'জনে। এটা
তাঁর স্ক্রীর বাপের
বাড়ির পুরনো এলাকা।
“এই যে পুরনো বাড়িটা,
এখানে আমরা বায়ো পড়তে
আসতাম। ... ওই যে, ওই লাল
বাড়িটা— ছোটবেলার
আঁকার স্কুল। আর এই গলি
ধরে সোজা গেলেই কাশী
মিত্তির ঘাট। ... বিয়ের
পরেও গিয়েছি বহুবার।"
আর এসব কথা গঙ্গার পাড়
ঘেঁষে গড়ে ওঠা বস্তির
জীবন ছাড়িয়ে, ছেলেবেলার
স্মৃতি পেরিয়ে, সাধের
ফুচকার টক-ঝাল স্বাদ
ডিঙিয়ে, গঙ্গার বুকে
অস্তগামী সূর্যের
দৃশ্যপট পেরিয়ে গিয়ে
অনুভব করেছে এক অপরূপ
প্রাচীনতার বিষণ্ণ
একাকীত্বকে। এক একাকী
মানুষও এখানে এসে বড্ড
একলা হয়ে যায়। নব্য
সংস্কৃতির ফাঁকফোকর
গলে প্রাচীনতা যেন
যথার্থই কথা বলে
অনর্গল, অবিরাম... একা
একা...
এভাবেই 'হাঁটতে-হাঁটতে
হাঁটতে-হাঁটতে একসময়
যেখান থেকে শুরু
করেছিলাম সেখানে
পৌঁছুতে পারি'— কবির
কথা। কবি তো কত কী বলেন।
তার একদিন ইচ্ছা হল
নদীতে মাছ ধরা দেখবে।
সে দেখতে গেল। মাঝিকে
বলে তাঁর ডিঙিতে উঠল।
তারপর মাঝগঙ্গায় গিয়ে
একদিকে কলকাতা, আর এক
দিকে হাওড়া শহরটাকে
দেখল। আহিরিটোলায় যে
লঞ্চ ঘাট আছে, তা
পেরোলেই বাঁধাঘাট।
ঘিঞ্জি এলাকা। বালক
ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর বাবা
ঠাকুরদাস
বন্দ্যোপাধ্যায়ের
সঙ্গে পায়ে হেঁটে
বেনারস রোড হয়ে এই
বাঁধাঘাটে
পৌঁছেছিলেন। পরে আবার
এখান থেকে নৌকাযোগে
বড়বাজারের এক বাড়িতে
গিয়ে উঠেছিলেন। কারণ,
কলকাতায় গিয়ে তাঁকে
ইংরেজিতে লেখাপড়া
শিখতে হবে। শোনা যায় যে,
বিদ্যাসাগরের ঠাকুরমা
দুর্গাদেবীর
অন্তর্জলি এই
বাঁধাঘাটেই হয়েছিল।
এখান থেকেই আরও একটু
এগিয়ে গেলেই পড়বে নতুন
মন্দির। যা শেঠ বংশীধর
জালান স্মৃতি মন্দির।
উপাস্য দেবতা শিব। আরও
এগোলে শীতলা তলা।
যেখানে ঘটা করে দেবীর
পুজো হয়। সবই চোখে পড়ে
প্রাচীন এই জনপদে।
বিশ্বাস করুন, উত্তর
কলকাতার ছাপ ওপারের
সালকিয়াতেও। আর এই
ঘাটটি তৈরি করেছিলেন
মোহনলাল ক্ষেত্রী ও
কিষাণলাল ক্ষেত্রী।
উভয়েরই আদি বাসস্থান
ছিল পাকিস্তানের
মুলতানে। তুলো ও সুতোর
ব্যবসা শুরু করেছিলেন
তাঁরা। সেই পরম্পরা আজও
আছে। এরপর তাঁরা তৈরি
করেছিলেন জুট প্রেস।
ব্রিটিশরা যার নাম
দিয়েছিল 'Empress of India Jute Press'।
যত জানছি, তত পরত খুলে
যাচ্ছে। বুঝতে পারছি
যে, কেউ চট কিনতে চাইলে
লোকে কেন এখানকার কথা
বলে। এভাবেই এসব পথ
প্রাক্তনীর সঙ্গে
হাঁটতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু সব চাওয়া তো আর...
গঙ্গা ভাসিয়ে নিয়ে
গেছে। গঙ্গা ফেরতও
দিয়েছে— জীবন। যদি কেউ
দুঃখ দেয়, আমি তাকে
সোহাগে আগলে রাখি। যদি
কেউ দুঃখ দেয়, সে তো
অমোঘ— তার আত্মার কোনও
ক্ষয় নেই। যদি কেউ দুঃখ
দেয়, তা ‘সত্যম্,
জ্ঞানম্, অনন্তম্
ব্রহ্ম’-এর মতো অনন্ত।
আমাদের ভাবনাগুলি
অনেকটা ঘোড়ার মতো— ছোটে
সে— বিষয়ের প্রতি আরও
জোরে ছুটতে ছুটতে আহত
হয়। আমরা বেশিরভাগ
মানুষই ভালো সারথি হতে
পারলাম না এখনও। ঘোড়া
ছোটাতে জানি সকলে,
কিন্তু সময়বিশেষে
লাগাম টানতে শিখলাম না।
এ হাঁটা একলাই। এ পথ
একলারই। এ জীবন একলার
নয়। ওই যে বলেছিলাম,
অনুপ্রাণিতে বাঁচা,
তাকেই ফিরিয়ে দিয়েছে এ
নদী। এ নদীর ধারে
কবিতার ঘরবাড়ি। ইট দিয়ে
তৈরি তা। বিদ্যুৎ নেই।
বাড়ির বারান্দায় মাদুর
পেতে বসে তোমার সঙ্গে
কথা নয়, দেখতে চাই নদী—
যে নদী ঈশ্বরে আবৃত। যে
নদী ভয়শূন্য। যে নদীতে
রোগমুক্তি ঘটে। যে নদী
আমাদের ভিজিয়ে দেবে, যে
নদীতে ডুবে স্পর্শ করব
তোমায়, স্ত্রীবন্ধু।