সোনালি অসুখ
তুই কে? তোর হাত জুড়ে কার
আঙুল! তোকে আমি চিনি না।
তাতে কী! চল, আমার হাত ধর,
বেরিয়ে পড়ি দুজন।
জনান্তিকে।
তুই কখনো গজগামিনী,
অলকানন্দা; মেঘদূত থেকে
ছিটকে পড়ে হারিয়ে যাস।
অথবা ফিদার ক্যানভাস
থেকে বেরিয়ে নিজেই
ক্যানভাস ডুবিয়ে দিস
রঙের হল্লায়। রঙের
হল্লায় এমন শূন্যতা
দেখেনি পৃথিবী, ধূলিকণা
দেখেছে লাল হয়ে আছে
উত্তরের আকাশ। তুই
ধূলিকণা ছিলি রক্তের
ভিতর।
এই রক্তের আর্দ্রতা
তোকে প্রতিরাতে
শৃঙ্গার করে জানি।
আমি জানি, শৃঙ্গারে হয়ে
উঠিস তুই মন্দাকিনী!
তবু শুধু ভাঙনের কাল;
ডুবে যাই চরাচর। কেন
ভাঙে না সমস্ত? চল,
পালিয়ে যাই। শুরু হলো
বুঝি আবার ঝড়ের মাতম।
এভাবেই চিরদিন।
ক্লান্তি নেই। এইসব কী?
এতো জটিলতা নয়, সহজ
হিশেব! অন্তরালে ছিঁড়ে
জাল। ছিঁড়ে নাকি?
অন্তরালে তো পাতা আছে
দিঘল আন্তর্জাল। এই জাল
অক্ষয় চিরদিন। কোথায়
অবসান? ছায়ায় তো
দিনাবসান।
রাত আসে। রাত্রিরা
জান্তব। কেউ মরে না।
পরিণত ধ্বংসের
প্রতীক্ষায় জেগে থাকি,
জেগে থাকি; আমি
শূন্যতা।
এই যে আমার শরীর, এই যে
সোনালি বিষ আর কহর, এই যে
পলিমাটি হাহাকার, এ
মানবেতর; খুঁজে ফেরে
পুষ্প ও অধর। কেবল
শরীরে নয়।
এইখানে বারোমাসী আবেগ,
আছে শ্যামল রোদ্দুর,
জলপাই কাতরতা আছে
ভাসমান নাভীসুর...
তুই দাঁড়া! তোর সঙ্গে
যাবো গহ্বরে। দাঁড়া
হাওয়াঝিরি। শিকড়
ছেঁড়ার দিন প্রতিদিন।
শিকড় তো ছাড়ে না। কেউ
ভুলে আছে। তাতে কী! কেনো
এখানে মেঘের ঘনঘট, কে
ঘটায় মেঘের ঘটনা, কে করে
হল্লা, কেন কলহ, কেন
প্রতিযোগ ছিনাল, কেনো
অনসূয়া পলাতক? অসহিষ্ণু
বীজাণুরা অক্টোপাস।
কে করে তালাশ? কেউ হারতে
চায় না।
তুই তা জানিস না, আমিও
জানি না। তবে তো সহজ! আয়,
হাতে হাত বাঁধি।
আয়, পান করি নদী।
ডাকে তক্ষক।
তাকে কী! আয়, বাঁধি
কণ্টকে কণ্টক।
চল, পালাই, ফসলের মাঠে
মাঠে আগুন লাগাই। ফসলি
জমিতে খরা ফুটে থাক।
চল এক চুমুকে পান করে
ছুঁড়ে দিই সোলালি যৌবন;
চল কেয়াবনে প্রজাপতি
হই, হই কেয়াবন।
তুই কখনো নন্দিত
অভিমান। সহসা হাসিতে
ম্লান করে দিস
দিকচক্রবাল।
আর নিঃশব্দ চুম্বনে ঝরে
পড়তে চায় তোর পায়ের
পাতায় পৃথিবীর সকল
নির্ঝর।
আর তুই ফিরেও তাকাস না,
নিষ্ঠুর।
এইসব ঘানি টানার মানে
কী? কেন রাই-সর্ষের বনে
এমন হনন। কী দরকার বয়ে
বেড়ানোর? সিসিফাস হয়ে
থাকার কী মানে?
প্রতিযোগ ভালো লাগে না:
চারপাশে প্রতিযোগীর
ভিড়।
যেই গৃহে অন্ন নেই সেই
গৃহে করি বাস হাজার
বছর। অন্নের ধারে তৃণ
লাগে—তৃণাঞ্চল অঝর।
আয়, তৃণে ধরি প্রাণ।
আয়, বাঁধি তালে আযানের
গান।
না, আমি সিসিফাস হবো না।
রাত্রি আমার কাটে, কাটে
না অমা।
তোর হাতজুড়ে কার আঙুল?
তাকে চিনি না। তাতে কী
আসে যায়। শৈশবহীন কে
আছে আর? সে যদি তুই তবে
আয় হাত ধর, ঋতুগন্ধে ডাক
দিয়ে যাই। দাঁতে মাছের
রক্ত লেগে আছে! পরোয়া
করি না। আমি কতোটা তরল
তাও জানি না।
জানি নদ আছে নদীরূপ।
রক্তের নদ শিরা
উপশিরায়।
কান্নার নদ আছে চোখের
ওপারে।
স্বেদের নদ রোমক‚পে।
ক্লেদের নদ আছে অন্ত্রে
অন্ত্রে।
কামনার নদ রক্তের
ঠোঁটে।
নদে নদে ভেসে আমি হয়েছি
প্লাবন শতদল,
আমি তোর হাতের মুঠোয়
ভেঙে যাই রুপালি অনল।
তুই কখনো লিথি। চোখ
ভেঙে বয়ে যাস দিগন্তের
দিকে। তোর বুকে চুমুক
দিয়ে ভুলে যাই জীবন।
তুই পাহাড়ের ভাঁজে
হারিয়ে যাস চিরচেনা
শালবন।
তুই সবুজ পাথর।
তুই সুধা! অমল পাবে না
কথনো সুধাপুষ্পের
ঘ্রাণ।
তুই শাদাপরী! আমাদের
পুকুর পাড়ের জবার ঝাড়ে
হঠাৎ বিস্ফারিত শাদা
জবা।
তুই মৃন্ময়ী রাত।
তুই অনিন্দ্য, নিবিড়
জলপাইবন, উদ্গত
অঙ্কুরের আভরণ ভেঙে
স্তন চেপে ধরিস আমার
বিস্ময়াহত ওষ্ঠাধরে।
তুই বুঝি দুধে জল মেশাস!
বিশ্বাস করি না। তোর
স্তনের বাটি তো পূর্ণ!
ওখানে জলের জায়গা কই?
তোকে মা ভেবে আমিই কেবল
দিতে পারি চুমুক, জল তো
পারে না। তোর নোনতা
স্বাদে সাধ জাগে
আরেকবার মরে যাই। দুধ
খাওয়া বারণ। তারপরও তুই
স্বপ্নের বেকার
কারিগর। আয়, আমরা
দিবালোকে মিলিত হই উথল
সঙ্গমে। ভেঙে দিই
সভ্যতার কাচের মুখোশ।
আয় পৃথিবীকে ধ্বংস করে
পালিয়ে যাই, অতিক্রম
করি ইতিহাস, হই প্রথম
অ্যামিবা।
মৃত্যুলোকের ঘর কতোকাল
পোষে রাখবো পরস্পরের
রন্ধ্রে? আয়, পরাজিত
মানুষের পদমূলে চিতা
জ্বেলে পালিয়ে যাই।
কুমারী তৃণে যে শিশির
জেগে থাকে রোদের
কামনায়, সে মিথ্যে কিছু
নয়, কিছুটা প্রাকৃতিক।
তোর প্রকৃতি তোর
নিরাভরণ সৌকর্য ছুঁয়ে
যায় মেঘ। তাও সত্য।
বাতাসে কে আসে? একখানা
প্রেমের কবিতা লিখে
ফেলি ঘটমান যুদ্ধের
বিপক্ষে। পক্ষ বুঝি,
শুক্লপক্ষ। দিন রাতও
আসে কদাচিৎ। তুই কে,
দগ্ধ করিস রাত্রিদিন?
মোহ আর কাম দাহন করে
গাভীন পৃথিবী। তারপরও
আশ্লেষে ঘুমিয়ে পড়ি না।
ঘুমোবার কৌশল কবেই
ভুলেছে চোখ! চিবুকের
নিচে কাটাদাগে লেখা আছে
অতল অসুখের প্রাক
ইতিহাস।
কোন সে অসুখ,
কবে হয়েছে তা পীতবর্ণ
সুখ?
তবু ঘোর জেগে থাকে। চোখ
সে কবে মেঘের পাল্কি!
অনূঢ়া মেঘের চোখের খাতা
কোন বিষাদে ঢাকা? একটা
চশমা বিক্রি হবে
কাচবিহীন। কেবলই ফ্রেম,
কেউ কেনে না। ওরা চোখের
মর্ম বুঝে না, বুঝে শুধু
কাচ।
চৈতসংক্রান্তির ভোরে
তার শালবনে রোদ এসে পড়ে,
সাংগ্রেং এ জলকেলি হবে
একটু পরে—
তার কেশদাম সাজে এরপরে
থরে বিথরে।
তারা বর্ষাকে করে নেবে
বক্ষের সংসার।
বুকের বিলাস ভেঙে
বিদ্রোহ করে পাঁজরের
কখানা হাড়।
ওরা কি চায় স্বর্গসুখ
শরীরের স্বপ্নিল
ক্ষুধায়?
অবচেতনায় বাজে যে বেহাগ
তার নাম পদ্মপুকুর।
কেন বেজেছিলো রাতের
বেহাগ, কেনো উদাসীন
দুপুর?
রাতে রাতে খাড়ির নিচে
চুরি হয় স্রোত। সেই
স্রোত প্রশান্ত উতলতা
হয় চোখের অতলে। ওখানে
সমস্ত রক্ত স্থিও বিশদ
অস্থিরতায়। অস্থিরতার
নাম মৃত্যু নয়, জীবনও
নয়।
শেষ কি অবশেষে হয়েছে
অশেষ,
আশ্লেষে ঘুরে কোন সে
ক্লেশ?
কখনো দ্বেষ আসে জীবনের
ঘোলা চোখে, জীবন
মৃত্যুকে কামনা করে;
মৃত্যু বড় কঠিন। সে
নিজেই জানান দেয়। ঘড়ি
চলে ঘুড়ির চালে।
কোন সে চালক?
মনে হয় সে অর্বাচীন। সে
কি বালক?
ধরা দেয় গান, কাঁদছে
আযান।
আয় সখা, বেঁধে ফেলি
শঙ্খতালে আযানের গান।
শেষে গানই সত্য হবে।
কে সখা, কে তুমি বঁধু
আমার?
কে হায় বন্ধুজন, খুঁজে
ফেরো আলেয়াহত অন্ধকার!
হলুদের ঘর আছে, বৃথায়
খোঁজো। এখানে আঁধার
সত্য, আলো সত্য নয়।
বুকের কখানা হাড়ে
স্বপ্ন বাঁধা যায়,
সুর্মাপাহাড় কবে গড়ায়
সুরমার উরুসঙ্ঘে? কে
হাঁটে জীবনের ভুলে,
জীবনের ভুল কতোটা উতল,
কতোটা তার চোখের জল?
আমি তার অধরোষ্ঠে
ওষ্ঠাধর রেখে হয়েছি
আকণ্ঠ। আমি কি অমর? এখনো
জানি না। জানি, শুধু
ঘুচেনি আজো যাপনের
অমা।
অস্থিরতা আছে, কামনা
আছে। বরফ আর আগুন আছে
তবু তুমি কে দাহন করো
চিরদিন? কে তুই একই
সঙ্গে মোহ ও মোহনার সুর
শেখাতে চাস? অবলীলায়
লীলা করে ঘূর্ণিপাকে
টেনে নিবি লৌকিক বসত!
হাজার বছর পড়ে থাকে
বনের পর বন; ঘাস আর ঘাস।
তবে কি ধূসর সত্য,
গায়ত্রী সত্য নয়?
লেলিহান জীবনের স্বেদে
বাঁধা আছে জীবনের গান।
মৃত্যু সত্য, গান সত্য
নয়।
লাল মদ
নির্জন ত্বকের পারে ধরে
আছো মদ
আজ নিরালা সাক্ষী হোক
ডাহুকের রক্তের দাগ
এখনো সকাল
খুরের ভাঁজে পথের পাথর
হিম
কাঙ্খে দোলাবে কোন
মাঙ্গলিক খরা
ধানকূপে আমি আছি
তালপত্রে আর তুমি
হেমন্তিকা নীল
চিহ্ন চিরে আসি চিহ্নে
উৎসবে
কোথাও নৃত্যপাঠে
উল্লম্ব অমৃত লাল
অজানিত
আমি বেড়ে উঠি সুন্দর
স্পর্ধায়
আমি শস্যের গোপন প্লাবণ
তার হাতে তুলে দেবো
পৃথিবীর অন্ধকার
আমি তাকে আলো নামে ডাকি
বাকি থাকে একটি দিন
হাজারটা দিন
অন্যদিনের মোড়ে
দাঁড়িয়ে কাকে খুঁজি
পাশাপাশি বনের
প্রান্তে মাঠ আর গ্রাম
জেগে
অন্ধকার তার চোখের
কাঁখে
তাকে চিনি না