আমরা যখন বাঁশের কঞ্চি
মতো জলের ভেতর ঢুকে
যেতাম নিজের শরীর লয়ে,
মাছেদের কিঞ্চিৎ কষ্ট
ভুলে গিয়ে তাকিয়ে
দেখতাম জলের টলটলে
শরীর। ওখানে ঘোলাটে
চোখের সামনে নিজেকে
নির্লজ্জ রকমের
বিন্যাসের সাথেই
একেবারে যুক্ত করে
দিতাম ঊরুর কাছে, এরপর
হাতের আঙুলগুলো
বাঁকিয়ে সাপের ফনার মতো
করে কিছু একটা টেনে
টেনে দেখেছি বহুদিন,
ওটার নাম ছিলো শৈশব।
কেবল মেঘনার নিঃসঙ্গ
জলের ভেতর আমরা আলাদা
হয়ে গিয়েছি বহুদিন
যতক্ষণ বাঁকের মুখে
নিশ্বাসটা আটকে না আসে।
আর যারা একটানা কয়েকটা
গুণটানা নৌকার মাঝি
তাদের কাছে জানতে
চাইছিলাম কেরায়া নৌকায়
কার লাশ যায়! মনে আছে এক
বর্ষায় ঘাটে ভিড়েছিল এক
নগ্ন নারীর শরীর,
মাছেরা তখনও তারে খেয়ে
শেষ করতে পারেনি এমন
সময় রাতে কী ঘুম হয় ! দশ
বছরের আমার মনে হলো এই
নদীটাই তো তার হয়ে গেছে,
আমাদের ঘাটের সেই
কোণাটায় যেখানে নারকেল
গাছটা নুইয়ে আছে,তার
তলায় মেয়েটি সম্ভবত
মরেও প্রশ্রয় চাইছিলো ।
সবাই বলাবলি করে
কমবয়েসী মেয়ে"
নিশ্চয়ই আত্মহত্যা !
হয়তো অনার্য সন্তান
পেটে ল্যাক্টোজ হজম
করার মতো একটি নতুন
কিছু !
পালোয়ানের মতো মন্না
নামের লোকটি তারে
ঠ্যালে দেয়, আসলে তার
নাম মান্না, সবাই বলতো
মন্না, হাতের পেশীগুলো
তার দৃঢ় যেন মধুদের
বাঁশতলার সবচেয়ে শক্ত
অংশটি। এবং লাশটাকে
ভাগিয়ে সে দুপুরের ভাত
খায় আমের ডাল দিয়ে
মেখে। আঙুলের ফাঁক
গলিয়ে বেরিয়ে আসা ভাতের
দলাগুলো লাশের মতো সাদা
সাদা খই হয়ে উঠতো। আমি
বড় হয়ে উঠতে উঠতে
জেনেছি সে কেমন পাশের
বাড়ির দিদিটারে
মেনীমাছ বলতো, আর
আঙুলের ফাঁকে সুকৌশলে
আঙুল ঢুকিয়ে টিকিটের
দাম চাইতো হয়তোবা। অথবা
কুৎসিত কারো মতো করে
ছিলে খেতো সাগর
কলাগুলো। যেন তার মোটা
তাজা কালিবাউশ মাছ
টাইপ যৌনাঙ্গের রকমারি
সুখ।
আমি আরও বড় হচ্ছিলাম,
এবার ঘাটে ভিড়েছিল মস্ত
বড়ো একটা ভেলা,আমি
ততোদিনে পড়েছি বেহুলা
ভাসান,এবং ঘাটে যাবার
সময় একটা গামছা মা
ঝুলিয়ে দিতেন শরীরে।
ভেজা নীলাম্বরী না হোক,
হোক তা তা নারীর শরীর।
ঘাটের জল যখন সরে যায়
দূরে দূরে কচুরিপানার
কাছে,বেলা বাড়লে আমরা
শেষ লঞ্চের অপেক্ষায়
দাঁড়িয়ে থাকতাম বটতলার
কাছে। কোনোদিন হয়তো
জুটে গেলেও যেতো একটা
অচেনা যুবকের
চোখেমুখের পাষবিক
হিংস্রতা। আমরাও আরও
বড় হই তখন, প্রেমপত্র
জুটে, স্কুলের ড্রেসের
ক্রসবেল আর মায়ের চোখের
কড়া ভাষা।
আমার চিঠিগুলো
সংগ্রহের জন্য একটা
ড্রয়ার খুব দরকার ছিল,
অথচ মায়ের আলমারিতে
একটা ড্রয়ারের মালিক
তখন দাদা, এক দুপুরে
গোপনে খুলে দেখি ওর
পেনফ্রেন্ডের সব
চিঠি,অথচ মেয়েটি ওকে
মেয়ে ভেবেই চিঠি লিখতো।
দাদার ড্রয়ারে
পেয়েছিলাম সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায়ের
রক্তমাংস উপন্যাস !
এই লকডাউনে আবার
পড়ছিলাম রক্তমাংস,অথচ
আমি আবিষ্কার করি আমি
পাঠক হিসেবে মরিনি,কেবল
বড় হয়ে গেছে জীবন বয়সের
কাছে। এ জীবনটা আমার
কাছে প্রত্যাশিত
স্বচ্ছতার ঘাটতি নিয়েই
আছে,আর জীবনে হয়তো এ
জীবন থেকে তুলে রাখবো
কয়েকটি চরিত্র। আমাদের
পুরাতন বাড়িতেই থাকবো
আমি বেশ কয়েকটি রাতের
জন্য, আমায় সেই রাতগুলো
কৈশোরীয়,যেন রূপকথার
তোলপাড়। কাকিমাকে আমার
মনে হতো পৃথিবীর সবচেয়ে
সুন্দর মানুষ,কেমন
দাবার ছককাটা তাদের
ঘরের মেঝেটা, বিকেলে
লম্বা চুল ছাড়ায়ে যিনি
বসে থাকতেন নদী লাগোয়া
বাগানটায়,বিপরীতে আমার
মায়ের তখনও শেষ হয়নি
গোবর মাটিতে ঘর লেপার
কাজ! ভাবতাম মা কেন
কাকিমা নয় !
আমাদের কলতলায় যেখানে
লম্বা পাইপটা ধরে
বিকেলে টাইমের জল আসতো
ওতে মুখ লাগিয়ে কতক্ষণ
জল খাওয়ার রেকর্ড করেছি
মনে নেই,তবে জলের বিল
দিতেন বলে জ্যাঠা তো
তার মুখে লোহার বাকশো
বসিয়ে দেন, আমার মা
স্নান সেরে উঠবেন
সন্ধ্যা নাগাদ,আমি
দাঁড়িয়ে থাকতাম মায়ের
কাপড় পেটিকোট নিয়ে, আর
দেখতাম কলতলার জল
গড়গড়িয়ে নামছে
হিজলতলার পুকুরে !
যে বার বন্যা বয়ে যায়, জল
ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় ঘরের
চৌকাঠ অবধি। মাঝে মাঝেই
নিরীহ সাপগুলো এসে পড়লে
তাদের সাথে গল্প জুড়ে
দিতো মা ! আমি মা মেজদি
আর ছোটভাই আমাদের
চালাঘরের অচ্ছ্যুত
সংসার যেন তখন, বাবা
আটকে গেলেন তার কেরানি
জীবনে, কেননা মাইনে না
পেলে বাড়ি এসে কী করবেন !
মা আমাদের গল্প শোনাতেন
তখন জলের ভেতর মাছের
জীবনের। কিলবিল করতে
করতে মাছেরা আমাদের
ঘরগুলো তখন ভরে দিতো,
আমাদের মাছ খাওয়ার লোভ
হয়নি তখনও, কেবল মাছ
ধরতে চাইতাম লোভীর
মতো।
আরও বড় হয়ে লোভী হয়ে
গেলাম কেমন! একটা আলাদা
ঘর হলো, জীবন হলো, এবং
ছেড়ে আসার সময় আমার
সবচেয়ে মায়া হয় আমার
ঘরের ফ্যানটার জন্য, ও
যখন অনবরত ঘুরছে অনেক
রাত অবধি আমি কথা বলেছি
প্রেমিকের সাথে,ও সব
জানতো। গোপনের কথাগুলো
ঘুরতে ঘুরতে হারিয়ে
ফেলে নিজেদের ভাষা,
হারায় প্রেম
প্রক্রিয়াটি। তবুও
কেমন ছেড়ে আসা যায়
পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে
অস্বীকার করে! যেন
মানুষেরাই গিলে নেয়
ঘুরন্ত রোদের কাফেলা,
বৃষ্টি নামায় একলা।
আমার ঘরের ভেতর আমার
নিজেকে সেই শৈশবের মাছ
মনে হয়,একবার যেখানে
শামুকে কাটছে পায়ের
বৃদ্ধাঙুল,আমি মাছ হয়ে
আমার ঘরে ঢুকে
যাই।সাঁতার কাটতে
কাটতে ভীষণ কান্না পায়,
পাশে তাকিয়ে দেখি
সামাজিক দূরত্বের
পরিধি ক্রমশ বিষন্নতা
দীর্ঘশ্বাস লয়ে মরে
যায়। আমি আমার
ব্যক্তিগত ড্রয়ারে
রাখা চিঠিগুলো খুললে
যত্রতত্র নির্বিকার
হয়ে যায় আমার নিজস্ব
চোখ,কোথায় হারিয়ে গেছে
জীবনের গল্প বসন্ত
প্রত্যাখ্যান কিংবা
খুনির প্রাপ্য দুঃখ!
কোথায় পৌঁছে দেওয়া
হয়েছে আমাকে অক্ষরের
আলোর বেগের ধ্রূবক
করে। আমি জানতে চাইলাম
বৃত্তের পরিধির উড্ডয়ন
পরিভাষা, দেখি দূরের
প্রতিটি প্রয়াসে কেবল
নীরিক্ষার অব্যক্ত
কায়ক্লেশ। আর আমি
প্রতিটি সূর্যাস্তের
কাছে একটা একটা চিঠিকে
পাঠানোর ম্যাপটাই
হারিয়ে এসেছি।
ভালো লাগে নিজেকে সরিয়ে
নিতে পারার সীমারেখা।
আবিষ্কার করা যায়
পরিযায়ী পাখি গাইছে
গুনগুন করে একা, মজা
পুকুরের জলে ব্যাঙাচিও
আমার মতো একা। নিঃসঙ্গ
মাছরাঙাটা জলের কাছে
বসে থাকে দুপুরের
কাছাকাছি তৃষ্ণা লয়ে,
বিকেলের পানিকৌড়িও
জানে তার ডানার বাতাসে
ঝাউপাতা হয়ে যায় আকাশের
সমভূমি। স্বামীহারা
বিধবা পিসিমার উলের
কাঁটা একটানা কতগুলো
আঙুল বুণে গেছে ভাবতেই
আমার ভালো লাগে, আমার
ভালো লাগে বৈধব্যের
লাগাতার শব্দ, তারা
বাঁচতে বাঁচতে জীবনে
শিখিয়ে দিচ্ছে পরদিন
আবার না ফিরেও গান
গাওয়া যায় নিজেরই জীবন
থেকে !
এরপর আরও চিঠি আসে, দম
হারিয়ে চিঠির খামে থাকে
ঠিকানাহীন গহীন
অন্ধকার। ভালোবাসারা
তো চুটিয়ে সংসার
করছে,জানছে জীবন থেকে
তুলে দিতে হয় মাখনের
মতো সুস্পষ্ট ইঙ্গিত।
জীবন তবে কেমন আমার
কাছে? আমি অবাক হয়ে
দাঁড়িয়ে থাকাটা শুধু
অনুভব করি, কেবল মনে হয়
জীবন মানে আমি অজস্র
দিন একা দাঁড়িয়ে গুণছি
পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের
তারাগুলো। আবার ভাবছি
আপাতত তীর্থই হয়তো
আকাশ, আমি হলে নিজেরে
দিতাম সপ্তর্ষির একটা
সময় , কেউ তো ভালোবেসে
খুঁজে বেড়ায় তাদের যৌথ
জীবন ! আমারে হারানোর
ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে না
যেহেতু কোনো অর্বাচীন
হৃদয়, প্রশ্নের জবাবে
কেবলই নিজস্ব আত্মজ তার
কাছে বন্ধকী রাখার
অভিঘাতিনীও জানছে
মানুষ ফিরে আসে কেবল
নিজস্ব জানালার কাছে
প্রয়োজন হলে ।
এক রাতের অন্ধ দোকানী
জানিয়েছিলো কীভাবে
আবিষ্কার করতে হয়
তারাদের পথ,অথচ সে অন্ধ
ছিলো না। আমি জানতাম
মানুষের মতো সাদা থকথকে
চোখগুলোই আলো,আলোর আবার
অন্ধকার জমিয়ে রাখা হয়
নাকি ! সেখানে তো
পৃথিবীর সমস্ত মরীচিকা
হয়ে সুখের কথা বলে!
সুখও তো আমার বইয়ের
পাতায় মরে যাওয়া
প্রজাপতির ডানায়
কার্তিকের গন্ধ হয়ে
গেছে ।
এরপর থেকে আমি একাই এক
বৃহৎ ইন্দো-ইরানীয়
হিজল,নুয়ে আছি পুকুরের
জলে ভেসে আসা সেই
লাশটার অপেক্ষায়, আমি
তারে ঠাঁই দিতাম
সপ্তর্ষি পুলস্ত্যের
দরবারে। এরপর আরও লাশ
ভেসে এলে আমিও ভেসে
যাবো ইন্টিলেকচুয়াল
লাশের মতো।
এমনতর হিজল গাছ একাই
বাঁচে,বাঁচতে হয়, আমিও
বাঁচি। আবারও চিঠি
পেয়েছি এই লকডাউনে
খুঁজে পেয়েছে জলবায়ু
পরিবর্তনের প্রস্তাব,
প্রস্তুতি নিচ্ছে ভীষণ
করে শরীর ভাগ করে নেওয়া,
যেন এসব শরীরগুলোকে
কেবল উত্তপ্ত লোহিত
সরণের কাছাকাছি লয়ে
যতদূরে যাওয়া যায়
সেখানেই দেয়াল ঘেঁষে
গড়ে উঠে ঘর সংবাদ বিয়ে,
আমি সব চুকিয়ে টিকিট
কাটছি আমার জলের ঘরে
ফিরে আসার মতো
ময়ূরপুচ্ছ লয়ে।