অশীতিপর ঠাকুমা এখনও
বসে আছে বারান্দায়
রোজকার মতো। তেলচিটে
ময়লা গামছাটা টিকে আছে
বুকের উপর আলগোছে। মা
এক পাতিল গরমজল করে
মিশিয়ে দেবে বালতির
ঠাণ্ডা জলে। তারপর বুড়ি
চানে যাবে। রোজ ঠিক চান
করার আগের এই
সময়টুকুতেই সে
বারান্দার এই কোণে বসে
উঠোনের লিচু গাছটার
দিকে তাকিয়ে থাকে আর কি
যে ভাবে! প্রতিবছর নিয়ম
করে নাতিরা গাছটির মাথা
ছেঁটে দেবার পরেও আবার
সবুজ পাতা গজিয়ে উঠলে
হয়তো তার বড় ছেলের কথা
মনে পড়ে। কত বছর আগেকার
কথা বলরামের হাট
থেইক্যা কলমের চারাটি
আইনা বুনছিল বাবু!
তারপর কুঁজো হয়ে যাওয়া
শিরদাঁড়ায় একটা ঘূর্ণি
বাতাস উঠলে হয়তো তার
রাখাল রাজার কথা মনে
পড়ে। যে তার পাঁজরের
সবকটি হাড় দিয়ে বাঁশি
বাজাতে বাজাতে গানের
মাঝপথেই উধাও হয়ে
গেছিলো। গুনগুন করে ওঠা
সেই গানটি শেষ হবার
আগেই জল গরম হয়ে যায়।
শরীরের সাথে প্রায় মিশে
যাওয়া স্তন দুটির উপরে
গামছাটি একহাতে চেপে
ধরে সে এগিয়ে যায়
কলপাড়ের দিকে। শীর্ণ
দুইহাতে কলের হাতল চেপে
কুয়োর ভেতর থেকে ঝরনার
মত জল বের করে আনে।
বিবর্ণ হয়ে যাওয়া রঙের
কৌটাতে বানানো মগ দিয়ে
জল ঢালে মাথায়। আর
কালের ভাঁজ পড়া ত্বকে
পাকা লিচুর খোসার মতো
রং ফুটে ওঠে গড়িয়ে পড়া
জলধারার নিচে!
পাখিদের পাঠশালা
প্রতিদিন দাওয়ায় বসে
চিমনির কালি ধুয়েমুছে
সাফ করে মা। কাঁচের
ভঙ্গুরতা বাঁচিয়ে,
ধারালো আঘাত বাঁচিয়ে
শাঁখা, পলা ও কড়ার শব্দ
তুলে রাখে গোপনে,
গোধূলির কাছে! সন্ধ্যে
নামলে তার দুই বাহুতে
বসে শালিকের মতো আমরা
চার ভাইবোন বাবার
অপেক্ষা করি।
হারিকেনের আলোতে নামতা
পড়তে পড়তে অন্ধকার
আরেকটু গভীর হলে
ডায়নামো লাগানো একটি
সাইকেল ঢুকে পড়ে
বারান্দার পাটাতনে,
ঘণ্টির আওয়াজ ছাড়াই।
রাত আরেকটু গভীর হলে
পুনরায় কালি জমে চিমনির
গায়ে।
এতগুলো বছর কেটে গেল! এক
অনন্ত অন্ধকারের পথে
সেই হারিকেন হাতে নিয়ে
কাকে যেন খুঁজতে বেরিয়ে
গেছে বাবা। আমি বসে বসে
দেখি- সন্ধ্যে হল, এখনও
মায়ের দু’হাত থেকে কিছু
পাখি উড়ে গেল, কিছু পাখি
তার গলা জড়িয়ে
ঝিমোচ্ছে। বাবা এল, মা
বৈদ্যুতিক পোলের ন্যায়
দাঁড়িয়ে আছে। মায়ের
জীর্ণ তারের ভিতর দিয়ে
বয়ে যাচ্ছে বাবা।
অন্ধকার হয়ে গেছে।
মায়ের রক্তশূন্য মুখের
দিকে তাকালে এখনও একটু
আলো জ্বলে উঠতে দেখি!
উঠান
জোছনার কুহক জুড়ে লেখা
কত গজল্! এবড়ো খেবড়ো
শস্যখেত ভরে আছে ফসলের
শ্লোকে! আমাদের
পূর্বজরা কি কখনো এদের
জুড়ে দেবার আপ্রাণ
চেষ্টা করেছিলেন? ফাঁকা
স্কুলে আমি আর তুমি।
আমাদের ভাই-বোনেরা কে
কোথায় ছড়িয়ে আছে তা
জানতে হলে আজ স্বপ্নে
যেতে হবে। ঝরে উড়ে
যাওয়া অথবা চুরি হয়ে
যাওয়া চালের ফাঁক গলে
আসা সূর্যালোক
শিক্ষকের মতো আঙুল দিয়ে
দেখালো- আকাশের
চারিদিকে কীভাবে ভেসে
বেড়ায় গাছপালা, নদী,
জল,ইট,কাঠ,পাথর ! এতসব
যোগাড়যন্ত্র দিয়ে আমরা
গান তো লিখলাম শেষ
পর্যন্ত। কিন্তু ঠিক
সঙ্গীত হল না। আমাদের
দুজনের মাঝে একটা উঠান
অপেক্ষা করে আছে আজও!