আমার বান্ধবী।
দেশোয়ালী বলে দেশী। তার
কথা আমার বন্ধুরা কেউ
জানে না। তাদের না
জানার কারণটা সহজ। আমি
যে দোকান থেকে কিনি,
তারা কেউ সেই দোকান
থেকে পান, সিগ্রেট কেনে
না। দোকানটা আমার
কেষ্টপুরের গুবলেটিং
পাড়া থেকে একটু দূরে, তা
সাত আট মিনিট হেঁটে তো
বটেই।
সেদিন সন্ধ্যাবেলা
বেড়াতে এসেছি। বললাম,
দেশী, তোমার ছড়া কাটার
অভ্যেসটা খুব ভালো।
শুনি আর মনে হয়, নিজের
জেলাকেই আমি জানি না।
জানবা কি করে। আমাদের
গ্রামে তো কোনদিন যাও
নি।
আমি হেসে উঠি, দেশী,
তোমার গ্রামে না গেলে
কি নিজের জেলাকে চিনব
না?
না। চিনবা না। জানবা কি
করে, ছড়া কেটে কত খুশি
লাগে আমাদের?
তা বটে। অন্য মাটি, অন্য
নদী। হাসা উচিত হয় নি।
প্রশ্ন ছুঁড়ে দম ধরে
থাকে না যে সে হল আমার
বান্ধবী। মৃদু হেসে
বলল, আমাদের গ্রামে আসো
একদিন। ভাইকে বলে দিবা
আগে।
ভাই মানে 'ঝন্টুর পানের
দোকান'-এর ঝন্টু। আমার
চেয়ে দশ বছরের ছোট হবে।
গত বছর ফণী ঝড়ের সময়ে
আচমকাই জানতে পারি
ঝন্টুর বাড়ি রানীনগর,
মুর্শিদাবাদ। ওদিকে
আমার যাওয়া নেই
সত্যিই।
বড় কাপে জাহানকোষা
আঁকা। চা শেষ হয়ে
গিয়েছিল, তলানিতে হালকা
চুমুক দিয়ে বললাম, যাবো,
দেশী। খাজুরের সময়
যাবো। ইচ্ছে হল।
আমাদের খাজুর ভালো হয়
না। তবে আসো, অন্য মজা
আছে, ভালো লাগবে।
আমি তো অল্পেই খুশি,
দেশী। হ্যানোত্যানো না
হলেও চলবে।
ঝন্টু আমার 'দেশী' বলাটা
জানে, আমার বান্ধবী
ভাবাটা জানে না। কেউ
জানে না। বান্ধবী
ভাবাটা জানি একমাত্র
আমি।
আমার বান্ধবী এখন
রানীনগরে মশগুল।
রান্না করছে নতুন
ফুলকপির রোস্ট। ছোলা
গাছ তুলছে। সবুজ ছোলা
ছাড়িয়ে লালচে মুড়িতে
দিয়ে সর্ষের তেল ঢেলে
মাখছে, এই এইসব।
ছোট এই ঘরের দেওয়াল
জুড়ে একটা নদীর ছবি।
দূরে বাঁক নিয়েছে। এত
বড়, এত ঝকঝকে প্রিন্ট যে
দেখলেই মনে হয় বেশ
দামী। এর সামনে আলগোছে
বসা আমার বান্ধবীকে আজ
সবুজাভ লাগছে।
মুর্শিদাবাদ জেলার
যেমন দক্ষিণ ভারী
চেহারা, আমার বান্ধবীরও
তাই। পায়ের উপর পা তুলে
ছিমছাম মাটির ঘটের মতন
বসবার ভঙ্গী, এককথায় নট
নড়নচড়ন আবহ। ডান কানে
সোনার বড় ঝুমকো, নবাবী
আমলের মোটিফ, তার একটু
দূর দিয়ে ছবির দিকে
তাকিয়ে আছি। মনে মনে
নিজেকে বলছি, দেরিতে
হলেও নদী দেখবার চোখ
ফুটেছে তোমার।
শুনলা না। কি জানি কি
ভাবছ। আবার শোনো। যে
দিবে মুঠি মুঠি, তার হবে
কোঠা কুঠি / যে দিবে কাঠা
কাঠা, তার যাবে ন্যাজ
কাটা।
পৃথিবীতে এমন কেউ আছে,
এটা শুনলে চুপ করে
থাকবে? আমিও চুপ থাকলাম
না।
তবে, কথা বলতে গিয়ে বাধা
পেলাম। আমার বান্ধবী
বলল, না। না। মানে
জিজ্ঞাস করবা না। রসের
কথা এভাবে বুঝে নাকি
কেউ? তুমি কি গ্রামের
লোক?
যেন হঠাৎ হাওয়ার ঝাপটা।
চোখে হাত দিয়ে ধুলো
আড়াল করলাম। কে বলল
গ্রামের লোক নই!
তোমাদের গ্রামে আমার
বাড়ি নয়। তাই বলে আমি
গ্রামের লোক নই? আমাদের
গ্রামে...
তোমাদের গ্রামে কী?
এগিয়ে ঝুঁকে পড়ল আমার
বান্ধবী। বেশ তো
উৎফুল্ল। কথার মধ্যে
কথা পাড়ার মজা টের
পেয়েছে।
আমাদের গ্রামে এত ছড়া
কাটা নেই। শাঁখ কাটা
আছে। আমরা দারুণ শাঁখা
বানাই।
ও, তাই! আমার চাই শাঁখা।
এনে দিবা। খাঁটি জিনিস
আনবা, যেন হাতে পড়লেই
দিলটা খুউউশ হয়ে যায়!
খাঁটি শাঁখা তুমি চিনো?
চিনো-টা এই আবহে বেরিয়ে
গেল দেখলাম।
চিনবো না? হাতে নিলেই
দেশের টান লাগবে।
শাঁখারি গ্রামের ভাব
আসবে। বুঝলে?
উফ্! 'বুঝলে' তো দেশী নয়।
ধাক্কা লাগছে এই এখানে,
আমি দেখাই।
কি আমার মন! বুঝলাম।
বুঝলাম, তোমার মন আর
ওখানে নাই।
নাই তো নাই। আমার মন
তিনদিকে ঘুরছে, দেশী।
ঠিক, সে এখানে নাই।
তিনদিকে? আচ্ছা! কিরকম!
একটা তো আজ ছড়ার পেছন
ধরছে।
হুঁ হুঁ।
আর একটা রাণীনগর ঘুরছে।
হুঁ হুঁ।
আর একটা এই নতুন ছবির
নদীর ধার ধার ঘুরছে।
(বান্ধবীর ধারে বারে
যাওয়া উচিত নয়, নদীর
ধারে সেফ।)
হা হা হা। তুমি কথা
ঘুরাতে জানো, ঠিক
বুঝেছি।
একটু ব্যোমকে গেলাম।
এরকম হলে তো খুব
মুশকিল। যত মুশকিলের
কথা জানি, তার মধ্যে
নিজের মনের কথা অন্যের
আন্দাজ পাওয়ার মতন
মুশকিল আর কিছুতে নেই।
শান্ত গলায় বললাম, মনটা
তেমাথায় ঘুরছে, সত্যি।
সেই কথাটা বললাম।
তুমি কি এই নদীর নাম
জানো? খুব যে ঘুরছ!
বাগে পেয়েছি। বললাম,
আমি কি তোমার নাম জানি?
যে এই ঘরে আরামসে বসে
আছি!
এরপর দুজনের কথা, ঠিক...
ঠিক... নাম জানতে কতক্ষণ
লাগে? তাতে কি, নাম দিয়ে
কি হবে? ইত্যাদি।
এবার আর মৃদু নয়, আমার
বান্ধবী জোরে হেসে উঠল -
তোমার সঙ্গে জমবে, আমি
জানি, তোমার সঙ্গে জমবে!
জমে গেল। কথায় কথায় জমে
গেল। সরু কথা ক্রমশ
প্রশস্ত হল। বিশাল এই
জেলা। আজও বুঝলাম না,
কথার মোহনায় আমার
বান্ধবীকে কিসের হদিশ
দিতে চাই?
চলে আসার সময় খোঁপা
বাঁধতে বাঁধতে বান্ধবী
বলল, আবার কবে আসবা?
আমি হেসে বললাম, খুব
তাড়াতাড়ি।
বান্ধবী চোখ না সরিয়ে
বলল, আসবা যেন
তাড়াতাড়ি। না হলে, ফোন
করব।
যখন রাস্তায় এসে
নামলাম, কয়েক সেকেন্ড
লাগল ঠিক বুঝে নিতে,
কোনদিকে যাবো।
প্রত্যেকবার এই হয়।
রাত্রি ক'টা বাজে দেখে
নিলাম মোবাইলে। চলতে
শুরু করেছি, মনে এল ওই
ছড়াটার কথা। জানতে
চেয়েও আমার বান্ধবীর
কাছে জানা হল না আজ।
|| ২ ||
লকডাউন শুরু হয়েছে।
লকডাউন টু পয়েন্ট জিরো,
ডে ফাইভ। লকডাউনটাই
শিখিয়ে দিয়ে যাচ্ছে,
কিভাবে দিনের পর দিন
ফোনে কথা না বলে,
হোয়াটসঅ্যাপে যেটুকু
না বললেই নয় সেটুকু বলে
থাকা যায়... কতজনকেই না
লকডাউন এমন ভাবিয়ে ছাড়ল
- ভালো, একা কিভাবে
বাঁচতে হয় শিখতে পারলাম
হয়ত...
আগের দিন যে সিগারেট
এনেছিলাম, শেষ হয়ে
গেছে। ঝন্টুকে ফোন
করলাম।
ক্ল্যাসিক দু'প্যাকেট
রাখা আছে, দাদা, বাড়িতে।
আর তোমার জন্য ঘুগনী
হয়েছে আজ।
জানলে কি করে, আমি আজই
ফোন করব?
ফোন না করলে আমিই করতাম
একটু পরে।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে ঘুরে
যাওয়ার একটা রাস্তা
আছে, সেই পথ ধরলাম। এ পথে
ঝন্টুর দোকান পড়ে না।
একটু গিয়ে ফিরে এলাম।
ঝন্টুর দোকানের সামনে
দিয়ে যাবো, কথা আছে।
আকাশ মেঘলা। বিকেল
বিকেল সরু শাটারটা হাফ
নামানো। বললাম, ঝন্টু,
দোকান খোলা নিয়ে কোন
ঝিল্লী লেগে নেই তো?
না দাদা। আমি নিয়ম মেনে
পাঁচটা আটটা - রাতের
স্লট।
বেশ তো, এটাই ঠিক আছে।
ঝিল্লী নেই, দাদা, লাস্ট
ইয়ার থেকে নো ঝিল্লী নো
ঝুট নো ঝামেলা।
সেটাই তো আমি চাই। আমার
বদলির আওয়াজ তোকে দিক,
তোর চিন্তা নেই।
কাউন্সিলার মেপে নিয়ে
ঝাঁপ খেয়েছে। ঝন্টু
মুখে শিস দেওয়ার মতন
ছোট, তীব্র শব্দ করল।
একবার এদিক ওদিক
তাকালাম। আচ্ছা বেশ।
সাংকেতিক ভুরু নাচিয়ে
পা বাড়ালাম।
ঝন্টুর আন্তরিকতা
হিসেবে মেলানোর নয়।
ঝন্টু আর দেশী দু'জনেই
অনার্স গ্র্যাজুয়েট।
কে এন কলেজ থেকে পাশ।
আমিও। ওরা অনেক ঠেকে
ঠেকে এসেছে এখানে। তাই
হয়ত দেশের টান, কলেজের
টান সব মিলেমিশে গেছে।
দিনে দিনে এদের
পারিবারিক বন্ধু হয়ে
বুঝেছি, সম্পর্কের
নির্ভার মেঘ কেন জটিল
মনে ছায়া ফেলে না।
আজ জন্মদিন। ঘরে বসতেই
আমার বান্ধবী সহজেই
বলল, আমাদের গরীব ঘর।
পায়েস হয় না। রানীনগরে
ঘুগনী হত। তাই ঘুগনীই
করেছি।
ঘুগনী খুশি কমায় না,
দেশী। কেউ তেমন লিখতে
পারে নি। আর, আমার তো
গন্তব্য রানীনগর! যদিও
হালচাল জানা নেই।
আমি আগেই বলেছি, তুমি
দেশ চিনো না। রানীনগর
গেলে তবে চিনবা।
কাঁসার বাটিতে কাঁসার
চামচ এগিয়ে এল। হাতে
নিয়েই খুব ভালো লাগল।
মনে মনে বললাম, এইরকম
বান্ধবী হয়ে থেকো
চিরকাল। মুখে বললাম,
দেশী, দারুণ ব্যাপার!
কাঁসার বাটি-চামচ তো
ভুলে গেছিলাম, মনে
করালে। তবে, আর একটু পরে
খেতে দিও। সন্ধ্যে হোক।
এক চিলতে বারান্দার
দিকে মুখ করে বসলাম।
পেছনে দেওয়াল জোড়া
শান্ত নদী। চেনা
আওয়াজগুলো নেই। বাইরে
রাস্তার ধারে একটা ছোট
পুকুর। সেখানে গাছগুলো
থেকে হালকা কিচিরমিচির
আওয়াজ আসছে। আর আসছে
রান্নাঘর থেকে আমার
বান্ধবীর আওয়াজ।
এ জনপদ আমি প্রতিষ্ঠা
করেছিলাম। নাম দিই নি।
দুটো ঈ-ইকার দিয়ে যখন
ভাগীরথী লেখা হত, সেই
সময়ের কথা। এ জনপদে সবই
ছিল। সুশাসন, সমৃদ্ধি,
নানা জাতি ও ধর্মের
সহাবস্থান। কেবল রানি
ছিল না, তাই নাম দিই নি।
লোক প্রচলিত নামটা মুখে
উচ্চারণ করতাম না। আমি
অপেক্ষা করে ছিলাম...
শুনলা না। কি জানি কি
ভাবছ। আবার শোনো -
লকডাউন তো একলা হয়ে
দাড়াই আসি,
কে বুললে গো, প্রেম
করিসি, ভালোই আসি?
পৃথিবীতে এমন কেউ আছে,
এটা শুনে আরেকটু শুনতে
চাইবে না? আমি শুনতে
চাইলাম।
ঘুরে বসে বললাম, তারপর?
ধানের খ্যাতে উদের সাতে
খুয়ার হ'লো,
আশমানি তো ডঙ্কা মেইরে
সরান গেলো।
তারপর?
আগে বাটিটা ধরো।
একসঙ্গে এর বেশি বলতে
পারি না। আমি কি কবি গাই?
হাত বাড়িয়ে ঝকঝকে
কাঁসার বাটি নিলাম।
বললাম, আমি শুধু শুনতেই
পারি। শোনা হলে, তারপর?
ছড়া কাটতে পারি না।
কেউই পারে না। কেবল
আমাদের দেশের লোক পারে।
তুমি তো দেশের লোক নও।
কতবার বলেছি।
না, না আমি দেশের লোক।
জোরেই বলে ফেলি। এই
প্রথম একটু অন্যরকম
ভাবনা আসে। যেন বৃত্তের
বাইরে সরে যাচ্ছি। যা
হয় হোক, আমি দেশের
বৃত্তের ভেতরেই।
আমার বান্ধবী হাসতে
হাসতে এক পায়ের উপর
আরেক পা তুলে দিয়ে বসে।
আজ সবুজ-নীল রঙের নট
নড়নচড়ন আবহ। হেলে দুলে
বান্ধবী বলল, তাহলে ছড়া
কাটান দাও। কাটান না
দিলে ছড়া এগোয় নাকি! এর
জন্যেই আমাদের
পালাগানের দলের এত
সুখ্যাতি। ওদের কাটান
শুনলে চোখ এমনি এমনি
হয়ে যাবে!
থেকে থেকে ঘাড় নাড়ি।
ঘুগনীতে ব্যস্ত হয়ে
পড়ি। কি বলব ভেবে পাই
না। ঘুগনীতে রানীনগরের
মতন সুঘ্রাণ। আহা! আমি
যে রাজ্য প্রতিষ্ঠা
করছিলাম, তার সুঘ্রাণ!
নদীর ধারে তৈরি
করেছিলাম জাফরি ঘেরা
সোপান...
বান্ধবী বলল, আশমানি
কোথায় গেল, বলো?
সেটা একটা বানিয়ে বলতে
পারি। কিন্তু ছড়া কাটতে
পারব না। আমি তো জানি না
কাটতে। ঘুরিয়ে বললাম,
অপূর্ব হয়েছে এই ঘুগনী,
দেশী! আমার মনপ্রাণ এখন
হাজারদুয়ারীর নবাবের
মতন খুশ! জন্মদিনে তুমি
কি চাও, বলো!
তুমি যা পারবে না, যা
ভেবে ভেবে নবাব হলে, এখন
সেটাই চাইব জাঁহাপনা!
সেই পুরোনো মুশকিলের
ফিলিংস ঝাঁপিয়ে এল।
ঠিকই, ছড়া কাটান দিতে
পারব না অথচ কি চাই বলে
ফেলেছি। উফ্! আমার
ভাবনা টের পাচ্ছে কি
করে!
ঘুগনী প্রায় শেষ।
বললাম, তাহলে নবাব একটু
পরে হচ্ছি। আপাতত,
আশমানি কোথায় গেল সেটাই
বলি।
আমার বান্ধবী শুনে দুলে
উঠল ঝড় লাগা হাওয়ায়।
যেদিকেই দুলুক আমার
দিকেই মজা দেখার চোখে
তাকিয়ে। আমি ঝকমকে চামচ
তুলতে তুলতেই সেটা
বুঝতে পারছি।
ঘুগনী শেষ। বাটি রেখে
দিয়ে বললাম, আশমানি গেল
জাঁহাপনার কাছে
মুর্শিদের খোঁজে। যে
একটানা ছড়া বলতে
শেখাবে। কেউ কাটান না
দিলেও।
এটা নতুন কথা। তাকিয়ে
দেখলাম, বান্ধবীর চোখ
একটু বড় বড় হয়ে গেল। সেই
সুযোগে আমি বললাম, দেশী,
শোনো। পরের দিন এসে আমি
চার লাইন মুর্শিদাবাদী
কাটানের ছড়া শোনাবো।
তারপর, তুমি বলবে আরও
চার লাইন, চাই কি আরও চার
লাইন।
একইরকম উৎসাহ! বান্ধবী
খুবই উৎফুল্ল হয়ে উঠল।
বাটি হাতে রান্নাঘরের
দিকে যেতে যেতে বলল, ওহ্!
তাই হবে! তাই হবে!
শুনতে পেলাম ও জোরে
হেসে উঠল। বলল, তোমার
সঙ্গে জমবে, আমি জানি,
তোমার সঙ্গে জমবে!
ঘড়ি দেখলাম। পৌনে আটটা।
এই সময়েই আমি ঘড়ি দেখি।
প্রতিবারই আমার
বান্ধবী আমার মনের কথা
বুঝতে পারে। প্রতিবারই
বলে, এবার এতদিন দেরি
করে এসো না। তাড়াতাড়ি
এসো, বুঝলা! বলে হাসে।
প্রতিবারই আমি হেসে কথা
দিই, দেরি করে আসব না।
আমি তো একা মানুষ। দেরি
করব কেন।
কিন্তু আজ আমার বান্ধবী
বলল, এখন তো লকডাউন।
তাহলে শোনো, আজ রবিবার,
এই সামনের বুধবারে আসো।
আসবা! মৃদু হেসে দীর্ঘ
কালো চুলে দু'হাত দিয়ে
খোঁপা করছে।
আমিও মৃদু হাসলাম, চোখে
চোখে তাকিয়ে বললাম, ঠিক
আছে, দেশী, আসব।
বুধবারেই আসব।
আমার বান্ধবীর
চোখ-মুখ-খোঁপা খুশিতে
ছেয়ে গেল। জাদুকরীর মতন
দু’হাত ঘুরিয়ে আমার
প্যান্টের দুই পকেটে
হাত চালিয়ে দিল। ওহ্ রে
চমক! ক্ল্যাসিকের
প্যাকেট দুটো!
হৃদয় দামামা বাজিয়ে
বলল, দেখে নাও, অন্যকে
খুশি দেখতে পারার চেয়েও
গভীর আনন্দ আর কিছুতে
আছে কিনা?
|| ৩ ||
নাকে রুমাল বেঁধে, এই
প্রশ্নটাকেই বাদাম
ভাজার মতন গরম বালিতে
ভাজতে ভাজতে ফিরব
ভেবেছিলাম।
রাস্তা শুনশান। মাত্র
রাত আটটা। নতুন দৃশ্য
আর অনুভূতি। অন্যদিন
রাত দশটাতেও এমন হত না।
প্রতিবারের মতন আজও
ঝন্টুকে হাত নাড়লাম। ও
শাটার নামানোর ঈঙ্গিত
করে হাত নাড়ল।
আবার দু'পা চলতেই বাদাম
উধাও, ছড়ার আবির্ভাব
ঘটল।
চার লাইন মুর্শিদাবাদী
কাটান ছড়া তৈরি করতেই
হবে। বুধবার আসতেই হবে।
শোনাতে হবে আমার
বান্ধবীকে। ভাবতে
ভাবতে এগিয়ে চললাম।
মেঘলা আকাশ থেকে ঠাণ্ডা
হাওয়া এসে লুটোপুটি
খেতে লাগলো আমার
চোখেমুখে। যেন আলাপ
আলোচনা করতে লাগল, যে
কৌশল জানা নেই তাকে
আয়ত্ত করবার উপায় কি।
পৃথিবীতে সবকিছুর শুরু
আছে। শেষ আছে। কিন্তু
একাকীত্বের শুরু
থাকলেও শেষ আছে বলে কেউ
লিখে যায় নি।