আমার সামনে যে মেঝে
সেটা আসলে একটা মাঠ। না,
ঠিক মাঠ নয়। মেঝেই
কিন্তু মাঠের ছদ্মতায়
গুমরে পড়ে থাকে। ঠিক
যেমন ছেলেরা বল পিটানো
শেষ হলে মাঠকে ভুলে যায়
এ মেঝেও সেভাবেই,
পরিত্যক্তবোধে
স্তব্ধ-ডুব থাকে
আনখশির। যবে থেকে এ
বাড়িতে এসেছি,
ভাড়াবাড়ি, বাড়াবাড়ি
আদরের বাড়িতে— এ বাড়িতে
এসেছি যবে থেকে, এই মেঝে
আমার কাছে আভূমিপ্রণত
হয়ে আছে।
সামন্ততন্ত্রীয়
আনুগত্য থইথই মেঝেভরা,
বুক পেতে দেয় অথচ পায়ের
চামড়ায় টের পাই অভিমান
স্রোত। বহুতলের মজা
হলো, আপনার ছাদ আমার পা
রাখার জায়গা হয়ে ওঠে।
আপনার মাথায় আমার পা।
আমার মস্তিষ্ক
অন্যকারো পদলেহন করে।
অবশ্য পা চাটা ছাড়া
মানব সভ্যতার জিভ এত
বড়ো হয় কী কখনও। এই সব
ভেবে দেখার কথা অন্ধকার
মেঝেকে বলে। সাধারণতঃ
ওদের প্রণয়ের সময় আমি
খুব একটা বিরক্ত করি
না। সম্পর্ক-শূন্য,
শূন্য সঙ্গম ও আলাপ এক
যুবকের জীবনকে শ্রোতা
বানাতে পারে এ কথা সত্য
যতটা সত্যির বিশ্বাস
নিয়ে কোনো বৃদ্ধ তার
পুত্রের মৃত্যুসংবাদ
শোনে। শূন্যতার বাধ্য
শ্রোতা হয়ে আমি শুনি,
দূরের ভাঙা কীর্তন,
ভেঙে খানখান কাওয়ালি
দাদা পিরের মাজারে।
শুনি প্রাতিষ্ঠানিক
বিরুদ্ধতা নিয়ে গীতা
ঘটক গাইছেন, “হৃদয় আমার
প্রকাশ হলো…”। মনে হয়,
এইসবই কেউ কোনোদিন
গায়নি, অব্যক্ত সমস্ত
কথা, সারেঙ্গির ছড়,
হারমোনিয়াম নেই কোথাও।
শ্রীখোল কে বাজায়? কত
জন্ম আগের বাজানো আঙুল?
পির গাইতে গাইতে কাঁদেন
কেন? শুনতে শুনতে দেখতে
পাই আমি। অন্ধকার তার
দৃশ্যসমূহ নিয়ে এসে
আমার সামনে উপুড় করে।
আমি হাতড়াই সেই সব সুর,
দৃশ্য।
মেঝে আর অন্ধকারের মাঝে
হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে
দক্ষিণ জানলার ছায়া
চাঁদ। মায়া শরীর নিয়েও
আটকাতে পারেনি তার
পুরুষকে। অন্ধকার
মেঝেতেই, মেঝে তার
প্রণয়। অথচ
জন্মান্তরের অভিমানে
সে কঠিন। অহল্যা যেমন,
গৌতমের অভিশাপ-টাপ বাল।
অবিশ্বাসের অভিমান
পাথর পাথর। কিন্তু
এদিকে কালো ভুলেছে তার
সংসার, ছায়াময় ভূমিকা।
কালাচাঁদ অন্ধকার
সন্ধ্যের পর ছাত্রকে
পড়তে বসিয়ে আসে, কথা বলে,
কথা বলানোর চেষ্টা করে
যায় নিথরকে। আমি চাঁদের
জলের কাছে আসি। জলের
ওপারে আরেক গীতা, গীতা
দাত। চাঁদের মতোই।
ওপারে কত হাস্যকলরব, কত
নাচা-গানা। মদ। প্রেম।
এপারেও প্রেম অবশ্য।
প্রেম ছাড়া জলের
অস্তিত্বই বা কী? জল
সেতু। স্বাভাবিক দর্শক
মাত্রেই জানেন, এ গদ্য
এবার সেতুর পথ ধরবে।
কিন্তু অস্বাভাবিক
মাত্রেই জানেন
পারাপারে সবসময় সম্মত
হতে নেই। তাই ওপার অপার
হয়ে থাকে। আমি চাঁদ
ছুঁয়ে ছুঁয়ে গতজন্মের
কথা, তিলের আখ্যান মনে
করি। এক বন্ধু আর এক
বন্ধুপ্রায় দাদা বেহেড
হয়ে নিজেরাই উৎসব হয়ে
গেছে তখন। প্রাকপুজো সে
রাত্তিরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে
আছে নেশা, কবুতরি আদর,
বিরাগ। তার মধ্যে শোক
বেজে চলেছে। শোক পাহাড়ি
নদী। এমনিতে পিকচার
পারফেক্ট কিন্তু কোথা
থেকে হড়কা নামবে কেউ
জানে না। বন্ধু আর
দাদাটি তুমুল হয়ে আছে
ঋত্বিককে নিয়ে, ঋত্বিক
ঘটক। তিরতিরিয়ে নদী
বইছে, ছলাৎছলে
মধ্যবিত্ত আবেগ আর তার
কাঁদুনেপনা। শোকও বইছে,
তারাও গ্লাসের পর
গ্লাস। আকণ্ঠ মদ, আকণ্ঠ
শোক, আবক্ষ জ্বালা-
আবক্ষ শোক, আকণ্ঠ
জ্বালা। তারপরই এক বাঁক
থেকে প্রাগৈতিহাসিক
টান। বিস্ফারিত সেই
বানে ভেসে গেলো
বন্ধুটি। কত কুড়ি না
আঠারো হাজারে কেনা
মোবাইলটি শিশুমৃত্যুর
মত আছড়েছিল এই মেঝেতেই।
“ঋত্বিক ঘটক হ্যাস বিন
কিলড”— সমে ফিরল সে। আর
বন্ধুপ্রতিম দাদাটির
_চোখে ক্যালেন্ডারের
ছবির মতো আবহমান শোক—
তিরতিরে। তার জল বয়ে
বয়ে গড়িয়ে যায়। ঋত্বিকে
মিশে যায় দাদাটির
বিশ্বাসঘাতিনী স্ত্রী,
প্রাক্তন স্ত্রী। মিশে
যায় বর্তমান সন্তান।
সমাজ, কালচার, পরিবার,
অপত্য, অপমান, যৌনতা
সবকিছু এক হেঁচকি
মেশানো ছন্দ হয়ে ঠিকরে
ঠিকরে পড়ে মেঝেতেই।
এইসব দৃশ্য ধ্বনিত হয়।
বারে বারে, ফাঁকা ঘরে।
কোণায় মেঝেতে বুঁদ
অন্ধকার। আর একা চাঁদ,
একা ছেলে এক।