এই আমি, একা, নিঃসঙ্গতা
আমার কল্পণার চেয়ে
সুদুরপ্রসারী, আর বহু
পুনঃজন্মের স্মৃতি
বিজড়িত; নিঃসঙ্গ আমি
একা, তখন আমি কবি, তখন
আমি জাতিস্মর! ঘুম
ভাঙিয়ে জেদি স্বপ্নেরা
দোদ্যুল্যমান
অন্ধকারজুড়ে আমাকে
কাঁপায় মাতায়, ঘরের
বাইরে ঝাউবন জুড়ে
পাতাদের উচ্ছ্বাস, ডাকে
-, “এসো! নক্ষত্রের রাত
তোমাকে ঘিরে উজ্জ্বল!”
আমার জানালায় ঝুলে থাকা
একখন্ড আকাশ, সেই
আকাশজুড়ে কল্পনারা
মাতিয়ে তোলে শূন্যতাকে,
স্বপ্নেরা ছোঁটে
আলোকণাদের পিছুপিছু, আর
আমি, হাওয়ায় দুলছি...,
আলোকণারা ঝলমলিয়ে
রেখেছে আমার পরিচ্ছদ,
শিরোস্ত্রানে কোহিনূর,
তখন আমি নক্ষত্রলোকের
যাত্রী! আমার গল্পে তখন
আমিই রাজা, বাকী সব
পার্শ্বচরিত্র,
ক্ষণেক্ষণে উঁকি দিয়ে
ঢুকতে চাইছে
সিংহদরজায়!
গল্পের শুরু এভাবে;
“যদি নির্বাসন দাও,
ওষ্ঠে অঙ্গুরী
ছোঁয়াবো...” বিষ পান করেও
মরা যেতে পারে, কিন্তু
‘উপেক্ষা’ তারচেয়েও
মর্মন্তুদ, ততোধিক
অমানবিক ! দক্ষিনের
জানালা দিয়ে ঢুকে বাতাস
লন্ডভন্ড করে দেয় তৈজস,
তাতেও একপ্রকার
মুগ্ধতা থাকে! ভালবাসতে
জানলে অন্তর-বাহির সব
একাকার হয়ে যায়,
নীলকন্ঠ সকল বিষ
গলাধঃকরণ করে তবেই
প্রেমিক! শুধু
‘উপেক্ষা’র বিষাক্ত
প্ররোচনা ছিন্নভিন্ন
করে প্রমিক হৃদয়,
পৃথিবীর যাবতীয়
বঞ্চনা তোমার দিকে,
তুমি ছুঁড়ে ফেলে
দিয়েছো বুকে জমে থাকা
ক্লেদাক্ত কুসুম,
হৃদয়হীন সহবাস। আজ যে
নিঃসঙ্গতার গান গায়, সে
ভোরের আলোছায়ার চেয়েও
রোমাঞ্চকর, দেখে নিজের
প্রতিবিম্ব সহস্র
কাঁচের টুকরোয় ভেঙে
পড়েছে; যখন ‘উপেক্ষা’
ছুঁড়ে দাও তুমি, বড়
মর্মন্তুদ, বড় অমানবিক!
‘উপেক্ষা’ প্রতিধ্বনি
হয়ে ফিরে আসে, তাকে তুমি
পারো না এড়াতে ! বরং
গতকাল যে তিনটে
লালগোলাপ নিয়েছিলে হাত
পেতে, আজ রক্ত গোলাপ
নিয়ে এসো তার জন্যে,
গোলাপ-ত্রিভুজ প্রেমে
পবিত্রতার সুঘ্রাণ
নিয়ে আসে !
তখন, দেড়শো বছর আগের
তেমনি এক দিনে বগলে
পুঁথি, মাথার তেল চপচপে
চুলে আঁকশি চালিয়ে মা
আমার বিগলিত, পাঠিয়ে
দিয়েছে নিবারণ
পন্ডিতের টোলে! পাশের
বাবু ময়রার ভাঁড়ার থেকে
উড়ে আসা ঘি-মিষ্টির
সুবাসে হৃষ্টপুষ্ট
আমরা জানি, বাবু ময়রা
কবিয়ালও বটে। দুলেদুলে
নামতার সাথে ‘হলে যদি
হলে সখা অধিষ্ঠান’
কবিগান মিলেমিশে
একাকার, একাকার কবি
ময়রার মিষ্টি, আর
নিবারন পন্ডিতের যষ্টি!
এমন স্বর্গরাষ্ট্র
শুধু সত্যজিৎকাকুই
ছবিতে বানাতে জানতেন,
কি রহস্যময় সেই
সন্ধ্যার বাতাসচিরে
বিদ্দ্যুচমকের মত
হুইসেলের ডাক, কাশবন
চিরে রেললাইনের পাশে
আবাক বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে
দেখছি অর্নগল
সমান্তরাল ইস্পাতের
রেল গিলতে গিলতে ধাবমান
সরিসৃপের ছুটে যাবার
দৃশ্য-, মাথার ওপরে
পাল্লা দিয়ে ছুঁটে চলে
যাচ্ছে বৈদ্যুতিক
পিলারের তার, অবাক
বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে
আকাশের মেঘ আর কাশবন
যেন সমার্থক, দিগন্তে
মিলেমিশে একাকার! সাথে
আসা লেজ নাড়া নেড়াঁ
কুকুরটাও তখন বড় বেশি
প্রগলভ, সদ্য হেঁসে ওঠা
চাঁদের দিকে চেয়ে করুণ
কন্ঠে চন্দ্রাহত
ডাকছে... যা শুধুই
নেকড়েকুলের জন্য
নির্ধারিত! সেই
সন্ধ্যাকালে “সাধু!
সাধু!!” মুখরিত আখড়ার
গন্জিকাসিক্ত বাতাস
জুড়ে কেবলি পলাতক
জীবনের স্মৃতিকথা!
জীবনপৃষ্ঠা উল্টে
উল্টে দেখা অলিখিত সেই
গ্রন্থে মিশে থাকে
মাটির সরল সুর, খালে
জাগদেয়া জলে পাটগন্ধ,
কলমিলতায় ছেয়ে ফেলা
পদ্মপুকুরে বিসর্জনে
ডোবানো প্রতিমার
কাঠামো থেকে মাঝরাতে
উঠে আসে জলকন্যা,
একহাতে তাঁর নীলপদ্ম,
করতলে চন্দ্ররশ্মী!
বালকস্বভাব রোমাঞ্চীত
হয়ে ওঠে নারীগন্ধে; কে
এই প্রতিমার অধীক সে
সিক্তবসনা নারী? নারী,
তবু সে পবিত্র মানব
প্রতিমা, চাঁদের আলোয়
আপ্লুত তাঁর
লাবণ্যপ্রভা, বিজয়া
বিসর্জনক্ষণে
সিঁদুরচর্চিত
দেবীমুখের পাশে অন্য
আরেক মুখ, আধেক
অবগুন্ঠনের আড়ালে
লাবণ্যমাখা মাতৃমুখ-,
দেবীর অধীক, পূর্ণিমার
রাতে আজ সে উঠে এলো
জলমগ্নতা ঠেলে,
মায়াভেজা চাঁদের
জ্যোৎস্নায়, স্থাণু
বালক সহসাই তাঁর পথের
সন্মুখে! রক্তিম
ওষ্ঠস্নাত-মৃদ্যুহাসি
ে সিক্তবসনা শিহরিত
বালককে জানিয়ে দিলো -
“জাতিস্মর, আরজন্মে
তুমি ছিলে শ্যামসুন্দর
বনিক, আমি তাঁর
গৃহলক্ষী!” সেইক্ষণে
বালকস্বপ্নে ভেসে আসে
টুইটুম্বুর নদীজলে
দুলন্ত বজরা, সিঁড়ির
পাটভেঙে সিক্তবসণা উঠে
যাচ্ছেন পূজামণ্ডপে,
হাতে লক্ষীভান্ডার,
বজরার ছাদে সুশোভন
পরিচ্ছদে শ্রীমান
শ্যামসুন্দর দাঁড়িয়ে,
অপেক্ষমান!
আহ্, কল্পনায় কতোসুখ !
আষাঢ়ের জলমগ্নতায় ভেসে
যায় রাজ্যপাট, ভরা
বিলের জল ছুঁয়ে ভেসে
আসে ভাটিয়ালী! নদী,
পুকুর জলে একাকার,
কল্পণারা জলজপ্রানীর
চেয়েও বেশি
মুক্তস্বাধীন। যখন
বাতাসে ভর করে নামে
বৃষ্টি, ঝরঝর অবিরল
বৃষ্টিধারাপাত, আর
পদ্মানদীর মাঝি-, মানিক
তার ডাকনাম, ইলিশটানা
জালের বদলে হাতে লেখা
পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা কাগজ
ভাসিয়ে দেয় জলে। সব
জেলেরাই অদ্ভূত,
ঝড়বৃষ্টি ঠেলে পাড়ি দেয়
নিঝুমদ্বীপ, মানিক
তাঁদের অনারম্বর
জীবনের কথা লিখে রাখে
পৃষ্ঠা জুড়ে; নৌকাতেই
খাওয়া, নৌকাই জীবন;
আকাশের কালোমেঘ আর
ধ্রুবতারা দেখে দেখে
চিনে নেয় জীবনের পথ।
মানিক শখের মৎসশিকারী,
স্নানরতা প্রেমিকার
জলেভাসা স্তনের তুলনা
তার কাছে মাংস নয়,
মৎস্যের ন্যায় জীবন্ত!
ভোরের কুয়াশামগ্ন
তেলতেলে স্থীর নদীজলে
বৃষ্টিজল ফেটে পড়ে
নদীর গায়ে। জলের সাথে
জলের কি অদ্ভুত
বোঝাপড়া। তার বাইরেও
অন্য হিসাব থাকে; লোভ,
লিপ্সা, ক্ষমতা’র হিসাব
কুন্ডলী পাকিয়ে
ঘূর্ণীঝড়ের আবরণে ঢেকে
রাখে নদীর জীবন।
বামুনের ছেলে সেই
পদ্মানদীর জলেই সমর্পণ
করেছে তাঁর মাঝির জীবন,
জলের হাহাকার সব কিছু
ছাপিয়ে উঠে আসে
উপন্যাসের পৃষ্ঠায়!
সে বড় অদ্ভূত পরম্পরা,
একের পর এক সিঁড়ি ভাঙতে
ভাঙতে পদশব্দ নেমে আসে
নীচে, সাথে নিয়ে আসে
সমুদ্রের বাতাস, কবিতার
ছন্দ, জন্ম কোলাহল,
বিস্মরণের সীমারেখা
পেরিয়ে জন্মান্তরের
অনিবার্য অন্বেষণ। কত
জন্মান্তর পার হয়ে এলে
কবিতা লেখা হয়? তুচ্ছ
দারুচিনি দ্বীপে
অন্বেষণে খুঁজে পাওয়া
পাখীর নীড়ের চোখ কিমবা
ক্ষেতের আল এর পাশে
নেমে আসা চাঁদ’কে চাষা
বিলিয়ে দেয় ফসলের সাধ,
তখনি জীবনের আনন্দ
ছুঁতে পারে কবিতা !
কবিরা কিভাবে কবিতায়
পায় অমরত্বের স্বাদ ?
কবিতা বেড়ে ওঠে
পরাবাস্তবের আড়ালে, জলজ
উদ্ভিদ আর রঙীন মাছের
জলকেলিতে, স্বপ্নের
মোড়কে বেঁচে থাকার
আকাঙ্খায় !
শ্পর্শগ্রাহ্য
কোনকিছুই আর কবিতার
সমার্থক নয়, কবিতা
নিরঙ্কুশ। চলে
স্বপ্নের চাষাবাদ,
জলসেচ, বীজের আবাদ! এক
জন্মে কবিতার বীজ বুনে,
অঙ্কুরোদগমের
অপেক্ষায় কেটে যায়
কয়েকটা জীবন। আজ যে
কবিতার জন্ম হলো, তার
বীজ বোনা ছিলে
জন্মান্তরে; সব কবিই
জাতিস্মর, এই কাব্যের
রীতি!