একা হবার মতো করে একা
হতে হয় না কারোকেই। একা
হবার মতো করে একা হওয়াও
যায় না। একা যারা, একা
একাই থাকে। রমরম করা
কোনো ভিড়ের মধ্যেই মুখ
ভাসিয়ে থাকল হয়তো, বাস
বা ট্রেনেই গাল গল্পের
ফাঁকফোকর খুঁজে থাকল।
হাসি হাসি বা
ভ্যাবলাকান্ত একটা
নিজেকে সামলাতে
সামলাতে থাকল। একটু
দূরে দাঁড়িয়ে বা বসে,
কাজে বা আলস্যে, জাল
বুনতে বুনতে কী জাল
খুলতে খুলতেই থাকল। আর
এইভাবে তার থাকাটাই,
তার নিশ্চুপ থাকাটাই,
তাকে একা করে দিল। হয়তো
বা থাকলই না সেখানে।
থাকা তো আসলে নানান
রকম। থেকেও তো না-থাকা
যায়। আবার না-থেকেও তো
থাকা যায়। সে যদি
সেখানে না থাকে ---
না-থেকেই না থাকে যদি
কিংবা থেকেই না থাকে?
ভিতরের একটা থাকা আর
বাইরের আর একটা থাকা।
মৃত্যুভয়ের চোখাচোখি
এক রকম থাকা আর উড়োঝুরো
ছাই হয়ে আর এক রকম থাকা।
বউবাচ্চার সঙ্গে একটা
থাকা আর বউবাচ্চা
পেরিয়ে আর একটা থাকা।
বউবাচ্চার সঙ্গে থেকেও
বউবাচ্চা পেরিয়ে আরও
একটা থাকা। কখন কোন
থাকাটা তুমি একা একা
থাকো তা কি তুমিও জানো?
কখন কোন থাকাটায় তুমি
একা হয়ে গেলে তা কি তখনই
জানতে পারলে? সঙ্ঘের
মধ্যে, মেলার ভিড়ের
মধ্যে, উৎসবের নানান রং
আর আলোর মধ্যে, সংসারের
টুলটুলে উদ্দীপনার
নাগরদোলার মধ্যে,
শ্মশানের ঢেউ-ওঠা
ব্যস্ততার মধ্যে, কাজের
ঘেরের মধ্যে --- কাজেরও
তো একটা ঘের থাকে --- বড়ো
ছোটো আঁকাবাঁকা নানান
রাজনীতির মধ্যে,
প্রশ্নের অরণ্যের
মধ্যে কখন তুমি একা হয়ে
গেলে! তখন?
একটা গাছ, ভাবো তুমি,
একটাই গাছ। একটা নদী,
ভাবো তুমি, একটাই নদী।
কখন কোন আবর্তে তার আর
একটা গাছ পাওয়া হয়ে
উঠবে, কখন কোন আবর্তে
তার আর একটা নদী পাওয়া
হয়ে উঠবে, কেউ কি তা
জানে? তা কেউ জানে না।
কেউই জানল না হয়তো।
খামোখা কে আবার জানতে
যাবে , কে আবার দেখতে
যাবে, সে একা নাকি দোকা?
সে নিষ্ফল একটা গাছ না
কি ঢলঢলে, ফলে, দোলাচলে,
ঝুঁকে-থাকা আর একটা
বাড়বাড়ন্ত গাছ? আর নাই
যদি দেখল, দেখার মতো
না-ই যদি দেখল, তবে তো
সারা জীবনেও জানা যাবে
না, সে যে একা, এই
কথাটাই। যদি ভাব ঘন
জঙ্গল একটা অবিচ্ছিন্ন
পৃথিবী, যদি ভাব, ঘন
জঙ্গল একটা
একান্নবর্তী পরিবার,
সে তুমি ভাবতেই পারো।
সে তুমি দূরে থাকলে
ভাবতেই পারো। সে তুমি
দেখার মতো না দেখলে
ভাবতেই পারো। সে তোমার
দেখা। তোমার দেখায় আমার
দেখা মিলবে কেন?
আমাদের চারপাশে
সমাজের একটা ঘের আছে।
নদীর যেমন একটা পাড়
থাকে, তেমন। গল্পের
যেমন একটা শেষ থাকে,
তেমন। কিন্তু নদীর পাড়
তো ভেঙেও যেতে পারে?
গল্পের শেষ তো অজানাও
হতে পারে? এই দ্যাখো,
গড়ার কথা বলতে গিয়ে,
বেড়ার কথা বলতে গিয়ে
তুমি তো দেখি ভাঙনের
কথা বলতে নিয়েছ। আচ্ছা,
আচ্ছা, বুঝেছি, কথাটাই
ভেঙে দিলাম, এখন ভেঙে
দিলাম, দিয়ে আগের কথার
কাছেই গেলাম না হয়...
'কোনখানেতে যাবেন
কত্তা?' -- 'ও, বামুনপাড়া?' --
'ও, কায়েতপাড়া?' যদি
তোমাকে গ্রামে যেতে হল,
তখন। 'ভাই, রেল কলোনিতে
নামাবেন' --- 'ভাই,
মেরিল্যান্ড
অ্যাপার্টমেন্টে
বাঁধবেন' --- যখন তুমি
শহরে ঘুরছ, তখন। সমাজের
যদি একটা আঁটোসাটো
বেড়াই না থাকল, তাহলে
সমাজ কীসের? সমাজের যদি
একটা আঁটোসাটো বেড়া
থেকেই থাকে, তাহলে
সমাজের তো একটা ভিতরঘরও
থাকবে, না কি? বামুন
পাড়ার মধ্যে একটা
বাড়ুজ্যে বাড়ি থাকবে
না, তা কি হয়? একটার বেশি
দুটোও থাকতে পারে।
তাহলে কি আর এক
বাড়ুজ্যে বাড়ির পাশে আর
এক সান্টু বাড়ুজ্যের
বাড়ি কোথাও থাকবে না,
তাও আবার হয় নাকি? হওয়া
সম্ভব? মেরিল্যান্ড
অ্যাপার্টমেন্টে একটা
টু বাই ওয়ান বিল্ডিং
থাকবে না, আর সেই
বিল্ডিংয়ের, একটা আকাশে
সেঁধিয়ে-যাওয়া ১৬ তলা
থাকবে না, আর সেখানে
সিক্সটিন বাই এ একটা
ফ্ল্যাট থাকবে না, তাও
কি হয়! সমাজের ওই অত্ত
বড়ো ঘেরের ভিতরে আরও
একটা সমাজ, তারও ভিতরে
আরও একটা। বামুনপাড়া,
বাড়ুজ্যে বাড়ি, সান্টু
বাড়ুজ্যের বাড়ি।
মেরিল্যান্ড
অ্যাপার্টমেন্ট, টু বাই
ওয়ান বিল্ডিং, সিক্সটিন
বাই এ-র ফ্ল্যাট। তারপর
তো তুমি সেই ভিতরটায়
ঢুকলে। একেবারে
ভিতরটায় ঢুকলে। ভাবলে,
একেবারে ভিতরেই ঢুকেছ।
একেবারে ভিতরেই ঢুকতে
পেরেছ। --- আরেব্বাবা,
এতদিন পরে! ---- বাব্বা, এত
দেরি? হয়তো কোথাও
অনভ্যস্ত উচ্ছ্বাস,
হয়তো আরো কোথাও কিছুটা
অবাক চাউনি। সেখানে
পৌঁছে গল্প করলে ---
কতদিনের কথা! কত দূরের
কথা! হয়তো এক যুগ কিংবা
তারও বেশি। হয়তো অর্ধেক
জীবন কিংবা তারও বেশি।
আদ্যিকালের মেঘ থেকে
পুরোনো আর ঘন সবুজ
শ্যাওলার মতো কত
বৃষ্টি! রিমঝিম কত
শ্রাবণ! কিংবা হয়তো
কথায় কথায় রোদের দরজাই
কেমন হাট করে খুলে গেল।
হয়তো সেই ঝড়ে এলোখেলো
কত বালি উড়ল, চোখ কড়কড়
করে উঠল। হয়তো সেই ঝড়
এড়াতে মাথা নীচু করে
কেউ বসেও থাকল। হয়তো
সেই ঝড়ের উলটো দিকের আর
একটা ঝড় ডেকে আনতে গলা
ওই উঁচুতে তুলে কেউ
কথাও বলল। কিংবা হয়তো
কিছুই হল না। তেমন বলার
মতো কিছুই হল না। তুমি
এসে মুখ গুঁজে বসে পড়লে
তোমার মোবাইলে হুমড়ি
খেয়ে, সেও এসে বসে পড়ল
তার মোবাইলে চোখ দিয়ে।
কেউ কারো কথা শুনল কি
শুনল না, কেউ কারো দিকে
দেখল কি দেখল না,কেউ
কারো কথা শুনতে শুনতেই
পথ হারাল হয়তো, কেউ কারো
দিকে দেখতে দেখতেই পথ
হারাল হয়তো। কেউ কারো
কথা শুনতে শুনতে
শোনা-টা মাঝপথে মুলতুবি
রাখল, কেউ কারো দিকে
দেখতে দেখতেই দেখা-টা
মাঝপথে মুলতবি রাখল।
কেউ কারো কথা শুনতে
শুনতেই অন্য একটা নিজের
দিকে যাবার পথ খুঁজে
পেয়ে গেল, কেউ কারোর
দিকে দেখতে দেখতেই
নিজের দেখার দিকে খানিক
গড়িয়ে গেল। কেউ হয়তো
শোনার রহস্য জানেই না,
তেমন করে জানেই না, কেউ
হয়তো দেখার রহস্য জানেই
না, তেমন করে জানে না।
না-শোনা আর না-দেখার
মাঝখানে একটা জায়গায়
তারা বসে আছে এখন, এই
মুহূর্তে, তুমি আর আমি
কথা বলছি যখন, কথার
সুতোটাকে লাটাই থেকে
খুলে দূরে চলে যাচ্ছি,
কিংবা কথার সুতো গোটাতে
গোটাতে কাছে আসছি আবার,
ঠিক সেই মুহূর্তে , হয়তো
সান্টু বাড়ুজ্যের
দাওয়ায়, হয়তো ১৬/এ-র
ডিভানে। সমাজের একটা
ঘেরের মধ্যে -- সমাজের তো
একটা ঘের থাকতেই হবে,
নইলে তো সেটা যখন যেমন
বেড়ে ওঠার ইচ্ছা, বেড়ে
উঠবে, নইলে তো সেটা যখন
যেমন ছড়িয়ে যাবার
ইচ্ছা, ছড়িয়ে যাবে --- যেন
বাড়ুজ্যে বাড়ির পিছনের
মজা পুকুরপাড়ের
উত্তরের বাঁশঝাড় ---
সমাজের এক ঘেরের মধ্যের
যে-ভিতর, তারও যে ভিতর,
তারও যে ভিতর --- সেখানে
তুমি তো একাই, নাকি?
২
তুমি একা হবে একথা তো
জানাই। তুমি একা হলে
কেন, এই কথাটা আরওই বেশি
করে জানার। কতকী ঘটে
যায়! কিছু জানা যায় আর
কিছু জানার বাইরে চলে
যায়। কিছু বোঝা যায় আর
কিছু বোঝার বাইরে চলে
যায়। জানা-বোঝার যে
গ্রামসভা --- তুমি তো
যূথবদ্ধ, তোমার বাইরের
দিকে আঁটোসাটো এক বেড়া
--- তারও বাইরে চলে যায়।
বেবাক বাইরে।
আজ করোনায় মানুষ একা
হয়ে গেছে যেমন। ধরো, একা
হয়ে গেছে।একা হয়ে,
জানার বাইরে চলে গেছে।
যে-ওষুধ তুমি ভেবেছিলে
তোমাকে বাঁচাবে, জানার
বাইরে থাকার জন্যই
ভেবেছিলে হয়তো।
'জানা'-টাও তার ভিতরে
ঢুকতে ঢুকতে পথ
হারাচ্ছে আর পথ
পেরোচ্ছে, যেন সে পতঙ্গ
কোনো, যেন সে জানতে
জানতেও জেনে উঠতে পারছে
না ঠিকমতো, তার নিজের
উড়ানেরই আটঘাট। যেন
তাবৎ বৈজ্ঞানিকেরা
অস্ত্র তৈরি করতে করতে,
ট্যাংক বানাতে বানাতে,
মহাকাশযান নির্মাণ
করতে করতে, পরমাণু
গবেষণা করতে করতে,
শব্দের থেকেও দ্রুত
কোনো বোমারু
যুদ্ধবিমানের অপরাজিত
নকশা বানাতে বানাতে
ক্লান্ত এখন, এতই
ক্লান্ত এখন, যে
ভাইরাসের চালচলন তাদের,
সেই লক্ষ লক্ষ
বিজ্ঞানীর মনের বাইরে
চলে গেছে। মননের কোন
দূরে চলে
গেছে।কুচকাওয়াজের
শব্দ শুধু, মহড়ার শব্দ ---
সিমুলেশন রুমে হবু
যুদ্ধের প্রস্তুতি আর
অস্ত্রের শব্দ,
অস্ত্রহীনতার
নৈঃশব্দ্য।
মনেরও তো একটা ছক
থাকে, না কি? মনেরও তো
একটা অসময়ের লুডোখেলা
থাকে। মনেরও ঠান্ডা সেই
ঘরে একটা ছক, আর বিস্তর
ঘুঁটি সাজানো থাকে।
পাশার বলো পাশার,দাবার
বলো দাবার, লুডোর বলো
লুডোর। ঘুঁটি থাকলে পুট
পড়বে না, ছয় পড়বে না, তা
কি হয়? আর পুট-ই যদি
পড়েছে, তাহলে কি আর
খেলার মজা থাকে? জেতার
জন্যেই তো খেলা? জয়ের
জন্যেই তো যুদ্ধ, সে
তোমার দুধ-ভাত যুদ্ধই
হোক আর লাল টকটকে
যুদ্ধই হোক, যুদ্ধ তো
যুদ্ধই। তোমার টিকার
পেটেন্ট যদি কেউ নাই
কিনল তবে আর সুখ কোথায়
হে? তবে আর গবেষণার
সুযোগই বা কোথায়? তুমি
কি আবদুল কাদির খান, যে
তোমার নামে
গবেষণাকেন্দ্র হবে,
তোমাকে ভাঙিয়ে
সেন্ট্রিফিউজের চোরা
চালান যাবে ইরানে আর
তুমিও তার বদলে সরকারকে
বা সেনাকে লাল গাইয়ের
মতো দুইতে দুইতে বছরের
পর বছর কলার উঁচিয়ে
পরমাণু ব্যবসা চালিয়ে
যাবে? তুমি যে-ই হও,
যে-হরিদাস পাল-ই হও, জানা
বোঝার বাইরে আর ভেতরে
তুমি যেখানেই থাকো,
তোমার জানাজানির
বাইরেও আরও কত যে জানা!
আরও কত যে জানা তোমাকে
প্রতিদিন একা করে দিয়ে
যায়! দিয়ে যাচ্ছে! দিয়ে
যাবে! নতুন নতুন জানা।
আর তুমি, তোমার সেই একা
হবার বোধকে ঠিকমতো বুঝে
নেবার আগেই তোমার 'বোঝা'
কেমন করে যেন বাঁক বদল
করছে। তোমার সেই 'বুঝ'
যেন রতিক্রিয়ার পরে
নারীর দুর্গম মন। তোমার
সেই 'বুঝ' যেন বর্ষার
জলঢাকা। তোমার সেই
বোঝা-কে তুমি বুঝতে
পারছ না আর, দুই বাহুর
মধ্যে মেলে, তাকে
আড়ে-বহরে সাপটে ধরে,
কাঁধ ঝাঁকিয়ে, চোখে চোখ
রেখে, বুকে বুক ঘনিয়ে,
বুঝতে পারছ না। বুঝতে
না পেরে নিজের মধ্যে
গুটিয়ে, ছোটো এতটুকু
হয়ে যাচ্ছ, আরোই ছোট্ট
হয়ে যাচ্ছ।
কে যেন বোঝায় ---কোন
ভালোমানুষের ছেলে
ভালোমানুষ কে-একটা যেন
বোঝায়, উহানে নেহাতই
আকস্মিক একটা ঘটনায় আজ
মানুষ করোনার থেকে
পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
তারপর কেউ আবার বোঝায় ---
অন্য কেউ আবার বোঝায়,
কোনো আড়বুঝুন্তি বাপের
আড়বুঝুন্তি কে-একটা
বেটা যেন বোঝায় --- আরও
এক যুদ্ধের কথা। তোমার
আমার মাপের থেকে দশ গুণ
একশো গুণ, হাজার লক্ষ
গুণ বড়ো সেই যুদ্ধ।
ক্ষমতা আর দম্ভ আর
একেশ্বরের বিরুদ্ধে
একেশ্বর হবার যুদ্ধ
সেটা। গোলা বারুদের
সমান্তরাল আরও একটা
যুদ্ধ। যে-যুদ্ধে জয়
পেতে হলে একটা
আন্তর্জাতিক স্টক
এক্সচেঞ্জে রাতারাতি
ধ্বস নামিয়ে দিলেই হল,
যে-যুদ্ধে তোমার বিরোধী
দেশের সরকারি ট্রেজারি
বিলে বিশাল অঙ্কের
পুঁজি ঢেলে দিয়ে তাকে
অসহায় হ্যালব্যালে করে
দিলেই হল, যে-যুদ্ধে
নিজের তৈরি স্যাটেলাইট
নিজেই ধ্বংস করে দিয়ে
একটা সূক্ষ্ম সংকেত
হাওয়ায় উড়িয়ে দিলেই হল,
যে-যুদ্ধে অত্যাধুনিক
প্রযুক্তির একটি ডিজেল
সাবমেরিন তোমার
আপাতনিরীহ যুদ্ধবিমান
বয়ে নিয়ে-যাওয়া সামরিক
জাহাজের পথে ভুস
করে,যেন-বা অজান্তেই,
যেন বা খেলার ছলেই,
ভাসিয়ে তুললেই হল,
যে-যুদ্ধে কম্পিউটারের
কোনো ধুরুন্ধর
অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে
তোমার গোপন তথ্য চুরি
করে নিলেই হল, যে-যুদ্ধে
একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গ
পাঠিয়ে পরমাণু
অস্ত্রাগার মুহূর্তে
অকেজো করে দিলেই হল,
যে-যুদ্ধে পৃথিবীর
মানচিত্রকে দাবার
বোর্ড মনে করে একটা
মোক্ষম দানে কোনো
ভূখণ্ডে নিজের পতাকা
উড়িয়ে দিলেই হল --- হতে
পারে সেই দেশ ইরাক, হতে
পারে সেই দেশ ভূটান, হতে
পারে তাইওয়ান, হতে পারে
অন্য যে-কোনো দেশ ---
শ্বাস ফেলতে না ফেলতেই
কত রকমের যুদ্ধ, কত
রকমের খেলা --- কেউ কি চায়,
তার খেলাটা পুট পড়ে
মাটি হয়ে যাক! মাটি আর
কে চাইবে, বোকার মতো!
যুদ্ধ হোক হাওয়ায়।
যুদ্ধ হোক কম্পিউটার
গেমস্-এ --- ঢিঁয়াও
ঢিঁয়াও, ঢিসুম ঢিসুম ---
যুদ্ধের আওয়াজ বড়ো
মনোহরা। তা, কেউ আবার
যেন বলে সীমাহীন আর
সাবলীল আর ভয়ংকরভাবে
নিস্তব্ধ আর অমায়িক
হাসিখুশি আর খেলাঝোলার
সেই যুদ্ধের কথাও। কেউ
যেন আরও বলে, কে-একটা যেন
বলে --- কোন আড়বুঝুন্তি
বাপের আড়বুঝুন্তি বেটা
---হতে পারে, তেমন একটা
মোক্ষম দাবার চাল হতেই
পারে, করোনার এই
মর্মান্তিক সংক্রমণ।
পাগলে কী না বলে!
তোমার বোঝার বাইরেই
যদি চলে যায় কোনোকিছু
,এই সহজ অথচ জটিল
হিসেবনিকেশগুলো যেমন,
বা অন্য আরো কত হিসেব,
হাজার লক্ষ হিসেব,
হাজার লক্ষ তত্ত্ব,
তোমাকে নিঃসংকোচে একা
করে দিয়েই যদি চলে যায়,
তাও কি সেটা চলে যেতে
পারে? চলে যাওয়া কি তাকে
মানায়? চলে যেতে কি সে
এসেছে আদৌ এতটা পথ
পেরিয়ে ? পচাগলা,
পেট-ফুলে-ওঠা, দুর্গন্ধ
ছড়ানো, লাশে ভর্তি
চরাচরের ওপর অপেক্ষায়
থাকা চিলের মতো ঘুরে
ঘুরে ফিরে আসবে না সে
আবার? যাও, বললেই কি সে
যায়! তারিয়ে তারিয়ে,
একটু একটু করে তোমাকে
ভয়ে ডুবিয়ে দিয়ে, তোমার
শিরদাঁড়ায় কাঁপন তুলে,
আমের আচার খাবার মজা
লুটবে না? তোমার
শিরদাঁড়া না-ই থাকল,
তোমার নেই জানা কথাই,
আমারও তো নেই, আমাদের
কারোরই নেই, আমাদের
সরকারেরও নেই, আমাদের
নেই বলেই আমাদের
সরকারের নেই হয়তো, না কি
আমাদের সরকারের নেই
বলেই আমাদেরও নেই, কে আর
ভেবে দেখতে যাচ্ছে সেই
কথাটা, আগে ডিম, না কি
আগে ছানা --- কিন্তু সেই
শিরদাঁড়াটা যাদের আছে,
ধরে নাও যাদের আছে --- সেই
একেশ্বরের যেমন কিংবা
সেই হবু একেশ্বরের ---
তাদেরও মুহূর্তে একা
করে দিয়ে যায় না এইসব
মোক্ষম খেলুড়েপনা? --- কে
কখন অজান্তে একটা ছক্কা
ফেলে বসে!
আজ বন্যায় মানুষ একা
হয়ে গেছে। একা কি হয়েছে?
একা কি আজ হয়েছে? মানুষ
তো গোষ্ঠীর মধ্যে থাকে,
তার আবার একা আর দোকা।
তার তো বহু। একা কি হয়
নি? বাঁধ ভেঙে, যায় নি কি
তাদের জোড়গুলো একে
অন্যের থেকে খুলে? ঘর
থেকে, জমি থেকে,
স্বামী-বাচ্চাকাচ্চা
থেকে, গাইবাছুর থেকে,
হাল-বলদ থেকে, খেতে
পড়ে-থাকা, অবহেলায়
ডাঁটো মেয়ের মতো
অরক্ষিত পড়ে থাকা, ঝুটি
দোলানো সোনাধান থেকে,
এখন এই ভাঙা বাঁধের
না-ডোবা মাটির ওপর
প্রাণ হাতে করে
শুধুমাত্র বেঁচে
থাকেনি কি তারা একা হয়ে,
এভাবে অমানুষের মতো,
গরু-ছাগলের মতো, বেঁচে
থাকে নি কি তারা? --- ফসল
আর মেয়েতে তফাত কি গো!
এইরকম, বাইরে থেকে আর
ভিড়ের ভিতর থেকে নানান
আওয়াজ উঠে একা হয়ে যায়
মানুষ। একদিন একা হয়ে
যায়। নানান ঝড় উঠে একা
হয়ে যায়। নানান
ঘূর্ণিতে একা হয়ে যায়।
নানান খেলা আর জয়ের
নেশাতে একা হয়ে যায়।
বোঝা আর না-বুঝতে-পারা
পরের যুদ্ধে নিজের
অজান্তেই একা হয়ে যায়।
একা হতে, আর কোনো কিছু
হতে হয় না কারোকেই।
কোনো 'বিগ শট' হতে হয় না,
কোনো কেরানিও হতে হয়
না। মাঝরাত্তিরের কালো
মুকুট চিরে 'একা' তখন
নিজেই আমাদের দখল নিতে
নেমে আসে মর্ত্যভূমিতে,
যেন সে বিশাল জোব্বাপরা
ব্ল্যাক নাইট ডন কিহো,
যেন সে আমাদের রক্ষা
করতে এসেছে, দুধেভাতে
রক্ষা করতে এসেছে।
একা
৩
একা হতেই হয়। নিজে থেকে
একা হতে চাও আর না চাও।
একা হতে চাইলেই যে একা
হবে, এমন কোনো কথা নেই।
একা হতে না-চাইলেই যে
একা হবে না, এমন কোনো
কথাও নেই। ভালোবাসায় আর
ভালো না-বাসায় একা সেই
হতেই হয়। মানুষ, সে যদি
তখনও মানুষ থাকে, কিংবা
সে যদি তখন আর মানুষ না-ই
থাকল --- তবুও তাকে একা
হতে হয়। এ-তো এক
ব্রতপালন! একাকিত্বের
ব্রতপালন। একাকিত্বের
উৎসব বা অনুৎসব বা শোক ---
যাই বলো না তুমি। কালো
অন্ধকারে ডুবে গেলেই বা
কী, আর সুগন্ধি
ভালোবাসায় ভেসে গেলেই
বা কী। এক হলেই বা কী, এক
না হতে পারলেই বা কী,
হঠাৎ কখনো মানুষ একা
হবেই। একা হয়ে যাবেই।
কোনো একটা ধাক্কা, কোনো
একটা ছন্দ, কোনো একটা
উথালপাথাল, কোনো এক
জাগরণ, কোনো দুঃস্বপ্ন,
সে যাই হোক না কেন --- একা
তাকে হতেই হবে। কাছের
সেই মানুষকে বোঝায়, আর
কাছের সেই মানুষকেই না
বোঝায়, অথবা না বুঝতে
চাওয়ায়, অথবা না
বোঝানোয়, একা হতে হবে।
কাছের সেই মানুষ তাকে
বুঝতে না পারায় একদিন
হঠাৎ করেই একা হতে হবে।
একটা প্রশ্ন মনে নিয়ে
একা হয়ে গেল হয়তো। একটা
বিরোধ মুখে তুলে একা
হয়ে গেল। একটা চাওয়া
বুকে নিয়ে, একটা ব্যথা
বুকে নিয়ে একা হয়ে গেল।
জগতের অমিত শূন্যতাকে
বুকে ডেকে নিল তখন। যেন
মরুভূমির ভিতরে একটা
উড়োঝুড়ো খেজুরগাছ
বালিঝড়ের বুকে তার অলীক
দীর্ঘতা এঁকে দিচ্ছে ।
যেন সন্তানহারা
দোয়েলপাখি। যেন
শ্রমিক-স্পেশালের সেই
বাবা, যে তার বাচ্চার
জন্য দুধ কিনতে অচেনা
স্টেশনের এক প্রান্ত
থেকে অন্য প্রান্তে
পাগলের মতো ছুটে বেড়িয়ে
শেষে হতাশ হয়ে ফিরে এসে
দেখে, দুধের আর প্রয়োজন
নেই, আর কখনো দুধের
প্রয়োজন হবে না। অমনি
একা হয়ে গেল সে।
একেবারেই একা। একা তো
হবেই। একাই তো হবে তখন।
একা হওয়া ছাড়া আর হবেই
বা কী? তাকে চেয়েই একা
হবে। তার থেকে চেয়েই
একা হবে। তাকে খুঁজেই
একা হবে। তার চোখে
নিজেকে খুঁজেই একা হবে।
আজ না হলে কাল, কাল না
হলে পড়শু। হয়তো সেই 'কাল'
অকালেই এসে গেল অসময়ের
ঝড়বৃষ্টির মতো, হয়তো
সেই 'কাল' আসবে কালের
নিয়মেই। সামনে আর
পিছনে, দু'দিকেই তো পথ।
দু'দিকেই পাঠক্রম।
একা হবার সেই 'কাল'
এসেছিল মহাভারতের
সময়েও, ঠিক যেভাবে একা
হবার সেই 'কাল' এসেছিল
তার আগেও, আর তার পরেও।
তার অ নে ক আগে আর তার অ
নে ক পরেও। এখন যেমন একা
হওয়াই নিয়তি। এই ২০২০-র
এপ্রিলেই ধরো, কিংবা মে
মাসে। আর এক এপ্রিলের
কথা ভাবো তো একবার --- ৩০
এপ্রিল, ১৯৪৫ --- দিনটা
মনে আছে তোমার? এক বর্বর
যেদিন নিজেকে বুলেটের
গুলিতে একা করে নিল?
খেয়ালখুশির বৃন্ত থেকে
নিজেকে উপড়িয়ে নিল?
এমনই নিল, এমনভাবেই নিল,
যে, তার ঈশ্বরের মতো ডান
হাতটি খানিক পিছনে এক
অবাক-করা দ্রুতিতে
হেলিয়ে সে আর অনুমোদন
করল না কোনো রক্তদাগ।
কোনোই রক্তদাগ। সে আর
অননুমোদন করল না কোনো
পরাজয়। কোনোই পরাজয়।
অল্পবয়সি অভিজ্ঞতাহীন
ইঞ্জিনিয়ার আর
পাইলটেরা দেশভক্তির
তলায় আছড়ে চাপা পড়ে গেল,
বা ডুবে গেল, বা আকাশেই
দাউদাউ করে জ্বলে গেল ---
সে আর অননুমোদন করল না
কোনোকিছুই। এক বছর
আগেও সে জানতে পারেনি,
ডাক আসছে তার। একা হয়ে
যাবার এক টালমাটাল
হাওয়া উঠেছে আন্দিজ
পাহাড়ের গোপন এক কোণে।
জানলে, ডাক-খোঁজ করত
কিছু হয়তো। দেখতে চাইত।
নানান দূর থেকে দেখতে
চাইত তার সেই একা
হতে-চাওয়াটা। জানলে,
রুখতে চাইত হয়তো তার
সেই একা হয়ে-যাওয়াটা।
হয়তো পারতও, কে বলতে
পারে। জানলে,
কীটপতঙ্গের মতো কোটি
কোটি মানুষ হয়তো বিশ্ব
জুড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে
যেত না, কে বলতে পারে।
জানাই যায় নি সেই
ডাকটাকে। জানা যায় না
কখনো । কখন একা হবার ডাক
আসবে কেউ জানে নাকি? কখন
একা হতে হবে কেউ জানে?
ভালোবাসায় কিংবা
ভালোবাসতে না পারায় একা
হতে হবে, নাকি ঘৃণায়
কিংবা অন্ধকারে একা হতে
হবে, কেউ জানে ? একা হবার
তেমন কোনো পাঁজিপুঁথি
আছে ! একা হবার তেমন কোনো
চিঠিপত্র আসে নাকি
শেষ-বিকেলের ডাকে!
গভীর বনের মধ্যে
মাটির অবহেলায় ঘুমিয়ে
আছেন দময়ন্তী। যেন
বন্যায় ভেসে যাওয়া জমির
আ-কাটা সোনাধান। যেন
বানভাসি হিঙ্গলগঞ্জের
কন্যে সে, উপেক্ষা আর
অসহায়তার জল থইথই
চারিদিক। জল থইথই
চারিদিক, তাঁর সেই
শুয়ে-থাকাটাকে ঘিরে।
ভাবনার ঘোলা জল।
রাজর্ষি নল ভাবছেন, আমি
যদি একে ছেড়ে চলে যাই,
তাহলে দময়ন্তী তার
পিতৃরাজ্যে ফিরে যেতে
পারে। পথে আসবার সময়
তাঁকে তাঁর পিতার
রাজ্যের হদিশ দিয়েই
রেখেছেন নানান কথা
ভেবে, এইসব নানান কথা
ভেবে। নল ভাবছেন, আমার
সঙ্গে থাকলে ওকে দুঃখই
পেতে হবে। আমি না
থাকলেই সম্ভবত সুখী হবে
ও। কিন্তু চলে যাব
বললেই কি যাওয়া যায়!
যাবেন কীভাবে? সোনার
পাখির রূপ ধারণ করে
জুয়ার পাশা যে তার
একমাত্র বস্ত্রটুকু
নিয়ে উড়ে গেছে! এখন তো
দময়ন্তীর বস্ত্রেরই
একটি কোণ ধরে কোনোমতে
তাকে লজ্জা নিবারণ করতে
হয়! তবু তো গেলেন! ঘুমের
মধ্যে আধখানা কাপড়
সন্তর্পণে ছিঁড়ে নিয়ে
চলে গেলেন। তখন কি তবে
ধর্ষণ বা রাহাজানি
কিছুই ছিলনা? কে বলল,
ছিলনা? মহাভারতে ছড়িয়ে
ছিটিয়ে আছে না, এমন কত
উদাহরণ? দময়ন্তীর মতো
ওইরকম বনভূমি আলো-করা
এক নারীর আর কোনো বিপদ
ছিল না? ছিলই তো। এক
ব্যাধ তাকে অজগরের মুখ
থেকে রক্ষা করে।
কোনোরকমে রক্ষা করে।
কোনোরকমে তাকে রক্ষা
করে আরও ভয়ানক এক
অজগরের মুখে ঠেলে দেয়।
সে-এক কামের অজগর। সেই
ব্যাধের নিজেরই কামের
অজগর। দময়ন্তীকে দেখে
সে কামনায় এমন আচ্ছন্ন
হয়ে পড়ে শেষে তার
মৃত্যুই হল, গল্পের সেই
ব্যাধের। নল জানতেনই না
এমন কিছু হতে পারে! তাই
হয় নাকি? তবে বনের
অন্ধকারে তাকে ফেলে
গেলেন যে! --- ডাক এসেছিল
তাঁর একা হবার। ভোর
হওয়া অবধি অপেক্ষা
করেনি একা হবার সেই
ডাক। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে
গেছে।
আগের গল্পটা মোটেই
গল্প না --- কাম, মানুষকে
এইভাবে একা করে দেয়।
সত্যি দেয়। নিজের দিকেও
একা আবার পরের দিকেও
একা। দোকাও যেমন করে,
একাও তো করে। শোনো
তাহলে, আর একটা গল্প
বলি। অনেক কাল আগে
সুন্দ-উপসুন্দ নামে দুই
ভাই ছিল অসুর-বংশের। কী
তাদের পরাক্রম! আর কী
তাদের মিল! ভাইয়ে ভাইয়ে
এমন মিল কি আর রোজ দেখা
যায়! তারা এক সঙ্গে
রাজ্য চালাবে, এক
বিছানায় ঘুমোবে, এক
সঙ্গেই খাওয়া-দাওয়া
করবে। এমনকি একই সঙ্গে
কঠিনের থেকেও কঠিন
তপস্যায় স্বয়ং
ব্রহ্মার আশীর্বাদ
ছিনিয়ে নেবে --- 'এক ভাই
অন্যকে ধ্বংস না করলে
তোমাদের মৃত্যু নেই। এক
ভাই অন্যের প্রতি ক্রূর
না হলে, তোমাদের বিনাশ
নেই' --- ভাবো একবার, এ-তো
দেবতাদেরও মহার্ঘ্য
অমরত্ব ! কিন্তু তাই তো
হল। শেষমেশ, তাই তো হল।
সেই আশ্চর্য দূরত্বই তো
পেয়ে বসল তাদের!
অসুর-ভাইয়েরা দুম করে
একা হয়ে গেল তাই একদিন।
একে অন্যের থেকে
একেবারে একা। কী কারণ,
না, বিন্ধ্যাচলের
উপত্যকার ফুলবনে এক
সুন্দরী, নাম যার
তিলোত্তমা, ফুল তুলছিল
সেদিন। দুই ভাই কামে
একেবারে জর্জরিত হয়ে
তাকে দখল করতে এল। নারী
তো, তাই দখল করার। দখল
করতেই এল তাই। দখল
করাতেই অসুরের অসুরত্ব
বলো, পুরুষের পুরুষত্ব
বলো, বীরের বীরত্ব বলো ---
যা-কিছু বলো, কিংবা
সবকিছুই একসঙ্গে বলতে
পারো। কে তাকে নিজের
সম্পত্তি করতে পারে তাই
নিয়ে দু'ভাইয়ের মধ্যে
কী-যে লড়াই শুরু হল। কী
ভয়ংকর! যে-দু'ভাই এক
সঙ্গে সারাজীবন থাকল,
খেল-দেল, ঘুমোল এমনকী
একসঙ্গেই তপস্যা অবধি
করল, হঠাৎ কীভাবে একা
হয়ে গেল তারা। এতই একা
যে কেউ কারোকে আর
ভালোবাসা দিতেই পারবে
না, কেউ কারোর কাছে আর
ক্ষমা চাইতেই পারবে না!
সুন্দ যদি বলেছে, 'আগে
আমি ওর হাত ধরেছি',
উপসুন্দ আরো দ্বিগুণ
জোরে বলে, 'আগে আমি ওর
হাত ধরেছি।' এই না ব'লে,
একে অপরের ওপর একেবারে
লাফিয়ে পড়ে। একে অপরের
ওপর গদার ভয়ংকর আঘাত
করে। একে অপরকে
রক্তাক্ত করে। ছিঁড়ে
ফেলে। মেরেই ফেলে শেষে।
দু'জনে দু'জনকেই। এক
হয়েও একা হয়ে যায় তারা ।
একা হতে হতে হারিয়েই
যায় শেষে।
সুন্দ-উপসুন্দর
ক্রোধ ত্রিজগৎকে ধ্বংস
করে শেষে ফিরে এসেছিল
তাদের কাছেই। আর কর্ণ?
কর্ণের ক্রোধ হত্যার
জঘন্য চক্রান্তের মধ্য
দিয়ে, বিবস্ত্রা
দ্রৌপদীকে ভরা সভায়
দেখার তারণার মধ্যে
দিয়ে, দেখে, তাকে না
পাওয়ার ব্যথার উপশমের
ভাবনার মধ্যে দিয়ে,
জতুগৃহে তাদের পুড়িয়ে
মারার সমর্থনের মধ্যে
দিয়ে ঘুরপাক খেতে খেতে
জ্বলে উঠছিল। যেন
অন্ধকার দাবানল কোনো,
যেন মনের অন্ধকারের
ব্যাপক দাবানল কোনো।
ব্যথা তো তার ছিলই।
কুরু-পাণ্ডবদের
অস্ত্রশিক্ষা
প্রদর্শনের আসর বসেছে।
অর্জুন সূতপুত্রের
সঙ্গে প্রতিযোগিতায়
রাজি হলেন না। অর্জুন
যদি বা কর্ণের হুংকার
উপেক্ষা করেই গুরু
দ্রোণাচার্যের
সম্মতিতে তার সঙ্গে
দ্বন্দযুদ্ধে রাজি
হলেন, কর্ণের এই হুংকার
উপেক্ষা করেই --- ' তোমার
গুরুর সামনেই তোমার
মুণ্ডচ্ছেদ করব' ---
কৃপাচার্য বেমালুম বলে
দিলেন, '
অজ্ঞাতকুলশীলের সঙ্গে
কোনো দ্বন্দযুদ্ধ হতে
পারে না, নিম্নবংশীয়ের
সঙ্গে কোনো
দ্বন্দযুদ্ধ হতে পারে
না।' ভীম কী বললেন তখন? ---
'ওহে, তোমার বংশ তো শুধু
ঘোড়ার চাবুকই সামলাতে
পারে।' ভীম আরও বললেন, '
অর্জুনের হাতে মরার
উপযুক্ত তুমি নও। কুকুর
কি কখনো যজ্ঞপিণ্ডের
অধিকারী হয়!' ব্যথা তো
তার ছিলই --- কী বিশাল
রঙ্গমঞ্চ সেখানে ,
আলাদা আলাদা আসনে কত
নারীপুরুষ, দিগ্
বিদিকের কত বিশিষ্ট
ব্যক্তিরা, কত যোদ্ধা,
কত রাজপরিবারের
সুন্দরীরা, কত
ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় আর
বৈশ্য, আর কত একা সে --- এক
সূতপুত্র ধনুর্ধর। কত
একা! সূর্যের দিকে
তাকিয়ে শুধু
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন
কর্ণ। কর্ণ উপস্থিত
ছিলেন দ্রৌপদীর
স্বয়ংবরেও। কী হল
সেখানে, বলো তুমি!
দ্রৌপদী হঠাৎ বলে
বসলেন --- ধনুর্ধর
শিরোমণি কর্ণ তখন
মুহূর্তেই ধনুক হাতে
তুলে তাতে গুণ পরিয়ে
ফেলেছেন --- দ্রৌপদী
বললেন, 'আমি সূতপুত্রকে
বরণ করব না।' হায়, ক্রোধে
জ্বলেপুড়ে গেলেন
মহাবীর কর্ণ। সূর্যের
দিকে তাকিয়ে শুধুমাত্র
ধনুকটা নামিয়ে রাখলেন
তিনি। একা একটা মানুষ
আরো একা হয়ে গেলেন।
আরওই একা হয়ে গেলেন।
গোপন জন্মের গ্লানি,
অন্ত্যজ হবার গ্লানি,
নারীর অ-গ্রহণের
গ্লানি, কর্মের
অনধিকারের গ্লানি,
পুরুষকার অস্বীকারের
গ্লানি --- সেই উৎসবমুখর
সভা হঠাৎ যেন একা করে
দিল তাঁকে। আরওই একা।
ক্রূর করে তুলল তাকে,
লোলুপ করে তুলল,
ষড়যন্ত্রী করে তুলল।
একা হলে মানুষকে শেষে
কত কী-ই না হতে হয়!
'চলো, এখনই বিশাল
সৈন্যদল নিয়ে দ্রুপদের
রাজ্যে চড়াও হই আমরা ---
দ্রুপদকে পরাজিত করে
পাণ্ডবদের বধ করি' --- এই
পরামর্শ স্বয়ং কর্ণ
দুর্যোধনকে দিলেন। কখন?
পাণ্ডবেরা দ্রৌপদীকে
জয় করে মহা সমাদরে
দ্রুপদ রাজ্যের অতিথি
হয়ে সুখে দিন
কাটাচ্ছেন। ধুমধাম করে
তাদের বিয়েও হয়ে গেছে ---
ঠিক এইসময়, এই পরামর্শ,
স্বয়ং কর্ণ দুর্যোধনকে
দিলেন। দ্রৌপদীকে ভরা
সভায় নগ্ন দেখার উৎসাহে
জল ঢেলে দিতে বিকর্ণ
যখন একের পর এক নীতির
প্রশ্ন তুলছেন, কৌরব
রাজ্যের সুবিধাভোগী
পাণ্ডাদের বিপুল
নৈঃশব্দ্যকে যুক্তির
বাণে অস্থির করে
তুলছেন, বিকর্ণ যখন
নিরুত্তর পিতামহ ভীষ্ম,
আচার্য দ্রোণ, আচার্য
কৃপর নীরবতা ভেঙে দেবার
শেষ একটা চেষ্টা থেকে
মরিয়া হয়ে বলতে শুরু
করেছেন, 'এই ব্যাপারে
আমি যা ন্যায়সংগত বলে
মনে করি, তা না বলে থাকতে
পারছি না। যুধিষ্ঠিরের
কোনো অধিকার ছিল না
দ্রৌপদীকে বাজি রাখার।
যুধিষ্ঠির স্বেচ্ছায়
নয়, শকুনির প্ররোচনায়
দ্রৌপদীকে বাজি রাখেন।
তাই আমার সিদ্ধান্ত হল
জুয়াতে দ্রৌপদী
হারেননি' --- কর্ণ তখন কী
বললেন? --- 'বিকর্ণ, তুমি
কুলাঙ্গারের মতো কথা
বলছ কেন? দেবতারা
নারীদের জন্য এক পতিরই
বিধান করেছেন। পাঁচ
পতির স্ত্রী হওয়ায়
দ্রৌপদী নিঃসন্দেহে
বেশ্যা। তাই আমার মনে
হয় একে এক বস্ত্রে অথবা
বস্ত্রহীনা করেও সভায়
নিয়ে আসা কোনো অনুচিত
কাজ নয়।' তারপর মহাবীর,
মহা ধনুর্ধর কর্ণ,
দুঃশাসনকে উৎসাহ দিয়ে
বললেন, 'বিকর্ণ বালক হয়ে
গুরুজনদের মতো কথা
বলছে। তুমি দ্রৌপদী এবং
পাণ্ডবদের বিবস্ত্র
করো।' হায় রে একা মানুষ,
এ কা মানুষ, হায় রে একা
আর ধ্বংস হয়ে-যাওয়া এক
মানুষ, বাসনার দাবানলে
জ্বলেপুড়ে যাওয়া এক
মানুষ, হায় রে করাল
স্রোতের ছটফট ডুবোজলে
এক বিশাল একা মানুষ !
মানুষ যখন, তখন তো
একাই। সে গল্পেই হোক,
ইতিহাসেই হোক আর
পুরাণেই হোক --- মানুষ
যখন, ক্রোধ আর কাম আর
ভালোবাসা আর অভিসন্ধি
আর পৌরুষ আর ছলনার
ডালপালা ঝুলে থাকা
অরণ্যে আজীবন, চিরটাকাল
পথ-হারানো মানুষ যখন,
তখন সে তো একাই।
প্রেমেও একা,
অ-প্রেমেও... কেন, তোমার
মনে নেই --- যে-দ্রৌপদীর
গায়ে বিরল কমলের সুগন্ধ
তাঁর জন্ম থেকেই ভাসত,
সেই পদ্মগন্ধা
দ্রৌপদীই বদরীর পবিত্র
আশ্রমে থাকার সময় হঠাৎ
একদিন ঈশান কোণ থেকে এক
সহস্রদল সুগন্ধি পদ্ম
উড়ে আসতে সেটা হাতে
নিয়ে ভীমকে বললেন, '
আমাকে যদি ভালোবেসে
থাকেন, তাহলে আমার জন্য
এইরকম ফুল আরও নিয়ে
আসুন। আমি এগুলি
কাম্যক্ বনে আমাদের
আশ্রমে নিয়ে যেতে চাই'?
তার জন্যেই তো
দ্রৌপদীকে ছেড়ে
সৌগন্ধিক বনের দিকে
চললেন ভীম, পথ কোথায় না
জেনেই, পথ আছে কি নেই না
জেনেই, সামনে কতটা বিপদ
ওঁত পেতে আছে, না জেনেই!
দ্রৌপদীকে ভালোবাসেন
বলেই তো সৌগন্ধিক বনে
প্রবল যুদ্ধ করতে হয়
একা তাকে সমস্ত যক্ষ ও
রাক্ষসদের সঙ্গে ---
কুবেরের বাগানের
সুগন্ধি পদ্ম তুলে নিয়ে
যাবেন তার আজন্মা
সুগন্ধি, পদ্মগন্ধা,
প্রাণাধিক প্রিয়
দ্রৌপদীকে উপহার দেবেন
বলে!
প্রেমেও কি আর মানুষ
একা না হয়ে পারে!
কোনোদিন পেরেছে!
৪
প্রতিটি ইতিহাসের একটা
দর্শন আছে। প্রতিটি
দৃশ্যেই আছে ইতিহাস।
সেই যে কর্ণ দ্রৌপদীকে
বেশ্যা বলে গালি দিলেন,
কর্ণ কি একা বললেন সেই
কথাটা? কর্ণ কি কোনো
যুগপুরুষের মতো একা
দাঁড়িয়ে কথাটাকে
হাওয়ায় ভাসিয়ে দিলেন,
এই প্রথমবারের জন্য
হাওয়ায় ভাসিয়ে দিলেন?
এই কথাটাই কি আলোয়
হাওয়ায় ঘুরতে ঘুরতে
আসছে না আরও অনেক অনেক
আগের থেকে, জলে ভাসতে
ভাসতে আসছে না, আরও অনেক
অনেক আগের থেকে? আর, এলোই
যদি বা, সে কি আর একা
আসছে? সঙ্গে কোনো দর্শন
নিয়ে আসছে না? তাই আবার
হয় নাকি! একটা একা,
দূরের আরো একটা একা-কে
তার প্রয়োজনে ডেকে
নিচ্ছে, সমাজের
প্রয়োজনে ডেকে নিচ্ছে,
সে যেভাবে সমাজকে ভাবে,
ভেবেছে, সে যেভাবে
সমাজের প্রশ্নের একটা
মীমাংসা খুঁজেছে, সে
যেভাবে সেই সমাজের
সঙ্গে লড়াই করবে বলে
ভেবেছে, লড়তে হয় বলে
ভেবেছে, সেই সমাজের
প্রয়োজনেই একটা একা আর
এক একা-র হাত ধরে, সেই
একা-র দর্শনের হাত ধরে।
একটা গল্প শোনো তাহলে
--- সমাজের আইন কানুনের
পিছনের এই গল্প। বলা
যায়, কেস স্টাডি। একবার
ঋষি উদ্দালক, শ্বেতকেতু
এবং তাঁর মা তাঁদের
কুটিরের দাওয়ায় বসে
আছেন, এই সময় এক
ব্রাহ্মণ এসে তাঁর
মায়ের হাত ধরল, এবং 'এসো
যাই', বলে একান্তে নিয়ে
গেল। শ্বেতকেতু সহ্য
করতে পারলেন না সেই
দৃশ্য, তিনি ভয়ানক
ক্ষুব্ধ হলেন। উদ্দালক
তখন শ্বেতকেতুকে
বোঝালেন, শোনো বাছা, রাগ
কোরো না, এটা সনাতন
ধর্ম। পৃথিবীতে সমস্ত
বর্ণের স্ত্রী
অরক্ষিতা। গরু যেমন
স্বচ্ছন্দবিহার করে,
মানুষও করতে পারে। এই
ঘটনাটি সেই বালকের মনে
এতই প্রভাব ফেলল, যে
শ্বেতকেতু যখন ঋষি
হলেন, তাঁর কথা যখন দেশে
দশে মেনে নেবার অবস্থা
হল, তখন শ্বেতকেতু
নিদান দিলেন, এক
স্ত্রীর কেবল একজন
স্বামীই হবে ।আচ্ছা
চলো, এই গল্পের হাত ধরেই
এবার আর একটা গল্পে যাই,
ঋষি দীর্ঘতমার গল্প।
দীর্ঘতমা ছিলেন
জন্মান্ধ এবং দরিদ্র।
একদিন তাঁর স্ত্রী
বললেন, স্বামীকে ভর্তা
বলা হয় কারণ স্বামী
ভরণপোষণ করে। তুমি তো
অক্ষম, সমস্ত সংসার
আমাকে চালাতে হয়। আমি
আর তোমাকে, তোমাদের,
ভরণপোষণ করতে পারছি না,
আমি চললাম। তাঁর স্ত্রী
অন্য পুরুষের কাছে চলে
যাবে, এত বড়ো কথা! আচ্ছা,
দাঁড়াও, এক্ষুনি একটা
নিয়ম চালু করছি। সমাজ
এখন থেকে সেই নিয়মেই
চলবে। নিয়ম জারি করলেন
ঋষি দীর্ঘতমা, 'নারীর এক
পতি হইবেক...নারী অন্য
পুরুষকে গমন করিলে
নিঃসন্দেহে পতিতা
হইবে।' তুমি বলবে, এ তো
সাধুবাদ দেবার মতো কথা!
ঋতুকালে স্বামীর সেবা
করো আর অন্য সময় অন্য
পুরুষে ইচ্ছামতো উপগত
হও, এ তো ব্যভিচার --- যে
কথাটা, কুন্তিকে
পরপুরুষে নেহাত আসক্ত
করবার জন্যেই হয়তো
বলেছিলেন মহারাজ
পাণ্ডু -- নইলে সন্তানের
ইচ্ছা তো পূর্ণ হত না
তাঁর ! অবশ্য তিনি চালু
ধর্মের বাইরের কোনো কথা
বলেন নি, ধর্মকে নিজের
প্রয়োজনে ব্যবহার
করেছিলেন মাত্র। যাই
হোক, আমাদের দীর্ঘতমার
ওই গল্পটা কিন্তু এখনো
শেষ হয় নি। তারপর কী হল
শোনো। তাঁর স্ত্রী আর
ছেলেরা নিজেদের মধ্যে
সাঁট করে তাঁকে ভাসিয়ে
দিল নদীর জলে। দীর্ঘতমা
গঙ্গায় ভাসতে ভাসতে
যাচ্ছেন, এদিকে রাজা
বলিও এসেছেন গঙ্গায়
স্নান করতে। তিনি
দীর্ঘতমাকে উদ্ধার
করলেন, শুনলেন তাঁর
দুঃখের কাহিনি। তাঁর
মনেও তো ভারি দুঃখ। এই
ঋষি পারেন না তাঁর দুঃখ
ঘোচাতে? তাঁর পুত্রের
অভাব পুরণ করতে পারেন
না, দীর্ঘতমা? তিনি
রাজমহিষী সুদেষ্ণাকে
পাঠালেন দীর্ঘতমার
কাছে। কই, দীর্ঘতমা
আপত্তি জানিয়েছিলেন
বলে তো শোনা যায় না, যে
বৎস, আমি সদ্য সদ্য যে
প্রথা নিজে চালু করে
এসেছি, এখন নিজেই আর
তাকে লঙ্ঘন করতে পারব
না? --- যে, তাহলে অন্য
পুরুষে উপগতা রাজমহিষী
সুদেষ্ণা পতিতা হবেন?
এই হল গিয়ে আমাদের
গপ্পো। কেন, রাজা যযাতি
তাঁর স্ত্রী দেবযানীর
দাসী, শর্মিষ্ঠার
গর্ভে সন্তান আনেন নি?
রাজা পুরু তো তাঁরই
তৃতীয় সন্তান,
শর্মিষ্ঠাই তো তাঁর মা!
তাহলে এই নিয়মটা হয়েছিল
কেন, একবার ভাবো। ---
রাজসভায় কর্ণ যে একথা
বলছেন, তাঁর পিছনে বলছে
তো আসলে তাঁর সমাজ।
দীর্ঘতমাদের আইন
যে-সমাজ ধারণ করেছে,
সুবিধা হচ্ছে বলে ধারণ
করেছে, সুবিধা হচ্ছে
বলে চাপিয়ে দিয়েছে
অন্যদের ওপর। কর্ণ একাই
বা কেন, দ্রৌপদীকে
যুধিষ্ঠিরেরা পাঁচ ভাই
মিলে গ্রহণ করবেন শুনে
রাজা দ্রুপদ বা তাঁর
ছেলে ধৃষ্টদ্যুম্ন কম
অবাক হয়েছিলেন? সেই একই
সমাজের কথা টেনে তাঁরা
বলেন নি, "হ্যাঁ, এক
পতির একাধিক পত্নীর কথা
তো শাস্ত্রে আছে,
কিন্তু এক পত্নীর
একাধিক স্বামী!"
শুনেছ তো তোমরা ঋষি
উদ্দালক কী বলেছিলেন?
তিনি শ্বেতকেতুকে
বুঝিয়েছেন, শোনো বাছা,
পৃথিবীতে সমস্ত বর্ণের
নারীই অরক্ষিতা। আর
শ্বেতকেতু যে এক নারীর
একটিমাত্র স্বামীর
বিধান দিয়ে গিয়েছেন,
সেটাও তো জেনে গেছ
তোমরা, তাই না? তোমরাই
তো সমাজ, না কি? তাহলে
সমাজকে তো দেখতে হবে
সেই দিকটা, যাতে একটা
অরক্ষিতা নারীর যতটা
সম্ভব সুরক্ষা দেওয়া
যায়? অরক্ষিতা বলে যদি
সমাজের মাথারা বসেই
থাকল, তাহলে আর সমাজ,
সমাজ কীসের! কোনো
বিবাহিতা নারীর
পুরুষটি মারা গেলে,
বলতে নেই, কোনো যদি
বিপদ-আপদ আসে তার, সে যদি
নিজেকে রক্ষা করতে না
পারে, সে যদি
চরিত্রভ্রষ্ট হয়, হ্যাঁ
গো, যদি কোনো পাপী
জোরজার করে তার ওপর, তাই,
খুব বিবেচনা করে,
ভাবনাচিন্তা করে,
সহমরণের এক খোলতাই
সমাজ-ব্যবস্থাও সামনে
চলে এল। কিছু আগে আর পরে,
এইটুকু। কালচক্রের
সামান্য এদিক আর ওদিক।
সমাজের দিগ্ গজেরা আগে
থেকেই সব আয়োজন পাকা
করে রেখেছিলেন। তারা
বললেন, বেশ ভেবে ভেবে,
মেপে মেপে, কথায় একটা
নোঙর বেঁধে রেখে, যাতে
আপত্তির হাওয়ায় সেটা
গড়িয়ে না পড়ে,"
স্ত্রীলোককে স্বামীর
সহিত মরণে প্রবৃত্তি
দিবার যথার্থ কারণ এবং
এরূপ বন্ধন করিয়া দাহ
করিবাতে আগ্রহের কারণ...
যে স্ত্রীলোক স্বভাবতই
অল্পবুদ্ধি,
অস্থিরান্তঃকরণ,
বিশ্বাসের অপাত্র,
সানুরাগা, এবং
ধর্মজ্ঞানশূন্য হয়।...
সুতরাং সহমরণ না করিলে
নানা দোষের সম্ভাবনা।...
অনেকেই সহমরণ করিতে
অভিপ্রায় করে, কিন্তু
অগ্নির উত্তাপে
চিতাভ্রষ্ট হইবার
সম্ভাবনা আছে, তাহা দূর
করিবার নিমিত্ত
বন্ধনাদি করিয়া দাহ করা
হয়।" শোনো একবার কেমন
একটা পাকা ব্যবস্থা হল
---আগুন গায়ে লাগলে সে তো
লাফিয়ে বাইরে চলে আসতে
পারে, আসতেই পারে, সেই
বুদ্ধিহীনা,
ধর্মভয়হীনা নারী, বিধবা
নারী, আর প্রাণের ভয়ে
যদি সে আসে, ধরো আসল, তবে
তো মহা অনর্থ হবে গো, তাই
না! আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে
দাও তবে স্বামীর
মৃতদেহের সঙ্গে। বাঃ,
এইবার আয়োজন সব নিখুত
করা গেছে। গল্পে বা
প্রবন্ধে নয়, সত্যি
করেই গেছে। কতবার
'প্রবর্ত্তক নিবর্ত্তক
সম্বাদ' লিখবে হে! কত
সমাজ সংস্কার করবে? কোন
দিকে বাঁধ দেবে?
যা কিছু দেখা যায় না,
তার শক্তি অনেক।
অনেকগুণ। চারিদিকে
তাকিয়ে দেখো, তুমি একমত
হবে। আলো, হাওয়া,
মাধ্যাকর্ষণ এসব কিছু
দেখা যায় কি? ভয় দেখা
যায়? আলোয় আলো হলে তবে
অন্য কিছুকে সেই আলোতে
দেখা যায়, তাই না! করোনার
জীবাণুটাকে কি দেখা
যায়? করোনায় আধ-মরা হলে
তখন সেই অবস্থাটা দেখা
যায়। কথা-ও তেমন এক
অদৃশ্য শক্তি। কথায় আছে
না, কথার ফাঁদ! কথাও তেমন
একটা ফাঁদ। কথা যে
শুনছে, আর কথা যে বলছে,
দু'জনকেই জড়িয়ে পড়তে হয়,
দু'জনেই মূল্য চোকায়।
ব্যাধের ফাঁদের থেকে
বহুগুণ শক্তিশালী এই
ফাঁদ। এই ধরো 'সোশাল
ডিস্ট্যান্সিং' কথাটা,
এর কি জোর কম ভেবেছ?
অর্থাৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে
যাও, অথবা বিচ্ছিন্ন
হওয়া। নিজের একা থাকা
একরকম কথা, আর সমাজ একা
করে দিতে চাইলে আর
একরকম কথা। এই কথাটা
কতটা শক্তিশালী ভাবো
তো? এই কথাটা, এই
কথাগুলোই কতটা পুরোনো,
কতবার ব্যবহার করা
হয়েছে, ভাবো তো! একটা
চেনা গপ্পো বলি। তিন জন
মানুষ এক সঙ্গে রোয়াকে
বসে নরক গুলজার করছে।
একটা লোক তখন একটা
ছাগলকে কাঁধে নিয়ে
সামনে দিয়ে যাচ্ছিল।
ছাগলটাকে কাঁধে নিয়ে
যাচ্ছে দেখে ওদের একটু
খিল্লি করতে সাধ হল,
ছোটো ছেলেমেয়েদের যেমন
হয় আর কী। লোকটাকে ওরা
জিজ্ঞেস করল, ও কত্তা,
কাঁধে বাছুর তুলে
যাচ্ছেন কোথায়? --- না তো,
এ তো ছাগল, লোকটা উত্তর
দিল! পরে আরো কতজন তাই
বলল, পরে আরও কতজন।
শুনেই বলল হয়তো, কিংবা
মজা পেতেই বলল। মজা
পেতে, কার না কিছু বলতে
ভালো লাগে। তিন সমাজ
পরপর একটা ছাগলকে বাছুর
বললে, বাছুর বলতে থাকলে ,
বাছুর বলে নিদান হেঁকে
দিলে, তিন জনের
বিশ্বাসে, তিন জনের
কৌশলে বাকিরাও একদিন
তাই বলতে থাকে। তখন
লোকটা বাছুর নিয়ে যে
যাচ্ছে, কাঁধে বাছুর
নিয়েই যে যাচ্ছে, এই
কথাটা খোলসা হয়ে যাবে
না! ভাবো তো কথা-র জোর!
শব্দ তো আগে, তারপর তো
তার রূপ। ছাগলকে
আজন্মকাল বাছুর বললে
অসুবিধা কোথায়? শব্দ
দিয়েই তো লোকে চেনে,
ভাবে, বিচার করে, শব্দ
নিয়েই তো লোকের কারবার।
তা, যদি আমি ছাগল-এর
শব্দটা পাল্টে বাছুরই
করে দিই, দীর্ঘদিন ধরে
করতেই থাকি, সমাজের
ভালোর জন্যই করতে থাকি,
লোকে তো বাছুর শব্দটাই
নেবে, যারা শুনবে তারা
বাছুর শব্দটাই নেবে,
তারপর বাছুরের জানা সেই
ছবিটা তাতে লাগাবে, সেই
শব্দের পিঠে লাগাবে, আর
লোকটার যাওয়াটা নতুন
করে গড়ে তুলবে। ছাগল
কাঁধে নিয়ে লোকটার
পুরোনো যাওয়াটা মিথ্যে
হয়ে যাবে। মিথ্যেও হতে
পারে, বদলেও যেতে পারে,
আবারও বদলে যেতে পারে --
যখন যেমন দরকার। কে আর
বাছুর কি ছাগল দেখতে এল,
কতজনই বা আর, একটা ঘটনা
দেখে, দেখবার মতো করে
দেখে, নিজের মতো করে
দেখে, অ-সামাজিক নিজস্ব
একটা দৃশ্য দেখে? দৃশ্য
কি একা ভেবেছ? তার পিছনে
ইতিহাস নেই?
শব্দই যুক্তি। আমি
বলি, তাইজন্যই আমি, আমি (I
speak, therefore I am.)। আমি ভাবি,
তাইজন্যই আমি, আমি।
তাহলে বাপু ঘুমিয়ে
থাকার সময় তুমি কোন
মনিষ্যিটা--- তুমি তো
বলছও না, তুমি তো ভাবছও
না? --- কে বলেছে? তুমি
স্বপ্ন দেখো না?
স্বপ্নের মধ্যে একটা
বিশাল ব্রিজ হুড়মুড় করে
ভেঙে, উত্তাল জলে পড়ে
যাও না? স্বপ্নে তোমার
মায়ের সঙ্গে, তোমার
বাপ-ঠাকুরদার সঙ্গে
কখনো কথা হয়নি? ---আরে, সে
তো অন্য কথা, আনসান যত
কথা, আগডুম বাগডুম সব
ছবি, আকাশ পাতাল কত
ভাবনা। সেগুলো আবার
আমার কথা হতে যাবে কেন?
--- না গো না! স্বপ্ন
দেখাদেখি তো আসলে শব্দ
দেখাদেখি, আসলে, ভাবনা
দেখাদেখি, আসলে, বাচ্য
দেখাদেখি। তোমার
ভাণ্ডারের সেই লুকিয়ে
ফেলা ছবি আর ভাবনা আর
শব্দ তোমার সঙ্গে তোমার
ঘুমের মধ্যে দেখা করতে
যায় যে! একটা জেগে-থাকা
যুক্তি, একটা জেগে থাকা
সামাজিক যুক্তি, আর
একটা ঘুমিয়ে থাকা একা-র
প্রতিযুক্তি,
প্রতিশব্দ, প্রতিভাবনা,
গোপনীয়তা, পীড়ন,
মাঝেমধ্যে মুখোমুখি
দাঁড়াতে যায়, বসতে যায়
তোমার ঘুমের
রেস্তোরাঁয়। --- আমি বলি,
আমি ভাবি, তাই আমি আছি।
তুমি বল না, তুমি ভাব না,
ভাবলেও কী ভাবছ সেটা বল
না, তাই তুমি নেই। থেকেও
নেই। থাকার মতো করে
নেই। থেকেও সমাজ থেকে
একা হয়ে আছ।
ময়দানবের সঙ্গে
অর্জুনের একটা 'গিভ
অ্যান্ড টেক' মৌ হয়,
এগ্রিমেন্ট হয়। একটু
ঘুরপথে হয় অবশ্য।
অর্জুন বিনিময়ে কিছু
'চাই না' বললেও, ভগবান
শ্রীকৃষ্ণ পাণ্ডবদের
প্রয়োজনের 'কথা'-টা
ময়দানবকে শুনিয়ে
রাখেন। কীসের বিনিময়ে,
না, খাণ্ডববনের আগুন
থেকে অর্জুন তাকে রক্ষা
করবে। সে পারে, তারা তো
অজীর্ণ রোগে ভোগা
বেচারা অগ্নিদেবের
মিত্রশক্তি, তারা বললে,
অগ্নিদেব না করবেন না।
বিনিময়ে ময়দানব তাদের
দিব্য সভা নির্মাণ করে
দেবে। ভালো কথা।
যথাসময়ে তা তৈরিও হয়েছে
আর উদ্বোধনও হয়ে গেছে।
দেবর্ষি নারদ এসেছেন
দেখা করতে। এসে
প্রশ্নের ছলে নানান
পরামর্শ দিচ্ছেন, একজন
নরম মনের আদর্শবাদী
রাজার কানে যে যে
প্রশ্নগুলো তুলে দেওয়া
উচিত, তাই দিচ্ছেন। ---
বন্ধু, শত্রু আর উদাসীন
লোকেদের সম্বন্ধে খোঁজ
খবর রাখেন তো? ---
শত্রুপক্ষের মন্ত্রী,
পুরোহিত, যুবরাজ,
সেনাপতি, এদের ওপর তিন
জন করে গুপ্তচর রাখেন
তো? --- নিজের কাছের
লোকেদের ওপরও গুপ্তচর
রাখেন তো? --- শত্রুদের না
বুঝতে দিয়ে তাদের সঙ্গে
মিষ্টি ব্যবহার করেন
তো? --- নারীদের বিশ্বাস
করে গুপ্ত কোনো কথা বলে
দেন না তো? ভাবো ---
বিদেশকে, দেশকে, সমাজকে
করাত দিয়ে চিরতে চিরতে,
তিনি ঢুকে পড়েছেন রাজা
যুধিষ্ঠিরের শোবার
ঘরেতেই! আচ্ছা, এ তো গেল
একটা দিক। এইবার ভীম
যখন সৌগন্ধিক বনে
চলেছেন, তখন পথে দেখা
হয়ে গেল রামায়ণের অসীম
শক্তিধর সেলিব্রিটি
সেই শ্রীহনুমানের
সঙ্গে। তিনিও ভীমের
অনুরোধ ফেলতে পারলেন
না, দু'একটা দরকারি
উপদেশ দিলেন। তার একটা
হল --- স্ত্রীলোক, মূর্খ
বালক, লোভী এবং নীচ
ব্যক্তির সঙ্গে কোনো
গুপ্ত পরামর্শ কোরো না।
--- স্ত্রীলোকের সঙ্গে
কথা বলাও যা, লোভী আর নীচ
ব্যক্তির সঙ্গে কথা
বলাও তাই! লোভী কিংবা
নীচ যদি বা বাড়ির বাইরে
থাকে ধরে নিই,
স্ত্রীলোক আর বাইরে কত
হুটহাট কথা বলার জন্য
পাবে বলো তো, কত আর
মিলেনিয়াম পার্ক, কী সি
সি ডি ছিল সেকালে,
স্ত্রীলোকের সঙ্গে
পরামর্শ করার জন্য,
গোপন প্রয়োজনীয় কোনো
কথা বলার জন্য!তাহলে,
হাতে রইল পেন্সিল।
তোমার নিজের স্ত্রী চার
দেয়ালের মধ্যে থেকেই,
উঠোনে যারা, বাইরে যারা,
নীচ যারা, তাদের সেই
অনির্দিষ্ট নীচতার
সঙ্গে কেমন মিশে গেল।
এটা কি সোশাল
ডিস্ট্যান্সিং নয়, এটা
কি কোয়ারেন্টাইন নয়!
শব্দ তো মৃত্যুর দিকে
নিয়ে যায়! মহাভারতের
সময় নারীদের এইভাবেই
চেনানো হতো --- আজও হয়। ---
তারা আসলে ব্যবহার্য,
সন্তান উৎপাদনের জন্য
ব্যবহার্য, সেটা ছাড়া
তাদের তেমন কোনো আর
ভূমিকা নেই। সিদ্ধান্ত
গ্রহণের অধিকারও নেই।
প্রশ্ন করবার, করে
উত্তর পাবার অধিকারও
বিশেষ ছিল কি? থাকলে,
পাশা খেলার সভায়
দ্রৌপদীর প্রশ্নের
উত্তর কেউ দিলেন না কেন?
সেটা কি দ্রৌপদীর
বিস্ফোরণ তাঁকে অনেকটা
উপশম এনে দিতে পারে ,
এইরকম কোনো মহৎ ভাবনায়!
বিদুর কি তেমন কিছুই
ভেবেছিলেন! তিনি তো
সময়ে-অসময়ে পাণ্ডবদের
শুভাকাঙ্ক্ষীর ভূমিকা
নিয়েছেন, তাঁদের
প্রাণেও বাঁচিয়েছেন।
তিনি এও জানতেন
দুর্যোধনের এই
সিদ্ধান্ত বদলাবার
ক্ষমতা এই সভায় উপস্থিত
কারোরই নেই। এটা কি তবে
তাঁদের নিশ্চুপ থাকার
পিছনের কারণ হতে পারে?
শুধুমাত্র সন্তানের
জননী যে হয়, পুরুষ যাকে
সন্তান কামনায়
নিঃসংকোচে অন্য
পুরুষের কাছে ঠেলে দিতে
পারে, তার জন্য এত
উদগ্রীব হওয়া গুণী
মানুষদের মানায় কিনা
আমাদের জানা নেই।
মধ্যযুগের ইউরোপে
একটা নৌকায়
কুষ্ঠরোগীদের তুলে
দ্বীপান্তরে রেখে আসা
হত --- ভাবখানা, এই আমার
পরিচ্ছন্ন সমাজ আর তার
থেকে দূ রে অসুখের ওই
দ্বীপ। এ-তো গেল শরীরের
অসুখের কথা। আর মনের
অসুখের কথা? পাগলাগারদ
কি প্রথমেই ছিল? পাগল
কারা? প্রথমে তো যারা
রাস্তায় নোংরা মেখে
ঘুরে বেড়াচ্ছে, ওই
আমাদের হিন্দি সিনেমায়
ডিটেকটিভ মহিলা
অফিসাররা যেমন খুনির
ওপর আউলা ঝাউলা পাগল
সেজে নজর রাখে, ঠিক তেমন
পাগলদের, পাগল বলা হত
---যারা, mad as such. তারপর তো
সেই পাগল চেনার
মন্ত্রটা আরও ছড়িয়ে পড়ল
বড়ো হয়ে। উক্তি আর
যুক্তি যাদের নড়বড়ে,
উক্তির পিছনে যুক্তি
যাদের নড়বড়ে, তারাও
নাকি পাগল! পাগল খুঁজে
বের করবার নয়া ফরমান কি
শুধুমাত্র প্রাকৃতিক
কারণ থেকেই, নাকি
সামাজিক কারণও তার
সঙ্গে জুটে গেল? আধুনিক
চিকিৎসাশাস্ত্র তো
ডি-রিজন বা আন-রিজিন যাই
বলো না কেন, ফরাসি
কায়দায় বলো কী ইংরেজি
কায়দায় বলো, সেগুলোকেও
পাগলামিই মনে করে, মনে
ক'রে তাদের বিচ্ছিন্ন
করে! --- হুজুর, খুন করেছি
ঠিকই, কিন্তু সেই সময়
আমি অপ্রকৃতস্থ ছিলাম
হুজুর। এই আমার
ডাক্তারের রিপোর্ট
দেখুন। লেখা আছে না,
'ইনসেন'! --- নিয়ম হলে তো
নিয়মের ফাঁক থাকবেই।
তাহলে নারী, যার সঙ্গে
কোনো গোপন পরামর্শই করা
যাবে না, সেটা কি এইজন্য
নয় যে তার যুক্তি,
কুযুক্তি --- তার উক্তির
পিছনের যুক্তি বেজায়
নড়বড়ে! সেটাও তাহলে
ইনস্যানিটি, যদি
আন-রিজন ইনস্যানিটি হয়ে
থাকে! তাই তার সঙ্গে
গোপন পরামর্শ করতে নেই।
সে হয়তো দুম করে বলে
বসবে, এই তো আমরা সুখেই
আছি --- কী হবে আর
প্রতিবেশী দেশ আক্রমণ
করে! কী হবে রক্ত ঝরিয়ে!
এটা একটা যুক্তিসঙ্গত
কথা হল, বলো! আর
যুক্তিসঙ্গত কথা যদি
না-ই হয়, তাহলে সেও কি,
সেই নারীও কি তবে একা
হয়ে গেল না, যখন গোপনতম
পরামর্শ করার জন্য তুমি
যাবে তোমার ভাই বা
মন্ত্রী বা অন্য অনেক
হিতাকাঙ্ক্ষীর কাছে!
তুমি ভাবছ, সমাজ তো অনেক
বদলেছে! --- সে তুমি দূরে
থাকো বলে ভাবছ, সে তুমি
আলোয় থাকো বলে ভাবছ।
তুমি পাগলদের পাগলা
গারদে ভরে সমাজ থেকে
বিচ্ছিন্ন করে দাও,
কিংবা তুমি আন-রিজন
কিংবা ডি-রিজনকে অস্ত্র
করে ঘরে রেখেই কারোকে
একা করে দাও, কী আর এমন
তফাত? মেয়েদের যোগ্য না
ভাবার সেই ট্র্যাডিশন
এখনো চলছে, জনাব! ১৯১৮
সালের ১৪ ডিসেম্বরের
আগে খোদ রানি
ভিক্টোরিয়ার
ভোটাধিকার ছিল না হে।
জার্মানির মতো উন্নত
দেশেও মেয়েরা
বিশ্ববিদ্যালয়ের
চৌকাঠ মাড়াতে পারত না
১৯০০ সালের আগেও
(ব্রিটেনে, ১৮৬৯ সালের
মে মাস থেকে) , না পেরে
নিজেকে তিলে তিলে ধ্বংস
করত। সেই সময় কুড়ি-একুশ
বছরের মেয়েদের মধ্যে
ভয়ংকরভাবে
হিস্টিরিয়ার প্রকোপ
দেখা যায় ! আমাদের দেশও
একটা মেট্রো সিটি নয়,
এখানে এখনো অনার কিলিং
চলে, আত্মজ-হত্যা
হাততালি কুড়োয়।
একটা মানুষের চাবি
হারিয়ে গেছে। তা, সে
চাবিটা খুঁজছে। বন্ধু
এসে বলল, কী খুঁজছ হে ? ---
আ রে আর বোলো না, আমার
চাবিটা গেছে হারিয়ে। ---
সে কী কথা! কোথায় হারাল ?
--- লোকটা দূরের একটা কোণ
দেখায়। তার বন্ধু তো
হাঁ --- তাহলে এখানে
খুঁজছ যে! খোঁজাখুঁজিতে
ব্যস্ত লোকটা উত্তর
দেয়, এইখানটায় আলো আছে
তো, এইখানেই খুঁজতে
সুবিধা।
৫
( এটা একজন মানুষের গল্প,
কখনো ফ্ল্যাশ-ব্যাকে,
কখনো
ফ্ল্যাশ-ফরোয়ার্ডে )
এক .
একা তিনি। একদম একা এক
মানুষ। নিজের সম্বন্ধে
হঠাৎ এই থমথমে রাত্রিতে
ভাবতে গিয়ে, এই কথাটাই
উঠে এল মনে। অন্য কোনো
মানুষ, কোনো একা মানুষ,
গভীর নিশুতি রাতে কী
করে? প্রশ্নটা উঠতে
নিজেই তার উত্তর দেন।
তাঁর উত্তরটা হল, তিনি
জানেন না। খুব বেশি
লোকের সঙ্গে তো তাঁর
কথা হয় না। কথা না হওয়ায়,
ভালো মন্দ কিছু মনেও হয়
না অবশ্য। কাজেই তাদের
হাল হদিশ জানা সম্ভব নয়
তার পক্ষেও। তিনি
তেমনভাবে মেলামেশা
করেন নি তো কখনো, কাজের
বাইরে কখনো সুযোগও
অবশ্য পান নি। সুযোগ
হয়েছে যদিও বা, কখনো
হয়তো এক আধবার তেমন
সুযোগ এসেছেও, তবে মতে
মেলে নি। সংকীর্ণতা
তিনি নিতে পারেন না,
কোনোদিন পারেননি। এই
'কোনোদিন' কথাটা খট করে
কেমন কানে লাগে তাঁর।
ভাবেন, কথাটায় কিছু ভুল
থেকে গেল, তাই শোধরাবার
একটা চেষ্টা করেন,
নিজের মনেই চেষ্টা
করেন। সংকীর্ণতা মেনেই
তো নিয়েছেন এখন, আজকাল।
এদিকে তাঁর ড্রাইভার
এসে চুপ করে ঘরের এক
কোণে দাঁড়িয়ে আছে, তাঁর
নিজের ঘরের এক কোণে।
তলব করেছিলেন তাকে।
অনেকদিনের সঙ্গী তো,
এখন কী করতে হবে, সমস্ত
সে জানে। বহুবার তাকে
করতে হয়েছে বলে সবকিছুই
তার জানা। কিছু বলেন না
তাই তাকে, চোখ তুলে একটা
হ্যাঁ দেন শুধু। তার
মৃত স্ত্রীর পোশাকগুলো
আলমারি থেকে বের করে
তার চোখের সামনে সাজিয়ে
রাখে সে। সাজিয়ে
রাখাটাই কাজ। সাজিয়ে
রেখে ঘরের এক কোণে তার
অনুপস্থিতি নিয়ে
অপেক্ষা করাটাই কাজ।
কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে
হবে তাকে, জানেন না
তিনিও। কতক্ষণ তিনি
তাকিয়ে থাকবেন তাও তো
জানেন না। যতক্ষণ না
তার চোখের জলের ধারায়
হুঁশ ফিরে আসে, হয়তো
ততক্ষণ।
দুই.
রাত ভোর হলেই ছেলেটা
চলে যাবে। তাঁর এক
বন্ধুর ছেলে। সঙ্গে
ছেলেটার এক বন্ধুও
এসেছে, সেও চলে যাবে
তাহলে । বাড়িটা খাঁ খাঁ
করবে। আরো দু'একদিন
থেকে গেলে কী এমন হতো,
বাড়ি তো ফাঁকাই পড়ে আছে,
থাকার তো কেউ নেই!
ছেলেটা হঠাৎ কালই চলে
যাবে ঠিক করেছে। ঘুম
আসছে না তার। ঘুম আসছে
না কেন? বিস্তর কাজ পড়ে
আছে তো কাল!
তিন.
বন্ধুর বাচ্চাটার
জন্য একটা দোল খাওয়া
কাঠের ঘোড়া কেনা যেতে
পারে। কিনলে খুব ভালো
হয় কিন্তু। সামনে থেকে
পিছন থেকে দেখলেন
প্রস্তাবটাকে, তাঁর
নিজের প্রস্তাবটাকে।
প্রস্তাব কেন, এটা তো
নিছক একটা ভাবনাই। এইসব
ভারী উকিলি লব্জ চলে
আসে আজকাল, এইসব
রাজনৈতিক ডিকশন চলে
আসে। নিজের অজান্তেই
তাঁকে দিয়ে বলিয়ে নেয়,
বুঝিয়ে নেয়।... ভাবছেন
তিনি, একবার নিজের দিক
থেকে, একবার বাচ্চাটার
দিক থেকে। মনে হল, দারুণ
হবে, দুজনের দিক থেকেই
মনে হল দারুণ একটা
ব্যাপার হবে । কারোকে
দিয়ে আনিয়ে নেবেন কি?
তিনি বললেই তো হুকুম
তামিল করার লোক হাজির।
বাতিল করলেন ভাবনাটা
তক্ষুনি। নিজেকে কিনতে
হবে। নিজে না দেখে
কিনলে কি হয়! কিন্তু
তাঁর যা পরিচয়, তাঁর যা
খ্যাতি, ভিড়ের মধ্যে
খেলনার দোকানে দাঁড়িয়ে
খেলনা খোঁজাটা কি তাঁকে
মানাবে! ভিড়ের মধ্যে
মিশে, ওই খেলনার
দোকানটায়? একবার গাড়ির
হ্যান্ডেলে হাত রাখছেন,
পরক্ষণেই হাত সরিয়ে
নিচ্ছেন। এক্ষুনি
তাঁকে ঘিরে একটা ভিড়
হয়ে যাবে না? আগের ভিড়ের
থেকে অন্য একটা ভিড়?
একটা নতুন ভিড়? তারপর,
আগের সেই পুরোনো ভিড়টাও
কি সেই নতুন ভিড়ে সামিল
হয়ে পড়বে না, তাঁকে
দেখামাত্র, তিনি কে,
বোঝামাত্র? ওই খেলনার
দোকানে ? এই
একমুহূর্তের ভাবনা,
ভাবতে আর কতটুকু সময় , এই
একমুহূর্তের ভাবনা
ঠেলে, হঠাৎ দরজা খুলে
রাস্তায় নেমে আসেন
তিনি। ওই তো কাঠের একটা
ঘোড়া হাওয়ায় কেমন
দুলছে!
চার.
পাঁচ বছর হল আর
কোর্টে যান না। সময়
কোথায় পাবেন এই তুমুল
ব্যস্ততায়! কিন্তু
আগ্রায় একটা নিরীহ ছেলে
ঘুষ দেয়নি বলে পুলিশ আর
মিলিটারি যোগসাজশ করে
মিথ্যে মামলা দিয়েছে।
ছেলেটার বাবা নাকি
আগ্রার এক নাম করা
ব্যবসায়ী। এখন কী করা
উচিত তাঁর? এটা ১৯৪২
সাল। তাঁর একরকমের একটা
পরিচয় তৈরি হয়ে তাকে পথ
আটকাচ্ছে ইতিমধ্যে ,
সেই তাঁর বিশেষ
পরিচয়টা, উগ্র
হিন্দুবিদ্বেষীর
পরিচয়টা। কী করেন! তাঁর
এক বন্ধুপুত্র বসন্ত
কৃপালনী তাঁকে খুব করে
ধরেছে এই মিথ্যে মামলা
থেকে ছেলেটাকে বের করে
আনার জন্য। অনেক
সাতপাঁচ ভেবে আগ্রায়
গেলেন তিনি, শেষে চলেই
গেলেন। এই ৪২-এর গনগনে
আঁচের মধ্যেও গেলেন
সেখানে। যাক, তাতে
নিরীহ ছেলেটাকে তো
বাঁচানো গেল!
পাঁচ.
ব্যারিস্টার হয়েছেন
সদ্য। মনে একটা ইচ্ছে
পুষে রেখেছেন অনেকদিন
ধরে। ইচ্ছে কেন,
স্বপ্নই বলা যায়।
"গ্র্যান্ড ওল্ড
ম্যান" দাদাভাই
নৌরজীর মতো একজন নামী
পার্লামেন্টারিয়ান
হবেন। কী যে বাগ্মী ওই
বুড়োমানুষটা! আহা,
ব্রিটিশ পার্লামেন্ট
ভবনে আইরিশ হোমরুল আর
নারীমুক্তি নিয়ে বলতে
উঠে যেন ঝড় তুলে দিলেন
সে'বার । শ্রোতা হয়ে,
মন্ত্রমুগ্ধ একজন
শ্রোতা হয়ে, শুধু শুনে
যেতে হয় তাঁকে ! পড়াশোনা
দিয়ে কি হয় এসব, তিনি তো
ঘণ্টার পর ঘণ্টা
ব্রিটিশ মিউজিয়ামের
লাইব্রেরিতে পড়ে থাকেন,
তিনিও একদিন তবে কি
বলতে পারবেন ওইরকম
ভাবে, ওইরকম নির্ভীক
দৃপ্ত ভঙ্গিতে!
রবিবারে হাইড পার্কে
গিয়েও নানা বিচিত্র
বিষয়ে নানান মানুষের
বক্তৃতা শোনেন, কল্পনা
করেন তিনিও একদিন
বলবেন, ওইভাবে, ঝরঝরে
ইংরেজিতে বলবেন।
নিজেকে বোঝালেন, আসলে
একটা ফুলকি ধরিয়ে দিতে
হয় জ্ঞানের রাজ্যে,
যাবতীয় তথ্যের গুদামে।
নইলে স্যাঁৎসেঁতে
বারুদে কোনো কাজ হয় না
কি! নিজের সঙ্গে, নিজের
সঙ্গে, নিজের সঙ্গে,
কথোপকথন তাঁর চলতেই
থাকে। সেই একা
মানুষের।
ছয়.
কলকাতা। ৮
ফেব্রুয়ারি, ১৯১০।
গোখলের প্রেস বিলের
সংশোধনী প্রস্তাব আনা
হচ্ছে। সেই গোখলে,
যাঁকে মন থেকে তাঁর
রাজনৈতিক গুরু হিসেবে
বরণ করে নিয়েছেন আগেই।
বড়লাটের কাউন্সিলের
সদস্য হিসাবে বলতে
উঠলেন তিনি :
--- 'মাই লর্ড, আজ আমি এমন
একটি বিষয় নিয়ে কথা
বলতে চাই, যা অত্যন্ত
বেদনাজনক। যা আমাদের
দেশের সর্বস্তরের
মানুষকে উত্তাল করে
তুলেছে, তাদের ঘৃণা ও
আতঙ্ককে চূড়ায় তুলে
নিয়ে গেছে। বিষয়টি,
দক্ষিণ আফ্রিকার
ভারতবাসীদের প্রতি
অত্যন্ত রূঢ় ও নিষ্ঠুর
আচরণ ঘিরে।'
--- বড়লাট লর্ড মিন্টো :...
"আমার মতে 'নিষ্ঠুরতা'
শব্দটি অত্যন্ত
কঠোর..."
--- "মাই লর্ড, আমার আরও
কঠোর শব্দ প্রয়োগের
ইচ্ছা ছিল। কিন্তু আমি
এই কাউন্সিলের বিধান
ভঙ্গ করতে চাই না...। "
সাত.
তাঁকে নিয়ে একটা বই
লিখেছেন সরোজিনী নাইডু
---' অ্যাম্বাসাডর অব
ইউনিটি'। সেই বইতে তাঁর
মুসলিম লিগের সদস্য
হবার ভিতরের কথাটাও
লিখে দিয়েছেন, '... তাঁর
নাম সুপারিশকারী
দু'জনকে এক আগাম পবিত্র
প্রতিশ্রুতি দিতে
হয়েছিল যে, তাঁর মুসলিম
লিগের ও মুসলিম
স্বার্থের প্রতি
আনুগত্য কোনোভাবেই বা
কোনো সময়েই, যে বৃহত্তর
জাতীয় স্বার্থের জন্য
তাঁর জীবনকে বাজি
রেখেছেন তিনি, তার
বিন্দুমাত্র বাধা হয়ে
দাঁড়াবে না।'
আট.
মে মাসের ২১ তারিখ।
সালটা, ১৯১৩। একটা চিঠি
লিখতে বসেছেন। চিঠিটি
যাবে মুসলিম লিগের
সম্পাদক সৈয়দ ওয়াজির
হাসানের কাছে। সব দিক
একটু ভেবে নিলেন তিনি।
বিষয়টি শুধু যে জটিল
তাই তো নয় --- এই যুদ্ধে
তিনি তো একা, ভীষণভাবে
একা। একেবারে একা হয়তো
নয়, কেউ কেউ কি আর তার
পাশে নেই! ভাবনার একটা
গোছ তৈরি হতেই লিখলেন :
হিন্দু-মুসলমান ঐক্য
প্রতিষ্ঠার জন্য উভয়
সম্প্রদায়ের নেতাদের
একটি সম্মেলন আহ্বান
করা দরকার এবং হিন্দু ও
মুসলমানদের জন্য আলাদা
আলাদা ইশকুলের বদলে একই
ইশকুলে আলাদা আলাদা
বিভাগ চালু হওয়া দরকার ;
দুটো সম্প্রদায়ের
ছাত্রদের মধ্যে
পরস্পরের সঙ্গে যত
যোগাযোগ বাড়ে ততই
বন্ধুত্বও বাড়বে।'
নয়.
মুসলিম লিগের সভাপতি
নির্বাচিত হয়েছেন
সদ্য। এখন, এই মুহূর্তে,
তাঁকে একটা বক্তৃতার
খসড়া তৈরি করতে হচ্ছে।
যে উদ্যেশ্য নিয়ে
কংগ্রেস এবং মুসলিম
লিগে তিনি একই সঙ্গে
যুক্ত, প্রথমেই সেটা
পরিষ্কার করে দেওয়া
দরকার, সেই বড়ো
লক্ষ্যটাকে,
জাতীয়তাবাদের সেই বড়ো
লক্ষ্যটাকে। তিনি চান
না কোনোরকম অস্বচ্ছতার
সুযোগ নিক গোঁড়া
মুসলমানরা, কিংবা অন্য
কেউই । তিনি লিখেছেন
তাই, "হিন্দুদের প্রতি
আমার মনোভাব হবে
শুভেচ্ছার, মনোভাব হবে
ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের
মতো। আমাদের নীতি হবে
দেশের স্বার্থে তাদের
সঙ্গে সহযোগিতা। দুই
ভ্রাতৃপ্রতিম মহৎ
সম্প্রদায়ের ভিতর
ঠিকমতো বোঝাপড়া এবং
হৃদয়ের সম্বন্ধ তৈরি
হলে তখনই কেবল
ভারতবর্ষের যথার্থ
প্রগতি সম্ভবপর
হবে।"
দশ.
মন্টেগু-চেমসফোর্ড
শাসন সংস্কারের
প্রস্তাবে সাক্ষ্য
দিচ্ছেন তিনি :
--- আপনি বললেন যে আপনি
ভারতবর্ষের দৃষ্টিকোণ
থেকে বলছেন। আপনি কি
তবে ভারতীয়
জাতীয়তাবাদী হিসেবে
বলছেন?
--- আজ্ঞে হ্যাঁ।
--- অর্থাৎ আপনার বক্তব্য
হল রাজনৈতিক জীবনে
যথাসম্ভব শীঘ্র
মুসলমান ও হিন্দুদের
মধ্যে পার্থক্য করা
বন্ধ হোক --- এই তো চান
আপনি ?
--- আজ্ঞে হ্যাঁ। আমার
কাছে ওই শুভ দিনটির
থেকে আরও বেশি আনন্দের
কিছু হতে পারে না।
এগারো.
এইভাবেই তাঁকে বলে
যেতে হবে, সামান্য
সুযোগ থাকলেই বলে যেতে
হবে এই
ভ্রাতৃত্ব্ববোধের কথা,
মিলনের কথা, তাঁর
লক্ষ্যের কথা,
জাতীয়তাবাদের কথা।
একটি বক্তৃতায় যেমন
বললেনও, 'যেদিন হিন্দু ও
মুসলমান মিলিত হবে,
সেইদিনই ভারতবর্ষ
ঔপনিবেশিক
স্বায়ত্তশাসন পাবে।' ----
'মহাত্মাজী'
হিন্দু-মুসলমান
সেতুবন্ধনে তাঁর
ঐকান্তিক প্রয়াসের কথা
বড়ো করে লিখেছেন! এই
নিয়ে ইয়াং ইন্ডিয়াতে
'মহাত্মাজী'র একটা
অসাধারণ প্রবন্ধ
বেরিয়েছে। তারিখটা ২৯
মে, ১৯২০। তাঁর
রাজনৈতিক গুরু
গোখলেজীও তাঁর
সম্পর্কে লিখেছেন, "
তাঁর ভিতর সাচ্চা বস্তু
আছে আর আছে তাবৎ
সাম্প্রদায়িক পক্ষপাত
ও গোঁড়ামি থেকে মুক্ত
সেই মানসিকতা, যার জন্য
তিনি হিন্দু-মুসলমান
ঐক্যের সর্বশ্রেষ্ঠ
রাজদূত হতে পারেন।" ----
তাঁর একা একা লড়াইটা
বৃথা যায় নি তাহলে। কেউ
কেউ লক্ষ করছেন সেটা,
এতদিনে লক্ষ করেছেন।
কেউ কেউ কাগজে
লিখেছেনও।
বারো.
হায়! যে স্বপ্ন
দেখেছিলেন, তা তো আর সফল
হবার নয়! মহাত্মাজীর
অসহযোগ আন্দোলনে তাঁর
ভরসা নেই ঠিকই, কারণ
তাঁর বিশ্বাস,
রাজনৈতিকভাবে
মোকাবিলা করা যেত এটা,
আরও ভালোভাবেই
মোকাবিলা করা যেত। তাই
নীতির প্রশ্নে তাঁকে
কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে
আসতে হয়েছে। নীতি, দুটো
মানুষের দু'রকম হলে কী
আর করা যায়! কাকে তুমি
বোঝাবে! তাই বলে কি
একজনের প্রতি অন্যের
শ্রদ্ধা নষ্ট হয়ে যায়!
তিনি খবর পেয়েছেন
মহাত্মাজীর অহিংস
সত্যাগ্রহ, বন্দুকের
মুখে রুখে দেওয়া হবে।
এখনি তাঁকে জানানো
দরকার। বরদোলিতে তাঁর
শিবিরে যাওয়া দরকার
এক্ষুনি। তিনি যাবেন,
তিনি নিজেই যাবেন।
তেরো.
১৯৩৭ সাল। এক একাকিত্ব
থেকে আর এক একাকিত্বে
চলেছেন তিনি। কোনো
কিছুই হল না শেষ
পর্যন্ত। নির্বাচনের
আগে কথা ছিল কংগ্রেস আর
লিগ কাঁধে কাঁধ দিয়ে
লড়বে। হলও তাই। কথা ছিল
ক্ষমতায় এলে লিগকে
মন্ত্রীসভায় উপযুক্ত
জায়গা দেওয়া হবে।
নেহেরুজী মানলেন না সেই
প্রতিশ্রুতি। লিগের
ভিতরে যাদের সঙ্গে লড়াই
করে এসেছেন এতদিন , তারা
মস্ত সুযোগ পেয়ে গেল
এইবার। একবার ভাবলেন,
তাঁর সঙ্গে প্রতারণা
করা হল। অবশ্য আরো একটা
কথা মাথায় রাখা দরকার।
১৯৩২ সালে বৃটিশ
প্রধানমন্ত্রী মেনে
নেননি যৌথ নির্বাচন
পদ্ধতি, বাঙালি
হিন্দুদের ওয়েটেজ তুলে
দেন তিনি। তাদের
আসনসংখ্যা কমিয়ে দেন।
বাঙালি হিন্দুরা
ওয়েটেজও হারাল, যৌথ
নির্বাচনও পেলনা। তবু
নেহেরুজী কি
উত্তরপ্রদেশের সরকার
গঠনে ঠিক সিদ্ধান্ত
নিলেন, তিনি ভাবেন!
অন্যায়ভাবে বঞ্চিত
করলেন না লিগকে? তিনি তো
চেয়েছিলেন মহাত্মাজী
মধ্যস্থতা করুন। গোপনে
তাঁর আশ্রমে দূতও
পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু
তার হাত দিয়ে যে ছোটো
চিঠিটা মাহাত্মাজী
পাঠিয়েছেন , তাতে মনে হল
তিনি হাল ছেড়েই
দিয়েছেন। কখনো তাঁকে
এত অসহায় মনে হয় নি আর।
তবে তাঁর হাতেও বোধহয়
নেই সবটুকু। (তাঁর
অনুমান সত্যি প্রমাণিত
করে, নেহেরুজী সম্পর্কে
নেহেরুজীর অন্তরঙ্গ
সঙ্গী মৌলানা আজাদ India Wins
Freedom বইটিতে পরে লিখবেন,
"উত্তর প্রদেশের
লিগের সহযোগিতার
প্রস্তাব যদি গ্রহণ করা
হত, তাহলে কার্যত
মুসলিম লিগ কংগ্রেসের
সঙ্গে এক হয়ে যেত।
জহরলালের কাজের ফলে লিগ
যেন নবজীবন পেল।" বইটি
মৌলানা আজাদ তাঁর
"বন্ধু ও সাথী"
জহরলালকেই উৎসর্গ
করেন। নেহেরুজী কখনো
আজাদজীর এই গুরুতর
ঐতিহাসিক উক্তির
প্রকাশ্য বিরোধিতা
করেছিলেন বলে শোনা
যায়নি ।)
চোদ্দ.
তাহলে তাঁর সামনে কোন
পথটা খোলা এখন? সেটা কি
আদৌ কোনো পথ! ১৯১৬ সালে,
যৌথ নির্বাচনের
সিদ্ধান্তের পিছনে
তিনি অক্লান্তভাবে
লেগে ছিলেন। এতদিন আগা
খাঁ-দের প্রতিহত করে
এসেছেন জোর গলায়। বলে
এসেছেন, আগে তিনি
ভারতবাসী, তারপরে
মুসলমান। এবার তাহলে
কি আরেকটা লড়াই? নিজের
কথাই, নিজের বিশ্বাসই
গিলে ফেলার আরও একটা
লড়াই! এ'কথা ভাবতেই
চোয়াল শক্ত হয়ে গেল
তাঁর। কংগ্রেসকেও
বুঝতে হবে তাঁকে
গুরুত্ব দেওয়া কত
প্রয়োজন ছিল।
মহাত্মাজীর পাঠানো
ছোটো চিঠিটার উত্তর
দেবার কথা ভেবে সেটা
কাগজে প্রকাশ করে
দিয়েছিলেন। এতে খুবই
ব্যথিত মহাত্মাজী। এই
বিষয়ে চিঠিতে কথাও
হয়েছে, তবে ওই
পর্যন্তই। দুঃখ প্রকাশ
করেছিলেন তাঁর কাছে
কিন্তু তিনি মেনে
নেননি। তাঁর হাতেও
এদিকে খেলার তাস ফুরিয়ে
আসছে।
পনেরো.
কলকাতায় লিগের সভায়
১৯৩৮-এর এপ্রিলে, শেষে
যুদ্ধ ঘোষণাই করে দিলেন
তিনি: "কংগ্রেস
প্রধানত হিন্দু
প্রতিষ্ঠান।
মুসলমানরা একাধিক বার
একথা স্পষ্ট করে বলেছে
যে, ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা
ও ব্যক্তিগত আইন ছাড়াও
তাদের অন্য একটি সমান
গুরুত্বপূর্ণ
জীবন-মরণের প্রশ্ন আছে।
সেটা হল এই যে, তাদের
ভবিষ্যৎ ও ভাগ্য ---
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে
অধিকার, জাতীয় জীবন,
সরকার ও প্রশাসনে
উপযুক্ত অংশ পাবার ওপর
নির্ভর করছে।"
পাঠক, 'তিনি' মানুষটা
যে কে, সবাই জানেন।
প্রবল জাতীয়তাবাদের
সেই সৈনিক, একজন সৎ ও
অসাধারণ রাজনৈতিক নেতা
--- একদিন
দ্বিজাতিতত্ত্ব তুলে
ধরলেন। ১৯৪০ সালে
লাহোরে এর সমর্থনে
বক্তৃতা করলেন, ' জাতি
(nation) শব্দের যেকোনো
পরিভাষা অনুযায়ী
মুসলমানরা একটি জাতি
এবং তাদের নিজস্ব
বাসভূমি, এলাকা এবং
রাষ্ট্র চাই।' শেষে
আলাদা রাষ্ট্রের দাবি
তুললেন তিনি, পেলেনও।
১৫ অগাস্ট, ১৯৪৭।
গান্ধিজীর অনশন,
কংগ্রেসের উৎসব,
মুসলিম লিগের ধুমধাম ও
তাঁর একাকিত্ব একই দিনে
আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে
গেল। --- পুলকের উলটো
পিঠেই তো বিষাদ!
প্রেমের উলটো দিকেই তো
ঘৃণা! মানুষের কি কোনো
সুস্থির অন্তর্লোক আছে,
থাকে? নীতি থাকে হয়তো ,
মানুষের নীতি থাকে, আর
সেই নীতিমালার বইয়ের
পাতাগুলো যদি ঝড়ে ভেসে
যায়, হঠাৎ যদি কোনো ঝড়ে
ভেসে যায়! --- এর চারদিন
আগের ঘটনা। ১১ অগাস্ট।
পাকিস্তান গণপরিষদের
সদস্যদের সামনে তাঁর
প্রথম বক্তৃতা ছিল
এইরকম : "আপনাদের ধর্ম
জাতি ও সম্প্রদায়, যা-ই
হোক না কেন, তার সঙ্গে এই
মূল নীতিটার কোনো
সম্পর্ক নেই যে আমরা
একই রাষ্ট্রের
অধিবাসী। আমার মতে এই
নীতিকে আমাদের আদর্শ
হিসাবে সবসময় জাগিয়ে
রাখা কর্তব্য। তাহলে
আপনারা দেখবেন যে একদিন
হিন্দুরা আর হিন্দু এবং
মুসলমানরা আর মুসলমান
থাকবে না ---
ধর্মবিশ্বাসের দিক
থেকে নয়, কারণ সেটা হল
প্রত্যেক মানুষের
ব্যক্তিগত বিশ্বাসের
প্রশ্ন --- এ হল রাজনৈতিক
অর্থে, রাষ্ট্রের
নাগরিক হিসাবে।"
খেলার ছলে, জেদের বশে,
ক্রোধ আর অভিমান থেকে
একটা দেশ তৈরি করা আর
সেই দেশের বাধাহীন
ধর্মীয় আবেগের সঙ্গে
পাল্লা দেওয়া কি তাঁর
পক্ষে খুব সহজ ছিল? তাঁর
আসল ক্ষমতা তো চলে
গিয়েছিল
প্রধানমন্ত্রী লিয়াকৎ
আলি খানের কাছে। তিনি
ডামি হয়ে থাকলেন। তাঁকে
পাঠিয়ে দেওয়া হয়
কোয়েটার কাছে এক
স্বাস্থ্যকর স্থানে
তাঁর চিকিৎসকের
হেফাজতে। তিনি নাকি
তাঁকে বলেন, পার্টিশন
হচ্ছে তাঁর জীবনের
বৃহত্তম ভুল।সেখান
থেকে যখন তাঁকে করাচিতে
ফিরিয়ে আনা হয় তখন
তাঁকে অভ্যর্থনা করতে
কেউ বিমানবন্দরে
আসেননি। মাটিতে শুইয়ে
রাখা হয় তাঁকে। তাঁর
দেহের ওপর পিঁপড়েরা
ঘুরে বেড়ায়। লক্ষ করেন
শুধু এক বাঙালি মুসলমান
বিমানবন্দর কর্মী,
অদৃষ্টের কী পরিহাস!
মিনিট দশেক পরে তাঁর
মন্ত্রীরা আসেন ও তাঁকে
সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
করাচিতে জন্মেছিলেন,
করাচিতেই মৃত্যু হল
তাঁর । কিন্তু ভারতীয়
হিসাবে নয়, পাকিস্তানি
হিসাবে। মৃত্যুশয্যায়
কে একজন স্তাবক তাঁকে
স্তোক দেন, " কায়দে আজম,
আপনি অনেক দিন
বাঁচবেন।" তিনি
উষ্মার সুরে বলেন,
"না" --- হয়তো আর
বাঁচার ইচ্ছা ছিল না
তাঁর। তিনি
যে-প্রত্যয়ে এসে
পৌঁছেছিলেন সেটা
নিশ্চয়ই অসত্য,
বিভ্রমজাত। সাত আটশো
বছর এক সঙ্গে বসবাসের
ইতিহাসে এমন মহামারির
নজির আর একটাও নেই। যত
দোষ নন্দ ঘোষ ইংরেজও এর
জন্য পুরোটা দায়ী, সে
কথা বলা যায় না।
ইতিহাসে তাঁকে যেভাবে
মনে রেখেছে, তার পিছনে
তাঁর দায় বরং অনেকটাই।
তবে সবটুকু নয়, এ'কথা
বলাই যায়। বিষবৃক্ষের
চারা কে বসায়, কে যে তাতে
জল দেয়, আর কে তার ফল
পেড়ে নেয়, সে তো এক বিরাট
গবেষণার ব্যাপার, সে তো
এক বিশাল উপন্যাসের
পটভূমি!
৬
আজ আর কাল তো সমান নয়!
সমান হতেও পারে, কখনো
সমান হতেও পারে, আজকের
ছায়া কালকের গায়ে একবার
ঢলে পড়তেও পারে, ঢলে
পড়তেই পারে, আজকের আগুন
কালকের পাটের গুদামে
একবার ঘুরে আসতেও পারে,
ঘুরে আসতেই পারে। পারে
যেমন, আবার নাও তো পারে ---
আজ আর কাল কি সমান? তাই
যদি হত, ১৯৩৭ সালের আগে
আর পরের সময়টা যদি একই
বলে ধরে নেওয়া যেত, ১৯৪৭
সালের আগের আর পরের
সময়টা যদি একই বলে মেনে
নেওয়া হত, তাহলে তো এই
লেখাটা আর লিখতেই হয় না,
এই পর্বটাই বাতিল হয়ে
যায়। লেখার কথা ভাবাই
যায় না আর, কখনো ভাবাই
যায় না। তবু লিখতে তো
হল। একটা মরমিয়া গান
আছে জানো, মহরমের গান ---
হিন্দু মুসলমান ভাইয়া,
জোরহুঁ রে পীরিতিয়া রে
ভাই, / হায় রে হায় --- ওগো
হিন্দু মুসলমান
ভাইয়েরা, প্রীতির
বাঁধনে বাঁধো রে ভাই
নিজেদের , হায়রে হায়।
মহরমের এই গান যেন
আমাদের গোটা জীবনটাকে
বেড় দিয়ে আছে। পরিতাপের
সেই গান। দুঃখই তো সমাজ!
শুরুতে ভেদাভেদ
থাকবেই, তা কিন্তু নয়।
শুরুতে হয়তো গলায় গলায়
খুব ভাবই থাকল, যেন
সুন্দ-উপসুন্দ দুই ভাই।
আমাদের দেশের কথাই ভাবো
না! শুরুর দিকের
ইতিহাসে, বিংশ শতকের
তিনের দশক অবধি অন্তত,
বিভেদের থেকে ঐক্যই তো
বেশি ছিল। কী করে যে
বিচ্ছিন্নতার দখলে চলে
গেল গোটা দেশটাই, কার
স্বার্থে যে গেল,
দেশভর্তি অসাধারণ সব
চরিত্ররা কীভাবে কোথায়
তলিয়ে গেলেন, যেন এক
একজন নিশ্চুপ ভীষ্ম বা
দ্রোণাচার্য! কত
লড়াইয়ের পর শ্বাস নেবার
একটা জায়গা তৈরি হয়েছিল
সবে, সঙ্ঘের একটা
মর্যাদা গড়ে উঠছিল। কত
কঠিন একটা লড়াই আর কী
বেদনাময় তার পরিণাম।
ভারতীয় মুসলমানদের
শিকড় যে ভারতে ---
পাকিস্তানে নয়, আরবে নয়,
ইরানে নয়, মধ্য এশিয়ায়
নয়, এটা উপলব্ধি করতে
পারলেন না কেউ! নাকি
জেগে ঘুমোনোর দরকার হয়ে
পড়েছিল কারো কারোর?
রাষ্ট্র তো একটা
যন্ত্র!
রাষ্ট্রযন্ত্র।
রাষ্ট্রের চোখে শৈশবও
নেই, বার্ধক্যও নেই,
মানুষের প্রতি যে
বিশ্বাস, মানুষের
সঙ্গে যে বোঝাপড়া, সেটা
সে কবেই পেরিয়ে এসেছে,
সেটা পেরিয়ে এসে তবেই,
একটা রাষ্ট্র শেষে
রাষ্ট্র হয়ে ওঠে।
রাষ্ট্রের কোনো স্বচ্ছ
চোখও নেই। রাষ্ট্র,
ধৃতরাষ্ট্র।
শুধুমাত্র সঞ্জয়ের
কমেন্ট্রি তার ভরসা।
সেই রাষ্ট্রযন্ত্রের
কাছে প্রতিষ্ঠানের
একটা দারুণ গুরুত্ব।
আর তার ফলেই অনেকগুলো
খুপরি, অনেক অনেক
খোঁয়াড়, কোনোটা
যোগনিদ্রাময় অফিস তো
কোনোটা পাগলাগারদ (নাকি
সংশোধনাগার), কোনোটা
লেবার লাইন তো কোনোটা
মধুচক্র । সবারই খুব
বজ্র আঁটুনি, সবারই খুব
সাজো সাজো রব, সবারই খুব
ব্যস্ততা, এইটা করতে
হবে, ওইটা করা যাবে না,
এইদিক দিয়ে ঢুকবে, এই
অবধি ছোঁবে। সবারই খুব
মাপাজোকা কাজ --- সংযম
বলো সংযম, হিসেব বলো
হিসেব। সবারই দুটি
লাইনের মধ্যে একটি
অপ্রকাশিত সুতীব্র
লাইন, সবারই
দিগন্তবিস্তৃত ছলনা
এবং গোপন এজেন্ডা।---
উত্তর প্রদেশের সরকার
গঠনে মুসলমান
প্রতিনিধিত্ব
অস্বীকার করা হয়েছে,এই
কথাটা ছাড়াও আরও একটি
অভিযোগ কংগ্রেসের
বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল ---
"কংগ্রেস প্রধানত
হিন্দু প্রতিষ্ঠান!"
কী আশ্চর্য, আজ তো সেই
বিশেষণ অন্য দলের গয়না!
ধর্মের পালে হাওয়া দিয়ে
গোপনে নিজেদের
উদ্দেশ্য হাসিল করার
লোক সব যুগেই
'অ্যাভেলেবল' --- ওই যে
হোয়াটসঅ্যাপে আমরা
স্টেটাস দিই না, তেমন !
ভীম যুধিষ্ঠিরকে
অনুনয় করছেন, পালিয়ে
বেড়াব কেন, আপনি অনুমতি
দিলে মাঠে লড়ে যাই। যদি
প্রাণ যায়, সে ভি আচ্ছা।
ক্ষত্রিয় যদি যুদ্ধ
করতে করতে মরেও যায়, সে
তো যাবে স্বর্গে!
আশ্চর্য! যা তুমি দেখনি,
যে অনুভব তোমার অচেনা,
শুধু সেখানে পাড়ি দেওয়া
সম্ভব হবে বলে, যা তুমি
দেখেছ, যা তুমি পেয়েছ, না
পেলেও চেষ্টা করলে,
রুখে দাঁড়ালে পেতে পার
একদিন --- সেই সম্ভাবনা
নষ্ট করে দেবে!
যুধিষ্ঠির তো অপেক্ষা
করছিলেন মাত্র, তিনি তো
মুলতবি রাখেননি!
স্বর্গারোহণের এই
টোপটি না ঝুলিয়ে দিলে
কেউ কি কখনো মানববোমার
সন্ধান পেত! ধর্মযুদ্ধে
মানুষ সরাসরি স্বর্গে
যায়, স্বর্গ লাভ করে,
জান্নত লাভ করে, এ'কথা
সবাই জানে, সবাই জেনে
গেছে, সবাইকে জানানো
হয়েছে, না জানালেও জেনে
গেছে সবাই, না জানলেও
শিগ্ গির জেনে যাবে ---
বিশ্বাস আর অন্ধতা তো
নদীর স্রোতের মতো
আবেগে চলে। এখানেও তাই,
ওখানেও তাই।
হিন্দুরাজত্বের
পাণ্ডাদের কাছেও তাই আর
আই এস আই এস-এর
পাণ্ডাদের কাছেও তাই।
অত দূরেই বা যেতে হবে
কেন --- ধর্ম কি ভেবেছ
শুধু হিন্দুর সঙ্গে
মুসলমানদের দূরত্ব
তৈরি করে? এক বর্ণের
মানুষের সঙ্গে অন্য
বর্ণের মানুষের বিভেদ
তৈরি করে দেয় না!শ্রী
মদ্ভাগবত কী বলছেন শোনো
---
বিরাট পুরুষের মুখ
থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু
থেকে ক্ষত্রিয়, ঊরু
থেকে বৈশ্য, পা থেকে
শূদ্র জন্ম নিয়েছে। এখন
আর পায় কে, শুরু হয়ে গেল
একের থেকে অন্যের একা
হয়ে যাওয়া! আজও কি তুমি
বর্ণে বর্ণে
ভেদাভেদহীন একটা
ভারতের কল্পনা করতে
পারো! এই প্রশ্ন করা কি
অসঙ্গত হবে , যে ভীম যখন
লাক্ষাগৃহে আগুন ধরিয়ে
দিলেন, তখন যে ভিল মা
ভিতরে তার পাঁচ ছেলে
নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন,
তাদের জাগিয়ে সেখান
থেকে বাইরে আনা হল না
কেন! উলটে, তারাও তো
কৌরবদের সঙ্গে
পাণ্ডবদের লুকোচুরি
খেলায় পাশার দান হয়ে
গেল! বড়ো আশা করে
আম্বেদকর লিখেছিলেন
Annihilation of caste --- তাঁর স্বপ্ন
ছিল একদিন হয়তো জাতপাত
শিকেয় তুলে মানুষ তার
অন্ধকার গুহা থেকে
বেরিয়ে আসবে! শেষে
তাঁকেই গুহাবাসী হতে
হয়। বৌদ্ধধর্মে আশ্রয়
নেন তিনি!
শেষ পর্যন্ত কিছু
কাঠামো, হিংস্র দাঁতওলা
অন্ধ যন্ত্রগুলোই
আমাদের দায়দায়িত্ব
তুলে নেয়। তোমাকে তার
মধ্যে মানিয়ে নিতে হবে।
ভালোর জন্য মানালে ভালো
কথা, অমানবিকতার মাপেও
মানিয়ে নিতে হবে,
যেভাবে ট্রেনে দূরে
যাবার সময় আমরা দক্ষতা
দেখাই, ঠিক সেই দক্ষতায়
মানিয়ে নিতে হবে।
ধর্মযুদ্ধ, বর্ণযুদ্ধ,
আরো নানান যুদ্ধে
মানিয়ে নিতে হবে,
স্পিক-টি নট হয়ে মানিয়ে
নিতে হবে। না হলেই
তোমার ঘুড়িটা ভো-কাট্টা
হয়ে যাবে, হয়ে যেতে পারে,
যাওয়ার সম্ভাবনা।
একটা তিন বছরের
বাচ্চা কার্পেট বোমায়
মারা যেতে যেতে বলছে,
ওপরে গিয়ে ভগবানকে স ব
আমি বলে দেব। ভগবান
তখনও মরে যায় নি তার
কাছে, সে মরে ভগবানের
কাছে যাচ্ছে। অতটুকু
বাচ্চা তো, ভগবানে খুব
ভক্তি, তখনও খুব ভক্তি।
'নমো করো তো বাবা
ঠাকুরকে, নইলে ঠাকুর
পাপ দেবে' --- তার বাবা মা
ওই বাচ্চাকে বা তার আর
কোনো পড়শি বাচ্চাকে
এ'কথা বলেছিল কি বলেনি
জানা নেই, বলবেই বা কেমন
করে, তারা তো অন্য দেশের
অন্য ভাষার লোক --- তারা
হয়তো বলেছে, বাবা গো,
সোনা আমার, কাঠকুটো জড়ো
করে খেলনা বন্দুক গড়ে
অমন রাস্তায় রাস্তায়
ছুটে বেড়াস নে বাপধন,
মাঠে খেলতে যাস নে, মাঠে
তোদের খেলা বারণ,
বাঙ্কারে ঢোক বাবা, কখন
কী হয়, কখন আকাশ থেকে
একটা বোমা এসে পড়ে, কখন
বুকে একটা গুলি বিঁধে
যায়!
একাকিত্বের আর
বিচ্ছিন্নতার
মুখোমুখি মানবিকতাই
হোক আগামীর একমাত্র
সংবিধান।
৭
একা থাকার কত যে দিগ্
বিদিক! সে তো আর
একটুখানি ভুবন নয় গো, যে
বলে বলে শেষ করা যাবে
কোনোদিন , লিখে শেষ করা
যাবে --- কত কত কত কত
মানবজন্ম ধরে মানুষ এই
একা থাকার মধ্যে
ঢুকেছে, ঢুকে পড়েছে, এখন
কি আর টুকরো কথায় তার
বাঁধ দেওয়া যায়, নাকি
'বাইরে আয়' বলে ডাক দিলেই
গুহার ভিতর থেকে সে
বাধ্য ছেলের মতো বেরিয়ে
আসবে ! কাকে ডাক দেবে,
কোন একা-থাকাটাকে?
স্বেচ্ছায় হোক বা
অনিচ্ছায়, ঘৃণায় হোক বা
প্রেমে --- একা থাকার, একা
হয়ে থাকার, একা হয়ে
যাবার কোনো ঠিকঠিকানা
আছে ! এ-তো বাঁধভাঙা
বেনো জল, হুড়মুড়িয়ে
ঢুকে পড়লেই হল, ঘুমের
মধ্যে ঢুকে পড়লেই হল,
কামের মধ্যে ঢুকে পড়লেই
হল। ঢুকে, মাঝরাত্তিরে
ভাসিয়ে নিয়ে গেল হয়তো ,
সাতসকালে ফলন্ত জমিতে
গুচ্ছের বালি ঢেলে দিয়ে
গেল, ঢুকে, কোন আনমনে
মিষ্টি জলের পুকুরে
নোনা জল ফেলে রেখে
অদৃশ্য হল, ঢুকে,
কচুকাটা করে রেখে দিয়ে
গেল মানুষগুলোকে, ঢুকে,
লুটপাট বা ধর্ষণ করে
গেল অধিকৃত ভূখণ্ডের
পরাধীন নারীদের --- কত আর
বলবে তুমি? কোন দিক নিয়ে
বলবে?
কোন জানলাটা খুলছ,
তার ওপরেই তো দৃশ্য।
কোন একা-থাকার জানলাটা
খুলছ, তার ওপরেই তোমার
দেখাশোনা, তোমার
অভিজ্ঞতা। যদি পুব
দিকেরটা খুলে থাকো,
দৈবাৎ খুলে যায়, তবে
সূর্যোদয়, যদি
উত্তরেরটা খুলে থাকো,
দৈবাৎ খুলে যায়, তবে
পাহাড়, পাহাড় থেকে নদী ---
দিক্ তো আর একটা-দুটো
নয়, দশ-দশটা! নদীও তো আর
একদিকে ঢলে নেই, কোনোটা
পুবমুখো তো কোনোটা
পশ্চিম। কোনো কিছুই
সীমার মধ্যে থাকে না,
কোনো সীমাকেই নিজের বশে
রাখা যায় না,
গ্রামবাড়ির পিছনের
বাঁশঝাড়ের মতোই চুপচাপ
ছড়িয়ে যায়, সীমানা
ভাঙতে ভাঙতে ছড়িয়ে যায়।
তুমি জানলেও না কখন
প্রান্তরেখা ভেঙে আর
একটা প্রান্তরেখা সে
তৈরি করে নিয়েছে। ওই যে
বাড়ুজ্যে বাড়ির পিছনের
পুকুরধারের উত্তরের
বাঁশঝাড়, ঠিক তারই মতো।
অন্যের জমিতে ঢুকে গেলে
যা হবার তাই হয়, আঁশবটি
হাতে উঠে আসে, রোগা
লোকের দল মোটা লোকের
দলের কাছে হেরে গজগজ
করে, কোর্ট-কাছারি করে,
উকিল-মোক্তার ধরে,
দাদা-দিদির কাছে হন্যে
হয়ে ছোটে, যতদিন দম থাকে
ছোটে, তারপর একদিন হঠাৎ
চুপ মেরে যায়। একদিন
রাতের বেলাতে কী যেন
বোধোদয় হওয়াতে সকাল
হতেই চুপ মেরে যায়, সেই
যে রোগা লোকটা একা হয়ে
গেল, একা হয়ে বোবা হয়ে
গেল, সারাজীবনেও আর কথা
ফুটল না তার। কোন
একা-টায় তুমি কুলিয়ে
গেলে, কোন একা-টায় তোমার
নিজের থাকা পাকা হয়ে
গেল, সেটাই হল গিয়ে লাখ
কথার এক কথা।
তবু কখনো কখনো একটা
মোহ জাগে, একটা মোহ জেগে
ওঠে। একটা মোহ জেগে
উঠতে পারে অন্তত, যে, এই
বিশাল আকাশ আর তার তলায়
পশুপক্ষী, জলবাতাস,
খেতখামার, সূর্যোদয় আর
সূর্যাস্ত, দিন আর
রাত্রি, ভালোবাসা আর
ঝড়,সাদা আর কালো, হা-ঘরে
আর ঘরুয়া, হা-ভাতে আর
দুধেভাতে, মনিব ও মুনিষ,
সংগীত আর সাইরেন, সবই
যেন, সবাই যেন, এক
মহামন্ত্রের অধীন,
একটাই সুর সঙ্গোপনে
বেজে উঠে চারিদিকে
ছড়িয়ে যাচ্ছে। এমন কি
হয় না, কখনো হয় না! হয় তো!
দূরে সরে গেলে হয়।
বহুদূরে সরে গেলে আরও
বেশি করেই হয়। দূরে
সরতে সরতে পৃথিবীটাই কত
কাছে এসে যায় তখন ।
উপগ্রহে রাখা নজরদারি
ক্যামেরার ছবিতে
দ্যাখোনি, কত কাছাকাছি
দুটো আদায়-কাঁচকলায়
বিরোধী দেশ!
কখনো কখনো মনে হয়, মনে
হতে পারে, কখনো হয়তো
আলোয়-আলো এক ভোরবেলায়
ঘুম থেকে উঠেই কেমন যেন
মনে হল, সব কিছুই এক
নিয়মের অধীন, কখনো
অন্তত মনে হতে পারে,
কখনো অন্তত মনে হবার
কথা। প্রকৃতির
ঋতুচক্রের মতো মানুষের
যাবতীয় উদ্যোগ এক মূল
সুরে বাঁধা, কখনো এমনটা
মনে হতে পারেই। দূরে
গেলে মনে হতে পারে।
প্রকৃতির থেকেও, আর
মানুষের থেকেও। সেই
ঐক্য, সেই অন্বয়, সেই
পরিচয়, মানুষ কীর্তির
ধ্বজার মতো তুলে ধরে
আকাশছোঁয়া উঁচু করে। সে
মনে করে বিশাল এক
মায়াযন্ত্রে কোনো
স্বর্গীয় হারমোনি বেজে
উঠেছে। সে মনে করে, তবে,
তবুও, তা ভেঙে যায়,
ঢেউয়ের ভাঙার মতো ভেঙে
যায়, বালির বাঁধের মতো
ভেঙে যায় । জাতপাতের
আয়োজনে, ঐশ্বর্যের থাকা
না-থাকায়, ক্ষমতার
কমবেশিতে ভেঙে যায়।
ভেঙে দেওয়ায়, কখনো ভেঙে
যায়। ভেঙে না-দেওয়াতেও
কখনো ভেঙে যায়। গড়তে
গড়তেই ভেঙে দেওয়া হল
হয়তো। জ্ঞানে বা
নির্জ্ঞানে ভেঙে দেওয়া
হল। ইচ্ছায়, বা
অনিচ্ছায়, উচ্চারণে বা
নৈঃশব্দ্যে, বেদে বা
নির্বেদে ভেঙে দেওয়া
হল। মানুষের তৈরি করা
সাম্য ধোপে টেকে না।
মানুষ চায়নি বলেই টেকে
না হয়তো, মানুষ চাইলেও
টেকে না। মানুষ থাকলে
মানুষের লোভও থাকে।
মানুষ থাকলে মানুষের
উচ্চাশাও থাকে। মানুষ
চাইলেও তাই, কোনো কোনো
মানুষ চাইলেও তাই,
গুটিকয়েক মানুষ কখনো
চাইলেও তাই, না চাইলেও,
কোনো অন্বয় কখনো তৈরি
হতেই পারে না। কক্ষনও
তৈরি হতে পারে না।
পারেনি অন্তত।
চারিদিকে তাকিয়ে দেখো।
কেউ যদি সাম্যের কথা
ভাবে, কেউ কেউ তো ভেবেছে,
কখনো কেউ ভাবেনি, তা তো
নয়। তবে তার, তাদের, সেই
ভাবনাটা হালে পানি
পায়নি। কেউ কেউ ভাবতে
ভাবতে শেষে এমন ঘুরপথে
হারিয়ে গেছে, চিরকালের
জন্য হারিয়ে গেছে যে,
শেষে আর মনেই থাকে না
তার শুরুর ভাবনাটা।
শেষে মুছেই যায় তার
শুরুর ভাবনাটা, মুছে
গিয়ে তার হারিয়ে
যাওয়াটাই থাকে। সে-যে
পথভোলার পাল্লায়
পড়েছিল, এই কথাটা কে আর
মনে রাখতে যাবে! সে কেন
যে পথভোলার পাল্লায়
পড়েছিল, এই কথাটাও কেউ
খুঁটিয়ে ভাবতে বসবে
ভেবেছ? আখেরে সেই
কল্পিত সাম্য, কল্পনার
রাজ্যে গা ঢাকা দেয়। সব
শেষে মানুষ একা হয়ে যায়,
কোনো একরকমের একা হয়ে
যায়। সে তার
একাকিত্বকে হয়তো রক্ষা
করতেও পারে না, সে তার
একাকিত্বকে হয়তো বহন
করতেও পারে না, সে তার
একাকিত্বকে জানেও না
হয়তো ঠিকমতো , কোন রকমের
একা-য় যে সে থাকে, কোন
রঙের 'অনেক' আসলে তার সেই
একাকিত্বেরই এক খোলস,
মনভোলানো খোলস কোনো,
ধরো কোনো ডনের ছদ্মবেশ,
না জেনে না বুঝে কখন সে
তার নিজেকে বাগিয়ে
নিয়ে, তার মধ্যে হঠাৎ
ঢুকে পড়ে পথ হারিয়ে
ফেলেছে , সেই ছদ্মবেশী
অনেক-এর মধ্যে। তখন
একটা বিভ্রম জেগে ওঠে
তার মনে , তখন তার এই 'আমি'
আর ওই 'আমি'-র কোন আমিটা
যে বেশি সত্যি এই নিয়ে
একটা বিভ্রম জেগে ওঠে,
একটা ধাঁধায় পড়ে যায়
সে,একটা স্বপ্নের
ধাঁধায়, একটা স্বপ্নের
পাড়া তৈরি হয় সেখান
থেকে, তৈরি হয়ে যায় কেমন
করে যেন, গোটা একটা
স্বপ্নের পল্লী, নানান
রকমের স্বপ্ন থরে থরে
সাজানো থাকে সেই
স্বপ্নপল্লীর
বাড়িঘরগুলোতে,
দোকানপাটে, স্বপ্নের
প্যারেডে ঘুম ভাঙে তার
আর স্বপ্নের প্যারেডেই
চোখ লেগে আসে। তখন সে
দেখে, স্বপ্নের মধ্যে
দেখে, সে ধীরে ধীরে এক
প্রজাপতি হয়ে গেল,
প্রজাপতি হয়ে সেই ঘর
ছাড়িয়ে, অদ্ভুত সব নীল
রঙের পাহাড় আর নদী
ছাড়িয়ে ফুলের দেশে গেল
মধু খেতে, তারপর, তারপরই
হঠাৎ তার কেমন একটা
দোলাচল শুরু হয়, কেমন
একটা দোলাচলে পড়ে যায়
সে, সেই একা থেকে অনেক-এর
দিকে চলে যাওয়া
মানুষটা, তখন সে আবার
ফিরে ভাবতে বসে, নীল
পাহাড় আর টলমলে নদীর
ওপর দিয়ে উড়তে উড়তে
ভাবে, ফুলের দেশে মধু
খেতে খেতে ভাবে , ভাবতে
থাকে, সে আসলেই কি একটা
মানুষ যে হঠাৎ প্রজাপতি
হয়ে গেছে, প্রজাপতি হয়ে
মধু খেয়ে খেয়ে
বেড়াচ্ছে, না কি সে এক
প্রজাপতিই, আসলেই এক
প্রজাপতি, যে ভুল করে
একদিন মানুষের খোলায়
ঢুকে পড়েছিল, একজন একা
দুঃখী মানুষের খোলায়
ঢুকে পড়েছিল! তার সেই
বিভ্রমের উত্তর পাবার
জন্য সে কত হাত নাড়ে, হাত
কিংবা ডানা নাড়ে, কত
চেঁচায়, কত বোঝায়, কত
চিৎকার করে বোঝাতে চায়,
কত চিৎকার করে বুঝতে
চায়, জানতে চায় কোনটা
তার ঘুম আর কোনটা তার
জেগে থাকা, কোনটা তার
স্বপ্ন আর কোনটা তার
যন্ত্রণা, কোনটা তার এক
আর কোনটা তার অনেক, সে
উড়ে উড়ে বেড়াতেই থাকে,
সে উড়ে উড়ে বলতেই থাকে,
চারিদিকে শুধু ফুলের
দেশ, চারিদিকে শুধু
নদীর দেশ, নদী আর নীল
পাহাড়ের দেশ, কোনো
মানুষ কোথাও নেই, কোনো
মানুষ কোত্থাও নেই,
শুধু স্বপ্নেরা আছে,
নানান রকমের থরে থরে
সাজানো স্বপ্নেরা আছে,
স্বপ্নেরা কেউ কোনো কথা
বলে না, স্বপ্নেরা
নিশ্চুপ থাকে,
স্বপ্নেরা কেউ কোনো
কথা শোনে না, শুনতেই পায়
না, স্বপ্নেরা নিশ্চুপ
থাকে, তার কোনো কথাই
কোথাও পৌঁছতে পারে না ।
পৌঁছল কি পৌঁছল না,
জানতেও পারে না সে।
একটা নতুন জন্মের মধ্যে
পুরোনো জন্মের দোলাচল
নিয়ে, কিংবা একটা
পুরোনো জন্মের মধ্যে
নতুন জন্মের দোলাচল
নিয়ে সে হাওয়ায় ভেসে
থাকে।