নিজের চিতায়(যদিও এখানে
নিজস্ব লিখলেই ভাল
হত,কারণ প্রত্যেক
মানুষেরই নিজস্ব চিতা
বা আপনি কবরও বলতে
পারেন,তবে এক্ষেত্রে
চিতা-ই,থাকে)উপুড় হয়ে
শুয়ে থাকবার কালে
হেমন্তের যা মনে
এল,হেমন্ত সরখেল,বয়স
৭৭,ম্যাসিভ হার্ট
অ্যাটাক সামলাতে না
পেরে,গতরাতে
হেমন্ত,নইলে এমনিতে তো
সুস্থই ছিল,বাজার-হাট
সবই নিজে গিয়ে
করত,সকালে নিয়ম করে ৩০
মিনিট হাঁটা যতটা জোরে
এ-বয়সে সম্ভব,হাল্কা
কিছু ব্যায়াম,এই যেমন
দুই পা দু'দিকে ছড়িয়ে
কোমরটাকে
বেঁকিয়ে,হাতের আঙুল
হাঁটুর নিচে নামানো এই
বয়সে এক অসম্ভব
প্রকল্প,কিংবা জোরে
জোরে শ্বাস নেওয়া ও
ছাড়া,এরকম,যেগুলো সম্ভব
আর কী,প্রেসার-সুগার,এই
বয়সে কার না
বাড়ন্ত,ওষুধ খেত
হেমন্ত,প্রেসারের,সুগা
ের,তবু ডাক্তার
বলেছিল,হাঁটা কিন্তু
মাস্ট,ওই ৩০ মিনিটই
যথেষ্ট,প্রতিদিন,যে-কোন
ো সময়,নিয়মিত যোগাযোগ
ডাক্তারের
সংগে,দু'তিনমাস অন্তর
প্রেসারটা,সুগারটা,চেক
করিয়ে নেওয়া,স্কুলের
নিচুক্লাসে,বন্ধুরা
'সরখেল' পদবীটা নিয়ে
খেলত,খ্যাপাত,সর
খেলো,সর খেলো,তাতে ফিক
করে হাসি পেল হেমন্তর।
ওই বয়সে কেউ একা থাকে
না,সাধারণত,একাকীত্বের
বোধটাই জন্মায় না
তখন,মানুষ একা হয়,একা
হতে থাকে,বয়স বৃদ্ধির
সংগে পাল্লা
দিয়ে,চু-কিৎকিৎ খেলতে
খেলতে সময়ের
সংগে,একাকীত্বটা আসলে
একটা বোধ,অনেকেরই অবশ্য
সে-বোধ জন্মায়
না,অনেকেরই বোধ যেমন
হাঁটু অবধি পৌঁছতে না
পৌঁছতেই আটকে
যায়,সারাজীবন আটকে থাকে
ওই হাঁটুতেই,চারপাশে
আত্মীয়স্বজন,বন্ধুবান
ধব,সন্তানের
মায়া,স্ত্রীর
পরিচর্যা(এখানে পুংকথা
লিখিত হইতেছে),মাঝখানে
উজ্জ্বল তুমি হইয়া
আছ,কিন্তু ভিড়ের মাঝে-ও
আসলে তুমি একা,তুমি জান
কি জাননা তাও
বোঝনা,জানত হেমন্ত,কেউ
কারো মত নয়,মানুষকে,সে
তোমার স্ত্রী
হলেও,সন্তান,প্রিয়
বন্ধু,কিংবা ঘনিষ্ঠ
আত্মীয়দের মধ্যেও,একজন
মানুষ গভীরতর ভাবে
ছুঁতে পারেনা অন্য একজন
মানুষকে,সে তোমার যতই
ফিজিকাল নিকটে কিংবা
দূর,তোমাকেও গভীরতর
ভাবে ছুঁতে পারেনা
কেউ,হেমন্ত জানত।
সরও তো তুমি খেয়েছিলে
হেমন্ত,খাওনি কি সর
জীবনের,সর খেলো তো
একর্থে কমবেশি
প্রত্যেকেই,যেজন্য
জীবন একইসঙ্গে মধুর এবং
তিতকুটেও,খুবই ছোট বয়সে
যে বয়সে হাগু করে একা
একা ছুঁচু করতে পারেনা
কেউ-ই,হয় মা কিংবা
সংসারের বয়স্ক
অন্যকেউ,হেমন্তর এক
দিদি ছিল,সে
দিদিও,কতদিন,দিদি আর
বেঁচে নেই,মা-ও,বাবা তো
হেমন্ত যখন ক্লাস সিক্স
কি সেভেন,ন্যাড়া মাথায়
ধুতি পরে শ্রাদ্ধে
বসে,হাসি পেয়ে গেছিল
হেমন্তর,যাচ্ছিল
বারবার,বকাও সেজন্য
খেয়েছিল খুব,কিন্তু
নিজের বাবার শ্রাদ্ধে
বসেও হাসি সামলাতে
পারেনি
হেমন্ত,পুরোহিতের
অদ্ভুত
অঙ্গভঙ্গি,হেমন্ত তারও
অনেক আগে,যখন একেবারেই
ছোট,শৈশব,মনে পড়ে গেল
হেমন্তর,হাগু করে হাগু
খাচ্ছিল,দূর থেকে মা
দেখতে পেয়েই চিৎকার করে
দৌড়ে,এ-ম্ম্যা,ছিঃ,তুলে
নিয়ে গিয়ে,ফিক করে ফের
একবার হাসি পেল
হেমন্তর,নিজের চিতায়
উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা
অবস্থাতেই।
পরক্ষণেই একটা গভীর
ভাবনাও,কোত্থেকে
হেমন্ত জানে না,ভুস করে
ভেসে যেমন তিমি
সমুদ্রে,যেন উঠল
হেমন্তর মস্তিষ্কের
এ-মুহূর্তে মৃত কোনো
কোষে,মন তো আসলে
সেখানেই থাকে যাকে মন
বলি আমরা,'এসেছ ন্যাংটো
একা,যাবেও ন্যাংটো
একা',ন্যাংটো হয়েই তো
উপুড় শুয়ে এখন
হেমন্ত,মাঝখানের এই যে
জীবন,যা আসলেই বলেছিলেন
কেউ কেউ,রঙ্গমঞ্চ,এই
রঙ্গমঞ্চে আমরা
প্রত্যেকেই একেকজন
অভিনেতা,অভিনয় করে
যাচ্ছি যে যার
নির্দিষ্ট
ভূমিকায়---এরকমই বোধহয়
যতদূর মনে পড়ছে
হেমন্তর,ছিল
কথাটা,অন্ধকার থেকেই তো
আসি আমরা,ফিরে যাই ফের
অন্ধকারে,মাঝখানের এই
আলোকিত অংশটুকু,যাকে
জীবন বলি,তাহলে আসবার
আগের যে অন্ধকার,ভাবতে
থাকে হেমন্ত,মনে পড়ে
রবিঠাকুরের
কবিতাটা,'ইচ্ছে হয়ে
ছিলি মনের মাঝারে',মা
খোকার যেখানে প্রশ্নের
উত্তরে বলছেন,আসবার
আগের যে অন্ধকার,যেখানে
ছিলাম আমি,যেখান থেকে
এলাম একা,সে অন্ধকার কি
মায়ের মনের গভীরে কোথাও
থাকা অন্ধকার,সে
অন্ধকার কি আলোকিত
অন্ধকার নয়,এবং মৃত্যুর
পরের যে অন্ধকার,আমরা
কি সত্যি ফিরি
কোথাও,অন্যকোনো নিজস্ব
অন্ধকারে,জন্মাবার পরে
যে জগতকে
দেখি,জীবনকে,তারই
সমান্তরালে একইসঙ্গে
কি বয়ে চলে অন্য এক
জগৎ,অন্য জীবন,জগতের
সবচেয়ে বুদ্ধিমান
প্রাণিটিও আজও খুঁজে
পায়নি এর উত্তর,হয়ত
পাবেও না---এরকম সব
কিলবিলে ভাবনায় ঘেঁটে
'ঘ' হতে থাকে চিতায় উপুড়
হয়ে শুয়ে থাকা হেমন্ত !
কৌম্যচেতনা থেকে যত
দূরে সরে এসেছে মানুষ
সভ্যতা গড়তে
গড়তে,সভ্যতার সিঁড়ি
বেয়ে ওপরে ক্রমশ উঠতে
উঠতে, ততবেশি সমাজের
মধ্যে থেকেও,পরিবারের
মধ্যে
থেকেও,আত্মীয়স্বজন,বন্
ুবান্ধব,একই ভাবনার
লোকেদের মধ্যে
থেকেও,মানুষ জানেই না
সে কীভাবে কখন একা হয়ে
গেছে ! ভয়ংকর ভাবে একা।
আসলে। যখন তোমার পাশের
লোকটিকেও আর স্পর্শ
করতে পারছ না তুমি,সেও
তোমাকে ! তুমি
এহবাহ্য,নিজেকেই কি পার
খুব গভীরে গিয়ে ছুঁতে ?
তোমার শরীর ও মনের যে
ঐক্য যা ওই কৌম্যচেতনার
মধ্যে ছিল,সে তো কবেই
গিয়েছে ভেঙে। নিজের
কাছেও তুমি অনেকটাই
অচেনা। আয়নায় যে তোমাকে
তুমি দেখ,সে তোমার
বাইরের প্রতিরূপ,
তোমার ভেতরও কি দেখায়
আয়না তোমাকে ?
ফলে যে মানুষ নিজের
থেকেই নিজে
বিচ্ছিন্ন,একা,বহুদূরে
চলে গেছ তুমি,মানুষের
ভেতরে খুব গভীরে কোথাও
কৌম্যচেতনাটাকে সে
বোধহয় আজও ক্যারি করে
জন্য,জোট
বাঁধে,সমাজ-পরিবার-আত্ম
ীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধব-ব
ইরে থেকে মনে হওয়া একই
ভাবনার লোকজন,কিন্তু
মেলে না কোথাও।
একাকীত্বটাকে বহন করে
বুঝে বা না-বুঝেও।
মৃত হেমন্ত,নিজস্ব
চিতায়
উপুড়হয়েশুয়ে,প্রস্তুত
চলছে ওর
ঘাড়ে,পিঠে,পাছায়,এবং
হাঁটু যেখানে ভাঁজ
করা,যেখান থেকে শুরু
পায়ের পাতা,সেসব
জায়গায়,কাঠের ভারী লগ
চাপিয়ে দেবার,নিজের
একাকীত্বের সংগে লড়াই
করছে,খুব গভীরে গিয়ে যা
হয়ত মৃত্যুর পরেই
সম্ভব,নিজের ৭৭ বছরের
জীবনটাকে বুঝে নিতে
চাইছে,রায় ও মার্টিনের
সাজেশন বুক সেকালে না
থাকায় ম্যাট্রিকে
ধ্যাড়ানো ভাগ্যিস
হেমন্ত সরখেল তখন
একীভূত করতে চাইছে
নিজের শরীর ও মনকে।
পরিপূর্ণভাবে। ডুবে
যেতে চাইছে নিজের
ভেতরে।
হেমন্তর ছোট ছেলে হাতে
পাটকাঠির গুচ্ছ
জ্বালিয়ে তখন এগিয়ে
আসছিল ওর মুখে আগুন
ছোঁয়াবে বলে।