ভাঙা টুল, সিংহাসন ও
স্ত্রীবিষয়ক
এবার ঈদে তেমন কোনো
আনন্দ নাই!
তাই আমার স্ত্রী
এবার বাংলা ফেলে
চাইনিজ রানছে
আর একা একা রান্নাঘরের
ভেতরে বসে কাঁপছে—
এদিকে উনুনে গরম পানি,
লেবুর রস
এক পেয়ালা মধু, আদার
কুচি, লবণজলের গড়গড়া
আর ফুটন্ত পানির ভাপ...
তারা রান্নাঘরের সমস্ত
চাইনিজ-প্রকার উল্টে
দিয়ে
এক রকম ধোঁয়ার সিংহাসন
হয়ে দাঁড়িয়ে আছে
আমাকে দেখেই আমার
কিংকর্তব্যবিমূঢ়
স্ত্রী
তার ভাঙা টুলটি দেখিয়ে
প্রচণ্ড ঝাঁজালো কণ্ঠে
বলল:
“এসব বদলাতে পারো না?
বসতে গেলেই খালি কটমট
করে
জামা ছেঁড়ে, ওড়না ফাড়ে
আর সারাক্ষণ কেমন পড়ে
যাবার ভয়!”
আমি তাকে শান্ত হতে
বলি
বলি যে, আচ্ছা অন্তত
আজকের দিনটা...
আমার মুখের কথা কেড়ে
নিয়ে আরো খানিক খেঁকিয়ে
উঠে বলে:
“এসব গাঁজাখুরি সংসার
আমার ভাল্লাগে না,
বুঝছো!
খালি নিজেরটা বুঝো
এই তুমিই না একদিন
কইছিলা— ‘শোনো, ভাঙা
টুল আর
সিংহাসন— চরিত্রে একই
রকম হয়!
সারাক্ষণই খালি পড়ে
যাবার ভয়!’
এইবার বুঝছি তোমার
চালাকি
তুমিও আমারে টুল থিক্যা
ফালায়া হাত-পা ভাঙতে
চাও
আর সিংহাসনচ্যুত রাজার
মতো দুনিয়ার হতভাগা আর
একা বানাতে চাও
আর সেই চান্সে একা একা
তুমি মনের মতো গাছে
গাছে পোস্টার ঝুলাবা
জানি:
‘আহা কী নিঃসঙ্গতা’! ‘ও
পরম একাকিত্ব’! ‘হে
কবিতা’!”
সাদা মেঘজুড়ে সাদা
সাদা হাঁসের পালক
আজকাল প্রায়ই দুপুরের
ভাত বিকেল গড়িয়ে খাই
আর
সকালের নাশতা একপ্রকার
না খেয়েই সময় গড়িয়ে
যায়
অথচ প্রতিদিন নিয়ম করে
স্বাস্থ্য-আপারা আসেন
আর আমার তুমুল
নিঃসঙ্গতা থেকে
কলহপ্রিয়তা
যৌনতা থেকে
স্মৃতিকাতরতা— একে একে
টেনে
শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন
করে আবার জোড়া দিয়ে যান
দেখি, তারাও এতোটা
নির্জনতাপ্রিয় যে
আমার
স্বাস্থ্যসংক্রান্ত
একটি বাক্যও কেউ মুখে
তুলছে না!
এই দেহের ভালোমন্দ ঘিরে
যাবতীয় অসামঞ্জস শুধু
তাদের চোখেমুখেই
ভেসে উঠতে থাকে—
দৃশ্যত, তারা কখনো
হাসছে
কখনো কাঁদছে আবার কখনো
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে
হয়ে উঠছে আমূল
সাংসারিক!
আবার যখন রাত্রি গড়িয়ে
দুপুরের খাবারের
প্রসঙ্গ আসে
ওইসব স্বাস্থ্য-সেবিকা
আমার অস্তিত্ব আছে কি
নাই— এ জাতীয়
সন্দেহ ধরে হ্যাঁচকা
টান মেরে দেখে— আসলে
আমি
অনস্তিত্বময় এক বিপুল
দোদুল্যমানতা,
গৃহমাত্র বসবাস করি
আর নিঃসঙ্গতা— আমার
প্রত্যন্ত অলঙ্কার
পরিবার থেকে
পরিবারতন্ত্রে আমার
অভ্রান্ত প্রতাপ
ঘর থেকে ঘরে আমি অভিন্ন
বিচরণকারী
আর এই
স্বাস্থ্যসেবিকাগণ
তারা প্রত্যেকে জ্ঞানত
গৃহবহির্ভূতা,
সম্ভ্রান্ত
অনুপ্রবেশকারী
নিঃসঙ্গ থেকে
নিঃসঙ্গতায়
অবাধ
অগণন
নির্জনতা শুয়ে আছে
সমুদ্র প্রহরায়
আমাদের পুত্র শস্য
আবহমান দুটো ছেঁড়া
বাঁশের কাঠি
জোড়া দিতে গিয়ে কতই-না
কসরত করে যাচ্ছে!
আমি দূর থেকে দেখছি, আর
মনে মনে লোহালক্কড়
হাতুড়ি-বাটালি,
সুচ-তুরপুনের
অদ্ভুত-প্রয়াশ শব্দ
শুনতে পাচ্ছি
অথচ শব্দগুলোয় আমুণ্ড
বনেদিপনা আর
আভিজাত্যের
ধ্বনি-প্রতিধ্বনি!
যারা কার্যত আমার
হৃদয়ের গভীর থেকে গভীরে
বসে
অসহ্য বিপন্ন ক্রোধে
আমাকে ছিটকে ফেলেছে
নির্জনতম দ্বীপে
একটু একটু করে বাড়ছে
রাত; আমি টের পাচ্ছি
হাওয়া-বাতাসহীন প্রগাঢ়
নির্জনতা
অভিন্ন বাড়িতে বসবাস
করেও অনায়াস অনুভব করা
যায়!
প্রিয়তম স্ত্রীর প্রতি
হাত বাড়াতে গিয়ে গুটিয়ে
নিই হাত
স্নেহার্দ্র
সন্তানযুগল জড়িয়ে ধরতে
গিয়ে কেঁপে ওঠে বুক
এঘর থেকে ওঘর ছোটাছুটির
কথা ভাবতে ভাবতে
প্রায়ান্ধ একটি রাত
অনুভব-অনুভূতিহীন
একটুকরো দুষ্প্রাপ্য
নিশ্বাসের আসা-যাওয়া
ঘিরে
ব্যক্তিগত বিছানায় পড়ে
থাকি
ভোর হতে-না-হতেই আমার
জন্য তৈরি হতে থাকে
সুস্বাদু ঝোলের
ব্যাঞ্জন
নওয়াবী-বাদশাহী শত শত
লোভনীয় অন্নের কদর, যথা
প্রকার—
আমার স্ত্রীর মুখে
অন্তত শতবর্ষের
কাঙ্ক্ষিত দাম্পত্যের
মধ্যবর্তী হাসি
সন্তানের চোখে নতুন
কোনো অদেখা অদিতির সৃজন
সম্ভার
অথচ তারা কোনো কিছু
বুঝে উঠবার আগেই আমি
এতটা পূর্বাহ্নে আজ
ঘামতে ঘামতে নির্জন
দ্বীপটি ভাসিয়ে দিলাম
অভাবিত সামুদ্রিক
উচ্ছ্বাস আর ত্রিকূল
ছাপানা ঊর্মি-মুখরতায়!
একই ঘরে থেকে এতোটা
হঠাৎ করেই কতো কতো
সহস্র ক্রোশের
দূরত্ব রচিত হলো—
পরস্পর প্রিয় পরিজনে!
তারা আমাকে আদরে আদরে
এতোটাই ভরিয়ে তুলল যে
বৎসরে অন্তত একবার হলেও
ছুটে আসে সমুদ্র
প্রহরায় —