একটা ভারী কাঠের দরজা।
দেখলেই বোঝা যায় বহু
যুগের পুরোনো। খোদাই
করা অপূর্ব সূক্ষ্ম তার
কারুকাজ। দু পাল্লায়
মোটা লোহার দুটি কড়া।
উচ্চতা খুব বেশি হলে
সাড়ে পাঁচ ফুট। সেই
বন্ধ দরজার গা ঘেঁষা
বুক সমান উঁচু পাঁচিল
ডিঙিয়ে একটা টগর গাছ
অর্কর প্রায় ঘাড়ের ওপর
ঝুঁকে পড়েছে ! কোলাপুর
শহরের রাজারামপুরীর এই
অনতিচওড়া
রাস্তাগুলোর দুধারেই
আছে এমন সব কাঠের সদর
দরজাওয়ালা সারিসারি
পুরোনো বাড়ি। মাথায়
টালির ছাদ। জানলায় ও
বারান্দায় কাঠের
জাফরি। দেখলেই অর্কের
মনে হয় এমন সব বাড়িতেই
বুঝি স্বপ্নদের বাস।
মাঝ রাতে স্বপ্নরা দল
বেঁধে এই সব বাড়ি থেকে
বেরোয় একা মানুষের
খোঁজে। রাস্তা নির্জন,
সন্ধ্যা নামছে
কাঠবাদাম ও নিম গাছ
জড়িয়ে। অর্ক জোরে একটা
শ্বাস নিতেই বুক পকেটে
ফোনটা বেজে উঠল। ও তখন
দরজাটার পাশে চুপ করে
দাঁড়িয়ে মন দিয়ে
পাঁচিলের ওপাশে
অন্দরমহলের দিকে
তাকিয়ে ছিল। অন্দরমহল
বলতে উঠোনের পাশে নিচু
বারান্দাসহ দুটো ঘর।
যার একটির খোলা দরজা
দিয়ে দেখা যাচ্ছে টিভির
পর্দা। নিচু টেবিলের
ওপরে রাখা ছোটো
সাদাকালো টিভি। তাতে
মারাঠি সংবাদ চলছে । আর
সামনের পালঙ্কে বসে
দুজন বৃদ্ধা মন দিয়ে
তাই শুনছেন। দুই বোন
নাকি জা? মা-মেয়ে না
শাশুড়ি-বৌ? না কি
ননদ-ভাজ? টিভির একটু
ওপরে নোনাধরা দেওয়ালে
ফ্রেমে বাঁধানো একজন
মারাঠি রাজপুরুষের
ফটো। তারও ওপরে
বাঁকানো বাহারি
ব্র্যাকেটে জ্বলছে কম
ওয়াটের একটা বাল্ব।
এলার ফোন। ফোনের
স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে
গুনে গুনে ছবার সুরটা
বাজতে দিল অর্ক। কারণ
ওর মাথা বোধহয় তখনও
ব্যস্ত ছিল ঘরের ঐ দুই
বৃদ্ধা মহিলার মধ্যের
সম্পর্কটা ঠিক কী হতে
পারে সেই ভাবনায়। অথবা
দেওয়ালে টানানো মারাঠা
ছত্রপতিদের সময়ের ঐ
আবছা হয়ে যাওয়া ফটো
থেকে ফিরে আসতে ওটুকু
সময় লেগে গেল!
- হ্যাঁ, বলো।
- কীগো, পুনে পৌঁছে গেছ
তো? পুনে থেকে
মুম্বইয়ের ট্যাক্সি
নিয়ে নিয়েছ? বারবার
স্যানিটাইজারে হাত
মুছছো তো? এলার স্বরে
উদ্বেগ।
-- না, আমি এখনো
কোলাপুরে। বলেছিলাম না,
আটটার সময়
ফ্র্যানচাইজিদের
সঙ্গে একটা মিটিং আছে।
এবং, ফলোড বাই ডিনার।
তাই নিয়ে এখন খুব
ব্যস্ত। তোমাকে তো
সকালেই বলেছিলাম।
--কী? তুমি এখনও
কোলাপুরে? দুপুরে যে
বললাম, ও সব ক্যান্সেল
করে রওনা দিয়ে দাও!
তোমাদের ঐ মিটিং-ডিনার
মানে তো রাতে দল বেঁধে
মদ গেলা! এলার স্বরে
এবার ক্রোধ।
অর্ক বাঁ হাতে ফোনটা
নিয়ে ডান হাত বাড়িয়ে
গাছ থেকে একটা টগর ফুল
ছিঁড়ে আঙুলের মধ্যে
চটকাতে চটকাতে বললো,
রাগ করছো কেন? তুমি তো
জানোই সোনা, বললেই কাজ
শেষ না করে এমন হুট করে
চলে যাওয়া যায় না। কাল
রাতের ট্রেনে
রিজার্ভেশন করা আছে,
পরশু সকালেই তো মুম্বাই
পৌঁছে যাব।
লক্ষ্মীসোনা!
-- ফাজলামো কোরো না তো।
সবাই বলছে আজ রাত
বারোটা থেকে লকডাউন
শুরু হয়ে যাবে! খবরে
বলছে। এতবার করে
বললাম...। এলার গলা
কান্নায় বুজে আসে।
-- আরে, এতো চিন্তা করছো
কেন। একদিনেই কী হবে?
--- কী হবে? আচ্ছা, তুমি
কথা বললে শোনো না কেন
বলো তো? তোমাকে পইপই
করে বললাম...। অর্ক ফোন
কেটে পকেটে রেখে হাঁটতে
থাকে সোজা রাস্তাটা
ধরে। রাস্তাটা ঢাল হয়ে
নেমে গেছে শহরের বুক
চিরে।
ও টের পাচ্ছে মা দু কাঁধ
ধরে ক্রমাগত ঝাকরাচ্ছে,
তোকে না পই পই করে
বলেছি স্কুল ছুটি হলেই
ঠিক সময়ে রোজ বাড়ি চলে
আসবি। সব্বাই চিন্তা
করছে, প্রায় সন্ধ্যা
হয়ে গেল, কোথায় ছিলি তুই?
কোন চুলোয় ঘুরে বেড়াস?
ঠোঁট টিপে থাকে অর্ক।
তখনও তো ওর মাথার
ভেতরে বিনবিন করছে, মরণ
রে তুঁ হুঁ মম
শ্যামসমান। চোখের
সামনে তখনও পিপুদি
হাঁটু ভেঙে ভেঙে, হাত
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নাচ করে
যাচ্ছে। পিঠ কুঁকড়ে
ওঠে ওর। গুমগুম করে
দুটো কিল পড়ে। মায়ের
ক্রুদ্ধ স্বর, ঠ্যাঁটা
ছেলে, তবু কোনো জবাব
নেই! আরেকদিন যদি ফিরতে
দেরি দেখি, চাবকে পিঠের
ছাল তুলে দেব।
কত বয়স তখন অর্কর? নয়?
নাকি দশ? শরৎসেন রোডের
স্কুল থেকে ফেরার পথে
প্রবীরকাকুদের বাড়ি
ঘুঙুরের আওয়াজ শুনে
দরজা ঠেলে ঢুকে পড়েছিল।
ভেতরে উঠোন ঘিরে টানা
রোয়াকে সেই বিকেলে
চলছিল পাড়ার পুজোর
ফাংশানের জন্য
রিহার্সাল।
ভানুসিংহের পদাবলী।
একদিকে বসে প্রবীরদার
বোন কৃষ্ণাপিসি
হারমোনিয়াম বাজিয়ে
গান গাইছে। পাড়ার অন্য
দিদিরাও বসে । পিপুদি
কি তখন কলেজে ফার্স্ট
ইয়ার? তাই হবে। পাড়ার
আরো কত ছোটো ছেলেমেয়েই
তো ভিড় করে বসে দেখছে।
অর্কও সামনে বাবু হয়ে
বসে পড়েছিল। ওর মনে
হচ্ছিল পিপুদি যেন ঐ
নাচটা করার সময় কাঁদছে।
তাই দেখে অর্করও
কান্না পাচ্ছিল।
অথচ ঐ গানের অর্থ তো
বোঝার কথা নয় ক্লাশ
ফোরের ছাত্রের।
বোঝেওনি তখন। তবু একটা
মনখারাপ করা সুর সেই
দিনই ওর ছোট্ট শরীরটার
খাঁচার ভিতরে বন্দী হয়ে
গিয়েছিল। সেই সুর যেন
মানুষকে একা করে
দেওয়ার সুর!
অর্কদের স্কুলের
পেছনেই ছিল একটা
নিরিবিলি পুকুর। সবাই
বলতো গোল পুকুর। শুধু
দোলের দিন সবাই সেখানে
দল বেঁধে স্নান করতে
যেত। আর বাড়ির
লক্ষ্মী-সরস্বতী পুজোর
ঠাকুর বিসর্জন করা হতো।
টিফিনের সময় স্কুলের
সব ছেলেরা যখন
গোল্লাছুট বা
বুড়িবসন্ত খেলতো, অর্ক
দারোয়ানের ঘরের পেছনের
দরজা দিয়ে চলে যেত ঐ
পুকুরের পাড়ে। ঘাটটা
ছিল স্কুলের
উল্টোদিকে। এ পারের
আকন্দগাছের ঝোপের পাশে
ঘাসের ওপরে চুপ করে বসে
থাকতো ও। দুপুর বেলার
শান্ত পুকুরে বুড়বুড়ি
কাটতো মাছ। ধারে ধারে
ফুটে থাকা শালুক ফুলের
ওপরে উড়ে বেড়াতো জল
ফড়িং। এই পুকুরটা নাকি
খুব গভীর। এর ঠিক
মধ্যেখানেই নাকি আছে
একটা মস্ত কুয়া। সেই
কুয়াটাকে ঘিরে ছিল
অর্কর মহা কৌতূহল।
পিপুদি, জানো, সবাই বলে
গোল পুকুরের মধ্যে নাকি
একটা কুয়ো আছে। একদিন
স্কুল থেকে ফেরার পথে
ঢুকে পড়েছিল পিপুদিদের
বাড়িতে। পিপুদি তখন
ওদের বাড়ির উঠোনের শেষে
শান বাঁধানো সিঁড়ির
ধাপে আলপনা দিচ্ছিল।
সাদা রঙ আর তুলি দিয়ে।
-- আছেই তো।
-- অনেক গভীর?
-- অ নে ক। পিপুদি চোখ বড়
করে, টেনে টেনে বলে। ওটা
কুয়ো নয় রে, একটা
সুড়ঙ্গ।
-- তাই? সেই সুড়ঙ্গ কোথায়
গিয়ে শেষ হয়েছে, তুমি
জানো ?
-- হ্যাঁ। চিলিকা
হ্রদে। একথা কেউ জানে
না। শুধু তোকে বললাম,
কাউকে বলিস না কিন্তু।
পিপুদি ঠোঁট টিপে হাসে।
-- চিলিকা হ্রদ মানে তো
অনেক দূর। সেই পুরির
কাছে, তাই না? আমাদের
একবার পুজোর ছুটিতে
বেড়াতে যাওয়ার কথা
হয়েছিল। ঐ সুড়ঙ্গ ধরে
অতদূর চলে যাওয়া যায়?
--হুঁ। তবে একা যেতে ভয়
করে তো, তাই একটা বন্ধুর
সঙ্গে যাই। রোজ রাতে।
-- কোন বন্ধু? কী নাম?
-- স্বপ্ন। কাউকে বলিস
না কিন্তু।
অর্ক মাথা নেড়ে বলেছিল,
-- স্বপ্ন? মানে ঘুমের
মধ্যে যা দেখি? সে আবার
কারো বন্ধু হয় নাকি!
-- হুঁ। বড় হলে বুঝতে
পারবি। স্বপ্নই তো
মানুষের একমাত্র
বন্ধু। পিপুদি আদর করে
অর্কর গাল টিপে দিয়েছিল
।
অর্ক অবাক হয়ে দেখছিল
সিঁড়ির ধারে কী সুন্দর
সব জোড়া মাছ আঁকছে
পিপুদি।
পুজোর তিন চার মাস পরে
এক শীতকালের সকালে গোল
পুকুরের শালুকফুলের
মধ্যে পিপুদির লম্বা
চুল ভেসে উঠেছিল।
পিপুদি কি তবে একা
গিয়েছিল ঐ সুড়ঙ্গে,
নিজের জরায়ু লুকোতে?
স্বপ্ন কি তাহলে ছেড়ে
চলে গিয়েছিলে পিপুদিকে!
খবর পেয়েও প্রবীরকাকু
আসে নি। চিলিকার
ফিসারিজ কোম্পানির
চাকরি থেকে নাকি ছুটি
পাওয়া যায়নি!
সুড়ঙ্গটার হদিশ পিপুদি
শুধু অর্ককেই দিয়ে
গিয়েছিল। সেই গোল পুকুর
বুজিয়ে তো কবেই উঠে
গেছে মানুষের আবাসন।
কিন্তু সেই থেকে
সুড়ঙ্গটা থেকে গেছে
অর্কর হেফাজতে। একটু বড়
হতেই অর্কও খুঁজে
পাচ্ছিল স্বপ্ন নামে
মানুষের একমাত্র
বন্ধুটাকে। তার কাঁধে
হাত রেখে ঐ রকম নানান
কিসিমের সুড়ঙ্গর মধ্যে
হেঁটে বেড়াতে শিখে
যাচ্ছিল ও। শুধু রাতে
নয়, দিনেও। তারপর থেকেই
যখন তখন ও ঢুকে পড়তে
পারে বিচিত্র সুড়ঙ্গর
মধ্যে। কখনও স্বপ্নের
হাত ধরে, কখনো বা একা।
রাত ঠিক সাড়ে নটার সময়
আবার এলার ফোন আসে।
অর্ক তখন গোকুল হোটেলে
নিজের রুমে। পায়ে হেঁটে
সবে ঘুরে এসেছে শহরটার
অনেকটা পথ। এমনিতেই
এসব শহরে সন্ধ্যা গাঢ়
হলে পথে মানুষজন কমে
যায়। আজ যেন আরও কম। যে
দুচার জন পথে বেরিয়েছে
তাদের বেশিরভাগেরই
মুখে রুমাল বাঁধা।
অর্কর খুব ভালো লাগছিল
আজ রাজারামপুরী,
শাহুপুরীর নির্জন পথে
একা একা ঘুরে বেড়াতে।
-- কী গো, মিটিং হয়ে গেছে?
ডিনার চলছে বুঝি? দু
পেগের বেশি নিও না
প্লিজ!
-- না, ডিনার হয়নি এখনো।
মিটিংটাও ক্যান্সেল
করে দিলাম।
সাঙলি,সাতারা,
ইছালকরঞ্জির
ফ্র্যানচাইজিরা আসতে
ভয় পাচ্ছিল। এখন তো
লোকজনের সঙ্গে দেখা
সাক্ষাত না হওয়াই
ভালো। তাই ওরা...।
-- দেখেছ? আর তুমি কি না
এদের জন্য থেকে গেলে!
--এদের জন্য নয়, মিটিংটা
জরুরি ছিল, তাই।
--ওই একই কথা। সবার
প্রাণে ভয় আছে, তুমিই
একমাত্র বীরপুরুষ।
-- জানো, একটু আগে দেখলাম
একটা এসএমএস এসেছে।
কালকের ট্রেনটা
ক্যান্সেল হয়ে গেছে।
--সে কী! তাহলে? তুমি
ফিরবে কী করে? এলা ফোনে
আর্তনাদ করে ওঠে।
-- আরে, এত চিন্তা করো না।
এখানকার ব্রাঞ্চ
ম্যানেজারের সঙ্গে কথা
হয়েছে। দেখি যদি কিছু
ব্যবস্থা করতে পারে! আর
হ্যাঁ, বেশী করে চাল ডাল
ও অন্যান্য শুকনো
জিনিসপত্র কিনে রাখো,
বুঝলে।
-- জানো, আমার না খুব ভয়
করছে! টিভির খবরে দেখছি
সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে
পড়ছে এই ভাইরাস!
-- তুমি সবেতেই বড্ড
টেনশন নাও। এখন ফোন
রাখো, আমি বাইরে গিয়ে
ডিনারটা করে আসি। এরপর
সব বন্ধ হয়ে গেলে
মুশকিল। ফোন রেখে দেয়
অর্ক।
নিচে এসে হোটেলের
রিসেপশনে কথা বলে। ওরাও
জানায় কাল থেকে লকডাউন
শুরু হবে, দু সপ্তাহের
জন্য। তবে নতুন
কাস্টমার না নিলেও যারা
আছেন তারা থেকে যেতে
পারবেন। কিচেন চালু
থাকবে, তবে শুধু মাত্র
রুম সার্ভিস। নিচের
রেস্টুরেন্ট বন্ধ
থাকবে। অর্ক বেরিয়ে
হাঁটতে থাকে শিবাজী
চকের দিকে। ওখানে ওর
চেনা একটি ঘরগুত্তি
খাবারের ব্যবস্থা আছে।
কোলাপুরে অফিস ট্যুরে
এলে রাতের খাওয়াটা ও
ওখানেই করে। ঘরে
বানানো খাবার। ডাল,
ভাত, রুটি, সবজি ও ফিস্
কারি।
সস্তা-সুন্দর-টিকাও।
একটি দরিদ্র পরিবারের
বাইরের ঘরে সাধারণ
টেবিল-চেয়ার পেতে
খাওয়ার ব্যবস্থা।
লাগোয়া রান্নাঘরে
মধ্যবয়স্কা, ইয়া বড়া
সিঁদুরের টিপ আর
মালকোঁচা করে সবুজ শাড়ি
পরা মহিলা মেঝেতে বসে
প্রায় থালার মাপের গরম
গরম রুটি বানান। অর্ক
বসে বসে দেখে। আর একটা
নতুন অচেনা সুড়ঙ্গের
মধ্যে ক্রমশঃ ঢুকে
পড়তে থাকে। হ্যাঁ এও
একরকমের স্বপ্নের
সুড়ঙ্গ। বউটি হয়তো
অর্কর পাতের পাশে
চিনেবাদাম পেষা লাল
রঙের শুখা চাটনিটুকু
দিতে দিতে টেরও পায় না
অর্ক ঐ রান্নাঘর ডিঙিয়ে
গিয়ে বসেছে ওর ভেতরের
ছোট্ট ঘরটায়। যার
একদিকে একটি কিশোর
মেঝেতে উপুড় হয়ে ক্ষীণ
আলোয় পড়াশোনা করছে।
একটি মলিন সালোয়াড় পরা
মেয়ে প্লাস্টিকের
ঠোঙায় ঠোঙায় ভরে রাখছে
ঘরে বানানো চাকলি। কাল
দোকানে সাপ্লাই দেবে
বলে। অর্ক এই পরিবারের
নিজস্ব স্বপ্নটুকু
ছোঁয়ার চেষ্টা করে
টেবিলে বসেই। কিন্তু
কথা বলে না বেশি। চুপ
করে বসে খেয়ে নেয়।
-- ভোজন ক্যসে হোতে?
খাওয়া হয়ে গেলে
প্রতিবার মহিলা প্রশ্ন
করেন।
আর অর্ক মৃদু হেসে,
মহিলার কপালের দুটাকার
কয়েনের মাপের
জ্বলজ্বলে লাল টিপটার
দিকে তাকিয়ে প্রতিবার
বলে, চাংলা! চাংলা আহে ।
অর্কর মনে পড়ে, ওর মাও
এমন বিরাট সাইজের টিপ
পরত।
রাতের খাবার খেয়ে
বেরিয়ে ফেরার পথে আজ
হঠাৎ অর্ক স্টেশনের
বাইরের পান-গুমটি থেকে
একটা সিগারেট কিনে
ধরায়। অনেক বছর হল,
সিগারেট ছেড়ে দিয়েছে ।
দু-তিনবার টান দিতেই
বেদম কাশি আসে, মুখের
ভেতর বিস্বাদ। টান
মেরে ফেলে দিয়ে আস্তে
আস্তে হাঁটতে থাকে
হোটেলের দিকে। বুক
পকেটে ফোন বেজে ওঠে।
বিশাল পোটে। ওর কোলাপুর
অফিসের ব্রাঞ্চ
ম্যানেজার।
--স্যার, ইন্ট্রা-স্টেট
বাস ভি কাল সে বন্ধ কর
দিয়া। আপকো আজ হি নিকাল
জানা চাহিয়ে থা।
-- বিশাল, তুমকো মালুম
হ্যায়, গোল পুকুর সে এক
সুড়ঙ্গ রাঙকালা লেক মে
ভি আয়া হ্যায়?
--স্যার, আপকা বাত ঠিকসে
সমঝা নেহি। বিশাল অবাক
স্বরে বলতে থাকে,
মহালক্ষ্মী মন্দিরের
কাছে রাঙকালা লেক আছে,
জানি। মহাদ্বার রোড
দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু
গোল পুকুর? সেটা কোথায়?
বিশাল হাই তোলে। ওর
গলায় ক্লান্তি। প্রায়
এগারোটা বাজে। অর্ক
বোঝে, কোলাপুর শহর পুনে
বা মুম্বাই নয়।
এগারোটা এখানে অনেক
রাত।
হোটেলে নিজের রুমে
ঢুকতে না ঢুকতেই আবার
এলার ফোন।
-- রাতের খাওয়া পেয়েছ?
স্বরে উদ্বেগ ও
উত্তেজনা।
-- হ্যাঁ। অর্ক বলে।
তোমাদের খাওয়া হয়ে
গেছে? জানো, তোমাদের না
আজ খুব মিস করছি!
-- থাক, ঢং করতে হবে না।
কত মিস করছ আমি জানি।
একা থাকতে পেলেই তো
তুমি ভালো থাকো, আমি
বুঝি না?
--- একা থাকলে তোমাকে
স্বপ্নে দেখি সোনা!
সত্যিই।
-- ঐ স্বপ্ন নিয়েই থাক।
শোনো, পার্থ গুগল সার্চ
করে পেয়েছে। একটা
প্রাইভেট ট্রাভেল
এজেন্সির বাস কাল সকাল
আটটার সময় কোলাপুর থেকে
মুম্বইয়ের জন্য ছাড়বে।
এসটি বাস স্ট্যান্ডের
সামনে। পরে কিন্তু আর
কোনো ব্যবস্থা পাবে না
শহর ছাড়ার। পার্থ
বলেছে, ট্রাভেলসের
নাম-টাম সব তোমাকে
হোয়াটস্যাপ করে দেবে।
--আচ্ছা, আচ্ছা। খুব
ভালো খবর দিলে। ছেলে
দেখছি আমার সাবালক হয়ে
গেল। আমি সকালেই
হোটেলে চেক-আউট করে ঐ
বাসে উঠে বসব। ব্যাস,
রাতে বাড়ি। তোমার হাতের
কালোজিরে কাচালঙ্কা
দেওয়া মাছের ঝোল, ভাত।
-- উমম। বাটা মাছ আছে
জানো। তুমি তো খুব
ভালবাসো। দোহাই আজ আর
রাত করো না। আমি সকালে
ফোন করে তুলে দেব?
--আরে না না। আমি এলার্ম
দিয়ে দেব। আটটায় সোজা
বাসে। চলো, এবার শুয়ে
পড়ো।
-- হুঁ। শুভ রাত্রি।
স্বপ্নে যেন আমি ছাড়া
কেউ না আসে! ফোন ছাড়ার
আগে এলা আদুরে গলায়
বলে।
এলা তো স্বপ্নই। এখনও।
সেই ছাব্বিশ বছর আগে
এলাকে প্রথম যেদিন
মঞ্চে দেখেছিল সেদিন
ওকে স্বপ্ন ছাড়া আর কীই
বা মনে হয়েছিল? ওডিসি
নাচ শিখতো এলা।
একদিন সন্ধ্যা বেলায়
অর্ক নিজের ধুমকিতে
এইট্টিসি কোয়ার্টারের
পাস দিয়ে সোজা হেঁটে
বনহুগলি লেকের ধারে
গিয়ে বসেছে। একেকদিন
সঙ্গে শম্ভু বা বাবুন
থাকে। সেদিন একা।
এমএসসির ফাইনাল
পরীক্ষা সবে শেষ হয়েছে।
রেজাল্ট বেরোয়নি।
অন্ধকারে সিগারেট থেকে
তামাক বের করে হাতের
তালুতে রেখে তার সঙ্গে
এক পুরিয়া কেষ্টদা
মিশিয়ে আবার সেটা
সিগারেটের খোলের মধ্যে
ঢুকিয়ে টান দিচ্ছিল।
এদিকটায় সচরাচর কেউ আসে
না। লেকের উল্টোদিকে
বিকেসি কলেজ। বাঁ
দিকে আনন্দম সিনেমা হল।
ডানদিকে কিছুটা দূরে
রাস্তার ধারে
প্যান্ডেল বেঁধে কোনো
জলসা হচ্ছে। মাইক
বাজছে। কেউ গাইছে,
দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার
গানের ওপারে...। তারপর,
মাইক টেস্টিং হ্যালো,
ওয়ান টু থ্রি ফোর...।
অর্ক একা বসে থাকে।
সামনে লেকের কালো জলে
চাঁদের ছায়া। জল দেখলেই
ওর কেন জানি মনে হয়
পৃথিবীতে ও বড় একা।
একটা সুড়ঙ্গর মধ্যে
দিয়ে একা হেঁটে যাচ্ছে।
সেই কবে থেকে। "সজনি
সজনি রাধিকা লো, দেখ
অবহুঁ চাহিয়া,
মৃদুলগমন শ্যাম আওয়ে...
", মাইকে ভেসে আসছে
গান। আচ্ছা, এই লেকটার
মধ্যেও কি কোনো কুয়ো
আছে? কোনো সুড়ঙ্গ? এই
লেকের ধার দিয়ে কত বার
গেছে, কিন্তু আগে কখনও
কেন একথা মনে হয়নি! ''গহন
কুসুম কুঞ্জ-মাঝে মৃদুল
মধুর বংশী বাজে''।
বংশীধারীর গায়ের রঙ কি
এই লেকের জলের মতো গহন
কালো ছিল! সে রঙেও ছিল
এমন হাতছানি! অর্কের
মাথার ভেতরে তখন
কেষ্টদার কারুকাজ। আর
দূরে মাইকে বাজছে,
"আজু, সখি, মুহু মুহু
গাহে পিক কুহু কুহু,
কুঞ্জবনে দুঁহু দুঁহু
দোঁহার পানে চায়।"
অর্ক দূর থেকে দেখতে
পায় মঞ্চে দল বেঁধে
মেয়েরা নাচছে। ওর
মাথার ভেতরে, ঘুরে ঘুরে,
বাজতে থাকে, "...মুহু
মুহু গাহে পিক কুহু
কুহু..."। ও উঠে এগিয়ে
যায় প্যান্ডেলের দিকে।
রাস্তার ধারে খোলা মাঠে
যুবক সংঘের বাৎসরিক
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
মাঠের ওপর চেয়ার পেতে
পাড়ার লোক জন বসে
দেখছে। স্থানীয়
ছেলেমেয়েদের নিয়ে নাচ
গানের জলসা। সেই
মঞ্চেই ও এলাকে প্রথম
দেখেছিল। নাচ করছিল।
মরণ রে তুঁ হুঁ মম শ্যাম
সমান। আর সেই মঞ্চ থেকে
সটান ওর স্বপ্নের
মধ্যে। সেই লাজুক এলা
এখন অবশ্য অনেক বদলে
গেছে। এখন ও বড্ড কথা
বলে। বিয়ের পরে চাকরি
নিয়ে ওরা মুম্বাই চলে
আসার পরে ছোটো করে কেটে
ফেলেছে চুল। আর কখনো
হাত খোঁপা করে না। নাচ
বলতে শুধুমাত্র
নবরাত্রিতে ডান্ডিয়া
নয়তো বন্ধুদের সঙ্গে
হুল্লোড়ে। কিন্তু,
অর্ককে এই একটা আশ্চর্য
ক্ষমতা পিপুদি দিয়ে
গেছে। এলা যখন সশরীরে
পাশে শুয়েও থাকে, অর্ক
পুরোনো এলাকে নিয়ে ঢুকে
যেতে পারে সেই গোপন
সুড়ঙ্গে। এলা টেরও পায়
না। এলা খুব ঘনঘন
উইকএণ্ডে বন্ধু
বান্ধবদের বাড়িতে
ডাকে। হৈচৈ হয় সাড়া
সন্ধ্যা। স্কচের বোতল
শেষ হয়ে যায়। সবাই বলে,
এলা, কাম অন, লেটস ডান্স।
অন্য বন্ধুদের
স্ত্রীরাও স্মারনফ উইথ
অরেঞ্জ জ্যুসে চুমুক
দিয়ে, কোমরে আঁচল জড়িয়ে
তৈরি হয়। সিস্টেমে
বাজে কোনো ফিল্মি গান।
সবাই জোরে হাসে।
অর্কও হাসে। নাচে।
হাততালি দেয়। উৎসাহ
দেয়। কিন্তু যেই এলা
এসে ঘরের মধ্যে
কার্পেটৈর ওপর দাঁড়িয়ে
গানের তালে তালে মৃদু
দুলতে শুরু করে, অর্ক
অবলীলায় ওর হাত ধরে
সাঁতরে ঢুকে পড়তে পারে
সেই কবে বুজে যাওয়া গোল
পুকুরের সুড়ঙ্গে। কেউ
বুঝতে পারে না। এমনকি
এলাও নয়।
পরের দিন সকাল সাড়ে
ছটায় উঠে পড়ে অর্ক।
নিজেই ইলেকট্রিক
কেটলিতে চা বানিয়ে খায়।
দুটো বিস্কুট আর বিপির
ওষুধটাও খেয়ে নেয়।
বাথরুমে গিয়ে গরম জলে
স্নান সেরে তৈরি হয়।
কাল রাতেই জিনিসপত্র
প্যাক করে রেখেছিল।
জিনিসপত্র বলতে তো একটা
ল্যাপটপ ব্যাগ আর একটা
ব্যাকপ্যাক। ঘড়িতে তখন
সাতটা পঁচিশ। এসটি
বাসস্ট্যান্ডে হেঁটে
গেলেও লাগবে খুব বেশি
হলে পনের মিনিট।
রিসেপশনে চেক আউট করে
বেরিয়ে আসে রাস্তায়।
সকালের শহর তখনও
আড়মোড়া ভাঙছে যেন।
রাস্তায় গাড়ি ঘোড়া নেই।
অন্য দিন অনেকগুলো অটো
রিক্সা দাঁড়িয়ে থাকে
হোটেলের সামনে। আজ
ফাঁকা। বাসস্ট্যান্ডে
হেঁটেই যেতে হবে। ডান
দিকে আধা কিলোমিটার
হাঁটলেই এসটি
বাসস্ট্যান্ড। যেখান
থেকে সকাল আটটায় ছাড়ার
কথা মুম্বইয়ের জন্য শেষ
বাস।
আর বাঁ দিকে চার
কিলোমিটার মহাদ্বার
রোড দিয়ে হাঁটলেই আসবে
রাঙকালা লেক। এতবার
কোলাপুরে এসেও যে লেকে
কখনো যাওয়া হয়নি ওর।
অর্ক হঠাৎ সেই সকালের
শান্ত শহরে বাঁদিকের
পথ ধরে হাঁটতে শুরু
করে। দূরে মহালক্ষ্মীর
মন্দিরের উঁচু চূড়া
ছুঁয়ে তখন সোনালী রোদ
ওর উদ্বেগহীন মুখে এসে
পড়েছে।
ঠিক আটটা পাঁচে, এলার
ফোন আসে। বাস ছেড়ে
দিয়েছে? জানলার পাশে
সিট পেয়েছ? বেশি করে
বিস্কুট টিস্কুট কিনে
নিয়েছ তো? বিপির
ট্যাবলেট খেয়েছ? ঘুম
ভাঙা স্বরে এক
নিঃশ্বাসে প্রশ্নগুলো
করে ও।
--বাস মিস করেছি সোনা।
খুব চেষ্টা করেছিলাম।
সাড়ে ছটায় এলার্ম দিয়ে
উঠেও পড়েছিলাম।
--তুমি তাহলে এখন কোথায়?
-- কোলাপুরেই।
--কী বলছো তুমি? তাহলে কী
হবে? পার্থ, এই দেখ, তোর
বাবা নাকি বাস মিস
করেছে...। এখন তাহলে কী
করে ফিরবে? লকডাইন
কতদিন চলবে তার তো কোনো
ঠিক নেই...। এলা বলতে
থাকে। চেঁচাতে থাকে।
কাঁদতে থাকে ফোনে।
অর্ক শান্ত মুখে হেঁটে
চলে মহাদ্বার রোড ধরে।
দুপাশের আশ্চর্য সব
বাড়ি ঘর, ছোটো ছোটো
মন্দির, সকালের শিশির
ভেজা গাছগাছালি,
পাখিদের কিচিরমিচির,
প্রায় তিনশো বছরে
পুরোনো মারাঠা ভোসলে
সাম্রাজ্যের ছড়িয়ে
থাকা নানান চিহ্ন দেখতে
দেখতে ও স্বপ্নের এলার
হাত ধরে ঢুকে পড়ে ওর
নিজস্ব সুড়ঙ্গের
মধ্যে। এলাও চুপ করে
হাঁটতে থাকে ওর পাশে।
দুচোখে নতুন জায়গা
দেখার বিস্ময়। এলার
পিঠের পরে লম্বা
বিনুনি। দু ভুরুর মাঝে
টিপ। ওর ডান হাতের
আঙ্গুলগুলো আলতো করে
জড়িয়ে আছে অর্কর
বাঁহাতের আঙুলগুলোকে।
এলা কি হাঁটতে হাঁটতে
নিজের মনে গুনগুন করছে!
অর্ক যেন শুনতে পায়, আজু,
সখি, মুহু মুহু, গাহে পিক
কুহু কুহু... ।
এলা ফোন করে এখন যাই
বলুক, যতই রাগারাগি
করুক অর্কর আর কিছুই
যায় আসে না।