চিলেকোঠা থেকে মধ্যম
স্বরে ও ডাকলেও তাতে
চাপা একটা উচ্ছ্বাস
ছিল। আমি বুঝে গেলাম
অন্যরকম কিছু একটা
হয়েছে।
আজ তিনদিন হলো নতুন এই
বাড়িতে আমরা এসেছি।
হ্যাঁ, আমি সচেতনভাবেই
'বাড়ি' শব্দটি ব্যবহার
করলাম। আজ থেকে প্রায়
বছর দশেক আগে এদেশে
এসেছিলাম স্টুডেন্ট
ভিসা নিয়ে, শেষ
গ্রীষ্মের এক ভোরে। সেই
ভোর থেকেই এই শহরে
নিজেকে স্থায়ী করতে
জন্য আমি প্রাণপণ
চেষ্টা করে গিয়েছি।
অবশেষে শহরের পাশে
শহরতলীর এই ওয়ান
ফ্যামিলি হাউজটি আজ
তিনদিন হলো আমাদের
স্থায়ী একটা ঠিকানা
দিলো।
মানে, ১১২৫ টেরি রোড,
রনকনকমা, নিউইয়র্ক, এটা
জেনি আর আমার স্থায়ী
ঠিকানা।
নিউইয়র্ক শহরের তুলনায়
এই জায়গাটা অনেক
নিরিবিলি। আর পেছন
উঠোনে দাঁড়ালে কয়েক হাত
দূরে বন দেখা যায়।
হেমন্তে সেখানে হরিণের
দল ঘুরতে আসে।
ব্যস, এতটুকুই যথেষ্ট
ছিল জেনির এই ঠিকানাটা
স্থায়ী করে নেবার জন্য।
শুধু তাই নয়, কোনোরকম
রেনোভেট ছাড়াই এ বাড়িতে
উঠে এসেছি খুব তাড়াতাড়ি
ওর জোরাজুরিতেই।
' হেমন্ত আসতে খুব বেশী
দেরী নেই। হরিণগুলো
নিশ্চয় প্রতিদিন আসবে
না। রেনোভেট করতে মাস
দুয়েক লেগে যাবে। তার
দরকার নেই। বাড়িটা আমরা
একটু একটু করে গুছিয়ে
নেবো।'
তাই অসংখ্য টেপ লাগানো
বক্স আর অল্পকিছু আসবাব
নিয়ে আমরা এই শহরতলীতে
চলে এসেছি। হেমন্তে
দু'জন পেছন উঠোনে
সামুদ্রিক মাছ বার বি
কিউ করতে করতে হরিণ
দেখবো।
ঘর ভর্তি অসংখ্য বক্স
আনপ্যাক করতে হিমশিম
খাচ্ছিলাম। তাই আপাতত
জেনির ডাকে চিলেকোঠায়
ছুটে যেতে পারছি না।
' তুমি, বইয়ের বক্সগুলো
যতটুকু পারো আনপ্যাক
করে চলে আসো। আমি
কুকওয়্যার গুলো
আনপ্যাক করছি।'
এটুকু বলা শেষ করার
আগেই জেনি প্রায় দৌড়ে
উপর থেকে নেমে এলো।
' আমি খুব সুন্দর একটি
জিনিষ পেয়েছি।'
এরপর আমাকে অবাক করে
দেবার ভঙ্গি নিয়ে সামনে
তুলে ধরলো একটি শোপিস।
আমি দেখলাম একটি পরী।
সাদারঙের পোর্সিলিনের
একটি পরী। পরীটার বুকের
মধ্যে একটি ছোট্ট
খোরগোশ।
আমি বললাম, ' এটা মনে হয়
আগের মালিক গার্বেজ
করতে ভুলে গেছে। তুমি
ফেলে দাও।'
' তুমি এটা ভাল করে
দেখেছো?'
' হ্যাঁ, একটা পুরাতন
শোপিস। যার রঙ ফেইড হয়ে
কালচে হয়ে গেছে।'
জেনি আমার কথায় একটু মন
খারাপ করলো। ওর সব
উৎসাহ দ্বিগুণ করতেই
আমি সবসময় উৎসাহী। আজই
মনে হয় প্রথম আমি খুব
একটা ওর উৎসাহে রঙ
চড়ালাম না। আসলে অসংখ্য
প্যাকিং বক্সে
হাবুডুবু খাওয়া এই সময়ে
আমি কোনোভাবেই এক
মুহূর্ত নষ্ট করতে
চাইছি না।
জেনি মন খারাপ করেছে
কীনা এটা বুঝতে বললাম,
'ব্রুশেতা,
মিটবল-গার্লিক সস আর
ফোকাশিয়া ব্রেড অর্ডার
করবো? লাঞ্চের জন্য।'
নিজের দেশীয় খাবারের
কথা শুনলেই লাফিয়ে ওঠে
জেনি। আজও তার
ব্যতিক্রম হলো না। গলায়
আহ্লাদ ঢেলে বললো,
'আমার সাথে থেকে তুমিও
ইতালিয়ান হয়ে যাচ্ছো।
ডেজার্টে তিরামিশু যোগ
করে দাও।'
জেনি শোপিস টা নিয়ে
আবার চিলেকোঠায় ফিরে
গেলো।
এরপর পোর্সিলিনের
পরীটির কথা আমি ভুলে
গেলাম। কারণ আমার ছুটি
দু'দিন পরেই ফুরিয়ে
গেলো। সারাদিন
ইনভেনটোরি ম্যানেজার
হিসেবে কোম্পানির
প্রোডাক্ট হিসেব করে
ফিরে জেনিকে সঙ্গে নিয়ে
নতুন বাড়ি গোছানোয়
ব্যস্ত হয়ে পড়তাম।
চিলেকোঠা বরাদ্দ করা
হলো আমাদের
স্টাডিরুমের জন্য।
যদিও এটা নিয়ে আমাদের
দু'জনের মতভেদ ছিল।
চিলেকোঠাটি খুব ছোট্ট
আর উচ্চতায় খুব নীচু।
আমি জেনিকে বোঝানোর
চেষ্টা করলাম এটি শীত
বা গরম কোন সময়েই
আরামপ্রদ হবে না।
' চিলেকোঠাকে আরামপ্রদ
বানানোর দায়িত্ব আমার।
আমি তোমার ধারণা পালটে
দেবো।'
জেনির এই আত্মবিশ্বাসী
কথায় আমি ভরসা পেলাম।
চিলেকোঠাকে উপযুক্ত
স্টাডিরুম বানানোর
দায়িত্ব পুরোটাই ওকে
দিয়ে দিলাম।
দায়িত্ব পেয়ে জেনিও খুব
আগ্রহী হয়ে উঠলো
চিলেকোঠা রেনোভেশনে।
পিচফলের মতো রঙ পড়লো
পুরাতন রঙচটা সাদা
দেয়ালে। পুরাতন মেরুন
রঙের কার্পেটের জায়গায়
এলো স্যাফায়ার ব্লু
কার্পেট। একপাশে অফ
হোয়াইট র্যাগ আর
মাল্টিকালার পিলো
রাখলো আরামের কথা ভেবে।
লো সিলিং এ কাঁচের
জানালাগুলো একই রাখলো
আলোর জন্য। ফ্লোর
ল্যাম্প রাখা হলো
দু'টো। আর ক্লোজেট
সরিয়ে বিল্ট ইন
বুকশেলফ।
জেনি একটি আদর্শ পড়ার
ঘর উপহার দিতে চাইলো
আমাকে।
তবে এই চিলেকোঠা বা
স্টাডি রুম যে নামেই
ডাকি না কেন সেটা
আমাদের জীবনে ঠিক কতটা
পরিবর্তন আনতে চলেছে,
তা তখনো আমার ধারণার
বাইরে।
রেনোভেশনের পর প্রথম
যেদিন জেনি আমাকে অবাক
করে দিতে চিলেকোঠায়
ডেকে নিলো আমি অবাকের
চেয়ে বিরক্ত হলাম বেশী।
বুকসেলফের একটি তাক
পুরোটাই দখল করে আছে
দেড় ফুটের সেই
পোর্সিলিনের পুরাতন
পরীটি। আর সেটা এই ঘরে
এতটাই বেমানান ছিল
যে,ঘরের যে কারোরই
মনোযোগ আকর্ষণ করার
জন্য যথেষ্ট।
বিরক্তিটুকু আড়ালে
রেখে খুব শান্তভাবে আমি
জিজ্ঞাসা করলাম,
' তোমার কী মনে হচ্ছে না
পরীটি খুব অহেতুক
এখানে?'
জেনি মাথা নীচু করে
কিছু একটা ভাবলো। এরপর
আমার মনোযোগ অন্যদিকে
নিতে প্রশ্ন করলো,
' পিচ রঙের সাথে
স্যাফায়ার ব্লু
কন্ট্রাস্ট কেমন
হয়েছে?'
আমি বুঝে নিলাম জেনী
কিছু লুকোতে চাইছে। আমি
এগিয়ে গিয়ে ওর কাঁধে
হাত রাখলাম। এরপর
আহ্লাদ করে বললাম,
' আমার জেনি, পৃথিবীর
সেরা ইন্টেরিয়র
ডিজাইনার। শুধু তাই নয়
পৃথিবীর সবচেয়ে সরল
মানুষটিও আমার জেনি।'
শেষের লাইনটিতে অবশ্য
ভনিতা ছিল না। সেটি
আমার মন থেকে অবলীলায়
বেরিয়ে এলো।
জেনি একটু ভাবুক হয়ে
উঠলো। আমার হাত নিজের
হাতের ভেতর নিয়ে খুব
ধীর লয়ে বললো,
' আমি তোমার কাছে একটা
কথা লুকিয়েছি। তুমি
বিশ্বাস করবে না এজন্য
বলিনি।'
আমি মুখে হাসি ঝুলিয়ে
বললাম,
' আমি বিশ্বাস করবো,
বলো।'
' আমি সেদিন একটা স্বপ্ন
দেখলাম। একটা ফুটফুটে
বাচ্চা। মাথায়
কোঁকড়ানো কালো চুল,
গোলাপি ঠোট আর হাতের
তালু। খিলখিল করে
হাসছিলো। তোমার আর আমার
মাঝখানে বসে খেলছিলো।
হঠাৎ বাচ্চাটার কিছু
একটা হলো। খেলা ফেলে
হামাগুড়ি দিয়ে চলে গেলো
কিচেনের দিকে। আমরা ঘর
থেকেই ওর হাসি শুনতে
পারছিলাম। ওর হাততালির
আওয়াজ পাচ্ছিলাম। এরপর
হঠাতই সব আওয়াজ থেমে
গেলো। কিছু সময় আমি
অপেক্ষা করলাম। না,
কোনো শব্দ নেই। আমি
অধৈর্য্য হলাম। দৌড়ে
কিচেনে গেলাম। সেখানে
কিছু ছিল না। শুধু এই
পরীটি মুখ থুবড়ে
পড়েছিলো।'
হড়বড় করে বলে গেলো
জেনি। আমি জানতাম
এরপরেও গল্প বাকী আছে।
তাই প্রশ্নবোধক চোখে
তাকিয়ে রইলাম,
' স্বপ্ন শেষ হবার পর সে
রাতে আমি কিচেনে
এসেছিলাম। সেখানে
সত্যিই পরীটি মুখ থুবড়ে
পড়েছিলো।'
আমি বুঝতে পারলাম
জেনিকে এখন কিছু বুঝিয়ে
লাভ হবে না। আমি তাই ওর
মনের বাকী কথাগুলো আমার
ভাষায় বলে দিলাম,
' এজন্যই তুমি এই
পোর্সিলিনের পরীটা
রেখে দিতে চাও। তুমি
ভাবছো এটি বিশেষ
কিছু।'
উত্তরহীন জেনীর চোখের
কাতরতায় আমি বুঝে গেলাম
ও এখন আমাদের সন্তানের
কথা ভাবছে। যে জন্ম
নেবার আগেই
'মিসক্যারেজ' নামক
শব্দটি দিয়ে একটি গভীর
ক্ষত রেখে গেছে জেনির
মনে।
আমি জেনিকে ভরসা দেবার
ভঙিতে ওর কাঁধে হাত
রেখে বললাম,
'আমি ভুল বলেছিলাম। ওটা
মোটেও বেমানান নয়।
থাকুক পরীটা এ ঘরে।'
ব্যস, এতটুকুই বললাম।
পরীটি এরপর মহা সমারোহে
আমাদের জীবনে প্রবেশ
করলো।
এদিনের পর চিলেকোঠায় বই
নিয়ে আলোচনা কম পরীটিকে
নিয়ে কথা বেশী হতো।
' আজ বিকেলে প্লামফলের
রঙের মতো রোদ পড়েছিলো
ছাদ জানালা দিয়ে পরীটার
উপর। আমি তখন স্পষ্ট
দেখলাম পরীটি হাসছে
আমার দিকে তাকিয়ে।'
অথবা,
' আজ বৃষ্টি জল ছাদ
জানালা ঢেকে রেখেছিলো।
ভেতরের আলো আঁধারে আমার
মনে হলো পরীটির পাখা
দুটো একটু নড়ে উঠলো।'
আমি বুঝতে পারছিলাম
পোর্সিলিনের পরী নিয়ে
জেনি অবশেসড্ হয়ে উঠছে।
কী করা উচিত তা নিয়ে
দ্বিধা বাড়ছিলো আমার।
আর ঠিক তখনি আরেকটি
ঘটনায় আমাদের জীবনের
অনাগত দিনগুলো
পুরোপুরি পোর্সিলিনের
পরীটির নামে হয়ে গেলো।
শীতের রবিবার। হেমন্তে
আয়েশ করা হরিণ দেখা শেষ
আমাদের ততদিনে। তাই এই
রবিবারগুলো কর্মহীন
আমাদের। আমি
নেটফ্লিক্সে আয়েশ করে
সিরিজ দেখি। আর জেনি
সময় কাটায় চিলেকোঠায়।
আমি দেখছিলাম
'উইন্ডসর'। মন ডুবিয়ে
দিয়েছি ইতিহাসের সেই
সময়ে। আর ঠিক তখনি জেনি
চিৎকার করে আমাকে ডাকতে
ডাকতে নেমে এলো
চিলেকোঠা থেকে।
হাতে একটি ছোট্ট লাল
ফুললতা নকশী তোলা ভাজ
করা লাল রুমাল। খুব
খেয়াল করে দেখলে বোঝা
যায় বিভিন্ন রঙের সুতোর
নকশীগুলো কাঁচা হাতে
তোলা। খুব একটা আগ্রহ
পেলাম না আমি। উইন্ডসর
মন রেখেই হালকা করে
কয়েকটি শব্দ ভাসিয়ে
দিলাম জেনির জন্য,
' এটা রুমাল। কেউ সুঁই
সুতোর কাজ শিখেছিলো
এটাতে।'
আমাকে উইন্ডসরে মন
বসাতে দিতে চাইলো না
জেনি। একদম সামনে এসে
দাঁড়িয়ে হাতের
রুমালটির ভাজ খুললো।
এবার আমার অবাক হবার
পালা। ভাজ খুলতেই বোঝা
গেলো সেটি একটি ছোট
নোটবুক। যার কভার
বানানো হয়েছে লাল কাপড়ে
লতাপাতার নকশী তুলে।
এরকম কভার আমি আগে
দেখিনি। তাই আমার সব
আগ্রহ ওখানেই।
' বেশ সুন্দর তো! কোথায়
পেলে এটা?'
আমার প্রশ্নটির উত্তর
না দিয়ে জেনি আবার গল্প
ফাঁদলো পরীর।
' আমার কী মনে হচ্ছে
জানো? পরীটি আমাকে কোনো
ম্যাসেজ দিতে চাইছে।'
উইন্ডসরে মন বসানোটাই
আমার উপযুক্ত মনে হলো।
আমি নীরব থেকে চোখ
ফেরালাম টিভির
পর্দায়।
জেনি আমাকে খুব ভাল
বোঝে। অন্যদিন হলে আর
কথা বাড়াতো না। কিন্তু
আজ এমনটা হলো না।
' এই নোটবুকে কী লেখা আছে
বলবে আমাকে?'
এ কথার উত্তরে জেনির
দিকে না তাকিয়েই আমি
বললাম, '
'তুমি পড়ে নাও।'
' লেখার ভাষা আমার
পরিচিত হলে কী তোমাকে
বলতাম?'
এবার একটু উষ্ম গলা
জেনির।
বিরক্ত হয়ে পজ বাটন
ক্লিক করলাম
উইন্ডসরে।
' কী ভাষা যা তুমি চেনো
না আমি চিনি?'
হাত বাড়িয়ে নিলাম
নোটবুক। নোটবুকের
প্রথম পাতাতেও দেখলাম
ফুললতা আঁকানো।
দোয়াতের কালি দিয়ে। আমি
পাতা উল্টালাম।
' ভাষা টা কী বুঝতে
পারছো?'
জেনির এই প্রশ্ন আমার
কাছে পৌঁছানোর আগেই আমি
ওর দিকে ছুড়ে দেলাম
আমার প্রশ্নটি।
' কোথায় পেলে এটা?'
' তোমাকে তো বললাম,
পোর্সিলিনের পরী আমাকে
কোনো ম্যাসেজ দিতে
চাইছে।'
এই সময় জেনির হেয়ালি
আমার ঠিক ভাল লাগছিলো
না। ততক্ষণে নোটবুকে
লেখা ভাষাটা আমাকে এক
গোঁলক ধাঁধায় ফেলে
দিয়েছে। আমি কিছুটা
বিরক্ত হয়ে বলি,
' আহা, এখন পরীর কথা নয়।
এটা কোথায় পেলে সেটা
বলো।'
জেনি যেন আরোও উৎসাহ
পেয়ে গেলো।
' সেটাই বলছি, শোনো। আমি
স্টাডিরুমে ছিলাম।
একটা বই শেলফ থেকে নিতে
গিয়ে পরীটা পড়ে গেলো
ফ্লোরে।'
আমি ধৈর্য্য হারালাম।
তবুও নিজেকে সংযত করে
বললাম,
' নোটবুক টা কোথা থেকে
পেলে,সেটা বলো।'
জেনি আবার শুরু করলো।
' এর আগে কখনো এমন হয়নি।
আমি পরীটাকে তুলে সেলফে
রাখতে গেলাম। তখন খেয়াল
করলাম হাতে জড়িয়ে রাখা
খোরগোশটি খুলে এসেছে।
ওটা ঠিক করতে গিয়েই
পেলাম এই নোটবুকটি।'
এই বাড়িটার পূর্ববর্তী
মালিক একজন বিহারী
মুসলিম ছিলেন। সেই
পরিবারে কেউ কি ছিল যে
এই ভাষার সাথে পরিচিত
ছিল? নোটবুকের কাগজগুলো
দেখলেই বোঝা যায়, এটি
অনেক পুরোনো।
' তুমি বুঝতে পারছো কী
লেখা আছে ওখানে?'
আমি তাকালাম জেনির
দিকে। এরপর মৃদূ মাথা
নেড়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর
দিলাম।
' জেনি, আমি সত্যিই খুব
অবাক হয়েছি। এই
পোর্সিলিনের পরীটা
এখানে কীভাবে আসলো? এটা
নির্ঘাত পূর্বের
মালিকের নয়।'
জেনি আমাকে দেখে কী
বুঝলো কে জানে। আমার
পাশে এসে বসে বললো,
' পরীটা কিছু বলতে চাইছে,
সেই প্রথম দিন থেকে।
তুমি যদি ভাষাটা পড়তে
পারো তাহলে হয়তো তোমার
প্রশ্নের উত্তর পাবে।'
আমি সম্মোহিতের মতো পড়া
শুরু করলাম।
' আজ দাদাভাই তাড়াতাড়িই
বাড়ি ফিরেছে। সন্ধ্যার
আগেই। বৈঠখানার
জানালায় তখন আমি
দাঁড়িয়ে ছিলাম। বর্ষার
বৃষ্টি এবছর একটু
বেশীই। সামনের বড়
রাস্তার ওপাশে পুকুর।
সেখানে কয়েকটি পাখি
চক্কর খেয়ে অন্যপাশে
উড়ে গেলো। লোহাড় গেট
ঠেলে ভেতরে দাদাভাই
ঢুকলো আধা ভেজা হয়ে।
হাতে একটা ব্যাগটা একটু
সামনে এগিয়ে মাকে
ডাকলেন
ব্যাগটা ধরো আগে।
মা এগিয়ে গেলেন একটি
শুকনো কাপড় নিয়ে,
দাদাভাইয়ের দিকে।
যেদিন থেকে
সংবাদপত্রের অফিসে
দাদাভাই জয়েন করেছেন
ব্যাগটা তার সাথে
থাকে।
'ওদিক থেকে কোনো খবর
পেলি?' মায়ের এই খবর
পাবার প্রত্যাশা আজ বছর
তিনেক হলো চলছে।এই
প্রশ্নের উত্তর যা আসে
তাতে আমি অপ্রস্তুত হই
না। তবে আমি নীরবে
সেখান থেকে সরে যাই।'
এ পাতায় এতটুকুই লেখা।
আমি পাতা উল্টায়।
সেখানে আবার কয়েকটি
ফুল, লতা আঁকানো। আমি
তাড়াহুড়ো করে আবার পাতা
উল্টায়।
'আজ সারাদিন বাড়িটা
নিঃস্তদ্ধ ছিল।
শব্দহীন বাতাস ঘুরপাক
খাচ্ছিলো এঘর থেকে ওঘর।
রেডিওটাও আজ ঠিকঠাক
চ্যানেল না ধরতে পেরে
নিশ্চুপ ছিল। আমার এই
নিঃস্তব্ধতা ভাল
লাগে।কোলাহোল থেকে
ভেসে আসা ফিসফিস
শব্দগুলোই বরং আমাকে
বিব্রত করে বেশী। মা আজ
সকালেই বড় খালার বাসায়
গিয়েছেন। ও বাড়ি থেকে
সম্মতি এলো কীনা
জানতে।'
এরপর বেশ কয়েক লাইন
ফাঁকা। কিছু লেখা নেই।
এককদম শেষ দু'লাইনে
লেখা।
' মা ফিরে খুব
কান্নাকাটি করেছেন।
তবে আমার কান্না পাই
না। আমি বিব্রত হই
শুধু।'
'আজ খুব ঝড় হলো সকালে।
কড়ই পাতা জমে ছাদের
নর্দমার মুখ বন্ধ হয়ে
পানি জমে যায় ছাদে।
এরকম বরাবর হয় ঝড় হলেই।
আমি খুঁচিয়ে নর্দমার
মুখগুলো খুলে দিতেই জমা
পানি জল প্রপাতের মতো
নীচে পড়তে লাগলো। আমি
সেই শব্দকে অগাহ্য করে
সামনের সবুজ পুকুরের
ওপাড়ে তাকালাম। এই ছাদ
থেকে বাড়িটির পূর্বকোণ
দেখা যায়। যেখানে একটি
লিকলিকে মাধবিলতা গাছ
বেয়ে ছাদে উঠে গেছে।
আমাদের বসার ঘরের
রেডিওতে সকালের খবর
হচ্ছিলো, 'সাংবাদিক
পুনর্বাসনে
রাষ্ট্রপতি
প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।'
দাদাভাইয়ের কথা ভেবে
আশ্বস্ত হলাম। দাদাভাই
এই পেশাটি বড় দুঃসময়ে
বেছে নিয়েছেন। তবে তাঁর
ভাষায় তিনি কলমকেই বেছে
নিয়েছিলেন যুদ্ধের
হাতিয়ার হিসেবে। যুদ্ধ
দাদাভাইকে যোদ্ধা
বানিয়েছে। আর আমাকে......'
অসমাপ্ত এই বাক্যটির
শেষে কলম দিয়ে কয়েকটি
কালো দাগ।
আমার আগ্রহ ক্রমেই
বাড়ছে। বিনা অনুমতিতে
কারো ব্যক্তিগত
দিনলিপি আমি পড়ছি এটা
একবারের জন্যও আমাকে
অনুতপ্ত করলো না।
আবার তাড়াহুড়ো করে পাতা
উল্টালাম।
' জানালার শার্সিতে
কয়েকটি চড়ুই আজ
খেলছিলো। আর বাইরে
ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি।
আমার কাছে যে কোনো
কোলাহলই বিব্রতকর। তবে
চড়ুইগুলোকে দেখতে
খারাপ লাগছিলো না।
'অভিশপ্ত' হ্যাঁ আমি
ঠিকই শুনেছি। মা এটাই
বলছিলো। দাদাভাইয়ের
ধমকে মা একটু সময় থামলো
এরপর আবার বললো, একটা
ব্যবস্থা করো। না হলে
তোমার ভবিষ্যতও নষ্ট
হয়ে যাবে। আমি মনে মনে
হাসলাম। আমার জীবনটা
সত্যিই দাদাভাইয়ের
সাথে জড়িয়ে গেছে।
সেদিনও দাদাভায়ের
কর্মের ফল আমাকে দেবে
বলেই ওরা ধরে নিয়ে
গিয়েছিলো। দাদাভাই
অবশ্য একটা উপায় বাতলে
ফেলেছে। আমাকে নিয়ে
ওদেশে যাবে। মেজোচাচার
বাড়িতে। এদেশে আমার
বিয়ে হবে না।'
জেনি খুব মন দিয়ে
শুনছিলো। এই প্রথম একটি
প্রশ্ন করলো। বিয়ের
জন্য দেশ ছাড়তে হবে
কেন?
আমিও সেই একই প্রশ্ন
নিয়ে পাতা উল্টালাম।
' আজ ছাদে গিয়ে অনেকক্ষণ
ও বাড়িটার দিকে তাকিয়ে
ছিলাম। একবার ইচ্ছে হলো
সাহস করে ও বাড়িতে চলে
যাই। ওই বাড়িটা তো আমার
ঠিকানাও। ওখানে গেলে
হয়তো আমার একটি
ব্যবস্হা হবে। কথাগুলো
মাকে বলতেই মা হইচই করে
বাড়ি মাথায় তুলে নিলেন।
আমি 'অভিশপ্ত' সে কথা
বারবার মনে করিয়ে দিয়ে
বললেন, এমনিতে কোনো
বাড়িই দেখে গিয়ে খবর
দেয় না। নিশ্চয় তারা
সত্যিটা জেনে যায়। নতুন
করে লোক আর জানানোর
প্রয়োজন নেই বলে, মা
আমাকে শাষণ করলো। ভোরে
দেশ ছাড়তে হবে সেজন্য
প্রস্তুতও হতে বললো।'
এরপরের পাতায় একটি
ঠিকানা
লেখা।
' সালাউদ্দিন আবু আসাদ
বহরমপুর বাজার,
বর্ধমান'
আমি পাতা উলটে পরের
পাতায় চলে গেলাম।
' আজ তিনদিন হলো এদেশে
এসেছি। এটাই আমাদের আদি
বাড়ি। দাদা দাদীর কবর
আছে পুকুরের ঐ কোণায়।
এই বাড়ি ছেড়ে আব্বা
১৯৪৬ সালে ঢাকা চলে
গিয়েছিলেন রেলওয়ের
চাকরী নিয়ে। এরপর দেশটা
দু'ভাগ হয়ে এদেশ আর ওদেশ
হয়ে যায়। আব্বা এদেশে
আর ফেরেননি। আমিও কবে
ওদেশে ফিরবো জানা নেই।
ওইদেশ ওইবাড়ি কেমন আছে
তাও জানা নেই। হ্যাঁ সে
বাড়িটার কথাই ভাবছি
এখানে আসা অবধি। সেদিন
সন্ধ্যাতেও একবার ছাদ
থেকে বাড়িটা
দেখেছিলাম। মাধবীলতার
ঝাড়ে কয়েকটি ফুলও ছিল
মনে হয়। আমি দেশত্যাগ
করার প্রস্তুতির জন্য
তাড়াতাড়ি নেমে
এসেছিলাম ছাদ থেকে। সব
গোছাতে মধ্যরাত হয়ে
গিয়েছিলো। বৈঠকখানায়
গোছানো শেষে শতরঞ্জি
পেতে ভাত খাবার
ব্যবস্থা হয়েছিলো।
পানি আনতে রান্না ঘরে
যাবার সময় জানালা দিয়ে
মানুষশূন্য রাস্তাটায়
চোখ আটকে গেলো। কয়েকটি
হাড় জিরজিরে কুকুর
ঘুরছিলো। মুহূর্তের
জন্য মনে হলো ওরা
অনন্তকাল ওখানেই আছে।
আমি পানি নিয়ে
শতরঞ্জিতে এসে বসতেই
ঘরের লাইট টা ফিউজ হয়ে
গেলো। জানালা দিয়ে ও
বাড়ি থেকে আলো এসে
পড়ছিলো আমাদের
ভাতগুলোর মধ্যে। আমরা
চুপচাপ খাওয়া শুরু
করলাম। হঠাতই রাস্তায়
কিছু গাড়ির শব্দ।
নিস্তব্ধ সময়টার গলা
চেপে ধরলো। এরপর কিছু
সময় আবার সব চুপচাপ।
পড়ে জেনেছি ওগুলো
ট্যাংক ছিল। তারপর
হঠাতই গুলির আওয়াজ। মা
আর দাদাভাই আতংকিত হলো,
কিন্তু আমি নই। আসলে
ওদের হাতে বন্দি থাকার
সময়ই আমার সব অনুভূতি
মরে গেছে। এখন আমি শুধু
বিব্রত হতে জানি। আমরা
সবাই খাবার কথা ভুলে
গেলাম। ও বাড়ির
মানুষগুলোর একটু আধটু
চিৎকার ভেসে আসতে শুরু
করলো। দাদাভাই কাঁপতে
কাঁপতে মেঝেতে শুয়ে
পড়লো। একদম শেষে ভেসে
এলো একটা বাচ্চার
চিৎকার। এরপর দীর্ঘসময়
সব নিঃশ্চুপ।
এই নিঃস্তব্ধতা আমার
অসহ্য লাগছিলো।
তারপর হঠাতই রাস্তায়
কুকুরগুলোর ঘেউঘেউ। এই
প্রথম কোলাহলে আমি
বিব্রত হলাম না।
সেদিন ভোর পর্যন্ত আমরা
সেভাবেই বসে থাকলাম।
সূর্য উঠতেই দাদাভাই
রেডিও ছাড়লো।
শব্দহীন আর নিস্তব্ধ
সময়টুকু আমাদের গিলে
নিতে চাইলো।
আমি দ্বিতীয়বারের মতো
ঠিকানা হারা হলাম।
ঠিকানাটা ছিল:
বাড়ি নম্বর# ১০, রোড# ৩২
ধানমন্ডি।
আমি প্রথমবার ঠিকানা
হারিয়ে ছিলাম ১৯৭১ এর
১৩ই সেপ্টেম্বর। যেদিন
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে
কলম ধরার অপরাধে
দাদাভাইকে খুঁজতে এসে
না পেয়ে আমাকে ক্যাম্পে
নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো।'
আমি থমকে গেলাম। একটা
দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো
আমার অজান্তে। জেনি
আলগোছে আমার আমার কাঁধে
হাত রাখলো।
' ক্যাম্পে নিয়ে
গিয়েছিলো কেন?'
আমি জেনিকে বলতে শুরু
করলাম মুক্তিযুদ্ধের
কথা, , বীরাঙ্গনাদের কথা,
আগষ্টের কথা।
' তোমার দেশের
মানুষগুলো নিজেদের
এ্যাঞ্জেলকে হত্যা
করেছে?'
আমি উত্তরহীন হয়ে মাথা
নীচু করলাম।
জেনিও নিজের
দীর্ঘশ্বাস লুকালো
আমাকে অপ্রস্তুত হতে
দেখে। এরপর বললো,
'এই নোটবুকটি তাহলে
একজন পরীর। কী নাম ছিল
তাঁর?'
আমার তখনই খেয়াল হলো
লেখাতে কোথাও তাঁর নাম
পাইনি আমি। আবার
নোটবুকের পাতা উল্টাতে
লাগলাম, নাম খুঁজে
পাবার আশায়।
এরপরের প্রায় সব পাতা
ফাঁকা। শুধু শেষ পাতায়
লেখা,
' এক বিহারী মুসলিম
পরিবারে আমার বিয়ে ঠিক
হয়েছে, সবকিছু গোপন
রেখে। দাদাভাই বলেছে,
আমি যেন আর কোনোদিন না
লিখি। এই নোটবুকও
পুড়িয়ে ফেলতে বলেছে।
তবে বিয়ে ঠিক হবার পর
আম্মা বদলে গিয়েছে।
আমাকে আর অভিশপ্ত বলে
বোকে না। সেদিন কোথা
থেকে একটি পরীর মতো
পুতুল এনে আমাকে দিলেন।
বললেন, রেবা দেখ
কোলকাতা থেকে এটা
এনেছি। আম্মার এই
আহ্লাদে অনভ্যস্ত আমি
একটু অবাক হলাম। বললাম,
আমার পুতুল খেলার বয়স
নেই আম্মা। কথাটা শুনে
আম্মা মন খারাপ করলো
না। বরং খেলনা পরীটা
দু'টুকরোয় খুলে দেখিয়ে
দিলো একটা গোপন কুঠুরি।
বললো, এখানে রেখে দিস
নোটবুকটা। আবার কখনো
লিখতে চাইলে লিখবি।'
ব্যস এতটুকুই। নোটবুকে
এটাই ছিল শেষ লেখা।
এরপর আর কখনো তিনি
লিখেছিলেন কীনা তা
আমাদের জানা হয় না।
তবে কালো কোঁকড়ানো চুল,
গোলাপি ঠোট আর নীল
চোখের রেবা এখন আমাদের
ঘরে খেলা করে।
জেনি সেদিনই বলে
দিয়েছিলো আমাদের মেয়ে
সন্তাানের নাম হবে
রেবা।
ছবি ঋণ: হুগো
সিমবার্গের দ্য উন্ডেড
এঞ্জেল