চিত্র : ১৭ ক, জ্যাকসন
পোলক
গড়পড়তার সব মানুষই মনে
করে নীল হলো বেদনার রং।
গড়পড়তার সব মানুষই মনে
করে লাল হলো বিপ্লবের
রং। গড়পড়তার সব মানুষই
মনে করে সাদা হলো
পবিত্রতার রং। গড়পড়তার
সব মানুষই মনে করে কালো
হলো অন্ধকারের রং।
এইখান থেকেই শুরু হলো
ঝগড়া।
লাল বললো, সম্পূর্ণতই
এবং মূলতই এগুলো খুব
বাজে আর একঘেয়ে ধারণা।
আই মিন জিজ আর ক্লিসে
থটস। লাল কি কেবল
বিপ্লবের ঝাণ্ডা হয়ে
থাকবে? লাল কি কেবল
আগুনের প্রতীক হয়ে
থাকবে? এই যে একটা গ্রহ
তার নাম তো মঙ্গল, সে তো
লাল, তাই না? লাল গোলাপ
কি পৃথিবীর মিষ্টিতম
জিনিস নয়? মানুষ নেহাতই
নির্বোধ একটা জাত। সব
কিছুকে সরল সূত্রে ফেলে
দেয়।’
কথাটা সবুজের ভালো
লাগলো না। সে বললো, তুমি
নিজে কেমন জাতের বলো হে?
তুমি তো এমন ঢালাও
মন্তব্য করতে পারো না।
দু’লাইন ইংরেজি বলতে
শিখে নিজেকে খুব আহামরি
কিছু ভাবছো! আরে ভাই,
অন্য জাতকে ছোট করে
দেখা নেহাতই একটা
বেয়াদবি। দেখো, আমার
বিবেচনায় মানুষ খুবই
বিবেচক জাতি।
মিষ্টিকুমড়া খেতে
মিষ্টি বলেই তারা তাকে
মিষ্টিকুমড়া বলে ডাকে,
বেগুন দেখতে বেগুনি
রঙের বলেই তাকে বেগুন
বলে ডাকে। মানুষের সব
কিছুর পিছনেই একটা
কার্যকারণ থাকে।’
লাল সত্যিই ক্ষেপে গিয়ে
বললো, কী যুক্তির বাহার!
করল্লা খেতে তিতা বলেই
তা করল্লা! এসব ফালতু
বাকোয়াজ ছাগলেও জানে।
পাগলেও জানে। ধরো তোমার
নাক বন্ধ করে দেয়া হয়
যদি, আর ধরো তোমার চোখ
বন্ধ করে দেয়া হয়, তাহলে
আপেল আর আলুর মধ্যে
তুমি কী কোন পার্থক্য
পাবে? কিন্তু ভেবে দেখো
আলুর রং আর আপেলের রং
কতোই না আলাদা। আসলে
আপেলের রং তোমাকে কী
বলে? আনন্দ? বেদনা? আলুর
রং তোমাকে কী বলে মাটি
নাকি একঘেয়ে পাথর? শোনো,
রঙ একটা গুরুত্বপূর্ণ
জিনিস। সেটাকে তুমি
হেলাফেলা করে দেখতে
পারো, কারণ তুমি নেহাতই
চোখের আরাম, তুমি সবুজ,
তুমি মিয়া লালের
মাহাত্ম কী বুঝবে!
হলুদ দেখলো পরিস্থিতি
খারাপ হয়ে যাচ্ছে। লাল
সবুজে ঝগড়া লেগে গেলে
ঝামেলা হয়ে যাবে। আদতে
লাল-সবুজ তো একটা
গুরুত্বপূর্ণ
কম্পোজিশন। হলুদ তাই সব
কিছু সামাল দেয়ার
চেষ্টাতেই বললো, দেখো,
যারা বর্ণ অন্ধ তারা
প্রায়শই হলুদ আর
গোলাপীর মধ্যে তর্ক
জুড়ে দিতে পারে কিংবা
বেগুনিকে বাদামী
ভাবতেই পারে। কিন্তু
বেগুন আর বাদাম এক নয়
যেমন সরিষা ফুল আর
গোলাওপ ফুল এক নয়।’
লাল, হলুদ, সবুজ কথা বললে
সাদা কি চুপ করে থাকবে?
তারও তো কিছু বলার
থাকতে পারে।
সে জ্ঞানী লোকের
ভঙ্গিতে বলে উঠলো, ও
আসলে রঙের ব্যাপারে
আমাদের সবারই
সীমাবদ্ধতা আছে। এমনকি
ঈশ্বরেরও। নিশ্চয়ই
তিনি অন্তত মানুষের রং
গুলানো নিয়ে আরেকটু
ভাবতে পারতেন। মানে
প্রেমিকটি যদি হলুদ
হতো, খুনিটি যদি সাদা
হতো, কবি যদি লাল হতো,
কেরানী যদি বেগুনি হতো,
কুমারী যদি নীল হতো,
যোদ্ধা যদি সবুজ হতো...
মানে এই রকম হতো আর হতোই
তাহলে ব্যাপারটা বেশ
সৃষ্টিশীল হতে পারতো।
রং বিষয়ে আমাদের
বিচ্ছিন্নতা থাকতো না,
ভুল ধারণা থাকতো না। যে
হেঁটে যাচ্ছে, যে
ঘুমাচ্ছে, যে
জন্মাচ্ছে, যে মারা
যাচ্ছে, যে চলে যাচ্ছে,
যে সুখে থাকছে তাদের
সবাইকে আমরা আলাদা রং
দিয়েই চিনে ফেলতে
পারতাম।’
সাদার উদ্ধত ভঙ্গিটি
মোটেই নীলের ভালো লাগলো
না। সে ক্ষেপে গিয়ে
বললো, ও আসছেন আমার
সক্রেটিস! বিরাট
জ্ঞানী! শোনো মিয়া, নতুন
যখন দাড়িমোছ ওঠে সবাই
নিজেরে বড় মনে করে।
তুমি হইলা সাদা। সাদা
কোন রং হইলো! আইছো পÐিতি
করতে। বোঝ না কিছু
ওলেরে কেউ লিচু।
নাস্তিকের মতো কইয়া
দিলা সৃষ্টিকর্তাও রং
বোঝো না। শালা ব্লগার।
তোমার মতো রঙহীন লোকের
পক্ষেই এই সব বলা
সম্ভব।’
‘দেখুন নীল সাহেব, আপনি
কিন্তু ব্যক্তিগত
আক্রমণ করছেন। সবাই
জানে সাদা মানেই
অত্যন্ত পুত পবিত্র,
ঠাস করে আপনি আমাকে
নাস্তিক বলতে পারেন
না।’
এবার কথা বলে উঠলো কালো
রং। সে বেশ উঁচু স্বরেই
বললো, সাদা রং যদি
পবিত্রই হয় তবে সকল
ইউরোপীয়,
স্ক্যান্ডেনেভিয়
লোকেরা পবিত্র আর
সুন্দর হতো। আর কালো রং
যদি অন্ধকারই হয় অশুভই
হয় তাহলে মার্টিন লুথার
কিং কিংবা প্যাট্রিস
লুলুম্বা কিংবা পল রবসন
কিংবা ধরো নেলসন
ম্যান্ডেলাকে তুমি কী
বলবে?
সাদা’র মেজাজ গেলো
খিচড়ে। তার আবার মেজাজ
খিচড়ে গেলে সে তোতলাতে
থাকে, ওঅঅঅই হালা কালা,
তুতুতুতুই কী বুঝস
রঙের! তুই রাইট রঙের
কিকিকিকিছুই বুঝোস
না...
‘তোরে আইজকা আমি...
কালো রঙ ঝাপিয়ে পড়তে
ঝাচ্ছিলো সাদা’র উপরে।
তখনই একটা সিগারেটের
ঝাঁজ তার নাকে এলো। সে
চোখের কোণা দিয়ে দেখলো
সিগারেটটা ফেলছেন
জ্যাকসন পোলক। তিনি ঘরে
ঢুকছেন। তার পা টলছে।
ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই নাক
দিয়ে শেষ ধোঁয়াটা
ছাঁড়লেন তিনি। তার চোখ
লাল, টাক মাথায় কয়েকটা
চুল তখনও বেয়াড়া রকমের
উসকোখুসকো।
জ্যাকসন পোলক একটা
বেয়াড়া লোকের মতো সারি
সারি রঙের কৌটার কাছে
এলেন। মেষপালকের মতো
তাকিয়ে দেখলেন থরে থরে
রাখা রঙের কৌটাগুলোকে।
তার ইচ্ছা করতে লাগলো,
নতুন নতুন রঙ তৈরি
করতে। মহাবিশ্বে যখন
মহাবিস্ফোরণ হলো তখন
মহাজগতের কী রঙ ছিলো!
পোলক আর কিছু ভাবতে
চাইলেন না। ভাবনার চেয়ে
তিনি কাজে বিশ্বাসী
বেশি। আজ তাকে অনেক কাজ
করতে হবে। কাল সারারাত
মদ খেয়েছেন তিনি। বারের
বাইরে পড়েছিলেন
অনেকক্ষণ। কেউ একজন
হয়তো বাসায় পৌঁছে দিয়ে
গেছে। কে পৌঁছে দিয়ে
গেছে তা তার মনে নেই।
মনে রাখাটাও অবশ্য
গুরুত্বপূর্ণ নয়। যেটা
গুরুত্বপূর্ণ তা হলো এই
দেয়ালটা ভাঙতে হবে।
ঘরটা ছোট। পোলক যা
আঁকতে চাইছেন তার চেয়ে
ছোট। বিশ ফুটের একটা
ক্যানভাসে তিনি রঙ নিয়ে
হুলুস্থুল করতে চান।
ঘরটা মাত্র বারো ফুট।
আহ, মাথার ভেতরে অনেক
অনেক রঙ গিজগিজ করছে,
যেন রঙেরা ঝগড়া করছে।
সারাটা সকাল কেটে গেছে।
এখন তার মাথার মধ্যে
ব্যথা করছে। এখন তার
মাথার মধ্যে রঙেরা ঝগড়া
করছে। আজ লি ক্রাশনারও
নেই, কোথায় যেন গেছে
মেয়েটা। ইদানিং লি কাছে
না-থাকলে পোলকের কেমন
একলা একলা লাগে। ধুর,
এতো সব ভাবনা তার ভালো
লাগে না। কাজ করতে হবে,
অনেক অনেক কাজ,
মহাবিশ্বের রঙগুলোকে
গুলে ফেলতে হবে, সব রঙ
তুলে ফেলতে হবে তুলিতে,
মাখিয়ে দিতে হবে
ক্যানভাসে। না, তুলিতে
কাজ হবে না।
পোলক রঙের কৌটাগুলোর
দিকে ক্ষুব্ধ চোখে
তাকালেন। যেন দৃষ্টি
দিয়েই সবগুলো রঙকে পোষ
মানাতে চান তিনি।
মেঝেতে ফেলে রাখা বিশাল
ক্যানভাসটায় নীল রঙের
কৌটাটা উপুড় করে দিলেন,
তার উপরে লাল রঙের
কৌটাটা ছুঁড়ে মারলেন।
নীলের উপরে লাল রঙের
ছুঁড়ে ফেলা কৌটা একটা
বিরাট ক্ষত চিহ্নের মতো
দেখালো। কোথাও নীল,
কোথাও লাল, কোথাও লালকে
খেয়ে ফেলছে নীল, কোথাও
নীলকে খেয়ে ফেলছে লাল।
এইবার লাল-নীলের এইসব
ছলাকলার উপর তিনি হলুদ
রঙ ফোঁটায় ফোঁটায়
ঢালতে লাগলেন। বিন্দু
বিন্দু হলুদ ছড়িয়ে পড়লো
পুরো ক্যানভাসে। আবার
দুইহাতে কালো ও সাদা রঙ
মোটা তুলিতে চুবিয়ে রঙ
ছিটাতে লাগলেন।
সাদা-কালোর আর্তনাদে
ভরে উঠলো ক্যানভাস।
পোলকের মুখে এখন হালকা
হাসি দেখা গেলো। তার
মাথা ব্যথা কমে যাচ্ছে।
ক্যানভাসের চেহারাটি
ক্রমশ তার মতো করে আদল
পাচ্ছে।
পোলক দেখলেন, আপাত
এলোপাথারি, কিন্তু আসলে
মহাবিশ্বের মতো তার
ক্যানভাসেও একটা ছন্দ
আছে, নিঁখুত বিজ্ঞান
আছে। ক্যানভাসের উপর
ক্রমশ গ্যালাক্সির পর
গ্যালাক্সি ভরে উঠলো
নক্ষত্র, গ্রহ, ধূমকেতু,
নিহারীকায় আর রঙেরা
পেলো তার আদি ভাষা।
বিবাদমান রঙগুলো
জ্যাকসন পোলকের হাতে
লক্ষী বালিকার মতো
চুপটি করে রইলো। তিনি
রঙগুলোকে নিয়ে এক
মহাবৈশ্বিক খেলা
খেলতেই থাকলেন।