লক্ষ্মীর ঝাঁপির ভেতর
রাখা আছে কড়ি। পাশে
রাখা সরা। সরায় ছবি,
রত্নাধার। গৃহস্থের
মঙ্গল চিহ্ন। দু’ছড়া
ধানের শীষ এলিয়ে রয়েছে
পাশে। দাওয়া জুড়ে
আলপনা। চালপিটুলি
দিয়ে। দুধসাদা পায়ের
ছাপ। ঘটের দু’পাশে।
মঙ্গলঘট। কানায় কানায়
জল। বিজোড় আমপাতা, ডাব।
প্রতীক ও পূর্ণতা।
ঈশ্বর অপেক্ষা করছে।
আমাদের খাওয়া হলে ঈশ্বর
খাবে। ১৬১ কিলোমিটার
দূরে আটকে পড়েছে জামলো
মাড়কাম। জামলো হাঁটছে।
জামলো এসে সরার সামনে
সাজিয়ে রাখা নকুলদানা
আর আমসত্ত্ব খাবে।
তিনখানা নাড়ু খাবে।
ঈশ্বর জানে। ১৫০
কিলোমিটার হাঁটছে
জামলো। ঈশ্বর অপেক্ষা
করছে। আর ১১ কিলোমিটার
হাঁটতে হবে জামলোকে।
আড়াই দিন ধরে হাঁটছে।
জামলো গত দেড় দিন প্রায়
কিচ্ছু খায়নি। যেটুকু
খেয়েছে, বমি হয়ে গেছে।
জামলো হাঁটা থামায়নি।
জামলোর বাবা, জামলোর
সঙ্গী আরও ১০ জন
হাঁটছে। ঈশ্বর জানে
জামলো আর ১১ কিলোমিটার
হাঁটলেই ঈশ্বর জামলোকে
দেখতে পাবে।
লক্ষ্মীমা’র হেন কথা
শুনি মুনিবর।
কহিতে লাগিল তারে জুড়ি
দুই কর।।
অপার করুণা তোমার আমি
ভাগ্যবান।
মর্ত্যলোকে নাহি দেখি
কাহার কল্যাণ।।
সেথায় নাই মা আর সুখ
শান্তি লেশ।
দুর্ভিক্ষ অনলে মাগো
পুড়িতেছে দেশ।।
রোগ-শোক নানা ব্যাধি
কলিতে সবায়।
ভুগিতেছে সকলেতে করে
হায় হায়।।
অন্ন-বস্ত্র অভাবেতে
আত্মহত্যা করে।
স্ত্রী-পুত্র ত্যাজি
সবাই যায় দেশান্তরে।।
সারা দেশে অসুখ।
প্রতিবেশীর অসুখ।
পরিচিতের অসুখ।
অপরিচিতের অসুখ।
বিষুবরেখা পেরিয়ে
দূরত্ব বাড়িয়ে নিয়েছে
দিন আর রাত। চাকা থেমে
গেছে। কুড়ুল থেমে গেছে।
কোদাল নামছে না। লেদ
মেশিনে আওয়াজ নেই। হাট
নেই। পথে কেউ খাবার
সাজিয়ে বসে নেই। নেই,
নেই, না। যাবতীয় আলোকিত
শব্দ মাস্কের আড়ালে।
জাঁকিয়ে বসেছে বিষণ্ণ
অসুখ। না, জামলোর শরীরে
সে অসুখের বীজাণু নেই।
জামালো মাড়কামের জ্বর
নেই, শ্বাসকষ্ট নেই। ১২
জন ওই যে ১৫০ কিলোমিটার
হেঁটে আসছে, তাদের
কারোর জ্বর, হাঁচি, কাশি
কিচ্ছুটি নেই। রোদ আছে।
গ্রীষ্মের শুরুতে
চাঁদিফাটা রোদ।
ক্লান্তি আছে।
ফুটিফাটা জুতো। আর,
খিদে। খিদে আছে খুব।
আড়াই দিনের খিদে। বারো
বছর বয়েসের খিদে।
বাপ-মা-বোন সবার খিদে।
তার গ্রামের খিদে। তার
দেশের খিদে। জামলো
জঙ্গল পেরোচ্ছিল।
ঈশ্বর জানত, জামলো তার
খাবারের কাছে ফিরবে।
দু’গাছি ধানের শীষ দুলে
উঠে হেলে পড়বে। আলপনার
সমৃদ্ধিচিহ্ন জামলোর
পায়ে লেগে যাবে। সেই
পায়ের ছাপ পড়বে দেশের
উঠোন জুড়ে।
অথচ, জামলোর শরীরে জল
শুকিয়ে যাচ্ছে। জামলো
হাঁটছে। আর মাত্র ১১
কিলোমিটার। ১৫০
কিলোমিটার মাটিতে
পায়ের ছাপ ফেলতে ফেলতে,
আলপথ জঙ্গল রাজপথ
পেরোতে পেরোতে জামলো
মাড়কামের শরীর শুকিয়ে
আসছিল। ঈশ্বর জানত আর
১১ কিলোমিটার এলেই জল।
ওই যে ছোট্ট গ্লাসে
রাখা জল, সরার পরিধিতে
আঁকা মঙ্গলকাহিনী, সরার
সামনে রাখা জল। সরার
পরিধিজুড়ে প্রশান্তি
আর পয়মন্ত কথা।
আশীর্বাদ আর যশ-অর্থ
আঁকা। মঙ্গলঘট রাখা।
ঈশ্বর অপেক্ষা করছে
মঙ্গলঘটে আঁকা
মাঙ্গলিক সিঁদুরচিহ্ন
নিয়ে। জামলো ওই ঘটে জল
দিলে মঙ্গল হবে। সরায়
প্রতীকগুলো উজ্জ্বল
হবে। আর তো মাত্র ১১
কিলোমিটার...
১১, ১৫০, ১২, আড়াই- সবই
সংখ্যা। জামলো মাড়কামও
একটা সংখ্যা। তার খিদে।
তার পরিবার। তার অন্য
রাজ্যের ক্ষেতে কাজ
করতে যাওয়া। রাজ্য আর
জেলা পেরোনো। লকডাউন,
কাজ বন্ধ। কত টাকা হাতে
পেল, কত টাকা আর পাবেনা।
সব সংখ্যা। ঈশ্বর জানে।
ঈশ্বরের দু’টো হাত,
চারটে বা দশটা হাত।
তিনটে চোখ। বরাভয়
মুদ্রায় আঁকা
আঙুলভঙ্গিমা। সবই
সংখ্যা। সংখ্যা বাড়তে
থাকলে সংখ্যা আরও বাড়তে
থাকলে জামলোর নাম থাকবে
না কোথাও। সেও তখন
সংখ্যার মধ্যে ঢুকে
পড়বে। ঈশ্বর কিন্তু
জানে। ওই ১১ কিলোমিটার
পরে জামলো নাড়ু খাবে।
কিছুটা চিঁড়ে বাতাসা।
জামলোর ১২ বছরের হাতের
তালু ভরে খাবার। ঈশ্বর
খাবে। নকুলদানা,
আমসত্ত্ব, থালায় ফল...
জামলোর বমি হচ্ছে। ঠিক
ওই ১১ কিলোমিটার
বাকি-পথের পাশে বমি
করছে জামলো। শরীর থেকে
জল বেরিয়ে যাচ্ছে।
ক্ষেত থেকে জল শুকিয়ে
যাচ্ছে। মাটি থেকে
পুকুর থেকে কুয়ো থেকে
জল শুকোচ্ছে। উবে
যাচ্ছে দ্রুত।
আঁকিলাম পদ দু’টি/ তাই
মাগো নিই লুটি।।
দিবারাত পা দু’টি ধরি/
তোমার বন্দনা করি।।
আমি আঁকি পিটুলির গোলা/
আমার হোক ধানের গোলা।।
আমি আঁকি পিটুলির বালা/
আমার হোক সোনার বালা।।
লৌকিক বাসনা। না,
অলৌকিক নেই। আশ্চর্য
নেই। জল নেই। ওষুধ নেই।
হাতে টাকা নেই। জ্বর
নেই। শ্বাসকষ্ট নেই।
শুধু নেই আর নেই। ঈশ্বর
আছে। অপেক্ষা করছে থালা
সাজিয়ে। জামলো মাড়কাম
খেলে ঈশ্বর খাবে। তাকে
জল আর নকুলদানা খাইয়ে
প্রার্থনায় বসবে
ঈশ্বর। ওই ১১
কিলোমিটার। জামলো
ভাববে আর ঘণ্টা দু’য়েক
পরেই তার গ্রামের
রাস্তা। প্রতিবেশীর
বাড়ি। রোদে জ্বলেও
অদ্ভুত সবুজ পথঘরদোর।
উঠোনজুড়ে আমসত্ত্ব,
নকুলদানা, সরার পরিসীমা
জুড়ে আলো আলো মুখ,
দু’পাশে ধানের ছড়া।
লক্ষ্মীর ঝাঁপি ভরে
উঠছে কড়িতে। ঝাঁপির
ভেতরে ধান। সরায় লালচে
রত্নাধার। জামলো
মাড়কামের শরীরে জল
প্রায় নেই। আড়াইদিন পথ
হাঁটতে হাঁটতে, দেশের
ভেতর দিয়ে ঘরের ভেতরে
ফিরতে ফিরতে ১৬১
কিলোমিটার আসতে আসতে
জামলোর পেট থেকে খাবার
শরীর থেকে সব জল বেরিয়ে
যাবে। ঈশ্বর অপেক্ষা
করবে ঝাঁপির কড়িতে,
সরার আঁকায়, মঙ্গলঘটের
সিঁদুরে-প্রতীকে। আমরা
অপেক্ষা করব জামলো
মাড়কামের নাম জানবার
জন্য। জামলো মাড়কামের
ধর্ম। তার জাত। তার
হেঁটে আসা কিলোমিটার
জানতে। ঈশ্বর অপেক্ষা
করবে- জামলো ফিরবে।
দড়ির ওপরে হাঁটে ঈশ্বর।
মূর্তি গড়া হয়। মূর্তি
ভাসানো হয়। সরা পুরনো
হয়। নতুন সরা আঁকা হয়।
মাঝে ঈশ্বর। দড়ির ওপরে
হাঁটে। জামলোর খাওয়া না
হলে ঈশ্বর খেতে পায় না।
ঈশ্বর জল পায় না।
মুর্তি হয়ে যায়। মূর্তি
তৈরি হয়, অনেক অনেক
মূর্তি। অনেক অনেক সরা।
জামলোরা হাঁটে।
সংখ্যা। সংখ্যা বাড়ে।
জামলো মাড়কামেরা
হাঁটে। অনেক জামলো
মাড়কাম