প্রিয় ভিনসেন্ট, তুমি
যে নক্ষত্রের রাত
এঁকেছিলে সেই কথা তোমার
মনে পড়ে? তোমার কি মনে
আছে তোমার ‘নক্ষত্রের
রাত’ ছবিটা তুমি কবে
এঁকেছিলে? সেই যে তোমার
যন্ত্রণার রাতগুলিতে
তুমি সেন্ট রেমির
অ্যাজাইলামের দোতলার
ঘরের পুব দেয়ালের
জানলার ওপারে দেখতে
রাতের আকাশ, ঘূর্ণায়মান
নক্ষত্রদল, চক্রমনে
মাতাল আকাশ। সেই ছবিতে
যেন-বা যন্ত্রণাদগ্ধ
তোমার অন্তরাত্মা
চক্রাকার নৃত্যে ভেঙে
দিতে চায় মহাকর্ষ,
মাধ্যাকর্ষকে, ঘুরছে
নীল, হলুদ, শাদা, কমলার
ক্ষ্যাপা উৎসার। আমি
তোমার কালার প্যালেটের
পাশে অতনু দাঁড়িয়ে
তোমার কানে, কানে কানে
বলছিলাম জীবদাশের
‘হাওয়ার রাত’—‘গভীর
হাওয়ার রাত ছিলো
কাল—অসংখ্য নক্ষত্রের
রাত; সারা রাত
বিস্তীর্ণ হাওয়া আমার
মশারিতে খেলেছে;
নক্ষত্রের দিকে উড়ে
যেতে চেয়েছে...’
তুমি কেন থাকতে
গিয়েছিলে লুনেটিক
অ্যাজাইলামে? পেছনে পড়ে
রইল আর্লের হলুদ বাড়ি,
পরিপাটি-করে-সাজানো
একলার বিছানা,
সূর্যমুখীর হাসি ও
কান্না। সেই-যে দক্ষিণ
ফ্রান্সের আর্ল নামের
ছোট্ট শহরের হলুদ
বাড়িটি, পরিপাটি করে
গুছিয়ে তুমি প্রতীক্ষা
করছিলে সেই-এক তাহিতির
রাজার জন্য, সেই
শেয়ারবাজারের
দালালটির জন্য, সেই
গৃহত্যাগী জোছনা,
পেটমোটা লোকটার জন্য,
যে পথে ছুড়ে ফেলে
এসেছিল স্ত্রী আর
সন্তানদের, সেই গঁগ্যার
জন্য। সে তোমার বন্ধু
ছিল, কিন্তু জানতে না সে
তোমাকে ঈর্ষা করত। না,
ঠিক তোমাকে না, ঈর্ষা সে
করত তোমার রংকে। সে
তাহিতি থেকে যে
ম্রিয়মাণ রং নিয়ে এলো
তা তোমার
সূর্যকরোজ্জ্বল রঙের
সামনে বরাবরই ম্লান হয়ে
গেল, কিন্তু সে
বার্নসিনা, ইয়েলো অকার
থেকে যেন বের হতেই পারল
না। তাই একদিন আর
তোমাদের মধ্যে বন্ধুতা
থাকল না। তোমরা হয়ে
উঠলে পরস্পরের শত্রু।
একদিন কী-এক কারণে তুমি
একটা কাচের গ্লাস ছুঁড়ে
মারলে তার মাথায়। একদিন
সে পথ দিয়ে হাঁটার সময়
সে শুনতে পেলো কে যেন
তার পিছনে ছুটে আসছে।
পিছনে ফিরে দেখল একটা
ধারালো ক্ষুর হাতে তুমি
ছুটে আসছো তার দিকে।
প্রতিরোধের জন্য
বিশালবপু গঁগ্যা ঘুরে
দাঁড়াতেই আবার ছুটে
পালিয়ে গেলে তুমি। এর
কারণ আর কেউ না জানুক,
আমি তো জানি। বলা হয়,
তুমি নিজের কান কেটে
সেই মেয়েটির কাছে
পাঠিয়েছিলে—যে বলেছিল
তোমার কান সুন্দর। কথা
তো সত্য নয়। সত্য হচ্ছে
গঁগ্যাই তোমার কান কেটে
দিয়েছিল। কান কেটে দিয়ে
পালানোর সময় তুমি তাকে
উদ্যত ক্ষুর হাতে তাড়া
করেছিলে। তারপরও তুমি
তাকে চিঠি লিখতে! তার
চিঠির উত্তর দিতে! এইসব
সত্য তো আমি জানি,
প্রিয়।
অশোক পুড়ে যায়, পুড়ে যায়
আরো আরো ক্ষেত্রজ
কুসুম, পুড়ে যায় বাসনা ও
পৃথিবীর যত আছে লাল।
তোমার পেইন্টি-এ
প্রোথিত নীরবতা আমাকে
শেখালো নৈঃশব্দ্যই সব
থেকে ললিত শব্দময়তা।
নৈঃশব্দ্যের ভাষায় কথা
বলতে পারে যে-জন সে-ই
বিজয়ী। তুমি তো বিজয়ীই
ছিলে। তোমার ভিতরে যে
ছিল জীবনতৃষ্ণা তাই-ই
তোমাকে মহান করেছে।
জীবদ্দশায় তোমার একটা
মাত্র ছবি বিক্রি
হয়েছিল তাও খুবই
কমদামে। আর তোমার
চিরপ্রস্থানের পর
তোমার আঁকা ছবির চেয়ে
দামি কোনো ছবিই বলা যায়
ছিল না। আমি আমার
প্রিসলিনকে বলেছিলাম,
ভিনসেন্ট এক এবং
অদ্বিতীয়। একজন
শিল্পীর মধ্যে যতগুলি
গুণ থাকা দরকার সবই তার
মধ্যে ছিল। যা আর কারো
মধ্যে ছিল না। হ্যাঁ,
চিত্রকলার ছাত্র
হিশেবে এইটুকুই বলতে
পারি, গুহাচিত্রের যুগ
থেকে আজ পর্যন্ত তোমার
মতো শিল্পীর জন্ম হয়নি
পৃথবীর কোথাও। হবে না
কোনোদিন।
প্রিয় ভিনসেন্ট, ভোর
হবার আগে আগে
‘নক্ষত্রের রাত’ এঁকে
শেষ করেছিলে তুমি। জুন
মাসের কোন এক রাত্রির
সেই চঞ্চলতা, আলোর
ছুটোছুটি, নীল অন্ধকারে
হলুদ নক্ষত্র আর চাঁদ
তুমি এঁকেছিলে। ১৮৮৯
সাল ছিলো সেটা। তুমি
আকাশের নক্ষত্র হয়ে
যাওয়ার এক বছর আগে।
তুমি বলছিলে, আমার
প্রায়ই মনে হয় যে, রাতেই
অন্ধকারেই দিনের চেয়ে
অনেক বেশি রং। রাতের রং
উজ্জ্বল বেগুলি, নীল আর
সবুজ। কিছু কিছু
নক্ষত্র কচি লেবুপাতার
সবুজ, কিছু গোলাপি। আর
আমি বলছিলাম ‘হাওয়ার
রাত’—‘যে-নক্ষত্রেরা
আকাশের বুকে
হাজার-হাজার বছর আগে
মরে গিয়েছে, তারাও কাল
জানালার ভিতর দিয়ে
অসংখ্য মৃত আকাশ সঙ্গে
করে এনেছে; যে-রূপসীদের
আমি এশিরিয়ায়, মিশরে,
বিদিশায় মরে যেতে
দেখেছি...’ ভোরের আগের
রাতের আকাশে সারা রাত
ধরে নক্ষত্রের দিকে
তাকিয়ে থাকতে। দেখতে
বিশাল নক্ষত্রের শরীর,
নৃত্যরত। তোমার
নক্ষত্রের আকাশের নিচে
ঘুমিয়ে থাকা শহরটি খুব
শান্ত । ঠান্ডা গাঢ় রং
আর জানালায় আলোর আভা
শৈশবে কোথাও ফেলে আসা
শহর মনে পড়ে যায়। তোমার
ভবঘুরে জীবনের অস্থির
ঘূর্ণিই যেন বা তোমার
‘নক্ষত্রের রাত’। হলুদ
আর নীলের বৈপরীত্যে এমন
উথল শৃঙ্গার আর কোথাও
কি দেখা যায়, বলো। তোমার
ছবিটা একদিন জীবনদাশের
কবিতা, ডন ম্যাকলিনের
গান আর আমার বিবর হয়ে
যাবে তা কি তুমি জানতে?
আচ্ছা, ছবিতে বাম দিকে
যে সাইপ্রেস গাছটি, তা
কি তুমি পরে এঁকে
দিয়েছিলে?
প্রিয় ভিনসেন্ট, একদিন
থিও তোমাকে নিয়মিত চিঠি
লিখত। আর এখন আমি
লিখছি। এই চিঠি তুমি
পড়তে পারবে না জানি।
কিন্তু আমার এ-চিঠির
অক্ষরেরা ইথারে ঘুরে
ঘুরে খুঁজে নেবে তোমার
নক্ষত্রের রাত, তোমার
ঘূর্ণিময় আকাশ, তোমার
মমতার প্রান্ত, তোমার
রঙের দুঃখ … আরো যা আছে
তোমার রক্তক্ষরণ। তুমি
চিরদিন একটা পরিবার, আর
সন্তানের স্বপ্ন
দেখতে। কিন্তু কেউ
তোমাকে বাঁধলো না। তাতে
কী!
প্রিয় ভিনসেন্ট, তোমার
কালারপ্যালেট থেকেই
যেন উদ্গত হলো ডেথ
সিম্ফনি। আমার
অ্যামাদিউস-এর কথা মনে
হয়। তুমি যখন
দিগন্তাবধি সোনালি
গমের মাঠ আঁকলে তখন তা
বিষয়ের আধিক্যে
ভারাক্রান্ত হয়ে গেল
না, তাতে যে ব্যাপ্ত
আবেগ এল তা
চিত্রনন্দনগত। তুমি
আঁকলে
কম্প্লিমেন্টারি রং
দিয়ে। জানি,
কম্প্লিমেন্টারি রং
হলো সেই রংগুলি যা
পরস্পর সংঘর্ষ তৈরি
করে, অভিঘাত ও বৈপরীত্য
তৈরি করে; একটার সঙ্গে
অন্যটা মিলে যায় না।
নীল, বেগুনি, হলুদ, কমলা
ইত্যাদি রং নিউটনের
রামধনুর ক্রমবিরোধী।
নিউটনের রামধনুতে
কোনটার পর কোন রং আসবে
তা বলে দেয়া যায়।
কিন্তু
কম্প্লিমেন্টারি রঙে
তা বলা যায় না। তুমি তাই
নিজস্ব এক টেকনিক দাঁড়
করালে। ক্যানভাসে
প্রতিটি স্ট্রোকে যে রং
চাও তা প্রথমে প্যালেটে
মিশিয়ে তৈরি করলে,
তারপর তা ক্যানভাসে
পাশাপাশি মোটা স্ট্রোক
দিয়ে লাগালে। প্রতিটি
ব্রাশস্ট্রোক পাশের
স্ট্রোক থেকে
স্বতন্ত্র। এইভাবে ছোট
ছোট স্ট্রোক মিলে ছোট
ছোট ফর্মের সৃষ্টি হলো।
এইভাবে বহু স্ট্রোককৃত
ফর্ম মিলে বহির্মুখি
হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল
নদীর মতো, ভেঙে পড়ল
তরঙ্গের মতো। এ যেনো
মধ্যযুগের সেই
কাঠখোদাইয়ের কৌশল।
এইভাবে তৈরি হলো এই
ছবি। শুধু কি এই ছবি!
তোমার
পোস্ট-ইম্প্রেশনিজম
পর্বের প্রতিটি ছবিই
এইভাবে তৈরি। তোমার এই
ছবিটা যখন আমি প্রথম
দেখি তখনই ছবির ভিতরে
ঢুকে গেলাম। তারপর আরো
অনেকবার তোমার আঁকা
ছবির ভিতর ঢুকে গেলাম।
তুমি আমাকে শিখিয়েছিলে
রঙের তৃষ্ণা। তুমি আকাশ
থেকে নীল নিয়ে ছবি
আঁকতে। আর সূর্য থেকে
নিতে হলুদ, নিতে লালের
অনেক গ্রেড। কখনো তুমি
গমক্ষেত থেকে সোনালি
এবং রাই-সর্ষেক্ষেত
কিংবা সূর্যমুখীর বন
থেকে হলুদ নিয়েও আঁকতে।
আমি স্বপ্ন দেখতাম,
একদিন আমি অনেক বড় হলে,
একগাড়ি রং কিনব,
ঘরভর্তি শাদা
ক্যানভাসে এঁকে দেবো
প্রগাঢ় রক্তজবার
বনাঞ্চল, প্রাচ্যের সকল
ধনেশ সচঞ্চু শৃঙ্গারে
একাকার। আরো এঁকে দেবো
নীলকণ্ঠের যত আছে
খণ্ডিত অভিমান। ইচ্ছে
ছিল কবেকার সকল মানুষের
প্রার্থনার রূপ এঁকে
হয়ে যাব আমিও হিরণ্ময়।
হলো না।
এই ছবি তুমি কার জন্য
এঁকেছিলে, প্রিয়
ভিনসেন্ট? আমার জন্যে?
এই ছবিতে যেন ‘সমস্ত
মৃত নক্ষত্রেরা ... জেগে
উঠেছিলো—আকাশে এক তিল
ফাঁক ছিলো না; পৃথিবীর
সমস্ত ধূসর প্রিয়
মৃতদের মুখও সেই
নক্ষত্রের ভিতর দেখেছি
আমি...’ সবকিছু বিবর্ণ
হয়, সব ফুরিয়ে যায়,
ফুরিয়ে যায় আকাশ। তোমার
এই বর্ণিল আকাশও একদিন
ফুরিয়ে যাবে।