একটি হাতের ছাপ… অমোঘ
অনিবার্য… পৃথিবীর
গূঢ়তম জিজ্ঞাসা ও রহস্য
নিয়ে জেগে থাকা একটি
হাতের ছাপ। তার নগ্ন
জমাট বেঁধে থাকা
আর্তনাদের কাছে তুচ্ছ
হয়ে আসে আমাদের সব
নান্দনিক বীক্ষা।
বিষাদসিন্ধুর গর্ভ
থেকে মাথা তুলে অচেনা
প্রাণের খণ্ড আমাদের এক
ঝলক দেখে; আবার ডুবে
যায়। প্রথাগত
আলো-অন্ধকারের ধারণা
পেরিয়ে সৃষ্টির
অন্দরমহলে যে জটিল তামস
অনির্বাচ্য দূর্জ্ঞেয়
রহস্যের খেলা তার দিকে
তাকিয়ে আমরা শিউরে
উঠি।
একটি হাতের ছাপ, মাত্র
একটি হাতের ছাপ… আমাদের
ফিরিয়ে নিয়ে যায়
মাতৃগর্ভের অন্ধকারে।
একদিন জন্ম দিয়েছিলে,
আমি জন্মেছিলাম। আজ আমি
চলে যাচ্ছি। রেখে
যাচ্ছি অন্ধকার এক
গুহার ভিতর আমার হাতের
ছাপ। এই অন্তর্লীণ
যন্ত্রণা ও
ট্র্যাজেডির সামনে
আনখশির কেঁপে উঠি আমরা।
অতিকায় সময়-দানবের হাতে
কাঁপছে আমাদের
ব্যক্তি-সময়। যে কোনও
সময়ে সে-দানব আমাদের
গিলে নেবে। কোনও চিহ্ন
থাকবে না আমাদের, শুধু
অন্ধকারে ধকধক করবে
একটি হাতের ছাপ… হয়তো।
দক্ষিণ-ফ্রান্সের সেই
গুহা-মানব বা মানবী কি
হাতের ছাপটুকু রেখে
যাবার আগে সচেতন হয়ে
উঠেছিল? আদিম কোনও
শিল্পবোধ কি তাকে তাড়া
করেছিল আঙুলগুলিকে
সুচারুভাবে বিন্যস্ত
করবার জন্য?
এই সুচারু বিন্যাসের
কথা মনে পড়লেই মনে হয়
শিল্পের সঙ্গে কিমাকার
এক ধারণার অদ্ভুত মিল
আছে। অনেক সময়ে আরও এক
ধাপ এগিয়ে মনে হয়, শিল্প
মাত্রই কিমাকার,
গ্রটেস্ক।
‘মেঘের কোলে রোদ
হেসেছে’ – এই একই শর্তে
চূড়ান্ত গ্রটেস্ক,
কিমাকার। ‘আট বছর আগের
একদিন’ যেমন গ্রটেক্স,
মকররাজের কানের কাছে
বেজে ওঠা মেঘের কোলে
রোদের গান একই রকম
কিমাকার।
আমি ছবি-অজ্ঞ মানুষ।
শুধু বুঝি আমাদের তাবৎ
গূঢ়ৈষণা তার গুপ্তপথ
ধরে শেষতক আশ্রয় পেতে
চায় ছবিতে। লক্ষ লক্ষ
শব্দের ফ্রিজশট একটি
ছবি। সব ক্যাকফনি
মুহূর্তে স্তব্ধ করে
ব্যান্ডমাস্টারের
অর্কেষ্ট্রা থামানোর
ইশারা থেকে শুরু হয়
ছবির সফর। শব্দহীন এক
অর্কেষ্ট্রা বাজতে
থাকে।
সুর আমাদের মাথার উপর
কোটি কোটি আলোকবর্ষ
জুড়ে ছড়িয়ে থাকা
অন্ধকারতম, তামস
চাঁদোয়া পর্যন্ত
পৌঁছাতে পারে না।
তথাকথিত ‘আলোকবিশ্ব’
পর্যন্ত পৌঁছাতেও সে
অক্ষম। সেখানে রেখা,
নিদেনপক্ষে একটি হাতের
ছাপ রাজার রাজা।
২
১৯৩৫ খ্রীষ্টাব্দ (১৩৪২
বঙ্গাব্দ) ও ১৯৩৬-এ তাঁর
দুটি আত্মপ্রতিকৃতি।
দ্বিতীয়টির কাছে
প্রথমে ফিরে আসি।
যে আদিম পাহাড়ের গোপন
করে রাখা পিঠে এখন
পর্যন্ত খুব কম মানুষ
পৌঁছেছে সেখানে জেগে
রয়েছে একটি ঝরনা। আমি
স্বপ্নে পৌঁছে যাই তার
কাছে।
সংশয়দীর্ণ রহস্যময় ও
আত্মপ্রশ্নে ছারখার
হয়ে যাওয়া একটি ঝরনা।
তার আশ্চর্য ক্ষমতা, সে
তার পতনশীল প্রাণকে
পাহাড়ের পিঠে স্থির
রাখতে পারে অনন্ত সময়
ধরে।
তারপর সে ঝরনা আমাকে
তার পাশে কয়েক দণ্ড
বসবার অনুমতি দেয়। শুরু
হয়ে আমার সঙ্গে তার
সামান্য কথোপকথন,
‘আমার সফর অপরিকল্পিত...
পাহাড়ের এই মুখে এসে
পড়াও আমার কিছুটা
দৈবক্রমে ঘটে যাওয়া।
আসার আগে জনপদে জনপদে
সরাইখানায় মানুষের
মুখে শোনা, এই পাহাড়ের
এক কোণে একটি সুরেলা ও
সাবলীল ঝরনা আছে... সেটি
লোকপ্রবাদের জাদু হয়তো,
কারণ ঝরনাটিকে এইমাত্র
দেখবার পর আমার
সরাইখানার গল্পের
প্রতি বিস্তর সন্দেহ
জন্মাল...’
‘সরাইখানার গল্প আমাকে
তাড়া করেছে সারা জীবন...
আমিও তীব্র সন্দেহ করি
এই গল্পকে, ধারণাকে।
আসলে আর কিছু নেই, যা আছে
তা হল আদিম রহস্যময়
আত্মভ্রূণের কান্না...
প্রিমিটিভ এক
বাস্তবতা...আমি যখন
নিজেকে পাহাড়ের গায়ে
ফ্রিজ করে রাখি তখন আমি
সেই প্রিমিটিভ... অন্য
সময়ে আমি নয়, আমার
বারিপতনের শব্দ
সরাইখানার মানুষের
কাছে প্রতারক হয়ে ওঠে।
তারা সেগুলিকে অতিক্রম
করে আমাকে ছুঁতে পারে
না...’
‘তার মানে শব্দ’ই
প্রতারক?’
‘শব্দ ও রেখার মধ্যে
তুলনামূলকভাবে শব্দ
অধীকতর প্রতারক’
‘ওই ভয়ংকর তীর্যক
দৃষ্টিতে আপনি কী
দেখছেন?’
‘আসলে আমি ওই সবুজ
অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে
রয়েছি... ভাল করে দেখ,
একটা ঝরনা নেমে আসছে
পাথরে বুক ঘষে। অথবা
তোমাদের দেখার ভুল,
আসলে দু’পাশ দিয়ে দুটি
অন্ধকার সবুজ ঝরনা নেমে
যাচ্ছে আর মাঝখানে জল
রয়েছে স্থির। এই
দৃষ্টিবিভ্রমটিকে
তোমরা অতিক্রম করতে
অনেকটা সময় নিয়ে
নিয়েছ...’
‘এবার আমার ডিফাইন করা
দরকার... সরাইখানা ও
শুঁড়িপথের দর্শনে
আমাদের গ্রহপথ ছেয়ে
রয়েছে। আপনি সুন্দর? না,
অসুন্দর?’
‘আমি সুন্দর-অসুন্দরের
বাইরে অবস্থান করা এক
রূপ... প্রিমিটিভ রূপ।
আমার মধ্যে ছেয়ে থাকা
আদিম অদ্ভুত শৈবাল ও
কয়েক ট্রিলিয়ন অন্ধকার
নিয়ে জেগে থাকা
প্রাণীটিকে আমি নিজেও
বহুদিন আবিষ্কার করে
উঠতে পারিনি। তার ছায়ার
আভাসমাত্র ফুটে আছে
আমার
আত্মপ্রতিকৃতি’তে...’
‘আপনি সংশয়ী? না,
নিঃসংশয়?’
‘জীবনে চূড়ান্ত সংশয় ও
লক্ষ লক্ষ বিক্ষুব্ধ
প্রহর ছাড়া আমার একটাও
দিন কাটেনি’
‘এ ঝরনার কাছে যারা
জলের সন্ধানে আসবার কথা
ভাবে, আমি ফিরে গিয়ে
তাদের কী জানাব?’
‘জানিও জলের সন্ধানে
তারা আসতেই পারে।
কিন্তু আমার জলে এক
আদিম আদিমতম খেলা রয়ে
গেছে। যাদের তৃষ্ণা কম
তাদের জন্য আমার জলে
একজন্মের তৃষ্ণার উপশম
ও নিবৃত্তি রয়েছে।
কিন্তু যাদের তৃষ্ণা
বেশি তারা ভুল করে আমার
কাছে এসে পড়লে আজীবনের
জন্য বিষ হাতে ফিরে
যেতে বাধ্য। আমার এই
স্থির হয়ে থাকা গতি ও
স্তব্ধতার মধ্যে বিষের
ভাণ্ড লুকানো রয়েছে’
‘এই ঝরনাটিকে,
সরাইখানায় ফিরে গিয়ে কী
ভাবে ডিফাইন করব? সরল?
না, জটিল?’
‘এ নক্ষত্রলোক সহজ? না,
জটিল? নিরুদ্ধ
অন্ধকারকে সহজ বা জটিল
কিছুই বলা চলে না’
৩
খনির অন্ধকার থেকে কালি
মেখে এইমাত্র উঠে এসেছে
এক খননকারী। তার
লম্বাটে মুখে প্রশস্ত
ললাটে কালি লেপ দিয়েছে
খনির অন্ধকার।তার
ডানচোখের আলো ক্রমাগত
অন্ধকার থেকে
অন্ধকারতর হয়ে উঠছে
বামচোখে এসে। ঠোঁট
দুটির আভাসে রয়েছে
অকল্পিত ভারবহন ও
চাবুকের স্মৃতি।
ঐশীপ্রাপ্ত মানুষের
ডিভাইন বিউটি ফুটিয়ে
তোলার একটি বাঁধা ধরা
পদ্ধতি আছে। তথাগত থেকে
শুরু করে যীশু – সেই এই
ধারায় কল্পিত এক রূপ।
এই আত্মপ্রতিকৃতিটি সে
ধারণাকে ছারখার করে
দেয়। এর দিকে তাকালেই
আমি দেখতে পাই গলগাথার
দিকে চলে যাওয়া একটি
রাস্তা। এক
দিব্যোন্মাদ নিজের
ক্রুশ নিজে বয়ে নিয়ে
চলেছে বধ্যভূমির দিকে।
জন্মের পর তিনি জেনে
যান একদিন তাঁকে এই
ক্রুশ বয়ে নিয়ে যেতে
হবে।
মহাহত্যাশালার দিকে
অন্ধকার নামছে। কিন্তু
ক্ষমতা কী অসহায়! যে
মুহূর্তে হেরড-ক্ষমতা
তোমার কাঁধে তোমাকেই
হত্যা করবার জন্য ক্রুশ
তুলে দিল সে মুহূর্ত
থেকেই তার পরাজয় শুরু
হয়ে গেল।
‘এটা কার
আত্মপ্রতিকৃতি? যেন
পৃথিবীর প্রাচীণতম
খনি-অন্ধকার থেকে উঠে
আসা পৃথিবীর আদিমতম
খনি-শ্রমিক... একদিন যে
আমাদের জন্য আগুনের রসদ
আনতে খনির অন্ধকারে
নেমে গিয়েছিল...’
‘এ আত্মপ্রতিকৃতি আমার
অথবা জিসাসের...’
‘একই সঙ্গে একটি
আত্মপ্রতিকৃতি দু’জন
মানুষের হতে পারে! এ
প্যারাডক্সের সামনে
দাঁড়িয়ে অসহায়
লাগছে...’
‘যা কিছু চূড়ান্ত সহজ
তাই
প্যারাডক্সিক্যাল...
আমি বলতে চাইছি গলগাথার
দিকে হাঁটতে হাঁটতে
ক্লান্ত জেসাসকে হয়তো
কয়েক মুহূর্তের
বিশ্রাম দেওয়া হয়েছিল।
যদি তিনি উঠে আসতেন ও
আত্মপ্রতিকৃতিটি
আঁকতেন, সেটি ঠিক এমনই
হত...’
‘যদি মেনেও নিই সেটা তা
হলেও তাঁর চোখে-মুখে এত
অন্ধকারের ছায়াপাত কেন?
মৃত্যু ভয়? নাকি হতাশা?
না, ক্লান্তি?’
‘তাঁর ডানচোখের দিকে
তাকাও... দেখ সে-চোখ একটি
তারকার নাভিকুণ্ডের
মতো জ্বলছে। তাঁর কোনও
মৃত্যুভয় আর তুমি দেখতে
পাবে না এরপর। তাঁর
কোনও মৃত্যুভয় নেই’ও...
যা আছে তা হল বধ হতে
যাওয়া এক মানুষের
ত্রস্ত-বিহ্বলতা...
হত্যাশালার বৈভবের
দিকে তাকিয়ে সে
বিহ্বলতার শুরু ও শেষ’
‘তা হলে সে কে?
হত্যাশালার বন্দি? না,
হত্যাশালাকে চিরদিনের
মতো পরাজিত করে দেওয়া
সম্রাট?’
‘সে দুই’ই। সে মানুষের
হাতে খুন হয়েছে বারবার...
হত্যাশালায় প্রমোদ
ঘনিয়ে উঠেছে তাকে ঘিরে,
আবার সেই ব্যর্থ করে
দিয়েছে সমস্ত হত্যা’
‘কিন্তু বারবার কেন এত
অন্ধকার দেখছি আমি তার
চোখে-মুখে?’
‘সৃষ্টির মূলে যে
অন্ধকার, যে পবিত্র
অন্ধকার তাকে তোমরা ভয়
পাও গুহাচারী মানুষের
মতো। সে সেই অনঙ্গ
অন্ধকার তোমাদের সামনে
এনেছিল। এই অন্ধকারই
তোমাদের সঙ্গে
মহাজগতের অদৃশ্য ভাবে
রয়ে যাওয়া সূত্র। এই
অন্ধকারই সময় ও
সময়হীনতা। তোমাদের
অতীত ও অস্তিত্বের
একমাত্র আলো। মানুষের
চোখ সেই অন্ধকার সহ্য
করতে পারেনি। সে তখন
বাধ্য হয়েছিল তোমাদের
আলোর গান শোনাতে।
কিন্তু মহাহত্যাশালার
মাঝখানে দাঁড়িয়ে এক
আর্তনাদ স্তব্ধ হয়ে
রয়েছে এই
আত্মপ্রতিকৃতি’তে।
তার সত্তার ভিতর লুকিয়ে
ছিল এক আদিম
আগ্নেয়গিরির লাভা...
তোমরা তাকে ছুঁয়ে দেখতে
ভয় পেয়েছে। তার শব্দের
কাছে এসে তোমরা আশ্রয়
পাবে, কিন্তু তার রেখা ও
রঙ তোমাদের সরাইখানা
শুঁড়িখানা ও জনপদের উপর
দিয়ে বইয়ে দেবে লাভা
স্রোত... তোমাদের মাত্র
দুটো চোখ। তোমাদের
ত্বকের সে ক্ষমতা নেই
যা এই লাভাস্রোতের
উত্তাপকে সহ্য করতে
পারে...’
‘আপনি ধীর ধীরে মিলিয়ে
যাচ্ছেন এই অদ্ভুত
আত্মপ্রতিকৃতির ভিতর।
কিন্তু আমাকে ফিরে যেতে
হবে পানশালা ও
সরাইখানার দিকে।
সেখানে ফিরে গিয়ে কী
বলব আমি? আপনি সুরের? না,
রেখার?’
‘আমি পৃথিবীর শেষ
উপজাতির দুর্বোধ্য ও
অনাবিষ্কৃত টোটেম... এই
টোটেমের ভিতর
মহাশৃঙ্খলা মহারহস্য ও
মহাপ্রলয়ের কিছু
স্মৃতি ও সূত্র রয়ে
গেছে... আমাকে
আবিষ্কারের শেষ
প্রামাণ্য রাস্তাটি
বেঁকে গেছে সেই টোটেমের
দিকে... আর কে না জানে
টোটেম রেখা ও রঙের...’