চোখে আলো পড়তে ঘুম
ভাঙল। জানলার বড় ফাঁক
গলে রোদ ঢুকেছে ঘরে।
ঘুম ভাঙতেই মনে হলো,
কোনো একটা ফুলের বাগানে
তিনি শুয়ে আছেন।
চারপাশে অচেনা কোনো সুর
ভেসে বেড়াচ্ছে।
সামান্য পরেই আবার
চায়ের তেষ্টা পেল। ধরমর
করে উঠতে গিয়ে হাঁটুর
পুরনো ব্যথাটা এমন
চাগাড় দিল, চোখমুখ
কুঁচকে তিনি উঠে বসলেন।
এদিক ওদিক তাকিয়ে
দেখলেন চারপাশ। একটা
জংলা জায়গার পোড়োবাড়ির
মেঝেতে এখন তিনি বসে।
ঘুমের রেণু লেগে আছে
চোখে। কিছু ঠাহর করতে
পারলেন না। মাথা পুরো
ফাঁকা।
তিনি তিনু সরকার, বয়স
পঁয়ষট্টি বা ছেষট্টি।
মুখে পনের কুড়ি দিনের
না কামানো দাড়ি। ধূসর
হয়ে আসা চুলগুলো বড্ড
এলোমেলো। হাত বাড়িয়ে
চশমাটা খুঁজছেন।
ডানদিকের গালটা
চুলকাচ্ছে। চুলকাতে
গিয়ে টের পেলেন
পেচ্ছাবের বেগ পেয়েছে।
উঠে দাঁড়াতে মাথা খুলে
গেল, গত পাঁচদিন
উপায়হীন তিনি এখানেই।
এত ভুলোমনা কবে হলেন,
নিজেকে শাসন করতে করতে
পা বাড়ান দরজার দিকে।
পা পড়ে যায় শীতল কিছুর
ওপর। স্নায়ুতে
স্নায়ুতে ছড়িয়ে পড়ে
সতর্ক বার্তা।
পোড়োবাড়ি। তাহলে কি
সাপ? ঝট করে পা সরিয়ে
নিলেন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি
ফেললেন। সাপ নয়, ছাল
বাকল উঠে যাওয়া
এবড়োখেবড়ো মেঝেতে তার
সাদামাটা হাতঘড়িটা
ধুলো মাখছে। নিচু হয়ে
ঘড়ি তুলে নিতে নিতে সময়
চোখে পড়ল। সকাল সাতটা।
দশ এপ্রিল। শুক্রবার।
মেঝেতে সারবেঁধে চলেছে
কালো পিঁপড়ের দল।
তিনু সরকার খুঁড়িয়ে
খুঁড়িয়ে বেরিয়ে এসে
পেচ্ছাব করছেন এখন
পোড়োবাড়ির জংলা
দেওয়ালের গায়ে। শৈশবের
দলবেঁধে কাটাকুটি
খেলার কথা মনে পড়ছে।
নেতিয়ে থাকা গাছগুলো
হলদে জলে স্নান সেরে
বেশ সবুজ। তিনি স্নান
করেন না ক’দিন? খাবার জল?
ঘরের ভেতরে ঢুকে মেঝেতে
বাবু হয়ে বসলেন। জলের
শূন্য বোতলটা মেঝেয় কাৎ
হয়ে শুয়ে। অবশ্য মেঝেটা
সাফসুতরো করে কিছুটা
বাসযোগ্য এখন। একবার
বাজারের দিকটায় যেতে
পারলে.. একটু জল. সামান্য
চিড়ে.. নিজের ভাবনায়
শিউরে ওঠেন নিজেই!
মানিব্যাগে পড়ে আছে
ক’টা টাকা! আর তাড়া
খাওয়া জন্তুর আবার
মানিব্যাগই কী, টাকাই
বা কী.. কেবল সুযোগের
অপেক্ষা। প্রয়োজনে
কেড়ে নেওয়া বা চুরি।
খিদে তো পায়। আশপাশে
কলাটা, মুলোটা কিছুই
নেই। কতদিনের লড়াই কে
জানে। আগেরবারের মত ভুল
করা চলবে না। ঝোলাটা
হাতড়ে প্যাকেটের
তলানীতে থাকা একমুঠো
চিড়ে, একটা আধখাওয়া
কেকের টুকরো হাতে ঠেকে।
তাই সই। কেকের টুকরোটায়
কালচে ছাতা পড়েছে।
খুঁটে খুঁটে সে অংশগুলো
ফেলে বেঁচে যাওয়া
কেকটুকু এক নিমিষে পেটে
চালান দেন। তারপর শুকনো
চিড়ে চিবাতে থাকেন অল্প
অল্প করে। জলে নেই।
সন্ধ্যা অবধি টিকে
থাকতে হবে। মাথাটা এখন
অনেক পরিষ্কার।
ঘরের ফাঁকফোকর দিয়েই
এদিকওদিক দেখেন।
গাছপালা ছাড়া আর কিছু
নজরে আসে না। ভয় এখন
মানুষকে। কতগুলো দিন
তিনি কেবল তাড়া খেয়ে
ফিরছেন মানুষের কাছে
থেকেই। মানুষ ভাবলে তাই
তার বমি পায়।
যেমন এখনও একটু একটু
বমিভাব হচ্ছে।
বমিভাব কমাতে বরং শুয়ে
থাকা ভাল। তিনি শুয়ে
পড়েন।
শুয়ে শুয়ে বাঘা যতীনের
বাড়িটায় চলে যান।
প্রমীলা দেবীর আজ সাত
তাড়াতাড়ি রান্না শেষ।
স্নানে ঢুকছেন তিনি কী
যেন বিড়বিড় করতে করতে।
মুখের কাছে কান নিয়েও
তিনু কথাগুলো বুঝতে
পারেন না। প্রমীলাও
তিনু সরকারের দিকে ফিরে
তাকান না। ঋদ্ধিকে
স্নান করিয়ে দেয় নীতা।
বিট্টুর বউ। তিনি
নীতাকে গুনে গুনে
তিনবার ডাকলেন। নীতাও
শুনল না। ঋদ্ধি
বাবুসোনার মত স্নান
করল। পাওডার মাখলো।
তারপর আপন মনে খেলতে
খেলতে ঘুমিয়ে পড়ল।
বিট্টু দক্ষিণের ঘরটায়
একা শুয়ে শুয়ে
কাতরাচ্ছে। সর্বনাশ!
তবে কি.. কাছে গিয়ে শরীরে
হাত রাখতেই হাতটা পুড়ে
গেল যেন। আর তিনু সরকার
ভয়ে জমে গেলেন। বিট্টু
কিন্তু বাবার গন্ধ পেল।
টের পেল বাবা এসে
দাঁড়িয়েছে।
- বাবা আমি মরে যাচ্ছি।
খুব কষ্ট হচ্ছে বাবা..
তিনু সরকারের বুকে
চিরচির করে ফাটল ধরছে।
ঘাম জবজবে শরীর। চোখের
কোণ গড়িয়ে জল নামছে।
অস্থির লাগছে তিনু
সরকারের। প্রমীলা,
ঋদ্ধি, বিট্টু আর নীতা?
ভাগ্য তাকে কোথা থেকে
কোথায় নিয়ে এল। বুক যেন
চৈত্রের খা খা জমি। কী
কুক্ষণে যে তিনি
বাংলাদেশে আসার জিদ
ধরেছিলেন। কেবল জিদ?
মাস ছয় আগেই তিনি
পাসপোর্ট করিয়েছিলেন
চুপচাপ। তারপর দালাল
ধরে ভিসা। একমাসের।
বিট্টু বা প্রমীলা কারও
কথাই শোনেননি। বয়স
হয়েছে। কবে কখন চলে যাব,
বাপ ঠাকুর্দার ভিটেটা
একবার ঘুরে আসি। চলে
এসেছিলেন বেনাপোল হয়ে
প্রথমে ঢাকা। ঢাকায় দু
একজন আত্মীয়বাড়ি।
তারপর লঞ্চে চেপে
বরিশাল। সেদিন কেন অত
জিদ দেখিয়েছিলেন! আজীবন
তিনি সবার সাথে সমঝে
চলা মানুষ।
বিট্টু-নীতার ওপর
অভিমান? নিজেকে ক্রমাগত
গুরুত্বহীন মানুষ ভেবে
একবার জ্বলে ওঠার
চেষ্টা? বাপকে খুব
অবহেলা করত বিট্টু?
নীতা? মেপে মেপে খেতে
দিত বলে, প্রমীলাকে
কাজের লোকের মত খাটিয়ে
নিত বলে কতদিন বিট্টুকে
বলতে গিয়ে অপমানিত হতে
হয়েছে..
আজ মনে হচ্ছে, সংসারে অত
ধরলে কি চলে.. তাছাড়া
বিট্টু ব্যস্ত মানুষ,
অত কী করে খেয়াল করবে
বাপ মাকে।
মোবাইল? অস্থির কাঁপা
হাতে ঝোলার ভেতর হাতড়ে
চলেন। দুটো পাজামা,
পাঞ্জাবি, দুটো গেঞ্জির
মাঝে ঘুমন্ত নকিয়া
৩৩১০। চার্জ ফুরিয়েছে
কবে। খুঁজে পেয়ে
দু’হাতে তাকেই আঁকড়ে
ধরেন তিনু সরকার।
বরিশাল বা বাঘা যতীন।
ফিরেছিলেন তো। ফিরতেই
চেয়েছিলেন। কিন্তু
কোথা থেকে কী হয়ে গেল।
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন
তিনু সরকার ফেরার পথে
মাগুরা আসার পর আটকে
গেলেন। কোনো হোটেল খোলা
নেই। কেউ কোথাও আশ্রয়
দিতে চায় না। সময়টা ভাল
নয়। এই বয়সী মানুষ এখন
বিপদজনক তায় আবার
বিদেশি। দরজাগুলো
বন্ধই ছিল। এখন আরও
শক্ত করে লাগানো হল।
তাই তিনি হাঁটতে শুরু
করলেন। হাঁটতে হাঁটতে
কেশবপুর অবধি গেলেন।
কোথাও আশ্রয় মেলেনি।
কেউ থাকতে দেয়নি। শেষে
এক প্রাইমারী স্কুলের
বারান্দায়। নেড়ি
কুকুরের সাথে।
চিড়ে, জলের বোতল আর
অলটাইম কেক কিনে খুচরো
নিচ্ছিলেন। জনা দশেক
ঘিরে ফেলল।
-এ গ্রামের নয়। কোথা
থেকে আসা হয়েছে?
কলকাতা? উত্তর
শোনামাত্র তেড়ে ওঠা।
বিদেশি লোক। মারাত্মক
এখন। কাজেই আক্রমণ।
যোগাযোগ বন্ধ, পথে আটকে
গেছেন। স্রেফ ক’টা দিন
আশ্রয় চাই। তারপর কোনো
উপায় পেলেই বর্ডার
পেরিয়ে ওপাশে চলে যাব।
কটা দিন.. সহজ কথাগুলো
সেদিন একটা লোকও বুঝতে
চায়নি। বরং গ্রাম ছাড়তে
বাধ্য করতে ধাওয়া করেছে
আর সে তীব্র আক্রমণ
থেকে জান বাঁচাতে
কমজোরি হাঁটুর
যন্ত্রণা দাঁতে চেপেও
তিনু সরকার দৌড়েছেন
যেদিক দু’ চোখ যায়।
বমি পাচ্ছে আবার। ঘাম
শুকিয়ে শরীরে এবার
কাঁপুরি ধরে তিনু
সরকারের।
তেষ্টা পায়..
খিদে পায়..
জল,, বিট্টু.. জল.. প্র মী
লা..
উঠে ভাঙা জানলা হাট করে
খুলে দেন তিনু।
দরজাও।
গাঢ় রোদ ঢুকে পড়ে ঘরে।
দু’চোখ মেলে ধরেন হলুদ
রোদের দিকে। বাইরের
সবুজের দিকে। চারদিকে
কেমন প্রাণের ঢেউ।
কোথাও মানুষ নামের
ভাইরাস চোখে পড়ে না বরং
চোখ প্রসারিত করতেই
একটা রুপালি জলের রেখা
দেখা দিয়ে আবছা হতে
চায়।
তিনি হাঁটতে থাকেন।
খুঁড়িয়েই। জলের রেখা
যেদিকে দেখা দিয়েছে,
সেদিকে।
উপায় কী! কোথাও তো যেতেও
হয়...