১.
নিজের মনের মধ্যে হঠাৎ
এই বিশ্রী রকমের ক্ষতটি
আবিষ্কার করে চমকে ওঠে
সুমাইয়া। দীর্ঘ সময় পার
হয়ে বয়স যখন পঞ্চাশের
কাছাকাছি তখনই সে
আবিষ্কার করে এই বিশ্রী
রকমের ক্ষতটি। আলমের
সাথে দীর্ঘ দাম্পত্য
জীবন। শারিরীক
বিষয়টিতে চমৎকার
বোঝাপড়া ছিল। তাদের
দাম্পত্যের তীব্র
স্পষ্ট ভালবাসার
ভারসাম্যতা অন্যের
কাছেও কখনও কখনও ইর্ষার
বিষয় ছিল। আলম তাকে আদর
করে সুমি বলেই ডাকত।
যাপিত জীবন যেন নিমিষেই
পার হয়ে গেল। কখনও এই
দীর্ঘ সময়টিকে এত বেশি
বৈচিত্র্যহীন মনে
হয়নি। বরং সংসারের
প্রতিটি বস্তুর সাথেই
সুমির আত্মা ছিল
সূক্ষ্ম তারে বাঁধা।
সবকিছুতেই ছিল সুমির
ভালবাসাপূর্ণ
আবিস্কার আর পরম যত্ন।
সাতাশ বছরের জীবন তাদের
দাম্পত্যের।
সংসারের প্রথম দিন যে
কড়াইটিতে সে পটল ভাজি
করেছিল, সে
অ্যালুমিনিয়ামের
কড়াইটি আজও তেমনই আছে।
একটু কালো হয়েছে,
কিন্তু অনেক বেশি
টেকসই। সুমিরও দুই
বাচ্চা বড় হয়ে গেছে,ওরা
এখন নিজেদের মত নিজেদের
সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
সুমির শরীরের মানচিত্র
বদলে গেছে সময়ের সঙ্গে
সঙ্গে। কিন্তু মনের
দিকটায় এতদিন কোনও
শিথিলতা সে অনুভব
করেনি। বরং তার নিজের
উপর এমন বিশ্বাস ছিল যে,
সে তার মনের ভিতর
লুকিয়ে থাকা সব ভালবাসা
দিয়ে আলো করে তুলবে
জীবনের চারপাশে থেমে
থাকা অন্ধকারকে।
কিন্তু কেমন করে বিশ্রী
এমন অজানা ক্ষতকে সে
বহন করে গেছে দীর্ঘদিন!
ভেবে কূল পায় না, সুমি।
এতদিন তার চোখবাঁধা ছিল
! কালো কাপড়ে! তাই দেখতে
পায়নি! আলমের জন্য ওর
মনের দিক থেকে যা ছিল ,তা
শুধুই কৃতজ্ঞতা!
কৃতজ্ঞতা তাকে আরামে
রাখার জন্য, যৌনতাকে
অনুভূতিময় স্বাদে
তৃপ্ত করে রাখার জন্য!
ভালবাসা আসলে যৌন
কৃতজ্ঞতারই আরেকটি নাম!
তাইতো মনে হচ্ছে! হ্যাঁ,
জীবনের এই পড়ন্ত বেলায়
এসে সুমাইয়া এমন করেই
ভাবতে বাধ্য হচ্ছে।
আজকাল আলমের গায়ের ভিতর
একটা বোঁটকা গন্ধ টের
পায় সুমি। সে কাছে এলেই
তার পালাতে ইচ্ছে করে।
তার ওপর রাত্রিতে নাকের
ডাকের প্রবল ঘূর্ণি।
যেন পাশ ফিরলেই
ঘুর্ণিঝড়। সুমি বুঝতে
পারছে, সে কিছুতেই
ভালবাসতে পারছে না
আলমকে। আগে আলমের যে
বিষয়গুলো তার চোখেই
পড়তো না, অথবা রাতের
শরীরের স্বাদ ভুলিয়ে
দিত দিনের সকল ছন্দপতন,
আজকাল সেই বিষয়গুলিই
বিকট হয়ে হাজির হচ্ছে
সুমির মনোজগতে। কী করবে
সে ভেবে পায় না।
সম্পর্কটিকে কোন্ দিক
থেকে উত্তরণ করা যায়
,সারাদিন যে কোনো ছুতোয়
কেবল তাই ভাবে। জীবনের
কোনো এক সময় সে ট্রয়ের
ঘোড়ার গল্পটি পড়েছিল ।
আহা কী সুন্দর ট্রয়ের
ঘোড়া! অথচ তার ভিতরে
লুকিয়েছিল হত্যকারী
সৈন্যের দল! তার যাপিত
জীবনের সকল সৌরভের
পিছনেও কেবলই
পারস্পরিক এক বোঝাপড়ার
সর্ম্পক! বিছানায় শুয়ে
শুয়ে এসব ভেবে কেবলই
ক্লান্ত হতে থাকে
সুমাইয়া। তার চোখে কী
এক যন্ত্রণা জ্বালা
করতে থাকে। সে বুঝে নেয়
বুকের ভিতর ঘুমিয়ে থাকা
যন্ত্রণাই চোখের
ভিতরটাকে পোড়াচ্ছে।
একটু কাঁদতে পারলে ভাল
হত। কান্নাও আসে না।
বাধ্য হয়ে চোখ বন্ধ করে
পাশ ফিরে শুয়ে থাকে
সুমাইয়া। আলমের বিকট
নাকের ডাকের শব্দ ও
দুলুনিতে কখন যেন
ঘুমিয়েও পড়ে।
২.
আমরা কেমন বদলে
গেছি,তাইনা!
আমরা মানে! কী বলছ তুমি!
কেন! তোমার মনে হয়না যে
আগের আমিটা আমার মধ্যে
বসবাস করে না!
একসময় তুমি খুব রূপসি
ছিলে। তোমার রূপের টান
আমি আজও অনুভব করি।
কিন্তু এখন তা আর
উপভোগের নয়। তাইতো! যেন
শরীরে টান পড়লে মনের
সৌর্ন্দয্যের জায়গায়ও
টান পড়ে। সত্যি বলতে
কী,আমি যা বলতে চাই,আমি
তা বলতে পারছিনা।
কিসের কথা বলছ!
আমার খুব সমস্যা হচ্ছে,
আমাকে নিয়ে। আমি আসলে
কথাটা কীভাবে বলব, তা,
বলা উচিত কিনা তাও
বুঝতে পারছি না।
বল, বলে ফেল।
বলব!
হ্যাঁ, বল।
আমার আসলে তোমার
সান্নিধ্য আর ভাল
লাগছেনা। আমি একা থাকতে
চাই। আমার ছেলেমেয়েরা
বড় হয়ে গেছে, তাদের জীবন
তারা গড়ে নিচ্ছে।
ভালমন্দ বুঝতে শিখেছে।
এখন আর কোনো দায়িত্ব
আমার আর ভাল লাগছে না।
আজকাল তোমার সাথে আমার
সম্পর্কও একটা বিপুল
দায়িত্বের বোঝার মতো
লাগছে। আমি এর ভিতর
থেকে পালাতে পারলেই
বাঁচি। আমি একাই দূরে
কোথাও চলে যেতে চাই।
কোথায়!
এটা হতে পারে,আমাদের
গ্রামের বাড়ি। সেখানে
আমাদের বড়
দিঘীটায়,যেখানের জলে
হাঁসভর্তি,তার ঘাটে পা
ডুবিয়ে বসে থাকতে চাই।
রাতে বারান্দায় বসে
দেখতে চাই সাদা
জ্যোৎস্নায় কেমন করে
বাগানের সাদাফুলগুলো
হাসছে। আমি আরও অনেক
কিছু চাই। আমি শুধু
আমার নিজের মনের সাথে
একান্তে বাস করতে চাই।
সেখানে আজকের এই
প্রাত্যাহিক অভ্যাসের
গল্পটি থাকবেনা।
থাকবেনা ভারী পাথরের
মতো এই প্রেমহীন জীবনকে
বয়ে বেড়াবার ক্লান্তি !
এই বয়সে তোমার অসুখ
করলে কে দেখবে! তাছাড়া
খাবার -দাবার তৈরি
করারও ঝামেলা আছে।
এখানে কাজের লোক
রয়েছে,তারা করে দেয়।
ওখানে কে দেখবে
তোমাকে!
আমার কিছুই লাগবে না।
শুধু একজনমে একবার
নিজের মতো করে বাঁচতে
চাই। বিয়ের আগে
বাবা-মায়ের কাছে,
কিছুদিন কলেজের
হোষ্টেলের সুপার আপার
তত্ত্বাবধানে,তারপর
তোমার কাছে। আমার জীবন
কোথায়! যা দূঃখ কষ্ট
সত্য মিথ্যার
অভিজ্ঞতায় পাবো!
কোনো এক সকালে এমন এক
স্বপ্নিল কথোপকথনের
ভিতর ঘুম ভাঙ্গে
সুমাইয়ার। দিনটি ছুটির
দিন। সকালের রোদ তখন
জানালা দিয়ে উঁকি
দিচ্ছে। আলম শুয়ে আছে
তখনও। হাতটা শিশুদের
মতো মুঠি করা। স্বপ্নের
কথোপকথন তখনও তার কানে
বাজতে থাকে। যে মানুষটি
এখন শিশুর মতো
ঘুমাচ্ছে, তাকে কী
সত্যিই কখনও বলা যাবে
এই সব স্বপ্নের না বলা
কথাগুলো! না, কখনও নয়।
এইসব কথা নিষিদ্ধ
সত্যের মতো। অবরুদ্ধ
মনের এইসব কথা আলম কখনও
বুঝবেনা। এখন সে সত্যিই
শিশু। কিন্তু জেগে ওঠার
পর তীব্র পুরুষ। শুধুই
পুরুষ। নিজের প্রয়োজনে
পাথর নারীকে যে ভেঙে
ফেলতে পারে শাবলের
তীব্র আঘাতে; যতক্ষণ
থাকে কামনার যন্ত্রনা।
তবু আজকের সকালটি তার
ভাল লাগে, তার মনের
প্রতিফলনটি অন্তত সে
দেখতে পেয়েছে ভোরের
স্বপ্নে।
বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে
সে আবার এও ভাবে ,এইসব
ভাবনাগুলি আমার মাথায়
কেন আসছে! সারাক্ষণ
টিভি সিরিয়াল দেখে দেখে
এইসব হচ্ছেনা তো! বাসায়
এখন দুটি ঠিকা বুয়া কাজ
করে। কোনো প্রয়োজন নেই,
দুজন কাজের লোকের। নিজে
কিছু কাজ করলেও শরীর-মন
ভাল থাকবে। এইসব অচেনা
অবচেতনের ভাবনা
সুমাইয়াকে সত্যি
সত্যিই ক্লান্ত করে।
তাই সে দেরী না করে
বাথরুমে ঢুকে একটা
চমৎকার ¯স্নানে সময়
কাটায়। ফ্রেশ, ফুরফুরে
ভাবনা মাথায় নিয়ে চায়ের
টেবিলে বসে। আলমও
ততক্ষণে বিছানা
ছেড়েছে। টেবিলে বসে
পত্রিকার মুখোমুখি।
চায়ের অপেক্ষায়। শুরু
হয় ফুরফুরে দিনের
মুখোশে আরেকটি
ক্লান্তিময় অর্থহীন
দিন।
৩.
সময়টা এভাবে কেটে যেতে
যেতে সুমাইয়ার
ভাবনাগুলো আরও জট
পাকায়। এবার সে স্থির
সিদ্ধান্তে আসে, এটা
ঠিক যে, তার জীবন এক
ক্লান্তিময় প্রেমহীন
সময়ের মধ্যে পার করছে।
যে সংসারকে আগে লতার
মতো মনে হত,এখন মনে হয়
ফনা ধরা সাপ। অথচ
উল্টোটাই হবার কথা ছিল।
তার মা-খালাদের জীবনে
এমন ক্লান্তি কখনও
আসেনি। এখনকার সময়টাই
এমনভাবে তৈরি। কী দরকার
ছিল ছেলে-মেয়েকে
লেখাপড়া শিখিয়ে বিদেশ
পাঠানোর! ছেলে বিয়ে
করেছে এক বিদেশীনি কে।
সে আবার সন্তান নিতে
রাজী না। আলম বিয়ের খবর
শুনে বলছিল,‘ভাগ্য ভাল
নিগ্রো-বিয়ে করেনি!
সমকামীতার ফাঁদে পড়েনি!
যা হয়েছে মেনে নাও।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলতে
ফেলতে সব মেনে নিয়েছে
সুমাইয়া। গত চারবছরে
ছেলে একবারও দেশে
ফিরেনি। মেয়েটি পি এইচ
ডি শেষ না করে বিয়েই
করবে না। ছেলেমেয়ে
দুটিই কোন্ দূরদেশে একা
একা জীবন পার করছে। কী
দরকার ছিল এসবের! এখন
নাতি নাতনি নিয়ে ভরা
সংসারে থাকার কথা
সুমাইয়ার, অথচ তাকে
থাকতে হচ্ছে হারানো
স্মৃতির মধ্যে।
ফেসবুকে একদিন
ছেলেমেয়েদের
ষ্ট্যাটাস না দেখলে
বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে!
কেন যেন বোবা কান্নায়
দমবন্ধ হয়ে আসে। এসব
কথা কাউকে বলা যায় না।
এসব মুহূর্তে আলমকেও
কাছে পাওয়া যায় না।
কারণ তার রয়েছে নিজস্ব
জগৎ, বিজনেসের নানা
প্রকল্প।
৪.
অসুস্থ মন কী করে সুস্থ
হবে তার ঠিক ঠিক সন্ধান
না জানলেও সুমাইয়া এখন
নিয়মিত পার্কে হাঁটতে
যায়। তার কোনো বন্ধু
-বান্ধব তৈরি হয় না।
আজকাল সব মানুষকেই তার
মনে হয় বিকারগ্রস্থ।
কেউ কেউ হঠাৎ বক
ধার্মিক,কেউ আবার
অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটার
জগতে সময় কাটায়। কেউ
কেউ সারাক্ষণ ম্যাসেজ
পারলারে। আর এদের
মুখভর্তি কেবলই
ফেসবুকে আবিস্কৃত জটিল
সংবাদ,যা শুনলে
সুমাইয়ার মাথা
তিনচক্কর দেয়। এসব
মানুষের কাছে কিছু
শেয়ার করার অর্থ,
ছদ্মবেশী মানুষের হাতে
ধরা খাওয়া। তবু এমন
দিনেই একদিন বসন্তের
বিকেলে সে পার্কে
হাঁটতে যেয়ে দারুণ এক
প্রেমময় যুগলকে
আবিষ্কার করে। দুজনেই
বাসন্তী রঙ গায়ে,
মেয়েটির চুলে হলুদ
অলকানন্দা । চমৎকার!
ছেলেটিকে সে আগেই দেখতে
পেত। কানে হেড ফোন
লাগিয়ে সুঠাম শরীরে
ট্র্যাকস্যুট গায়ে
জগিং করছে। হাঁটতে
হাঁটতে বিপরীতদিক থেকে
কখনও মুখোমুখি হয়ে গেলে
সুমাইয়াকে সালাম
জানাত। এমন মিষ্টি করে
হাসত,যেন কতকালের চেনা।
সুমাইয়ারও খুব ভাল
লাগত। এমন মরীচিকাময়
জগতে, ছেলের মতো, বন্ধুর
মতো, বা কোনো এক রহস্যময়
যুবকের মতই সুমাইয়াকে
আকৃষ্ট করত ছেলেটি। আর
তার বলিষ্ঠ সুদর্শন
শরীরে এমন একটি সুস্থির
প্রাণের স্পর্শ ছিল, যা
খুবই আকর্ষণ করত
সুমাইয়াকে।
সর্ম্পকটির কোনো নাম
নেই, কিন্তু পার্কের
চমৎকার সুন্দর ঋজু
গাছগুলির নিচে চুপচাপ
দাঁড়িয়ে থাকলে যে
অনুভবটি পাওয়া যায়
ছেলেটির কাছে দাঁড়ালেও
তা পাওয়া যেত। সুমাইয়ার
মনে তখন কোনো যন্ত্রণা
কাজ করতো না। সে
সুস্থির হয়ে দেখত
বিকেলের সময়টিকে।
একদিন আকস্মিকভাবে
সুন্দর বিকেলের মধ্যেই
হঠাৎ করে আকাশ অন্ধকার
হয়ে এল। সুমাইয়া তখন
পার হচ্ছিল লেকের
ব্রীজটা। ছেলেটাও
আসছিল দৌড়ে- দৌড়ে,
মুখোমুখি। ঝড়ো বাতাস
হঠাৎ যেন অসময়ে এসে
চিরচেনা পরিবেশকে
একেবারে উল্টে পাল্টে
দিল। ছেলে-বুড়ো সকল
মানুষের হুড়োহুড়ির
ভিতর সুমাইয়া কখন যেন
ছেলেটির হাতের লগ্নি
হয়ে আতঙ্কিত সময়টিকে
নিমিষে পার করে একটা
চমৎকার ছায়াময়
অ্যাপার্টমেন্টের
তলায় গিয়ে দাঁড়িয়ে
পড়েছিল। ছেলেটি
এমনভাবে পাশে এসে
দাঁড়িয়েছিল যেন এই
মুহূর্তে সুমাইয়াকে
রক্ষা করার দায়িত্ব
তারই। ঝড় থামার আগে সে
সময়টিতে ঘুরে-ফিরে অনেক
কথা হল। জানা গেল,ওর নাম
তসলিম হোসেন সেন্ট্রাল
রোডে নিজেদের বাড়ি।
দুইভাই ডাক্তার। দেশের
বাইরে। সে আর তার মা
বাড়িটিতে থাকে। কয়েকজন
কেয়ারটেকার আছে বাড়ি
দেখাশোনা করার। ছেলেটি
জার্নালিজমে পড়েছে,
কিন্তু মিডিয়ার কোনো
চাকুরি তার ভাল লাগে
না। স্বাধীন ব্যবসার
কথা ভাবছে।
সুমাইয়ার ভারী ভাল
লাগছিল এইসব অন্তরঙ্গ
আলাপ। নিজের ছেলেকে আর
কতটাই বা পেয়েছে। পেলেও
তার নিজের ছেলে ,এই
ছেলেটির মতো নয়।
মানুষের মধ্যে
স্বচ্ছতার এক ভিন্ন
সৌর্ন্দয্য আছে। সবার
মধ্যে তা পাওয়া যায় না।
এসব ভাবতে ভাবতে
সুমাইয়া বলে ফেলল.কিছু
মনে করো না,তুমি আমার
ছেলেরই বয়সী। ওইদিন যে
মেয়েটিকে তোমার সাথে
ঘুরে বেড়াতে দেখলাম সে
কী তোমার স্ত্রী!
লজ্জায় মুখটা একটু লাল
হল তসলিমের। ওর নাম
তন্বী। সামনে ওর
মেডিকেল ফোর্থ ইয়ারের
পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষ
হলেই আমরা বিয়ে করব।
ও দেখতে খুব সুন্দর।
তোমাদের দুজনকে দারুণ
মানিয়েছে। ওর চুলের
হলুদ ফুলটাও মানিয়ে ছিল
দারুণ। আমি দূর থেকে
তোমাদের দেখছিলাম।
আজকাল মানুষের
সর্ম্পকের মধ্যেও
সুস্থতা চোখে পড়ে না।
অশালীন কত কিছু ঘটে যায়
চোখের সামনে। কিন্তু
তোমাদের মধ্যে দারুণ
একটা ঝকঝকে ভাব দেখলাম।
ভাল লাগল।
তসলিম নিঃশব্দে হাসে।
নিঃশব্দতার ফাঁদটিকে
এড়াবার জন্য সুমাইয়া
আবার বলে,একদিন তন্বীকে
নিয়ে আসো আমার বাসায়।
ধানমন্ডী পনেরোতে। চা
খাবো আর গল্প করবো।
তোমার আম্মুকে নিয়েও
আসতে পার।
জ্বী, আন্টি। তসলিম
মাথা নেড়ে সম্মতি
জানায়। সুমাইয়া খুব
গভীরভাবে ছেলেটিকে
দেখতে থাকে। ঝড় থামার
পর বসন্ত বিকেলের শেষ
আলোটিকে আরেকবার
আকাশের এক কোণে উঁকি
দিতে দেখা গেল। সবাই
যার যার মতো বাড়ি ফেরার
দিকে। সুমাইয়ার গাড়ির
ড্রাইভারের কলটি বেজে
উঠল মোবাইলে।
৫.
লেকের পাড়ে বসে
সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে
সুমাইয়া মাঝে মাঝে
খুঁজে পায় চমৎকার ছোট্ট
একলা পাখি। নীল আকাশে
একা একাই ছোট্ট ডানা
মেলে ভাসে। একলা,
স্বাধীন আর পূর্ণ।
এতটুকু প্রাণে একা একা
উড়বার সাহস। সুমাইয়ার
প্রাণে কেমন আনন্দ হয়
,দেখতে দেখতে। সে
গুনগুন করে গায়,‘আপনি
যে আছে আপনার
কাছে,নিখিল জগতে কী
অভাব আছে’।
.অজস্র বৃষ্টির ফোঁটা
মাথায় নিয়ে একদিন
পার্কের সবুজ
গাছগুলিতে বর্ষা নামে।
সুমাইয়ার বয়স আরও বাড়তে
থাকে। বলিরেখাগুলো
স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর
হয়। তার আর আলমের মধ্যে
সর্ম্পকের ব্যাথারা
ক্রমশই কখনও তিক্ততায়
,আবার কখনও অস্থিরতায়
ভিতরে ভিতরে ফুঁসে ওঠে।
ওরা দুজনেই ক্লান্ত
হয়,আবার দুজনেই দুজনের
মতো করে মুক্তির উপায়
খোঁজে। অনেকদিন হল
পার্কে তসলিমকে দেখা
যাচ্ছে না। ভিতরে ভিতরে
সুমাইয়া অনেক লোকের
ভীড়ে তাকে খোঁজে। হঠাৎ
কী হল! অনেকদিন ধরে
ছেলেটিকে দেখিনা কেন?
প্রায়ই ছেলেটির ভাবনা
মাথার ভিতর জট পাকায়।
এভাবে ছয়টি মাস পার হয়ে
যায়। তসলিম পার্কে আসে
না। দুটো ইদ উৎসবের আগে
সুমাইয়া ভেবেছিল
তসলিমের দেখা পাবে।
কথায় কথায় অনেক কথা
হলেও ওর ফোন নাম্বার বা
বাসার ঠিকানা কোনোটাই
নেয়া হয়নি সুমাইয়ার।
নেবেই বা কেন! পার্কে
হাঁটার সময় কতজনের
সাথেইতো দেখা হয়! তাই
বলে সেই সর্ম্পককে কেউ
বাড়িতে বয়ে নিয়ে আসে
নাকি! তবে তসলিমের জন্য
যে মনের ভিতর এমন একটি
আলাদা টান তৈরি হবে ,তা
কী সে জানত! আর এমন হঠাৎ
করে সে উধাও হয়ে যাবে,
এটাও সে ভাবেনি। হাঁটতে
হাঁটতে প্রতিদিনই তার
মন প্রতিক্ষায় উন্মুখ
হয়ে থাকে তসলিমকে দেখার
জন্য। এভাবে একটি বছর
প্রায় শেষ হয়ে আসতে
থাকে। আবার বসন্ত আসে।
সেদিন পহেলা ফাগুন। পথে
পথে হলুদ রঙ ছাপানো
বিস্তার। বাতাস আর
ধুলোও হলুদ রঙের সাথে
পাল্লা দিচ্ছে অসীম
সাহসে। আজ ভীড়ও অনেক।
যেন সব বয়সী মেয়েরাই
সেজেছে হাত ও মাথায়,
ফুলের সাজে। এমন ভীড়ের
মধ্যে মাথায় হলুদ ফুল
গোঁজা তন্বীকে দেখে
চমকে ওঠে সুমাইয়া।
তন্বীর সাথে তার আলাপ
নেই। তবু গায়ে পড়ে
শুধুমাত্র তসলিমের খবর
জানার জন্য ভীড়ের মধ্যে
লোকের ধাক্কা সামলাতে
সামলাতে দ্রুত এগোতে
থাকে সুমাইয়া। তন্বীও
দুলতে দুলতে খুব দ্রুত
এগোচ্ছে। হাতে দুটো
কোণ্ আইসক্রিম।
সুমাইয়ার চোখ তাকে
তীব্রভাবে অনুসরণ করতে
থাকে।
লেকের পাড়ে একটি হুইল
চেয়ার। নিরাপদে এককোনে
রাখা আছে। তাতে বসে আছে
তসলিম। হলুদ শার্ট
গায়ে। হুইল চেয়ারে কেন!
সুমাইয়া এক ঝটকায় ঝুঁকে
পড়তে চায়। তার পা দুটি
আছে কী নেই বুঝা যাচ্ছে
না। ঢোলা কালো প্যান্ট
কোমরের অংশ থেকে পা
পর্যন্ত। হুইল চেয়ারে
বসেই তন্বীর হাত থেকে
আইসক্রীমটা সে নিল।
একটু হেসে মুখটি নামিয়ে
জিভে লাগাল আইসক্রিমের
স্বাদ। আনন্দিত। চোখে
-মুখে ছড়িয়ে পড়েছে
আনন্দের রেশ। সুমাইয়া
বিস্মিত! কী বলবে সে!
কিছু জিগ্যেস করা কী
ঠিক হবে! এটি সাময়িক
অসুস্থতা কিনা তাও
নিশ্চিত হতে পারছে না।
তন্বীর হলুদ শাড়ি ,হলুদ
টিপ আর চমৎকার সুন্দর
মুখের কাছে যেয়ে কোনো
প্রশ্ন করার সাহস হল না
সুমাইয়ার।
সুমাইয়া চোখ ফিরিয়ে
নিয়ে যাবার উপক্রম
করতেই তসলিমের চোখে চোখ
পড়ল। সেই ডেকে নিল
সুমাইয়াকে।
আন্টি! আন্টি!
হ্যাঁ,আমি তোমাদের
দেখছিলাম। কিন্তু! তুমি
হুইল চে---য়া--রে---। কথাটি
ঠিকঠাক শেষ করতে পারলনা
সুমাইয়া। রক্তশূন্য
মুখনিয়ে চোখে
দুর্বোধ্য দৃষ্টি।
তসলিম নিজেই
বলল,‘রিকশা থেকে নামতে
যাচ্ছিলাম,সিএনজি
ধাক্কা দিয়ে ফেলে
দিয়েছিল রাস্তার উপর।
একটি পা পুরোপুরিই
গেছে। অনেকদিন বিছানায়
ছিলাম।’ তারপর একটু
থেমে, মুখে সেই চমৎকার
হাসিটি নিয়েই বলল,‘ কী
আর করা! সবই কপাল! এখন
তন্বীই আমার অভিভাবক।
দু মাস আগে আমরা বিয়ে
করেছি। ’
সুমাইয়ার চোখের ঘোর
কাটতে চায় না। অপলক
তাকিয়ে থাকে। লেকের
পানিতে তখন বাতাসের
দোলায় ঢেউ দিয়ে যাচ্ছে।
তাতে মিশে যাচ্ছে
অস্তগামী সূর্যের রঙ।
দুটি মানব-মানবীর শান্ত
প্রাপ্তির মধ্যে তার
অপ্রাপ্তির রঙগুলোকে
সে লেকের জলের
সূর্যাস্তে মিলিয়ে
যেতে দেখার জন্য ঠায়
দাঁড়িয়ে থাকে।