সেদিন ধলা জ্যোৎস্নায়
রাত নিশুত হইছিলো না।
বিলের বাতাসে আউশ ধানের
গন্ধ। হিজল গাছের পাতায়
পাতায় একটু আধটু আন্ধার
ঘুপটি মাইর্যা ছিল।
আখড়ার মন্দিরে
অষ্টপ্রহরের কীর্তন
হুট কইর্যা থাইম্যা
গেলো। আর তখনি বকপাখির
মতো সাদা পাখনা লাগান
একখান নকশীবাক্স
উইড়্যা আইস্যা পড়লো এই
বাড়ির আঙিনায়।'
কাঠের নকশী বাক্স নিয়ে
দাদীর এই গল্প বাড়ির
সকলের জানা। যতবার দাদী
এই গল্প করেন কেউ মুচকি
হাসে, কেউ বিরক্ত হয় আর
কেউবা চোখ দু'টো সরু করে
দাদীর দিকে অপলক তাকিয়ে
থাকে। আর সেই সরু চোখকে
আরোও সরু করে দিয়ে দাদী
বলে ওঠেন,
‘ধলা জ্যোৎস্নায়
হিজলের বনে
বকপক্ষী সুর যোগায়
বন্ধুর গানে'
তিনি অবশ্য শুধু এ
বাড়ির নয়, বলতে গেলে এই
পুরো গ্রামের দাদী।
বিলের ঠিক মাঝখানে
দাঁড়ানো পাকুড়গাছের
জন্মবৃত্তান্ত
একমাত্র দাদীই বলতে
পারেন। শাদা ছনের মতো
চুল আর হলদে জ্যোৎস্নার
মতো গায়ের রঙ নিয়ে দাদী
সারাক্ষণ গীত বানান
মুখে মুখে।
এই তো সেদিন,
কৃষ্ণপক্ষের ঘোলা আলো
বিলের পানির শরীরে
পাকুর গাছ মস্ত ছায়া
ফেললো। আর সাথে সাথেই
দাদী গেয়ে উঠলেন,
' চান্দের আলোয় বিল অথই
বন্ধু আমার আইলো কই?
নিশুত রাত, নিদ্রার
ক্ষণ
জাগায় মোরে হিজল বন।
বকপক্ষীরা ধরে গান
মনের ভেতর ঝড়-তুফান।'
দাদীর এই গীত আপাত খুব
সরল। এ বাড়ির
মানুষগুলোর সে সুর আর
কথায় খুব একটা মন নেই।
তবে গাইতে গাইতে
দাদীজান যে কাজটা করে
তাতে সকলেই আগ্রহী হয়ে
ওঠে।
না, না, সে আগ্রহ দাদীর
প্রতি নয়, তা জাগে সেই
কাঠের নকশী বাক্সটির
প্রতি।
গাইতে গাইতেই দাদী নকশী
বাক্সে মোলায়েম হাত
বোলায় আর শত ব্যবহারে
নরম হয়ে আসা পরনের
কাপড়খানা দিয়ে ধুলো
মোছে।
' ও বড় দাদী, বাক্সখান
কীসের?'
এ বাড়ির অল্পবয়সী
সদস্যরা প্রায়ই প্রশ্ন
করে তাঁকে।
দাদী মুচকি হাসে। পান
খাওয়া লাল ঠোঁট নাড়িয়ে
বলে,
' তামাম জীবনের সম্পদ'
এই উত্তর তাদের বোধগম্য
হয়না। কেউ কেউ অতি
উৎসাহি হয়ে বলে,
' ওই বাক্স তাইলে
পুতুলের ঘর। ও দাদী কী
কী রঙের পুতুল আছে?
দেখাও দেখি।'
বলে এক পা দু'পা এগোয়
তারা। আর তখনি মুচকি
হাসি ফুরিয়ে যায় দাদীর
লাল ঠোঁট থেকে।
জ্যোৎস্নার মতো
চেহারায় এক টুকরো
অমাবস্যা হঠাতই উদয়
হয়।
' থাম্, আর আগাইবিনা কেউ।
আর এক পা আগাইলে
বাক্সখান বকপক্ষী হইয়া
উইড়্যা যাইবো।'
ব্যস্, হয়ে গেলো।
বাচ্চাগুলোর তীব্র
আকাঙ্খায় বাঁধা পড়তেই
শুরু হয়ে যায় চিৎকার।
এ চিৎকার বাড়ির বড়দের।
' মুরুব্বী মানুষ এমন
কাজ ক্যামনে করে?
এজন্যই জ্বীন ভূতের ভয়ে
পোলাপাইনগুলা রাতে
স্বপ্নে কাঁনতে থাকে।'
দাদী সাদা ছনের মতো চুল
হাতে জড়িয়ে খোঁপা করে।
এরপর উড়ে আসা সব বাক্য
উপেক্ষা করে ঘরের দরজায়
হুড়কা দেয়। আড়াল করে
নকশী বাক্স।
আর এই আড়াল জন্ম দেয়
আরোও কতশত আগ্রহের।
' আসলে বাক্সখান তিনি
পাইছেন কোথায়?' '
বাক্সখান এত আগলাইয়া
রাখেন ক্যান উনি?'
'বাক্সখান লইয়া এমন
রূপকথার গল্প ক্যান
বলেন তিনি?' -----------
প্রশ্নগুলো এ বাড়ির এ
ঘর থেকে ও ঘরে ভেসে
বেড়ায়। ভেসে বেড়ায়
বিলের বাতাসে।
তবে যিনি এই প্রশ্নগুলো
প্রথম তুলেছেন তিনি আর
এখানে নেই।
সেদিন সন্ধ্যাটা একটু
বেশীই আবছা ছিল। বিলের
পানিতে একাদশীর চাঁদ
তিরতির করে কাঁপছিল।
দাদী তখন যুবতী। তিন
সন্তানের মা। বিলের
পানিতে সারাদিন জাল
ভাসিয়ে ঘরে ফিরেছে তাঁর
স্বামী। ইয়াকুব
মুন্সী। খালি হাত তাঁর।
ভাতের জন্য আবদার করতে
করতে ঘুমিয়ে পড়েছে
সন্তানগুলো। তাদের
অগভীর নিঃশ্বাস স্থির
থাকতে দেয়না তাঁকে।
অস্থির করে তোলে।
' আইজ জালে যা পড়ছিলো তার
সবই আগের দেনা মেটাইতে
গ্যাছে। ভুখা
বাচ্চাগুলান দ্যাখলে
জান পুড়ায়। ওই নকশী
বাক্সখানের কী কাজ এই
অভাবের সংসারে। দেও,
ভেতরে যা আছে তা
দিইয়্যা কিছু খানার
যোগান করি।'
কথা শেষ করে ইয়াকুব
মুন্সী এগোয় মাচার উপর
কাপড় দিয়ে ঢাকা
বাক্সটার দিকে। তাঁর
স্ত্রী কিছুটা সময় নেন
ঘটনা বুঝতে। ইয়াকুব
মুন্সী গিয়ে দাঁড়ান
মাচার পাশে। হাত দিয়ে
সরান কাপড়ের আবরণ নকশী
বাক্স থেকে।
আর তখনি যুবতী স্ত্রী
প্রায় দৌড়ে গিয়ে থামান
তাঁকে।
' না, না, এই বাক্সে হাত
দেওন যাইবো না।'
সারাদিনের পরিশ্রম আর
সন্তানদের ক্ষুধা
ইয়াকুব মুন্সীকে আগে
থেকেই অধৈর্য্য করে
রেখেছিলো। আর নকশা
বাক্স নিয়ে স্ত্রীর
আদেখলাপনায় তিনি
শকুনের মতো তীক্ষ্ণ হয়ে
উঠলেন। এক ছোঁ মেরে
বাক্সটা নিয়ে চলে এলেন
ঘরের বাইরে। রাগে
কাঁপতে কাঁপতে বললেন,
' এত দরদ ক্যান এই
বাক্সের জইন্য? কী আছে
এই বাক্সের অন্দরে?
পোলাপাইন্যার ভুখেও যে
মা সম্পদ আগলাইয়্যা
বইস্যা থাকে সে একখান
ডাইনি।'
ইয়াকুব মুন্সীর স্ত্রী
তখন আছাড়িপিছাড়ি যায়
দুয়ারে।
' এই সর্বনাশা কাম কইরেন
না। আমি পাড়া থ্যাইকা
চাল চাইয়া আনমু।'
কিন্তু ইয়াকুব মুন্সীর
ক্ষুধার্ত দেহ ও অভাবী
মন তাতে পাত্তা দেয় না।
তিনি নকশী বাক্স নিয়ে
ততক্ষণে উঠোনে। মাটিতে
রেখে তা খুলতে উদ্যত।
আর তখনি বিলের পানিতে
ঘূর্ণি আসে। শুরু হয়
আচমকা তুফান। সে তুফান
অবশ্য ইয়াকুব মুন্সীকে
নিরস্ত্র করতে পারে না।
তিনি দারুণ ক্ষীপ্রতা
দিয়ে নকশী বাক্স খুলতে
ব্যস্ত। বাক্সের ডালায়
ইয়াকুব মুন্সির হাত।
বিলের ঘূর্ণি উঠে আসে
উঠানের শিমুল গাছে।
একটি ডাল হঠাৎ ভেঙে পড়ে
ঠিক ঠিক তাঁর মাথা
বরাবর। আঘাতে ইয়াকুব
মুন্সীর হাত আলগা হয়ে
আসে নকশী বাক্স থেকে।
তরতর করে বের হতে থাকে
রক্ত মাথা থেকে।
সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন
তিনি।
এদিনের পর আর সংজ্ঞায়
ফেরেননি ইয়াকুব
মুন্সী।
' মানুষটা যখন তুফানের
মইধ্যে জ্ঞান
হারাইল্যান তখন কতগুলি
বকপক্ষী আইস্যা
ঘিইর্যা ধরলো পুরা
বাড়ি। জানাজার পর
পক্ষীগুলান উইড়্যা
যায়।'
এ কথা গ্রামে প্রচলিত।
গ্রামের সবাই কিন্তু
সেদিনই প্রথম জেনেছিলো
নকশী বাক্সের
অস্তিত্বের কথা।
ইয়াকুব মুন্সীর যুবতী
স্ত্রী নির্বাক হয়ে
দাঁড়িয়েছিলেন সেদিন
নকশী বাক্সটি কোলে
নিয়ে, তুফানের ভেতর।
তুফান থেমে গেলেও গ্রাম
আর এ বাড়ি থেকে থেমে যায়
না নকশী বাক্স নিয়ে
কথা। ইয়াকুব মুন্সীর
ফেলে যাওয়া প্রশ্নগুলো
আরোও তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে
দিনে দিনে।
প্রশ্নগুলো যত তীক্ষ্ণ
হতে থাকে দাদী হতে
থাকেন তত নিস্পৃহ। সেই
নিস্পৃহতা শুধুই
প্রশ্নগুলোর প্রতি।
নকশী বাক্সকে ঘিরে তাঁর
যত্ন বেড়ে যেতে থাকে
বরং প্রশ্নাতীত।
আর এই অতিরিক্ত যত্ন ও
আড়ালটাই এই বাড়ির
বর্তমান মানুষগুলোর
চক্ষুশূল। আর তা হবেই
বা না কেন?
বিলের বাতাসে যেভাবে
ভেসে বেড়ায় নকশী বাক্স
নিয়ে গল্প ঠিক
তেমনভাবেই ভেসে বেড়ায় এ
বাড়ির দারিদ্রতার
গল্প।
এ বাড়িতে এখন বসত দাদীর
তিন নাতির। দোচালা
দু'টি ঘরের মরচে ধরা
টিনের ফুটোয় সারাক্ষণ
বেজে চলে অভাবের একঘেয়ে
সুর। এ বাড়ির কেউ
বাপ-দাদার মতো বিলের
পানিতে জাল ভাসায় আবার
কেউবা করে দিনমজুর। তবে
দিনশেষে একটি কাজ
তাদেরকে একসুত্রে
গেঁথে দেয়। আর তা হলো,
প্রয়োজনের অপ্রতুল
যোগান আনার ব্যর্থতা
নিজেরা ঢেকে দেয় দাদীকে
অকথ্য ভাষায় বকা দিয়ে।
' ওই বুড়ি হইলো এই
সংসারের দুশমন। পাষাণ
বুড়ি স্বামীরে খাইছে,
বেটা গো খাইছে অহন
আমাগো খাইবো। তাও ওর
হাউস মিটবো না। আমাগো
এত কষ্টেও বাইর হইবো না
বাক্স থ্যাইকা এক আনা।'
এই গালাগাল দাদীর গা
সওয়া হয়ে গেছে এতদিনে।
সেই স্বামী থেকে শুরু
এরপর নিজের সন্তানেরাও
আর্থিক দুর্গতির জন্য
তাঁকেই দায়ী করে গেছে।
সবার একই কথা, ' এত্ত
অভাবের ভিতরেও যে নকশী
বাক্সে সম্পদ
আগলাইয়্যা বইস্যা থাকে
সে ডাইনি।'
শুধু তাই নয়, দাদীর ছেলে
তো সেই নকশী বাক্স কেড়ে
নিতে গিয়ে মায়ের মাথাও
ফাটিয়ে দিয়েছিল। কপাল
আর মাথার সংযোগস্থলে
কাটা জায়গায় হাত বুলাতে
বুলাতে দাদী প্রায়ই
আক্ষেপ করেন,
' পোলাডার অভাবে মাথা
নষ্ট হইয়্যা গেছিলো।
কয়দিন প্যাটে ভাতও
পড়ছিলো না তহন। তাই
ভুখের জ্বালায় কাইড়্যা
নিতে আইছিলো বাক্সখান।
আমি বাঁধা দেওয়োনে
ধাক্কা দিছিল। ভুখা
শরীরে আমিও দুব্বল
আছিলাম তাই এই
রক্তারক্তি।'
এটুকু বলার পরেই একটা
ভেজা দীর্ঘশ্বাস বেয়ে
উঠে দাদীর গলায়।
' পোলাডা সেই রক্ত
দ্যাইখ্যা এমন ডরাইলো
যে পালাইয়্যা গ্যালো
বাড়ি থেইক্যা। আর
কুনুদিন ফিইর্যা আইলো
না।'
আর ঠিক একথার পরেই
তীব্র একটা ক্ষোভ ভর
করে দাদীর চেহারায়।
বৃদ্ধ শরীরে কোথা থেকে
যেন জড়ো হয় যৌবনের তেজ।
প্রায় চিৎকার করে বলে,
' এ বাড়িত কেউ ভাল থাহে
না। এই বাড়ি থ্যাইক্যা
মানুষ খালি হারাইয়্যা
যায়। এইড্যা একখান
অভিশপ্ত বাড়ি।'
দাদীর এইসব ক্ষোভ বা
হাহাকার এ বাড়ির
মানুষগুলোকে নাড়া দেয়
না। এ বাড়ি থেকে হারিয়ে
যাওয়া মানুষ নিয়েও
তাদের মাথাব্যথা নেই।
এখন তাদের আগ্রহ বা
মাথাব্যথা ওই নকশী
বাক্স নিয়ে।
তাই অন্যসব দিনের মতো
আজও বন্ধ দরজার এপাশে
দাঁড়ানো বাড়ির
মানুষগুলোর মনে
পুনঃবার ঠাঁই করে নেয়
বিরক্তি। বা তার চেয়েও
বেশী কিছু।
নকশী বাক্স নিয়ে এই
আদেখলাপনায় তারা
রীতিমতো
ক্রোধান্বিত।
' এই বয়সেও তিনি এমন
ত্যাজ দেখান! মুখের
উপরে দুয়ার আটকাইয়া
দ্যান। আমাগো দয়ায়
এইখানে আছেন তা ভুইলা
যান তিনি।'
বড় নাতিন বৌয়ের কথাগুলো
দাদীর থমথমে চেহারায়
একটা সুক্ষ্ম হাসির
প্রলেপ ফেলে। ফিসফিস
করে বলে,
' এইখানে আছি নিজের
ইচ্ছায়। জবান দিছিলাম,
অপেক্ষা করুম।'
এই কথাগুলো অবশ্য বাইরে
আসে না। ঘরের ভেতরে
বাতাসে কাটাকুটি খেলে
সে সব শব্দ।
সে সব শব্দ কোন
চুপিসারে ঘরের জং ধরা
টিনের ফাঁক দিয়ে গিয়ে
মেশে বিলের পানিতে ।
হিজল গাছ থেকে কয়েকটি
বকপাখি উড়ে এসে বসে
দাদীর ঘরের চালে।
দাদী গীত ধরে----------
'ছাইরঙের মেঘে যখন
আসমান ঢাইক্যা রাখে
মনের আশা বিলের ঢেউয়ে
তরতরাইয়্যা ভাসে।'
না, দাদীর মনের আশা
জানবার ইচ্ছা এ বাড়ির
কারো নেই। তবে যে নকশী
বাক্সের জন্য এ বাড়ির
বৌ বাচ্চারা অপমানিত
হয়, সেটার প্রতি ক্ষোভ
না জন্মে উলটো
অদ্ভুতভাবে আগ্রহ
জন্মে।
' এইবার তো পানি মাথার
উপরে উইঠা গ্যাছে। আর
কতদিন এমন চলবো? অনেক
হইছে। কাল সকালেই
দাদীরে ওই বাক্স খুইলা
দেখাইতে হইবো।'
ইউনুস মুন্সীর আদেশ।
দাদীর বড় নাতি। আপাতত
এই বাড়ির কর্তা সে। ছোট
দুইভাই সবকিছুতেই তার
আজ্ঞাবহ।
' বড়ভাই, ঠিক কইছে। কাল
সকালেই নকশী বাক্স
খুইল্যা দেখাইতে
হইবো।'
ছোটভাই শামসু মুন্সীর
এই কথার সাথে ঘাড়
নাড়িয়ে সায় দেয় মেজো
ভাই তমীজ মুন্সীও।
হুরকা লাগানো দরজার
এপাশে অবশ্য বাড়ির
অন্দরের সেই আদেশ এখনো
পৌঁছে না। দাদী তখনো
গুনগুন করে সুর ভাজছেন
গীতের।
মনের আশা বিলের জলে
তরতরাইয়্যা
ভাসে---------গাইতে গাইতে
দাদী এসে দাঁড়ান ঘরের
কোণায় বানানো ভাঙা
মাচার কাছে। পুরাতন
কাপড়ে ঢাকা নকশী বাক্স
সেখানে। তা সড়িয়ে ডালা
খোলেন নকশী বাক্সের।
এরপর হাত বাড়িয়ে দেন
ভেতরের অন্ধকারে।
সেখান থেকে মুঠোবন্দি
করে আনেন কিছু একটা।
মুঠোবাঁধা হাত নাকের
খুব কাছে এনে মুঠো
খোলেন। নাক ডুবিয়ে দেন
তাতে। কোনো সুবাসের
আশায় বুক ভরে শ্বাস
নেন। বাস বা সুবাস কী
পান বোঝা যায় না। তবে
চোখ খুলে হাতের দিকে
তাকান। ঘোলা চোখটা চকচক
করে ওঠে। হাতের ভেতরটা
ফাঁকা। হঠাৎ বিড়বিড় করে
ওঠেন দাদী,
' এই গ্রাম বদলাইয়্যা
গ্যাছে অনেক। কিচ্ছু
নাই আগের মতোন। বিলের
বাতাসে আউশের ঘ্রাণ
নাই, জ্যোৎস্নার ধবল রঙ
নাই, বিলের ঢেউয়ে
বাহারি নাও
নাই-----কিচ্ছু নাই।'
একটা লম্বা প্রশ্বাস
ঘরের বাতাসে ধাক্কা খায়
খুব আলগোছে।
দাদীর শ্বাসের খাঁজে
খাঁজে থাকা কথাগুলো এই
গ্রামের রূপকথা।
"এক গ্রামে আছিল এক
রাজকুমার। যেমন আছিল
তাঁর রূপ তেমন আছিল
তাঁর গুণ। কাঠের গায়ে
খোদাই কইর্যা নকশা
ফোটাইতো সে বড় চমৎকার।
আর এরলগে আছিল দরাজ
গানের সুর। সেই সুরে
গ্রামের লোক জাইগ্যা
যাইতো প্রত্যেক ভোরে।
লোকে তারে ডাকতো
গানকুমার। সেই
গানকুমারের আছিল একখান
বাহারি নাও। সেই বাহারি
নাওয়ের নকশাও তিনিই
ফোটাইছিলেন। মন চাইলেই
বিলের ঢেউয়ে ভাইস্যা
যাইতেন গানকুমার
বাহারি নাওয়ে। আর
ভাইস্যা ভাইস্যা
বাঁধতেন গান, বাঁধতেন
সুর। মাঝে মইধ্যে বিলে
ভাইস্যা হইয়া যাইতেন
তিনি নিরুদ্দেশ। কোনো
খবর বৃত্তান্ত পাওয়া
যাইতো না ম্যালাদিন।
তারপর হুট কইর্যা এক
দুপুরে ফিইর্যা আইতেন
নতুন গান, নতুন সুর
লইয়্যা। সেই সুর যখন
মাঝবিল থেইক্যা বাতাসে
ভাইস্যা আইতো তখন এক
ঝাঁক বকপক্ষী সাদা
পাখনা মেইল্যা উড়তে
থাকতো গ্রামের আকাশে।
বকপক্ষীগুলান আছিল
গানকুমারের বন্ধু। গান,
বিলের ঢেউ আর বকপক্ষী
লইয়্যা ভালই দিন
কাটতেছিল গানকুমারের।
কিন্তু গানকুমারের
বাবা-মার মন দুঃখে
কাতর। এই রাজ্যপাট
দ্যাখবে কে? কে রাখবো
হিস্যাব নিক্যাশ
সম্পদের। রাজপুত্র যে
সুযোগ পাইলেই ঘরবিমূখ!
অনেক ভাবনাচিন্তা
কইর্যা রাজকুমারের
জইন্য একটা রাজকুমারী
খুঁজে আনা হইলো।যে
রাজকুমারের সাথে সুখে
শান্তিতে বসবাস করিবে।
হইলোও তাই। গানকুমার
সংসারে মন বসাইলো। নতুন
রাজকুমারী গানকুমারের
সাথে সাথে মন জয়
কইর্যা নিলো গ্রামের
সক্কলের। তবে, সংসার কী
এতই ক্ষমতা ভোলাইয়্যা
দেয় গানকুমারের সুর?
বরং উলটা সেই সুর
গাইড়্যা বসলো সংসারে।
গানকুমার নিজে তুইল্যা
দিলো সুর রাজকুমারীর
কন্ঠেও। দু'জন মিইল্যা
গায়,
' বাঁশি বাজে বাজে রইয়া
রইয়া
গৃহে যাইতে মন চলে না
প্রাণ বন্ধুরে থুইয়া
কদমতলায় বাজে বাঁশি
রাধারে শোনাইয়া
পায়ে ধরি থামাও বাঁশি
নাগর কানাইয়া।'
কিন্তু সে সুখ
হারাইয়্যা গেল হঠাৎ
কইর্যা। গান বাঁধার
আশায় এক পূর্ণিমায় গান
কুমার বিলের ঢেউয়ে আবার
ভাসাইলো বাহারি নাও।
রাজকুমারী বাঁধা দেয়
নাই। গানকুমারের গান যে
তাঁরও জিয়নকাঠি। সেই
গানে ভাটা পড়লে চলবো
ক্যামনে। তাই
রাজকুমারী নিজে
বকপক্ষীগুলার লগে
বিলের তীরে দাঁড়াইয়্যা
বিদায় দেয় গানকুমারকে।
যাইতে যাইতে গানকুমার
গান ধরছিলো,
' পূর্ণিমার চান্দে
আন্ধার কাইট্যা
ধবল জ্যোৎস্নায় ভাসে
গাও
ছলাৎ ছলাৎ বৈঠার শব্দে
ভিড়বে তীরে আমার নাও'
কিন্তু, গানকুমারের নাও
আর ফিইর্যা আইলো না এই
গ্রামে। দিন কাইট্যা
মাস আসে, মাস কাইট্যা
বৎসর। কিন্তু
রাজকুমারীর অপেক্ষা আর
ফুরায় না। সেদিনের পর
থাইক্যা প্রত্যেক
পূর্ণিমায় বিলের ঢেউয়ে
ধবল জ্যোৎস্নার লগে
রাজকুমারীও অপেক্ষায়
থাকতো গানকুমারের।
কিন্তু একদিন ঘটলো এক
অঘটন। পুর্ণিমার
একরাতে হঠাত আসমান
আন্ধার হইয়্যা গ্যালো
মেঘে। তুফান উঠলো বিলের
পানিতে। সেই তুফানে
আছরাইয়্যা পড়লো
গ্রামে। সেই তুফানের পর
আর কোনো পূর্ণিমায়
রাজকুমারীকে দেখা যায়
না বিলের পাশে,
অপেক্ষায়। রাজকুমারীও
হারাইয়্যা যায় গ্রাম
থ্যাইক্যা।'
এইসব রূপকথা অবশ্য এ
বাড়ির মানুষগুলোর কাছে
একেবারেই গুরুত্বহীন।
নকশী বাক্স গুরুত্বের
সবচেয়ে বড় আসনে বসে আছে
আপাতত এদের কাছে।
' কী আছে ওই বাক্সে? খুব
দামী কিছু তো হইবই। না
হইলে এমন আগলাইয়া রাখবো
ক্যান দাদী?'
শামসু মুন্সী বিড়বিড়
করে বলে। এরপর হঠাৎ
করেই কিছু একটা ভেবে
চলে আসে ঘরের বাইরে ।
বাইরে নীরব অন্ধকার।
সেই অন্ধকারের নীরবতার
সাথে তাল মিলিয়ে
সন্তর্পণে এগিয়ে যায়
দাদির ঘরের দিকে। বন্ধ
দরজার এপারে দাঁড়ায়
কিছু সময়ের জন্য। এরপর
হুট করে সরে আসে দরজার
খুব কাছে। চারদিকে
কয়েকমুহূর্ত চোখ
বোলায়। তারপর একটি
লাকড়ি দিয়ে এক ঝটকায়
খুলে ফেলে দাদীর ঘরের
হুড়কা। এক মুহূর্ত সময়
নষ্ট না করে দ্রুত
পৌঁছে যায় নকশী বাক্সের
কাছে।
কয়েক মুহূর্তের
ব্যবধান এখন নকশী বাক্স
আর শামসু মুন্সীর
মধ্যে। সব পাবার
উত্তেজনা খুব কষ্টে
দমিয়ে সাবধানে হাত
বাড়ায় জিনিষটার দিকে।
আর তখনি তার আসন্ন
বিজয়ের মুহূর্ত নস্যাত
করে দুয়ারে একটি শব্দ
হয়। চারপাশের সব নীরবতা
খানখান হয়ে যায় কারো
সর্তক পায়ের আওয়াজে।
শামসু মুন্সী সজাগ হয়।
হুট করেই নিজেকে মিলিয়ে
দেয় মাচার নীচের
অন্ধকারে।
আর ঠিক তখনি অন্ধকারে
ফিরে আসে আবার অদ্ভুত
নীরবতা। ফুরিয়ে যায়
সর্তক পায়ের আওয়াজটি।
শামসু মুন্সীর কাছে
সময়গুলো অনন্ত মনে হতে
থাকে। একটু হাসফাস
লাগাও শুরু হয়। সে
মাচার নীচ থেকে মাথাটা
বাড়িয়ে দেয়। আর তখনি
দুয়ারের কাছে অন্ধকারে
দুলে ওঠে একটি ছায়া।
শামসু মুন্সী এবার
আঁতকে ওঠে। নিজেকে আবার
ফিরিয়ে নেয় মাচার নীচের
কালচে অন্ধকারে।
কালো ছায়া আস্তে আস্তে
মানুষের আদল হয়ে ওঠে
শামসু মুন্সির কাছে।
কালচে অন্ধকারে
নির্বিকার থেকে সে
দেখতে থাকে মানুষটির
কান্ড-কারখানা। ঘরের
ভেতরে এসে মানুষটি কিছু
সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে
থাকে। এরপর কয়েক পা
এগিয়ে এসে দাঁড়ায় মাচার
পাশে। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে
চারপাশ দেখেই চট করে
হাত বাড়ায় কাপড়ে ঢাকা
বস্তুটির দিকে।
' খবরদার! ওইদিকে হাত
বাড়ান যাইবো না।'
শামসু মুন্সী বেরিয়ে
এসেছে মাচার নীচ থেকে।
তার চিৎকারে থেমে যায়
মাচার সামনে দাঁড়ানো
মানুষটির সকল
গতিবিধি।
'মনে এত লোভ আছিল, আমাগো
ফাঁকি দেওয়োনের ইচ্ছা
আছিল।'
এবার মানুষটি ফেরে
শামসু মুন্সীর দিকে।
' ফাঁকি দেওয়ার ইচ্ছা কী
আমার একাই আছিলো? এত
রাইত্যে তুমি এইঘরে
ক্যান আইছো?'
গলা খাদে নামানোর
চেষ্টা ব্যর্থ হয় তমীজ
মুন্সীর। উল্টো তার
ফ্যাসফ্যাসে গলায়
শব্দগুলো এই ঘরের দুয়ার
ডিঙ্গায় অবলীলায়।
রাতের নীরবতায় তা তা হৈ
চৈ হতে সময় নেয় না
মোটেও।
এ বাড়ির সবগুলো ঘরে
জ্বলে ওঠে লাইট
মধ্যরাতের ঘুমভাঙা
বিরক্তি নিয়ে। উঠোনে
জটলা জানান দেয় বাড়ির
বাচ্চাগুলোও এসে হাজির
হয়েছে এক অদ্ভুত কৌতুহল
নিয়ে।
' এই বাড়ির নিয়ম কী
সক্কলে ভুইল্যা
গ্যাছে?'
ইউনুস মুন্সীর গর্জন
বাড়ির সীমানা পেরিয়ে
আছড়ে পড়ে বিলের পাড়ে।
' ভাইয়ে-ভাইয়ে এমুন
বিবাদ শত অভাবেও এই
বাড়িত কখনো হয় নাই।'
বলেই ইউনুস মুন্সী
প্রায় দৌড়ে গিয়ে ঢোকেন
দাদির জীর্ণ ঘরটিতে। যে
বস্তুটিকে নিয়ে বিবাদ
সরাসরি গিয়ে দাঁড়ান
সেটার পাশে।
' এই বাক্স শুরু
থ্যাইক্যাই এই বাড়ির এই
বাড়ির শত্রু। মুরুব্বী
মাইনষের জিনিষ বইল্যা
এতদিন চুপ কইর্যা
ছিলাম। কিন্তু আর সম্ভব
না।'
ইউনুস মুন্সী সব আক্রোশ
দিয়ে আঁকড়ে ধরেন নকশী
বাক্সটি।
হঠাৎ ঘুম ভাঙা মানুষটি
সাময়িক ধাক্কা কাটিয়ে
উঠতে পারলেও,বেশী বয়সের
সীমাবদ্ধতায় আটকে যায়।
বিছানায় বসেই দাদি ভাঙা
গলায় টেনে টেনে কয়,
' ও ও ইউনুস, মাথা ঠান্ডা
কর নাতি। ওই বাক্স তোগো
কোনো ক্ষতি করে নাই।
ওইডা রাইখ্যা দে ভাই।'
শব্দগুলোয় কী খুঁজে পায়
ইউনুস মুন্সী তা বোঝা
যায় না। তবে তীব্র
ক্রোধে চিৎকার করে
বলে,
' থামো তুমি, অনেক হইছে।
এই বাক্সের জন্যই এ
বাড়িতে কাইজ্যা হয়। এই
বাক্সের জন্যই দাদাজান
ইন্তেকাল করছ্যান।
ছোটচাচা বাড়ি
থ্যাইক্যা পালাইছেন।
এই বাক্স একখান আপদ।
আইজ আমি সবার সামনেই
খুলুম এই নকশী বাক্স।
যা আছে ভাগ হইবো সবার
মইধ্যে।'
ইউনুস মুন্সী আর কথা
বাড়ায় না। নকশী বাক্সের
ডালা খুলতে যায় তীব্র
তৎপরতায়।
দাদীর বিহ্বলতা কেটে
গেছে ততক্ষণে। প্রায়
দৌড়ে এসে অনুনয় করতে
থাকে ইউনুস মুন্সীর
কাছে। সে অনুনয় গুরুত্ব
পায়না । তিনি তখন এই
বাড়ির সকলের নকশী বাক্স
নিয়ে আগ্রহ নিবৃত্ত
করতে ব্যস্ত।
তাই সমস্ত অনুনয়
অগ্রাহ্য করে ইউনুস
মুন্সী আশ্চর্য
তৎপরতায় খুলে ফেলে নকশী
বাক্স।
বাক্সটি খুলতেই
এতদিনের জমানো অন্ধকার
ভেতর থেকে ফুরফুর করে
বেরিয়ে এসে মিশে যায়
বিলের বাতাসে। সেখানে
জায়গা করে নেয়
ইলেকট্রিক বাল্বের
ক্ষীণ আলো।
বাড়ির প্রতিটি মানুষের
কৌতুহলী চোখ তখন নকশী
বাক্সের দিকে।
হঠাৎ মানুষগুলোর দিকে
ছুটে আসে ভৎসনা,
' এত লোভ তোগো সর্বনাশ
করবো। আমি কথা দিছিলাম
আমৃত্যূ অপেক্ষা করুম
মানুষটার জন্য।'
কথাগুলোর সাথে সাথেই
দাদির চেহারায় জায়গা
করে নেয় হেরে যাবার
হতাশা।
সে হতাশা অবশ্য ইউনুস
মুন্সীর চোখ এড়িয়ে যায়।
তাঁর দৃষ্টি তখন নিবদ্ধ
নকশী বাক্সের সম্পদের
দিকে। হাত বাড়িয়ে
উল্টিয়ে পাল্টিয়ে
দেখেন জিনিষটি। এরপর তা
বাড়িয়ে দেন মেজো ভাই
তমীজ মুন্সীর দিকে।
তমীজ মুন্সী হাত বাড়িয়ে
নেয় একটি কাগজ। বিবর্ণ
কাগজটি থেকে অস্পষ্ট
হয়ে আসা শব্দগুলো
উদ্ধার করে পড়তে থাকে
সে----
' শ্রীচরণেষু,
দেশের পরিস্থিতি হঠাৎ
করিয়া খুব অবনতি
হইয়াছে। দেশ ভাগ হইবার
পর আমাদের গ্রাম পূর্ব
পাকিস্তানে পড়িয়াছে।
গ্রামের প্রতিবেশী
যারা আমাদের পরম আত্মীয়
ছিল তাদের কেউ কেউ
হঠাতই শত্রুতা শুরু
করিয়া দিয়াছে। গত মাসে
আড়তের সব ধান লুট হইয়া
গিয়াছে। তবুও আমরা সকলে
জন্মভূমির মায়ায়
সবকিছু মানিয়া
লইয়াছিলাম। কিন্তু গত
১৫ই ভাদ্রের ঘটনায় আমরা
সকলে মানসিকভাবে ভেঙে
পড়িয়াছি। পূর্ণিমার
রাত থাকায় আমি আর
বাবামশায় বাড়ির
সন্মুখের বিলের তীরে
দাঁড়াইয়া ছিলাম
সন্ধ্যা গড়িয়ে যাবার
কিছু পরেই। হঠাতই
ওপাড়ায় দিক হতে হইচই
ভাসিয়া আসিতে থাকে।
প্রথমে বাবামশায় পাড়ার
অল্পবয়সীদের খেলাধুলা
ভাবিয়া চুপ করিয়া
থাকেন। কিন্তু সেই
আওয়াজ ক্রমশ আমাদের
বাড়ির নিকটে আসিতে
থাকিলে তিনি অস্থির
হইয়া পড়েন। আমাকে
লইয়্যা বাড়ির ভেতরা
চলিয়া যান। তবে তাহাতে
খুব একটা লাভ হয়না।
আমাদের প্রায়
পিছুপিছুই বাড়ির ভেতরে
দশ থেকে বারোজন লোক
ঢুকিয়া পড়েন। তাহাদের
সকলের মুখ ছিল কালো
কাপড়ে ঢাকা। আমি তখন
আমার ঘরে ঢুকিয়া দরজায়
হুড়কা দিয়েছি। কিন্তু
জানালা দিয়া যতটুকু
দেখিয়াছি তাহারা
বাবামশায়ের সাথে
প্রথমে তর্কে লিপ্ত হয়।
এরপর আমার ঘর দেখাইয়া
কিছু ইঙিত করে। এরপর
বাবামশায় কোমড় হইতে
সিন্ধুকের চাবিখানা
দিইয়া দেন। এ বাড়ির
মেয়েদের সকল
স্বর্ণালংকার ও নগদ
অর্থ তাহারা লইয়া
গিয়াছে। আমরা খুব
দুরাবস্থায় পড়িয়াছি।
ঘরে কোনো নগদ অর্থ নেই,
চাল নেই। এমনকি ঘরের
সকল আসবাব বিক্রি করিয়া
পাওয়া অর্থও ফুরাইয়া
গিয়াছে। আর দাঙ্গার ভয়
তো আছেই। আপাতত তাই
এখানে থাকাটা বাবামশায়
নিরাপদ বোধ করিতেছেন
না। এমতাবস্থায়, আমরা
ওপাড়ে চলিয়া যাইতেছি।
এই বাড়িতে আপাতত ইয়াকুব
মুন্সীর পরিবারকে
পাহাড়ার জন্য রাখিয়া
যাওয়া হইলো।
ওপাড়ের ঠিকানা-
২৪, দত্তপাড়া লেন-
কলিকাতা।
আপনি ফিরিয়া এই পত্র
পাওয়া মাত্র কলিকাতার
উদ্দেশে রওয়ানা
হইবেন।
ইতি
প্রভাসুন্দরী বালা
বিঃ দ্রঃ পরীজান বানু,
ইয়াকুব মুন্সির স্ত্রী
যার কাছ হইতে এই
পত্রখানা আপনি পাইবেন।
আমি আপনারই নিজ হাতে
বানানো কাঠের বাক্সের
ভেতরে পত্রখানা রাখিয়া
গেলাম। এতে করিয়া আপনি
বিভ্রান্ত হইবেন না।
আমি খুব গোপনে
বাক্সখানা পরীজানের
কাছে রাখিয়াছি। আসলে এই
অবিশ্বাসের সময়ে এই
মানুষটিকেই আমার
বিশ্বাসযোগ্য মনে
হইয়াছে। কারণ, সে আমার
নিকট একটি আবদার লইয়া
আসিয়াছিল। তাহাকে
একখানা গান শিখাইয়্যা
দিতে হইবে। সে সুর খুব
পছন্দ করে। তার গলায়
সুরও আছে। আর সুরের
মানুষগুলো অন্যকে
ঠকাইতে পারে না। এই
বাক্সখানা আপনার হাতে
পৌছাইয়া দেবার জন্য পণ
সে করিয়াছে।'
'বাঁশি বাজে বাজে রইয়া
রইয়া
গৃহে যাইতে মন চলে না
প্রাণ বন্ধুরে থুইয়া
কদমতলায় বাজে বাঁশি
রাধারে শোনাইয়া
পায়ে ধরি থামাও বাঁশি
নাগর কানাইয়া।'
সকলের অলক্ষ্যে দাদী ঘর
থেকে বেরিয়ে উঠোনে এসে
দাঁড়িয়েছেন। বিলের ঢেউ
আছড়ে পড়ছে তীরে। আজ
প্রভাসুন্দরী বালার
গান অবিকল হয়ে উঠেছে
পরীজান বানুর কন্ঠে।
সেই গানের সুর ভিজে
মাটি হয়ে মিশে যেতে
থাকে বিলের ঢেউয়ে।