রিয়াদ ষ্টোর গলির ঠিক
মাথায় দাঁড়িয়ে। গলির
একপাশে বিএনপি আমলে
তৈরি বসিত্ম অন্যপাশে
বিহারী ক্যাম্প।
হামিদা বেগম রোজ সকালে
রিয়াদ ষ্টোরে এসে বসে
থাকে। রিয়াদ ষ্টোরের
মলিক সেও রোজ সকালে আসে,
গায়ে খয়েরি পাঞ্জাবি,
চোখে সুরমা, লুঙ্গিটা
হাঁটুর একটু নিচ দিয়ে
গেছে। রিয়াদ ষ্টোরের
লম্বা পাকা সিঁড়ি।
হামিদা বেগম সিঁড়ির
একপাশে বসে থাকে।
দোকানে আরও লোক আসে, ছোট
ছেলে-মেয়েরা আসে
আইসক্রিম কিনতে, লেমন,
কাপ আইসক্রিম, পেসত্মা,
চকলেট-কতরকম আইসক্রিম
যে বের হইছে, তার হিসাব
নাই। হামিদা বেগম ভাবে
আর দেখে, তার দেশ বিহারে
এমনসব আইসক্রিম ছিল না।
একটা আইসক্রিমওয়ালা
আসতো শেখের গলিতে।
বৌ-বাচ্চারা ভিড় করে
বাটিতে কুলফি বরফ খেত।
হামিদা বেগম ভাবে আর
দেখে দেশ ক্যামন ক্যামন
কইরা বদলাইয়া গেল।
রায়টে কত লোক মরল, কত লোক
বাঁচল তার ইয়ত্তা নাই।
এইদিকে, ওই দিকে কত লোক
চলে গেল, হামিদা বেগমও
বাপ আর ছোট চাচার হাত
ধইরা পাকিস্তানে চইলা
আসল। তখন কি গরম দেশ,
চারদিকে মরণের ভয়। বাপ
কইল এই দেশ আমাগো, আমরা
এইখানে থাকব। কেউ
আমাদের সরাতে পারবে না।
মুসলমান মুসলমান ভাই
ভাই। অনেকদিন ভালই
কাটল, বাপ মিরপুরে জরির
দোকান দিল। হামিদা
সারাদিন চুমকি নিয়ে
খেলা করে, পুতুলের গায়ে
চুমকি বসায়। আরও কত
মানুষ ক্যাম্পে গিজগিজ
পরিবেশ তাও হামিদার ভাল
লাগত। গলিতে ঢোকার মুখে
ময়লার স্তূপ। সারা
দুনিয়ার লোক মনে হয়
গলির মধ্যে হানদাইতে
চায়। ঘরে হামিদার বাপ
ছোট্ট একটা পাতিলে ভাত
রানত আর কলিজা ভুনা
করত। বাবার এক খায়েশ
প্রত্যেক ওয়াক্তে
কলিজা পাতে পরন চাই।
হামিদার কলিজার গন্ধ
সহ্য হত না, একটু ডিম
ভাজি করে ভাত খেত না হলে
আলু ভর্তা। ক্যাম্পের
আমিরা আর গওহরের সাথে
হামিদার অনেক
বন্ধুত্ব। আমিরা আর
গওহরের সাথে কত খেলা যে
খেলল হামিদা বেগম,
বেশুমার। সেই খেলাও
একদিন শেষ হল আবার
দাঙ্গা লাগল, যুদ্ধ
লাগল। বাপ হামিদাকে
কোথায় লুকাবে ভেবে পায়
না। শেষে কচুক্ষেতে এক
বাঙালি বাড়িতে
হামিদারা আশ্রয় পেল।
সারাদিন ভাত আর ডাল
রান্না। ডেকচি ডেকচি
ভাত আর ডাল রান্না হত।
রাতে সব মুক্তিরা আসতো,
সবার হাতে কত যন্ত্র;
হামিদা অবাক হয়ে দেখত,
এইসব দিয়ে মানুষ মারা
হয়। হামিদার বুকটা ভেঙে
যেত। কেন মারে? কাকে
মারে? আহা বাপজান, গওহর,
আমিরা সব কোথায়? বুকের
ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠত।
যখন বোম্বিং হত সবাই
ট্রেঞ্চের নিচে চলে
যেত। যুদ্ধটা যেন চোখের
পলকে ঘটে গেল। রাতে ঘরে
থাকা যেত না, সবাই পাশের
কবরস্থানে গিয়ে রাত
কাটাত। সারারাত
ফায়ারিং এর শব্দ।
দ্রুম, দ্রুম। চোখের
পাতা এক করা যেত না। বড়
রাস্তায় ট্যাঙ্ক
যাওয়ার শব্দ শোনা যেত।
সবাই একদম মরার মতো পড়ে
থাকত। না মরেও সব যেন এক
একটা জিন্দা লাশ। পুরা
যুদ্ধের সময়টা এমন
কাটল। মাঝে মাঝে
হামিদার মনে হত এইযুদ্ধ
আর কোনোদিন শেষ হবে না।
সব মানুষ যেদিন মইরা
যাবে, ওইদিন শেষ হবে
হায়েনাদের খেলা।
রক্তের মধ্যে গড়াগড়ি
খেতে খেতে সবাই যেন এক
একটা নমরুদ হয়্যা গেছে।
যুদ্ধও শেষ হল,
পাকিস্তান ভেঙে
দু-টুকরা হয়ে গেল।
হামিদার বাবা ৭২ সালের
জানুযারি মাসে
হামিদাকে নিতে আসল।
হামিদার বাবার সেকি
চেহারা, তাকানো যায় না,
য্যানো একটা জ্বলন্ত
আগুনের গোলা, চোখে-মুখে
আক্রোশ, বাঙালিদের হাতে
পরাজয়ের কষ্ট,
যন্ত্রণা। হামিদা বলবল
, বাপজান আপনি রাগ করেন
কেন? আমরাতো আমাদের
দেশেই আছি। এদেশ থন
কেউতো আমাগো বাইর করব
না। বাপ চোখ লাল করে
মেয়ের দিকে তাকিয়ে
থাকে। মুখে কোনো শব্দ
নাই। কয়েক বছর খুব
দমবদ্ধ অবস্থায় কাটল।
রাতে হামিদার বাবা
চোখের পাতা এক করত না।
কিসের যেন ভয়। কেউ
কাউকে বিশ্বাস করতে
পারত না। ক্যাম্পের
মানুষরাও অচেনা হয়ে
গেল। যুদ্ধের কয়েক বছর
পর হামিদার বিয়ে হল
তেজগাঁ ক্যাম্পের জহির
বখশের ছেলে ফারুকের
সাথে, বয়স একটু বেশি,
কিন্তু মানুষ খুব ভাল।
হামিদারও বিশ পার হইয়া
গেছে। ফারুক হামিদার
চুলে জরি মাখাইয়া দিত,
সারা মুখে-ঠোঁটে,
জামায়। হামিদা ফারুকের
সাথে মিরপুর ১১ নম্বর
স্ট্রান্ডেড
পাকিস্তানিদের
ক্যাম্পে ঘর পেল, ফারুক
সুতার দোকান দিল। ঘরে
বসে হামিদা শাড়িতে,
জামায় চুমকির কাজ করে।
কত কাজ করল হামিদা
বেগম। শাড়িতে ময়ূর, সাপ,
বন-জঙ্গল, নদী, পাহাড়। এই
দেশ, ওই দেশ। রিয়াদ
ষ্টোরের পাশেই হামিদার
স্বামীর সুতার দোকান
ছিল। ছেলেমেয়ে কিছু হল
না হামিদা-জহিরের
সংসারে। জহির অনেক
চিকিৎসা করালো।
ডাক্তার, কবিরাজ ফেল
করল। একটা ছেলেকে
রাস্তা থেকে কুড়িয়ে বড়
করল হামিদা বেগম। বছর
১২ হলে সে ছেলেও কোথায়
যে চলে গেল কেউ খোঁজ
দিতে পারলা না। সেই
ছেলের খোঁজে হামিদা
উন্মাদের মতো হয়ে গেল।
নিজের দেশ ছেড়ে নতুন
দেশে এসেও এত কষ্ট হয়
নাই কিন্তু কষ্টের শেষ
অনেক সময় হয় না।
হামিদার স্বামীও বুকে
ব্যথা হয়ে তিনদিনের
মাথায় মরে গেল। বাপও
মরল পরের বছর। ঘরটা আছে
ক্যাম্পে। তা নিয়েও
নানা কাড়াকাড়ি। হামিদা
বেগম এখন চোখে ভাল দেখে
না, হাতে করে জরি, চুমকি,
সুতা এগুলো বিক্রি করে।
ক্যাম্পের ছোট ছোট
মেয়েরা অনেকে সেলাই
শিখতে আসে তাদেরকে সে
কোরআন শরীফ পড়তে শেখায়।
খুশি হয়ে যে যা দেয় তাতে
কোনো-রকমে দিন কাটে কি
কাটে না। ক্যাম্পের
লোকজনও কেমন যেন বদলে
গেছে, কেউ কারো না, শুধু
ভাবে একদিন তারা
পাকিস্তান চলে যাবে। এই
একটাই চিন্তা নিয়ে তারা
থাকে। ক্যাম্পের অফিসে
বসে স্বপ্ন দেখে আর
ভাবে তাদের সোনার
পাকিস্তান আলোতে ঝলমল
করছে; কত খানা-দানা,
আখরোট, পেস্তা, বাদাম,
লাড্ডু। সবাই খালি
যাওয়ার কথা বলে কিন্তু
হামিদা বেগম কোথাও যাবে
না, এই ঘিনঘিনা গলির
ক্যাম্পই তার কাছে অনেক
বেশি দেশ। দেশ কয়টা হয়
মানুষের? কতবার সেই দেশ
বদলায়? কে বানায় এই নিয়ম?
কেন সেই নিয়ম মানতে হবে?
হামিদা বেগম সারারাত
ঘুমায় না, চিৎকার করে
বলে, কারো নিয়ম মানি না।
যার যা মনে হবে তাই
মানতে হবে? আমরা মানুষ
না? আমরা কিছু কইতে পারব
না? কারো কথা মানি না,
কারো দেশ মানি না।
যেইখানে ইচ্ছা থাকব,
মইরা যাব তাও কারো পিছে
ঘুরব না। হামিদা বেগম
সারারাত স্ট্রান্ডেড
পাকিস্তানিদের
ক্যাম্পে চিৎকার করতে
থাকে। তার চিৎকার গলির
মোড়ের রিয়াদ ষ্টোর
থেকেও শোনা যায়। যুবক
ছেলেরা সিঁড়িতে বসে
সিগারেট-গাজা খায় আর
বলে বুড়িটা এখনও আছে?
মরে নাই? সেই কবে শুনছি
ক্যাম্পে আসছে? ওর বয়স
ক্যাম্পের বয়সের থেকেও
বেশি। মরণ নাই বুড়ির।