আমাদের মহামারী
অনেকদিনের। একটা
কোলগেট। আমার। দাদুর
অবশ্য ডাবরের কিছু একটা
ছিল। আমরা সকালে উঠে
দুটো বয়সের দাঁত মাজতে
মাজতে কলঘরে আসতাম।
একটা চাঙর খসে আসা ডাউন
দ্য মেমোরি লেনে তখন
থেকেই আসা। যাওয়া।
আমাদের যাওয়া তো নয়
যাওয়া। দাদুর
সেরিব্রাল ঠোঁট বেঁকে
গেছিল অনেকটা। নদী যেমন
বেঁকে যায় মোহনা
পেলেই। তখনও অনেক কথা
জমে ছিল। চেষ্টা করত।
ফ্যালফ্যাল করে
তাকিয়ে থাকা দাঁতের
মাড়ি আর লালারসের ফাঁক
দিয়ে এক একটা মিইয়ে
যাওয়া সন্ধের দিকে সেসব
চলে যেত। আমরা শুনতে
পেতাম না। এমন একটা
সময় যখন আমি, আমরা
সিনেমা প্যারাডাইসো
দেখিনি। আলফ্রেডো।
ফিরে আসছে প্রিয়
শিষ্য, সন্তানসম। বৃদ্ধ
আলফ্রেডো শুয়ে।
ডেথবেড। 'একটা সময় আসে
যখন কিছু বলা আর না বলার
ভেতর বিশেষ তফাৎ থাকে
না'। দাদুর আর ঠাকুমার
ভেতর বয়সের বেশ কিছুটা
ব্যবধান। দুটো ছোট
শোবার চৌকির ভেতর একটা
সরু প্যাসেজ। ব্যবধান।
সিনেমাহল। শেষ দিকের
শো। দুজন দুটো রো এর
শেষে বসে এবার একসঙ্গে
হাত ধরাধরি করে ফিরবে।
কেউ সামান্য আগে পরে।
ভিড়ের জন্য বোধহয়।
ডিস্ট্যান্সিং। তখন তো
ফোন নেই। বাইরে
দাঁড়িয়ে অপেক্ষা। এই
আসছি। আমি যে আসা
যাওয়ার কথা বলছি
সেখানে একটা প্রেডিকশন
থাকছে। হেলথ
এমার্জেন্সি। বয়স। বি
প্রিপেয়ার্ড। বাবা
বলত প্যানেলে নাম উঠছে।
কার প্যানেল? কিসের
প্যানেল? শুধু বয়স
দিয়েই প্যানেল হয়?
ব্যতিক্রম? নদীতে ডুবে
যাওয়া কিশোর? হঠাৎ
স্ট্রোকে কথা বন্ধ করে
দেওয়া যুবক? প্যানেল?
তবু! প্রেডিকশন একটা
থাকে। চিকিৎসা একটা
সময় কি ঘাড়ের উপর
চেপে বসে? এতদিন, এত এত
দিন? 'আমুর'। মাইকেল
হানাকের সেলুলয়েড।
অ্যান ওল্ড কাপল। জর্জ।
অ্যানা। 'থিংস উইল গো অন
অ্যাজ দে হ্যাভ ডান আপ
আন্টিল নাও। দে উইল গো
ফ্রম ব্যাড টু ওর্স।
থিংস উইল গো অন, অ্যান্ড
ওয়ান ডে ইট উইল অল বি
ওভার।' কোমায় পৌঁছে
একজন বৃদ্ধ কি এইসবই
ভাবেন? থিংস উইল গো ...।
নাকি ঈশ্বর ভাবনা? দেখা
হওয়া। পরজন্ম।
মহামারীর পর আর কী জন্ম
থাকতে পারে? কুৎসিৎতর
মহামারী? টেনিসন।
মৃত্যুশয্যায়
জিয়োর্দানো ব্রুনোকে
ভেবে বলেছিলেন 'হিজ ভিউ
অফ গড ইজ ইন সাম ওয়েজ
মাইন'। আমরা যারা
দাদুকে দাদু বলে ডাকিনি
কোনওদিন, ঠাকুমা
সম্বোধনটাও বন্ধুদের
জন্য ছিল, তাদের কিছু
ব্যক্তিগত বন্ধুনাম
থাকে। সেসব বলা বারণ।
নামের মোহ একটা সময়
কেটে গেলে বুঝি আমাদের
বোটানিক্যাল গার্ডেনে
আর কোনও বটগাছ নেই।
এখানে পিকনিক হতে পারে,
উইকেন্ড ট্যুর হতে
পারে, আশ্রয় হবে না।
তখন, তখন অনেকটা বড়,
বয়স্ক, আমিও ....
আশ্রয় নিয়ে কথা
হচ্ছিল। অনেকটা বড় হতে
এসব বন্ধুনাম, সিলভার
লাইন ছদ্মবেশে আসে।
অন্য ভাবে। আত্মীয়তার
বাইরে। রক্তের বাইরে।
এসেই আবার আমাদের
ভেনেসীয় জানলা মনে
করায়। মনে করায়
জুলিয়েট বারান্দা।
শ্যামচাঁদ মিত্র লেনে
নকুবাবু মিউজিয়াম
চালান। সুশীলকুমার
চট্টোপাধ্যায়। ভালো
নাম না, ডাকনামেই আলো
দেখান তস্য গলির উত্তর
কলকাতার পড়শিদের।
আমাদের দুজনেরই মিল
নাইন্টিজ। বৃদ্ধ তাঁর
বয়সের নাইন্টিজে, আমার
স্মৃতির নাইন্টিজ। যখন
গেছি, জড়িয়ে ধরতেই
অঘোর সেনের সেই দোতলার
পাতালঘর ঘর টেনে
নিয়েছে মাকড়সার
জালের মতো। একটা কাগজ
দিয়ে লেখা, 'অতীতের
আশ্রয়'। অন্ধকার
সিঁড়ি বেয়ে ওঠার
রাস্তা 'অনন্তের দিকে'।
পুরনো সাউন্ড রেকর্ডার,
সেলাই মেশিন, কলিং বেল,
গ্রামাফোন - আমি
নাইন্টিজের বেশি আগে
হাঁটতে পারি না। বৃদ্ধ
পারেন। স্মৃতি।
স্বাধীনতা, বিহারের
চম্পারন, গান্ধীজী,
অলৌকিক এক মনন। উত্তর
কলকাতা আমাকে
ঈশ্বরবিশ্বাসী হতে
বলে। 'আমাকে নিয়ে
লিখবে ভাই? সবাই আসে, চলে
যায়। কেউ তো লেখে না।
আমি চলে যাই, যাব। এই
সংগ্রহগুলো কী করবে?
ছেলে মাঝে মাঝে
পরিষ্কার করবে।
গল্পগুলো? সেগুলো তো
হারিয়ে যাবে?' একসময়
মন পাঠিয়ে দেন অতীতে।
টাইম ল্যাপস। পুরনো
রেকর্ডে ঘর ভরে তোলেন
জর্জ বিশ্বাস। 'পথে
যেতে যেতে ....
মৃত্যু-আঘাত লাগে
প্রাণে, তোমার পরশ আসে
কখন কে জানে ...'
আঘাতও পরশ। পুরস্কার।
রবীন্দ্রনাথ। ছবি
আঁকলেন ষাট পেরোনোর পর।
'ইফ হুগো ক্যান, হোয়াই
ক্যান্ট আই?' ছবি। এক
প্যারালাল পৃথিবীর।
রেনেসাঁ-ম্যান।
শান্তিনিকেতন।
সুনীতিকুমার পাঠক।
পৃথিবীর শেষ স্টেশন
থেকে এসেছেন। যেখানে
মাইনরিটি ভিনজেন্স,
ব্যক্তিগত বিদ্বেষ,
নিউজ মিডিয়া - এসব কিছু
নেই। আছে শুধু
টিবেটিয়ান স্মৃতি,
তথাগত এবং অপার শান্তির
পৃথিবী। একটা টিমটিম
ঘরে বুদ্ধচর্চা।
স্ত্রী সামান্য বয়সের
এদিক ওদিকে। আমি গেলেই
লাল চা খেতে বলেন। আমি
লালের ভেতর বিশ্বাস
দেখি, দেখি শ্রদ্ধা।
আমরা পঁয়ত্রিশেই
পাশের মানুষটাকে
ঘেন্না করতে অভ্যেস
করি, ওঁরা আশি পেরিয়েও
এখনও বন্ধু,
প্রীতিভাজনেষু। ধর্ম
কী? সুনীতিবাবু
প্যান্ডোরার বাক্স
খুলে বসেন। 'ধর্ম তো
রিলিজিয়ন না, ধর্ম
পার্টিকল'। চলে আসেন
রাহুল সাংকৃত্যায়ন,
নিকোলাস রোয়েরিক,
মহাত্মা, রবীন্দ্রনাথ।
আমি এক প্রজ্ঞার কথা
শুনতে পাই দূর থেকে।
তথাগত তিনি স্থাণু ....
বটুদার পৃথিবীতে শব্দ
নেই। বটুদাকে কাগজে
লিখে লিখে কথা বলি। বলি
স্থাপত্য, মিথ, মন্দির।
বীরভূম ঝাড়খণ্ড
সীমান্তের মলুটি আমাকে
জাতিস্মর হতে বলে। বলে
শতক পেরিয়ে এসো।
পিছোও। দেখবে আটচালা,
দেখবে পঞ্চরত্ন, দেউল,
জোড়বাংলা, রাসমঞ্চ।
দেখবে সমাজবিজ্ঞান,
পুরাণ, চুল আঁচরানো
রাজমহিষী,
ভিক্টোরিয়ান লেডি,
বালক বিস্ময়,
কালীয়দমন। নিজের ভালো
নামে বিস্মৃতির
শ্যাওলা। ছত্রাক। তবু,
গোপালদাস
মুখোপাধ্যায়ের শিরা
হাতের চামড়া থেকে
বেরিয়ে এসেছে
অনেকদিন। মলুটির
সত্তরের উপরে মন্দির
সংস্কার। একা। টিমটিম
আলোয় জিওলজিকাল
স্যামপ্লিং। নদীর
ধারের প্রিহিস্টরিক
পৃথিবী। বৃদ্ধের
কালেক্টিবল। আমি
অহঙ্কারের কথা শুনেছি
সাধারণের চোখে। সেদিন
ঈশ্বরের চোখে বিনয়
দেখলাম, দেখলাম জল। চলে
গেলে? কী হবে মন্দির
গ্রামের? সংরক্ষণ?
বৃদ্ধ কাঁপেন।
নিরুত্তরে।
এসব ইতিহাস নিয়েই আমার
অর্ধেক জীবন। চরাচর।
নকুবাবু মহামারী ভাবতে
পারছেন না। 'একদিন এসো
ভাই। বিজ্ঞানের ভেতর
অলৌকিক আছে। শোনাব।
দেখাব।' একটা পুতুল
কিনতে বলেছিলেন। 'দাম
দিয়ে দেব ভাই, এনো।
শান্তিনিকেতনের কাজ।
মাটির। একটা
সংগ্রহশালা খুলছি'।
নকুবাবু ছিয়ানব্বই।
সংগ্রহশালা। আমার এখনও
কেনা হয়নি পুতুল। অনন্ত
হরতাল। কোনওদিন দেওয়া
হবে? নকুবাবুর
সংগ্রহশালায়? নেওয়া
হবে অলৌকিকতার পাঠ?
বটুদা এয়ারফোর্সের
গল্প বলেন। প্রাক্তন
জীবন। মলুটির
দুর্গাদালানের উপর চটি
খুলে বসেন। দৃশ্যমান
শিরার পাশ দিয়ে চলে
যাওয়া বিষধরের সঙ্গে
এক সমান্তরাল পৃথিবী।
সেদিন স্বপ্নে দেখি,
বৃদ্ধ সরীসৃপ হয়ে
গেছেন। বুকে ভরসা রেখে
ইতিহাসের উপর দিয়ে
হাঁটছেন। মলুটি
পেরিয়ে দেখছেন ইটন্ডা,
ঘুড়িশা, কেঁদুলি।
পোড়ামাটির বীরভূম গলে
গলে পড়ছে। ভেতরে অনন্ত
দেবী। সিংহবাহিনী।
বাঙালির ইতিহাস
নীহারবাবু ছাড়া আর কেউ
তেমন লিখল না।
সুনীতিবাবুর আক্ষেপ।
বয়স। বৃদ্ধ কি
বেঞ্জামিন বাটনের
কিউরিয়াস কেস পড়েছেন?
পড়লে যদি বিশ্বাস করে
ফেলতেন? হ্যান্স
ক্রিশ্চিয়ান
অ্যান্ডারসন মনে পড়ে।
মনে পড়ে দেশলাই
বালিকা, বরফের ফার গাছ,
আগলি ডাকলিং। বৃদ্ধ
হ্যান্স চলে যাওয়ার
আগে ফিউনারাল মিউজিক
কম্পোজ করতে বললেন
সুরকারকে। শেষযাত্রায়
থাকবে তো শুধু ছোটরা।
এমনভাবে সুর দাও, যেন
বিট ওদের ছোট ছোট পা
ফেলার সঙ্গে মেলে। 'মেক
দ্য বিট কিপ টাইম উইথ
লিটল স্টেপস'। ছোট ছোট
পা। আমার
থ্যানাটোফোবিয়া ছিল।
ঠাকুমার শরীরের শুধু
পা'টুকু দেখেছি। ছোট
ছোট। মুখ দেখিনি। পাশ
দিয়ে যাওয়া একটা
মোটরসাইকেলের লুকিং
গ্লাসে দেখে ফেলেছি।
শান্তি। আর অভিযোগ নেই
দাদুর কাছে। দেখা।
কথোপকথন। সেই 'আমুর'।
শেষটুকু।
- 'ইটস বিউটিফুল!'
- 'হোয়াট?'
- 'লাইফ। লং ....'