ক্রমশ সরে যাওয়া রাত
।ফিরে যাওয়া রাত । জানি
না । জানালার ওপাশে
দিঘি থেকে নিশাচর বক
ডানা মেলে ক্রেংকার
তুলে উড়ে গেল । সম্ভবত
সাঁড়াশির মতন ঠোঁটে
চেপে একটি মাছ । গুমোট
শহরে ঘরের ভিতরে বনবাস
উঠে আসছিল না
গ্রামচিত্র জানি না ।
বারান্দার সামনে ইট
ভাঙ্গা রাস্তা ধরে
কাঁচা খিস্তির ঢেউ তুলে
চলে গেল নিশাচর লক্কা
পায়রার দল । পাশের
বাড়ির সমকামী
চৈতন্যবাবু এত রাতে ফুল
ভল্যুমে গান শুনছিল ।
তুমি আমারি তুমি আমারি
...তুমি সন্ধ্যার
মেঘমালা ...... আজ নিশ্চিত
কোনো টাইট পোক্ত কিছু
পেয়েছে চৈতন্যবাবু ।
আনন্দে এখন তাই শ্রবণ
উৎসব যাপন করছে ।
সেই বিকেল থেকে বৃষ্টি
হয়েই চলেছে । গত তিন চার
দিন ধরে মরসুমি মেঘ যেন
শ্রাবণ গিলে খাচ্ছে ।
কিছুক্ষণ আগে দরজায়
টোকা পড়েছিল । বন্ধ
দরজার সামনে আছড়ে
পড়েছিল মধ্য রাতের
মদ্যপ অভিশাপ । এখন
শব্দহীন । জমাট অন্ধকার
। বিকেলে এক
রাষ্ট্রক্ষমতার ফেউ বা
নরকের কীট এসে অশালীন
ভাষা বলতে বলতে চুম্বক
দিয়ে ঘরের ভিতরের সমস্ত
আসবাব টেনে নিয়ে গেছে ।
লোহার খাট , স্টিলের
চেয়ার , থালা বাসনপত্র ,
এমনকি জানালার লোহার
শিকগুলো পর্যন্ত বেঁকে
গেছে । কেমন যেন তছনছ
হয়ে আছে চারধার । খাটের
নিচে লোহার কড়াই , কোদাল
খুরপি , এমনকি আমার
স্টিলের ফ্রেমের চশমা
জানালার কপাটের আঙটার
সঙ্গে বেমালুম ঝুলে আছে
। হাত বাড়িয়েছি চশমাটি
আনব বলে – ঠিক তখনই রাত
গভীর প্রচ্ছন্ন আলোতে
দেখলাম দেওয়াল ঘড়ির
কাঁচের ওপরে , একটি
মাকড়শা দৃশ্যমান
মিনিটের কাঁটার ওপরে
স্থির , অনেকটা রহস্যময়
রাতের সময়কে চুপ করে
দাঁড়িয়ে থাকতে বলছে ।
আমাকে সর্বস্বান্ত করে
দিল । ঘরের ভিতরে
ঘরগুলি খা খা করছে ।
অন্ধকারে জোনাকি
গৃহস্ত হাতরে যাচ্ছে ।
বৃষ্টির ভেজা বাতাসে
জানালার ভাঙ্গা কাঠের
পাল্লা সন্দেহজনক
হাপরের মতন বন্ধ হচ্ছিল
আর খুলে যাচ্ছিল । গোটা
বাড়িটা রাত শেষে মোমের
মতন গলে যাবে কিছুক্ষণ
পরে । কদম গাছের পাতায়
যেন বৃষ্টির টুপ টুপ জল
। শুধু আজকে কেন বেশ
কয়েকদিন ধরে আকাশ বড়ই
বান্ধবহীন । কিন্তু না,
ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম
ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের আড়াল
টপকে কয়েকটি উজ্জ্বল
তারা ধ্বংসপ্রায়
সুতোকলের পাঁচিলের
ওপরে বসে যেতে চাইছে ।
ও তুমি এসে গেছ ? কখন এলে ?
বাঃ । বেশ তো । টের পেলাম
না ? ইসস কতটা শব্দহীন
তুমি ? অথচ দেখ একবার ,
আমি সেই সন্ধ্যে থেকে
তক্তপোষে শুয়ে আছি ,
গোটা শহর জুড়ে কত শব্দ
অথচ আমি এখানে আমার ঘরে
শব্দহীন ।
হ্যাঁ মাঝে মাঝে মনে হয় ,
এই নিঃসঙ্গ জীবন অনেকটা
সেই ব্যর্থ চিত্রকরের
আঁকা স্টিল লাইফের মতন ,
ভাঙ্গাচোরা কিছু নমুনা
রেখে স্টাডি করেছে , তাই
হয় , লোকে জানতে পারলে
সেই ভাঙ্গা ব্যর্থ
বেদনাময় জীবনকে নিয়ে
রচনা করে শিল্পকলা ।
বিন্যাসটি এমন ,- মাটির
কলসির ভাঙ্গা কিছু
টুকরো , শুকনো ফুলের
এলানো ফুলদানি ,
তালপাতার পুরানো হাত
পাখা , চুইয়ে চুইয়ে আলো
এসে পড়েছে জানালার
ভাঙ্গা কপাট অতিক্রম
করে সাবজেক্টের ওপরে ।
এমন একটি জীবন ,
আঙ্গুলের ডগায় ছুঁয়ে
নিলে , ব্যক্তিত্বের
পালিস কমে যায় ।
ব্যক্তি তখন
সত্ত্বাহীন । অথবা
...অথবা নগ্ন একটি মানুষ
মিকেল অ্যাঞ্জেলোর
ভাস্কর্যের মতন শুয়ে
আছে । শুকিয়ে যাওয়া
নদীর শরীরের ওপরে
ডিঙ্গি কাৎ হয়ে পড়ে আছে
এমন পাথুরে শরীর যেমন ।
একটা কিছুর শব্দ হল না ?
তুমি শুনতে পেলে ? কেমন
ধাতব ঝন ঝন , গুছিয়ে তোলা
সংসারের ভেঙ্গে যাওয়ার
শব্দ । তুমি শুনতে পেলে ?
আমাকে এরকম শব্দের থেকে
চিরকাল তুমি সচেতন করেছ
। অথচ দেখ এই শব্দের
পতনের সাথে তুমি এলে ,
অনেকদিন পরে আমার
আত্মহননের দিনে । কি
আশ্চর্য ! আমাকে তুমি
সচেতন করা সত্ত্বেও
তোমার নিজের হাতে গড়ে
দেওয়া সংসার কেমন
এলোমেলো হয়ে গেল ,
ভোকাট্টা । তুমি চলে
গেলে । বলে গেলে নতুন
অনুভবের সন্ধানে ।
আচ্ছা বলো তো , জন্ম
মানেই কি আত্মহনন ?
দেখ আমি কি বোকা ?
অপূর্ব তোমার যুক্তি ।
আসলে তোমরা বোধ হয় এমনই
হয়ে থাকো । হ্যাঁ ,
অবশ্যই তোমরা ? তা ছাড়া
আবার কারা ? কোনো যুক্তি
মানো না । প্রথাগত
নির্দেশ মানো না । অথচ
আমরা যদি প্রথাগত কিছু
ভাঙ্গতে চাই , তখন তুমি
নিজে নীরব থেকে ,
প্রতিবাদী হয়ে ওঠো ।
মনে নেই , সেই সময়ে একটি
রাইফেল এনে বিছানার
তোষকের নিচে রেখে
দিয়েছিলাম । তুমি
বলেছিলে আমার মাথা না
কি খারাপ হয়ে গেছে ।
একদিন সে কি তোমার
বিরক্তিকর
চেল্লামেল্লি । অসহ্য ।
তুমি বলেছিলে , একদিন
কাক নীরব দুপুরে
রাইফেলটি নাকি ঘরের
ভিতরে পায়চারি করছে ।
কেউ এসে দেখে ফেললে না
কি সর্বনাশ হয়ে যাবে ।
কে আবার দেখবে ?
চারদিকের পরিস্থিতি
ভালো নয় ।
র্যাডিক্যাল....
র্যাডিক্যাল ...
র্যাডিক্যাল ।
বিপ্লবীদের খামার । হাঃ
হাঃ হাঃ ...এসব তোমাদের
কারসাজি ।
রাষ্ট্রক্ষমতা এমন
......বটতলার রগ রগে যৌনতা
বিষয়ক গ্রন্থেও
বিপ্লবের গন্ধ খোঁজে ,
অভিসন্দি খোঁজে । মনে
নেই মোটা কাঁসার চাদরের
গ্লাসটি তোমার হাত থেকে
পড়ে গিয়ে গড়িয়ে গেল
একেবারে ঘরের চৌকাঠ পার
হয়ে বারান্দার উঠোনে ,
তুমি গ্লাসটি কুড়িয়ে
আনতে গেলে , মাথা তুলে
দাঁড়াতেই , তোমার চোখের
সামনে , লাল বুটজুতো
তারপরে গোটা খাকি
পোশাকের কদাকার নিসর্গ
... উঠোন পেরিয়ে পাঁচিলের
ওপারে তখন ছায়া রোদে
ভাসছে ননসেস্ন
...রাসকেল... বেজন্মা আরও
কত কত ভোঁতা জং পড়ে
যাওয়া শব্দ ।
তুমি রাইফেলটিকে আঁচলে
লুকিয়ে আমার দিকে এমন
তাকালে , যেন আমি তোষকের
নিচে রাইফেলটিকে রেখে
খুব অপরাধ করে
ফেলেছিলাম । বিশ্বাস
করো সেদিন তোমাকে দেখে
আমার করুণা হয়েছিল ।
আমাকে আড়াল করতে গিয়ে
নিজেই তুমি একশো শতাংশ
ঝুঁকি নিলে । পরবর্তী
অধ্যায় তোমার একেবারেই
ভুলে যাওয়ার কথা নয় ।
প্রবল বৃষ্টিতে ভেসে
আসা নদীর জল ছোপ ছোপ লাল
লাল বাকিটা তো মায়াময়
রাষ্ট্রক্ষমতার শুকনো
জবা ফুল আর করবী গাছের
বিষাক্ত শিকড় ।
হ্যাঁ , রাইফেল , কত বছর
আগে ? রাষ্ট্র বিপ্লবের
যন্ত্র , আর আজ তোলাবাজি
আর বুথ দখলের হাতিয়ার ।
সাব্বাস , সেই সব
কলমগুলি যারা
আত্মসমর্পণ করেছিল
তারাই সেই কবে থেকে
এখনও ছদ্মবেশ ধরে আমার
তোষকের নিচে রাখা
রাইফেল নিয়ে কি চমৎকার
রোমান্টিক গল্প
উপন্যাস লিখে চলেছে
প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে ।
একটি সময় অতীতের আচমকাই
সরে গেল জানালার কপাট
পার হয়ে , রেখে গেল কালো
লোমশ লেজের নেমে যাওয়ার
গাঢ় অন্ধকারের বিমূর্ত
স্মৃতি ।
হ্যাঁ , আমাকে নিয়ে
তোমার পরেশানি কম ছিল
না । আমার চিন্তায় মগ্ন
হয়ে , নিজে প্রায় মরা
টিকটিকির মতন হয়ে
যাচ্ছিলে । আমাকে তুমি
বারে বারে বলতে , -
একদিন যাও । যেই নদী ঘাট
থেকে , রক্তাক্ত জলের
প্লাবন আমাদের বাড়ির
উঠোনে এসে উচ্ছসিত ছল
ছল, সেই ঘাটে একবার গিয়ে
ডুব দিয়ে এসো ।
আমি হতবাক হয়ে এখন
তাকিয়ে আছি দেওয়ালের
দিকে । একটি পাখি ক্রমশ
টি টি করে রাতের শহর পার
হয়ে যাচ্ছে, চোখের
সামনে ভেসে উঠছে ব্রাউন
রাইফেল । টেবিলের ওপরে
জল ভরা গ্লাসের পাশে
স্তব্ধ জোনাকি , ঘড়ির
কাঁটার টিক টিক শব্দ ।
দেওয়ালে ঝোলানো বাবার
সামরিক বাহিনির কম্বল
কাপড়ের টুপি , বেল্ট
ঝুলছে হুক থেকে , দু দুটো
যুদ্ধ পার হওয়া চামড়ার
কালো জুতোর ভিতরে ইদুর
খস খস । আমার ছাত্র
জীবনের জ্যামিতির
বাক্সের ওপরে পোকা উড়ে
টোকা দেওয়ার টং টং ।
ঘরের ভিতরে তোমার জর্দা
পানের গন্ধ । বহু দূর
থেকে ভেসে আসছে রিক্সার
পাম্প টেপার পু পু শব্দ ,
রাতের শেষ ট্রেন এখনো
সিগন্যাল অতিক্রম করে
নি , রাত গভীর হচ্ছে ।
শব্দহীন , স্মৃতির
তুখোড় ঢেউ আছড়ে পড়ছে
মস্তিস্ক জুড়ে ।
মহাকাশে কৃষ্ণগহ্বর
গিলে ফেলছে তারা
নক্ষত্র গ্রাম । আমি
ক্রমশ বিবস হয়ে যাচ্ছি ,
কতক্ষণ হয়ে গেল
রান্নাঘর স্নানঘর
বৈঠকখানা মায় দুই তিনটি
ঘর থেকে কোনো শব্দ ভেসে
এল না । আসলে কেউ বেঁচে
নেই । এমনকি তুমিও নও ।
তুমি কি এসে গেছ ? আমার
পাশে বসবে না ? একটু বোসো
। আজকে আমার কিছু বলার
আছে । তোমাকে ? হ্যাঁ
তোমাকে ? তোমাকেই বলছি ।
কিছু কথা বলার আছে ।
আজকে যদি তোমাকে
কথাগুলি না বলি , তাহলে
আগামীকাল কেউ এসে ,
ফ্রিজ থেকে জমানো
বরফগুলিকে নোংরায় ফেলে
দেবে । আমার ভিতরে শীতল
কথাগুলিকে আজ তোমার
উষ্ণতা দিতে চাই ।
ভয়ংকর হীম শীতল , অনৈতিক
, বেহিসেবি , পৌরসভার
বেশ্যাপাড়া অতিক্রম
করে আসার পরে , বুঝতে
পারলাম , হয়তো কেউ মারা
গেছে । স্বাভাবিক
অস্বাভাবিক বা হত্যাও
হতে পারে । তেল চোয়ানো
লাইটপোস্টে হেলান দিয়ে
দাঁড়ালাম । জিজ্ঞাসা
করলাম একজনকে । সবাই কি
রকম অতিরিক্ত হাসছে ।
আমি জানতে চাইলাম ।
দালাল বিক্রেতা ক্রেতা
গলির মাতব্বর সবাই
আমাকে কি রকম সন্দেহের
চোখে দেখছিল । জানি
মহল্লার সবাই আবার
সকালে নদীতে স্নান করতে
যাবে সাবান দিয়ে ধুয়ে
সাফ করে দেবে সন্ধ্যা
নেমে যাওয়ার আজকেরা
ঘটনাটি ।
এই সব বা এমন নানান ঘটনা
তো রোজই ঘটত বা ঘটে যেত
। কিন্তু আজ সকাল থেকেই
কাক ডাকা থেকে শুরু করে ,
চড়াই পাখির চিউ চিউ ,
শহুরে ময়লা শূন্যতায়
করবী গাছের ফুল , ভাঙ্গা
দেওয়াল উপছে রোমান্টিক
কদম ফুল , সাইকেলচারির
প্যাডেল ঘোরানো ,
বিদ্যালয়ের পাঁচিল
টপকে এসে ঘণ্টার ঢং ঢং
শব্দ , সাইনবোর্ড ,
ট্রেনের হুইসেল , চায়ের
দোকান এই সমস্ত কিছুই
অন্য অর্থ সংগ্রহ করতে
ব্যস্ত ছিল ।
তার মধ্যে হাসপাতাল
থেকে চূড়ান্ত রিপোর্ট
নিয়ে বাড়িতে ফেরা ।
তারপরে আমি ব্যাকুল ,
বাড়িতে ফিরে কল বাথরুম
করে , তক্তপোষের ওপরে
বিছানায় বসে আজকের
সংবাদপত্রটিকে
দেশলাইয়ের কাঠি
জ্বালিয়ে আগুন ধরিয়ে
দিলাম । আসলে কোনো
প্রকার বর্তমানের
সাক্ষ্য সরিয়ে ফেলতে
চাইছিলাম, আর নিজেই এক
গভীর গোপন আশ্রয়ের
সন্ধান চাইছিলাম ।
বইয়ের তাকে নাক রেখে
অনেকক্ষণ ধুলোর গন্ধ
নাকে নিলাম । জানি না ,
কবে শেষ একটি বই তাক
থেকে তুলে নিয়ে
পড়েছিলাম ।
শুয়ে পড়লাম । ধান
ক্ষেতের বিকেলে ভেসে
আসছে শ্যালোর ভুট ভুট
শব্দ । পারিযায়ী
মরসুমের আগে , একটু
রাস্তা ধরে হেঁটে যাওয়া
।
কোনো রাতের অন্ধকারকে
পাশে বসিয়ে আদর করে
কোনোদিন কথা বলি নি ।
তাই আজ রাতের ঘরের
অন্ধকার আমার সঙ্গে
অনেক কথা বলতে চাইছে ।
প্রায় প্রতিদিন রাতের
অন্ধকার আমার সঙ্গে কথা
বলতে চাইত । আর আমি তাকে
প্রত্যাখ্যান করতাম ।
কিন্তু আজ রাতের
অন্ধকারের কাছে আমি
আত্মসমর্পণ করলাম ।
কি চমৎকার শব্দহীন
মুছে যাওয়া আলোর রেশ
নিয়ে কিছু বলছে হয় তো ।
কে জানে রাত্রি এমনই
কথা বলে । আলো যখন কথা
বলে , সে অন্ধকারের কথা
কে আড়াল করে , অন্ধকার
যখন কথা বলে তখন কোনো
আলোর স্পর্শ থাকে না ।
আগে বুঝতে পারি নি ,
দিনের বেলা সারা জীবন
ব্যস্ততা আর কাজ দিয়েছে
। ব্যস্ত রেখেছে
অনাচারে । অথচ বেচারা
অন্ধকার , রাতের পর রাত
যন্ত্রণা দিয়েছে । যত
কাব্য কি দিনের অধিকারে
? আর যৌনতার অধিকারে
রাত্রি । আসলে
বিশ্রামের চূড়ান্ত
পরিণতি অন্ধকার ।
শব্দহীন , ঝি ঝি এক গভীর
মগ্নতার মধ্য দিয়ে মরে
যাওয়া মহাবিশ্ব কি
নিপুণ হাতে বেহালা
বাজিয়ে যাচ্ছে ।
উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলের
ওপরে হাত রাখলাম ।
অন্ধকারে কিছু ঠাহর
করতে পারছিলাম না । কেন
তুমি আমাকে আবার আলো
জ্বালতে বলছ ? তুমি তো
জানো আমি আজ আলো
জ্বালবো না । ডেস্কটপের
পাশে তোমার ছবির
এ্যালবামটি রাখা আছে ।
হাত বাড়িয়ে তোমার ছবির
স্পর্শ পাচ্ছি না ।
এ্যালবামের ছবির
চতুর্থ পাতায় তোমার ছবি
। ছবিটি যেন আমার
মুখস্ত । কতবার যে
জীবনে আমার বৈকালিক
নিঃসঙ্গতায় তোমার এই
ছবি আমার আশ্রয় ছিল ।
তুমি তা জানো নি । জানবে
কি করে ? কোথায় এক
সঙ্গতায় তুমি তখন এতটাই
মগ্ন ও মুগ্ধ যেন নিজের
জীবনকে তুমি অন্য
পরিভাষায় সংজ্ঞায়িত
করছ ।
আমি তো সাধারণ রক্ত
মাংসের মানুষ , নিজের
অক্ষম বোধের দ্বারা
শীতকালের ঘাসের ওপরে
শিশির ছুঁয়ে ছিলাম ,
জানি না , আমি সত্যি
ছিলাম না মিথ্যা ,
বিশ্বাস করো - পাহাড়ের
ওপরে গাছের মধ্যে যে
সন্ধ্যা নেমে আসার বাসা
থাকে আমি জানতাম তাই ।
পরে জেনেছিলাম তা
মিথ্যে । আসলে সব
নিসর্গই যে একরকম থাকে
না । তুমি সেটা ভালো
মতনই জানো । কিন্তু আমি
আজও দেখো কি বোকা থেকে
গেলাম , এখনও । আজও আমার
শরীরের গভীরে যখন
ম্যালিগন্যান্সি
তুষার ঝড় তুলেছে , আমি
তোমার ছবির এ্যালবামের
আশ্রয়ে বেঁচে আছি ।
চমকে উঠলে তুমিও ।
কাঁচের গ্লাস আমার
আঙ্গুলের টোকায় বোধ হয়
পড়ে গেল , কাঁচ ভাঙ্গার
শব্দ বোধহয় এমনই
তীক্ষ্ণ হয় । অন্ধকারে
কোনো পতনের ছবি হয় না ।
কেন জানি আজ থেকে
সাতান্ন বছর আগের
মাতৃগর্ভের জমাট
অন্ধকার চাইছি । চাইছি
আবার সেই শুরু , আবার সেই
সূচনা । যদিও পুনরায়
সূচনা বলে কিছু হয় না ,
তবুও যদি সেই সূচনা
আবার আবার , তবে কি ...তবে
কি ... তোমার গর্ভের
ভিতরে আমার বাসাবাড়ি
ছিল সেই খান থেকে তুমি
আমাকে বাহির করে দিলে ।
এই এইখানে আমার ঘরের
ভিতরে , এ আমার ঘর নয় ,
চারদিকে ঘরের ভিতরে যা
কিছু ছড়ানো , ঘরের
অন্দরে বস্তুগত বিবরণ
এই সব কিছুই অর্জন বা
পাওয়ার মাঝে এক চূড়ান্ত
বিভ্রম । আহা তোমার
গর্ভ গৃহ , মহাকাশের মতন
অন্তহীন । তোমার গর্ভ -
মহাকাশকে কোমল করেছে ।
চারদিকে রক্ত স্রোতের
জীবন উদ্যান । আর সে
তুমি যার শরীরের গহীন
স্রোতে জীবন চরাচর , সেই
তুমি পাশের ঘরের মেঝে ,
রক্ত বমি করে ভাসিয়ে
দিলে , ডাক্তার বাবু
এলেন , আমরা সবাই বুঝতে
পেরেছিলাম , আমাদের
পরিবারে ভয়ংকর এক
বিচ্ছেদ ঘটতে চলেছে ।
ডাক্তার বাবু পরিষ্কার
জানিয়ে গেলেন , - ফুটো
কলসিতে আর রক্ত ভরে কি
হবে ? অপেক্ষা করুন ।
আমরা সবাই হেরে গেলাম ।
তুমি শরীরে হারিয়ে গেলে
। শ্মশানে মধ্যরাতে
জ্বলে যাওয়া চিতার আগুন
, কাঁচা কাঠ পুড়ে যাওয়ার
গন্ধ ।
তোমার দাহ কাজের পরে ,
আমরা শ্মশান যাত্রীরা
ফির আসছিলাম বাড়ির পথে
। ভোর হয়ে আসছিল । পিছন
থেকে কে যেন বলল ,-পা
চালিয়ে । বাড়িতে ফিরতে
হবে তো । আমরা সবাই
সরকারি প্রসুতি সদনের
পাশ দিয়ে হেঁটে পার হয়ে
যাচ্ছিলাম শ্মশানের
ফেলে যাওয়া পথ । ওই
সদনের ভিতরে সারাদিন
সাররাত নিরন্তর জন্মের
উৎসব । সব শিশুই নিজের
ঘর ছেড়ে দিয়ে ......আমি
হতবাক ! তাই তো , আমার আপন
ঘর যেখানে আমার প্রথম
জীবনের ধুকপুক তা আজ
শ্মশানের চিতায় পুড়ে
ছাই হয়ে গেল । আজ আমি
প্রকৃতই দিশাহীন ,
নিসর্গহীন রিফিউজি ।
গৃহহীন দিশাহীন এক আমার
আমি ।
সন্ধ্যার পরে রাত একটু
একটু করে যখন আমার
তক্তপোষের ওপরে এসে বসত
, ঘরের চারদিকে ফোড়ন ,আর
মশলার গন্ধ । তোমার
জন্য রান্নাঘর একই আছে
। এখনও তোমার রান্নার
আয়োজনের ঠোকাঠুকির
শব্দগুলি একই আছে । আর
কারও কোনো শব্দের
স্পর্শ আমি নিতে দিই নি
। তাই রান্নাঘরটি একটি
বাস্তু উপকরণের আদিম
সংগ্রহশালার মতন । বেশ
কয়েকবছর হয়ে গেল ,
রান্নাঘর একইভাবে ,
স্বাদহীন , উপকরণ
বঞ্চিত , আগুন জল তেল
ফোড়নের বাইরে । রাত
গভীর হলে , আজকে যেমন
আদিম পোকা পায়চারি করছে
দেওয়ালে । আমার মা
বলতেন আমার জন্ম হয়েছিল
রাত্রি দেড়টার সময় ।
আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল
একটি মোম জ্বালতে ।
হ্যাঁ , আর সাথে কে থাকবে
? একাই মোম জ্বালি ,
সঙ্গে কে থাকবে আমার –
আত্মহননের দিনটিকে
উদযাপন করি । রান্নাঘর
থেকে নিয়ে বাকি
ঘরগুলিতে , কি বিস্তর
ব্যস্ততা ছিল , অফিস
টাইম চা জল সাবান
ফিনাইল , শব্দ হত রেডিও
সংবাদের , সন্ধ্যার
টেলিভিশন যুক্তিহীন
তর্ক , রাষ্ট্রক্ষমতার
হুমকি , শাসন , আলনায়
তোমার নতুন বিয়ের কাপড় ,
ঝুড়ি ভর্তি সবজি
রান্নাঘরে । তেলাপোকায়
চেটে দেওয়া আলুর টুকরো
। শতরঞ্চি । লোহার
তোরঙ্গ । তোরঙ্গের
ভিতরে মায়ের ওপার
বাংলায় যাওয়ার
পাসপোর্ট । বাবার ছিল
না । কারণ তিনি সামরিক
বাহিনিতে কাজ করতেন বলে
, অনুমতি ছিল না । ক্লাসে
ফেল করা আমার রেজাল্ট
বইয়ের তাকের নিচে
লুকানো । সেই কত বছর
আগের মনে পড়ছে না ।
সম্ভবত কারও হাত হয় তো
সেইখানে আজও পৌঁছয়নি ।
আজ রাত্রি ক্রমশ আমার
বেহাত হয়ে যাচ্ছে ।
আমার সঙ্গে এক সংঘাতময়
রাত্রি । যেন আত্মহননের
জন্য বসে আছি তক্তপোষের
ওপরে । শরীর ক্রমশ
দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাচ্ছে
।
রাত ক্রমশ মধ্য অবস্থান
অতিক্রম করে নিশাচর
বকের মতন কৃষ্ণপক্ষের
রাতে ডানা মেলেছে । টিপ
টিপ করে বৃষ্টি পড়েই
যাচ্ছে । কদম গাছের
পাতায় কেমন জল বিন্দুর
শব্দ , অন্ধকারের মেঘ
যেন জলাশয়ের ওপরে নেমে
এসেছে । নিঃসঙ্গ জলে
ভেজা পাখি গাছের ডাল
থেকে একাকী আর্তনাদ করে
যাচ্ছে । কীসের যেন
একটি শব্দ হল । বাবার
সেই সামরিক বাহিনীর
বুটের থ্যাবড়ানো
শব্দের মতন । আমি উঠে
দেখলাম , একটি ছায়ার মতন
সরে গেল পাশের দরজার
পাল্লা ছুঁয়ে ।
মনে পড়ছে , বাবা যদি
একবার ডাকাডাকি শুরু
করতেন , কিছুতেই থামতে
চাইতেন না । দেখলাম
একটি ছন্দহীন শব্দ ,
ক্রমশ এলোমেলো করে
দিচ্ছে আমার স্মৃতিকে ,
ঠিক এমনই শব্দ হয়েছিল ,
দরজার পাল্লা জুড়ে
যেদিন বাবার শব নিয়ে
আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম ,
শ্মশানের দিকে । বাড়ি
থেকে বেড়িয়ে বাবার
শবযাত্রার পাশে , সব
শব্দগুলি আজও যেন আমার
মনে পড়ছে । শব্দস্মৃতি
এত প্রখর হয় জানতাম না ।
রাস্তার নানান শব্দ ,
মানুষের ব্যস্ততার
শব্দ ও নানান কত কিছু ।
আজ এই রাতে জীবনের শুধু
একটি রাতে বুঝতে পারছি
কী ভীষ নিঃসঙ্গতার
মধ্যেও শব্দের কি প্রখর
ভুমিকা থাকে ।
# # #
আর কিছুক্ষণ , মাত্র আর
কয়েক ঘণ্টা ।
এরপরে সব কিছুই হয় তো ...
কেমন পড়ে থাকবে , অনেকটা
জল ছড়ানো কাঁচের
গ্লাসের মতন । কাত হয়ে ।
জীবন এমনই ক্ষয়ে যেতে
যেতে শরীর একসময় বস্তু
হয়ে যায় । নিজের সঞ্চিত
আঁকার সরঞ্জামগুলি ,
কেমন বিশৃঙ্খল , বহুদিন
আগে থেকেই এক এক করে
কুড়িয়ে নিয়ে গেছে
প্রতিবেশীরা । আর কিছু
জল রঙের ছবি বৃষ্টিতে
ভিজে গলে গেছে ।
ঘরদুয়ার , দরজার চৌকাঠে
যেন আর সেই আবেগ পড়ে নেই
, দেওয়ালে উইপোকার
মাটির পথ , বইয়ের তাকে ,
সংগৃহীত গ্রন্থ
উইপোকার দংশনে মাটি হয়ে
আসছে ।
দীর্ঘ বছর ধরে সঞ্চিত
গ্রন্থগুলির কোনো কোনো
গ্রন্থকে মনে হচ্ছিল এক
একটি পর্বত । চতুরঙ্গ ,
ম্যাজিক মাউনটেন ,
রেজারেক্সন , দি হাউস অফ
দি ডেড , দি ইডিয়ট , দিবা
রাত্রির কাব্য ও
অ্যান্ড কোয়ায়েট ফ্লোজ
দি ডন – আবার এই সময়ে
আমার ভিতরে নির্মাণ
করছিল চূড়ান্ত বিভ্রম
।
আমার অহেতুক সাহিত্য
পাঠ , গ্রন্থ সঞ্চয় ,
তোষকের নিচে রেখে
দেওয়া টাকা ভর্তি খাম ,
বহু বছর আগে ঘরের
দেয়ালে আঁকা কিছু
বিন্যাস এমনকি ঠাকুর
ঘরে পিঁপড়ে মাটি তুলে
রখেছে মেঝে ভর্তি – ঠিক
এই সব কিছুর মতনই নিজের
শরীরকে আলাদা করতে
চাইছিলাম নিজের থেকে ।
বুঝতে পারছিলাম আমার
শরীর নামক বস্তু দিয়ে
আর যাই হোক ...হ্যাঁ
ক্রমশ নুয় পড়ছি
তক্তপোষের ওপরে বসে
থেকে থেকে , খুব চিৎকার
করে বলতে ইচ্ছে করছিল –
কেউ আমাকে একটি ক্রাচ
দিতে পারেন ... ক্রাচ
...একটি নিষ্প্রাণ
নির্ভরতা যা মানুষের
থেকে অনেক অনেক বেশি
বিশ্বাসি । মানুষের
রাস্তা বদল হয় , রাস্তার
দুই পাশে বদলে যায়
নিসর্গ বিবরণ , অনুভূতি
ও অনুভবের পোশাক বদলে
যায় ... ক্রমশ একজন অপরকে
ময়লা করে দিয়ে যায় । ঠিক
যেমন মন্দিরে যাওয়ার
আগে পুরোহিত গত রাতের
কাম তৃপ্ত লিঙ্গকে
পরিষ্কার করে বসে
মন্ত্রোচ্চারণ করে
ভক্তদের বলে , - কাম
ক্রোধ পরিত্যাগ করে
ঈশ্বরের শরণাপন্ন হও ।
এসো । বসো । কিছু বলবে ?
না কিছু বলব না ।
হ্যাঁ । কিছু বোলো না
শব্দে আর । কথায় না আর ।
মৌন থেকে নীরবে অনেক
কথাই তো বললে , এই গভীর
রাতে মাঠের ঘাসের মাঠে
এনে দিয়েছে অবিশ্বাসী
ঘ্রাণ । তোমার ঘরে ফিরে
যাওয়ার অনন্য ইচ্ছা
আমাকে মৃত্যুর আগে পরম
প্রিয় শান্তি দিল । এসো
যদি আমার হাত ধরায় কোনো
সংকোচ না থাকে , একবার
ফিরে তাকাও , দেখ
হাসপাতালের
বহির্বিভাগের দেওয়ালে
লেখাতই দেখ ......
ক্যানসার ওয়ার্ড .........
আজকের রাতকে আমি কি করে
বলি , একটু থাকো । কিন্তু
না । ঠিক তোমার মতনই
আকজকের এই রাত বেহাত
হয়ে গেল ।