দাউদাউ করে জ্বলছে
কাঠের দরজা , জানলা ,
পাতি আসবাব , কাগজপত্র ,
কংক্রিটের দেওয়াল । হু
হু করে চারপাশ থেকে
হাওয়ার দল দৌড়ে আসছে
বাইসন স্পীডে । উস্কে
বাড়িয়ে দিচ্ছে, ছড়িয়ে
দিচ্ছে আগুনের
শিখাগুলো । দেওয়ালের
ফাঁকফোকর মোটা গরাদে
ঢাকা । ছোট ছোট জালঘেরা
খাঁচায় অপ্রাপ্তমন
আদমসন্তানেরা জন্তুর
মত ছটপট করছে একটু
হাওয়ার জন্যে, বাঁচার
জন্যে। দেখাশোনা করার
কেউই তখন মজুত নেই ।
মাইনেকরা কর্মচারীর দল
বেতনলব্ধ সময় থেকে সময়
বার করে নিজের
ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ত
। সবখেকোর খিদে যখন
মিটলো , ধ্বংসস্তুপের
মধ্যে পোড়া কাঠকয়লা
ছাপ্পান্নটা লাশ । বিগত
মানুষ ।
এ কোনো বানানো গল্প নয় ।
কবিকল্পনা বা হরর মুভির
গা ছমছম ওকে - কাট করা
সিন নয় । আমাদের এই
হতভাগ্য দেশে
বেঙ্গালুরুতে ঘটে
যাওয়া এক অপ্রকৃতিস্থ
মানুষদের হোমের ঘটনা ।
জন্তুর মত রাখা হত
সেখানে সেই
মৃতভাগ্যদের । খাঁচার
ভেতর রেখে দেওয়ার
অজুহাত সেই একই , ওরা
ভারসাম্যহীন । খাঁচা
থেকে বেরোনোর আপ্রাণ
চেষ্টায় জীবনযুদ্ধে
হেরে যাওয়াদের লাশ হয়ে
যাবার খবরেও খুব একটা
হেলদোল হয়নি সমাজের
মাথার মণিদের । ওরা তো
ছিল সমাজের বোঝা ।
অথচ , আমরা কি একবারও
ভাবি যে এদেরও
প্রাত্যহিক চাহিদা
থাকে আমাদের মতই ! এরাও
ভাবে , এরাও কাজ করে
নিজেদের বৃত্তের ভাবনা
অনুযায়ী । আর আমাদের
মতই হাত পা চোখ মুখ নিয়ে
এরাও মানুষ হয়েই জন্ম
নিয়েছে । আমাদের ভাবনার
যে মস্ত বাওবাব শাখা
প্রশাখা ছড়িয়ে আমাদের
মননে বিস্তার করেছে ,
মনের ভারসাম্যতা নষ্ট
হলেই সে আর মানুষের
পর্যায়ে পড়বে না , সেটাই
এক বিশাল ভুলের মাটির
ওপরে দাঁড়িয়ে আছে
আমাদের অজান্তেই । ওই
অসহায় মানুষদের সঙ্গে
যাখুশি করার অধিকার
আমাদের প্রত্যেকের যেন
জন্মগত ।
অপ্রকৃতিস্থ মানুষ
রাস্তায় বেরোলে তাকে
দেখে হাসব , ঢিল ছুঁড়ব ,
পিটিয়ে মারব । ছোট
থেকেই আমাদের শেখানো হয়
, “ ওর কাছে যাসনা । ও ,
কামড়ে দেবে ”। তারমানে
মনের স্বাভাবিক তরঙ্গ
হারানো মানুষগুলোর
স্বভাবই নাকি হিংস্র ।
তারা আর যাই হোক মানুষ
নয় । আমাদের ভদ্রজনোচিত
ব্যবহার তাদের সঙ্গে
করার জন্য নয় । ওদের আর
পাঁচটা স্বাভাবিকের
থেকে আলাদা করে রাখতে
হয় । সময়ে সময়ে হাতে
পায়ে বেড়ি দিয়ে বেঁধে ,
গরাদের গন্ডীর মধ্যে
রাখতে হয় । আর যদি সেই
কেটে দেওয়া গন্ডী
পেরিয়ে কেউ সুস্থ ,
স্বাভাবিক জীবনে আসার
চেষ্টাও করে তাহলে তাকে
পিটিয়ে মারতে হয় ।
কলকাতায় আশির দশকে বিজন
সেতুর ওপরে জীবন্ত
পুড়িয়ে মারা হয়েছিল
দশজন মানুষকে। সংবাদ
মাধ্যমের কাছে
কর্তাদের কৈফিয়ত ছিল ,
ওরা ওরা মানসিক
ভারসাম্যহীন । কারন
তারা নাকি মৃত মানুষের
মাথা খুলি নিয়ে নেচেছিল
। কিন্তু কেঁচো খুড়তে
বেরোল কেউটে । আসলে ওই
লোকগুলো নাকি ছিল অন্য
রাজনৈতিক মতাদর্শের
মানুষ । তাহলে আইনের
চোখ যখন এমনিতেই বাঁধা ,
তখন সমাজের বাকী অংশের
চোখে ধুলো দিয়ে
পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি
রাখার জন্যেই এই
পাগলপ্রলাপের অবতারণা
। আর এই ভুলের ধুলো
আমজনতার চোখে ছিটানো
নৈমিত্তিক ব্যাপার ।
দেখা যাচ্ছে একজন , যে
কিনা এই সমাজেরই অংশ , আর
সে তার মতাদর্শ কিম্বা
কাজ দিয়ে অন্য সব
মানুষদের প্রভাবিত করে
চলেছে , যাতে ক্ষতি
হচ্ছে অন্য কোনো
মতাদর্শের অনুসারীদের,
স্পষ্ট ভাষায় বলা ভালো
সব
দেশ-কাল-জাতি-ধর্ম-রাজন
তি নির্বিশেষে
শাসকদলের , তাকে
বিচ্ছিন্ন করার জন্যই ঐ
প্রাগৈতিহাসিক অপবাদ
দিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে ।
এক বীভৎস অস্থিরতার
সৃষ্টি হচ্ছে জনজীবনে ।
ইচ্ছাকৃতভাবে এই ভুলের
ধোঁয়াশায় রাখার চেষ্টা
অবিরাম চলে আসছে
প্রাচীন যুগ থেকেই ।
গণশত্রু বিশেষণ দিয়ে
গণপ্রহারে মেরে ফেলতে
পারলে নির্দিষ্ট কেউ
দোষী সাব্যস্ত হয়না ।
অথচ মজার ব্যাপার হলো ,
যখন একটা মানুষকে
গণপ্রহারে মেরে ফেলা
হচ্ছে তখন তাতে অংশ
নেওয়া যূথের মধ্যে তৈরি
হচ্ছে বিকট হিস্টিরিয়া
। সুস্থ অবস্থায় কোনো
মানুষ আর একজন মানুষ কে
মেরে ফেলতে পারেনা ।
তাহলে ঐ খুন করতে যাওয়া
মানুষেরাও সেই
মুহূর্তে অসুস্থ ,
অপ্রকৃতিস্থ । কিন্তু
সেই অমোঘ সত্যিটা তারা
নিজেরাও জানেনা । সেই
মুহূর্তের বর্ণনা দিতে
গিয়েও তারা ভাবতেও
পারেনা যে তারা নিজেরাও
মানসিক অসন্তুলনের
শিকার । খুনী যখন
নিজেকে সুস্থ ,
স্বাভাবিক ভাবে , তার
চাইতে বড় ভুল আর কি হতে
পারে ?
গণহিস্টিরিয়া তৈরি
করার রীতিমত কৃৎকৌশল
আছে । প্রথম হচ্ছে , যে
আসল স্বার্থকে গোপন
করার জন্যে এই
হিস্টিরিয়া তৈরি করতে
হবে , একটা সত্যির মত
দেখতে -
শুনতে - বুঝতে ভুল ধারণা
গড়ে তুলে তাকে আড়াল
করতে হয় আমমানুষের
মধ্যে । একটা ভুলের
সুযোগ খুঁজতে হয় যাকে
শিকার করা হবে , তার ।
যদি সে কোনো ভুল নাও করে
তবে তার যেকোনো একটা
কাজকে ভুল , জনবিরোধী ,
স্বার্থান্বেষীর ভুল
তকমা লাগিয়ে দিতে হবে ।
তারপর কোনো এক
মাহেন্দ্রক্ষণে
ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে
সদলবলে হারেরেরেরে করে
। এভাবেই মারা গেছেন
জিওদার্ণো ব্রুণো,
জোয়ান অব আর্ক,
বেঞ্জামিন
মোলায়েজ , লোরকা, হেমন্ত
বসু আরও কত মহারথী।
এ তো গেল রাজনৈতিক
উদ্দেশ্যসিদ্ধির
জন্যে ইচ্ছাকৃত ভুল
সৃষ্টি করা । দেখা
যাচ্ছে ক্ষমতার
কেন্দ্রে থাকা
সুবিধাভোগীরা সবচেয়ে
বেশী এই হিস্টিরিয়া কে
কাজে লাগিয়েছে । ধর্মের
নামে আমরা দেখেছি ,
ইউরোপে , আমেরিকায় ,
এশিয়ায় , আফ্রিকায় ভুল
মানসিকতায় হিস্টিরিয়া
তৈরি করা হয়েছে । ডাইনি
অপবাদের ভুল কালি
লাগিয়ে এখনো
গ্রামেগঞ্জে মেরে ফেলা
হয় কত নিরাপরাধ কে।
উড়িষ্যার কালাহান্ডির
বোলাঙ্গিতে এক
প্রত্যন্ত গ্রাম ।
সভ্যতার আলো খুবই কম
ঢুকেছে সেখানে হয়তো
দুর্গমতার জন্যে , হয়তো
রাজনৈতিক উদ্দেশ্য
সেরকম পরিমানে সিদ্ধি
হবেনা ভেবে । বছরের এক
নির্দিষ্ট মাসে
একসঙ্গে গ্রামের সমস্ত
মানুষ গণহিস্টিরিয়ায়
আক্রান্ত হন । যেহেতু
সেই গ্রামে স্কুল নেই,
নেই কোনো প্রাথমিক
স্বাস্থ্যকেন্দ্র ,
ডাক্তার , তাই ভাগ্যের
হাতে নিজেদের ছেড়ে
দিয়েছে আপামর
গ্রামবাসী । ওঝাদের
প্রতিপত্তি সেখানে
অবিসংবাদী । বছরের ওই
সময়ে ওঝারা এক মাস যাবৎ
তাদের বিভিন্ন ভুতুরে
কার্যকলাপ চালায় । আর
কিচ্ছু না বুঝেই তাতে
অংশগ্রহণ করে সবাই ।
তারা ঘোর ভুলের
অন্ধকারে বাস করতে করতে
নিজেদের সুস্থ ভাবে ।
কিন্তু
অপ্রকৃতিস্থতায়
সুদিনের আশায় মাতে ।
কিছুদিন আগেই খবরের
কাগজে খুব হৈ চৈ হল
কয়েকটা মানসিক রোগীদের
হাসপাতালের বিভিন্ন
অনিয়ম নিয়ে । জানা গেল
এক হাসপাতালে নাকি
এমনকি যুবতী রোগীদেরও
পরার কাপড় দেওয়া হয়না ।
অথচ সরকার থেকে বরাদ্দ
টাকা ঠিকই নেয় হাসপাতাল
কর্তৃপক্ষ, যা ভাগ
বাঁটোয়ারা হয় কিছু
ক্ষমতাশালীর মধ্যে ।
কাপড় না দেওয়ার অজুহাত ,
ওরা নাকি দিলেও নিজেদের
গায়ে কাপড় রাখতে পারেনা
। মুখে বলতে পারেনা ,
অভিযোগ জানাতে পারেনা
বাইরের তথাকথিত সুস্থ
জগতের কাছে বলে , ওদের
জন্যে বরাদ্দ
ওষুধপ্ত্র , খাবার ,
বিছানা বা দৈনন্দিন
প্রয়োজনীয় জিনিস কিছুই
সঠিক পরিমানে বা
পদ্ধতিতে দেওয়া হয়না ।
ওইসব মানসিক হাসপাতালে
বা হোমগুলোতে দৈহিক
লালসার শিকার হতে হয়
বিভিন্ন বয়সের মেয়েদের
। অথচ ভুল চেতনার অন্ধ
কুঠরীতে বাস করে বোঝা
ভেবে তাদের বাড়ীর
লোকেরা , তাদের আত্মীয়
স্বজনেরা কখনো
একবারটির জন্যও খোঁজ
নেয়না , সেই
হতভাগ্যগুলো কেমন আছে ।
নিজেকে সেই জায়গায়
বসিয়ে অবস্থাটা কল্পনা
করলেও শিউরে উঠবে
যেকোনো তথাকথিত সুস্থ
মানুষ ।
এই কোলকাতাতেই এক বাবা
তার মানসিক বিকলাঙ্গ
ছেলেকে খুন করে নিজেও
আত্মহত্যা করলো । হয়তো
তার মনে হয়েছিল এ ছেলেও
একদিন শিকার হয়ে যাবে
তার অবর্তমানে । কিম্বা
সেই বিকলাঙ্গতায় হয়তো
সে নিজেই লজ্জিত ছিল।
নিজের ছেলে, ভাই , বাবা,
বোন যদি এরকম হয় , তাহলে
আমরা তাকে বাড়ীর বাইরে
বেরোতে দিইনা । হয়তো
তার মানসিক অসুস্থতা ১৫
বা ২০% । তবুও যদি সে
বাড়ীর বাইরে পা রাখে ,
তাহলে যদি প্রতিবেশীরা
কিম্বা রাস্তার কেউ
তাকে দেখে টিটকারি দেয় ,
হাসে , মারধর করে , তাহলে
অপমানের তীক্ষ্ণ হুল
বিঁধবে অলিভ অয়েল
চর্চিত সযত্নলালিত
তথাকথিত সুস্থ ভদ্র
চামড়ায় । এই তথাকথিত
শব্দটা বারবার ব্যবহার
করছি কারন , এক বিশাল
ভুলের গ্লোবে ঘুরপাক
খেতে খেতে আমরা জানিই
না যে প্রত্যেক মানুষই
কিছু শতাংশ
অপ্রকৃতিস্থ। তা না
হলে, আমরা একসিডেন্ট
দেখলে মুখ ঘুরিয়ে চলে
যেতাম না । ঝগড়ার সময়
জিনিসপত্র ভেঙে রাগ
দেখাতাম না । প্রতিবেশী
বিপদে পড়লে মনে মনে
খুশি হতাম না ।
সেই অসুস্থ রোগীকে
সুস্থ সমাজ থেকে আলাদা
করে রেখে ভুল চিকিৎসা
পদ্ধতির প্রয়োগ করি
সম্পূর্ণ নিজের
স্বার্থে কিম্বা নিছক
মজায় কিম্বা
প্রতিষ্ঠার ক্ষতির
আশংকায় । মন ভারী বিষম
বস্তু । কখন যে
মস্তিষ্কের জটীল
কুঠরীতে নিউরো
ট্রান্সমিটার
সেরাটোনিন ক্ষরণ কমতে
থাকবে । স্নায়ুতন্তুর
মাধ্যমের বিভিন্ন
নির্দেশের তরঙ্গগুলো
হারাতে থাকবে
স্বাভাবিক সন্তুলন , তা
কেউই জানেনা । কেনই বা
হয় এটা তাও কেউ জানেনা
সঠিকভাবে। তবু সৃষ্টি
হয়েছে মনোবিদ্যার ।
বিভিন্নভাবে চেষ্টা
করা চলে মানসিক
ভারসাম্যতা হারানো
রোগীকে সুস্থতায়
ফিরিয়ে আনার ।
কিন্তু বারবার আমরা
ভুলে যাই সেই মানসিক
অবসাদগ্রস্তও একজন
পূর্ণ মানুষ । সেও
দেশের একজন নাগরিক ।
সমাজের সব অধিকার
সাংবিধানিকভাবে
প্রদত্ত হয়েছে তার
প্রতি। আমরা ভুলি সেই
আজন্ম সযত্ন লালিত
কুসংস্কারে যে , এও এক
রোগ । যেমন একজন সুস্থ
মানুষ হজমের গোলমালে,
ক্যান্সারে, হার্টের
রোগে আক্রান্ত হয়। যেমন
পোলিও তে কিম্বা
স্নায়ুরোগে আক্রান্ত
হয়ে একজন সুস্থ মানুষ
বিকলাঙ্গ হয়ে যায় । ঠিক
তেমনি এই মানসিক
বিকলাঙ্গতাও এক রোগ ।
এই রোগের শিকারদের
দরকার সহমর্মিতা।
দরকার কিছু শুশ্রতা
(Nurshing)। সেটাই ওদের জন্য
সঠিক চিকিৎসা। কিন্তু
তা না করে আমরা ওদের
বোঝা ভাবি । অমানুষ
ভাবি । জন্তু ভাবি ।
নিজেরাই জানিনা যে এ কত
বড় ভুল আমাদের ।