স্মৃতির উৎখননে বসে মনে
হয়, কবে যেন পেরিয়ে গেছে
কুসুমের মাস। অথবা
যাচ্ছে হু-হু করে। নয়তো
এত শুকনো পাপড়ি জমা হয়
কী করে! তবু,
স্মৃতিটুকুই তো থাকে।
মানুষের একান্ত সম্বল।
দার্শনিক হেরাক্লিটস
বলেন, এক নদীতে কেউ
দু-বার স্নান করতে পারে
না। করবে কী করে! নদীটিও
এক থাকে না। মানুষটিও।
জীবন তো চলমান। সেই
প্রবহমানতার কথাই বলেন
দার্শনিক। এই প্রবাহের
ঢেউয়ে ঢেউয়ে শুধু
স্মৃতিটাই থেকে যায়।
অধ্যাপক অরিন্দম
চক্রবর্তী তাঁর লেখায়
জানিয়েছিলেন,
‘গর্ভোপনিষৎ’ নামে এক
প্রাচীন গ্রন্থে বিধৃত
আছে যে, মাতৃগর্ভে নবম
মাসে নাকি পূর্বজন্মের
সব স্মৃতি ফিরে আসে।
তখন কষ্ট হয়। কত লক্ষ
জন্ম ঘুরে এসেছি আমরা,
কত কী করেছি, কাদের জন্য
করেছি আর এখন কেন এই
অবস্থায় এসে পড়েছি- সব
মনে পড়তে থাকে। তখন
ভূমিষ্ট হওয়ার
ব্যাকুলতা জন্মে। মনে
হয়, এবার এমন কাজ করব,
যাতে আর জন্মে জন্মে
ফিরতে না হয়। অবশ্য
ভূমিষ্ট হওয়া মাত্র
নাকি সেই স্মৃতি লুপ্ত
হয়। ফলে আবার একটা নতুন
যাত্রার শুরু।
কিন্তু কথা হল, সেই
গর্ভজলের ভিতরে কেমনে
ফিরে এল সেই স্মৃতি?
কোথায় থাকে এই স্মৃতি!
কে জানে! মৃত্যু মানেই
তবে সব শেষ নয়।
কিছু-না-কিছু থেকে
যায়-ই।
সাদিক হোসেনের গল্প
‘মারাদোনার বাম পা’,
সেখানেও ফিরে আসে এই
স্মৃতির কথা- ‘কিন্তু
প্রদীপ্ত প্রায় অবিচল।
সে সেইভাবে সিপ নিচ্ছে
আর বলছে, একমাত্র
মানুষের ক্ষেত্রেই ডেথ
মানে বিয়োগ নয়। প্রতিটা
ডেথ প্রচুর স্মৃতির
জন্ম দেয়। প্রতিটা ডেড
বডি আবার নতুন করে
বেঁচে ওঠে। একমাত্র
আমরাই ডেড বডির সঙ্গে
বসবাস করতে পারি।
একমাত্র মানুষের
সমাজেই জীবিতের থেকে
মৃতের সংখ্যা বেশি।’
কী সাংঘাতিক সত্যি! এই
ফাঁকে কুন্দেরাও
ফিসফিসিয়ে নিশ্চিত বলে
যাবেন, নব্য মৃত এসে তো
পুরনো মৃতের জায়গা
নেবে। সেই অসংখ্য মৃতের
সমাজে অবশেষ হিসেবে
কেবল জমা থাকছে স্মৃতি।
স্মৃতি জমে জমে বেদনা
হয়। বেদনা গাঢ় হলে
পুনর্জন্মের শাঁখ বেজে
ওঠে।
স্মৃতির উৎখননে বসে তাই
কখনও মনে হয়, আসলে এক ঝরা
পাপড়ির সংক্রান্তি
থেকে কুসুমের মাসের
দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি
বোধহয়। দ্রুত।
স্মৃতি কোনও সহজ সমীকরণ
নয় তাই। স্মৃতি সম্বল।
আশ্রয়, ভরসা-ও। এই যে
মানুষের মুখে মুখে ফেরা
গানে তোমাকে পাওয়ার
আর্তি, সেই গান কোথায়
থাকে? স্মৃতিতে। ইতিহাস
তো চিরকালই শাসকের।
জয়ীর। আর পরাজিতের কথন?
সে তো প্রথাগতভাবে
প্রক্ষিপ্তই। কিন্তু
স্মৃতির ইতিহাস তাকে
ফেলে দেয় না। বরং মুখে
মুখে জাগিয়ে রাখে। ওরাল
হিস্ট্রি বাঁচিয়ে তোলে
অন্যতর ইতিহাস। আর সেই
মৌখিক ইতিহাসের সূত্রে
আমরা পেয়ে যাই ব্যক্তির
ভিতর অন্য ব্যক্তিকে।
দেশের ভিতর অন্য দেশকে।
ভিন্নতর সে ইতিহাসের
বয়ান। তবে ধারক তো সেই
স্মৃতিই। সংবাদপত্রের
তথ্যনির্ভর আর্কাইভে
তা থাকে না। আজ তাই
যে-কোনো নস্ট্যালজিয়াই
খুব জরুরি হয়ে পড়েছে।
কেন? কেন এই অতীত বিলাস!
কেন সামনের দিকে তাকাব
না? আসলে সামনে তাকানোর
জন্যই একবার পিছনে ঘাড়
ঘোরাতে হচ্ছে। দেখে
নিতে হচ্ছে, কেমন
আলো-হাওয়ার চলাচল ছিল
এককালে। উঠোনে কেমন এসে
পড়ত রোদ্দুর। আর
লকলকিয়ে উঠত লাউ-কুমড়ো
লতা। খুব জরুরি ছিল না
খেয়াল করা, অন্তত সে-সময়,
যে, কাঠের কাজ করতে এসে
ও-পাড়ার যে কালোকাকু
দুপুরে স্নান সেরে
মায়ের হাতের বেড়ে দেওয়া
ভাতে গরাস ভাঙতেন
অনায়াসে, তাঁর নাম কী
ছিল কিংবা বাড়ি ফেরার
সময় তিনি কেন মাথায় ফেজ
টুপি পরতেন। কেন-না
এ-খুবই স্বাভাবিক
দৃশ্য। ফলে প্রশ্নের
জন্ম হয় না। খুব জরুরি
ছিল না খেয়াল করা, তবু
মনে তো পড়বেই যে, পিরের
ঘরেই বসেছে রামায়ণ
গানের আসর। মালসা ভোগ
হবে। ধোয়া-মোছা মালসার
ঠাঁই হয়েছে পিরের ঘরের
দাওয়াতেই। কথা হল, কে এই
পির? কে জানে! তখন কে
জানত সত্যপির আর নারায়ণ
এক হয়ে গিয়ে হাত ধরাধরি
করে ঢুকে পড়েছে
গ্রামে-গঞ্জে। জানত না
কেউ। শুধু জানত, পিরের
ঘরেও সন্ধেবেলায় একই
সঙ্গে প্রদীপ জ্বলে
উঠত, ধূপের ধোঁয়া আর
গন্ধ ছড়িয়ে পড়ত, যেমন
তুলসীতলায়। কাছাকাছি
ঘরের কোনও বউই মাথায়
ঘোমটা তুলে সে দায়িত্ব
পালন করতেন। খুব জরুরি
ছিল না খেয়াল রাখা। তবু,
আজ প্রাসঙ্গিক বড়ো যে,
রাস্তার ধারে ভিড় করে
দেখছি মহরমের তাজ। আর
কালীপুজোর ভোর রাতে
পোসেনজিত-ঋতুপর্ণার
মাতিয়ে দেওয়া মুহূর্তে,
একখানা ভিডিও ক্যাসেট
যেন দুই পাড়ার বাহ্যিক
ও মনস্ত্বাত্বিক
যা-কিছু দূরত্ব মুছে
দিয়েছে। ভোরের দিকে
বাতাস ঠান্ডা ঠান্ডা।
তাই ঘা ঘেঁষাঘেঁষি করে
বসাই দস্তুর। এ সবই
স্বাভাবিক। ছিল। আলাদা
করে করে দাগিয়ে
উল্লেখের প্রয়োজন তো
পড়েনি। তবু স্মৃতি হয়তো
আজ কিঞ্চিৎ রক্ষাকবচের
ভূমিকায়। যেখানে আজও সব
অবিকল। সব আছে
পাশাপাশি। সেই-ই বলতে
পারে, এই ছিল তোমার
অতীত। আর এই এখন তোমাকে
দেখানো হচ্ছে। এবার
তুমিই দেখে নাও, তুমি
জেনেশুনে বিষ পান করবে
কি না।
অবশ্য সবই কি আর এমন
নিকোনো উঠোন? স্মৃতিই
সাক্ষ্য দেবে কিছু
বেচাল ছিল। থাকেই।
কালী, খণ্ডিত যে কাল, তা
বস্তুতই ঝঞ্ঝামুখর।
মহাকাল, শান্ত সমাহিত।
এই মুখর কাল, মহাকালের
বুকে পা দিয়ে আপন
প্রগলভতায় লজ্জা পাবে।
জিভ করবে। এই তো
দস্তুর। এই লজ্জা
পাওয়াটুকুকেই আমরা
পুজো করে আসছি। আমরা,
আমাদের বলছি, এই
ঝঞ্ঝা-মহামারীতে মেতে
থাকায় আমাদের লজ্জা
হোক। লজ্জা হোক। স্মৃতি
আজ সেই দূতীর ভূমিকা
পালন করে যেন।
আত্মভ্রষ্টজনকে সে
জাগিয়ে দিয়ে বলতে পারে,
ওই দেখো তোমার শান্ত
সমাহিত মহাকালের জীবন।
আর এই তুমি কেবলই ভুল
ভেবে ভুলের লালায় রচিত
ফাঁদে আটকে ফেলছ তোমার
সর্বস্ব। এই যে কেবলই
মহামারী বুকে ধরে বসে
আছ, তোমার কি লজ্জা
পাওয়া উচিত নয়!
ফলে সত্যিই স্মৃতির পথে
ফিরে যেতে হয়। ফিরতে
সাধ হয়। একমাত্র এই
মৃতের পৃথিবীতে সেই-ই
তো খুঁজে দিতে পারে
জীবন। আমি শুনতে পাই,
প্রতিমা
বন্দ্যোপাধ্যায়
গাইছেন,
‘স্মৃতি জানলা খুলে
চেয়ে থাকে
চোখ তুলে যতটুকু আলো
আসে
সে আলোয় মন ভরে যায়...’
আলো ঝলমলে সেই
দিনকালকে, সেই অতীতকে
কতকাল দেখিনি আমরা। সাধ
হয়, একবার দেখি।