টানা বৃষ্টি । তিনদিন
ধরে অঝোর । আদি ঘর বন্দী
। কলেজ কামাই করছে ।
গায়ে জ্বর । আদি , আদিত্য
, বছর পঁয়তাল্লিশ বয়েস ।
কলেজে পড়ায় । সঙ্গে
শর্ট ফিল্ম , টেলি , ডকু
নিয়ে কাজ করে । এটা নেশা
। তিনদিন ও
পিরানদ্দেল্লো নিয়ে
ডুবে আছে । রান্নার
মাসিটি আছে প্রায় তের
বছর । সরলা মাসি প্রথমে
রান্নার মাসি হিসেবে
এসেছিল । এখন সে ই আদির
দেখ - ভাল করার একমাত্র
মানুষ ।
‘ কি খাবে আজ ? কাল ও তো
খিচুড়ি খেলে ? ’
‘ যা হোক কিছু একটা কর না
সরলা মাসি ’
প্রতিদিন এই একই
কথপোকথন ।
বুকশেলফের পাশেই
মাটিতে বসে দেয়ালে
হেলান দিয়ে বই পড়া ,
লেখা, আদির অভ্যেস ।
একরাশ বই নামাবে । সব
ফেলে রেখে যখন উঠে যাবে
সরলা মাসি আবার সব
শেলফে গুছিয়ে রাখবে ।
পিরানদ্দেল্লো ’র ছোটো
গল্প গুলো নিয়ে কিছু
নতুন কাজ করার কথা
ভাবছে আদি । একটা বই
শেলফ থেকে টানতেই দুটো
লম্বা সাদা বেশ পুরোনো
খাম মাটিতে
পড়ল । আদি তুলে নিল ।
একটা থেকে বেরিয়ে এল
তোর্সার একটা ছবি ।
এরকমই এক মুখর শ্রাবণ
দিনে ঘর-বন্দী ছিল ওরা
এই ফ্ল্যাটেই ।
একসঙ্গে
থাকত । কদম ফুল মাথায়
গোঁজা তোর্সার নানান
ভঙ্গির ছবি তুলছিল
সেদিন আদি । প্রিন্ট
বের করে আনার পর একটা
ছবি হাতে নিয়ে তোর্সা
বলেছিল ‘তোর ফিল্মের
হিরোইন দের মত আমি
এটাতে অটোগ্রাফ করে দিই
?’ তারপর খসখস করে
ছবিটার ওপর লিখে দিল ‘
তোর্সা একটি নদীর নাম ’
। ‘একটু বেশি ফিল্মি
হয়ে গ্যালো না ? তিতাস
একটি নদীর নাম টাইপ ? ’
আওয়াজ দিল আদি । খিলখিল
করে হাসছিল তোর্সা ।
ছবিটা হাতে ধরে
দাঁড়িয়ে আছে আদি । আরেক
হাতে আরেকটা সাদা খাম ।
কোনো মেডিকেল
সেন্টারের । কোনো
মেডিকেল রিপোর্ট আছে
বোঝা যাচ্ছে । বছর বারো
আগে তোর্সার হঠা একদিন
আদিকে বিয়ে করতে চাওয়া
। আদির তখন সময় নেই।
ফিল্ম ফিল্ম করে মেতে
আছে । তারপরই হঠাৎ
কাউকে কিচ্ছু না বলে
বহুদূর পদ্মাপাড়ের
অসম্ভব পিছিয়ে পড়া একটা
গ্রামে তোর্সার চাকরি
পেয়ে গ্রামের মানুষদের
উন্নয়নের কাজ করবে বলে
চলে যাওয়া , কিছুতেই আর
আদির সঙ্গে যোগাযোগ
রাখতে না চাওয়া , সব মনে
পড়ে গেল । আদি খুব
বিরক্ত হয়েছিল , আদির
অসম্ভব রাগ হয়েছিল ।
যন্ত্রনা হয়েছিল ।
শুধুমাত্র সম্পর্ক টা
ভেঙ্গে দিয়ে ছেড়ে চলে
যাওয়ার জন্যই যাওয়া ।
তোর্সার বাড়িতে যোগযোগ
করে ও জেনেছিল বাড়িতেও
কিচ্ছু জানায়নি ।
তোর্সার দিদি তিস্তা
শুধু কথা বলতে চায়নি
আদির সঙ্গে । আদি
অপেক্ষা করেছে । বারবার
ফোন করেছে । তোর্সা সব
মোবাইল নাম্বার বদলে
ফেলে । আদি যেতে চেয়েছে
ওর গ্রামে । তোর্সার
বাড়ি থেকে বারণ করেছে ,
বলেছে তোর্সা আর কোনো
সম্পর্ক আদির সঙ্গে
রাখতে চায় না । আদি মদে
চুর হয়ে ডুবে থেকেছে
রাত দিন । আদি কাজ করেছে
। কলেজে পড়িয়েছে ,
প্রচুর ডকুমেন্টারী আর
শর্ট ফিল্ম বানিয়েছে ।
কিছু বিদেশ ঘোরাও হয়ে
গেছে । দু তিনটে
পুরষ্কার আদির ঝুলিতে
এখন । সাথে বহু - নারী
সঙ্গ । একের পর এক
মেয়েরা
এসেছে । মত্ত থেকেছে
আদি । চলেও গেছে তারা ।
সকলেই এসেছে আদিকে
আশ্রয় করে কিছু সুবিধে
পেয়ে নিতে । অভ্যেস হয়ে
গিয়েছিল আদির । শেষ এল
সুলগ্না । ওর ওপর একটু
বেশি যেন মায়া পড়েছিল
আদির । বেশ কয়েকটা
টেলিফিল্মে সুলগ্না কে
নায়িকা করে ও । একসঙ্গে
মাঝেমাঝেই থাকত ওরা এই
ফ্ল্যাটে । সবাই ধরেই
নিয়েছিল এবার আদি আর
সুলগ্নার বিয়ের নিউজ টা
খুব তাড়াতাড়ি সকলে পাবে
। একদিন ওর সঙ্গে ফিল্ম
নিয়ে কাজ করে তমোজিত
নামের ছেলেটি হন্তদন্ত
হয়ে আদির কলেজে হাজির ।
অফ পিরিওডে বসল ওরা
একসঙ্গে । তমোজিত সামনে
রাখল সুলগ্না র কিছু
ছবি , টলিউডি এক
প্রোডিউসারের
কন্ঠলগ্না । আদি থমকালো
, হাসল , একটা সিগারেট
ধরিয়ে বলল ‘ চ, দু পেগ
হয়ে যাক , ক্লাশ টা সেরে
আসি । জাস্ট ওয়ান্ট টু
সেলিব্রেট ’ ।
তোর্সার ছবি , তোর্সার
হাসি বারো বছর পর মুখর
শ্রাবণ দিনে আদি কে
আচ্ছন্ন করে ফেলছে ।
কেমন আছে তোর্সা ? কেনই
বা ছেড়ে গেল ওভাবে ?
‘ সরলা মাসি ই ই ই ই ’
‘ চিৎকার করছো কেন ? কি
বলবে বল ’ । সরলা মাসি
ঘরেই ছিল । টেবিল চেয়ার
পরিচ্ছন্ন করছিল ।
‘ এই মেডিকেল রিপোর্টটা
কোত্থেকে এল ? ’
‘চশমা টেনে নাকের ওপর
তুলে সরলা মাসি দ্যাখে ,
‘ ওমা , এতো তোর্সা
দিদিমনির । চলে যাওয়ার
ক’দিন আগেই তো এটা হাতে
বাড়ি ঢুকল , বারবার খুলে
দ্যাখে আর রেখে দেয় ।
নিয়ে যেতে ভুলে গেছে ।
আমি তোমাকে
দেখিয়েছিলাম আদি
দাদাবাবু , তুমি খুলেও
দেখলে না , আমি বই এর
মধ্যে করে তুলে
রাখলাম’, একটানা কথা
গুলো বলে গেল সরলা মাসি
।তাড়াতাড়ি খামটা খোলে
আদি । প্রেগনেন্সি
কালার টেস্ট রিপোর্ট।
পজিটিভ ।
আদির হাত কাঁপতে থাকে
। তোর্সার ছবি টা
মাটিতে পড়ে যায় । ‘
পজিটিভ ’ ।
পাগলের মত ছুটে যায়
ল্যান্ড - ফোন টেবিল টা র
কাছে । ওখানে একটা ছোটো
নোটবুকে অনেক পুরোনো
নাম্বার লেখা আছে ।
তোর্সার বাড়ির
নাম্বারে ফোন করে
শিলিগুড়িতে । ওপাশ থেকে
যান্ত্রিক স্বর জানান
দেয় ডায়াল করা নাম্বার
টি আরেকবার চেক করে
নিতে হবে । শিলিগুড়ি ,
তোর্সার বাড়ির ঠিকানা
আদির জানা । কোনো রকমে
জামা কাপড় বদলে বেরিয়ে
পড়ে আদি । তখনও বৃষ্টি
অঝোর ।
‘ আদি দাদাবাবু উ উ উ ’ ।
সরলা মাসি আতংকিত । ‘
আমি শিলিগুড়ি যাচ্ছি ’
। আদি বেরিয়ে যায় ।
তিনদিন হল ড্রাইভার কে
ছুটি দিয়েছে । অস্থির
হয়ে ট্যাক্সীর জন্য
ছটফট করতে থাকে আদি ।
একটা ট্যাক্সী ধরেই
শিয়ালদা স্টেশন
এনকোয়ারি কাউন্টারে
ফোন , নর্থ বেঙ্গল
যাওয়ার কোন ট্রেন কখন
ছাড়বে । সন্ধে সাতটা
নাগাদ একটা ট্রেন আছে ।
আদি রুদ্ধশ্বাসে
ট্যাক্সীর বিল মিটিয়ে
টিকিট কাউন্টারে ।
রিজারভেশন পাওয়া সম্ভব
না । তবু টিকিট কেটে নেয়
। ট্রেনের অপেক্ষায় বসে
থাকে । মোবাইলে
অনেকগুলো ফোন আসছে
ক্রমাগত । সুইচড অফ করে
দেয় । কোনো হুঁস নেই
আদির । মেডিকেল রিপোর্ট
টা হাতে ধরা । ‘পজিটিভ’
।
ট্রেন আসে । উঠে পড়ে
আদি । পৌঁছতে সকাল ন’টা
তো হবেই । চেকার কে বলে
আরেকটা লোকের সঙ্গে
একটা সিট কোনো রকমে
ভাগাভাগি করে নেয় ।
আদির কোনো হুঁস নেই ,
ক্ষিধে নেই , তেষ্টা নেই
, ঘুম নেই । শুধু একটাই
অক্ষর ‘পজিটিভ’ ।
ট্রেন থামে নিউ
জলপাইগুড়িতে । সকাল
সাড়ে নয় । মেঘলা । নেমে
যায় আদি । বাস ধরে ।
ঠিকানা মুখস্থ ।
শিলিগুড়ি শহরের একটু
কোল ঘেঁষে সবুজ ঢাকা
একটা অংশে তোর্সাদের
বাড়ি । লোহার বেড়া দিয়ে
ঘেরা এখনো । লোহার গেট
খোলে । ক্যাঁচ ক্যাঁচ
করে আওয়াজ হয় । মস্ত ফুল
বাগান । নেপালী মালী টা
খুরপি হাতে উঠে দাঁড়ায়
। আদি মোরাম রাস্তা
দিয়ে এগিয়ে যায়
বারান্দার দিকে ।
বারান্দায় গ্রিল
লাগানো হয়েছে । আগে ছিল
না ।
‘ কে এল পূজন ? ’ তিস্তা
বেরিয়ে আসে বারান্দায় ।
তিস্তা আর আদি একই বয়সী
। তোর্সা ওদের থেকে বছর
চারেকের ছোটো । তিস্তার
চোখে চশমা উঠেছে । শরীর
বেশ ভারি । একদৃষ্টে
তাকিয়ে তাকে তিস্তা –
‘আদি !’
বিধ্বস্ত আদি । যেন
ধ্বংসস্তুপ ।
‘ মাম মাম , পাপাই কে
প্লীজ বুঝিয়ে বল না আজ
আমরা ঋজু দের বাড়ি যাব।
একটা দুরন্ত ফুটফুটে
বছর দশ এগারোর ছেলে
এসেই ঝাঁপিয়ে পড়ে
তিস্তার
ওপর । স্কুল ড্রেস পরা ,
কাঁধে স্কুল ব্যাগ ।
পেছন পেছন রঙ্গন দা ,
তিস্তার হাসব্যান্ড ।
ছেলেটির সব দুরন্তপনা
নিমেশে থেমে যায় আদিকে
দেখে । চুপ করে তিস্তার
গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে
। তোর্সার মুখ টা যেন
অবিকল কেটে বসানো ।
‘ স্কুল বাস এসে যাবে
আদি , দেরি কোরো না ’ ।
তিস্তা বলে ছেলেকে ।
রঙ্গন দা ছেলেটিকে নিয়ে
এগোয় ।
‘ ভেতরে এস ’ , তিস্তা
ডাকে আদি কে ।
বসার ঘরের সোফায় বসে
পড়ে ক্লান্ত আদি । গা
এলিয়ে আসছে ।
‘কেন এসেছো ?’
মেডিকেল রিপোর্ট টা
এগিয়ে দেয় আদি । তিস্তা
রিপোর্ট টা দেখে
দেয়ালের দিকে তাকায় ।
আদিও তাকায় । তোর্সার
একটা বড় ছবি আদিরই তোলা
কদম ফুল গোঁজা ছবিগুলোর
একটা । মস্ত বড় একটা
কদমফুলের মালা ঝুলছে
ছবিতে ।
‘ যে গ্রামে কাজ করতে
গেছিল , সেখান কার
মেয়েদের স্বাস্থ্য -
শিক্ষা সচেতনতার জন্য
দিনরাত কাজ করত , শরীর
ভেঙ্গে পরে , ওখানকার
আবহাওয়া সহ্য হয় না ।
হঠাত ফোন আসে তোমার
রঙ্গন দা র কাছে ,
গ্রামীন হাসপাতালে
ভর্তি , আমি আর রঙ্গন
ছুটে যাই । ওকে
শিলিগুড়িতেই দাহ করা হয়
। তারপর মা চলে গেলেন ,
বাবা ও , পরপর’ । খুব
শান্ত গলায় কথাগুলো বলল
তিস্তা ।
‘ তোমার ছেলের নামও আদি
মানে আদিত্য রেখেছো ? ’
আদি ভুতগ্রস্থের মত
জিজ্ঞেস করে ।
‘ হ্যাঁ ’ ।
‘তোর্সা প্রেগনেন্ট
ছিল’ ।
‘ হ্যাঁ , তোমার তখন
শোনার সময় ছিল না আদি ,
বোঝার মন ছিল না ’ ।
‘ একবার জানাতে পারতে ’
‘ কি করতে ? তুমি জোর করে
অ্যাবরশন করাতে ।
তোর্সা তা চায়নি ’ ।
ভুতে ধরা পাগলের মত উঠে
দাঁড়ায় আদি । তোর্সা
বাধা দেয় না। হাঁটতে
থাকে মোরাম ধরে । নুয়ে
পড়া , একটু যেন ঝুঁকে পড়া
আদি । যেন বয়স আশির
কোঠায় । রঙ্গন দা ফিরে
আসছে ছেলেকে স্কুল বাসে
তুলে । আদি ক্রশ করে
এগিয়ে যায় । খুরপি আতে
পূজন মালী আবার উঠে
দাঁড়ায় । ‘পজিটিভ’ ।
তোর্সার দিদি তিস্তার
তো ইউটেরাস এ পলিসিস্ট
হয়ে খারাপ অবস্থা
হয়েছিল । ইউটেরাস কেটে
বাদ দিতে হয় বিয়ের আগেই
। তা হলে বাচ্চা টা ?
ভুতে তাড়া করা আদি আবার
দৌড়তে থাকে বারান্দার
দিকে । রঙ্গন দা দরজা
বন্ধ করছিল । এগিয়ে আসে
। ‘ ইউ আর দ্য লুজার মাই
ব্রাদার , আদি ’র ওপর
পিতৃত্বের দাবি নিয়ে এস
না । ও আমাদের ছেলে ’ ।
দরজা বন্ধ করে দেয়
রঙ্গন দা । ঝমঝম করে
শিলিগুড়িতে বৃষ্টি
নামল । হাতে ধরা
মেডিকেল রিপোর্ট পড়ে
গেল মোরামে । ভেসে
যাচ্ছে জলের তোড়ে
বাগানের সরু নালা বেয়ে
। ‘ পজিটিভ ’ ।
অবিকল তোর্সার মুখ ।
টলতে টলতে মোরাম পেরিয়ে
লোহার গেটের ক্যাঁচ
ক্যাঁচ পেরিয়ে রাস্তায়
নেমে পড়ল । অঝোর ভিজে
চলেছে শিলিগুড়ি
শহর।আদি কোথায় চলেছে ?
বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে
মিশে যাচ্ছে তোর্সার
খিলখিল হাসির শব্দ ।
‘ তোর্সা একটি নদীর নাম
’
‘ একটু বেশি ফিল্মি হয়ে
গ্যালো ’, বিড়বিড় করতে
করতে বৃষ্টিতে ঝাপসা
হওয়া রাস্তায় মিশে যায়
আদি ....