ধনেশ কাকা ঢাকনা খোলা
হারমোনিয়ামে তান তোলে।
ঘরের মধ্যে সুর ছড়ায়
ধুন তোলা তুলোর মতো।
মিঠু দলে নতুন, সে
ঠুনঠুনি বাজায়।
আম্মাজান তীক্ষ্ণ চোখে
চারপাশ তাকিয়ে বলাইকে
ইশারা করে। মানে
পিকদানীটা নিয়া আসো
সামনে। বাচ্চা একটা
পোলা বলাই কাসার একটা
পিকদানী এনে
আম্মাজানের সামনে
রাখে। মৃদু একটা শব্দ
হয়। প্রিন্টেড লুঙ্গি
পরা গুলশানজী তবলায় বসে
আছেন। এরকম একটা মহড়া
সন্ধ্যায় ধনেশ কাকা তখন
গান ধরে।
আমার পায়ে ঝুমঝুম
নূপুর। আমি রেডি।
আম্মাজান হাত তোলে মানে
হলো থামো। আমার দিকে
কড়া করে তাকিয়ে থাকলেন।
নায়িকা জবা চৌধুরী কোমর
দুলিয়ে আমার কাছে আসে।
একটা লাল রঙা গামছা
কোমরে বেঁধে কিছু অংশ
ঝুলিযে রাখে। জবা জানে
এই কঠিন তাকানোর অর্থ।
ধনেশ কাকা শুরু করেন।
জলে গিয়াছিলাম সই
কালা কাজলের পাখি দেইখা
আইলাম কই
সোনারও পিঞ্জুরা সই গো ,
রুপারও টাঙ্গুনি
আবের চান্দুয়া দিয়া
পিঞ্জুরা ঢাকুনি।
পালিতে পালিছলাম পাখি
দুধ কলা দিয়া
এগো, যাইবার কালে
বেইমান পাখি না চাইল
ফিরিয়া
ভাইবে রাধারমন বলে পাখি
রইলো কই
এগো, আইনা দে মোর প্রাণ
পাখি পিঞ্জুরাতে থুই।
তালে তালে আমি নাচতে
থাকি। আমার সমস্ত শরীর
হিলহিল করে ওঠে সুরে
বাজনার দোলে। সাথে জবা।
আম্মাজান আমার দিকে
তাকিয়ে আছেন এক ঠারে
বুঝতে পারি। তিনি খুশি
কি বেজার বুঝতে পারি
না। মনে লয় তিনি খুশি
নন। প্রসন্ন হলে এক
খিলি পান মুখে দিতেন।
যেহেতু এখনো নতুন খিলি
মুখে ঢোকাননি...অতএব
আবার নাচতে হবে।
পুরানো পানের পিক ফেলতে
গিয়ে টের পেলেন যে
পর্যাপ্ত রস জমেনি
মুখে..মুখ কুচকে
ফেললেন। ভারী শরীর নিয়ে
উঠে এলেন মোড়া থেকে
আমার কাছে। ঠাস করে চড়
দিলেন আমার পাছায়।
বারোমাস তাঁর গলা
ফ্যাসফ্যাসে। শুনলে
মনে হবে নিজেই গলা
খাকারি দিয়ে নিজের গলা
পরিস্কার করি।
বললেন: ফুয়া নাচের না
কিতা ফুরি নাচের কুছতা
বুঝতাম পারি না ( ছেলে
নাচে নাকি মেয়ে নাচে
বুঝতে পারি না )
ডান্স মাস্টার
এডওয়ার্ড ভাই খুবই
তালপাতার সিপাই।
পায়জামা পাঞ্জাবিতে
আরো বকের ঠ্যাং কাকের
ঠ্যাং লাগে। প্রায় উড়ে
এলেন। আমার শরীরের
জায়গায় জায়গায় হাত দিয়ে
বলতে শুরু করেন..
ঝুমুর গান শৃঙ্গার রসের
এবং তাতে মধু আছে।
অশ্লীল দুলবি তবে তা
দোষের না। মানুষরে
আনন্দ দেওয়া পুণ্যের
কাম।
এডওয়ার্ড ভাই সুযোগ
পেলেই বক্তৃতা দেবেন।
শোন;
: নাচের মইধ্যে ৩ রকম ঢেউ
তুলবি। মানুষরে ডাক
দিবি। শরীরে পয়লা
আবাইদা করবি। আবাইদা
হইলো আবাদ করা। তারপর
রুআ মানে ফসল বুনবি।
সবশেষে ফসল কাটবি।
ফিনিশিং দিবি। এই দেখ
আমার দিকে নজর দে..
বলে শুকনা পাটকাঠির মতো
আমাকে নাচ দেখাচ্ছেন
দুলে দুলে।
বলাই পানের বাটা আনে।
আম্মাজান নতুন এক খিলি
পান মুখে দেন। অল্প
লতিকা সময়ে চমন বাহার,
বাবা জর্দার সুঘ্রাণ
ছড়িয়ে পড়ে। তিনি আমার
পাশে এলেন। আরো পান
ঘ্রাণ পেলাম। ভেতরের ঘর
থেকে জবা থমথমে মুখে
আবার হেঁটে এলো। শরীরে
শৈথিল্য। বোঝা যাচ্ছে এ
সময় নাচ মহড়ার আদৌ তার
ইচ্ছা নাই। গান শুরু
হলো আবার খনখনে গলায়।
বিকালের আলো চোখ মুদে
আসছে ঘরের ভেতর।
জানালার ও পাশে বসে
থাকা অপেক্ষায়
সন্ধ্যার নিমফুল। জবা
আস্তে আস্তে গানের
শব্দের আসনে প্রবেশ
করতে শুরু করে। আমি
জবার ছন্দ দেখতে থাকি,
পায়ের কাজ..শরীর নাগরে
ডুবতে থাকি অনটনে। ধনেশ
কাকার ইশারায় ওদের
মাঝখান থেকে উঠে আসি,
কাকা আমাকে বাইরের
উঠানে নিয়ে আসেন।
দূরের ধান ক্ষেত এখন
ফাঁকা..মাসখানেক আগেই
পাকা ধান কাটা সারা।
নাড়া পোড়ানো হচ্ছে।
একটা পেঁচানো ধোঁয়া
মিশে যাচ্ছে আকাশের
নীলে। পোড়া আগুনে বিকাল
জাগা ছেলের দল আলু
পোড়াচ্ছে। আলু পোড়ানোর
সুবাস আসছে উত্তুরে
বাতাসের যাত্রা পালায়।
আমার খিদা লাগতেছে।
কাকা পাতার বিড়ি ধরায়।
কী টান! চিমনির মতো
ধোঁয়া ছাড়ে।
ধান ক্ষেতের পাশেই
গোরস্তান। গোরস্তানের
দেওয়াল শ্যাওলা
পড়া..মেরামত নাই..কয়েক
পাশ ভেঙ্গে হা হয়ে আছে।
ভাঙ্গা এক জায়গায় টিনের
সাইনবোর্ড :
এখানে গরু ছাগল ও
মহিলাদের প্রবেশ
নিষেধ
*
ময়লা বিবর্ণ স্যান্ডেল
পায়ে ধুলো মাখা ফেরিঅলা
ফিরছে সন্ধ্যার ছবির
মতো। তাকিয়ে দেখছি
লোকটা আবার কালকের দিনে
নবীন হবে। এই ফেরিঅলা
যেখানে যাক সঙ্গে থাকে
অভাব। সন্ধ্যায় আমার
বাড়ছে বৈরাগ্য। ভিতর
থেকে আর ঝুমুরের শব্দ
আসছে না। থেমে আছে এই
গোরস্থানের মতো। ধনেশ
কাকা কথা বলছে না আর।
কোথায় যেন তাকিয়ে আছে।
হয়তো তাকিয়ে নেই কোথাও।
চোখে চাবি মাইরা ছাইড়া
দিছে নিজেরে। আবার
নিজের ভিতর কাকা নিজেরে
লুকাইছে।
আমি ডাক দিলাম: কাকা
কাকা জবাব দিলো না।
খিদার দাপটে উঠে
দাঁড়ালাম। ফেরিঅলা
আমাদের কাছে এসে একটু
থামল। কাঁধ থেকে ঝাঁকা
নামাল। আমারে বলল;
বাবারে এক বাটি পানি
দিবেন?
ভিতর থেকে কাঁসার এক বড়
বাটিতে পানি এনে দিলাম।
লোকটা শব্দ করে পানির
বাটিতে চুমুক দেয়।
তৃষ্ণার ভাদ্র মাসের
জমি। তিনি পানি খেতেই
আছেন। আহারে। উঠানের
পাশের খুঁটিতে হেলান
দিয়ে বসে সে। গামছা
দিয়ে চোখ মুছল। আমাকে
বলল; বাবাজী একটা গান
করবাইন?
হেসে বললাম; গান তো ন
জানি।
: কিতা্ কইন..আফনারা যদি
গান না জানেন..কেম্বে
চলব?
আমি সন্ধ্যার লগনে
লজ্জ্বা মেখে গান ধরলাম
বেসুরো গলায়। আমার গান
শেষ হলে ফেরিঅলা হাঁটু
ধরে আল্লাহ আল্লাহ বলে
উঠে দাঁড়ায়। তাকে বাড়ি
ফিরতে হবে বুঝতে পারি।
*
উঠানে বাঁশের দুটো
খুঁটি লাগানো, তাতে
দলের মেয়েদের শাড়ি কাপড়
শুকাতে দেয়া। দিনের আলো
আর নাই..অলস সন্ধ্যা।
এখনো কাপড় তুলছে না
ওরা। জবা কোমল পায়ে
হেঁটে আসছে দেখছি। কাকা
বিড়িটা শেষ করে ধীরে
ধীরে উঠে দাঁড়াল। চেয়ার
থেকে তার উঠতে সময়
লাগে। হাঁটু ধরে
খানিকটা কঁকিয়ে ওঠেন।
জবা কাকাকে দেখে হাসে
না। কাকাও জবাকে দেখে
ওর দিকে না তাকিয়ে
পায়ের স্যান্ডেল ঘষতে
ঘষতে উঠান ছাড়েন। জবা
খালি চেয়ারটায় বসে।
আমাকে ইশারায় ডাকেন,
আমি এ সময়টার জন্য হা
করে থাকি। প্রায় দৌড়ে
নায়িকার কাছে চলে যাই।
তিনি আমাকে মায়া করেন।
এটা ওটা ফাই ফরমাস
খাটি। একবার দোকান থেকে
বডিজ কিনে দিয়েছিলাম
জবা ম্যাডামের জন্য।
সেদিন বুঝেছিলাম
ম্যাডাম আমাকে পাত্তা
দেন। আমাদের কথোপকথন
শুরু হয়;
: হের ফরে বাইনা কই,
কইতারোছ?
: শুনছিলাম চুনারুঘাট
: মনে হয় আর বায়না নাই
: রাতের বেলা মোটর
সাইকেলে এক ছেমড়া আহে,
অধিকারীর সাথে কী জানি
ফুসুরফাসুর করে..চিনস?
: না, চিনব কেমতে?
: লুকটারে সুবিদার মনো
অইতাছে না। আমার কিছতা
অইলে তুই আমারে
বাঁচাইতে না?
বুকের মইদ্যে কই মাছ
ঘাই মাইরা ওঠে। জবা
ম্যাডামের জন্য জান দিব
সিদ্ধান্ত নিলাম।
রাতের বেলা আজ আসুক
মোটর সাইকেল। আগুন
ধরায়ে দিব। ধনেশ কাকার
পকেট থেকে ম্যাচ বাক্স
নিতে হবে।
: হুন লুকজন অহন আর
যাত্রা দ্যাহে না।
সিনেমাত লামবাম।
অদিকারী কইছে সিনেমাত
হে্ইলার নাহি কুন
ডাইরেক্টরের লগে হেবি
কাতির। নাইকা ফফিরে ত
হেই ডাইরেক্টরঅই
ফিলিমো আইনছে। তর কি
মনে অয়? আমি দেকতে
সুন্দর না? নাইছ জানি
গান জানি। ইট্টু মুডা
আমি তয় আমরার দ্যাশো
মুডা নাইকার ডিমান্ড
বেশি।
জবা ম্যাডামের মুখে
সাঁঝ বাতির কাঁপা কাঁপা
আলো নামে ভয়ের কাঁচা
হলুদে। ওনার মুখের দিকে
তাকিয়ে থাকি। অথচ কাজল
রেখা পালায় কী সাহসী
অভিনয়। জবা ম্যাডামকে
কী অসহায় লাগে আমার।
নিজেরও মেরুদণ্ড বেয়ে
একটা অজানা ভয় নামতে
থাকে। দল ভাইঙ্গা গেলে
আমার কি হবে? আমি কই যাব?
এই মানুষগুলানই আমার
সব। বাবা মা। জন্মের পর
এই মঞ্চ এই , রাতের এই শত
শত বাল্বের নিচে আমার
স্বপ্ন, জীবন। আমার ভাত
কাপড়। জবা ম্যাডাম অলস
উঠে যাচ্ছেন অনিশ্চিত
পায়ে পায়ে।
আমার ভয় করতে শুরু করে।
এশার আজান পড়ে।
গোরস্থানের ওখানে
ছমছমে আলো অন্ধকার।
ভাঙ্গা অংশ দিয়ে
শিয়ালের আনাগোনা, ছায়া
দেখা যায় না..উঠানের এক
পাশে চাটাই ঘেরা
রান্নার জায়গা। ডাল
বাগার দেবার একটা
হুমহুম ঘ্রাণ বাতাসে
ছড়িয়ে জানান দেয় একেকটা
দিন খিদা..একেকটা দিন
খাবার জন্য বাঁচা..
আমার শীত শীত করতে
লাগে। খালি চেয়ারটায় পা
তুলে বসি। দুই হাতে
নিজের হাঁটু মুড়ে থাকি।
নিজেকে ছোট করতে করতে
কুণ্ডলী পাকিয়ে ফেলি।
আমার কি জ্বর আসছে? আমি
কি মায়ের পেটে যাচ্ছি?
*
বৃষ্টি কি সৌদি আরব চলে
গেছে? কতদিন বৃষ্টির
দেখা নাই। সুতানালী
সাপের মতো কালো মেঘের
একটা আঁকাবাঁকা জমাট
দেখছিল আকাশে কিন্তু
এখন কোন খবর নাই।
বৃষ্টি হবে কেমনে,
দ্যাশে নদী নাই,
গাছপালা নাই। আকাল আর
আকাল। স্কুল ঘরের পাশে
একটা বড় কড়ই গাছ্।
গাছের গোড়ায় বসার ইচ্ছা
হইছিল কিন্তু গোড়ায় লাল
পিঁপড়া কালো পিঁপড়ার
মিছিল যেন। ছোটবেলায় এই
সব পিঁপড়াকে ওরা বলত
হিন্দু পিঁপড়া মুসলমান
পিঁপড়া।
এই গরমে কেউ তেমন পালা
শোনে না। শীতকাল হলো
যাত্রা পালার সময়। তবুও
চেয়ারম্যান সাহেবের
খাতির এই নিউ বাসন্তী
অপেরাকে আমন্ত্রণ
জানানো হয়েছে। তারপর
আবার এক হুজুর এলাকায়
ওয়াজ করে যাত্রা পালার
বিরুদ্ধে। সেই সুদিন
বুঝি আর নাই তবুও
স্বপ্ন দেখেন তিনি জেগে
জেগে।
সকাল এগারোর রোদে
ঝিমুনি অন্যরকম। রোদের
দিকে তাকালে একটা ঝাঁ
তাপ টের পাওয়া যায়।
দুপুর নামেনি আবার
সকালের নরমের চিহ্ন
নেই। কড়ই গাছের ছায়ায়
তিনি বসে আছেন কাঠের
পুরানো চেয়ারটায়।
সূর্যের সাথে সাথে
ছায়ার দিক পরিবর্তিত
হয়। তিনি চেয়ারটা নিয়ে
জায়গা পাল্টান। চেয়ার
নিয়ে ছায়ার সাথে এই
খেলা তিনি উপভোগ করছেন।
যদিও কষ্ট। বলাই এক
বাটি মুড়ি আর গুড়ের চা
দিয়ে গেছে এক ফাঁকে।
বাম হাতটা তার প্রায়
অচল তবু সামলে নেন
প্রায় সব এই এক ডান
হাতে। এরই মধ্যে এলাকার
বাচ্চা ছেলে মেয়ের দল
যাত্রার রিহার্সেল
দেখার জন্য ভিড় করেছে।
ভেবেছিলেন বলাইকে ডেকে
বলবেন ছেলেমেয়েদের ধমক
দিয়ে তাড়িয়ে দিতে।
বলাইয়ের ধমকে কাজ হবে
বলে মনে হয় না। আবার
মুহূর্তে তার মধ্যে এক
ধরনের বাৎসল্যবোধ তৈরি
হয়। থাকুক না ওরা।
দেখুক রাতের রঙচঙ মাখা
এই সব নায়ক নায়িকাদের।
এক মুঠো মুড়ি মুখে পুড়ে
চায়ে চুমুক দিলেন।
অমৃত। দাঁতের আর সেই
জোয়ানকি নাই। চিবানো
থামিয়ে কবরস্থানের
দিকে তাকালেন। তাছাড়া
মুড়ি চিবালে শব্দের
কারণে মনোযোগে চিন্তা
করা যায় না। যুত হয় না।
ডায়াবেটিসের প্রকোপ
তার বেশি। ঘন ঘন
পেশাবের বেগ পায়। এই
আলসেমির ডায়রিয়া তাকে
ছাড়ে না। চায়ের কাপে
আবার ঠোঁট ছুঁইয়ে চুমুক
করলেন শব্দ করে গুড়ের
চায়ে।
একটা প্রাচীন পাখি কি
উড়ে গেল পেছনে? স্বপ্ন
ডানা কি মেলে দিল অতীত
প্রাক দুপুরে?
একসময়ের বাঘা ছাত্র
দীপকদা তার নাম পাল্টে
রেখেছিল ধনেশ।